20-01-2021, 08:25 PM
(This post was last modified: 20-01-2021, 08:32 PM by Mr Fantastic. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
** হঠাৎ একদিন সিঁড়িতে **
তুমি কেমন আছো ?
--ভালো আছি।
উত্তরটা দেওয়ার সময় পারমিতা মাথাটা সামান্য ঝুঁকিয়েছিল সামনে, ঠোঁটে লেগে ছিল পাতলা কুয়াশার মতো হাসি। দশবছর পর আজ দেখা হল পারমিতার সঙ্গে একটা নেমন্তন্ন বাড়িতে। শুনেছি ওর স্বামী তার স্ত্রী অন্য কারোর সঙ্গে মেলামেশা করুক পছন্দ করেন না। পারমিতার স্বামী বড়ো ব্যবসায়ী একজন, নিজে তিনি কতক্ষণ স্ত্রীর সাথে মেলামেশার সুযোগ পান জানি না।
আমি উঠছিলাম, সিঁড়ি দিয়ে নামছিল পারমিতা, এক মুহূর্তের জন্য চোখাচোখি হতেই দুজনের স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ একে অন্যের উপর। আমার বুক কাঁপছিল। তেত্রিশ বছর বয়সেও আমার বুক কাঁপে। তবে গত দশ বছরে কাঁপে নি। একটু আগে সিঁড়ির নিচে আমি পঞ্চাশজনের সাথে পঞ্চাশ রকম ভাবে হেসে ও কণ্ঠস্বর বদলে কথা বলেছি। এখন পারমিতার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আমার গলা শুকিয়ে এলো। এরকম মুহূর্তে সবাই নিজের হৃদস্পন্দনের শব্দ শুনতে পায়।
-- তুমি কেমন আছো ?
-- ভালো আছি।
পারমিতার স্বামী সিঁড়ির দু-তিন ধাপ নিচে নেমে গেছেন। পারমিতা আর দাঁড়ালো না, নেমে গেল ধীর পায়ে। আমি ওপরে উঠে এলাম। উঠছি তো উঠছি, সিঁড়ির কি আর শেষ নেই ?
একটু বাদে খেয়াল হল, আমি তো সিঁড়ির সেই ধাপেই আছি। একবার মনে হল সমস্ত সিঁড়িটা ফাকা, খাঁ খাঁ করছে। চারদিক অন্ধকার, আমি সেখানে একা। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, নেমন্তন্ন বাড়ির ভিড়ের মধ্যে অনবরত নারীপুরুষ আমাকে ঠেলে ঠেলে উঠছে নামছে। শুনতে পাচ্ছি পুরুষদের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা, মেয়েদের চপল হাসির শব্দ। পারমিতা নেই।
দশ বছর বাদে মাত্র দুটি শব্দ, ভালো আছি –এর মানে কি ? পারমিতার ঠোঁটে ওই বিষণ্ণ মাখা পাতলা কুয়াশার মতো হাসি লেগেছিল কেন ?
এর মানে না জানতে পারলে সারা জীবনে কি আর আমি কোনো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবো ?
দুদ্দাড় করে লোকজনের ভিড় ভেদ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। পারমিতা কোথায় ? নেই তো কোথাও! এতো বছর পর মাত্র ওই দুটি শব্দ, কিন্তু এর মধ্যে অনেক কথা লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই। আমাকে জানতে হবে। ও তো জিজ্ঞেস করলো না যে, আমি কেমন আছি ?
একজন চেনা লোক দেখে জিজ্ঞেস করলাম, অমুক ব্যক্তি আর তার স্ত্রীকে দেখেছেন ?
--এইমাত্র তো বেরিয়ে গেল, বাইরে লাল গাড়ি…।
লাল গাড়ি, লাল গাড়ি কোথায় তুমি ? সদ্য স্টার্ট নিয়েছে, জানলার কাছে পারমিতার মুখ। দাঁড়াও একটু দাঁড়াও! গাড়ি দাঁড়ালো না। আমি ছুটতে লাগলাম, এই বয়সেও অন্তত একবার চক্ষুলজ্জাহীন হয়ে ছুটতে দ্বিধা লাগে না আজ।
লাল গাড়ি মিশে গেল রাতের শহরের অসংখ্য কালো গাড়ির মধ্যে। বৃষ্টি নামলো। কতো রাস্তায় ঘুরেছি হন্যে হয়ে আমি জানি না, নিঃশব্দে চিৎকার করলাম বহুবার, - পারমিতা, তুমি জিজ্ঞেস করলে না, আমি কেমন আছি ?
হঠাৎ নিসঙ্গতা ভঙ্গ করে বেজে উঠলো কোনো এক গির্জার ঘণ্টা। সেই শব্দ যেন শহরের সমস্ত কোলাহল ঢেকে দিল। পরক্ষনেই আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম, গির্জার সেই মন খারাপ করা ধ্বনির মধ্যে পারমিতার গলা – আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই, আমি ভালো নেই…
( সমাপ্ত )