06-01-2021, 01:42 PM
পর্ব এক (#4-#4)
মনমরা একটা উত্তর পেলাম, “আচ্ছা ঠিক আছে।” গলাটা বেশ শুকনো।
বুঝতে পারলাম না কেন তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল?”
সেই শুকনো গলায় উত্তর এলো, “না মানে তুমি তো একদম ক্লাসের সময়ে আসো, তাই কখন সময় হবে সেটাই ভাবছি।”
সেটাও ঠিক, মাঝে মাঝে ক্লাসে ঢুকি একদম সাতটায়। ওকেই জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বল।”
কাঁধের ওপরে ওর নরম চাঁপার কলি আঙ্গুলের চাপটা একটু শক্ত হয়ে গেল। পিঠের ওপরে ওর নধর কোমল দেহপল্লবের ভার একটু বেড়ে গেল। “কাল বিকেলে কলেজে চলে আসতে পারবে?” মিহি কন্ঠস্বরের বদলে একটা উচ্ছল ভাব ওর কন্ঠে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপরে?”
মুচকি হেসে উত্তর দিল, “তারপরে হেদুয়াতে বসে তুমি আমাকে ভিসুয়াল বেসিকটা বুঝিয়ে দিও।”
সেটা শুনে আমি সত্যি হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। এতদিন কপালে কিছুই জোটেনি আর যখন একজন বলছে তখন কি আর না করা যায়। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে, ওই ছ’টা কি সাড়ে ছ’টার মধ্যে আমি চলে আসব।”
আবার গলা শুকিয়ে গেল ললনার, “একটু তাড়াতাড়ি হতে পারে না?”
আমি বাইক চালাতে চালাতেই উত্তর দিলাম, “আচ্ছা দেখছি, চেষ্টা করব।” চেষ্টা মানে, করতেই হবে চেষ্টা, না হলে কি করে মিটবে তেষ্টা। আমি তিতলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “আজকে কোথায় নামাবো তোমাকে?”
তিতলি একটু চিন্তা করে উত্তর দিল, “ওই রাস্তার মুখেই নামিয়ে দিও।” গলাটা শুকিয়ে গেল মনে হল, “আসলে কি জানো, পাড়ার কেউ দেখলে যদি বাড়িতে বলে দেয় তাহলে ভীষণ মুশকিলে পরে যাবো। আমার বাবা একটু অন্য ধরনের মানুষ।” বুঝলাম আসলে কি বলতে চাইছে। আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বাড়ির গল্প শুরু করে দিল, “বাবা এয়ারপোর্ট অথরিটি তে আছেন। ভাই এই ক্লাস টুয়েলভ দেবে পরের বছর। নিচের তলায় কাকা থাকেন। কাকা আবার পার্টি পলিটিক্স করে, বুঝলে। আমার না জানো খুব গাছ লাগানোর শখ। বাড়িতে একটা বেশ বড় বাগান আছে। চারটে নারকেল গাছ, একটা আম গাছ, একটা পেয়ারা গাছ। ছাদেও একটা ছোট ফুলের বাগান করেছি জানো। ওটা আমার একদম নিজের।” কথা গুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু ওই ওর বাবার কথা শুনে মনের ভেতরে একটু খচখচ করে উঠল। “এই ক্লস্ট্রোফোবিয়ার জন্য রোজ দিন সকালে ড্রাউভার গাড়িতে করে কলেজ ছেড়ে আসে আর ফেরার সময়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরি।” বুঝলাম যে বাড়িতে একটা গাড়ি আছে, গাড়ি চালানর জন্য একটা ড্রাইভার আছে। বেশ ধনি পরিবার ওদের সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। “জানো, আমার মা আমার এই ক্লস্ট্রোফোবিয়ার জন্য খুব আমাকে আগলে আগলে রাখত। আগে তো কোথাও ভিড় দেখলে চেঁচামেচি করতে শুরু করে দিতাম। কারুর সাথে মিশতে পারতাম না, জানো। বাড়িতে একা একাই থাকতাম। পরে আমাকে নাচের কলেজে ভর্তি করে দিল।”
উরিব্বাস, কন্যে তাহলে নাচতেও জানে। তাই ললনার চলনে এত মত্ততা, যেন এক পাহাড়ি নদী আপন খুশিতে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে। মন বেশ খুশি হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “কি ধরনের নাচ শিখতে?”
বাইকের আওয়াজে কথাটা মনে হয় ওর কানে গেল না, তাই নিজের গল্পেই মশগুল ছিল তিতলি। তবে উত্তরটা নিজেই দিয়ে দিল, “তারপরে একটু আধটু ওই বন্ধুত্ত হল। মানুষের সাথে মিশতে পারতাম। বাইরে বের হতে পারতাম। তবে কি জানো, বাসে চড়লেই আমার এখন দম বন্ধ হয়ে আসে। জানো আমার নাচের কলেজটা বাড়ির পাশেই বুঝলে। কত্থক শিখি।”
বাইক লেকটাউন দিয়ে ভেতরে নিতেই আমাকে বলল, “এই এই শোন, আমি না এই লেকটাউন গার্লসে পড়তাম।” বাইকের আওয়াজে আর হেলমেট থাকার জন্য আমি বিশেষ কথা বলতে পারছিলাম না, শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করা ছাড়া। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় পড়তে?”
আমি উত্তর দিলাম, “ছোটবেলা থেকে সব কিছুই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। কলেজ কলেজ সব।”
কাঁধের ওপরে হাতের চাপ বেড়ে গেল, মাথা আরও বেশি করে ঝুঁকিয়ে দিল আমার কাঁধের ওপরে, “কি বললে?”
বুঝলাম আওয়াজে শুনতে পায়নি। আমি হেসে বললাম, “এইভাবে কি আর কথা বলা যায় নাকি? তুমি বল আমি শুনছি তোমার কথা।”
কাঁধের ওপরে আলতো একটা চাঁটি পড়ল ললনার, “শুধু আমি বলব, তুমি শুনবে? ক্লাস নাকি এটা না ইন্টারভিউ দিচ্ছি?” শেষের দিকে মুচকি ইয়ার্কি মার্কা একটা হাসি।
জয়া সিনেমা হলের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে দিতেই আমাকে বলল, “এই এখানে দাঁড়াচ্ছ কেন?”
আমি হেলমেট খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এবারে আমি বলি তুমি শোন। না হলে খোঁটা শোনাতে ছাড়বে না, বলবে ইন্টারভিইউ দিচ্ছ।”
পিঠের ওপরে চাঁপার কলি কোমল আঙ্গুলের একটা ছোট চিমটি খেলাম, “ধ্যাত, তুমি চালাও না হলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।” চিমটিতে ব্যাথার চেয়ে মিষ্টি মধুর ছোঁয়া বেশি করে ছিল। “বাবা আবার না ইন্সটিটিউটে ফোন করে দেয়। ভীষণ কড়াকড়ি বাড়িতে।” শেষের দিকে মনমরা হয়ে গেছিল তিতলির।
বাইক ছুটিয়ে দিলাম, আমার জন্য ওকে যেন কারুর কাছে বকা না খেতে হয়। পিঠের ওপরে সারা ভার দিয়ে বাকিটা রাস্তা চুপটি করে বসেছিল তিতলি। ওর হৃদপিণ্ডের মৃদু কম্পন পিঠের ওপরে অনুভব করতে পেরেছিলাম। ধুকধুক ধুকধুক করে কাঁপছে ওর বুকের ভেতরটা। সাতগাছি পার হতেই ওর ভার আমার পিঠের ওপরে বেড়ে গেল, কেন জানি না মনে হল যেন আমাকে ছাড়তে চাইছে না। হুহু করে উঠল আমার বুকের ভেতরটা। বড় জোর আর পাঁচ মিনিট তারপরেই চলে যাবে। কাজিপাড়া মোড় আসতেই আবার সোজা হয়ে বসে গেল তিতলি। আগের দিনের মতন রাস্তার ওপরেই ওকে নামিয়ে দিলাম।
ব্যাগ বুকের কাছে ধরে বাইক থেকে নেমে আমার অদুরে দাঁড়িয়ে রইল। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় বুঝতে পারলাম, সারা চেহারা এক রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হয়ে গেছে ওর। ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে। জানি না কেন, থেমে গেলাম। আমি হয়ত একটু ভিতু।
যাওয়ার আগে মৃদু হেসে আমাকে বলল, “কাল একটু তাড়াতাড়ি এসো। প্লিজ...”
মাথা দোলালাম আমি, “একদম, চলে আসব।”
হটাত কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “শেভ করে আসবে। ওই খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে একদম আসবে না।”
কথাটা আমার কানে যেতেই আমি ওর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। তিতলির কাজল কালো চোখের মণিতে ঝিলিক, গাল দুটো পিচ ফলের মতন লালচে হয়ে গেছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল গলির ভেতরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ ওকে দেখা যায়। গলির বাঁকে এসে একটু থেমে আমার দিকে চেয়ে একটু মাথা নোয়াল। বুঝতে পারলাম হাত নাড়ালে পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে আর বাড়িতে বলে দেয় তাহলে ওর বাড়িতে ধুন্দুমার কান্ড ঘটে যাবে। গলির বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার পরে ওইখানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিলাম। পিঠের ওপরে যেখানে চিমটি কেটেছিল, সেখানে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। ভীষণ মিষ্টি ব্যাথা, পিঠে নয় ওর হারিয়ে যাওয়ার পরে বুকের বাঁ দিকে হয়েছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে সারাটা রাত শুধু ভাবলাম। কি করছি? ওর বাবা বড়লোক, ওর বাবা বেশ কড়া। আমি ঘোষ ও ব্যানারজি। কত কিছু ভেবে নিলাম, ভবিষ্যতের কথা। একদিকে অলীক স্বপ্নপুরীর রাজকন্যে, অন্যদিকে ভাঙা কুঁড়ে ঘর।
সকালে উঠে একবার ভাবলাম, না যাবো না। তারপরে ভাবলাম, বেচারি আমার জন্য কলেজের বাইরে অপেক্ষা করে থাকবে। শুধু তো পড়া বুঝাতে হবে। এই হেদুয়াতে বসে একটু পড়া বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসব। আর বলেও আসব। কি বলে আসব, ভেবে পেলাম না। ওর মনে কি আছে সেটা তো জানিই না আমি। হয়ত বন্ধুত্ত্ব শুধু মাত্র।
অফিসে ঢুকে দেখলাম যে কাজের চাপ, টেবিলে এক গাদা ফাইল, কোথায় কোন সাইটে কোন মাল যাবে তার লেখাজোকা করতে বসতে হবে। পড়েছি ফিসিক্স নিয়ে করতে হচ্ছে কেরানির কাজ। খাতা লিখছি যেন কোন মুদি খানার দোকানে। কম্পিউটার তখন সবে আসছে আর আমাদের এই কোম্পানির মালিক আবার একটু বামপন্থি। কম্পিউটার এলে মানুষের কাজবাজ থাকবে না, ব্যাবসা লাটে উঠে যাবে। হিসাবে গড়বড় হয়ে যাবে। আসলে সব কিছু কম্পিউটারে থাকলে কারচুপি করা যাবে না সেটা আসল কথা। খাতায় লিখলে যখন অডিট হবে তখন পুড়িয়ে দিলেই কাজ শেষ। কোন প্রমান নেই কিছুই নেই। কোম্পানির কর্ণধার, সঞ্জীব বারুই এমনিতে বেশ ভালো লোক তবে মাঝে মাঝে অকথ্য গালিগালাজ করে যেটা আমার একদম পছন্দ নয়। আমার ম্যানেজার, সন্তোষ স্যার বেশ আময়িক, রামকৃষ্ণ দেবের ভক্ত, প্রতি রবিবার সস্ত্রীক বেলুড় যাওয়া চাই তাঁর। আমি নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করেছি তাই ওনার প্রিয় পাত্র নেক নজরে থাকি।
খাতা লিখেই চলেছি, ডাক পড়ল বিকেলের দিকে। একবার জোকার একটা সাইটে যেতে হবে। আমার মাথায় বাজ পড়ল। মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, তিতলি কলেজের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ভীষণ বিষিয়ে গেল। আমি সন্তোষ স্যারকে জানালাম যে আমার একটু কাজ আছে আমাকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেড়িয়ে যেতে হবে। যেহেতু আমার বাড়িতে কেউ নেই সেহেতু অন্যদিনে কাজ করি, দেরি করেই বাড়ি ফিরি। সন্তোষ স্যার একটু ভেবে আমাকে বললেন যে তিনি ম্যানেজ করে নেবেন। তবে পরেরদিন আমাকে অফিসে ঢোকার আগেই জোকা গিয়ে তদারকি করে বিকেলের মধ্যে একটা রিপোর্ট বানিয়ে দিতে হবে। আমি মাথা দোলালাম, হ্যাঁ হয়ে যাবে।
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আকাশ মেঘলা, হাওয়া চলছে। বৃষ্টি শুরু হলে হেদুয়াতে বসা যাবে না। বৃষ্টি শুরু হলে তিতলিকে ট্যাক্সি করেই বাড়ি পাঠাতে হবে। বুকের বাঁ দিকে একটু চিনচিন ব্যাথা শুরু হল। আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে অকথ্য গালিগালাজ করলাম, তোদের কি আর সময় হয় না নাকি? এখুনি গুড়গুড় চড়চড় করতে হত? বাইক ছুটিয়ে দিলাম রবীন্দ্র সরণি দিয়ে। একদম সোজা পথ, রবীন্দ্র কাননের মোড় ঘুরলেই ওর কলেজ পৌঁছে যাবো। অফিস থেকে বেথুন পৌঁছাতে আধা ঘন্টার মতন সময় লাগলো। সেই আধা ঘন্টা আমার কাছে অর্ধ শত বছরের মতন মনে হয়েছিল। ক্রসিং গুলোতে কিছুতেই আর তর সইছিল না। বাস ট্রাম গাড়ির ফাঁক দিয়ে এপাশ ওপাশ ফাঁক ফোঁকর যেখানে পেয়েছি সেখানেই বাইক ঢুকিয়ে দিয়েছি। ওর কলেজের সামনে পৌঁছাতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। বেথুন সম্পূর্ণ মেয়েদের কলেজ, গেটের সামনে অনেক মেয়ের জটলা। মেয়েদের দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। রবীন্দ্র কাননের দিকেই আমি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরে যাওয়ার জো নেই, কাকে জিজ্ঞেস করব তাও জানি না, কি জিজ্ঞেস করব।
হটাত কানে ভেসে আসল তিতলির গলা, “এই আদি।”
চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি তিতলি দাঁড়িয়ে। একটা কচি কলাপাতা রঙের বেশ লম্বা মতন ফ্রক পড়েছে। ফ্রকের ঘের বেশ ফোলা ফোলা। দুই মসৃণ পেলব বাহু চকচক করছে। ঠোঁটে মিষ্টি গোলাপি রঙে রঞ্জিত। মাথার ঢালাও কালো চুল একটা খোঁপা করে বাঁধা তাতে আবার একটা কাঠের ক্লিপ লাগানো। ওর সাথে ওর আরো দুই বান্ধবী ছিল। এতক্ষন ওর কলেজের গেটের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তিতলি আমায় দেখে মিষ্টি হেসে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপরে দুই বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, একজন পারমিতা অন্যজন সুস্মিতা। ওর দুই বান্ধবীকে দেখে আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটু মাথা নত করলাম। নিজে থেকেই বেশ আমার বাইকের পেছনে উঠে বসে পড়ল। বান্ধবীদের দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
হেলমেটটা বাইকের হ্যান্ডেলে গুঁজতে যাবো, তিতলি আমাকে বলল, “দাও, আমি ধরছি।”
আমি ওর হাতে হেলমেট দিয়ে বললাম, “তাহলে হেদুয়া?”
আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে দেখল তিতলি। মুখ ব্যাজার করে বলল, “বৃষ্টি এলে কি করব?”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “বৃষ্টি এলে ভেজা যাবে আর কি।”
তিতলি মুখ ব্যাজার করে বলল, “ধ্যাত, বাবা বকবে।”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “বৃষ্টি এলে ভিজে যাবে তাতে বকা খাওয়ার কি আছে?”
তিতলি শুকনো মুখে বলল, “বাঃ রে, আমার না কলেজ শেষে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার কথা। ট্যাক্সির মধ্যে কি আর বৃষ্টি হয় নাকি?”
ঠিক কথা, আমি তো গাড়ির মালিক নই, সামান্য একটা বাইক আমার রথ। তাও সেই সামান্য রথেই আমার পেছনে বসা রূপসী রাজকন্যে আমার কোমর জড়িয়ে ডান কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে মিহি কন্ঠে বলল, “বাড়ি চল।”
আমার মাথা গরম হয়ে গেল। কত স্বপ্ন দেখতে দেখতে এসেছিলাম। ওকে সাথে নিয়ে বসব, পাশাপাশি বসব, একটু গল্প করব। আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “মানে? ভিসুয়াল বেসিকের কি হবে?”
খিলখিল করে হেসে ফেলে তিতলি, “ভিসুয়াল বেসিকের কি হবে আমি কি করে জানবো। আমি বিল গেটস নাকি?” তারপরে গলা নামিয়ে আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল, “একা একা ট্যাক্সিতে উঠতে ভালো লাগে না, আদি।”
কানের কাছে ঠোঁট আনতেই ওর উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ লেগে গেল আমার কানের লতিতে আমার গালে। আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বললাম ওকে, “তুমি না খুব দুষ্টু। জানো আমার আজকে একটা সাইটে যাওয়ার কথা ছিল।”
একটু শুকনো গলায় আমাকে বলল তিতলি, “বান্ধবীর জন্য এতটুকু ও করতে পারবে না আদি?”
পাঁজর চেঁচিয়ে উঠল আমার, তোর জন্য সব কিছুই করতে রাজি। একবার মুখে বল, আমি চাঁদের আলোয় তোর রাত ভরিয়ে দেব। আমি মুচকি হেসে বললাম, “আচ্ছা।”
বাইকে স্টার্ট দিলাম। বাড়ির পথের দিকেই যাত্রা শুরু করলাম। হেদুয়ার সামনে আসতেই, হা হা করে উঠল তিতলি, “এই দাঁড়াও দাঁড়াও।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল কিছু পরে গেছে নাকি?”
মুচকি হেসে আমাকে বলল, “ফুচকা খাবো।”
আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম। গঙ্গার দিক থেকে জোলো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি ওকে বললাম, “ধ্যাত ফুচকা খেতে হবে না বাড়ি চল।”
নাক মুখ কুঁচকে পিঠের ওপরে গাল চেপে ধরে মিষ্টি মধুর কন্ঠে আবদার করল তিতলি, “প্লিজ আদি, অনেকদিন ফুচকা খাইনি।”
আমি বাইক না থামিয়েই ওকে আবার বললাম, “তিতলি অন্যদিন ফুচকা খাওয়াব। আজকে না।”
আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধের ওপরে মাথা রেখে আবদার করতে শুরু করল, “আদি আদি, প্লিজ আদি। অনেকদিন ফুচকা খাইনি। প্লিজ চলো না। বেশিক্ষন লাগবে না। দশ টাকার ব্যাস।”
দশ টাকার ফুচকা মানে অনেক গুলো ফুচকা। কিন্তু তিতলি যে ভাবে দুই পেলব বাহু দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ওইভাবে আমার পিঠের ওপরে নিজেকে ঢেলে দিয়ে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, ওর সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না। বাইক উল্টো দিকে হেদুয়ার গেটের সামনে নিয়ে পার্ক করলাম। বাইক থামাতেই কচি বাচ্চার মতন লাফিয়ে বাইক থেকে নেমে পড়ল তিতলি। ফুচকা ওয়ালার সামনে অনেক ভিড়, তাও সেই ভিড় ঠেলে হাত বাড়িয়ে দিল।
হাতে শাল পাতার দোনা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে ডাক দিল, “এই এসো না।”
আমি শুধু ওর মিষ্টি চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে ছিলাম। কচি কলাপাতা রঙের ফ্রকে তিতলিকে একদম ইংরেজি দেশের রূপকথার গল্পের পরীদের মতন লাগছিল দেখতে। আমি মাথা দুলিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
নাক ঠোঁট কুঁচকে আমার দিকে কাতর ভাবে তাকিয়ে বলল, “এই আদি রাগ করে না, প্লিজ।”
আমি ওর কাজল কালো নয়নের কালো মণির ভেতরে নিজের ছায়া দেখতে পেলাম। গোলাপি ঠোঁট জোড়া ভীষণ ভাবেই আমাকে নিঃশব্দে আদর করে ডাকছে। আমি ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে নিলাম। ফুচকা ওয়ালার সাথে ফুচকার ঝাল নিয়ে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটাল, এটা ঝাল দিয়েছে নাকি? একটু শুকনো লঙ্কা আরো দাও। জলে একটু আরো তেঁতুল গোল, একদম টক হয়নি। এমন সাদা মাটা জল দিলে দুটো ফাউ দিতে হবে কিন্তু ... ইত্যাদি।
মনমরা একটা উত্তর পেলাম, “আচ্ছা ঠিক আছে।” গলাটা বেশ শুকনো।
বুঝতে পারলাম না কেন তাই জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল?”
সেই শুকনো গলায় উত্তর এলো, “না মানে তুমি তো একদম ক্লাসের সময়ে আসো, তাই কখন সময় হবে সেটাই ভাবছি।”
সেটাও ঠিক, মাঝে মাঝে ক্লাসে ঢুকি একদম সাতটায়। ওকেই জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি বল।”
কাঁধের ওপরে ওর নরম চাঁপার কলি আঙ্গুলের চাপটা একটু শক্ত হয়ে গেল। পিঠের ওপরে ওর নধর কোমল দেহপল্লবের ভার একটু বেড়ে গেল। “কাল বিকেলে কলেজে চলে আসতে পারবে?” মিহি কন্ঠস্বরের বদলে একটা উচ্ছল ভাব ওর কন্ঠে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তারপরে?”
মুচকি হেসে উত্তর দিল, “তারপরে হেদুয়াতে বসে তুমি আমাকে ভিসুয়াল বেসিকটা বুঝিয়ে দিও।”
সেটা শুনে আমি সত্যি হাতে চাঁদ পেয়ে গেলাম। এতদিন কপালে কিছুই জোটেনি আর যখন একজন বলছে তখন কি আর না করা যায়। আমিও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে, ওই ছ’টা কি সাড়ে ছ’টার মধ্যে আমি চলে আসব।”
আবার গলা শুকিয়ে গেল ললনার, “একটু তাড়াতাড়ি হতে পারে না?”
আমি বাইক চালাতে চালাতেই উত্তর দিলাম, “আচ্ছা দেখছি, চেষ্টা করব।” চেষ্টা মানে, করতেই হবে চেষ্টা, না হলে কি করে মিটবে তেষ্টা। আমি তিতলিকে জিজ্ঞেস করলাম, “আজকে কোথায় নামাবো তোমাকে?”
তিতলি একটু চিন্তা করে উত্তর দিল, “ওই রাস্তার মুখেই নামিয়ে দিও।” গলাটা শুকিয়ে গেল মনে হল, “আসলে কি জানো, পাড়ার কেউ দেখলে যদি বাড়িতে বলে দেয় তাহলে ভীষণ মুশকিলে পরে যাবো। আমার বাবা একটু অন্য ধরনের মানুষ।” বুঝলাম আসলে কি বলতে চাইছে। আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বাড়ির গল্প শুরু করে দিল, “বাবা এয়ারপোর্ট অথরিটি তে আছেন। ভাই এই ক্লাস টুয়েলভ দেবে পরের বছর। নিচের তলায় কাকা থাকেন। কাকা আবার পার্টি পলিটিক্স করে, বুঝলে। আমার না জানো খুব গাছ লাগানোর শখ। বাড়িতে একটা বেশ বড় বাগান আছে। চারটে নারকেল গাছ, একটা আম গাছ, একটা পেয়ারা গাছ। ছাদেও একটা ছোট ফুলের বাগান করেছি জানো। ওটা আমার একদম নিজের।” কথা গুলো শুনতে বেশ ভালো লাগছিল। কিন্তু ওই ওর বাবার কথা শুনে মনের ভেতরে একটু খচখচ করে উঠল। “এই ক্লস্ট্রোফোবিয়ার জন্য রোজ দিন সকালে ড্রাউভার গাড়িতে করে কলেজ ছেড়ে আসে আর ফেরার সময়ে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফিরি।” বুঝলাম যে বাড়িতে একটা গাড়ি আছে, গাড়ি চালানর জন্য একটা ড্রাইভার আছে। বেশ ধনি পরিবার ওদের সেটা বুঝতে অসুবিধে হল না। “জানো, আমার মা আমার এই ক্লস্ট্রোফোবিয়ার জন্য খুব আমাকে আগলে আগলে রাখত। আগে তো কোথাও ভিড় দেখলে চেঁচামেচি করতে শুরু করে দিতাম। কারুর সাথে মিশতে পারতাম না, জানো। বাড়িতে একা একাই থাকতাম। পরে আমাকে নাচের কলেজে ভর্তি করে দিল।”
উরিব্বাস, কন্যে তাহলে নাচতেও জানে। তাই ললনার চলনে এত মত্ততা, যেন এক পাহাড়ি নদী আপন খুশিতে নাচতে নাচতে এগিয়ে চলেছে। মন বেশ খুশি হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করলাম, “কি ধরনের নাচ শিখতে?”
বাইকের আওয়াজে কথাটা মনে হয় ওর কানে গেল না, তাই নিজের গল্পেই মশগুল ছিল তিতলি। তবে উত্তরটা নিজেই দিয়ে দিল, “তারপরে একটু আধটু ওই বন্ধুত্ত হল। মানুষের সাথে মিশতে পারতাম। বাইরে বের হতে পারতাম। তবে কি জানো, বাসে চড়লেই আমার এখন দম বন্ধ হয়ে আসে। জানো আমার নাচের কলেজটা বাড়ির পাশেই বুঝলে। কত্থক শিখি।”
বাইক লেকটাউন দিয়ে ভেতরে নিতেই আমাকে বলল, “এই এই শোন, আমি না এই লেকটাউন গার্লসে পড়তাম।” বাইকের আওয়াজে আর হেলমেট থাকার জন্য আমি বিশেষ কথা বলতে পারছিলাম না, শুধু হ্যাঁ হ্যাঁ করা ছাড়া। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় পড়তে?”
আমি উত্তর দিলাম, “ছোটবেলা থেকে সব কিছুই নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে। কলেজ কলেজ সব।”
কাঁধের ওপরে হাতের চাপ বেড়ে গেল, মাথা আরও বেশি করে ঝুঁকিয়ে দিল আমার কাঁধের ওপরে, “কি বললে?”
বুঝলাম আওয়াজে শুনতে পায়নি। আমি হেসে বললাম, “এইভাবে কি আর কথা বলা যায় নাকি? তুমি বল আমি শুনছি তোমার কথা।”
কাঁধের ওপরে আলতো একটা চাঁটি পড়ল ললনার, “শুধু আমি বলব, তুমি শুনবে? ক্লাস নাকি এটা না ইন্টারভিউ দিচ্ছি?” শেষের দিকে মুচকি ইয়ার্কি মার্কা একটা হাসি।
জয়া সিনেমা হলের সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে দিতেই আমাকে বলল, “এই এখানে দাঁড়াচ্ছ কেন?”
আমি হেলমেট খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এবারে আমি বলি তুমি শোন। না হলে খোঁটা শোনাতে ছাড়বে না, বলবে ইন্টারভিইউ দিচ্ছ।”
পিঠের ওপরে চাঁপার কলি কোমল আঙ্গুলের একটা ছোট চিমটি খেলাম, “ধ্যাত, তুমি চালাও না হলে বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে।” চিমটিতে ব্যাথার চেয়ে মিষ্টি মধুর ছোঁয়া বেশি করে ছিল। “বাবা আবার না ইন্সটিটিউটে ফোন করে দেয়। ভীষণ কড়াকড়ি বাড়িতে।” শেষের দিকে মনমরা হয়ে গেছিল তিতলির।
বাইক ছুটিয়ে দিলাম, আমার জন্য ওকে যেন কারুর কাছে বকা না খেতে হয়। পিঠের ওপরে সারা ভার দিয়ে বাকিটা রাস্তা চুপটি করে বসেছিল তিতলি। ওর হৃদপিণ্ডের মৃদু কম্পন পিঠের ওপরে অনুভব করতে পেরেছিলাম। ধুকধুক ধুকধুক করে কাঁপছে ওর বুকের ভেতরটা। সাতগাছি পার হতেই ওর ভার আমার পিঠের ওপরে বেড়ে গেল, কেন জানি না মনে হল যেন আমাকে ছাড়তে চাইছে না। হুহু করে উঠল আমার বুকের ভেতরটা। বড় জোর আর পাঁচ মিনিট তারপরেই চলে যাবে। কাজিপাড়া মোড় আসতেই আবার সোজা হয়ে বসে গেল তিতলি। আগের দিনের মতন রাস্তার ওপরেই ওকে নামিয়ে দিলাম।
ব্যাগ বুকের কাছে ধরে বাইক থেকে নেমে আমার অদুরে দাঁড়িয়ে রইল। ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় বুঝতে পারলাম, সারা চেহারা এক রক্তিম আভায় উদ্ভাসিত হয়ে গেছে ওর। ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যেতে। জানি না কেন, থেমে গেলাম। আমি হয়ত একটু ভিতু।
যাওয়ার আগে মৃদু হেসে আমাকে বলল, “কাল একটু তাড়াতাড়ি এসো। প্লিজ...”
মাথা দোলালাম আমি, “একদম, চলে আসব।”
হটাত কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “শেভ করে আসবে। ওই খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে একদম আসবে না।”
কথাটা আমার কানে যেতেই আমি ওর দিকে মুখ তুলে তাকালাম। তিতলির কাজল কালো চোখের মণিতে ঝিলিক, গাল দুটো পিচ ফলের মতন লালচে হয়ে গেছে। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল গলির ভেতরে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম যতক্ষণ ওকে দেখা যায়। গলির বাঁকে এসে একটু থেমে আমার দিকে চেয়ে একটু মাথা নোয়াল। বুঝতে পারলাম হাত নাড়ালে পাছে যদি কেউ দেখে ফেলে আর বাড়িতে বলে দেয় তাহলে ওর বাড়িতে ধুন্দুমার কান্ড ঘটে যাবে। গলির বাঁকে হারিয়ে যাওয়ার পরে ওইখানে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিলাম। পিঠের ওপরে যেখানে চিমটি কেটেছিল, সেখানে ছুঁয়ে দেখতে চেষ্টা করলাম। ভীষণ মিষ্টি ব্যাথা, পিঠে নয় ওর হারিয়ে যাওয়ার পরে বুকের বাঁ দিকে হয়েছিল। সেদিন বাড়ি ফিরে সারাটা রাত শুধু ভাবলাম। কি করছি? ওর বাবা বড়লোক, ওর বাবা বেশ কড়া। আমি ঘোষ ও ব্যানারজি। কত কিছু ভেবে নিলাম, ভবিষ্যতের কথা। একদিকে অলীক স্বপ্নপুরীর রাজকন্যে, অন্যদিকে ভাঙা কুঁড়ে ঘর।
সকালে উঠে একবার ভাবলাম, না যাবো না। তারপরে ভাবলাম, বেচারি আমার জন্য কলেজের বাইরে অপেক্ষা করে থাকবে। শুধু তো পড়া বুঝাতে হবে। এই হেদুয়াতে বসে একটু পড়া বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসব। আর বলেও আসব। কি বলে আসব, ভেবে পেলাম না। ওর মনে কি আছে সেটা তো জানিই না আমি। হয়ত বন্ধুত্ত্ব শুধু মাত্র।
অফিসে ঢুকে দেখলাম যে কাজের চাপ, টেবিলে এক গাদা ফাইল, কোথায় কোন সাইটে কোন মাল যাবে তার লেখাজোকা করতে বসতে হবে। পড়েছি ফিসিক্স নিয়ে করতে হচ্ছে কেরানির কাজ। খাতা লিখছি যেন কোন মুদি খানার দোকানে। কম্পিউটার তখন সবে আসছে আর আমাদের এই কোম্পানির মালিক আবার একটু বামপন্থি। কম্পিউটার এলে মানুষের কাজবাজ থাকবে না, ব্যাবসা লাটে উঠে যাবে। হিসাবে গড়বড় হয়ে যাবে। আসলে সব কিছু কম্পিউটারে থাকলে কারচুপি করা যাবে না সেটা আসল কথা। খাতায় লিখলে যখন অডিট হবে তখন পুড়িয়ে দিলেই কাজ শেষ। কোন প্রমান নেই কিছুই নেই। কোম্পানির কর্ণধার, সঞ্জীব বারুই এমনিতে বেশ ভালো লোক তবে মাঝে মাঝে অকথ্য গালিগালাজ করে যেটা আমার একদম পছন্দ নয়। আমার ম্যানেজার, সন্তোষ স্যার বেশ আময়িক, রামকৃষ্ণ দেবের ভক্ত, প্রতি রবিবার সস্ত্রীক বেলুড় যাওয়া চাই তাঁর। আমি নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করেছি তাই ওনার প্রিয় পাত্র নেক নজরে থাকি।
খাতা লিখেই চলেছি, ডাক পড়ল বিকেলের দিকে। একবার জোকার একটা সাইটে যেতে হবে। আমার মাথায় বাজ পড়ল। মানসচক্ষে দেখতে পেলাম, তিতলি কলেজের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। মনটা ভীষণ বিষিয়ে গেল। আমি সন্তোষ স্যারকে জানালাম যে আমার একটু কাজ আছে আমাকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে বেড়িয়ে যেতে হবে। যেহেতু আমার বাড়িতে কেউ নেই সেহেতু অন্যদিনে কাজ করি, দেরি করেই বাড়ি ফিরি। সন্তোষ স্যার একটু ভেবে আমাকে বললেন যে তিনি ম্যানেজ করে নেবেন। তবে পরেরদিন আমাকে অফিসে ঢোকার আগেই জোকা গিয়ে তদারকি করে বিকেলের মধ্যে একটা রিপোর্ট বানিয়ে দিতে হবে। আমি মাথা দোলালাম, হ্যাঁ হয়ে যাবে।
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে পাঁচটায় অফিস থেকে বেড়িয়ে গেলাম। আকাশ মেঘলা, হাওয়া চলছে। বৃষ্টি শুরু হলে হেদুয়াতে বসা যাবে না। বৃষ্টি শুরু হলে তিতলিকে ট্যাক্সি করেই বাড়ি পাঠাতে হবে। বুকের বাঁ দিকে একটু চিনচিন ব্যাথা শুরু হল। আকাশের মেঘের দিকে তাকিয়ে অকথ্য গালিগালাজ করলাম, তোদের কি আর সময় হয় না নাকি? এখুনি গুড়গুড় চড়চড় করতে হত? বাইক ছুটিয়ে দিলাম রবীন্দ্র সরণি দিয়ে। একদম সোজা পথ, রবীন্দ্র কাননের মোড় ঘুরলেই ওর কলেজ পৌঁছে যাবো। অফিস থেকে বেথুন পৌঁছাতে আধা ঘন্টার মতন সময় লাগলো। সেই আধা ঘন্টা আমার কাছে অর্ধ শত বছরের মতন মনে হয়েছিল। ক্রসিং গুলোতে কিছুতেই আর তর সইছিল না। বাস ট্রাম গাড়ির ফাঁক দিয়ে এপাশ ওপাশ ফাঁক ফোঁকর যেখানে পেয়েছি সেখানেই বাইক ঢুকিয়ে দিয়েছি। ওর কলেজের সামনে পৌঁছাতেই আমার গলা শুকিয়ে গেল। বেথুন সম্পূর্ণ মেয়েদের কলেজ, গেটের সামনে অনেক মেয়ের জটলা। মেয়েদের দেখে আমার গলা শুকিয়ে গেল। রবীন্দ্র কাননের দিকেই আমি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভেতরে যাওয়ার জো নেই, কাকে জিজ্ঞেস করব তাও জানি না, কি জিজ্ঞেস করব।
হটাত কানে ভেসে আসল তিতলির গলা, “এই আদি।”
চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখি তিতলি দাঁড়িয়ে। একটা কচি কলাপাতা রঙের বেশ লম্বা মতন ফ্রক পড়েছে। ফ্রকের ঘের বেশ ফোলা ফোলা। দুই মসৃণ পেলব বাহু চকচক করছে। ঠোঁটে মিষ্টি গোলাপি রঙে রঞ্জিত। মাথার ঢালাও কালো চুল একটা খোঁপা করে বাঁধা তাতে আবার একটা কাঠের ক্লিপ লাগানো। ওর সাথে ওর আরো দুই বান্ধবী ছিল। এতক্ষন ওর কলেজের গেটের দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তিতলি আমায় দেখে মিষ্টি হেসে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। তারপরে দুই বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, একজন পারমিতা অন্যজন সুস্মিতা। ওর দুই বান্ধবীকে দেখে আমিও ভদ্রতার খাতিরে একটু মাথা নত করলাম। নিজে থেকেই বেশ আমার বাইকের পেছনে উঠে বসে পড়ল। বান্ধবীদের দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে দিল। আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
হেলমেটটা বাইকের হ্যান্ডেলে গুঁজতে যাবো, তিতলি আমাকে বলল, “দাও, আমি ধরছি।”
আমি ওর হাতে হেলমেট দিয়ে বললাম, “তাহলে হেদুয়া?”
আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে দেখল তিতলি। মুখ ব্যাজার করে বলল, “বৃষ্টি এলে কি করব?”
আমি হেসে উত্তর দিলাম, “বৃষ্টি এলে ভেজা যাবে আর কি।”
তিতলি মুখ ব্যাজার করে বলল, “ধ্যাত, বাবা বকবে।”
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম, “বৃষ্টি এলে ভিজে যাবে তাতে বকা খাওয়ার কি আছে?”
তিতলি শুকনো মুখে বলল, “বাঃ রে, আমার না কলেজ শেষে ট্যাক্সি করে বাড়ি ফেরার কথা। ট্যাক্সির মধ্যে কি আর বৃষ্টি হয় নাকি?”
ঠিক কথা, আমি তো গাড়ির মালিক নই, সামান্য একটা বাইক আমার রথ। তাও সেই সামান্য রথেই আমার পেছনে বসা রূপসী রাজকন্যে আমার কোমর জড়িয়ে ডান কাঁধের ওপরে থুঁতনি রেখে মিহি কন্ঠে বলল, “বাড়ি চল।”
আমার মাথা গরম হয়ে গেল। কত স্বপ্ন দেখতে দেখতে এসেছিলাম। ওকে সাথে নিয়ে বসব, পাশাপাশি বসব, একটু গল্প করব। আমি ওকে প্রশ্ন করলাম, “মানে? ভিসুয়াল বেসিকের কি হবে?”
খিলখিল করে হেসে ফেলে তিতলি, “ভিসুয়াল বেসিকের কি হবে আমি কি করে জানবো। আমি বিল গেটস নাকি?” তারপরে গলা নামিয়ে আমার কানের কাছে ঠোঁট এনে ফিসফিস করে বলল, “একা একা ট্যাক্সিতে উঠতে ভালো লাগে না, আদি।”
কানের কাছে ঠোঁট আনতেই ওর উষ্ণ শ্বাসের ঢেউ লেগে গেল আমার কানের লতিতে আমার গালে। আমি হেসে ফেললাম ওর কথা শুনে, মাথা নাড়িয়ে বললাম ওকে, “তুমি না খুব দুষ্টু। জানো আমার আজকে একটা সাইটে যাওয়ার কথা ছিল।”
একটু শুকনো গলায় আমাকে বলল তিতলি, “বান্ধবীর জন্য এতটুকু ও করতে পারবে না আদি?”
পাঁজর চেঁচিয়ে উঠল আমার, তোর জন্য সব কিছুই করতে রাজি। একবার মুখে বল, আমি চাঁদের আলোয় তোর রাত ভরিয়ে দেব। আমি মুচকি হেসে বললাম, “আচ্ছা।”
বাইকে স্টার্ট দিলাম। বাড়ির পথের দিকেই যাত্রা শুরু করলাম। হেদুয়ার সামনে আসতেই, হা হা করে উঠল তিতলি, “এই দাঁড়াও দাঁড়াও।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষে দিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হল কিছু পরে গেছে নাকি?”
মুচকি হেসে আমাকে বলল, “ফুচকা খাবো।”
আকাশের দিকে চেয়ে দেখলাম। গঙ্গার দিক থেকে জোলো হাওয়া শুরু হয়ে গেছে। আমি ওকে বললাম, “ধ্যাত ফুচকা খেতে হবে না বাড়ি চল।”
নাক মুখ কুঁচকে পিঠের ওপরে গাল চেপে ধরে মিষ্টি মধুর কন্ঠে আবদার করল তিতলি, “প্লিজ আদি, অনেকদিন ফুচকা খাইনি।”
আমি বাইক না থামিয়েই ওকে আবার বললাম, “তিতলি অন্যদিন ফুচকা খাওয়াব। আজকে না।”
আমার কোমর জড়িয়ে ধরে কাঁধের ওপরে মাথা রেখে আবদার করতে শুরু করল, “আদি আদি, প্লিজ আদি। অনেকদিন ফুচকা খাইনি। প্লিজ চলো না। বেশিক্ষন লাগবে না। দশ টাকার ব্যাস।”
দশ টাকার ফুচকা মানে অনেক গুলো ফুচকা। কিন্তু তিতলি যে ভাবে দুই পেলব বাহু দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ওইভাবে আমার পিঠের ওপরে নিজেকে ঢেলে দিয়ে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বলেছিল, ওর সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে থাকতে পারলাম না। বাইক উল্টো দিকে হেদুয়ার গেটের সামনে নিয়ে পার্ক করলাম। বাইক থামাতেই কচি বাচ্চার মতন লাফিয়ে বাইক থেকে নেমে পড়ল তিতলি। ফুচকা ওয়ালার সামনে অনেক ভিড়, তাও সেই ভিড় ঠেলে হাত বাড়িয়ে দিল।
হাতে শাল পাতার দোনা নিয়ে আমার দিকে চেয়ে ডাক দিল, “এই এসো না।”
আমি শুধু ওর মিষ্টি চেহারা দেখে মুগ্ধ হয়েই তাকিয়ে ছিলাম। কচি কলাপাতা রঙের ফ্রকে তিতলিকে একদম ইংরেজি দেশের রূপকথার গল্পের পরীদের মতন লাগছিল দেখতে। আমি মাথা দুলিয়ে ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
নাক ঠোঁট কুঁচকে আমার দিকে কাতর ভাবে তাকিয়ে বলল, “এই আদি রাগ করে না, প্লিজ।”
আমি ওর কাজল কালো নয়নের কালো মণির ভেতরে নিজের ছায়া দেখতে পেলাম। গোলাপি ঠোঁট জোড়া ভীষণ ভাবেই আমাকে নিঃশব্দে আদর করে ডাকছে। আমি ওর ব্যাগ হাতে নিয়ে নিলাম। ফুচকা ওয়ালার সাথে ফুচকার ঝাল নিয়ে একটা তুলকালাম কান্ড ঘটাল, এটা ঝাল দিয়েছে নাকি? একটু শুকনো লঙ্কা আরো দাও। জলে একটু আরো তেঁতুল গোল, একদম টক হয়নি। এমন সাদা মাটা জল দিলে দুটো ফাউ দিতে হবে কিন্তু ... ইত্যাদি।