16-01-2021, 07:43 PM
(This post was last modified: 16-01-2021, 07:55 PM by Mr Fantastic. Edited 5 times in total. Edited 5 times in total.)
** অসুখের ওপারে স্বাধীনতা **
ডালহৌসি স্কোয়ারে বাস থেকে নেমে সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছি, হঠাৎ মনে হল পৃথিবীতে কোথাও কিছু গন্ডগোল হয়েছে। কিসের একটা শোরগোল শুনতে পেলাম। দূরে তাকিয়ে দেখলাম দূরে একটা মিছিল ক্রমশ এগিয়ে আসছে। এখান থেকে কি একশো চুয়াল্লিশ ধারা উঠে গেছে, না মনে হয়। এখন তো সারা বছরই থাকে। অবিলম্বে পুলিশ এসে মিছিল অবরুদ্ধ করল। উত্তেজনা ও গোলমাল আরো বাড়ল। তারপরেই একপ্রকার খণ্ডযুদ্ধ। লোকজন ছুটোছুটি করছে চারদিকে। ধাবমান লোকগুলোর কোনো নির্দিষ্ট দিক নেই।
আমি গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে প্রাক্তন রিজার্ভ ব্যাংকের গাড়িবারান্দার নিচে এসে দাঁড়ালাম। কলেজজীবন থেকেই বইপাড়ায় পুলিশের লাঠিচার্জ আর টিয়ার গ্যাস চালানো এতো দেখেছি যে এইসব গন্ডগোলের চরিত্র বুঝতে আমার ভুল হয়না।
এই ঝামেলার ফলে লেগে গেল একটা বিশ্রী ট্রাফিক জ্যাম। এর ওপর আবার হঠাৎ আরম্ভ হয়ে গেল তুমুল বৃষ্টি। বর্ষার তেজি বৃষ্টি অন্য কিছু সহ্য করে না। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মিছিল, লোকজনের ছুটোছুটি, পুলিশ সব উবে গিয়ে রাস্তা শান্ত হয়ে গেল। বৃষ্টিরই প্রবল দাপট দেখা গেল। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটতে লাগলাম। বেশিদূর নয়, আমার যাবার কথা কাছেই। শিখা ওখানেই আসবে, ঠিক সাড়ে চারটের সময়। আমার মাত্র পাঁচ মিনিট দেরি হয়েছে। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে একটা গাছতলায় দাঁড়ালাম। শিখা এখনও আসেনি। কোনদিনও দেরি করে না যদিও, তাও মনে হল এই বিরাট ট্রাফিক জ্যাম আর প্রবল বৃষ্টির মধ্যে শিখা আসবে কি করে? ট্রাম, বাস, ট্যাক্সি সব অচল।
পাঁচটা বেজে গেছে, শিখা এখনও এলো না। ফোন বেজে থেমে গেল। এরকম তো কখনও হয়না। নিশ্চয়ই কোনো আকস্মিক অনিবার্য কারণে আটকে গেছে। আরও দশ-পনেরো মিনিট অপেক্ষা করে গাছতলা থেকে বেরিয়ে পা বাড়ালাম। আর অপেক্ষা করার মানে থাকে না, শিখা আজ আসতে পারবে না হয়তো।
খানিকটা এগোতেই কার্জন পার্কের মোড়ের কাছে দড়াম করে জোর একটা কানে তালা লাগানো শব্দ পেলাম। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সর্বনাশ ! পেট্রল বোমা। দুটো মিছিল পরস্পরের মুখোমুখি। দু’দলই বোমা-পিস্তল-ডান্ডায় সজ্জিত। একদলের পরনে গেরুয়া বসন, কপালে তিলক তো অপর পক্ষের মাথায় সাদা টুপি, পায়ে লুঙ্গি। দুই শিবিরের মুখেই হিন্দিতে অশ্রাব্য গালিগালাজ আর রণহুঙ্কার। এই এক হয়েছে ঘোর কলির সমস্যা। দেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী উঠে-পড়ে লেগেছে ভারতকে শুধুই * রাষ্ট্র বানানোর জন্য। ফলস্বরূপ দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সারা দেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি, বিভাজন, দাঙ্গা এসব লেগেই আছে। পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই সাম্প্রদায়িক সৌজন্যের বার্তা বহনকারী। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে এখানেও চরম দুর্বিষহ পরিস্থিতি। দেশে ক্ষমতায় থাকা দলের পক্ষ থেকে আবার এও বলা হচ্ছে সারা দেশে একটাই ভাষা থাকবে। অর্থাৎ হিন্দি-* -* স্তান। প্রসঙ্গত অ-হিন্দি ভাষার রাজ্যগুলি স্বভাবতই সেকথা মানতে চায়নি, তুমুল বিতর্ক চলছে দেশজুড়ে। আবার এও বলা হয়েছে অনেকবার যে সব বাঙালিরাই নাকি আসলে বাংলাদেশী ! তাদের ভারতে থাকার কোনো অধিকার নেই ! ভাবতে অবাক লাগে এরা কি বোঝেনা যে বাঙালিরা না থাকলে দেশটাই স্বাধীন হতো না ! স্বাধীনতা আদায়ে সবথেকে অগ্রণী ভূমিকা যাদের ছিল তারাই এখন উপেক্ষার পাত্র এদের কাছে !
ভারতবর্ষ বহু ভাষা-ভাষীর ধর্ম নিরপেক্ষ সার্বভৌম গণতান্ত্রিক দেশ। বৈচিত্রের মাঝে ঐক্য - এতকাল তাই জানতাম। কিন্তু আজকাল যেন তা কোনোভাবেই মেলাতে পারছি না। কেউ বলে * বিপদে আছে, কেউ বলে .। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি দেশমাতৃকা স্বয়ং বিপদে আছেন। চরম অনাচারের মধ্য দিয়ে চলছে দেশ।
আজ বিকেল থেকে একটার পর একটা খারাপ ঘটনা ঘটছে কেন? পৃথিবীর যন্ত্রপাতির সব গন্ডগোল কি আজই হতে হল?
হঠাৎ আমার মনে হল শিখার নিশ্চয়ই কোনো অসুখ হয়েছে। শুনলে কাকতালীয় লাগবে, কিন্তু আমার মনে হল শিখার হয়তো অসুখ হয়েছে কোনো - সেজন্যই আজ একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। এইসব ঘটনার সঙ্গে নিশ্চয়ই শিখার অসুখের কোনো সম্পর্ক রয়েছে। এ জগৎ তো মায়ার প্রতিভাস, আমাদের মনের অবস্থা অনুযায়ী সব কিছু ঘটে থাকে।
অনেক ঝুঁকি নিয়ে বিপদকে তোয়াক্কা না করে সেখান থেকে শিখার বাড়ি এলাম প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর। দরজা খুলল শিখার ভাই। মুখখানা থমথমে। কোনো দ্বিধা না করে বললাম, দিদি আছে?
-- দিদি উপরে শুয়ে আছে।
-- শরীর ভালো তো?-- না, দুপুর থেকে ধূম জ্বর।
আমি জানতাম নির্ঘাত এরকম কিছু একটা হবে ! সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। শিখার ঘর তিনতলায় সিঁড়ির পাশেই।
শিখা বিছানায় শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। গায়ে একটা পাতলা নীল চাদর, চোখ বোজা। ওর মা শিয়রের কাছে বসে কপালে জলপট্টি দিচ্ছেন। শিখার মা আমাকে দেখে একটু অবাকই হলেন, কথায় তা প্রকাশ না করে বললেন চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে।
আমাকে অজুহাতে বলতেই হল শিখার বিশেষ বন্ধু তৃষা আমার মাসতুতো বোন, সে শিখার থেকে একটা বই এনে দিতে বলেছিল, আমি এ পাড়া দিয়েই যাচ্ছিলাম, তাই আজ আসা।
ওর মা বলল দ্যাখো দেখি, হঠাৎ কি জ্বর ! সকালেও ভালো ছিল।
-- কি হয়েছে?
-- বুঝতে পারছি না তো, টেম্পারেচার একশো তিনের উপরে।-- ডাক্তার এসেছিলেন?
-- খবর তো দেওয়া হয়েছে। ন’টার সময় আসবে বলেছে। তার অপর আজ যা বাজে দিন, ওর বাবাও এখনো অফিস থেকে ফেরেনি।
কথাবার্তা শুনে শিখা একবার চোখ মেলে তাকাল। ঘোলাটে শূন্য দৃষ্টি। আমাকে চিনতে পারলো কিনা কে জানে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম, শিখার মা কি একবারও ঘর ছেড়ে যাবেন না? আজকালকার মায়েরা তেমন অবুঝ নন। একটুবাদেই উনি বললেন, তুমি বসো। আমি একটু গরম দুধ নিয়ে আসি, যদি খায়।
উনি ঘর ছেড়ে চলে যেতেই শিখার কাছে এসে আমি ওর কপালে হাত দিলাম। কপালটা যেন পুড়ে যাচ্ছে একেবারে। শিখা চোখ মেলে তাকাল আবার। তারপর অস্পষ্ট গলায় বলল, আমি আজ যেতে পারিনি।
-- ওকথা থাক এখন। তোমার কষ্ট হচ্ছে?
-- আমার মন খারাপ লাগছে খুব।-- ছিঃ এমন মন খারাপ করতে নেই। হঠাৎ অসুখ বাধালে কি করে?
-- আমার তো অসুখ হয়নি, আমার মন খারাপ।
-- লক্ষীটি এমন মন খারাপ কোরো না।
শিখা আমার হাতটা ধরে টেনে নিজের বুকের উপর রাখলো। আমি ভালোলাগায় বিধুর হয়ে গেলাম। আবার ভয়ও করতে লাগল, এই বুঝি ওর মা এসে পড়েন ঘরে। শিখা বলল, তুমি যেও না প্লিজ।
আমি দ্রুত হাত সরিয়ে নিয়ে চেয়ারে এসে বসলাম।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ওর মা ঢুকলেন ঘরে। উত্তেজনায় আমি কাঁপছি, কিছু দেখতে পান নি তো !
ডাক্তার এলো সাড়ে ন’টায়। তখনও জ্বর কমেনি, বরং বেড়েছে আরো মনে হয়।
ডাক্তার শিখাকে পরীক্ষা করে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, জ্বর তো একশো পাঁচের কম নয়। কোনো রকম ভাইরাস ইনফেকশন হয়েছে মনে হচ্ছে। রক্ত পরীক্ষা করতে হবে। আজ তো আর সম্ভব নয়। কাল সকালেই পাঠিয়ে দেবো।
তার পরদিন থেকে কলকাতায় কি তুলকালাম কান্ড। আগের দিনের ঘটনার জেরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভ মিছিল, ছাত্র ধর্মঘট। পুলিশের সঙ্গে আবার মারামারি। জায়গায় জায়গায় বাস-ট্রাম, পুলিশের গাড়ি পুড়লো। পুরো শহরটা বিকল হয়ে গেল। আমি বিকেলে আবার শিখার বাড়ি গেলাম। শিখার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। কোনো কথা বলতে পারছে না, সবসময় একটা ঘোরের মধ্যে আছে। এদিকে রক্ত পরীক্ষার কোনো ফলাফল তখনও আসেনি।
বিষন্ন মনে বেরিয়ে এলাম ওখান থেকে। রাস্তাঘাট শুনসান, থমথমে। যে ক’জন লোককে দেখা গেল, সকলের মুখ আতঙ্কগ্রস্ত। মাঝে মাঝে হিংস্র চেহারার পুলিশ আর আধা সামরিক বাহিনীর গাড়ি টহল দিচ্ছে। আমি তো জানি, এই অস্থির পরিস্থিতি আসলে শিখার মন-শরীরের বাস্তব প্রতিফলন। শিখার অসুখ ঠিক না হলে এই শহর রসাতলে যাবে।
পরদিন 14-ই আগস্ট। শিখার অবস্থার উন্নতি নেই। ডাক্তাররা কিছু বলতে পারছেন না। সেদিন কলকাতার বারো জায়গায় বাসে ট্রামে আগুন লেগেছে। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাম্প্রদায়িক হিংসা-দাঙ্গার খবর আসছে। বহু পুলিশ ও নিরীহ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দাঙ্গাবাজদের কবলে পড়ে। একটু ফাঁকা ঘর পেয়ে আমি অবচেতন শিখার কপালে হাত রেখে বললাম, শিখা, ভালো হয়ে ওঠো। তোমাকে ভালো হয়ে উঠতেই হবে !
পরদিন 15-ই আগস্টে কলকাতায় কারফিউ জারি করার কথা ভাবা হয়েছিল, কেউ কেউ বলছিল আর্মিকে ডেকে আনা হবে। কিন্তু সেদিনই সকালে রক্ত পরীক্ষার ফল পাওয়া গেল, রোগের উৎস জানা গেল। ঠিক ইনজেকশন দেবার পরই শিখার জ্ঞান ফিরে এলো। এক ঘন্টা বাদে ও অনেকটা সুস্থ, ওর মুখের রংটা স্বাভাবিক লাগল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, শিখা, এখন কেমন আছো ?
সামান্য হেসে শিখা বলল, আমার মন ভালো হয়ে গেছে।
বাইরে এসে দেখলাম চমৎকার ফুরফুরে হওয়া বইছে, সুন্দর রোদ উঠেছে। রাস্তায় অনেক বেশি লোকজন। কয়েকজন পুলিশের মুখেও হাসি। স্বাধীনতা দিবসের আনন্দের কাছে যেন হিংসা-মারামারি সব ম্লান হয়ে গেছে। চারদিকে সম্প্রীতির বার্তা। সবার গলায় ধ্বনিত হচ্ছে জাতীয় সংগীত। পাড়ায় পাড়ায় চলছে পতাকা উত্তোলন, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে চলছে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন।
উপরে মুখ তুলে দেখলাম শিখা বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। আমার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে হাসিমুখে। আমি বুঝলাম, সব কিছু একেবারে স্বাভাবিক এবার।
( সমাপ্ত )