23-01-2021, 09:43 PM
** গাধার গপ্পো **
নিশিকান্ত পাকড়াশিকে অনেকে ডাকে ‘গাধা পাকড়াশি’। এর কারণ সে এক জন সৎ মানুষ। ছোটবেলা থেকেই তার এই স্বভাব। বড় হয়েও এক কাণ্ড! নগদ টাকা নিয়ে কাজ কারবার, কিন্তু হিসেব ঠিক রাখে। সম্ভবত এই কারণেও তাকে ‘গাধা’ ডাকা হয়। সৎ মানুষকে ‘গাধা’ ডাকা হবে কেন? গাধারা কি সৎ হয়? পশুবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন কি না, কারও জানা নেই। তবে ভবিষ্যতে যদি এমন কোনও গবেষণা হয়, তা হলে নিশিকান্ত পাকড়াশির এই গল্প কাজে লাগতে পারে। গল্পটা এ রকম—
অনেক ভাবনাচিন্তার পর নিশিকান্ত সিদ্ধান্ত নিল, সে আত্মহত্যাই করবে।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বালিশের তলা হাতড়ে হাতঘড়ি বের করে চোখের সামনে ধরল নিশি। জানলা থেকে আসা ল্যাম্পপোস্টের ফ্যাকাসে আলোয় সময় দেখল। রাত দেড়টা। তার ভুরু সামান্য কুঁচকোল। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য রাত দেড়টা কি শুভক্ষণ? মা বলতেন, 'বাবা নিশি, বড় কাজ করার আগে সময় বিচার করবি। বড় কাজের জন্য আলাদা সময় থাকে। সেই সময় জানতে হয়।’
আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত অবশ্যই একটা ‘বড় কাজ’। সেই কাজ শুভক্ষণে করা গেল কি না কে জানে। তবে সিদ্ধান্ত নিতে বাবাও খানিকটা সাহায্য করেছে। শুয়ে শুয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলেছিল নিশিকান্ত। মনে মনে কথা। মনে মনে কথা কেউ শুনতে পায় না, বাঁচোয়া। নইলে লজ্জার ব্যাপার হত। কেউ শুনলে ভাবত, পাশাপাশি শুয়ে পিতা পুত্র কথা বলছে। আসল ঘটনা তা না। বাবা সাড়ে চার বছর আগে মারা গিয়েছেন।
--‘বাবা, আমি তো বিরাট সমস্যায় পড়েছি। সমস্যা থেকে বেরোতে গিয়ে সব জট পাকিয়েও ফেলছি।’
বাবা বললেন, ‘নিশি, সমস্যার পিছনে কি রহস্য আছে?’
গণেশ বলল, ‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
বাবা বললেন, ‘অনেকটা আমার মতো কেস। অবশ্য এমনটা হওয়ারই কথা। উত্তরাধিকার বলে একটা ব্যাপার আছে না?’
নিশিকান্ত বলল, ‘এখন ও সব জ্ঞানের কথা ছাড়ো। সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনও উপায় আছে কি না বলো।’
বাবা হেসে বললেন, ‘সমস্যা নিয়ে নাজেহাল হয়ে পড়েছিস নিশি! তুই কি আমার ছেলে? আমার হাল মনে নেই তোর? একে ওই কাণ্ড, তার ওপর ঘাড়ে অত বড় সংসার, তোর মায়ের অসুখ, তোর পরীক্ষা, পাড়ার গুন্ডা বিয়ে না করলে রিম্পাকে অ্যাসিড মারবে বলে হুমকি দিয়েছে। পুলিশ ডায়রি নিচ্ছে না। কী ভয়ংকর সে-সব দিন গেছে! ভুলে গেলি?’
নিশিকান্ত বলল, ‘উফ, আবার পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে শুরু করলে।’
বাবা একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, পজিশন কি সত্যি খুব ঢিলা হয়ে পড়েছে?’
নিশিকান্ত বলল, ‘তবে আর বলছি কী? নিজের ওপর কোনও জোর নেই। সে দিন তো পথে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার জোগাড়। একটা চায়ের দোকানে বসে জলটল খেয়ে সামলালাম। দরজায় ঠকঠক শুনলেই ভাবি পুলিশ এসেছে।’
বাবা বললেন, ‘তা হলে এক কাজ কর, যখন সমাধান কিছু পাচ্ছিস না, এক্সট্রিম পথ বেছে নে। এত দুশ্চিন্তা ভাল না। শরীর খারাপ হয়। প্রেশার, সুগার বাড়ে। এক্সট্রিম কিছু করে ফেললে সব টেনশন থেকে মুক্তি। মনে রাখবি, মুক্তিই আসল। বড় বড় মনীষীরাও তা-ই করেছেন। মুক্তির পথ খুঁজেছেন। কলেজে ওনাদের জীবনী পড়িসনি?’
নিশিকান্ত বলল, ‘চূড়ান্ত পথটা কী বাবা?’
বাবা ফের মৃদু হাসলেন। খুকখুক কাশলেনও যেন। ‘পথ কী, তুমি নিজেই ঠিক করো। ঠান্ডা মাথায় ভাবলে পথ ঠিক পাওয়া যাবে।’
বাবার সঙ্গে কথা শেষ করার কিছু ক্ষণের মধ্যেই নিশি ‘মুক্তির পথ’ খুঁজে পায়। আত্মহত্যা। একমাত্র উপায়। সব টেনশনের অবসান। তখন দরজায় পুলিশ কড়া নাড়লেই বা কী, পথে মাথা ঘুরলেই বা কী? সব সমান। সব মায়া। নিশির নিশ্চিন্ত লাগে। নিজের ওপর হালকা রাগও হয়। এমন সহজ একটা পথ খুঁজে বের করতে এত সময় লাগল! ছিঃ। সত্যি সে বোকা।
নিশিকান্ত পাকড়াশি শুনলে মনে হয়, বয়স্ক মানুষ। আসলে নিশির বয়স মাত্র তিরিশ। বড়বাজারে ছোটখাটো একটা প্রাইভেট অফিসে চাকরি করে। কাজ ঝামেলার এবং অপমানের। কিন্তু ও নিয়ে ভাবলে চলে না। বাবার মৃত্যুর পর ছোট মফস্সল শহর থেকে কলকাতায় চলে আসতে হয়েছিল। কাজ চাই। নিশির বাড়িতে বাবা-ই ছিলেন একমাত্র রোজগেরে মেম্বার। বিডিও অফিসে সামান্য করণিক পদে কাজ করতেন। জীবনের শেষ তিনটে বছর ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে চাকরি থেকে সাসপেন্ড হয়ে ছিলেন। বন্যার সময় ত্রিপল কেনায় ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ। সাসপেন্ড অবস্থাতেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে মৃত্যু হয় মানুষটার। রেখে যান দেড় কামরার একটি বাড়ি, কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী স্ত্রী, পাড়ার গুন্ডার ভয়ে কলেজ বন্ধ করে দেওয়া অষ্টাদশী কন্যা এবং কোনও ক্রমে কলেজ পাশ করা যুবক পুত্র নিশিকান্তকে। নিশির তখন কাজ খোঁজা ছাড়া উপায় কী? কলকাতায় দূর সম্পর্কের মামা এই অফিসে ঢুকিয়ে দিলেন।
বাবার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। কঠোর তদন্ত কমিটি। কমিটি মেম্বাররা প্রথম বার বসেই অতি তৎপরতার সঙ্গে সাসপেনশনের হুকুম দিলেন। তার পর শুরু হল মূল তদন্ত। মূল তদন্তে অনেক হ্যাপা। দোষ প্রমাণ করতে হয়। তার পর বিচার। সব শেষে শাস্তি। দোষ প্রমাণ জটিল বিষয়। সাক্ষী লাগে, প্রমাণ। তদন্ত কমিটির মেম্বারদের সাবধানে চলতে হয়। কান টানতে মাথা না এসে পড়ে। দলাদলিও আছে। হুটপাট কিছু করা ঠিক না। এর মধ্যে আবার নিশির বাবা কমিটির কাছে চিঠি লিখলেন। যে দিন অফিসে বসে ঘুষ নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, সে দিন তিনি অফিসেই আসেননি। বন্যার জল ঘেঁটে জ্বরে কাবু হয়ে বাড়িতে কুঁইকুঁই করছিলেন। সুতরাং তাঁর সাসপেনশন প্রত্যাহার করা হোক। আবেদনের সঙ্গে স্থানীয় বিশিষ্ট হাতুড়ে চিকিৎসক উমাপদ মান্নার সার্টিফিকেট। এতে অবস্থা জটিল হল। কোনটা সত্য? অভিযোগ না আবেদন? মাসের পর মাস, বছর কেটে যেতে লাগল। তদন্ত আর এগোয় না। কমিটি মিটিঙেই বসে না। মেম্বাররা বদলি হয়ে যান, রিটায়ার করেন, কেউ চাকরি ছেড়েও দেন। এক জন তো মারাও গেলেন। এ দিকে সংসারে টাকাপয়সার অবস্থা ভয়ংকর। সংসার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। মানুষটা অফিসে অফিসে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। তদন্তে যদি গতি আসে। কোথায় গতি!
বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ার পর নিশিকান্তও ক’দিন কলেজ কামাই করে ছোটাছুটি করেছে। অফিসারদের ধরাধরি করেছে। কাঁচুমাচু মুখে বলত, ‘স্যর, কিছু কি করা যায় না?’
অফিসার মুখ দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করে বলত, ‘কী করি বলো তো ভাইটি? আমাদের হাত-পা বাঁধা। তোমার বাবার কেস তো বিচ্ছিরি ভাবে ঝুলে আছে দেখছি। ফাইল আছে, কিন্তু মানুষ নেই। কমিটি আছে কিন্তু মেম্বার নেই।’
নিশি বলে, ‘তা হলে স্যর, তদন্ত কমিটির ফাইলটাই তুলে দিন না!’
অফিসার দার্শনিক ধরনের মুখ করে বলেন, ‘ওটি হওয়ার নয় ভাইটি। সরকারের ঘরে সব তোলা যায়, ফাইল তোলা যায় না।