11-01-2021, 07:11 PM
পর্ব দুই (#2-#8)
ব্লাকে প্রচন্ড ভিড় তাও আবার মাঝ পথ থেকে চড়েছি। বর্ধমান পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এতটাই নিজের চিন্তায় মশগুল ছিলাম যে বর্ধমানে জায়গা পাওয়ার পরে সেই যে বসে গেলাম আর কিছুই মনে নেই। ট্রেন হাওড়া ঢুকে গেছে, এক এক করে যখন লোকজন নামতে শুরু করল তখন সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। বাড়ি যেতে হবে, রাত অনেক হয়ে গেছে। একা একা বাড়িতে যেতে একদম ইচ্ছে করছিল না। স্টেশানের বাইরে বেড়িয়ে একটা টেলিফোন বুথ থেকে মামা বাড়ি ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে বাড়িতে আসছি। মামা বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। মামা ঘুমিয়ে পড়লেও মামিমা জেগে ছিলেন আমার জন্য।
বাড়িতে পা রাখতেই, মামিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে রে তোর?”
আমি মৃদু হেসে মামিমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কই কিছুই হয়নি তো।”
মামিমা আমাকে বললেন, “বিকেলে বোউমা ফোন করেছিল।”
আমি প্রমাদ গুনলাম, তোতাপাখি যে বাড়িতে বলে দেবে সেটা জানতাম। কারণ অনেক। বুদ্ধদেব বাবু প্রবালদার বস, তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে হয়ত প্রবালদার চাকরি সুত্রে উন্নতি হত। মামা মামিও মেয়ে দেখে এক প্রকার পছন্দ করে এসেছিলেন। হয়ত এটাই ভেবেছিলেন, যদি আমি আর প্রবালদা, দুই ভাই এক সাথে এক জায়গায় থাকি তাহলে দুইজনের অনেক সুবিধা।
আমি মামিমাকে বললাম, “কয়েক সপ্তাহ সময় দাও। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম এলো না। আকাশ মেঘলা, হাওয়া বইছে। বাড়ির পেছনে একটা ছোট পুকুর আছে সেই পুকুর পাড়ের বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ আর সুপারি গাছ মাথা দুলিয়ে ভুতুরে অন্ধকারে আমাকে মনে হয় ডাকছে। মাথাটা পুরো শুন্য, হারিয়ে গেছি কোথাও। খাটের ওপরে চুপচাপ বসে থাকলাম সারা রাত। আঁধার কাটিয়ে, কালো মেঘের আড়াল থেকে পুব আকাশে একটু খানি লাল রঙের ছোঁয়া লেগেছে। পাখির কিচির মিচির একটু শুরু হয়েছে, চড়াই, শালিক, টিয়া। আচমকা কাঁধে একটা হাত পড়তেই ভীষণ চমকে গেলাম।
দিম্মা অনেক ভোর বেলায় ওঠে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল অনেক রাতে এইচিস?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।” তারপরে মৃদু হেসে আমি আমার বিশ্ব সুন্দরীর কাছে আবদার করলাম, “আজকে একটু পাটি সাপটা বানিও তো, অনেকদিন খাইনি।”
হেসে ফেললেন দিম্মা, “আচ্ছা প্রভাকে বলে দেব। তা তুই সারা রাত ঘুমাসনি কেনে?”
আমিও দিম্মাকে ইয়ার্কি মেরে বললাম, “তুমি দেখেছ নাকি যে আমি ঘুমাইনি?”
আমার উষ্কখুষ্ক চুলে সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে বললেন, “এডা দেকতি হয় নাকি? তুই ঘুমাসনি সেটা তোর চোকে মুখে লেকা আছে। কি হইছে রে তোর? গতকাল বিকেলে তোর তোতাপাখি ফোন করিছেলো। মৃগেন চিন্তেয় পরি গেছল।” দিম্মাকে কি করে বলব কিছুই বুঝে পেলাম না। দিম্মা নিজেই আমাকে জিজ্ঞস করলেন, “সংযুক্তা তো দেকতি শুনতি ভালো।” আমি মাথা দোলালাম, ওকে নিয়ে তো আমার সমস্যা নয়। দিম্মা বললেন, “সত্যি কতা কি জানিস। যেখানে মনের মধ্যে দোটানা রইচে সে পথে যাতি নাই।” আমিও দিম্মার কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়ালাম। দিম্মা বললেন, “দেক, সময় আছে। তোরা দুই ভাই এক সাতি থাকলে আপদে বিপদে এক জনের পেচনে অন্যজনে দাঁড়াতি পারবি।” আমার মনের কথাই বলছে আমার দিম্মা। “তবে কি জানিস আদি। দোনামনা এক ব্যাপার আর ভয়ে পিচিয়ে আসা অন্য ব্যাপার।” আমি অবাক হয়ে গেলাম দিম্মার কথা শুনে। দিম্মা মৃদু হেসে আমাকে বললেন, “তোর চোকে নেকা যে তুই ভয়ে পিচিয়ে গেছিস। কেন?”
আমি নিরুত্তর, এত কথা নিশ্চয় তোতাপাখি মামিমাকে বলেনি আর মামিমাও নিশ্চয় দিম্মাকে বলেনি। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেছি সেই ব্যাপারে দিম্মা কি করে জানল তাহলে? আমি বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে দিম্মাকে ধিরে ধিরে সব কথা খুলে বললাম। যেটা তোতাপাখি কেও বলিনি সেটাও বললাম। আমি মরতে ভয় পাইনা তবে পঙ্গু হয়ে কারুর গলগ্রহ হয়েও থাকতে চাই না। শেষ কথাটা দিম্মাকে ভাবিয়ে তুলল।
দিম্মার হাতের পাটিসাপটা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। সোমবার অফিসে ভীষণ কাজের চাপ ছিল। সারাদিন মাথা উঠানোর পর্যন্ত সময় ছিল না। অফিস থেকে বের হতে অন্যদিনের চেয়ে একটু দেরি হয়েই গেছিল। বাইক ছুটিয়ে দিলাম ইন্সটিটিউটের দিকে। ক্লাস শুরুর মাত্র দু মিনিট আগে পৌঁছালাম। যথারীতি দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসে ঢুকলাম। প্রথম সারির চেয়ারে বিদ্যমান তিতলি। আমাকে দেখতে পেয়েই ওর হাসি হাসি মুখে একটা মেঘের ছায়া নেমে এলো। চুপচাপ দাঁতের মাঝে পেন চেপে ধরে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি অনির্বাণের পাশে বসতে বসতে ওর দিকে চেয়ে দেখলাম। ক্লাস শুরু হল। একবার শুধুমাত্র চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে দেখল তিতলি। কিছু যেন বলতে চাইছে ওর ওই কাজল কালো ভাসা ভাসা নয়ন।
ক্লাসের শেষে তিতলি আর দাঁড়ায়নি। আমার আগেই ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে গেছিল। আমি ওর যাওয়ার পথের দিকে একটু চেয়ে থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ভুলে যাওয়াই ভালো। বড় লোকের সুন্দরী মেয়ে, যে পথ আমার নয় সেই পথে না চলাই শ্রেয়। বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে অনির্বাণের সাথে সিগারেট টানতে টানতে একটু গল্প করলাম। আগের দিন দুর্গাপুর গেছিলাম নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে সেটা জানাতেই লাফিয়ে উঠল অনির্বাণ।
অনির্বাণ আশ্চর্য হয়ে বলল, “বিয়ে করছিস তাহলে?”
আমি হাসলাম ওর কথা শুনে, “ঠিক নেই।”
অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল, “কেন রে? দেখতে শুনতে খারাপ নাকি? নাকি অন্য কিছু আছে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “না না, সেটা নয় রে। সংযুক্তা দেখতে ভালো। ওর বাবা ডিভিসিতে খুব বড় পোস্টে চাকরি করে, ওর দাদাও ডিভিসিতে আমার দাদাও ডিভিসিতে।”
হেসে ফেলল অনির্বাণ, “শালা তোদের পুরো ফ্যামিলিকে মনে হচ্ছে ডিভিসি পুষছে।” একটু চুপ করে থাকার পরে জিজ্ঞেস করল, “আর এদিকের কি খবর?”
আমি মাথা নাড়লাম, “জানি না। এই সেমেস্টার শেষ হলে আর এক ব্যাচে এডমিশান নেব না।”
মাথা দোলাল অনির্বাণ, “হুম। বুঝলাম। তা আমাকে জানিয়ে দিস কোন ব্যাচে নিবি তাহলে আমিও তোর ব্যাচেই এডমিশান নেব।”
আমি হেসে ফেললাম, “হ্যাঁ রে জানিয়ে দেব। পরের মাসে তো সেমেস্টার এক্সাম। প্রিপারেশান হয়েছে?”
হেসে ফেলল অনির্বাণ, “ওই যা হওয়ার হয়েছে। দেখা যাবে। আমি শালা কোন চাকরি করব।”
আমাকে রিতিমত পড়াশুনা করতেই হবে। অন্তত ভালো গ্রেড নিয়ে পাস করতে হবে। ডিভিসি না হোক অন্য কোথাও একটা চাকরি খুঁজতে হবে। অফিসের বস ভালো হলে কি হবে মাইনে দেয় না যে। মাইনে দেওয়ার বেলায় যত নাকে কান্না, নতুন প্রোজেক্ট ভালো বিক্রি হয়নি, সেই এলাকার ক্লাব রাজনৈতিক দলের লোকদের টাকা দিতে হয় ইত্যাদি অনেক কিছুই গল্প শুরু হয়ে যায়।
সেপ্টেম্বর শেষ। আকাশে বাতাসে আগমনীর সুর। নীল আকাশে মাঝে মাঝে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়, সেই সাদা পোজা তুলোর মতন মেঘের দর্শন এখন আসতে দেরি। গত দুই সপ্তাহে শুধু মাত্র ওই চোখের দেখাই হয়েছিল তিতলির সাথে। যতবার ওর সাথে চোখা চুখি হত, মন বাঁধ মানতে চাইত না। প্রতিবার একটা কথাই মনে হত, কেন সেদিন ওকে বাইকে নিয়ে ওর বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। একটা ট্যাক্সি ডেকে ভাড়া দিয়ে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যেত। প্রথম দিনে যদিও ওর আর আমার মাঝে সহস্র যোজনের ব্যাবধান ছিল, কিন্তু ওই কাঁধে হাত রেখে চুপ করে বসে থাকাটাই আমার কাছে অনেক।
সেমেস্টারের শেষ ক্লাস, দুই দিন পরেই সেমেস্টার পরীক্ষা। তার পরে আর হয়ত কোনদিন তিতলির সাথে দেখা হবে না। শেষ দিনের ক্লাসে মন খুব খারাপ লাগছিল আমার। সারাটা সময় মাথা নিচু করে বসে ছিল তিতলি। আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এক এক মিনিট করে ক্লাস এগোয় আর আমার বুকের মাঝে ধস নামতে শুরু করে। ভীষণ এক অব্যাক্ত বেদনা। দুর থেকেই বুঝতে পারছিলাম ওর ফর্সা টিয়াপাখির মতন নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। সেদিন ওর পরনে একটা সাদা রঙের ঢিলে সালোয়ার কামিজ, আর রঙচঙে ওড়না। সাদা রঙ যেন ওর জীবনের রঙ। ক্লাস শেষের পরেও সেদিন বসেছিল কিছুক্ষন। আমার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল। অনির্বাণ আমার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইশারায় তিতলির দিকে দেখতে অনুরোধ করল। চুপ করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। আষাঢ়ের কালো মেঘের মতন ঢালাও চুল একটা হাত খোঁপা করে বাঁধা। প্রতিবারের মতন প্রসাধনহীন লাবণ্যে সজ্জিত সুন্দরী, কাজল কালো নয়নে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। আমি আমার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওর কাজল কালো চোখ জোড়া আমার বুকের ভেতর পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। আমি কত ভীতু কত কাপুরুষ সেটা যেন ও দেখে ফেলল। নিচের ঠোঁট ওপরে ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে মাথা নিচু করে বেড়িয়ে চলে গেল।
একটা আবেগ দলা পাকিয়ে এলো গলার কাছে। অনির্বাণকে বললাম তুই বাড়ি চলে যা। ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল অনির্বাণ, জিজ্ঞেস করল আমি কি করতে চাই। আমি উত্তর দিলাম যে আমি একটু একা থাকতে চাই। অনির্বাণের অপেক্ষা না করেই বেড়িয়ে গেলাম ইন্সটিটিউট থেকে। রাস্তার ওপাশে বাসস্টান্ডের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। তিতলি তখন বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে। রাস্তার একপাশে আমি দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্যপাশে তিতলি। বেশ কয়েকটা খালি ট্যাক্সি বেড়িয়ে চলে গেল রাস্তা দিয়ে। বাস স্টান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে, বুকের কাছে ওর পড়ার ব্যাগ চেপে ধরে, চোখের দৃষ্টি রাস্তায় নেই। রাস্তা পেরিয়ে রাস্তার বিপরিতে আমার দিকে। ওর তীক্ষ্ণ গভীর নজর এড়াতে একটু অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু কাজে দেয়নি। সেই অন্ধকার আমাকে লুকাতে পারেনি ওর কাজল কালো নয়নের বেদনা থেকে। আমি সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। চোয়াল কঠিন, চোখ জোড়া ভীষণ জ্বলছে। ফুসফুস একটানে যতটা ধোঁয়া টানতে পারে ততটা টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। আমি যে পালিয়ে যাবো তার উপায় ও নেই। আমার বাইক ওই বাসস্টান্ডের পাশেই পার্ক করা। প্রায় আধা ঘন্টা যুদ্ধ চলল দুই প্রানের। শেষ পর্যন্ত দুইজনেই হেরে গেল সেই যুদ্ধে। রাত বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেল তিতলি।
ট্যাক্সি চলে যেতেই আমি আকাশের দিকে তাকালাম। কি থেকে কি হয়ে গেল জীবনটা। এতদিন শুধু ওই গানের মধ্যেই শুনেছি, ভালোবাসা পোড়ায় যে মন পোড়ে না তো অঙ্গ, এ কেমন রঙ্গ জাদু এ কেমন রঙ্গ। সেই শেষ দিনের দেখায় তখন আমি বুঝতে পারিনি যে আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু এই আজকের রাতের দেখায়, রাস্তার ওইপাশে ওর আঁখি দেখে বুঝতে পারলাম, যে হ্যাঁ আমি ওকে ভালোবাসি। তাই আমি এইপাশে ভিতুর মতন অন্ধকারে ওর চোখের আড়াল করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আর তিতলি ছিল বাসস্টান্ডের আলোয় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষায়। রাস্তা আমি পার করতে পারলাম না।
বাইকে উঠে শেষ পর্যন্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উল্টোডাঙ্গার খালপারের বস্তির মধ্যে ঢুকে এক বোতল দেশি আর গিলা মেটে কিনলাম। তারপরে বাইক ছুটিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছালাম তখন বাজে রাত সাড়ে ন’টা। বাড়িতে ঢুকেই আগে জামা কাপড় কোন মতে খুলে সোজা বোতল খুলে গলায় ঢেলে নিলাম দেশি মদ। গলা জ্বলে গেল, গরল গলা দিয়ে নামছে পুরো টের পেলাম। সেই সাথে একটা সিগারেট ধরালাম। মাথা ঝনঝন করে উঠল। বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে উত্তম মধ্যম গালা গালি দিলাম। শালা বোকাচোদা তোর কপালে সুখ বলে কিছুই নেই। তোর মা অনেক বছর আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তোকে ছেড়ে চলে গেছে। তোর বাবার কোন খবর নেই, তুই নিজেই জানিস না সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। যদি বেঁচেও থাকে তাহলে কোনদিন তোর খবর নিতে আসবে না। তোর দিম্মা একা কি করবে? তোর মামা মামির বয়স হয়েছে, তুই নিজে তাঁদের বাড়িতে থাকিস না। তোর কি হবে। তুই শালা এই রাতে এই মদ খেয়েই মর। মরেই যা, কাল সকালে যখন তুই অফিসে পৌঁছাবি না অথবা তোর মামা অথবা হোঁৎকা যখন তোকে ফোন করে পাবে না তখন তোর মৃতদেহ পাবে এখানে।
ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। শালা এত রাতে কে ফোন করে। ঘড়ি দেখলাম, রাত দশটা। ফোন তুলেই গালাগালি দিতে যাবো কি থমকে গেলাম। মামিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ছিলিস রে তুই? সেই সাড়ে আট’টা থেকে তোকে ফোন করে যাচ্ছি।”
কথা জড়িয়ে এলো, “কি হয়েছে বলো।”
আমার গলা শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেলেন মামিমা, “এটা কি করছিস রে তুই, বুধো? তুই কালকেই বাড়ি আসবি। তোর আর ওইখানে একা একা থাকতে হবে না।”
মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার কিছু হয়নি। এই একটু খানি আর কিছু না। তুমি ওই নিয়ে চিন্তা করো না।”
জানি না মামিমা আমার কথা কতটা বিশ্বাস করলেন। তবে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে বললেন, “সুবির, মানে তোর বাবা আজ বিকেলে ফোন করেছিল। তোর মামার সাথে কথা বলেছে, আমার সাথেও কথা হয়েছে।”
সুবির ঘোষ, আমার বাবার নাম শুনেই মাথাটা আরো বেশি গরম হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে মামিমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, তা কি বলতে চায়?”
মামিমা নরম কন্ঠে বললেন, “তুই কাল বাড়ি আয় বাবা, তারপরে সব কিছু বলব।”
আমিও মাথা দোলালাম, “ঠিক আছে, অফিসের পরে সোজা চলে আসব।”
ফোন ছাড়ার আগে ধরা কন্ঠে মামিমা বললেন, “কেন ওইসব ছাইপাঁশ গিলছিস বলতো।”
আমি আরও এক ঢোঁক গলায় ঢেলে মামিমাকে আসস্থ করে বললাম, “আরে না না, তুমি কি ভাবছ আমি ওই মেয়েটার জন্য গিলছি নাকি?”
সত্যি নিজের বুকের জ্বালা কমাতে মদ গিলছিলাম, কিন্তু জ্বালা আরও বেশি করেই জ্বলে উঠল আমার বাবার নাম শুনে। ফোন রাখার পরে কি করেছি ঠিক মনে নেই। মাথা ঝিমঝিম করছিল ভীষণ ভাবেই। সোফার ওপরেই ধপ করে পরে গেলাম, সেখানেই মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পরে ওই সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পরেরদিন অফিস থেকে সোজা মামা বাড়ি। বাড়িতে পা রাখতেই মামিমা ভীষণ বকাঝকা শুরু করে দিলেন। এত বড় ছেলে কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই, একা একা থাকিস কিছু একটা হয়ে গেলে কে দেখবে। তারপরে কিছুক্ষন মামার অবর্তমানেই মামার মুন্ডপাত করা হল, কেন মরতে যে ছেলেটাকে ওইখানে পাঠিয়ে দিল। সেদিন বুঝালাম মামিমা আমাকে খুব ভালোবাসে। এমন নয় যে আমার মাকে মনে নেই। মাকে ভালো করেই মনে আছে তবে মা মারা যাওয়ার পর মামিমার কাছেই মানুষ হয়েছি।
রাতে খাওয়ার পরে মামিমা আমার ঘরে এসে বললেন “গতকাল বিকেলে সুবির, তোর বাবা ফোন তোর মামাকে ফোন করেছিল। বুধো তোর বাবা কালকে তোর মামার কাছে কাঁদছিল রে।”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল সেই শুনে। চাপা ক্রোধ ভরা গলায় বললাম, “তা আমি কি করব।”
মামিমা বললেন, “তোকে একবার ফোন করতে বলেছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমার ফোন নাম্বার দাওনি তো?”
মামিমা মাথা নাড়লেন, “না তোর ফোন নাম্বার দেয়নি তোর মামা। তবে সুবির নিজের ফোন নাম্বার দিয়েছে আমাদের।”
আমি মাথা নাড়লাম, “আচ্ছা দেখা যাবে।”
মামিমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “দেখ বাবা, সবার অনেক বয়স হয়েছে। একবার কথা বলে দেখ। কি বলতে চায় সেটা শোন। কথা বলতে ক্ষতি কোথায়? সবাই একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তাও শেষ বেলায় পুরানো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে একটা অন্তত সুযোগ দেওয়া উচিত।”
আমি মামিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মা চলে যাওয়ার পরে তোমার কাছে মানুষ হয়েছি...”
মামিমা মৃদু হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তো একটা ফোন করলেই কি আমার ছেলে পর হয়ে যাবে নাকি? আমি কি এমনি এমনি ছেড়ে দেব?”
আমি হেসে মামিমাকে জড়িয়ে ধরলাম, “না না একদম না।”
আমার কান টেনে ধরে স্নেহ ভরা শাসন করে বললেন, “ওই ছাইপাঁশ গেলা ছাড়। তোর মামা শুনলে খুব রাগারাগি করবে।”
আমিও বললাম, “আরে না গো, রোজদিন তো খাই না। এই মাঝে মধ্যে এই আর কি।”
ব্লাকে প্রচন্ড ভিড় তাও আবার মাঝ পথ থেকে চড়েছি। বর্ধমান পর্যন্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। এতটাই নিজের চিন্তায় মশগুল ছিলাম যে বর্ধমানে জায়গা পাওয়ার পরে সেই যে বসে গেলাম আর কিছুই মনে নেই। ট্রেন হাওড়া ঢুকে গেছে, এক এক করে যখন লোকজন নামতে শুরু করল তখন সম্বিত ফিরে পেলাম আমি। বাড়ি যেতে হবে, রাত অনেক হয়ে গেছে। একা একা বাড়িতে যেতে একদম ইচ্ছে করছিল না। স্টেশানের বাইরে বেড়িয়ে একটা টেলিফোন বুথ থেকে মামা বাড়ি ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে বাড়িতে আসছি। মামা বাড়ি পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেল। মামা ঘুমিয়ে পড়লেও মামিমা জেগে ছিলেন আমার জন্য।
বাড়িতে পা রাখতেই, মামিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি হয়েছে রে তোর?”
আমি মৃদু হেসে মামিমাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কই কিছুই হয়নি তো।”
মামিমা আমাকে বললেন, “বিকেলে বোউমা ফোন করেছিল।”
আমি প্রমাদ গুনলাম, তোতাপাখি যে বাড়িতে বলে দেবে সেটা জানতাম। কারণ অনেক। বুদ্ধদেব বাবু প্রবালদার বস, তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হলে হয়ত প্রবালদার চাকরি সুত্রে উন্নতি হত। মামা মামিও মেয়ে দেখে এক প্রকার পছন্দ করে এসেছিলেন। হয়ত এটাই ভেবেছিলেন, যদি আমি আর প্রবালদা, দুই ভাই এক সাথে এক জায়গায় থাকি তাহলে দুইজনের অনেক সুবিধা।
আমি মামিমাকে বললাম, “কয়েক সপ্তাহ সময় দাও। আশা করি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
খেয়ে দেয়ে ঘুমাতে গেলাম। ঘুম এলো না। আকাশ মেঘলা, হাওয়া বইছে। বাড়ির পেছনে একটা ছোট পুকুর আছে সেই পুকুর পাড়ের বেশ কয়েকটা নারকেল গাছ আর সুপারি গাছ মাথা দুলিয়ে ভুতুরে অন্ধকারে আমাকে মনে হয় ডাকছে। মাথাটা পুরো শুন্য, হারিয়ে গেছি কোথাও। খাটের ওপরে চুপচাপ বসে থাকলাম সারা রাত। আঁধার কাটিয়ে, কালো মেঘের আড়াল থেকে পুব আকাশে একটু খানি লাল রঙের ছোঁয়া লেগেছে। পাখির কিচির মিচির একটু শুরু হয়েছে, চড়াই, শালিক, টিয়া। আচমকা কাঁধে একটা হাত পড়তেই ভীষণ চমকে গেলাম।
দিম্মা অনেক ভোর বেলায় ওঠে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল অনেক রাতে এইচিস?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।” তারপরে মৃদু হেসে আমি আমার বিশ্ব সুন্দরীর কাছে আবদার করলাম, “আজকে একটু পাটি সাপটা বানিও তো, অনেকদিন খাইনি।”
হেসে ফেললেন দিম্মা, “আচ্ছা প্রভাকে বলে দেব। তা তুই সারা রাত ঘুমাসনি কেনে?”
আমিও দিম্মাকে ইয়ার্কি মেরে বললাম, “তুমি দেখেছ নাকি যে আমি ঘুমাইনি?”
আমার উষ্কখুষ্ক চুলে সরু সরু আঙ্গুল দিয়ে আঁচরে বললেন, “এডা দেকতি হয় নাকি? তুই ঘুমাসনি সেটা তোর চোকে মুখে লেকা আছে। কি হইছে রে তোর? গতকাল বিকেলে তোর তোতাপাখি ফোন করিছেলো। মৃগেন চিন্তেয় পরি গেছল।” দিম্মাকে কি করে বলব কিছুই বুঝে পেলাম না। দিম্মা নিজেই আমাকে জিজ্ঞস করলেন, “সংযুক্তা তো দেকতি শুনতি ভালো।” আমি মাথা দোলালাম, ওকে নিয়ে তো আমার সমস্যা নয়। দিম্মা বললেন, “সত্যি কতা কি জানিস। যেখানে মনের মধ্যে দোটানা রইচে সে পথে যাতি নাই।” আমিও দিম্মার কথা শুনে বাধ্য ছেলের মতন মাথা নাড়ালাম। দিম্মা বললেন, “দেক, সময় আছে। তোরা দুই ভাই এক সাতি থাকলে আপদে বিপদে এক জনের পেচনে অন্যজনে দাঁড়াতি পারবি।” আমার মনের কথাই বলছে আমার দিম্মা। “তবে কি জানিস আদি। দোনামনা এক ব্যাপার আর ভয়ে পিচিয়ে আসা অন্য ব্যাপার।” আমি অবাক হয়ে গেলাম দিম্মার কথা শুনে। দিম্মা মৃদু হেসে আমাকে বললেন, “তোর চোকে নেকা যে তুই ভয়ে পিচিয়ে গেছিস। কেন?”
আমি নিরুত্তর, এত কথা নিশ্চয় তোতাপাখি মামিমাকে বলেনি আর মামিমাও নিশ্চয় দিম্মাকে বলেনি। আমি ভয়ে পিছিয়ে গেছি সেই ব্যাপারে দিম্মা কি করে জানল তাহলে? আমি বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে দিম্মাকে ধিরে ধিরে সব কথা খুলে বললাম। যেটা তোতাপাখি কেও বলিনি সেটাও বললাম। আমি মরতে ভয় পাইনা তবে পঙ্গু হয়ে কারুর গলগ্রহ হয়েও থাকতে চাই না। শেষ কথাটা দিম্মাকে ভাবিয়ে তুলল।
দিম্মার হাতের পাটিসাপটা খেয়ে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। সোমবার অফিসে ভীষণ কাজের চাপ ছিল। সারাদিন মাথা উঠানোর পর্যন্ত সময় ছিল না। অফিস থেকে বের হতে অন্যদিনের চেয়ে একটু দেরি হয়েই গেছিল। বাইক ছুটিয়ে দিলাম ইন্সটিটিউটের দিকে। ক্লাস শুরুর মাত্র দু মিনিট আগে পৌঁছালাম। যথারীতি দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসে ঢুকলাম। প্রথম সারির চেয়ারে বিদ্যমান তিতলি। আমাকে দেখতে পেয়েই ওর হাসি হাসি মুখে একটা মেঘের ছায়া নেমে এলো। চুপচাপ দাঁতের মাঝে পেন চেপে ধরে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। আমি অনির্বাণের পাশে বসতে বসতে ওর দিকে চেয়ে দেখলাম। ক্লাস শুরু হল। একবার শুধুমাত্র চোখের কোনা দিয়ে আমার দিকে দেখল তিতলি। কিছু যেন বলতে চাইছে ওর ওই কাজল কালো ভাসা ভাসা নয়ন।
ক্লাসের শেষে তিতলি আর দাঁড়ায়নি। আমার আগেই ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে গেছিল। আমি ওর যাওয়ার পথের দিকে একটু চেয়ে থেকে বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ভুলে যাওয়াই ভালো। বড় লোকের সুন্দরী মেয়ে, যে পথ আমার নয় সেই পথে না চলাই শ্রেয়। বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে অনির্বাণের সাথে সিগারেট টানতে টানতে একটু গল্প করলাম। আগের দিন দুর্গাপুর গেছিলাম নিজের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে সেটা জানাতেই লাফিয়ে উঠল অনির্বাণ।
অনির্বাণ আশ্চর্য হয়ে বলল, “বিয়ে করছিস তাহলে?”
আমি হাসলাম ওর কথা শুনে, “ঠিক নেই।”
অনির্বাণ জিজ্ঞেস করল, “কেন রে? দেখতে শুনতে খারাপ নাকি? নাকি অন্য কিছু আছে?”
আমি মাথা নাড়লাম, “না না, সেটা নয় রে। সংযুক্তা দেখতে ভালো। ওর বাবা ডিভিসিতে খুব বড় পোস্টে চাকরি করে, ওর দাদাও ডিভিসিতে আমার দাদাও ডিভিসিতে।”
হেসে ফেলল অনির্বাণ, “শালা তোদের পুরো ফ্যামিলিকে মনে হচ্ছে ডিভিসি পুষছে।” একটু চুপ করে থাকার পরে জিজ্ঞেস করল, “আর এদিকের কি খবর?”
আমি মাথা নাড়লাম, “জানি না। এই সেমেস্টার শেষ হলে আর এক ব্যাচে এডমিশান নেব না।”
মাথা দোলাল অনির্বাণ, “হুম। বুঝলাম। তা আমাকে জানিয়ে দিস কোন ব্যাচে নিবি তাহলে আমিও তোর ব্যাচেই এডমিশান নেব।”
আমি হেসে ফেললাম, “হ্যাঁ রে জানিয়ে দেব। পরের মাসে তো সেমেস্টার এক্সাম। প্রিপারেশান হয়েছে?”
হেসে ফেলল অনির্বাণ, “ওই যা হওয়ার হয়েছে। দেখা যাবে। আমি শালা কোন চাকরি করব।”
আমাকে রিতিমত পড়াশুনা করতেই হবে। অন্তত ভালো গ্রেড নিয়ে পাস করতে হবে। ডিভিসি না হোক অন্য কোথাও একটা চাকরি খুঁজতে হবে। অফিসের বস ভালো হলে কি হবে মাইনে দেয় না যে। মাইনে দেওয়ার বেলায় যত নাকে কান্না, নতুন প্রোজেক্ট ভালো বিক্রি হয়নি, সেই এলাকার ক্লাব রাজনৈতিক দলের লোকদের টাকা দিতে হয় ইত্যাদি অনেক কিছুই গল্প শুরু হয়ে যায়।
সেপ্টেম্বর শেষ। আকাশে বাতাসে আগমনীর সুর। নীল আকাশে মাঝে মাঝে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখা যায়, সেই সাদা পোজা তুলোর মতন মেঘের দর্শন এখন আসতে দেরি। গত দুই সপ্তাহে শুধু মাত্র ওই চোখের দেখাই হয়েছিল তিতলির সাথে। যতবার ওর সাথে চোখা চুখি হত, মন বাঁধ মানতে চাইত না। প্রতিবার একটা কথাই মনে হত, কেন সেদিন ওকে বাইকে নিয়ে ওর বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলাম। একটা ট্যাক্সি ডেকে ভাড়া দিয়ে দিলেই কাজ শেষ হয়ে যেত। প্রথম দিনে যদিও ওর আর আমার মাঝে সহস্র যোজনের ব্যাবধান ছিল, কিন্তু ওই কাঁধে হাত রেখে চুপ করে বসে থাকাটাই আমার কাছে অনেক।
সেমেস্টারের শেষ ক্লাস, দুই দিন পরেই সেমেস্টার পরীক্ষা। তার পরে আর হয়ত কোনদিন তিতলির সাথে দেখা হবে না। শেষ দিনের ক্লাসে মন খুব খারাপ লাগছিল আমার। সারাটা সময় মাথা নিচু করে বসে ছিল তিতলি। আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। এক এক মিনিট করে ক্লাস এগোয় আর আমার বুকের মাঝে ধস নামতে শুরু করে। ভীষণ এক অব্যাক্ত বেদনা। দুর থেকেই বুঝতে পারছিলাম ওর ফর্সা টিয়াপাখির মতন নাকের ডগা লাল হয়ে গেছে। সেদিন ওর পরনে একটা সাদা রঙের ঢিলে সালোয়ার কামিজ, আর রঙচঙে ওড়না। সাদা রঙ যেন ওর জীবনের রঙ। ক্লাস শেষের পরেও সেদিন বসেছিল কিছুক্ষন। আমার জন্যেই যেন অপেক্ষা করছিল। অনির্বাণ আমার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইশারায় তিতলির দিকে দেখতে অনুরোধ করল। চুপ করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। আষাঢ়ের কালো মেঘের মতন ঢালাও চুল একটা হাত খোঁপা করে বাঁধা। প্রতিবারের মতন প্রসাধনহীন লাবণ্যে সজ্জিত সুন্দরী, কাজল কালো নয়নে আমার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল। আমি আমার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। ওর কাজল কালো চোখ জোড়া আমার বুকের ভেতর পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। আমি কত ভীতু কত কাপুরুষ সেটা যেন ও দেখে ফেলল। নিচের ঠোঁট ওপরে ঠোঁটের মধ্যে চেপে ধরে মাথা নিচু করে বেড়িয়ে চলে গেল।
একটা আবেগ দলা পাকিয়ে এলো গলার কাছে। অনির্বাণকে বললাম তুই বাড়ি চলে যা। ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে দেখল অনির্বাণ, জিজ্ঞেস করল আমি কি করতে চাই। আমি উত্তর দিলাম যে আমি একটু একা থাকতে চাই। অনির্বাণের অপেক্ষা না করেই বেড়িয়ে গেলাম ইন্সটিটিউট থেকে। রাস্তার ওপাশে বাসস্টান্ডের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতর ছ্যাঁত করে উঠল। তিতলি তখন বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে। রাস্তার একপাশে আমি দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্যপাশে তিতলি। বেশ কয়েকটা খালি ট্যাক্সি বেড়িয়ে চলে গেল রাস্তা দিয়ে। বাস স্টান্ডে ঠায় দাঁড়িয়ে, বুকের কাছে ওর পড়ার ব্যাগ চেপে ধরে, চোখের দৃষ্টি রাস্তায় নেই। রাস্তা পেরিয়ে রাস্তার বিপরিতে আমার দিকে। ওর তীক্ষ্ণ গভীর নজর এড়াতে একটু অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু কাজে দেয়নি। সেই অন্ধকার আমাকে লুকাতে পারেনি ওর কাজল কালো নয়নের বেদনা থেকে। আমি সেই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরালাম। চোয়াল কঠিন, চোখ জোড়া ভীষণ জ্বলছে। ফুসফুস একটানে যতটা ধোঁয়া টানতে পারে ততটা টেনে নিলাম বুকের মধ্যে। আমি যে পালিয়ে যাবো তার উপায় ও নেই। আমার বাইক ওই বাসস্টান্ডের পাশেই পার্ক করা। প্রায় আধা ঘন্টা যুদ্ধ চলল দুই প্রানের। শেষ পর্যন্ত দুইজনেই হেরে গেল সেই যুদ্ধে। রাত বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত একটা ট্যাক্সিতে উঠে চলে গেল তিতলি।
ট্যাক্সি চলে যেতেই আমি আকাশের দিকে তাকালাম। কি থেকে কি হয়ে গেল জীবনটা। এতদিন শুধু ওই গানের মধ্যেই শুনেছি, ভালোবাসা পোড়ায় যে মন পোড়ে না তো অঙ্গ, এ কেমন রঙ্গ জাদু এ কেমন রঙ্গ। সেই শেষ দিনের দেখায় তখন আমি বুঝতে পারিনি যে আমি ওকে ভালোবাসি। কিন্তু এই আজকের রাতের দেখায়, রাস্তার ওইপাশে ওর আঁখি দেখে বুঝতে পারলাম, যে হ্যাঁ আমি ওকে ভালোবাসি। তাই আমি এইপাশে ভিতুর মতন অন্ধকারে ওর চোখের আড়াল করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। আর তিতলি ছিল বাসস্টান্ডের আলোয় দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষায়। রাস্তা আমি পার করতে পারলাম না।
বাইকে উঠে শেষ পর্যন্ত বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। উল্টোডাঙ্গার খালপারের বস্তির মধ্যে ঢুকে এক বোতল দেশি আর গিলা মেটে কিনলাম। তারপরে বাইক ছুটিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। বাড়ি পৌঁছালাম তখন বাজে রাত সাড়ে ন’টা। বাড়িতে ঢুকেই আগে জামা কাপড় কোন মতে খুলে সোজা বোতল খুলে গলায় ঢেলে নিলাম দেশি মদ। গলা জ্বলে গেল, গরল গলা দিয়ে নামছে পুরো টের পেলাম। সেই সাথে একটা সিগারেট ধরালাম। মাথা ঝনঝন করে উঠল। বাথরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে উত্তম মধ্যম গালা গালি দিলাম। শালা বোকাচোদা তোর কপালে সুখ বলে কিছুই নেই। তোর মা অনেক বছর আগেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তোকে ছেড়ে চলে গেছে। তোর বাবার কোন খবর নেই, তুই নিজেই জানিস না সে বেঁচে আছে না মরে গেছে। যদি বেঁচেও থাকে তাহলে কোনদিন তোর খবর নিতে আসবে না। তোর দিম্মা একা কি করবে? তোর মামা মামির বয়স হয়েছে, তুই নিজে তাঁদের বাড়িতে থাকিস না। তোর কি হবে। তুই শালা এই রাতে এই মদ খেয়েই মর। মরেই যা, কাল সকালে যখন তুই অফিসে পৌঁছাবি না অথবা তোর মামা অথবা হোঁৎকা যখন তোকে ফোন করে পাবে না তখন তোর মৃতদেহ পাবে এখানে।
ক্রিং ক্রিং, ক্রিং ক্রিং। শালা এত রাতে কে ফোন করে। ঘড়ি দেখলাম, রাত দশটা। ফোন তুলেই গালাগালি দিতে যাবো কি থমকে গেলাম। মামিমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় ছিলিস রে তুই? সেই সাড়ে আট’টা থেকে তোকে ফোন করে যাচ্ছি।”
কথা জড়িয়ে এলো, “কি হয়েছে বলো।”
আমার গলা শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেলেন মামিমা, “এটা কি করছিস রে তুই, বুধো? তুই কালকেই বাড়ি আসবি। তোর আর ওইখানে একা একা থাকতে হবে না।”
মাথা ঝাঁকিয়ে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করলাম। বললাম, “আমার কিছু হয়নি। এই একটু খানি আর কিছু না। তুমি ওই নিয়ে চিন্তা করো না।”
জানি না মামিমা আমার কথা কতটা বিশ্বাস করলেন। তবে বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে বললেন, “সুবির, মানে তোর বাবা আজ বিকেলে ফোন করেছিল। তোর মামার সাথে কথা বলেছে, আমার সাথেও কথা হয়েছে।”
সুবির ঘোষ, আমার বাবার নাম শুনেই মাথাটা আরো বেশি গরম হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত পিষে মামিমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, তা কি বলতে চায়?”
মামিমা নরম কন্ঠে বললেন, “তুই কাল বাড়ি আয় বাবা, তারপরে সব কিছু বলব।”
আমিও মাথা দোলালাম, “ঠিক আছে, অফিসের পরে সোজা চলে আসব।”
ফোন ছাড়ার আগে ধরা কন্ঠে মামিমা বললেন, “কেন ওইসব ছাইপাঁশ গিলছিস বলতো।”
আমি আরও এক ঢোঁক গলায় ঢেলে মামিমাকে আসস্থ করে বললাম, “আরে না না, তুমি কি ভাবছ আমি ওই মেয়েটার জন্য গিলছি নাকি?”
সত্যি নিজের বুকের জ্বালা কমাতে মদ গিলছিলাম, কিন্তু জ্বালা আরও বেশি করেই জ্বলে উঠল আমার বাবার নাম শুনে। ফোন রাখার পরে কি করেছি ঠিক মনে নেই। মাথা ঝিমঝিম করছিল ভীষণ ভাবেই। সোফার ওপরেই ধপ করে পরে গেলাম, সেখানেই মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পরে ওই সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পরেরদিন অফিস থেকে সোজা মামা বাড়ি। বাড়িতে পা রাখতেই মামিমা ভীষণ বকাঝকা শুরু করে দিলেন। এত বড় ছেলে কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই, একা একা থাকিস কিছু একটা হয়ে গেলে কে দেখবে। তারপরে কিছুক্ষন মামার অবর্তমানেই মামার মুন্ডপাত করা হল, কেন মরতে যে ছেলেটাকে ওইখানে পাঠিয়ে দিল। সেদিন বুঝালাম মামিমা আমাকে খুব ভালোবাসে। এমন নয় যে আমার মাকে মনে নেই। মাকে ভালো করেই মনে আছে তবে মা মারা যাওয়ার পর মামিমার কাছেই মানুষ হয়েছি।
রাতে খাওয়ার পরে মামিমা আমার ঘরে এসে বললেন “গতকাল বিকেলে সুবির, তোর বাবা ফোন তোর মামাকে ফোন করেছিল। বুধো তোর বাবা কালকে তোর মামার কাছে কাঁদছিল রে।”
চোয়াল শক্ত হয়ে গেল সেই শুনে। চাপা ক্রোধ ভরা গলায় বললাম, “তা আমি কি করব।”
মামিমা বললেন, “তোকে একবার ফোন করতে বলেছে।”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি আমার ফোন নাম্বার দাওনি তো?”
মামিমা মাথা নাড়লেন, “না তোর ফোন নাম্বার দেয়নি তোর মামা। তবে সুবির নিজের ফোন নাম্বার দিয়েছে আমাদের।”
আমি মাথা নাড়লাম, “আচ্ছা দেখা যাবে।”
মামিমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “দেখ বাবা, সবার অনেক বয়স হয়েছে। একবার কথা বলে দেখ। কি বলতে চায় সেটা শোন। কথা বলতে ক্ষতি কোথায়? সবাই একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে। তাও শেষ বেলায় পুরানো ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে একটা অন্তত সুযোগ দেওয়া উচিত।”
আমি মামিমার দিকে তাকিয়ে বললাম, “মা চলে যাওয়ার পরে তোমার কাছে মানুষ হয়েছি...”
মামিমা মৃদু হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তো একটা ফোন করলেই কি আমার ছেলে পর হয়ে যাবে নাকি? আমি কি এমনি এমনি ছেড়ে দেব?”
আমি হেসে মামিমাকে জড়িয়ে ধরলাম, “না না একদম না।”
আমার কান টেনে ধরে স্নেহ ভরা শাসন করে বললেন, “ওই ছাইপাঁশ গেলা ছাড়। তোর মামা শুনলে খুব রাগারাগি করবে।”
আমিও বললাম, “আরে না গো, রোজদিন তো খাই না। এই মাঝে মধ্যে এই আর কি।”