01-01-2021, 03:58 PM
ততক্ষনে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে শ্মশানে! চারিদিকে বড় বড় গাছপালা থাকায় অনেক জলদি চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল! বিন্দুবালা খাটয়ার সামনে কিছু কাঠ জ্বালালো! সেই আগুনের আলোয় যত না দেখা যায়, না দ্যাখা যায় তার চেয়ে ঢের বেশি!চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, শেয়ালের হুক্কা হুয়া, প্যাঁচার ভুতুম শব্দ, অদূরে মড়া পোড়ার বিজাতিয় কটুগন্ধময় ধোঁয়া – সব মিলিয়ে এক অতিপ্রাকৃতিক, আধিভৌতিক পরিস্থিতের সৃষ্টি হয়েছে! বিন্দুবালা একটা চিনামাটির পাত্রে রামচরনের জন্যে এক বাটি মুড়ি আর খান চারেক বাতাসা এনে দিল! কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো – শুনুন, আজ রাতটা এখানে আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে! আপনি একটু মানিয়ে নিন!
রামচরন – আপনি সে নিয়ে চিন্তিত হবেন না! আমি জীবনে এর থেকেও দুর্গম জায়াগাতে কাটিয়েছি! আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না! আপনি খেলেন না যে ?!
বিন্দুবালার মুখটা বেদনায় যেন কাতর হয়ে উঠলো – আমার, আমার আজ খেতে মন চাইছে না রামচরনবাবু! ও আমার অভ্যেস আছে!
রামচরন – সাধুবাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো কিছুটা সুরাহা হতো। আমার সাথে গাড়ি আছে, এখনো যদি বেরোই, মাঝরাত্তিরে কলকাতার কোনো ভালো হাসপাতালে বাবাকে অ্যাডমিট করাতে পারবো! চলুন ওনাকে নিয়ে যাই!
বিন্দুবালা রুক্ষ স্বরে জবাব দিল – বাবা সিদ্ধ পুরুষ! ওনার আয়ুর্বিদ্যা জানা আছে! চাইলে উনি এখনো নিজেই নিজেকে শুধু সুস্থই করতে পারবেন তাই নয়, উনি নিজের বার্ধক্যকে ত্যাগ করে পুনর্যৌবন লাভ করতে পারেন! উনি সেচ্ছায় সমাধি নিতে চাইছেন! আপনার শরীর দেখেই বুঝেছি, আপনি অমিত ক্ষমতাশালী পুরুষ! তাঁবুতে এক জোড়া শাবল আর বেলচা রাখা আছে! বাবা আগের থেকেই সব জোগাড় করে রেখেছেন! উনি ভবিষ্যত দৃষ্টা! আপনি কি আমায় একটা সাহায্য করবেন? ওই শিমূল কাছের নীচে যেখানে ত্রিশূল পোঁতা আছে দেখছেন, ঠিক ওই জায়গায় একটা গর্ত খুড়োতে হবে – ছয় ফুট গভীর আর চার ফুট বাই চার ফুট মাপের।
রামচরন – গর্তটা খুঁড়ে কি করবেন?
বিন্দুবালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো – বাবা ওই গর্তেই নির্বিকল্প সমাধি নিয়ে মোক্ষ লাভ করবেন পদ্মাসনে বসে!
রামচরন শুনে আঁতকে উঠলো - অ্যাঁ ! কি বলছেনটা কি আপনি?! তা কি করে সম্ভব! দেখছেন না ওনার অবস্থা! উনি যে বিছানাতে মড়ার মতন শুয়ে আছেন! এই শরীর নিয়ে ওই গর্তে পদ্মাসন? একটা জ্যান্ত মানুষকে বাঁচানোর নূন্যতম চেষ্টাটুকুও করতে দিচ্ছেন না! সব কিছুর একটা সীমা আছে বিন্দুদি!
বিন্দুবালা সহসা সাপের মতন হিসিয়ে উঠলো – চুপ একদম! খুব দরদ না? আমি ২২ বছর বাবার সাথে আছি, ওনার বিষয় আমি যা জানি তা আপনি ছিটেফোঁটাও জানেন না! আপনার চাইতে আমার কষ্ট লক্ষগুন বেশি! আজ আমি অভিভাবখীন হতে চলেছি, তবু সব সহ্য করতে হবে! এ হলো বিধাতার আদেশ, বাবার আদেশ! অন্যথা হবে না! বাধা দিলে আপনাকে আমি শেষ করে দেবো!
রামচরন রাগে ফেটে পড়লো – যা ইচ্ছে তাই করবেন আবার শাষানি দিচ্ছেন? কি করে নেবেন আপনি?! বলে খপ করে বিন্দুবালার হাতটা ধরতে গেলো রামচরন! অবাক বিষ্ময়ে দেখলো যে তার হাত এক মুঠো বাতাসকে খাবলে ধরলো খালি! এত তড়িৎ গতিতে বিন্দুবালা তার হাতখানা সরিয়ে কি করে নিল সেটা রামচরন ভেবে পেলনা! রামচরন এইবার আবার চেষ্টা করলো! আবার ব্যর্থ হলো!
বিন্দুবালা এইবার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো – দারুন বীরপুঙ্গব আপনি! আর আমি অবলা, অসহায় এক নারী?! তাই না? এটাই তো ভেবে বসে আছেন?! শুনুন, কিছু কিছু বিদ্যে এই বিন্দুবালার পেটেও আছে! জোর করার চেষ্টা করলে আমি আপনার কি হাল করতে পারি তা আপনি জানেন না! তাই চাইলে আমার কাজে সাহায্য করুন! নতুবা চুপটি করে বসে থাকুন বাবার পাশে! বাবা এখন যোগ নিদ্রায় আছেন, দয়া করে চেল্লামেল্লি করে ওনার ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করবেন না! ফল ভালো হবেনা!
সেই ঘোর কালো অমাবস্যার রাতে বিন্দুবালার লাস্যময়ী অপার যোউবনবতী দেহবল্লরিকে যে কোনো পুরুষেরই কামোদ্রেক হবেই! কিন্তু রামচরনের শিরদাঁড়ায় এক শ্রদ্ধা, বিষ্ময় আর ভয়ের সঞ্চার ঘটলো! এ নারী আপাতদৃষ্টিতে যত কমনীয়, মোহময়ী, কুহকিনী মনে হোক না কেন, ইনি অপার শক্তিময়ী! একটা জান্তবতা আর নিষ্ঠুরতার মিশেল ঘটেছে এই লাস্যময়ী তরুনির ব্যক্তিত্বে! এ এক অসাধারন নারী! একে হাল্কাভাবে নিলে খুব ভুল হবে! বিজ্ঞান আর যুক্তিবাদের বাইরেও একটা রহস্যময় দুনিয়া থাকে, সেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন, অচেনা জগতের এই মানসকন্যা আর সিদ্ধাই পুরুষকে যুক্তি-তক্ক দিয়ে যে বিচার করা নিরর্থক, তা রাআমচরন হাড়ে হাড়ে টের পেল! সে মার্শাল আর্টে সিদ্ধহস্ত, চোখের পলক পড়ার আআগেই সামনের এক পর্বতপ্রমাণ মানুষকে জুডোর প্যাঁচে সে অনায়াসে ধরাশায়ী করতে পাআরে! কিন্তু এই নারী তাআর ক্ষিপ্রতাকে যেমন অবলীলায় নস্যাৎ করেছে, তাতে একে সাধারন নারী বলে মানতে রামচরন নারাজ!
খানিক চুপ করে থেকে সে চাপা গলায় বলে উঠলো – বেলচা আর শাবলটা দিন!
বিন্দুবালা একটা চাপা হাসি হাসলো, তারপর বললো – শিমূল গাছের নীচেই রাখা আছে সব! আসুন আমার সাথে!
বিন্দুবালা নিজের শাড়িটা গাছকোমর করে বেঁধে নিল! তারপর রামচরন আর বিন্দুবালা মিলে গর্ত খোড়া শুরু করলো শাবল আর বেলচা দিয়ে! প্রায় ঘন্তা চারেকের নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রমে তাদের গর্ত খোঁড়ার কাজ সম্পন্ন হলো! কাজ শেষ হতে বিন্দুবালা শাবলে এক হাত রেখে গর্তের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো! রামচরন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে বিন্দুবালার দিকে তাকিয়ে থাকলো খানিক ক্ষন! তারপর তার বড় মায়া হলো! এগিয়ে গিয়ে বিন্দুবালার কাঁধে হাত রাখলো আলতো করে! বিন্দুবালা এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিল!
বিন্দুবালা হিসহিসিয়ে বলে উঠলো – খবরদার! আমায় স্পর্শ করবেন না! আপনার কাছে আমি আজীবন থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি বাবাকে! তার মানে এই নয় যে আপনি আমাকে ছোঁয়ার স্বত্তাধিকার লাভ করেছেন! দূরে থাকুন! কাছে একদম আসবেন না!
রামচরন খুব আহত হলো মানসিকভাবে, ক্ষুব্ধ অথচ শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো – কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে আপনাকে আমি ছুঁই নি বিন্দুদি! তবুও কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি এভাবে কখনো বিব্রত করবোনা!
বিন্দুবালা সে কথা শুনতে পেল কিনা জানা নেই! আকাশের মিটমিটে তারার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললো – সময় হয়েছে, চলুন, বাবার তিরোধান হতে বেশি দেরী নেই!
বিন্দুবালা বেড়ালের ক্ষীপ্রতায় গর্ত থেকে মাটির উপরে এসে গেল, রামচরনও নিপুন দক্ষতায় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসলো! একবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে বিন্দুবালার না তাকিয়ে থাকতে পারলো না রামচরন! বিন্দুবালার স্তনগুলো ৩৬ ইঞ্চির কম নয়, নিতম্ব ৩৮ ইঞ্চি তো হবেই, কোমরখানি তাও ৩৪ ইঞ্চি! উচ্চতায় রামচরনের থেকে এক দেড় ইঞ্চি কমই হবে, ওই ৫’৬’ মতন! এমন আপাত থলথলে গতরে এমন ফ্লেক্সিবিলিটি আসে কোত্থেকে?!
বিন্দুবালা যেন মনের কথা পড়তে পারলো রামচরনের, কতকটা স্বগতোক্তির স্টাইলে বললো – কালারিপায়াত্তুর নাম শুনেছেন রামচরনবাবু? এটি দক্ষীন ভারতের সমর কৃষ্টি! এই কালারিপায়াত্তুকেই কিন্তু প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সমর কৌশলের জনক বলা যেতে পারে! যাই হোক, আপনার এই বিদেশি সমর শিক্ষা, যাকে আপনারা ইংরাজিতে মার্শাল আর্ট বলেন, তার উৎস কিন্তু এই ভারতের মাটিতেই, সে খবর রাখেন? আমার বাবা আমায় সেই শিক্ষায় দীক্ষিত করেছেন! কাজেই এসব দেখে বেশি অবাক হবেন না!
রামচরন কিছু উত্তর করলো না এ কথা শুনে! কিন্তু মনে মনে অদম্য কৌতুহল হলো কালারিপায়াত্তুর ব্যাপারে! সেই কৌতুহল দমন করেই বিন্দুবালার সাথে সাধু বাবার খাটিয়ার সামনে এসে দুজনে দাঁড়ালো! সাধু বাবা তখনও তেমনই নিশ্চল, অনড়, মৃতবৎ শুয়ে রয়েছেন! দাড়ি গোঁফে ঢাকা শত বলিরেখা ঢাকা মুখে একটা জিনিষ লক্ষ্য করে রামচরন অবাক হলো! মুখে যেন একটা হাল্কা হাসি ফুটে উঠেছে! সাধুবাবা হাসছেন নাকি?! ওনার তো কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক!
মিনিট দশেক পরে বিন্দুমালা যেন সম্মোহিতের মতন বলে উঠলো – বাবা! এবার উঠুন! সময় উপস্থিত!
রামচরন আগুনের আলোয় নিজের রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকালো! ঘড়িতে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে এগারোটা বাজে! তারপর যেটা ঘটলো সেটা দেখে রামচরন হতবাক হয়ে গেল! এক ঝটকায় যেন কোন অদৃশ্য তড়িৎস্পর্শে সাধু বাবা তন্দ্রা থেকে জেগে উঠলেন! কোথায় অসুখ, কোথায় দুর্বলতা, কোথায় জরা? খাটিয়ার উপরে যিনি এইমাত্র বসেছেন, তার সারা অঙ্গ দিয়ে যেন তেজ জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে! এ কোনো অশতিপর বৃদ্ধের শরীর তো নয়! এ এক অনন্ত শক্তিমান, অপার তেজস্বী পুরুষ! যাকে সময় স্পর্শ করতে ভয় পায়, যাকে হয়তো স্বয়ং মৃত্যুও স্পর্শ করতে ভয় পাবে! কোন যাদুবলে হলো এই ট্রান্সফর্মেশান! এ কি অলিক ভোজবাজি! নিজের অজান্তেই রাআমচরন নিজের গায়ে চিমটি কাটলো! উফফফফ! ব্যথা! না না, সে কোনো স্বপ্ন দেখছে না! এ যে ঘোর বাস্তব!
খাটিয়াতে উপবিষ্ট সেই অগ্নিপ্রভ মানুষটি গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো – ওম ব্রম্ভায় নমঃ! ওম শিবায় নমঃ! ওম নারায়নায় নমঃ! বৎস, রামচরন, শ্রবন করো! আমি আমার তেজরাশির কিছুটা তোমাদের দান করে যাচ্ছি! তোমাদের জীবনে খুব শীঘ্রই অনেক বড় দুর্বিপাক আসতে চলেছে! আমি মহাকালের সেবক! তাকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, বিন্দু মা আর তুমি একসাথে থাকলে তোমাদের কোনো বিপদই নত বা ধ্বঙ্গস করতে পারবেনা! মহাকালের ইচ্ছে অনুযায়ী অন্তিমেতে সব কিছুই মঙ্গলময় হয়ে উঠবে! আমার বিদায়বেলায় তোমাদেরকে অনুরোধ, অশ্রুপাত করবেনা! তাতে কিন্তু আমার আত্মা রুষ্ট হবে! আমি শুধু এক ঘর থেকে আরেক ঘরে চলেছি! এ কোনো শোকের সময় নয়! এ হলো অপার আনন্দের ক্ষন! এই পোড়া শরীর আমি অনেক বইলাম! এবার দেবধামে যাওয়ার সময় এসেছে!
এই বলে সাধুবাবা জড়তাহীন ভাবে উঠে দাড়ালেন খাটিয়া থেকে! দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপে তিনি এগিয়ে চললেন শিমূল গাছের কাছে খোঁড়া গর্তের দিকে! মুখে তার অপার হাসি, চোখ দুটো দিয়ে পরম মুক্তির আনন্দ ফুটে উঠছে! এক লাফে তিনি গর্তে প্রবেশ করলেন, এ যেন তার কাছে নিছকই ছেলেখেলা! তারপর তিনি নীচেতে মাটির উপরে বসলেন পদ্মাসনে! শিরদাঁড়া একদম সোজা!
খুব স্পষ্ট অথচা ক্ষীন আওয়াজে মন্ত্রোচ্চারন করলেন - ওম ত্রয়োমবকম যজামাহে, সুগান্ধিম পুষ্টি বর্ধনম, উর্বারুকাম এব বন্ধনাত, মৃত্যো মুক্ষসিয়ো মা অমৃতাত! একটু চুপ করলেন সাধুবাবা! রামচরনের রেডিয়ামের ঘড়ি দ্যখাচ্ছে, সময় প্রায় বারোটা! বিন্দুবালা কড়জোড়ে তদগত চিত্তে ক্ষীন স্বরে বিড়বিড় করে কি এক অব্যক্ত মন্ত্র পড়ে চলেছে।! আমগাছের তলায় জ্বলতে থাকা আগুন হঠাত এক দমকা হাওয়া দ্বিগুন জোরে জ্বলে উঠলো!
ঠিক সেই সময়েই সাধুবাবা হাড় হিম করা জলদ্গভীর স্বরে বলে উঠলেন – বায়ুর অনিলাম অমৃতম অথেদাম ভষ্মমন্তাম শরীরম! ওম কৃত স্ম্মরা কৃতম স্মরা কৃত স্মরা কৃতম স্মরা!
এই মন্ত্রোচ্চারনের সঙ্গে সঙ্গেই সাধুবাবার শরীর পলকেই পাথর হয়ে গেল পদ্মাসনে বসেই! ওনার শরীরকে আর রক্তমাংসে গড়া কোনো মানুষের শরীর বলে মনেই হচ্ছেনা! যেন কোনো প্রস্তরমুর্তিকে মাটির উপরে বসানো রয়েছে! বিন্দুবালার দীর্ঘশ্বাসে রামচরনের ঘোর কাটলো!
খানিক ভেজা গলায় বলে উঠলো বিন্দুবালা- সব শেষ! বাবা চলে গেলেন! আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোনা মুছে বিন্দুবালা ধরা গলায় রামচরনের দিকে তাকিয়ে বললো – রামচরনবাবু, এইবার মাটিটা চাপা দিয়ে বাবাকে সমাধিস্ত করতে হবে!
রামচরন জানে। সন্ন্যাসিদের দাহ করা হয়না ধ্যান সমাধির মাধ্যমে তিরোধান হলে! দুজন মিলে সাধুবাবাকে মাটির নীচে চাপা দিয়ে সেই মাটির ঢিবের উপরে বিন্দুবালা ঘড়ায় করে শান্তি জল ঢেলে তার উপরে সাধুবাবার কমন্ডুল রাখলো আর ত্রিশূলটা পুঁতে দিল! রামচরন অপার বিষ্ময়ে দেখছে বিন্দুবালাকে! সেই বাচ্চা বয়েস থেকে এই সাধুবাবাই এই নারীর মহাবিশ্ব, আজ সেই সাধুবাবা গত হলেন! কিন্তু বিন্দুবালা বোধহয় শোকে পাথর হয়ে গেছে! মুখে কোনো কথা নেই, যন্ত্রবৎ সব আচারাদি সম্পন্ন করলো! তখন ধীরে ধীরে পূব দিকে লাল সূর্য্য মাথা চাড়া দিচ্ছে দিগন্তরেখার নীচ থেকে! বিন্দুবালা একবার কবরের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললো – বাবা, ভালো থেকো! আমি আর রামচরন আসলাম!
তারপর রামচরনের দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো – চলুন রামচরন বাবু! আমরা ফিরে যাই! এখানের সব কাজ শেষ!
রামচরন – তোমার জিনিষপত্তর?
বিন্দুবালা ম্লান হেসে জবাব দিল – আমি যে যোগিনী গো! আমার আবার জিনিষপত্তর! এই পুঁটলিটায় কিছু কাপড় আর গয়নাগাটি আছে! বাবাই দিয়েছিলেন! ওগুলোই সম্বল! এখন থেকে আমার ভার আর জ্বালা – সব তো আপনাকেই বইতে হবে রামচরনবাবু! তা আপনি চান কি না চান! চলুন কোথায় যাবেন, চলুন!
রামচরন ঠান্ডাআ মাথায় বললো – আপাতত চলুন আমার বন্ধু আসিফের বাড়িতে! তারপর দিন চারেক পরে সেখানে থেকে চুঁচুড়াতে আমার বসত বাটিতে ফেরত যাবো দুজনায়!
বিন্দুবালা ঘাড় নাড়লো আর বললো – তাই হোক! চলুন তাহলে!
রামচরন – আপনি সে নিয়ে চিন্তিত হবেন না! আমি জীবনে এর থেকেও দুর্গম জায়াগাতে কাটিয়েছি! আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না! আপনি খেলেন না যে ?!
বিন্দুবালার মুখটা বেদনায় যেন কাতর হয়ে উঠলো – আমার, আমার আজ খেতে মন চাইছে না রামচরনবাবু! ও আমার অভ্যেস আছে!
রামচরন – সাধুবাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো কিছুটা সুরাহা হতো। আমার সাথে গাড়ি আছে, এখনো যদি বেরোই, মাঝরাত্তিরে কলকাতার কোনো ভালো হাসপাতালে বাবাকে অ্যাডমিট করাতে পারবো! চলুন ওনাকে নিয়ে যাই!
বিন্দুবালা রুক্ষ স্বরে জবাব দিল – বাবা সিদ্ধ পুরুষ! ওনার আয়ুর্বিদ্যা জানা আছে! চাইলে উনি এখনো নিজেই নিজেকে শুধু সুস্থই করতে পারবেন তাই নয়, উনি নিজের বার্ধক্যকে ত্যাগ করে পুনর্যৌবন লাভ করতে পারেন! উনি সেচ্ছায় সমাধি নিতে চাইছেন! আপনার শরীর দেখেই বুঝেছি, আপনি অমিত ক্ষমতাশালী পুরুষ! তাঁবুতে এক জোড়া শাবল আর বেলচা রাখা আছে! বাবা আগের থেকেই সব জোগাড় করে রেখেছেন! উনি ভবিষ্যত দৃষ্টা! আপনি কি আমায় একটা সাহায্য করবেন? ওই শিমূল কাছের নীচে যেখানে ত্রিশূল পোঁতা আছে দেখছেন, ঠিক ওই জায়গায় একটা গর্ত খুড়োতে হবে – ছয় ফুট গভীর আর চার ফুট বাই চার ফুট মাপের।
রামচরন – গর্তটা খুঁড়ে কি করবেন?
বিন্দুবালা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো – বাবা ওই গর্তেই নির্বিকল্প সমাধি নিয়ে মোক্ষ লাভ করবেন পদ্মাসনে বসে!
রামচরন শুনে আঁতকে উঠলো - অ্যাঁ ! কি বলছেনটা কি আপনি?! তা কি করে সম্ভব! দেখছেন না ওনার অবস্থা! উনি যে বিছানাতে মড়ার মতন শুয়ে আছেন! এই শরীর নিয়ে ওই গর্তে পদ্মাসন? একটা জ্যান্ত মানুষকে বাঁচানোর নূন্যতম চেষ্টাটুকুও করতে দিচ্ছেন না! সব কিছুর একটা সীমা আছে বিন্দুদি!
বিন্দুবালা সহসা সাপের মতন হিসিয়ে উঠলো – চুপ একদম! খুব দরদ না? আমি ২২ বছর বাবার সাথে আছি, ওনার বিষয় আমি যা জানি তা আপনি ছিটেফোঁটাও জানেন না! আপনার চাইতে আমার কষ্ট লক্ষগুন বেশি! আজ আমি অভিভাবখীন হতে চলেছি, তবু সব সহ্য করতে হবে! এ হলো বিধাতার আদেশ, বাবার আদেশ! অন্যথা হবে না! বাধা দিলে আপনাকে আমি শেষ করে দেবো!
রামচরন রাগে ফেটে পড়লো – যা ইচ্ছে তাই করবেন আবার শাষানি দিচ্ছেন? কি করে নেবেন আপনি?! বলে খপ করে বিন্দুবালার হাতটা ধরতে গেলো রামচরন! অবাক বিষ্ময়ে দেখলো যে তার হাত এক মুঠো বাতাসকে খাবলে ধরলো খালি! এত তড়িৎ গতিতে বিন্দুবালা তার হাতখানা সরিয়ে কি করে নিল সেটা রামচরন ভেবে পেলনা! রামচরন এইবার আবার চেষ্টা করলো! আবার ব্যর্থ হলো!
বিন্দুবালা এইবার একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো – দারুন বীরপুঙ্গব আপনি! আর আমি অবলা, অসহায় এক নারী?! তাই না? এটাই তো ভেবে বসে আছেন?! শুনুন, কিছু কিছু বিদ্যে এই বিন্দুবালার পেটেও আছে! জোর করার চেষ্টা করলে আমি আপনার কি হাল করতে পারি তা আপনি জানেন না! তাই চাইলে আমার কাজে সাহায্য করুন! নতুবা চুপটি করে বসে থাকুন বাবার পাশে! বাবা এখন যোগ নিদ্রায় আছেন, দয়া করে চেল্লামেল্লি করে ওনার ধ্যানের ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টা করবেন না! ফল ভালো হবেনা!
সেই ঘোর কালো অমাবস্যার রাতে বিন্দুবালার লাস্যময়ী অপার যোউবনবতী দেহবল্লরিকে যে কোনো পুরুষেরই কামোদ্রেক হবেই! কিন্তু রামচরনের শিরদাঁড়ায় এক শ্রদ্ধা, বিষ্ময় আর ভয়ের সঞ্চার ঘটলো! এ নারী আপাতদৃষ্টিতে যত কমনীয়, মোহময়ী, কুহকিনী মনে হোক না কেন, ইনি অপার শক্তিময়ী! একটা জান্তবতা আর নিষ্ঠুরতার মিশেল ঘটেছে এই লাস্যময়ী তরুনির ব্যক্তিত্বে! এ এক অসাধারন নারী! একে হাল্কাভাবে নিলে খুব ভুল হবে! বিজ্ঞান আর যুক্তিবাদের বাইরেও একটা রহস্যময় দুনিয়া থাকে, সেই কুয়াশায় আচ্ছন্ন, অচেনা জগতের এই মানসকন্যা আর সিদ্ধাই পুরুষকে যুক্তি-তক্ক দিয়ে যে বিচার করা নিরর্থক, তা রাআমচরন হাড়ে হাড়ে টের পেল! সে মার্শাল আর্টে সিদ্ধহস্ত, চোখের পলক পড়ার আআগেই সামনের এক পর্বতপ্রমাণ মানুষকে জুডোর প্যাঁচে সে অনায়াসে ধরাশায়ী করতে পাআরে! কিন্তু এই নারী তাআর ক্ষিপ্রতাকে যেমন অবলীলায় নস্যাৎ করেছে, তাতে একে সাধারন নারী বলে মানতে রামচরন নারাজ!
খানিক চুপ করে থেকে সে চাপা গলায় বলে উঠলো – বেলচা আর শাবলটা দিন!
বিন্দুবালা একটা চাপা হাসি হাসলো, তারপর বললো – শিমূল গাছের নীচেই রাখা আছে সব! আসুন আমার সাথে!
বিন্দুবালা নিজের শাড়িটা গাছকোমর করে বেঁধে নিল! তারপর রামচরন আর বিন্দুবালা মিলে গর্ত খোড়া শুরু করলো শাবল আর বেলচা দিয়ে! প্রায় ঘন্তা চারেকের নিরবিচ্ছিন্ন পরিশ্রমে তাদের গর্ত খোঁড়ার কাজ সম্পন্ন হলো! কাজ শেষ হতে বিন্দুবালা শাবলে এক হাত রেখে গর্তের দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো! রামচরন কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে বিন্দুবালার দিকে তাকিয়ে থাকলো খানিক ক্ষন! তারপর তার বড় মায়া হলো! এগিয়ে গিয়ে বিন্দুবালার কাঁধে হাত রাখলো আলতো করে! বিন্দুবালা এক ঝটকায় সেই হাত সরিয়ে দিল!
বিন্দুবালা হিসহিসিয়ে বলে উঠলো – খবরদার! আমায় স্পর্শ করবেন না! আপনার কাছে আমি আজীবন থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি বাবাকে! তার মানে এই নয় যে আপনি আমাকে ছোঁয়ার স্বত্তাধিকার লাভ করেছেন! দূরে থাকুন! কাছে একদম আসবেন না!
রামচরন খুব আহত হলো মানসিকভাবে, ক্ষুব্ধ অথচ শান্ত কন্ঠে বলে উঠলো – কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে আপনাকে আমি ছুঁই নি বিন্দুদি! তবুও কথা দিচ্ছি, আপনাকে আমি এভাবে কখনো বিব্রত করবোনা!
বিন্দুবালা সে কথা শুনতে পেল কিনা জানা নেই! আকাশের মিটমিটে তারার দিকে অশ্রুসিক্ত চোখে তাকিয়ে বললো – সময় হয়েছে, চলুন, বাবার তিরোধান হতে বেশি দেরী নেই!
বিন্দুবালা বেড়ালের ক্ষীপ্রতায় গর্ত থেকে মাটির উপরে এসে গেল, রামচরনও নিপুন দক্ষতায় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসলো! একবার সপ্রশংস দৃষ্টিতে বিন্দুবালার না তাকিয়ে থাকতে পারলো না রামচরন! বিন্দুবালার স্তনগুলো ৩৬ ইঞ্চির কম নয়, নিতম্ব ৩৮ ইঞ্চি তো হবেই, কোমরখানি তাও ৩৪ ইঞ্চি! উচ্চতায় রামচরনের থেকে এক দেড় ইঞ্চি কমই হবে, ওই ৫’৬’ মতন! এমন আপাত থলথলে গতরে এমন ফ্লেক্সিবিলিটি আসে কোত্থেকে?!
বিন্দুবালা যেন মনের কথা পড়তে পারলো রামচরনের, কতকটা স্বগতোক্তির স্টাইলে বললো – কালারিপায়াত্তুর নাম শুনেছেন রামচরনবাবু? এটি দক্ষীন ভারতের সমর কৃষ্টি! এই কালারিপায়াত্তুকেই কিন্তু প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সমর কৌশলের জনক বলা যেতে পারে! যাই হোক, আপনার এই বিদেশি সমর শিক্ষা, যাকে আপনারা ইংরাজিতে মার্শাল আর্ট বলেন, তার উৎস কিন্তু এই ভারতের মাটিতেই, সে খবর রাখেন? আমার বাবা আমায় সেই শিক্ষায় দীক্ষিত করেছেন! কাজেই এসব দেখে বেশি অবাক হবেন না!
রামচরন কিছু উত্তর করলো না এ কথা শুনে! কিন্তু মনে মনে অদম্য কৌতুহল হলো কালারিপায়াত্তুর ব্যাপারে! সেই কৌতুহল দমন করেই বিন্দুবালার সাথে সাধু বাবার খাটিয়ার সামনে এসে দুজনে দাঁড়ালো! সাধু বাবা তখনও তেমনই নিশ্চল, অনড়, মৃতবৎ শুয়ে রয়েছেন! দাড়ি গোঁফে ঢাকা শত বলিরেখা ঢাকা মুখে একটা জিনিষ লক্ষ্য করে রামচরন অবাক হলো! মুখে যেন একটা হাল্কা হাসি ফুটে উঠেছে! সাধুবাবা হাসছেন নাকি?! ওনার তো কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক!
মিনিট দশেক পরে বিন্দুমালা যেন সম্মোহিতের মতন বলে উঠলো – বাবা! এবার উঠুন! সময় উপস্থিত!
রামচরন আগুনের আলোয় নিজের রিস্ট ওয়াচের দিকে তাকালো! ঘড়িতে ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে এগারোটা বাজে! তারপর যেটা ঘটলো সেটা দেখে রামচরন হতবাক হয়ে গেল! এক ঝটকায় যেন কোন অদৃশ্য তড়িৎস্পর্শে সাধু বাবা তন্দ্রা থেকে জেগে উঠলেন! কোথায় অসুখ, কোথায় দুর্বলতা, কোথায় জরা? খাটিয়ার উপরে যিনি এইমাত্র বসেছেন, তার সারা অঙ্গ দিয়ে যেন তেজ জ্যোতি ঠিকরে বেরোচ্ছে! এ কোনো অশতিপর বৃদ্ধের শরীর তো নয়! এ এক অনন্ত শক্তিমান, অপার তেজস্বী পুরুষ! যাকে সময় স্পর্শ করতে ভয় পায়, যাকে হয়তো স্বয়ং মৃত্যুও স্পর্শ করতে ভয় পাবে! কোন যাদুবলে হলো এই ট্রান্সফর্মেশান! এ কি অলিক ভোজবাজি! নিজের অজান্তেই রাআমচরন নিজের গায়ে চিমটি কাটলো! উফফফফ! ব্যথা! না না, সে কোনো স্বপ্ন দেখছে না! এ যে ঘোর বাস্তব!
খাটিয়াতে উপবিষ্ট সেই অগ্নিপ্রভ মানুষটি গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠলো – ওম ব্রম্ভায় নমঃ! ওম শিবায় নমঃ! ওম নারায়নায় নমঃ! বৎস, রামচরন, শ্রবন করো! আমি আমার তেজরাশির কিছুটা তোমাদের দান করে যাচ্ছি! তোমাদের জীবনে খুব শীঘ্রই অনেক বড় দুর্বিপাক আসতে চলেছে! আমি মহাকালের সেবক! তাকে স্বাক্ষী রেখে বলছি, বিন্দু মা আর তুমি একসাথে থাকলে তোমাদের কোনো বিপদই নত বা ধ্বঙ্গস করতে পারবেনা! মহাকালের ইচ্ছে অনুযায়ী অন্তিমেতে সব কিছুই মঙ্গলময় হয়ে উঠবে! আমার বিদায়বেলায় তোমাদেরকে অনুরোধ, অশ্রুপাত করবেনা! তাতে কিন্তু আমার আত্মা রুষ্ট হবে! আমি শুধু এক ঘর থেকে আরেক ঘরে চলেছি! এ কোনো শোকের সময় নয়! এ হলো অপার আনন্দের ক্ষন! এই পোড়া শরীর আমি অনেক বইলাম! এবার দেবধামে যাওয়ার সময় এসেছে!
এই বলে সাধুবাবা জড়তাহীন ভাবে উঠে দাড়ালেন খাটিয়া থেকে! দৃপ্ত ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপে তিনি এগিয়ে চললেন শিমূল গাছের কাছে খোঁড়া গর্তের দিকে! মুখে তার অপার হাসি, চোখ দুটো দিয়ে পরম মুক্তির আনন্দ ফুটে উঠছে! এক লাফে তিনি গর্তে প্রবেশ করলেন, এ যেন তার কাছে নিছকই ছেলেখেলা! তারপর তিনি নীচেতে মাটির উপরে বসলেন পদ্মাসনে! শিরদাঁড়া একদম সোজা!
খুব স্পষ্ট অথচা ক্ষীন আওয়াজে মন্ত্রোচ্চারন করলেন - ওম ত্রয়োমবকম যজামাহে, সুগান্ধিম পুষ্টি বর্ধনম, উর্বারুকাম এব বন্ধনাত, মৃত্যো মুক্ষসিয়ো মা অমৃতাত! একটু চুপ করলেন সাধুবাবা! রামচরনের রেডিয়ামের ঘড়ি দ্যখাচ্ছে, সময় প্রায় বারোটা! বিন্দুবালা কড়জোড়ে তদগত চিত্তে ক্ষীন স্বরে বিড়বিড় করে কি এক অব্যক্ত মন্ত্র পড়ে চলেছে।! আমগাছের তলায় জ্বলতে থাকা আগুন হঠাত এক দমকা হাওয়া দ্বিগুন জোরে জ্বলে উঠলো!
ঠিক সেই সময়েই সাধুবাবা হাড় হিম করা জলদ্গভীর স্বরে বলে উঠলেন – বায়ুর অনিলাম অমৃতম অথেদাম ভষ্মমন্তাম শরীরম! ওম কৃত স্ম্মরা কৃতম স্মরা কৃত স্মরা কৃতম স্মরা!
এই মন্ত্রোচ্চারনের সঙ্গে সঙ্গেই সাধুবাবার শরীর পলকেই পাথর হয়ে গেল পদ্মাসনে বসেই! ওনার শরীরকে আর রক্তমাংসে গড়া কোনো মানুষের শরীর বলে মনেই হচ্ছেনা! যেন কোনো প্রস্তরমুর্তিকে মাটির উপরে বসানো রয়েছে! বিন্দুবালার দীর্ঘশ্বাসে রামচরনের ঘোর কাটলো!
খানিক ভেজা গলায় বলে উঠলো বিন্দুবালা- সব শেষ! বাবা চলে গেলেন! আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখের কোনা মুছে বিন্দুবালা ধরা গলায় রামচরনের দিকে তাকিয়ে বললো – রামচরনবাবু, এইবার মাটিটা চাপা দিয়ে বাবাকে সমাধিস্ত করতে হবে!
রামচরন জানে। সন্ন্যাসিদের দাহ করা হয়না ধ্যান সমাধির মাধ্যমে তিরোধান হলে! দুজন মিলে সাধুবাবাকে মাটির নীচে চাপা দিয়ে সেই মাটির ঢিবের উপরে বিন্দুবালা ঘড়ায় করে শান্তি জল ঢেলে তার উপরে সাধুবাবার কমন্ডুল রাখলো আর ত্রিশূলটা পুঁতে দিল! রামচরন অপার বিষ্ময়ে দেখছে বিন্দুবালাকে! সেই বাচ্চা বয়েস থেকে এই সাধুবাবাই এই নারীর মহাবিশ্ব, আজ সেই সাধুবাবা গত হলেন! কিন্তু বিন্দুবালা বোধহয় শোকে পাথর হয়ে গেছে! মুখে কোনো কথা নেই, যন্ত্রবৎ সব আচারাদি সম্পন্ন করলো! তখন ধীরে ধীরে পূব দিকে লাল সূর্য্য মাথা চাড়া দিচ্ছে দিগন্তরেখার নীচ থেকে! বিন্দুবালা একবার কবরের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললো – বাবা, ভালো থেকো! আমি আর রামচরন আসলাম!
তারপর রামচরনের দিকে ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো – চলুন রামচরন বাবু! আমরা ফিরে যাই! এখানের সব কাজ শেষ!
রামচরন – তোমার জিনিষপত্তর?
বিন্দুবালা ম্লান হেসে জবাব দিল – আমি যে যোগিনী গো! আমার আবার জিনিষপত্তর! এই পুঁটলিটায় কিছু কাপড় আর গয়নাগাটি আছে! বাবাই দিয়েছিলেন! ওগুলোই সম্বল! এখন থেকে আমার ভার আর জ্বালা – সব তো আপনাকেই বইতে হবে রামচরনবাবু! তা আপনি চান কি না চান! চলুন কোথায় যাবেন, চলুন!
রামচরন ঠান্ডাআ মাথায় বললো – আপাতত চলুন আমার বন্ধু আসিফের বাড়িতে! তারপর দিন চারেক পরে সেখানে থেকে চুঁচুড়াতে আমার বসত বাটিতে ফেরত যাবো দুজনায়!
বিন্দুবালা ঘাড় নাড়লো আর বললো – তাই হোক! চলুন তাহলে!