07-01-2021, 09:22 PM
পর্ব এক (#5-#5)
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনে গেলাম। একের পর এক টপাটপ দুটো মুখের মধ্যে পুরে নিল তিতলি। কষ বেয়ে কিছুটা জল বেড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই। ফুচকা খেতে খেতে গোলাপি নরম গাল ফুলে গেছে। ইসস উফফ করছে ঝালে তাও চেহারায় এক ভীষণ খুশির ছটা। ঝালের জন্য চোখের কোল বেয়ে জল বেড়িয়ে আসার যোগার, তাও রূপসী ললনার ফুচকা খাওয়া চাই।
আমি ওকে বললাম, “বেশি খেও না।”
কে কার কথা শোনে, উলটে আমাকেই একটা ধ্যাতানি দিল, “চুপচাপ দাঁড়াও, অনেক দিন পরে খাচ্ছি।” তারপরের ফুচকাটা আমার দিকে উঁচিয়ে ধরে বলল, “এই নাও খাও একটা।”
অগত্যা ওই ভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের হাত থেকে প্রথমবার ফুচকা খাওয়া ভেবেই আমার গা হাত পা শুকিয়ে গেল। প্রেম কেন জীবনে এর আগে এইভাবে কোন মেয়ের সাথে ঘুরতে পর্যন্ত বের হইনি। আর প্রথম বারেই এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে ফুচকা খাওয়াবে বলছে ভেবেই আমার ভীষণ অসস্থি বোধ হল। সেদিকে তিতলির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
সরু পেলব চাঁপার কলি আঙ্গুল দিয়ে ফুচকা আমার মুখের সামনে ধরে কাতর কন্ঠে বলে ওঠে, “নাও না, কি করছ। জল সব পরে গেল যে।”
আমি ওর হাত থেকে ফুচকা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। ওইভাবে কেউ আমাকে রাস্তার মাঝে খাইয়ে দেবে ভাবতেই ভীষণ বিব্রতবোধ করছিলাম।
আমি ফুচকা নিয়ে ওকে বললাম, “তুমি খাও আমি তোমার দোনা থেকেই খেয়ে নেব।”
টপ করে পরের ফুচকাটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে আমাকে বলল, “এর পরেরটা তোমার কিন্তু।”
আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না, “আচ্ছা বাবা, কিন্তু তাড়াতাড়ি খেও। আকাশের অবস্থা কিন্তু একদম ভালো নয়।”
দুইজনে মিলে দশ টাকার ফুচকা খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “উফফ কি শান্তি।”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ বুঝলাম। এবারে বাড়ি যাওয়া যাক।”
বাচ্চা মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
বাইকে উঠে যথারীতি বাড়ির পথ ধরলাম। আমাকে দুই হাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরল তিতলি। সারা পিঠে শুধু একটা নরম উষ্ণ পরশ ছাড়া আর কিছুই নেই। মনে হল যেন আমার পিঠে জামাটাও নেই। মনে হল শুধু তিতলির শরীর আমার পিঠের ওপরে গলে গিয়ে মধুর প্রলেপ লাগিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁকুড়গাছি মোড় পর্যন্ত চুপচাপ আমার পিঠের ওপরে নিজেকে ঢেলে, কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে চুপচাপ বসেছিল। কাঁকুড়গাছি মোড় আসতেই ইন্সটিটিউটের দেখা পেল।
দেখা পেতেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কাল আসবে তো? নাকি সাইটে যাওয়ার আছে?”
আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলাম, “কাল সাইটে যাওয়ার আছে। জানি না কখন ফিরব।”
জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সাইট?”
আমি উত্তর দিলাম, “জোকা।”
একটু মনমরা হয়েই উত্তর দিল তিতলি, “অনেক দুর তো।”
সত্যি অনেক দুর। সাইটে গিয়ে সব কিছু দেখে শুনে আবার অফিস এসে একটা রিপোর্ট বানাতে হবে। জানি না পরেরদিন কখন ছুটি পাবো। মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল আমার। সেই সাথে আকাশ গুড়গুড় চড়চড় করা শুরু করে দিল। ঝোড় হাওয়া বইতে শুরু করে দিল। তিতলির রেশমি চুল উড়ে এসে আমার হেলমেটের সামনে বার বার চলে আসছে। প্রানপনে আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে তিতলি। উল্টোডাঙ্গা পার হতেই ঝড় উঠে গেল।
তিতলি ভয়ে ভয়ে আমার কানে বলল, “আদি কি হবে?”
আমি ওকে অভয় দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, “এই তিতলি, চিন্তা করো না। বৃষ্টি আসার আগেই তোমাকে কাজিপাড়া পৌঁছে দেব।” চেঁচাতে এইজন্য হল কারণ আমার মাথায় হেলমেট আর চারপাশে ঝড় হাওয়া।
পাগলের মতন বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। বাসের পাশ ঘেঁষে, গাড়ির পাশ কাটিয়ে বাইক ছুটে চলেছে। মনে হল যেন ফরমুলা ওয়ান রেস করছি। লেকটাউন থেকে যশোর রোডে বাঁক নেওয়ার সময়ে পুরো বাইক ডান দিকে কাত করে দুটো বাসের মাঝখান থেকে বের করে দিয়ে একটা টাক্সির কানের পাশ একদম ঘেঁষে বেড়িয়ে গেলাম। তিতলিকে আমাকে প্রানপনে জড়িয়ে ধরে। দশ মিনিট লাগলো, উল্টোডাঙ্গা থেকে কাজিপাড়া পৌঁছাতে। উত্তেজনায় তিতলির হৃদপিণ্ড গলার কাছে আটকে গেছিল। ওর বুকের তীব্র ধুকপুকানি পিঠের ওপরে অনুভব করতে পারছিলাম। আমার চোখের সামনে তখন শুধু মাত্র একটা লাল ফিতে, কাজি পাড়ার মোড়, তিতলির বাড়ির গলির মুখ। বাইক থামাতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তিতলি বাইক থেকে নেমে ব্যাগ থেকে ছাতা বার করে খুলে নিল।
আমি ওকে বাড়ি চলে যেতে বললাম, “আর দাঁড়াতে হবে না যাও।” সে মেয়ে কি আর কথা শোনে নাকি, সেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন। আমি ওকে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন দেরি হচ্ছে না?”
মাথা নাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “থ্যাঙ্কস ফর ফুচকা।”
আমি আকাশের দিকে তাকালাম, ধিরে ধিরে বৃষ্টির ধারা বাড়তে শুরু করেছে। আমি ওকে মুচকি হেসে বললাম, “ওরে পাগলি মেয়ে, বাড়ি যাও।”
বুকের কাছে ব্যাগ চেপে ধরে, দুই হাতে ছাতা ধরে আমাকে বলল, “তোমার ফোন নাম্বার।”
আমি ওকে বললাম, “কাল দেবো। তুমি এখন যাও না হলে ভিজে যাবে।”
মুখ শুকনো হয়ে গেল আমার কথা শুনে, একটু পরে হেসে বলল, “কাল তাড়াতাড়ি এসো।”
আমি মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ। এবারে যাও।”
হেসে ফেললাম আমি। সত্যি পাগলি মেয়ে। হরিণীর মতন লাফাতে লাফাতে, না না, ঠিক সেই অর্থে লাফাতে লাফাতে যায়নি। তবে মায়া মৃগের ন্যায় মত্ত চালে সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে চলে গেল তিতলি। যথারীতি সেই গলির বাঁকে গিয়ে একটু থেমে যাওয়া, আধো আলো আঁধার থেকেই মাথা দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানানো। বৃষ্টি জোরেই শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না আমার। ছোট বেলায় হোস্টেলে বৃষ্টিতে বেশ ভিজতাম আর ধাম ওয়ার্ডেন, বিশেষ করে মনিষ মহারাজের কাছ থেকে খুব বকা খেতাম। বাইক চালিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। ভিজতে ভিজতে বাড়ি পৌছালাম সেদিন। জামাটা খুলে রেখে দিলাম। জামাটা ধুতে একদম ইচ্ছে করছিল না। সারা জামায় তিতলির শরীরের মিষ্টি গন্ধে মম করছিল। বারেবারে মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে আমার জামা কত বেশি ভাগ্যবান। জামার ওপরে তিতলির গাল, তিতলির হাতের ছোঁয়া, তিতলির শরীরের কোমল পরশ, তিতলির গায়ের গন্ধ সব কিছুই মাখামাখি। মনে মনে হেসে ফেললাম।
পরেরদিন একদম ভোর বেলায় সন্তোষ স্যারকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে সোজা জোকা চলে যাবো। সেখানে তদারকি করে তবেই অফিসে যাবো। কথা মতন কাজ। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। গতদিন অনেক রাত পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তা ঘাট ভেজা তাই একটু সাবধানে বাইক চালাতে হচ্ছিল। তাও এক ঘন্টার মধ্যে সাইটে পৌঁছে গেলাম।
ঠাকুরপুকুর, বরিশা, বাবুর বাগান, কালুয়া, জোকা এখানে আগে অনেক ধানা জমি ছিল। ইদানিং চারপাশের এই সব ধানা জমি হুহু করে চড়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন হাইরাইজ উঠছে, নতুন নতুন আবাসন গড়ে উঠছে। সবুজ গাছপালা মরে যাচ্ছে। পাখীদের কলতান চেপে দেওয়া হচ্ছে। শুধু মাত্র মনে পরে গেল আমার তিতলির কথা। যেখানে মানুষ গাছ কাটতে ব্যাস্ত সেখানে তিতলি নিজের বাড়িতে গাছ লাগায়, ছাদেও একটা বাগান করেছে। কনক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পেলাম কচি কলাপাতা রঙের ফ্রক পরিহিত এক পরী। তার হাতে একটা জাদুর দন্ড। এই কংক্রিট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে সবুজের ছোঁয়ায় পৃথিবী আবার হরিত করে তুলতে ব্যাস্ত।
দুপুরের পরে অফিস ফেরার পথে ন্যাশানাল লাইব্রেরি পার করেছি কি বৃষ্টি শুরু। কোলকাতায় বর্ষা কালে যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। অগত্যা চিড়িয়াখানার বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রমাদ গুনলাম, বৃষ্টি মাথায় যদি সময় মতন অফিসে না পৌঁছাতে পারি তাহলে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য আমাকে থেকে যেতে হবে। ওইদিকে চোখের সামনে ভেসে আসে তিতলির চেহারা, কানের মধ্যে বেজে উঠল, “কাল আসবে তো? একটু তাড়াতাড়ি এসো।” সাথে রেনকোট ছিল, সেটা পরেই নিলাম আর অফিসের দিকে রওনা দিলাম। মুষলধারে বৃষ্টি, তাও বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। হেলমেটের কাঁচ ফেলা, সব কিছুই আবছা দেখাচ্ছে। ধ্যাত, রেস কোর্সের ওইখানে আবার লম্বা জ্যাম লেগেছে। প্রতিবার এইখানে জল জমবে আর জ্যাম হবেই, মিউনিসিপালিটি যে কি দেখে কে জানে। গালাগালি দিতে ইচ্ছে করল, কবে যে এই সরকার যাবে। অফিসে একপ্রকার কাক ভেজা হয়েই ঢুকলাম। ঘড়ি দেখলাম চারটে বাজে, হাতে মাত্র দেড় থেকে দু ঘন্টা রয়েছে রিপোর্ট তৈরি করতে।
সন্তোষ স্যার আমাকে ডেকে বললেন, “তুই তো ভিজে চুপসে গেছিস রে।” হেসে ফেললেন আমাকে দেখে।
ব্যাগটা ভাগ্যিস রেন কোটের মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম তাই রক্ষে। ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজ পত্র গুলো টেবিলে রাখার সময়ে আমার ডাক পড়ল কর্ণধার সঞ্জীব স্যারের কেবিনে।
আমাকে কাক ভেজা হয়ে ঢুকতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে হেসে ফেললেন, “বাড়ি যা, কালকে সকালের মধ্যে রিপোর্ট বানিয়ে দিস।”
আমি হেসে বললাম, “না স্যার, এক ঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে।”
সঞ্জীব স্যার বললেন, “আচ্ছা বেশ, যদি ছুটির আগে রিপোর্ট বানিয়ে দিতে পারিস তাহলে কাল তোর ছুটি।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “একা একা ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে কি করব স্যার, তার চেয়ে অফিস ভালো।”
সঞ্জীব স্যার বললেন, “প্রেম কর একটা তখন দেখব তোর হাতে কত সময়।”
আমি লাজুক হেসে মাথা নিচু করে নিলাম। দেড় ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট তৈরি করে ফেললাম, ছুটি আমার চাই না, শুধু মাত্র তিতলির সাথে দেখা করতে চাই। পৌনে ছ’টা নাগাদ রিপোর্ট নিয়ে সঞ্জীব স্যারের কেবিনে পৌঁছে দিলাম। স্যার সব কিছু দেখে নিয়ে খুব খুশি। বললেন যে পুজোতে আমার জন্য দুই দিন ছুটি বশি দেবে। সেটা অবশ্য আমার খুব দরকার। দিম্মা কে নিয়ে মামা বাড়ির সবাইকে নিয়ে হরিদ্বার ঋশিকেশ যাওয়ার কথা আছে। আমিও মাথা নাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বেড়িয়ে পড়লাম অফিস থেকে। বৃষ্টি ধরে এসেছে একটু তবে শেষ হয়নি। ইলশেগুঁড়ির খেলা চলছে মেঘের সাথে কোলকাতার মাটির।
বৃষ্টি মাথায় করে ইন্সটিটিউট পৌঁছাতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। ক্লাস শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই পৌঁছালাম। ক্লাসের মধ্যে ঢুকতেই প্রথম সারির কোনার চেয়ারে বসা রূপসী ললনার সাথে চোখা চুখি হল। আমার জামা ভেজা দেখে ওর মুখ শুকনো হয়ে গেল। সবার অলক্ষ্যে ওকে চোখের ইশারায় চিন্তা করতে বারণ করে দিলাম। শেষের দিকের টেবিলে আমার বন্ধু অনির্বাণ বসে। যথারীতি তার পাশেই আমার স্থান গ্রহন করতে হল।
বসা মাত্রই অনির্বাণের প্রশ্ন, “কি রে, কোথায় ছিলিস রে বোকাচোদা? আমি তো তোর দেরি দেখে ভাবলাম আর আসবি না।”
চোখের কোনা দিয়ে ইতিমধ্যে তিতলি আমার দিকে দুই বার দেখে নিয়েছে। আমি ওর দিকে আড় চোখে তাকিয়েই অনির্বাণকে উত্তর দিলাম, “সাইটে গেছিলাম, সেই জোকা।”
অনির্বাণ আমার কানেকানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “অনুস্কা কয়েকবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। কি ব্যাপার একটু সত্যি করে বলবি?”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অনির্বাণের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কতটা কি ধরতে পেরেছে। শয়তানের মস্তিস্ক, ধোঁয়া দেখলে আগুনের ছোঁয়া বলেই ধরেই নেয়। এখন আমি নিজেই সেই আগুনের দেখা পাইনি তাই তার আগেই ছাই চাপা দিতেই হবে।
ওর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি পালটা ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “রবিবার এক্সট্রা মেসিন রুম ছিল সেটা তুই জানতিস?”
অনির্বাণ অবাক হয়েই প্রশ্ন করল, “কবে রে?”
আমি বললাম, “গত রবিবার।”
উত্তর এলো, “ধ্যাত, বালের ঢপের চপের মেসিন রুম ছিল।”
আমিও বললাম, “তুই ছিঁড়ে আঁটি বাঁধ।”
অনির্বাণ বলল, “সত্যি না বললে তোর গাঁড়ে লাত্থি মারব শালা।”
আমিও মিথ্যে বলে দিলাম ওকে, “রবিবার আমার একটা বই নিয়ে গেছিল সেটা সোমবার আনেনি তাই হয়ত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তোকে...”
অনির্বাণ আমার মতন শয়তান ছেলে। আড় চোখে সামনের চেয়ারে বসা তিতলিকে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, “তোর বিচি চটকে হাতে ধরিয়ে দেব চোদনা। বইয়ের জন্য বারেবারে অনুস্কা পেছন ঘুরে তাকাচ্ছে তাই না।”
ধরা পরে গেছি, এবারে সত্যিটা বলতেই হয়। আমি শেষ পর্যন্ত ওর মায়ের দিব্যি দিয়ে ওকে ছোট করে তিতলির পরিচয় দিলাম। সেই সাথে এটাও জানালাম যে এখন পর্যন্ত এর আগে কিছুই হয়নি। শুধু মাত্র ভালো বান্ধবী।
আমার সব কথা শুনে থমকে গেল অনির্বাণ। বেশ কিছুক্ষন আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আমাকে বলল, “অনুস্কা ব্যানারজি, কাজিপাড়া থাকে? ওর কাকা বামপন্থি? পার্টি করে বলছিস? বুধাদিত্য, যদি এই মেয়ে অমিত ব্যানারজির ভাইঝি হয় তাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে রে ভাই।” আমি ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকাতে ও আমাকে বলল, “অমিত ব্যানারজি শালা মহা শয়তান ঢ্যামনা মাল। ওই এলাকার বেশ বড় গুন্ডা। এই সাতগাছি ওইদিকে দমদম ক্যান্টন্মেন্ট থেকে এক নম্বর গেট পর্যন্ত মস্তানি করে বেড়ায়। প্রোমটারদের থেকে তোলা আদায় করে বেড়ায়। সাবধানে থাকিস ভাই। কোনদিন তোকে কেটে ওই বাগজোলা খালে লাশ ভাসিয়ে দেবে। আমি শালা তোর চিতায় আগুন দিতে পারব না রে ভাই।” শেষের কথাটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলল।
কথাটা শুনে ক্ষনিকের জন্য ভয় ঢুকে গেল মনের মধ্যে। মা নেই, বাবা কোথায় জানি না। আমি যদি মারা যাই তাহলে দিম্মা হয়ত তার আগেই মারা যাবে তবে হোঁৎকার মুখটা মনে পড়তেই সব থেকে কষ্ট হল। হোঁৎকা আর তোতাপাখি আমাকে খুব স্নেহ করে। ক্লাসের পড়া আমার মাথায় উঠে গেল। কি করব কিছুই ভেবে পেলাম না। সামনের সাদা বোর্ডের কালো অক্ষর আর মাথার মধ্যে ঢুকছে না। সব কিছু কেমন এলোমেলো হতে শুরু করে দিল। আমাদের মধ্যে ঠিক কি ধরনের সম্পর্ক? একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কি ভালো বন্ধু হতে পারে না? শুধু মাত্র ভালো বন্ধু? কিন্তু যেভাবে গতকাল বাড়ি ফেরার সময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। আমি তিতলিকে সেই মুহূর্তে ভীষণ ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, দেখা যাবে কি হয়।
ক্লাস শেষে অনির্বাণ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি ভাবছিস?”
আমি মাথা নাড়লাম, “জানি না রে।”
জানি না কি উত্তর দেব, বারেবারে হোঁৎকার মুখ মনে পড়ছে। একবার ছোট বেলায় ছাদে উঠেছিলাম দুই ভাই খেলতে। মামা বাড়ির ছাদে রেলিং দেওয়া ছিল না তখন। আমি বল ধরতে গিয়ে ছাদের ধারে চলে গেছিলাম। পা ফস্কে পরে গেলাম। হোঁৎকা দৌড়ে এসে আমার পা টেনে ধরে ফেলল। দুইজনেই তখন অনেক ছোট। হোঁৎকা আমাকে টেনে তুলতে পারেনি, ত্রাহি চিৎকার করে উঠছিল। দিম্মা আর মা দৌড়ে এসেছিল তখন। দোষ আমার ছিল যদিও কিন্তু হোঁৎকা সেদিন মামিমার কাছে বকা খেয়েছিল। ভাইকে দেখতে পারিস না?
কিছুক্ষন বসে থাকার পরে ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমি আর অনির্বাণ। তিতলির সাথে চোখা চুখি হল। বিল্ডিঙের বাইরে বেড়িয়ে দেখলাম তখন বৃষ্টি পরেই চলেছে। বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে একটা দোকানের নিচে আমি আর অনির্বাণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তিতলি বৃষ্টি দেখে বিল্ডিঙের ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল।
অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল, “বুকের পাটা আছে?”
বুক ভরে শ্বাস নিলাম, সিগারেটে একটা বড় টান মেরে বললাম, “জীবন একটাই, মরব একবার। শেষ দেখেই মরি তাহলে।”
মৃদু হাসি দিল অনির্বাণ, “শালা তুই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছিস। মর শালা তাহলে।”
বেশ কিছুপরে দেখলাম তিতলি ছাতা মাথায় করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। অনির্বাণকে দেখে একটু হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই, কেমন আছো?”
অনির্বাণ সিগারেট ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে ওকে মুচকি হেসে উত্তর দিল, “ভালো আছি।” তারপরে আমাকে বলল, “এই আমি চললাম রে। কথাটা মনে রাখিস।” বলে ছাতা মাথায় বেড়িয়ে চলে গেল।
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ওর কথা শুনে গেলাম। একের পর এক টপাটপ দুটো মুখের মধ্যে পুরে নিল তিতলি। কষ বেয়ে কিছুটা জল বেড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই। ফুচকা খেতে খেতে গোলাপি নরম গাল ফুলে গেছে। ইসস উফফ করছে ঝালে তাও চেহারায় এক ভীষণ খুশির ছটা। ঝালের জন্য চোখের কোল বেয়ে জল বেড়িয়ে আসার যোগার, তাও রূপসী ললনার ফুচকা খাওয়া চাই।
আমি ওকে বললাম, “বেশি খেও না।”
কে কার কথা শোনে, উলটে আমাকেই একটা ধ্যাতানি দিল, “চুপচাপ দাঁড়াও, অনেক দিন পরে খাচ্ছি।” তারপরের ফুচকাটা আমার দিকে উঁচিয়ে ধরে বলল, “এই নাও খাও একটা।”
অগত্যা ওই ভাবে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে একটা মেয়ের হাত থেকে প্রথমবার ফুচকা খাওয়া ভেবেই আমার গা হাত পা শুকিয়ে গেল। প্রেম কেন জীবনে এর আগে এইভাবে কোন মেয়ের সাথে ঘুরতে পর্যন্ত বের হইনি। আর প্রথম বারেই এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে ফুচকা খাওয়াবে বলছে ভেবেই আমার ভীষণ অসস্থি বোধ হল। সেদিকে তিতলির কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।
সরু পেলব চাঁপার কলি আঙ্গুল দিয়ে ফুচকা আমার মুখের সামনে ধরে কাতর কন্ঠে বলে ওঠে, “নাও না, কি করছ। জল সব পরে গেল যে।”
আমি ওর হাত থেকে ফুচকা নিজের হাতে নিয়ে নিলাম। ওইভাবে কেউ আমাকে রাস্তার মাঝে খাইয়ে দেবে ভাবতেই ভীষণ বিব্রতবোধ করছিলাম।
আমি ফুচকা নিয়ে ওকে বললাম, “তুমি খাও আমি তোমার দোনা থেকেই খেয়ে নেব।”
টপ করে পরের ফুচকাটা মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে আমাকে বলল, “এর পরেরটা তোমার কিন্তু।”
আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না, “আচ্ছা বাবা, কিন্তু তাড়াতাড়ি খেও। আকাশের অবস্থা কিন্তু একদম ভালো নয়।”
দুইজনে মিলে দশ টাকার ফুচকা খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “উফফ কি শান্তি।”
আমি মাথা দুলিয়ে বললাম, “হ্যাঁ বুঝলাম। এবারে বাড়ি যাওয়া যাক।”
বাচ্চা মেয়ের মতন মাথা দুলিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”
বাইকে উঠে যথারীতি বাড়ির পথ ধরলাম। আমাকে দুই হাতে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরল তিতলি। সারা পিঠে শুধু একটা নরম উষ্ণ পরশ ছাড়া আর কিছুই নেই। মনে হল যেন আমার পিঠে জামাটাও নেই। মনে হল শুধু তিতলির শরীর আমার পিঠের ওপরে গলে গিয়ে মধুর প্রলেপ লাগিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। কাঁকুড়গাছি মোড় পর্যন্ত চুপচাপ আমার পিঠের ওপরে নিজেকে ঢেলে, কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে চুপচাপ বসেছিল। কাঁকুড়গাছি মোড় আসতেই ইন্সটিটিউটের দেখা পেল।
দেখা পেতেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কাল আসবে তো? নাকি সাইটে যাওয়ার আছে?”
আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিলাম, “কাল সাইটে যাওয়ার আছে। জানি না কখন ফিরব।”
জিজ্ঞেস করল, “কোথায় সাইট?”
আমি উত্তর দিলাম, “জোকা।”
একটু মনমরা হয়েই উত্তর দিল তিতলি, “অনেক দুর তো।”
সত্যি অনেক দুর। সাইটে গিয়ে সব কিছু দেখে শুনে আবার অফিস এসে একটা রিপোর্ট বানাতে হবে। জানি না পরেরদিন কখন ছুটি পাবো। মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল আমার। সেই সাথে আকাশ গুড়গুড় চড়চড় করা শুরু করে দিল। ঝোড় হাওয়া বইতে শুরু করে দিল। তিতলির রেশমি চুল উড়ে এসে আমার হেলমেটের সামনে বার বার চলে আসছে। প্রানপনে আমাকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে তিতলি। উল্টোডাঙ্গা পার হতেই ঝড় উঠে গেল।
তিতলি ভয়ে ভয়ে আমার কানে বলল, “আদি কি হবে?”
আমি ওকে অভয় দিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, “এই তিতলি, চিন্তা করো না। বৃষ্টি আসার আগেই তোমাকে কাজিপাড়া পৌঁছে দেব।” চেঁচাতে এইজন্য হল কারণ আমার মাথায় হেলমেট আর চারপাশে ঝড় হাওয়া।
পাগলের মতন বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলাম। বাসের পাশ ঘেঁষে, গাড়ির পাশ কাটিয়ে বাইক ছুটে চলেছে। মনে হল যেন ফরমুলা ওয়ান রেস করছি। লেকটাউন থেকে যশোর রোডে বাঁক নেওয়ার সময়ে পুরো বাইক ডান দিকে কাত করে দুটো বাসের মাঝখান থেকে বের করে দিয়ে একটা টাক্সির কানের পাশ একদম ঘেঁষে বেড়িয়ে গেলাম। তিতলিকে আমাকে প্রানপনে জড়িয়ে ধরে। দশ মিনিট লাগলো, উল্টোডাঙ্গা থেকে কাজিপাড়া পৌঁছাতে। উত্তেজনায় তিতলির হৃদপিণ্ড গলার কাছে আটকে গেছিল। ওর বুকের তীব্র ধুকপুকানি পিঠের ওপরে অনুভব করতে পারছিলাম। আমার চোখের সামনে তখন শুধু মাত্র একটা লাল ফিতে, কাজি পাড়ার মোড়, তিতলির বাড়ির গলির মুখ। বাইক থামাতেই টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। তিতলি বাইক থেকে নেমে ব্যাগ থেকে ছাতা বার করে খুলে নিল।
আমি ওকে বাড়ি চলে যেতে বললাম, “আর দাঁড়াতে হবে না যাও।” সে মেয়ে কি আর কথা শোনে নাকি, সেই দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষন। আমি ওকে হেসে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন দেরি হচ্ছে না?”
মাথা নাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, “থ্যাঙ্কস ফর ফুচকা।”
আমি আকাশের দিকে তাকালাম, ধিরে ধিরে বৃষ্টির ধারা বাড়তে শুরু করেছে। আমি ওকে মুচকি হেসে বললাম, “ওরে পাগলি মেয়ে, বাড়ি যাও।”
বুকের কাছে ব্যাগ চেপে ধরে, দুই হাতে ছাতা ধরে আমাকে বলল, “তোমার ফোন নাম্বার।”
আমি ওকে বললাম, “কাল দেবো। তুমি এখন যাও না হলে ভিজে যাবে।”
মুখ শুকনো হয়ে গেল আমার কথা শুনে, একটু পরে হেসে বলল, “কাল তাড়াতাড়ি এসো।”
আমি মাথা দোলালাম, “হ্যাঁ। এবারে যাও।”
হেসে ফেললাম আমি। সত্যি পাগলি মেয়ে। হরিণীর মতন লাফাতে লাফাতে, না না, ঠিক সেই অর্থে লাফাতে লাফাতে যায়নি। তবে মায়া মৃগের ন্যায় মত্ত চালে সারা অঙ্গে ঢেউ তুলে চলে গেল তিতলি। যথারীতি সেই গলির বাঁকে গিয়ে একটু থেমে যাওয়া, আধো আলো আঁধার থেকেই মাথা দুলিয়ে আমাকে বিদায় জানানো। বৃষ্টি জোরেই শুরু হয়ে গেল। কিন্তু কোথাও দাঁড়াতে ইচ্ছে করল না আমার। ছোট বেলায় হোস্টেলে বৃষ্টিতে বেশ ভিজতাম আর ধাম ওয়ার্ডেন, বিশেষ করে মনিষ মহারাজের কাছ থেকে খুব বকা খেতাম। বাইক চালিয়ে দিলাম বাড়ির দিকে। ভিজতে ভিজতে বাড়ি পৌছালাম সেদিন। জামাটা খুলে রেখে দিলাম। জামাটা ধুতে একদম ইচ্ছে করছিল না। সারা জামায় তিতলির শরীরের মিষ্টি গন্ধে মম করছিল। বারেবারে মনে হচ্ছিল আমার চেয়ে আমার জামা কত বেশি ভাগ্যবান। জামার ওপরে তিতলির গাল, তিতলির হাতের ছোঁয়া, তিতলির শরীরের কোমল পরশ, তিতলির গায়ের গন্ধ সব কিছুই মাখামাখি। মনে মনে হেসে ফেললাম।
পরেরদিন একদম ভোর বেলায় সন্তোষ স্যারকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে সোজা জোকা চলে যাবো। সেখানে তদারকি করে তবেই অফিসে যাবো। কথা মতন কাজ। সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়লাম। গতদিন অনেক রাত পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছিল। রাস্তা ঘাট ভেজা তাই একটু সাবধানে বাইক চালাতে হচ্ছিল। তাও এক ঘন্টার মধ্যে সাইটে পৌঁছে গেলাম।
ঠাকুরপুকুর, বরিশা, বাবুর বাগান, কালুয়া, জোকা এখানে আগে অনেক ধানা জমি ছিল। ইদানিং চারপাশের এই সব ধানা জমি হুহু করে চড়া দামে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন হাইরাইজ উঠছে, নতুন নতুন আবাসন গড়ে উঠছে। সবুজ গাছপালা মরে যাচ্ছে। পাখীদের কলতান চেপে দেওয়া হচ্ছে। শুধু মাত্র মনে পরে গেল আমার তিতলির কথা। যেখানে মানুষ গাছ কাটতে ব্যাস্ত সেখানে তিতলি নিজের বাড়িতে গাছ লাগায়, ছাদেও একটা বাগান করেছে। কনক্রিটের জঙ্গলের মধ্যে দেখতে পেলাম কচি কলাপাতা রঙের ফ্রক পরিহিত এক পরী। তার হাতে একটা জাদুর দন্ড। এই কংক্রিট ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে সবুজের ছোঁয়ায় পৃথিবী আবার হরিত করে তুলতে ব্যাস্ত।
দুপুরের পরে অফিস ফেরার পথে ন্যাশানাল লাইব্রেরি পার করেছি কি বৃষ্টি শুরু। কোলকাতায় বর্ষা কালে যখন তখন বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতে পারে। অগত্যা চিড়িয়াখানার বাসস্টান্ডে দাঁড়িয়ে পড়লাম। প্রমাদ গুনলাম, বৃষ্টি মাথায় যদি সময় মতন অফিসে না পৌঁছাতে পারি তাহলে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য আমাকে থেকে যেতে হবে। ওইদিকে চোখের সামনে ভেসে আসে তিতলির চেহারা, কানের মধ্যে বেজে উঠল, “কাল আসবে তো? একটু তাড়াতাড়ি এসো।” সাথে রেনকোট ছিল, সেটা পরেই নিলাম আর অফিসের দিকে রওনা দিলাম। মুষলধারে বৃষ্টি, তাও বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। হেলমেটের কাঁচ ফেলা, সব কিছুই আবছা দেখাচ্ছে। ধ্যাত, রেস কোর্সের ওইখানে আবার লম্বা জ্যাম লেগেছে। প্রতিবার এইখানে জল জমবে আর জ্যাম হবেই, মিউনিসিপালিটি যে কি দেখে কে জানে। গালাগালি দিতে ইচ্ছে করল, কবে যে এই সরকার যাবে। অফিসে একপ্রকার কাক ভেজা হয়েই ঢুকলাম। ঘড়ি দেখলাম চারটে বাজে, হাতে মাত্র দেড় থেকে দু ঘন্টা রয়েছে রিপোর্ট তৈরি করতে।
সন্তোষ স্যার আমাকে ডেকে বললেন, “তুই তো ভিজে চুপসে গেছিস রে।” হেসে ফেললেন আমাকে দেখে।
ব্যাগটা ভাগ্যিস রেন কোটের মধ্যে নিয়ে এসেছিলাম তাই রক্ষে। ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজ পত্র গুলো টেবিলে রাখার সময়ে আমার ডাক পড়ল কর্ণধার সঞ্জীব স্যারের কেবিনে।
আমাকে কাক ভেজা হয়ে ঢুকতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করলেন, তারপরে হেসে ফেললেন, “বাড়ি যা, কালকে সকালের মধ্যে রিপোর্ট বানিয়ে দিস।”
আমি হেসে বললাম, “না স্যার, এক ঘন্টার মধ্যে হয়ে যাবে।”
সঞ্জীব স্যার বললেন, “আচ্ছা বেশ, যদি ছুটির আগে রিপোর্ট বানিয়ে দিতে পারিস তাহলে কাল তোর ছুটি।”
আমি মুচকি হেসে বললাম, “একা একা ছুটি নিয়ে বাড়ি থেকে কি করব স্যার, তার চেয়ে অফিস ভালো।”
সঞ্জীব স্যার বললেন, “প্রেম কর একটা তখন দেখব তোর হাতে কত সময়।”
আমি লাজুক হেসে মাথা নিচু করে নিলাম। দেড় ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট তৈরি করে ফেললাম, ছুটি আমার চাই না, শুধু মাত্র তিতলির সাথে দেখা করতে চাই। পৌনে ছ’টা নাগাদ রিপোর্ট নিয়ে সঞ্জীব স্যারের কেবিনে পৌঁছে দিলাম। স্যার সব কিছু দেখে নিয়ে খুব খুশি। বললেন যে পুজোতে আমার জন্য দুই দিন ছুটি বশি দেবে। সেটা অবশ্য আমার খুব দরকার। দিম্মা কে নিয়ে মামা বাড়ির সবাইকে নিয়ে হরিদ্বার ঋশিকেশ যাওয়ার কথা আছে। আমিও মাথা নাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বেড়িয়ে পড়লাম অফিস থেকে। বৃষ্টি ধরে এসেছে একটু তবে শেষ হয়নি। ইলশেগুঁড়ির খেলা চলছে মেঘের সাথে কোলকাতার মাটির।
বৃষ্টি মাথায় করে ইন্সটিটিউট পৌঁছাতে আমার একটু দেরি হয়ে গেল। ক্লাস শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই পৌঁছালাম। ক্লাসের মধ্যে ঢুকতেই প্রথম সারির কোনার চেয়ারে বসা রূপসী ললনার সাথে চোখা চুখি হল। আমার জামা ভেজা দেখে ওর মুখ শুকনো হয়ে গেল। সবার অলক্ষ্যে ওকে চোখের ইশারায় চিন্তা করতে বারণ করে দিলাম। শেষের দিকের টেবিলে আমার বন্ধু অনির্বাণ বসে। যথারীতি তার পাশেই আমার স্থান গ্রহন করতে হল।
বসা মাত্রই অনির্বাণের প্রশ্ন, “কি রে, কোথায় ছিলিস রে বোকাচোদা? আমি তো তোর দেরি দেখে ভাবলাম আর আসবি না।”
চোখের কোনা দিয়ে ইতিমধ্যে তিতলি আমার দিকে দুই বার দেখে নিয়েছে। আমি ওর দিকে আড় চোখে তাকিয়েই অনির্বাণকে উত্তর দিলাম, “সাইটে গেছিলাম, সেই জোকা।”
অনির্বাণ আমার কানেকানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “অনুস্কা কয়েকবার তোর কথা জিজ্ঞেস করছিল। কি ব্যাপার একটু সত্যি করে বলবি?”
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অনির্বাণের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলাম, কতটা কি ধরতে পেরেছে। শয়তানের মস্তিস্ক, ধোঁয়া দেখলে আগুনের ছোঁয়া বলেই ধরেই নেয়। এখন আমি নিজেই সেই আগুনের দেখা পাইনি তাই তার আগেই ছাই চাপা দিতেই হবে।
ওর প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য আমি পালটা ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “রবিবার এক্সট্রা মেসিন রুম ছিল সেটা তুই জানতিস?”
অনির্বাণ অবাক হয়েই প্রশ্ন করল, “কবে রে?”
আমি বললাম, “গত রবিবার।”
উত্তর এলো, “ধ্যাত, বালের ঢপের চপের মেসিন রুম ছিল।”
আমিও বললাম, “তুই ছিঁড়ে আঁটি বাঁধ।”
অনির্বাণ বলল, “সত্যি না বললে তোর গাঁড়ে লাত্থি মারব শালা।”
আমিও মিথ্যে বলে দিলাম ওকে, “রবিবার আমার একটা বই নিয়ে গেছিল সেটা সোমবার আনেনি তাই হয়ত ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য তোকে...”
অনির্বাণ আমার মতন শয়তান ছেলে। আড় চোখে সামনের চেয়ারে বসা তিতলিকে দেখে শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, “তোর বিচি চটকে হাতে ধরিয়ে দেব চোদনা। বইয়ের জন্য বারেবারে অনুস্কা পেছন ঘুরে তাকাচ্ছে তাই না।”
ধরা পরে গেছি, এবারে সত্যিটা বলতেই হয়। আমি শেষ পর্যন্ত ওর মায়ের দিব্যি দিয়ে ওকে ছোট করে তিতলির পরিচয় দিলাম। সেই সাথে এটাও জানালাম যে এখন পর্যন্ত এর আগে কিছুই হয়নি। শুধু মাত্র ভালো বান্ধবী।
আমার সব কথা শুনে থমকে গেল অনির্বাণ। বেশ কিছুক্ষন আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আমাকে বলল, “অনুস্কা ব্যানারজি, কাজিপাড়া থাকে? ওর কাকা বামপন্থি? পার্টি করে বলছিস? বুধাদিত্য, যদি এই মেয়ে অমিত ব্যানারজির ভাইঝি হয় তাহলে তোর কপালে দুঃখ আছে রে ভাই।” আমি ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকাতে ও আমাকে বলল, “অমিত ব্যানারজি শালা মহা শয়তান ঢ্যামনা মাল। ওই এলাকার বেশ বড় গুন্ডা। এই সাতগাছি ওইদিকে দমদম ক্যান্টন্মেন্ট থেকে এক নম্বর গেট পর্যন্ত মস্তানি করে বেড়ায়। প্রোমটারদের থেকে তোলা আদায় করে বেড়ায়। সাবধানে থাকিস ভাই। কোনদিন তোকে কেটে ওই বাগজোলা খালে লাশ ভাসিয়ে দেবে। আমি শালা তোর চিতায় আগুন দিতে পারব না রে ভাই।” শেষের কথাটা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলল।
কথাটা শুনে ক্ষনিকের জন্য ভয় ঢুকে গেল মনের মধ্যে। মা নেই, বাবা কোথায় জানি না। আমি যদি মারা যাই তাহলে দিম্মা হয়ত তার আগেই মারা যাবে তবে হোঁৎকার মুখটা মনে পড়তেই সব থেকে কষ্ট হল। হোঁৎকা আর তোতাপাখি আমাকে খুব স্নেহ করে। ক্লাসের পড়া আমার মাথায় উঠে গেল। কি করব কিছুই ভেবে পেলাম না। সামনের সাদা বোর্ডের কালো অক্ষর আর মাথার মধ্যে ঢুকছে না। সব কিছু কেমন এলোমেলো হতে শুরু করে দিল। আমাদের মধ্যে ঠিক কি ধরনের সম্পর্ক? একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কি ভালো বন্ধু হতে পারে না? শুধু মাত্র ভালো বন্ধু? কিন্তু যেভাবে গতকাল বাড়ি ফেরার সময়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল। আমি তিতলিকে সেই মুহূর্তে ভীষণ ভাবেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বুক ভরে শ্বাস নিলাম, দেখা যাবে কি হয়।
ক্লাস শেষে অনির্বাণ আমাকে জিজ্ঞেস করল, “কি ভাবছিস?”
আমি মাথা নাড়লাম, “জানি না রে।”
জানি না কি উত্তর দেব, বারেবারে হোঁৎকার মুখ মনে পড়ছে। একবার ছোট বেলায় ছাদে উঠেছিলাম দুই ভাই খেলতে। মামা বাড়ির ছাদে রেলিং দেওয়া ছিল না তখন। আমি বল ধরতে গিয়ে ছাদের ধারে চলে গেছিলাম। পা ফস্কে পরে গেলাম। হোঁৎকা দৌড়ে এসে আমার পা টেনে ধরে ফেলল। দুইজনেই তখন অনেক ছোট। হোঁৎকা আমাকে টেনে তুলতে পারেনি, ত্রাহি চিৎকার করে উঠছিল। দিম্মা আর মা দৌড়ে এসেছিল তখন। দোষ আমার ছিল যদিও কিন্তু হোঁৎকা সেদিন মামিমার কাছে বকা খেয়েছিল। ভাইকে দেখতে পারিস না?
কিছুক্ষন বসে থাকার পরে ক্লাস ছেড়ে বেড়িয়ে পড়লাম আমি আর অনির্বাণ। তিতলির সাথে চোখা চুখি হল। বিল্ডিঙের বাইরে বেড়িয়ে দেখলাম তখন বৃষ্টি পরেই চলেছে। বিল্ডিং থেকে বেড়িয়ে একটা দোকানের নিচে আমি আর অনির্বাণ দাঁড়িয়ে রইলাম। তিতলি বৃষ্টি দেখে বিল্ডিঙের ভেতরেই দাঁড়িয়ে রইল।
অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরিয়ে আমার কাঁধ চাপড়ে জিজ্ঞেস করল, “বুকের পাটা আছে?”
বুক ভরে শ্বাস নিলাম, সিগারেটে একটা বড় টান মেরে বললাম, “জীবন একটাই, মরব একবার। শেষ দেখেই মরি তাহলে।”
মৃদু হাসি দিল অনির্বাণ, “শালা তুই ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছিস। মর শালা তাহলে।”
বেশ কিছুপরে দেখলাম তিতলি ছাতা মাথায় করে আমাদের দিকে এগিয়ে এলো। অনির্বাণকে দেখে একটু হাত নাড়িয়ে বলল, “হাই, কেমন আছো?”
অনির্বাণ সিগারেট ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে দেখে ওকে মুচকি হেসে উত্তর দিল, “ভালো আছি।” তারপরে আমাকে বলল, “এই আমি চললাম রে। কথাটা মনে রাখিস।” বলে ছাতা মাথায় বেড়িয়ে চলে গেল।