04-02-2021, 06:10 PM
(10-01-2021, 01:09 PM)Mr Fantastic Wrote:বাহঃ সুন্দর!!!
** মধুচন্দ্রিমা **
“বিয়ে তো জীবনে একবারই হয় !” এই বলে বড়ো অভিমান করে থাকে নতুন বউ। বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত বাঙালি ছেলের মতো এর বরটিও বিয়ের পর প্রথম নারীসঙ্গ পেয়েছে। জীবনে এই প্রথম নারীর নিবিড় সান্নিধ্য এমনিতেই তার মাথার সবটুকু ঘোলাটে করে রেখেছে। কিভাবে এই নিজস্ব রমণীটির কাছে নিজেকে বড় করে দেখানো যায় তার ফন্দি ফিকির মাথায় খেলছে সবসময়। কি বললে খুশি হবে মেয়েটি, কি করলে মুগ্ধ হয়ে যাবে, একবার ‘ইমপ্রেস’ করার জন্য বলে ফেলেছিল -- জানো, সামনের বছর একটা বাইক কিনবো ! নতুন বউ চমকে উঠে বলেছিল -- খবরদার না ! দু’চাকা হল শয়তানের চাকা, ভীষণ একসিডেন্ট হয় ওতে।
ছেলেটি খুশি হয় তাতে। কিন্তু কিন্তু বিয়ের এক মাসের মাথাতেই মেয়েটি জানায় -- সবাই হানিমুনে যায়, আমরা যাবো না?
শুনে ছেলেটা মনে মনে গুম হয়ে যায়। বিয়েতে সর্বদা বাজেট ছাড়িয়ে খরচ হয়, তারও হয়েছে। তাছাড়া ছুটি পাওনা নেই তেমন। ছেলেটা আবার একটু ঘরকুনোও বটে। জবাব দিল -- এসব ইংরেজিয়ানার কুফল। বিদেশী প্রথা। আমরা এসব মানবো না। বউ খুশি হয় না। অভিমান করে বলে -- বিয়ে তো জীবনে একবারই হয় ! সবাই যায়। বিদেশী প্রথা আবার কি? তুমি তো দিব্বি প্যান্ট শার্ট পরে অফিসে যাও, ধুতি পাঞ্জাবি পরো না কেন? এটা ইংরেজিয়ানা নয় বুঝি?
ছেলেটা সিগারেট ধরিয়ে বিষন্ন দৃষ্টিতে বউয়ের মুখ দেখে। তারপর বলে -- আচ্ছা দেখবো।
বউ আশান্বিত হয়ে বলে -- খুব দূর নয়, নির্জন জায়গায় যাবো কিন্ত। শুধু তুমি আর আমি।
-- পুরী?
-- আমার পাহাড় ভালো লাগে।
-- তবে দার্জিলিং?
-- হ্যাঁ। বউ হেসে গলা কাত করে দেয়।
বিয়ের পর থেকে মা একটু গম্ভীর। ছেলের সঙ্গে ভালো করে কথা কন না। তাকানোর মধ্যে কেমন যেন একটু উদাস অভিমান ভাব। খেতে বসেছে ছেলেটা, মা ভাত দিয়ে বলে -- রিমি বলছিল দাদা-বউদি হানিমুনে যাচ্ছে। তা কোথায় যাওয়া ঠিক করলি?
-- কোথায় আর যাবো? এখনো সেরকম কিছু ঠিক নেই। ছেলেটা একটু লজ্জা পেল যেন, সেটা ঢাকতে গোগ্রাসে খেতে থাকে।
-- আস্তে খা। মা একটু চুপ করে থেকে বলেন -- উনিই নতুন বউয়ের মাথা খাচ্ছেন। কেবল বলতে শুনি, যাও ঘুরে টুরে এসো। একটু নিরিবিলিতে থেকে এলে বাঁধনটা পোক্ত হয়। কই আমরা তো কখনো যাইনি, তা বলে আমাদের বাঁধন পলকা হয়েছে?
উনি হলেন ছেলের বাবা। প্রশ্রয় কিছুটা বেশিই দেন নতুন বৌকে। বলেন -- সংসারের চার্জ এখন থেকে তোমার হাতে বৌমা। বুঝেসুঝে নাও। মা তাতে খুশি হন না। আড়ালে বলেন, কেন, আমার কি গতরে শুঁয়োপোকা ধরেছে? সংসারের টানাপোড়েনগুলো ছেলেটা বিয়ের আগে বুঝতো না। এখন কিছু কিছু বুঝছে।
নতুন বউ একদিন রাতে বলল -- রিমি আজ কি বলেছে জানো, বলে দাদা নাকি বিয়ের আগে একটুও স্টাইল করতো না। আজকাল খুব পোশাকের দিকে নজর। আর বলে, বিয়েতে দাদার অনেক খরচ হয়েছে। এবার হানিমুন করতে গেলে সংসার নাকি ভেসে যাবে। কি হিংসুটে দেখো !
ছেলেটা উদাস ভাবে বলল -- ওর মনটা আসলে খুব ভালো।
-- ছাই ভালো। তোমার আমার বেশি ভাব পছন্দ করেনা। আমি দেখবো বিয়ের পর ও নিজে হানিমুনে যায় কিনা !
চিন্তায় ছেলেটার অনেক রাত অবধি ঘুম আসে না। পুজোর আর দেরি নেই। দার্জিলিঙের মরসুম পড়েই গেল। রিজার্ভেশনে এখন ভিড়, কতো লোক যে পুজোতে দার্জিলিং যাবে।
অনেক অনেক ধস্তাধস্তির পর দার্জিলিঙের দুটো রিজার্ভেশন পায়। বারোদিনের ছুটি নেয়। বাবার হাতে সেই মাসে বেশ কিছু টাকা কম দেয়। মায়ের মুখ গম্ভীর। বোন পেট পাতলা, সে বলেই দেয় -- ওসব মধুচন্দ্রিমা-টন্দ্রিমা বড়লোকদের ব্যাপার।
ছেলেটার মন খারাপ হয়। কিন্তু বউ খুশি, বাড়ির সবাই হিংসে করুক তাকে। হিংসে করে জ্বলুক।
পথে যা হওয়ার হলো। অনর্গল পয়সা বেরিয়ে যাচ্ছে। কুলি, খাবার, চা কতো কি। দার্জিলিং-এ যত সস্তায় থাকবে ভেবেছিলো, হলো না। সাধ্যের মধ্যে থাকা হোটেলগুলি সব ভর্তি। বহু কষ্টে একটা গেস্ট হাউস পাওয়া গেল। রোজের ভাড়া একটু বেশি, সুতরাং বউকে চুপিচুপি বলল -- পাঁচদিনের বেশি থাকা যাবে না, টাকা নেই। বড়ো মেঘলা দার্জিলিং। বৃষ্টি পড়ছে থেকে থেকে। চাঁদ-টাদ দেখাই যায় না, পাহাড় মুখ লুকিয়ে আছে জমাট কুয়াশায়। ছেলেটা বিছানায় শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে বলে, টাকাটাই জলে গেল।
বউ ঝামটা মেরে বলে --জলে আবার কি? আসা তো হলো। লোকে বলতে পারবে না যে ওরা হানিমুনে যায়নি।
ছেলেটা বউয়ের দিকে অর্থপূর্ণ ভাবে তাকিয়ে বলে -- ও আচ্ছা, লোক দেখানোর জন্য আমরা হানিমুন আসবো ঠিক করেছিলাম?
--ধ্যাত !
ছেলেটা হাত বাড়িয়ে বউকে কাছে টেনে নিল। বিয়ের পর এই প্রথম ওরা বাড়ির বাইরে নির্জনে একে অপরকে নিজের মতো করে পেয়েছে। ডুবে যায় দুজনে সুখ সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে।
দুদিন পর রোদ উঠলো। খুব বেড়ালো দুজনে সেদিন। বউ এটা সেটা নানা রকম জিনিস কিনতে চায়, বরের জন্য ভুটিয়া সোয়েটার, ননদের জন্য পাথরের মালা, মায়ের জন্য শাল। ছেলেটা সবরকম কেনাকাটায় বাধা দিতে থাকে, কেবল বলে- উঁহু, বাজেটে কুলোবে না। পরদিন গাড়ি ভাড়া করে টাইগার হিল, ঘুম, মনাস্ট্রি, সিঞ্চল লেক দেখলো। এক স্বর্গীয় আনন্দের জলে যেন মুখ ধুয়েছে বউ, এমন উজ্জ্বল দেখাল তার মুখ। ছেলেটা নিসর্গ দেখে যতটা না আনন্দ পেল, তার থেকেও দ্বিগুন খুশি হলো বউয়ের হাসিমাখা ঝলমলে মুখ দেখে -- হোক না টাকা খরচ, আহা ও তো খুশি হয়েছে !
ফেরার সময় হাওড়া স্টেশনেই টাকা শেষ। ট্যাক্সি করে বাড়ি এসে ভাড়া মেটাল। বাড়িঘর কেমন জীর্ণ মনে হচ্ছে ছেলেটির। মা-বাবাকে কি আরেকটু বুড়ো দেখাচ্ছে? রিমিরও মুখটা বসে গেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলো ছেলেটি, ওরা ফিরে আসায় বাড়ির সবাই খুশিতে ছুটে এসে ধরলো তাদের।
-- ও বৌমা, কেমন ঘুরলে? ভালো ছিলে তো সব? কি রকম বাজারদর ওখানে? বাহ্ বউদি এই মালাটা আমার জন্য এনেছো? ভীষণ সুন্দর তো ! বউ নিজের নাম করে অনেকগুলো জিনিস কিনেছিলো। কিন্তু ছেলেটি অবাক হয়ে দেখলো সে সব জিনিস অকৃপণভাবে বাড়ির সবাইকে বিলিয়ে দিচ্ছে বউ। সে রাতে যখন চাঁদ উঠলো তখন ছেলেটি খোলা জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে তাকিয়ে ভাবলো, বাহঃ ভারী মিষ্টি চাঁদ উঠেছে তো আজ !
( সমাপ্ত )