23-03-2019, 12:56 PM
রাহুলের মুখে ক্ষনিকের জন্য হাঁসি ফুটে ওঠে। আবার মিলিয়ে যায়।
"টক.টক.." হঠাং দরজায় নক হয়।
"রাহুল.."
"হ্যাঁ, এসো.."
"রাহুল আজে আমাকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস বেরুতে হবে। তুমি তোমার ব্রেকফাস্ট নিজে বানিয়ে খেয়ে নিও।"
"আচ্ছা, কিন্তু সারা.."
"বলো.."
"আজ রাতের ফ্লাইটে আমাকে ইন্ডিয়া যেতে হবে, অফিসের কিছু কাজের জন্য।"
"খুব জরুরি?"
"হ্যাঁ, এইমাত্র অফিস থেকে ফোন এসেছিল।"
"আচ্ছা, তাহলে সন্ধ্যায় দেখা হবে এয়ারপোর্টে।"
"তুমি আবার কষ্ট করতে যাবে কেন?"
"ওসব কথা রাখো, কটায় এয়ারপোর্টে যাবে বলো।"
"ছটার সময়.."
"আচ্ছা তাহলে এখন আসি.."
"এসো.."
সারা বেড়িয়ে যেতে রাহুল তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নেয়। তারপর কিচেনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে খেয়ে নেয়। তারপর জামাকাপড়, ফাইলপত্র সব গুছিয়ে নেয়।
সন্ধা ছটায়, রাহুল আর সারা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে..
সারা,"রাহুল আমি তোমাকে খুব মিস করবো।"
রাহুল,"আমিও" বলে দুজনে একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে।
সারা," নিজের খেয়াল রেখো"
রাহুল,"হ্যাঁ রাখবো, তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।"
সারা,"হুম" বলে রাহুলের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়,"রাহুল ইউ আর দ্যা বেষ্ট পারশন আই এভার মেট ইন মাই লাইফ.. গুড বাই।"
রাহুল কিছু বলে না। শুধু একটু হাঁসে। তারপর 'বাই' বলে সারার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে সিকিউরিটি এরিয়ার ভিতরে চলে যায়।
বাইরে সারা কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাহুলের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। তারপর এয়ার পোর্ট থেকে বেড়িয়ে যায়।
রাহুল ভিতরে ঢুকে চেক ইন করে একটা সিটের উপর বসে পড়ে। ফ্লাইটের এখনও একটু দেরি ছিল। বসে বসে ভাবতে থাকে দেশের মাটিতে কাটানো সময়গুলোর কথা।
রাহুল বেঞ্চে বসে একটু অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল। তাই কিছু দূরে রাখা একটা কলাম এর কাছে গেল। সেখানে কিছু বিদেশী ম্যগাজিন রাখা ছিল। রাহুল একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখতে লাগলো। কিন্তু ওতে লেখা কিছু পড়ছিল না। ওর মন ছিল অন্যত্র।
এভাবে কিছুক্ষন কাটানোর পর রাহুল ম্যাগাজিন বন্ধ করে আবার ওখানেই রেখে দিল। তারপর ঘুরে সামনের দিকে তাকাল। সামনের দিকে তাকাতেই রাহুল চমকে উঠল।
রাহুলের চোখের ঠিক সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, বেশ জোরে জোরে হাঁসছিল মেয়েটা। হাঁসিতে ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল সারা মুখে। যেন মুক্ত ছড়িয়ে দিচ্ছিল সারা অঞ্চল জুড়ে। হাঁসতে হাঁসতে কিছু ইংরেজদের সাথে কথা বলছিল। মেয়েটিকে দেখে রাহুলের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। যেন অনেক বছর পরে দেহে প্রান ফিরে এল।
"ইশি" রাহুলের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল ওর দেওয়া সেই মিষ্টি নামটি। খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল ইশিকার হাঁসি মুখটা। রাহুল নিস্পলক তাকিয়ে ছিল ইশিকার দিকে। এই নিস্পাপ হাঁসি মুখটারই প্রেমে পড়েছিল রাহুল একদিন। এখনও ভুলতে পারেনি এই মুখটাকে
হঠাং ইশিকার নজরও পড়ল রাহুলের উপর। ইশিকাও বোধ হয় রাহুলকে আশা করেনি। কিন্তু রাহুলকে দেখে ইশিকার মুখে রাহুলের মতো হাঁসি ফুটে উঠল না। বরং ধীরে ধীরে হাঁসি চলে গেল ইশিকার মুখ থেকে।
রাহুলের পা আপনা থেকেই চলতে লাগলো ইশিকার দিকে। ইশিকার খুব কাছ এসে দাঁড়িয়ে গেল রাহুল। দুজনেই নস্পলক তাকিয়ে রইল একে অপরের চোখের দিকে। যেন খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু। চোখে চোখে আদান প্রদান হল অনেক কিছু। রাহুল বোধ হয় মুখেও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মাইকে ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্ট হয়ে যায়। ইশিকা নিজের ব্যাগ উঠিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় ফ্লাইটের দিকে। রাহুল স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ইশিকার চলে যাওয়া। রাহুর চেঁচিয়ে দাঁড় করাবার চেষ্টা করে ইশিকাকে। কিন্তু মুখ দিয়ে আওয়াজ বেড়োয় না। মনে পড়ে যায় ইশিকার দেওয়া দিব্যির কথা।
কিছুক্ষন স্থবিরের দাঁড়িয়ে থাকার পর রাহুলও এগিয়ে যায় ফ্লাইটের দিকে। ফ্লাইটের ভিতরে ঢুকে টিকিট দেখে নিজের সিট কনফার্ম করে। তারপর সিটের দিকে এগিয়ে যায়।
রাহুল নিজের সিটে বসতে যাচ্ছিল। হঠাং চোখ পড়ে ইশিকার ওপরে। ইশিকা জানালার ধারে একটা সিটে বসে হেঁসে হেঁসে কথা বলছিল কারো সাথে। রাহুল ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ইশিকাকে দেখতে দেখতে আরও একবার ওই সুন্দর মুখটার মধ্যে হারিয়ে যায়। সেই চেনা মুখ, পড়ন্ত যৌবনের ছাপ পড়েছে মুখে। কিন্তু আগের মতোই মায়া ধরানো, আগের মতোই উজ্জ্বল। এই মুখটাকে দেখার জন্যই এত বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল, এই মুখটাকে দেখার জন্যই ওর আবার দেশের মাটিতে আসা।
রাহুল একইভাবে দাঁড়িয়ে ইশিকাকে নিরিক্ষন করছিল। তখনই ইশিকার চোখ পড়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাহুলের উপর। কিন্তু রাহুলকে অবাক করে দিয়ে, ওর মুখে লেগে থাকা হাঁসি আবার মিলিয়ে যায়। রাহুলের মনে কু গেয়ে ওঠে। তবে কি ইশিকা অন্যকারো হয়ে গেছে? রাহুল ভাবতে পারে না, মুখ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়। কিন্তু তার আগেই মাইকে এনাউন্সমেন্টে হয়,"দ্যা ফ্লাইট ইজ গোইং টু টেক অফ। প্যাসেঞ্জার্স আর রিকোয়াস্টেড টু সিট ডাউন অন দেয়ার ওন সিট এন্ড টাইট দেয়ার সিট বেল্ট।"
রাহুল ব্যাগ হাতে ইশিকার অপর সারিতে একটা সিট পিছনে বসে পড়ে। একবার ইশিকার দিকে তাকায়। তারপর ল্যাপটপ খুলে মেল চেক করতে থাকে।
এদিকে ইশিকার চোখের কোনাতেও এক ফোঁটা জল চলে এসেছিল রাহুলের কথা ভেবে। ওর মনের মধ্যেও চলছিল প্রবল ঝড়। কিন্তু চোখের জলকে আমল না দিয়ে বাঁ হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে সিটের আলো নিভিয়ে দেয়।
রাহুলের মেল চেক করা হয়ে গেলে ফটোগুলো খুলে একবার দেখছিল। ওই ফটোগুলোর মধ্যে ছিল ওর দেশের মাটিতে কাটানো সব স্মৃতি। একটা ফটোতে এসে রাহুল থেমে গেল। যেটায় ইশিকা ওর কান মুলে দিচ্ছিল আর রাহুল হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছিল। এটা পরীক্ষার পরে সবাই মিলে ট্রিপে গিয়ে তুলেছিল। রাহুলের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। হাঁসির সাথে সাথে চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। মনে মনে বলল,"ওই ট্রিপের কথা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো না ইশিকা।"
রাহুল পকেট থেকে রুমাল বের করে ল্যাপটপের স্ক্রিনটা পরিষ্কার করল। তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। মুখ ঘুড়িয়ে পাশের সারিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ইশিকার সিটের আলো নিভে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দশটা বাজে। রাহুল নিজের সিটের আলো অফ করে সিটের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। কাল সারা রাত বিছানায় ছটফট করেছিল, ভালো করে ঘুম হয়নি। তাই মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় চলা সত্বেও তলিয়ে গেল ঘুমের মধ্যে। আবার রাহুলের ঘুমন্ত অবচেতন মনকে গ্রাস করে নিল অতীতের কিছু স্মৃতি...
"দ্যা ফ্লাইট ইজ গোইং টু ল্যান্ড অন নেতাজি সুভাস এয়ারপোর্ট। প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়েস্টেড টু টাইট দেয়ার সিট বেল্ট।"
মাইকের এনাউন্সমেন্টে রাহুলের ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখে বিমানের ভিতর রয়েছে। দুহাত দিয়ে চোখ রগড়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খায়। তারপর ধীরে ধীরে মনে পড়ে গত রাতের কথা। ইশিকার কথা মনে পড়তেই আবার বুক কেঁপে ওঠে রাহুল। চকিতে ঘুরে তাকায় ইশিকার সিটের দিকে। ইশিকা আগেই উঠে পড়েছিল আর পাশের লোকটির সাথে কথা বলছিল। কাল রাতে হেঁসে হেঁসে কথা বলছিল দুজনে। কিন্তু এখন দুজনের মুখই একটু থমথমে। দুজনে কী কথা বলছে রাহুল শোনার চেষ্টা করলো।
"বেটি এবার আমাদের নামতে হবে। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল। আর ওই ছেলেটা রাহুল, খুব দুঃখ পেয়েছিল মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় ওর একটা ছোটো ভুল মাফ করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা খারাপ ছিল না। আমার মনে হয় তুমিও ওকে খুব ভালোবাসো, নাহলে তুমি এখনও সংসার না করে কেন ওর অপেক্ষায় জীবন কাটাচ্ছ। ও এখন কোথায় আছে তোমার জানা আছে? আবার যদি কোনোদিন দেখা হয়, ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না যেন।"
লোকটার এত কিছু প্রশ্নের উত্তরে ইশিকা শুধু বলল,"আচ্ছা.."। বলবার ছিল অনেক কিছু। আঙুল দেখিয়ে বলতে চেয়েছিল,"ওই দেখুন আপনার পিছনে যে ছেলেটি বসে আছে, ওর নাম রাহুল... ওকেই আমি ভালোবাসি। কিন্তু বলতে পারে না। বিবেক এসে বাধা দেয়। যদি রাহুল বিয়ে করে থাকে, যদি রাহুল স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে থাকে... তাহলে ও কেন ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগাতে যাবে... ওতো রাহুলের অমঙ্গল চায়না, ওতো চায়না ওর জন্য আরও একটি মেয়ের সর্বনাশ হোক। দোষ তো ওরই ছিল... ওই তো রাহুলের একটা ছোটো ভুলকে ক্ষমা না করে রাহুলকে ওর জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আজ যদি রাহুল ওর সামনে এসে ওকে জবাবদিহি করে,"কেন সেদিন আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে ইশি? আমি কি তোমাকে ভালোবেসে পাপ করেছিলাম?" তখন কী উত্তর দেবে ইশিকা... তার থেকে ভালো রাহুলের থেকে দূরে দূরে থাকা, রাহুলের প্রতি ওর ভালোবাসাকে বুকে পাথর দিয়ে চেপে রেখে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া।
এদিকে রাহুল মনোযোগ দিয়ে ওই লোকটার কথা শুনছিল। ইশিকা হয়তো খেয়াল করেনি যে রাহুল ঘুম ভেঙে গেছে। লোখটির কথার মানে উদ্ধার করে রাহুলের দেহে প্রান ফিরে আসে, মন নেচে এক খুশির ঝরনায়, হৃতস্পন্দন বেড়ে ওঠে উত্তেজনায়। মুখে ফুটে ওঠে হাঁসি, বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া সেই হাঁসি.। ইশিকা ওকে এখনও আগের মতো ভালোবাসে, ইশিকা এতদিন অপেক্ষা করেছে ওর জন্য। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর হারিয়ে যেতে দেবে না ইশিকাকে, যেমন করে হোক ফিরিয়ে আনবে নিজের কাছে, চেপে ধরে রাখবে বুকের দুই পাঁজরের মাঝে।
কাল রাতে উত্তেজনার বসে পাশে বসে থাকা লোকটির দিকে লক্ষ করেনি, আজ ভালো করে দেখে বুঝতে পারে, ওর সন্দেহ সম্পুর্ন ভুল, লোকটি ইশিকার থেকে অনেক বড়ো।
ভাবতে ভাবতে প্লেন ল্যান্ড করে দেশের মাটিতে। ইশিকা দেখে রাহুল মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। এই সুযোগ পালিয়ে যাওয়ার। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। ইশিকা কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে রাহুলের চোখ এড়িয়ে দ্রুত নেমে যায় প্লেন থেকে।
রাহুল মাথা নিচু করে ইশিকাকে কীভাবে আটকাবে সেই কথা ভাবছিল। কারন ইশিকা যে ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে সেটা নিশ্চিত। কখন যে প্লেন নেমে গেছে বুঝতেই পারেনি। হঠাং খেয়াল হতেই চকিতে ইশিকার সিটের দিকে তাকিয়ে চমতে ওঠে রাহুল। ইশিকা ওর সিটে নেই। তার মানে ইশিকা নেমে গেছে প্লেন থেকে। কিন্তু ইশিকা ওর সাথে কোনো কথা না বলে চলে গেল কেন? ওকি ভাবছে রাহুল আর ওকে ভালোবাসে না? এখন ভাববার সময় নেই... যে করে হোক আটকাতে হবে ইশিকাকে। আজ যদি না আটকাতে পারে তাহলে হয়তো আর কোনো দিনই ইশিকাকে নিজের করে নিতে পারবে না।
"টক.টক.." হঠাং দরজায় নক হয়।
"রাহুল.."
"হ্যাঁ, এসো.."
"রাহুল আজে আমাকে একটু তাড়াতাড়ি অফিস বেরুতে হবে। তুমি তোমার ব্রেকফাস্ট নিজে বানিয়ে খেয়ে নিও।"
"আচ্ছা, কিন্তু সারা.."
"বলো.."
"আজ রাতের ফ্লাইটে আমাকে ইন্ডিয়া যেতে হবে, অফিসের কিছু কাজের জন্য।"
"খুব জরুরি?"
"হ্যাঁ, এইমাত্র অফিস থেকে ফোন এসেছিল।"
"আচ্ছা, তাহলে সন্ধ্যায় দেখা হবে এয়ারপোর্টে।"
"তুমি আবার কষ্ট করতে যাবে কেন?"
"ওসব কথা রাখো, কটায় এয়ারপোর্টে যাবে বলো।"
"ছটার সময়.."
"আচ্ছা তাহলে এখন আসি.."
"এসো.."
সারা বেড়িয়ে যেতে রাহুল তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে ফ্রেস হয়ে নেয়। তারপর কিচেনে গিয়ে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে খেয়ে নেয়। তারপর জামাকাপড়, ফাইলপত্র সব গুছিয়ে নেয়।
সন্ধা ছটায়, রাহুল আর সারা এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে..
সারা,"রাহুল আমি তোমাকে খুব মিস করবো।"
রাহুল,"আমিও" বলে দুজনে একে অপরের গলা জড়িয়ে ধরে।
সারা," নিজের খেয়াল রেখো"
রাহুল,"হ্যাঁ রাখবো, তুমিও নিজের খেয়াল রেখো।"
সারা,"হুম" বলে রাহুলের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়,"রাহুল ইউ আর দ্যা বেষ্ট পারশন আই এভার মেট ইন মাই লাইফ.. গুড বাই।"
রাহুল কিছু বলে না। শুধু একটু হাঁসে। তারপর 'বাই' বলে সারার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে সিকিউরিটি এরিয়ার ভিতরে চলে যায়।
বাইরে সারা কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাহুলের চলে যাওয়া দেখতে থাকে। তারপর এয়ার পোর্ট থেকে বেড়িয়ে যায়।
রাহুল ভিতরে ঢুকে চেক ইন করে একটা সিটের উপর বসে পড়ে। ফ্লাইটের এখনও একটু দেরি ছিল। বসে বসে ভাবতে থাকে দেশের মাটিতে কাটানো সময়গুলোর কথা।
রাহুল বেঞ্চে বসে একটু অধৈর্য হয়ে যাচ্ছিল। তাই কিছু দূরে রাখা একটা কলাম এর কাছে গেল। সেখানে কিছু বিদেশী ম্যগাজিন রাখা ছিল। রাহুল একটা ম্যাগাজিন তুলে নিয়ে পাতা উল্টে উল্টে দেখতে লাগলো। কিন্তু ওতে লেখা কিছু পড়ছিল না। ওর মন ছিল অন্যত্র।
এভাবে কিছুক্ষন কাটানোর পর রাহুল ম্যাগাজিন বন্ধ করে আবার ওখানেই রেখে দিল। তারপর ঘুরে সামনের দিকে তাকাল। সামনের দিকে তাকাতেই রাহুল চমকে উঠল।
রাহুলের চোখের ঠিক সামনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে, বেশ জোরে জোরে হাঁসছিল মেয়েটা। হাঁসিতে ঝিলিক খেলে যাচ্ছিল সারা মুখে। যেন মুক্ত ছড়িয়ে দিচ্ছিল সারা অঞ্চল জুড়ে। হাঁসতে হাঁসতে কিছু ইংরেজদের সাথে কথা বলছিল। মেয়েটিকে দেখে রাহুলের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। যেন অনেক বছর পরে দেহে প্রান ফিরে এল।
"ইশি" রাহুলের মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেড়িয়ে এল ওর দেওয়া সেই মিষ্টি নামটি। খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল ইশিকার হাঁসি মুখটা। রাহুল নিস্পলক তাকিয়ে ছিল ইশিকার দিকে। এই নিস্পাপ হাঁসি মুখটারই প্রেমে পড়েছিল রাহুল একদিন। এখনও ভুলতে পারেনি এই মুখটাকে
হঠাং ইশিকার নজরও পড়ল রাহুলের উপর। ইশিকাও বোধ হয় রাহুলকে আশা করেনি। কিন্তু রাহুলকে দেখে ইশিকার মুখে রাহুলের মতো হাঁসি ফুটে উঠল না। বরং ধীরে ধীরে হাঁসি চলে গেল ইশিকার মুখ থেকে।
রাহুলের পা আপনা থেকেই চলতে লাগলো ইশিকার দিকে। ইশিকার খুব কাছ এসে দাঁড়িয়ে গেল রাহুল। দুজনেই নস্পলক তাকিয়ে রইল একে অপরের চোখের দিকে। যেন খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে হারিয়ে যাওয়া অনেক কিছু। চোখে চোখে আদান প্রদান হল অনেক কিছু। রাহুল বোধ হয় মুখেও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই মাইকে ফ্লাইটের এনাউন্সমেন্ট হয়ে যায়। ইশিকা নিজের ব্যাগ উঠিয়ে দ্রুত পালিয়ে যায় ফ্লাইটের দিকে। রাহুল স্থবিরের মতো দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে ইশিকার চলে যাওয়া। রাহুর চেঁচিয়ে দাঁড় করাবার চেষ্টা করে ইশিকাকে। কিন্তু মুখ দিয়ে আওয়াজ বেড়োয় না। মনে পড়ে যায় ইশিকার দেওয়া দিব্যির কথা।
কিছুক্ষন স্থবিরের দাঁড়িয়ে থাকার পর রাহুলও এগিয়ে যায় ফ্লাইটের দিকে। ফ্লাইটের ভিতরে ঢুকে টিকিট দেখে নিজের সিট কনফার্ম করে। তারপর সিটের দিকে এগিয়ে যায়।
রাহুল নিজের সিটে বসতে যাচ্ছিল। হঠাং চোখ পড়ে ইশিকার ওপরে। ইশিকা জানালার ধারে একটা সিটে বসে হেঁসে হেঁসে কথা বলছিল কারো সাথে। রাহুল ওখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে। ইশিকাকে দেখতে দেখতে আরও একবার ওই সুন্দর মুখটার মধ্যে হারিয়ে যায়। সেই চেনা মুখ, পড়ন্ত যৌবনের ছাপ পড়েছে মুখে। কিন্তু আগের মতোই মায়া ধরানো, আগের মতোই উজ্জ্বল। এই মুখটাকে দেখার জন্যই এত বছর ধরে অপেক্ষা করেছিল, এই মুখটাকে দেখার জন্যই ওর আবার দেশের মাটিতে আসা।
রাহুল একইভাবে দাঁড়িয়ে ইশিকাকে নিরিক্ষন করছিল। তখনই ইশিকার চোখ পড়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাহুলের উপর। কিন্তু রাহুলকে অবাক করে দিয়ে, ওর মুখে লেগে থাকা হাঁসি আবার মিলিয়ে যায়। রাহুলের মনে কু গেয়ে ওঠে। তবে কি ইশিকা অন্যকারো হয়ে গেছে? রাহুল ভাবতে পারে না, মুখ বাড়িয়ে কিছু বলতে যায়। কিন্তু তার আগেই মাইকে এনাউন্সমেন্টে হয়,"দ্যা ফ্লাইট ইজ গোইং টু টেক অফ। প্যাসেঞ্জার্স আর রিকোয়াস্টেড টু সিট ডাউন অন দেয়ার ওন সিট এন্ড টাইট দেয়ার সিট বেল্ট।"
রাহুল ব্যাগ হাতে ইশিকার অপর সারিতে একটা সিট পিছনে বসে পড়ে। একবার ইশিকার দিকে তাকায়। তারপর ল্যাপটপ খুলে মেল চেক করতে থাকে।
এদিকে ইশিকার চোখের কোনাতেও এক ফোঁটা জল চলে এসেছিল রাহুলের কথা ভেবে। ওর মনের মধ্যেও চলছিল প্রবল ঝড়। কিন্তু চোখের জলকে আমল না দিয়ে বাঁ হাতের তালুর উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে সিটের আলো নিভিয়ে দেয়।
রাহুলের মেল চেক করা হয়ে গেলে ফটোগুলো খুলে একবার দেখছিল। ওই ফটোগুলোর মধ্যে ছিল ওর দেশের মাটিতে কাটানো সব স্মৃতি। একটা ফটোতে এসে রাহুল থেমে গেল। যেটায় ইশিকা ওর কান মুলে দিচ্ছিল আর রাহুল হাত জোড় করে ক্ষমা চাইছিল। এটা পরীক্ষার পরে সবাই মিলে ট্রিপে গিয়ে তুলেছিল। রাহুলের মুখে হাঁসি ফুটে উঠল। হাঁসির সাথে সাথে চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। মনে মনে বলল,"ওই ট্রিপের কথা আমি কোনোদিনও ভুলতে পারবো না ইশিকা।"
রাহুল পকেট থেকে রুমাল বের করে ল্যাপটপের স্ক্রিনটা পরিষ্কার করল। তারপর ল্যাপটপ বন্ধ করে ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। মুখ ঘুড়িয়ে পাশের সারিতে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল ইশিকার সিটের আলো নিভে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত দশটা বাজে। রাহুল নিজের সিটের আলো অফ করে সিটের ওপর গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো। কাল সারা রাত বিছানায় ছটফট করেছিল, ভালো করে ঘুম হয়নি। তাই মনের মধ্যে প্রচন্ড ঝড় চলা সত্বেও তলিয়ে গেল ঘুমের মধ্যে। আবার রাহুলের ঘুমন্ত অবচেতন মনকে গ্রাস করে নিল অতীতের কিছু স্মৃতি...
"দ্যা ফ্লাইট ইজ গোইং টু ল্যান্ড অন নেতাজি সুভাস এয়ারপোর্ট। প্যাসেঞ্জারস আর রিকোয়েস্টেড টু টাইট দেয়ার সিট বেল্ট।"
মাইকের এনাউন্সমেন্টে রাহুলের ঘুম ভাঙে। চোখ খুলে দেখে বিমানের ভিতর রয়েছে। দুহাত দিয়ে চোখ রগড়ে ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে জল খায়। তারপর ধীরে ধীরে মনে পড়ে গত রাতের কথা। ইশিকার কথা মনে পড়তেই আবার বুক কেঁপে ওঠে রাহুল। চকিতে ঘুরে তাকায় ইশিকার সিটের দিকে। ইশিকা আগেই উঠে পড়েছিল আর পাশের লোকটির সাথে কথা বলছিল। কাল রাতে হেঁসে হেঁসে কথা বলছিল দুজনে। কিন্তু এখন দুজনের মুখই একটু থমথমে। দুজনে কী কথা বলছে রাহুল শোনার চেষ্টা করলো।
"বেটি এবার আমাদের নামতে হবে। তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল। আর ওই ছেলেটা রাহুল, খুব দুঃখ পেয়েছিল মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় ওর একটা ছোটো ভুল মাফ করে দেওয়া উচিত ছিল তোমার। তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে ছেলেটা খারাপ ছিল না। আমার মনে হয় তুমিও ওকে খুব ভালোবাসো, নাহলে তুমি এখনও সংসার না করে কেন ওর অপেক্ষায় জীবন কাটাচ্ছ। ও এখন কোথায় আছে তোমার জানা আছে? আবার যদি কোনোদিন দেখা হয়, ওকে দূরে সরিয়ে দিয়ো না যেন।"
লোকটার এত কিছু প্রশ্নের উত্তরে ইশিকা শুধু বলল,"আচ্ছা.."। বলবার ছিল অনেক কিছু। আঙুল দেখিয়ে বলতে চেয়েছিল,"ওই দেখুন আপনার পিছনে যে ছেলেটি বসে আছে, ওর নাম রাহুল... ওকেই আমি ভালোবাসি। কিন্তু বলতে পারে না। বিবেক এসে বাধা দেয়। যদি রাহুল বিয়ে করে থাকে, যদি রাহুল স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখে থাকে... তাহলে ও কেন ওদের সুখের সংসারে আগুন লাগাতে যাবে... ওতো রাহুলের অমঙ্গল চায়না, ওতো চায়না ওর জন্য আরও একটি মেয়ের সর্বনাশ হোক। দোষ তো ওরই ছিল... ওই তো রাহুলের একটা ছোটো ভুলকে ক্ষমা না করে রাহুলকে ওর জীবন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। আজ যদি রাহুল ওর সামনে এসে ওকে জবাবদিহি করে,"কেন সেদিন আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে ইশি? আমি কি তোমাকে ভালোবেসে পাপ করেছিলাম?" তখন কী উত্তর দেবে ইশিকা... তার থেকে ভালো রাহুলের থেকে দূরে দূরে থাকা, রাহুলের প্রতি ওর ভালোবাসাকে বুকে পাথর দিয়ে চেপে রেখে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া।
এদিকে রাহুল মনোযোগ দিয়ে ওই লোকটার কথা শুনছিল। ইশিকা হয়তো খেয়াল করেনি যে রাহুল ঘুম ভেঙে গেছে। লোখটির কথার মানে উদ্ধার করে রাহুলের দেহে প্রান ফিরে আসে, মন নেচে এক খুশির ঝরনায়, হৃতস্পন্দন বেড়ে ওঠে উত্তেজনায়। মুখে ফুটে ওঠে হাঁসি, বহুকাল আগে হারিয়ে যাওয়া সেই হাঁসি.। ইশিকা ওকে এখনও আগের মতো ভালোবাসে, ইশিকা এতদিন অপেক্ষা করেছে ওর জন্য। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, আর হারিয়ে যেতে দেবে না ইশিকাকে, যেমন করে হোক ফিরিয়ে আনবে নিজের কাছে, চেপে ধরে রাখবে বুকের দুই পাঁজরের মাঝে।
কাল রাতে উত্তেজনার বসে পাশে বসে থাকা লোকটির দিকে লক্ষ করেনি, আজ ভালো করে দেখে বুঝতে পারে, ওর সন্দেহ সম্পুর্ন ভুল, লোকটি ইশিকার থেকে অনেক বড়ো।
ভাবতে ভাবতে প্লেন ল্যান্ড করে দেশের মাটিতে। ইশিকা দেখে রাহুল মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে। এই সুযোগ পালিয়ে যাওয়ার। যেমনি ভাবা, তেমনি কাজ। ইশিকা কাঁধে ব্যাগ উঠিয়ে রাহুলের চোখ এড়িয়ে দ্রুত নেমে যায় প্লেন থেকে।
রাহুল মাথা নিচু করে ইশিকাকে কীভাবে আটকাবে সেই কথা ভাবছিল। কারন ইশিকা যে ওর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে সেটা নিশ্চিত। কখন যে প্লেন নেমে গেছে বুঝতেই পারেনি। হঠাং খেয়াল হতেই চকিতে ইশিকার সিটের দিকে তাকিয়ে চমতে ওঠে রাহুল। ইশিকা ওর সিটে নেই। তার মানে ইশিকা নেমে গেছে প্লেন থেকে। কিন্তু ইশিকা ওর সাথে কোনো কথা না বলে চলে গেল কেন? ওকি ভাবছে রাহুল আর ওকে ভালোবাসে না? এখন ভাববার সময় নেই... যে করে হোক আটকাতে হবে ইশিকাকে। আজ যদি না আটকাতে পারে তাহলে হয়তো আর কোনো দিনই ইশিকাকে নিজের করে নিতে পারবে না।