23-01-2021, 09:46 PM
নিশিকান্ত তার অফিসে ক্যাশিয়ার রজনী চক্রবর্তীর অ্যাসিসট্যান্ট। সকালবেলা রজনী চক্রবর্তী হাতে লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেন। কোন কোন পার্টির কাছে টাকা পাওনা, তার লিস্ট। সঙ্গে বিল, ক্যাশবুক। ক্যান্টিনে হাফ গ্লাস জল, এক কাপ তিতকুটে চা খেয়ে লিস্ট হাতে বেরিয়ে পড়ে নিশিকান্ত। লিস্টে তিনটি ভাগ। প্রথম ভাগে যারা সে দিন পাওনা টাকা দেবে, তাদের নাম। দ্বিতীয় ভাগে থাকে যারা কবে টাকা দেবে শুধু সেটুকু। আর তিন নম্বর ভাগে তাদের নাম যারা টাকা দেবে না, আবার কবে দেবে সে কথাও জানাবে না। শুধু বসিয়ে রাখবে।
(সমাপ্ত)
তার পর এক সময় খবর পাঠাবে, আজ দেখা হবে না, চলে যান। ঘটনা অপমানের। নিশিকান্ত অবশ্য অপমান নিজের মতো করে গুছিয়ে নিয়েছে। কোথাও চুপ করে বসে থাকে। কোথাও দেয়ালে পিঠ রেখে ঘুমিয়ে পড়ে।
সব থেকে ভাল জায়গা ‘ঘোষ অ্যান্ড সন্স’-এর অফিস। রিসেপশনের মেয়েটি কোনও এক রহস্যময় কারণে তাকে পছন্দ করে। পছন্দ না হয়ে মায়াও হতে পারে। খাটাখাটনি দেখে মায়া। বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার নাতিদীর্ঘ স্বাস্থ্যবতী মেয়ে। নাম মিলি। বয়স তেইশ চব্বিশের বেশি না। মিলি নিশিকান্তের মাথার ওপর ফ্যান চালিয়ে দেয়, চা দিতে বলে। টুকটাক কথাও হয়। গায়ের রং চাপা হলে কী হবে, মিলিকে দেখতে মিষ্টি। মেয়েরা হাসলে সুন্দর দেখায়। কিন্তু নিশি খেয়াল করে দেখেছে, গম্ভীর হলে মিলিকে বেশি সুন্দর লাগে।
লিস্টে টিক দিয়ে অফিসে ফেরে নিশিকান্ত। রজনী চক্রবর্তী টিক মিলিয়ে হিসেব দেখেন। খোদ মালিকের লোক। কথায় কথায় বলেন, এখানে কম্পিউটারের বালাই নেই। খাতা-কলমের সিস্টেম। টাকা জমা দেওয়ার আগে দু’বার যোগ-বিয়োগ করে নিতে হয়। এক বার ক্যালকুলেটরে, এক বার আঙুলে কর গুনে। সতর্ক থাকার আসল কারণ, মুখে কড়া হলেও রজনী চক্রবর্তী নিজে প্রায়ই হিসেবে গোলমাল করে ফেলেন। নয়কে ছয় লেখেন। শেষে শূন্য বসাতে ভুলে যান। বয়স হয়েছে। নিশিকান্ত ঠিক করে দেয়। রজনী চক্রবর্তী ভুল ঠিক করে নিতে নিতে ধমক দেন, ‘গাধা কোথাকারে। আমার ভুল ধরে। চশমার পাওয়ারে যে গোলমাল সেটা বোঝে না। তোমার ভুল যে দিন পাব, একেবারে দূর করে দেব।’
অতঃপর ভুল হয়েছে। বড় ভুল হয়েছে নিশিকান্তের।
দু’দিন আগে বিকেলে কাজ সেরে অফিসে ফিরে দেখে, সাড়ে সতেরো হাজার টাকার হিসেব মিলছে না। যে ব্যাগে টাকা, চেক, ক্যাশবুক থাকে, সেখানে সবই আছে, নেই শুধু প্লাস্টিকে মোড়া সাড়ে সতেরো হাজারের একটি বান্ডিল। সে দিনই এক পার্টি পেমেন্ট দিয়েছিল। টাকা নিয়ে সাবধানেই ছিল নিশি। লিস্টের এক নম্বর, দু’নম্বর পর্যায় শেষ করে, ‘শুধু অপেক্ষা করে চলে আসা’র পর্যায়ে ঢুকেছিল বিকেলে। তিন জায়গায় ঢুঁ মেরেছে। এক জায়গায় অফিসের বাইরে পায়চারি করেছে, এক জায়গায় হালকা ঝিমিয়েছে। মিলির অফিসে ব্যাগ থেকে কাগজ-টাগজ বের করে কাজকর্ম ঝালিয়েও নিয়েছে। মিলি রিসেপশনের টেবিলে কাগজ ছড়িয়ে কাজ করলে কিছু বলে না। অফিসে ফিরে টাকা, চেক, বিল সব রজনী চক্রবর্তীর কাছে জমা রেখে বাথরুমে যায় নিশিকান্ত। চোখেমুখে জল দিয়ে আসে। ঠান্ডা মাথায় হিসেব নিয়ে বসে, আর তখনই জানা যায়, টাকার বান্ডিল ভ্যানিশ। রজনী চক্রবর্তী চাপা হুংকার দিয়ে ওঠেন।
এই দু’দিনে অফিসে সবাই জেনে গেছে। ‘গাধা পাকড়াশি’ টাকা সরিয়েছে। কেউ বলছে, ‘এত দিনে মানুষ হল।’ কেউ বলছে, ‘মিটমিটে শয়তান’। কেউ বলছে, ‘এখন শুনছি গাধাটার বাবাও এমন ছিল। ঘুষ নিয়ে ফেঁসেছিল।’ কোম্পানির মালিক নিশিকান্তকে ডেকে পাঠালেন।
--‘এক সপ্তাহ সময়। টাকা ফেরত না দিলে থানায় কমপ্লেন হবে। থানা কী জিনিস জানো তো? ওখানে গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা হয়। এই যে থম মেরে দাঁড়িয়ে আছ, পুলিশের ডান্ডা খাওয়ার পর দেখবে ছুটছ। যাও, আপাতত সাসপেন্ড। অফিসে আসবে না।’
তিন দিন হল নিশিকান্ত নিজের ঘরে বন্দি। ভাড়াবাড়ির এক কামরার ঘর। অনেক ভেবেও কূলকিনারা পায়নি। টাকা কোথায় গেল? টেনশন হচ্ছে। পুলিশের মার তো আসছেই, তার আগে মানসম্মান সবই গেল। মিলিও নিশ্চয়ই খবর পাবে। সব থেকে বড় সমস্যা, কাজটা গেল। বাড়িতে অসুস্থ মা, গুন্ডার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এবং বছর ঘুরতে না ঘুরতে আবার ফিরে আসা বোন। তাদের কে খাওয়াবে? শুধু একটাই ভাল লাগা। বাবার সঙ্গে একটা মিল হল। বাবা সাসপেন্ড, ছেলেও সাসপেন্ড। যাঃ, বাবাকে এই মজার কথাটা বলা হল না। মনে মনে হাসল নিশি। পাশ ফিরে শুল। কালই আত্মহত্যার কাজটা সেরে নিতে হবে।
সকালবেলা দরজায় ধাক্কা। ধড়ফড় করে উঠে বসল নিশিকান্ত। কে? নিশ্চয়ই পুলিশ। দরজা খুলে নিশি থ। মিলি! মিলি কেন? সে কী করে এ বাড়ির ঠিকানা জানল?
মিলি ঘরে ঢুকে গম্ভীর গলায় বলল, ‘এত দিন দেখিনি কেন ? কী হয়েছে ? শরীর খারাপ ?’
নিশিকান্তর কী যেন হল! মিলিকে খাটে বসিয়ে, চা বানিয়ে কাপ হাতে দিয়ে হড়বড়িয়ে সব ঘটনা বলে ফেলল। বলে লজ্জাও পেল খুব। লোকে কি তাকে এমনি ‘গাধা’ বলে ? একটা প্রায় অচেনা মেয়েকে এত কথা বলার মানে কী ? মিলি পুরো ঘটনা আরও দু’বার শুনল। তার পর বলল, ‘আমি আগেই সব খবর পেয়েছি। আপনার অফিস থেকে অন্য লোক এসেছিল, তার কাছে। শুনেই খটকা হল। এখন আপনার কাছে ঘটনা জেনে বুঝতে পারছি, ওই রজনী চক্রবর্তীই টাকা সরিয়েছে। আপনি যখন বাথরুমে গিয়েছিলেন, তখনই করেছে। ওর বাড়ির ঠিকানা জানেন?’
নিশিকান্ত ভয়ে কুঁকড়ে যায়। মেয়েটা বলছে কী! মাথা খারাপ হল না কি ?
মিলি তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। তার চোখমুখ রাগে থমথম করছে। বলল, ‘চলুন। ঠিকানা খুঁজে নেব। এই সব লোককে কী ভাবে শায়েস্তা করতে হয়, মিলি সেনের খুব ভাল জানা আছে। ঘাড় ধরে টাকা আদায় করব। মনে রাখবেন, আমার দাদু দারোগা ছিলেন।
নিশিকান্ত মিনমিন করে বলল, ‘মিলি... মিলি... এক বার শুনুন...’
মিলি এ বার ধমক দিল এবং সম্বোধন বদল করল। বলল, ‘চুপ করো। আমার সঙ্গে তোমাকে যেতে বলছি না ?’
রজনী চক্রবর্তীর কাছ থেকে সব টাকা পাওয়া গেল না। কিছু খরচ করে ফেলেছেন।
হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ের তেজ দেখে যে পোড় খাওয়া রজনী চক্রবর্তী ওমন ঘাবড়ে যাবেন, নিশিকান্ত ভাবতেও পারেনি, নিজেও সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
একদিন নিশিকান্তের বিয়ে হল। মিলিকে বিয়ে করেছে। ফুলশয্যার রাতে মিলিকে বলল, ‘ভাগ্যিস আত্মহত্যা করিনি! তা হলে বিয়েটাই করা হত না!’
মিলি বরের কানে ফিসফিস করে গাঢ় স্বরে বলল, ‘আমার গাধা পাকড়াশি!’ (সমাপ্ত)