28-12-2020, 11:30 PM
আমার দিকে এগিয়ে আসে শুভ্র, আমি প্রমাদ গুনি সেই আনন্দের। চোখ বন্ধ করে নেই, আমার শ্বাসের গতি বেড়ে চলে। বন্ধ চোখের সামনে অসংখ্য তারা বাতির আলো জ্বলে ওঠে। সারা শরীরের যত গুলো ধমনী ছিল সব গুলোর মধ্যে রক্ত যেন তীরের বেগে ছুটতে শুরু করে দিয়েছে। শ্বাসের বর্ধিত গতির জন্য আমার বুক দুটি হাপরের মতন ওঠা নামা করতে থাকে। আমি বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারি যে আমার কুঁচ যুগল আমার অন্তর্বাসের অভ্যন্তরে পিষ্ট হচ্ছে। আমার সারা শরীরে একের পর এক বিদ্যুৎ ঝলকানি খেলে যেতে থাকে। আমি আসন্ন আলিঙ্গনে বদ্ধ হবার উন্মুখ আশঙ্কায় তির তির করে কেঁপে উঠি। ওর পায়ের শব্দ ধিরে ধিরে আমার কাছে এগিয়ে আসে। আমি নাকে ভেসে আসে ওর গায়ের গন্ধ। আমি বুঝতে পারি ও আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। আমার শরীর বারংবার কেঁপে ওঠে একটা ভিজে পায়রার মতন, কিছুটা ঠাণ্ডায় বেশিটা ওর বাহুপাশে বদ্ধ হবার আশঙ্কায়।
এক সেকেন্ড যেন এক একটা বছর মনে হয় আমার। অবশেষে আমার সব আশঙ্কা ঘুচিয়ে দিয়ে আমাকে শাল জড়িয়ে দিল। আমি চোখ না খুলেই ওর মুখের দিকে মাথা উঁচু করে নেই। ঠোঁট জোড়া তির তির করে কাঁপতে থাকে যেন ওকে আহ্বান জানায় আমার সুধা পান করার জন্য। ও আমার চারদিকে শাল জড়িয়ে দিয়ে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমার বুকের ভেতরটা যেন গলে পরে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসে। আমি যেন একটা পুতুলের ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
অল্পক্ষণ না অনেক্ষন জানিনা, বহু দূর দিয়ে ওর গলার স্বর ভেসে আসে---"অহনা, চোখ খোল প্লিস।"
দৃষ্টি ঝাপ্সা আমার, আস্তে আস্তে চোখ খুলি আমি। ও আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে। আমার সারা মুখের ওপরে ওর উষ্ণ প্রশ্বাস ঢেউ খেলে বেড়ায়।
"আমার কিছু বলার আছে, শুভ্র। আমার অনেক কিছু বলার আছে তোকে আজ।" ঠোঁট কেঁপে ওঠে আমার কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। কেউ যেন আমার গলার আওয়াজ কেড়ে নিয়েছে।
---"অনেক রাত হয়ে গেছে, তুই শুতে যা।"
আমি নড়ে উঠি ওর কথা শুনে---"তুই কোথায় শুবি?"
---"আমি বসার ঘরে সোফার ওপরে শুয়ে পরবো, তুই আমার খাটে শুয়ে পর।"
আমি মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকি, ও হটাত করে আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি আর থাকতে পারিনা, আমার যত সংকচ সব ছুঁড়ে ফেলে হাত দুটি দিয়ে ওর বলিষ্ঠ শরীর কে আলিঙ্গন করে নেই। ও আমার মাথার ওপরে আলতো করে একটা চুমু খায়, আমার সারা শরীর গলে ওঠে। ওর বুকে মাথা গুঁজে থাকি ওর শরীরের শেষ উষ্ণতা টুকু নিঙরে নিজের মধ্যে করে নিতে। সর্ব সক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরি আমি, পৃথিবীর কোন শক্তি যেন আমাকে ওর কাছ থেকে বিচ্ছেদ না করতে পারে। ওর বুকের ওপরে ধিরে ধিরে আমি নিজের মুখ ঘসতে থাকি, আমার নাকে ওর গায়ের গন্ধ ভেসে আসে। বলিষ্ঠ বাহুপাশে আমার নরম শরীরটা যেন পিষ্ট হতে বাকি রাখে ও। জড়িয়ে ধরে ছিল আমায় কিন্তু সেই জড়িয়ে ধরার মধ্যেও আমি কেমন যেন একটা দ্বিধা বোধের আশঙ্কা খুঁজে পাই। আমি বুঝে উঠতে পারিনা, শুভ্র কেন আমাকে এতো ভালবাসার পরেও কিছু বলছেনা।
আমি থাকতে না পেরে বলে উঠি---"কিছু তো বল আজ, কেন তুই চুপ করে থাকিস। আমি ও জানি তুই কি চাস তুই ও জানিস আমি কাকে চাই। তাও কেন আমাকে তুই বলতে পারিসনা।"
আমি বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারি যে আমার কথা শুনে ওর বুক কাঁপছে। আমি ওর কপম্পন আমার গালের ওপরে অনুভব করি। ধিরে ধিরে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে জল। সেই জল দেখে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা। আমার গাল বেয়ে আমার চোখের জল নেমে আসে।
---"কি যে বলি তোকে আমি নিজে জানিনা রে অহনা।"
আমি নিজেকে আস্তে আস্তে ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বলি---"কেন আমাকে তোর লুকোনোর কি আছে শুনি?"
আমাকে বসার ঘরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে---"আমি তোর জীবনের এগিয়ে যাবার পথের কাঁটা হতে চাইনা।"
আমি চিৎকার করে উঠি---"মানে? তুই কেন আমার পথের কাঁটা হবি?"
আমার পায়ের কাছে বসে পরে আমার হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। আমার বুক ভেদ করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে।
সত্যি কি প্রেম ছিল (#20)
তারপরে আস্তে আস্তে বলে ওঠে---"আমার ভবিষ্যতের কোন ঠিকানা নেই, অহনা। তোর সামনে একটা বিশাল জীবন পরে আছে।"
আমার বুক কেঁপে ওঠে, ও থামেনা "আমি চিরটাকাল ভবঘুরের মতন এখানে সেখানে করে কাটিয়েছি। অনেক দিন ধরে হস্টেলে থেকে থেকে ভেতরটা পাষাণ হয়ে গেছে। আমি যা ছুঁতে চাই তাই আমার কাছ থেকে দূরে চলে যায়। ছোটো বেলায় মা মারা যাবার পরে আমি ভেবেছিলাম আমি বাবার সাথে থাকব, কিন্তু আমাকে দূর বিহারে কোন এক হস্টেলে পাঠিয়ে তিনি নিজের কর্তব্য করেছেন। ভালবাসার নামে প্রতেক মাসে একটা চেক আমার ব্যাঙ্কের খাতায় জমা পরে। চার বছর আগে কলকাতা ফিরে আসি আমি এই ভেবে যে বাবা আর আমি এক সাথে থাকব। কিন্তু আমার মামা যখন আমায় হোস্টেল থেকে আনতে যায় তখন আমায় বলে যে বাবা আমার আবার একটা বিয়ে করেছেন। তার বিয়ে করা নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই, সেটা তার নিজের জীবন, তিনি কি ভাবে বাঁচবেন তার জীবন, সেটা নিয়ে আমি প্রশ্ন করার কে? আমি শুধু চেয়েছিলাম তার কাছে থাকতে, সেটা হয়ে ওঠেনি। তার বদলে পেলাম একটা চেক।"
আমি অবাক হয়ে হাঁ করে ওর কথা গুলো শুনতে থাকি, নিজের বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা, চোখ দিয়ে অবিশ্রাম বারিধারা বয়ে চলে। আমার সারা শরীর মৃদু মৃদু শিহরনে কেঁপে ওঠে।
---"তুই এম-এস-সি করবি, আমার পড়া এখানে শেষ। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাবো, ফিরবনা কোনোদিন।"
আমি চিৎকার করে উঠি---"না তুই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারিস না"
---"আমার কথা শোন দয়া করে, তারপরে বলিস।"
আমি বারংবার মাথা ঝাঁকাই, আমার বুক কাঁপতে থাকে, বন্যা নেমে আসে আমার দু চোখ দিয়ে---"না আমি কিছু আর শুনতে চাই না। তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিসনা।"
কান্না জড়ানো গলায় ও বলে যেতে থাকে---"এক সময় তোর মনে হবে কেউ থাকলে ভাল হতো যার কাঁধে মাথা রেখে কিছু মনের কথা বলতে পারতাম, আমার ও এক সময় মনে হবে এই কথা। হয়তো আজ নয় অনেক দিন পরে। অনেক কথা হয়তো আমরা নিজেদের শয়ন সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে বলে উঠতে পারবোনা, সেই ব্যাথা গুলো আমরা একে অপরকে জানাব। সব সময় তো আর এক ছাদের তলায় থাকলে বুকের ব্যাথা অপরকে জানানো যায়না। সেই সময় আমি থাকব তোর কাছে।"
আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে, ওকে কি বলবো কিছু ভেবে পাইনা আমি। এক ভাবে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে, নাকের ফুটো বারংবার ফুলে ওঠে। আমার দুই হাত ওর হাতের মুঠোয় বরফের মতন জমে যায়। আমি সব শক্তি হারিয়ে ফেলি, একটু যে নড়ে বসবো সেটার ক্ষমতা ও থাকে না আমার মধ্যে।
দু জনে চুপ করে বসে থাকি, ও আমার পায়ের কাছে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ভাষা হারিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
কিছুক্ষণ পরে কাঁপা স্বরে বলে উঠি---"তুই আমার সব থেকে ভাল বন্ধু রে।" বুকের এক একটা পাঁজর ভাঙতে থাকে যখন আমি ওকে ঐ কথা গুলো বলতে থাকি "আমি নিজেকে কোন দিন যা ভাবিনি সেটা তুই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছিস। অনেক স্বপ্ন ছিল ডানা মেলে এই আকাশে উড়ে যেতে, সেটা তুই শিখিয়েছিস। আর সব থেকে বড়, আমাকে নিজেকে ভালবাসতে শিখিয়েছিস তুই। কিন্তু তুই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারিসনা, শুভ্র।"
"আমি তোকে ছেড়ে যাবো না তোর কাছেই থাকব, ডাক দিস আমি আসবো।" তারপরে হটাত করে হেসে ওঠে "আরে পাগলী মেয়ে, অনেক রাত হল, শুতে হবে, কাল ছুটি, সকাল সকাল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে আমার শান্তি।"
আমি কান্না জড়ানো গলায় হেসে উঠি---"তুই না কি যে আর বলি তোকে। নাই বা শুলাম আজ রাতে। ধরে নে এটা আমাদের জীবনের শেষ রাত, কি করতিস তুই?"
বুক থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে ও বলে---"তোকে আগে ঘুম পারাতাম তার পরে আমি ঘুমিয়ে পরতাম।"
ওর কথা শুনে আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারিনা---"ঘুমটা তো পাড়া আগে।"
ও আমার গালে হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয়---"শুতে চাস না, তাহলে আর কি, চল গল্প করি।"
সত্যি কি প্রেম ছিল (#21)
যে মুহূর্তে ওর হাত আমার গালে আসে, আমি কেঁপে উঠি আমি ওর হাতের ওপরে হাত রেখে গালের সাথে চেপে ধরি।
ও আস্তে আস্তে হাতটা সরিয়ে নিয়ে আমায় বলে---"অহনা, আমাদের শোয়া উচিৎ। গল্প করা টা হয়তো ঠিক হবেনা।" আস্তে আস্তে আমার হাত ধরে উঠায় সোফা থেকে, আমাকে ও ওর নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে---"শুয়ে পর প্লিস। এর পরে যদি জেগে থাকি তাহলে হয়তো আর আমরা নিজেদের সামলে রাখতে পারবোনা। আমি চাই না আমি তোকে কিছু করি।"
আমি হাত টা ওর হাত থেকে টেনে নিতে নিতে বলি---"আমি জানিনা এটা কি হয়ে গেলো আমাদের মধ্যে, তবে তুই আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলি।"
সারা টা রাত আমি জেগে কাটা ই, দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা। বুকের মাঝে এক ভীষণ ঝঞ্ঝা বারংবার আমার হৃদয় টা দোলাতে থাকে সারা রাত ধরে। আমি সারা রাত বিছানার এ পাশ থেকে ও পাশ করতে থাকি আর নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি "একি হল আমার।"
মাঝ রাতে উঠে দেখি, সোফার ওপরে গুটি শুটি মেরে পরে আছে শুভ্র একটা শাল গায় দিয়ে। টেবিলের ওপরে একটা গেলাস, তাতে কোকা কোলা রঙের কিছু। মাঝে মাঝে একটু একটু চুমুক দিচ্ছে গেলাসে আর আমার দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। যেহেতু আমার ঘরের আলো বন্ধ তাই আমাকে ঠিক ভাবে দেখতে পারেনা ও। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে এক মনে দেখে যেতে থাকি। শুভ্রর চোখ দুটি জবা ফুলের মতন লাল হয়ে জ্বলছে যেন। আমি বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারি ওর বুকের পাঁজর গুলো এক এক করে ভাঙছে, সেই নিস্তব্ধ রাতে ওর বুকের পাঁজরের ভাঙ্গার আওয়াজ আমার কানে ভীষণ ভাবে ধাক্কা দিতে থাকে।
আমি চুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে অন্ধকারে মিলিয়ে দিতে প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। প্রানপনে ডাকতে থাকি "তারা তারি যেন সকাল হয় আমি আর পারছিনা ওর চোখের সামনে থাকতে। আমি হয়তো মারা যাবো না হলে ও হয়তো নিজেকে শেষ করে দেবে।"
সেই বেদনাময় রাত বা মধুময় রাত, জানিনা সেই রাত কি ছিল, তবে সেই রাত আমার জীবনের সব থেকে বড় রাত। সকাল হতে আর যেন চায়না আকাশ, সূর্য্যি মামা যেন আর উঠতে চায়না তার বালিশ ছেড়ে। আমি প্রান পনে বালিশটাকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে আমার বুক ফাটার আওয়াজ লুকিয়ে রাখি, পাছে ও শুনতে পায় আমার কান্না, সেই ভয়ে।
======সমাপ্ত======
এক সেকেন্ড যেন এক একটা বছর মনে হয় আমার। অবশেষে আমার সব আশঙ্কা ঘুচিয়ে দিয়ে আমাকে শাল জড়িয়ে দিল। আমি চোখ না খুলেই ওর মুখের দিকে মাথা উঁচু করে নেই। ঠোঁট জোড়া তির তির করে কাঁপতে থাকে যেন ওকে আহ্বান জানায় আমার সুধা পান করার জন্য। ও আমার চারদিকে শাল জড়িয়ে দিয়ে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমার বুকের ভেতরটা যেন গলে পরে। রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে আসে। আমি যেন একটা পুতুলের ন্যায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
অল্পক্ষণ না অনেক্ষন জানিনা, বহু দূর দিয়ে ওর গলার স্বর ভেসে আসে---"অহনা, চোখ খোল প্লিস।"
দৃষ্টি ঝাপ্সা আমার, আস্তে আস্তে চোখ খুলি আমি। ও আমার দিকে এক ভাবে তাকিয়ে আছে। আমার সারা মুখের ওপরে ওর উষ্ণ প্রশ্বাস ঢেউ খেলে বেড়ায়।
"আমার কিছু বলার আছে, শুভ্র। আমার অনেক কিছু বলার আছে তোকে আজ।" ঠোঁট কেঁপে ওঠে আমার কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। কেউ যেন আমার গলার আওয়াজ কেড়ে নিয়েছে।
---"অনেক রাত হয়ে গেছে, তুই শুতে যা।"
আমি নড়ে উঠি ওর কথা শুনে---"তুই কোথায় শুবি?"
---"আমি বসার ঘরে সোফার ওপরে শুয়ে পরবো, তুই আমার খাটে শুয়ে পর।"
আমি মাথা নিচু করে চলে যেতে থাকি, ও হটাত করে আমায় জড়িয়ে ধরে। আমি আর থাকতে পারিনা, আমার যত সংকচ সব ছুঁড়ে ফেলে হাত দুটি দিয়ে ওর বলিষ্ঠ শরীর কে আলিঙ্গন করে নেই। ও আমার মাথার ওপরে আলতো করে একটা চুমু খায়, আমার সারা শরীর গলে ওঠে। ওর বুকে মাথা গুঁজে থাকি ওর শরীরের শেষ উষ্ণতা টুকু নিঙরে নিজের মধ্যে করে নিতে। সর্ব সক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরি আমি, পৃথিবীর কোন শক্তি যেন আমাকে ওর কাছ থেকে বিচ্ছেদ না করতে পারে। ওর বুকের ওপরে ধিরে ধিরে আমি নিজের মুখ ঘসতে থাকি, আমার নাকে ওর গায়ের গন্ধ ভেসে আসে। বলিষ্ঠ বাহুপাশে আমার নরম শরীরটা যেন পিষ্ট হতে বাকি রাখে ও। জড়িয়ে ধরে ছিল আমায় কিন্তু সেই জড়িয়ে ধরার মধ্যেও আমি কেমন যেন একটা দ্বিধা বোধের আশঙ্কা খুঁজে পাই। আমি বুঝে উঠতে পারিনা, শুভ্র কেন আমাকে এতো ভালবাসার পরেও কিছু বলছেনা।
আমি থাকতে না পেরে বলে উঠি---"কিছু তো বল আজ, কেন তুই চুপ করে থাকিস। আমি ও জানি তুই কি চাস তুই ও জানিস আমি কাকে চাই। তাও কেন আমাকে তুই বলতে পারিসনা।"
আমি বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারি যে আমার কথা শুনে ওর বুক কাঁপছে। আমি ওর কপম্পন আমার গালের ওপরে অনুভব করি। ধিরে ধিরে মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখে জল। সেই জল দেখে আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা। আমার গাল বেয়ে আমার চোখের জল নেমে আসে।
---"কি যে বলি তোকে আমি নিজে জানিনা রে অহনা।"
আমি নিজেকে আস্তে আস্তে ওর আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করে বলি---"কেন আমাকে তোর লুকোনোর কি আছে শুনি?"
আমাকে বসার ঘরে নিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলে---"আমি তোর জীবনের এগিয়ে যাবার পথের কাঁটা হতে চাইনা।"
আমি চিৎকার করে উঠি---"মানে? তুই কেন আমার পথের কাঁটা হবি?"
আমার পায়ের কাছে বসে পরে আমার হাত দুটি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেয়। আমার বুক ভেদ করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে আমার মুখের দিকে।
সত্যি কি প্রেম ছিল (#20)
তারপরে আস্তে আস্তে বলে ওঠে---"আমার ভবিষ্যতের কোন ঠিকানা নেই, অহনা। তোর সামনে একটা বিশাল জীবন পরে আছে।"
আমার বুক কেঁপে ওঠে, ও থামেনা "আমি চিরটাকাল ভবঘুরের মতন এখানে সেখানে করে কাটিয়েছি। অনেক দিন ধরে হস্টেলে থেকে থেকে ভেতরটা পাষাণ হয়ে গেছে। আমি যা ছুঁতে চাই তাই আমার কাছ থেকে দূরে চলে যায়। ছোটো বেলায় মা মারা যাবার পরে আমি ভেবেছিলাম আমি বাবার সাথে থাকব, কিন্তু আমাকে দূর বিহারে কোন এক হস্টেলে পাঠিয়ে তিনি নিজের কর্তব্য করেছেন। ভালবাসার নামে প্রতেক মাসে একটা চেক আমার ব্যাঙ্কের খাতায় জমা পরে। চার বছর আগে কলকাতা ফিরে আসি আমি এই ভেবে যে বাবা আর আমি এক সাথে থাকব। কিন্তু আমার মামা যখন আমায় হোস্টেল থেকে আনতে যায় তখন আমায় বলে যে বাবা আমার আবার একটা বিয়ে করেছেন। তার বিয়ে করা নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই, সেটা তার নিজের জীবন, তিনি কি ভাবে বাঁচবেন তার জীবন, সেটা নিয়ে আমি প্রশ্ন করার কে? আমি শুধু চেয়েছিলাম তার কাছে থাকতে, সেটা হয়ে ওঠেনি। তার বদলে পেলাম একটা চেক।"
আমি অবাক হয়ে হাঁ করে ওর কথা গুলো শুনতে থাকি, নিজের বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারিনা, চোখ দিয়ে অবিশ্রাম বারিধারা বয়ে চলে। আমার সারা শরীর মৃদু মৃদু শিহরনে কেঁপে ওঠে।
---"তুই এম-এস-সি করবি, আমার পড়া এখানে শেষ। আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাবো, ফিরবনা কোনোদিন।"
আমি চিৎকার করে উঠি---"না তুই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারিস না"
---"আমার কথা শোন দয়া করে, তারপরে বলিস।"
আমি বারংবার মাথা ঝাঁকাই, আমার বুক কাঁপতে থাকে, বন্যা নেমে আসে আমার দু চোখ দিয়ে---"না আমি কিছু আর শুনতে চাই না। তুই আমাকে ছেড়ে যেতে পারিসনা।"
কান্না জড়ানো গলায় ও বলে যেতে থাকে---"এক সময় তোর মনে হবে কেউ থাকলে ভাল হতো যার কাঁধে মাথা রেখে কিছু মনের কথা বলতে পারতাম, আমার ও এক সময় মনে হবে এই কথা। হয়তো আজ নয় অনেক দিন পরে। অনেক কথা হয়তো আমরা নিজেদের শয়ন সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে বলে উঠতে পারবোনা, সেই ব্যাথা গুলো আমরা একে অপরকে জানাব। সব সময় তো আর এক ছাদের তলায় থাকলে বুকের ব্যাথা অপরকে জানানো যায়না। সেই সময় আমি থাকব তোর কাছে।"
আমার চোখ লাল হয়ে ওঠে, ওকে কি বলবো কিছু ভেবে পাইনা আমি। এক ভাবে তাকিয়ে থাকি ওর মুখের দিকে, নাকের ফুটো বারংবার ফুলে ওঠে। আমার দুই হাত ওর হাতের মুঠোয় বরফের মতন জমে যায়। আমি সব শক্তি হারিয়ে ফেলি, একটু যে নড়ে বসবো সেটার ক্ষমতা ও থাকে না আমার মধ্যে।
দু জনে চুপ করে বসে থাকি, ও আমার পায়ের কাছে আমার হাত দুটি নিজের হাতে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ভাষা হারিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি।
কিছুক্ষণ পরে কাঁপা স্বরে বলে উঠি---"তুই আমার সব থেকে ভাল বন্ধু রে।" বুকের এক একটা পাঁজর ভাঙতে থাকে যখন আমি ওকে ঐ কথা গুলো বলতে থাকি "আমি নিজেকে কোন দিন যা ভাবিনি সেটা তুই আমাকে ভাবতে শিখিয়েছিস। অনেক স্বপ্ন ছিল ডানা মেলে এই আকাশে উড়ে যেতে, সেটা তুই শিখিয়েছিস। আর সব থেকে বড়, আমাকে নিজেকে ভালবাসতে শিখিয়েছিস তুই। কিন্তু তুই আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারিসনা, শুভ্র।"
"আমি তোকে ছেড়ে যাবো না তোর কাছেই থাকব, ডাক দিস আমি আসবো।" তারপরে হটাত করে হেসে ওঠে "আরে পাগলী মেয়ে, অনেক রাত হল, শুতে হবে, কাল ছুটি, সকাল সকাল তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে আমার শান্তি।"
আমি কান্না জড়ানো গলায় হেসে উঠি---"তুই না কি যে আর বলি তোকে। নাই বা শুলাম আজ রাতে। ধরে নে এটা আমাদের জীবনের শেষ রাত, কি করতিস তুই?"
বুক থেকে একটা বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে ও বলে---"তোকে আগে ঘুম পারাতাম তার পরে আমি ঘুমিয়ে পরতাম।"
ওর কথা শুনে আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারিনা---"ঘুমটা তো পাড়া আগে।"
ও আমার গালে হাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয়---"শুতে চাস না, তাহলে আর কি, চল গল্প করি।"
সত্যি কি প্রেম ছিল (#21)
যে মুহূর্তে ওর হাত আমার গালে আসে, আমি কেঁপে উঠি আমি ওর হাতের ওপরে হাত রেখে গালের সাথে চেপে ধরি।
ও আস্তে আস্তে হাতটা সরিয়ে নিয়ে আমায় বলে---"অহনা, আমাদের শোয়া উচিৎ। গল্প করা টা হয়তো ঠিক হবেনা।" আস্তে আস্তে আমার হাত ধরে উঠায় সোফা থেকে, আমাকে ও ওর নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলে---"শুয়ে পর প্লিস। এর পরে যদি জেগে থাকি তাহলে হয়তো আর আমরা নিজেদের সামলে রাখতে পারবোনা। আমি চাই না আমি তোকে কিছু করি।"
আমি হাত টা ওর হাত থেকে টেনে নিতে নিতে বলি---"আমি জানিনা এটা কি হয়ে গেলো আমাদের মধ্যে, তবে তুই আমাকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেলি।"
সারা টা রাত আমি জেগে কাটা ই, দু চোখের পাতা এক করতে পারিনা। বুকের মাঝে এক ভীষণ ঝঞ্ঝা বারংবার আমার হৃদয় টা দোলাতে থাকে সারা রাত ধরে। আমি সারা রাত বিছানার এ পাশ থেকে ও পাশ করতে থাকি আর নিজেকে প্রশ্ন করতে থাকি "একি হল আমার।"
মাঝ রাতে উঠে দেখি, সোফার ওপরে গুটি শুটি মেরে পরে আছে শুভ্র একটা শাল গায় দিয়ে। টেবিলের ওপরে একটা গেলাস, তাতে কোকা কোলা রঙের কিছু। মাঝে মাঝে একটু একটু চুমুক দিচ্ছে গেলাসে আর আমার দরজার দিকে তাকিয়ে বসে আছে। যেহেতু আমার ঘরের আলো বন্ধ তাই আমাকে ঠিক ভাবে দেখতে পারেনা ও। আমি দরজায় দাঁড়িয়ে ওকে এক মনে দেখে যেতে থাকি। শুভ্রর চোখ দুটি জবা ফুলের মতন লাল হয়ে জ্বলছে যেন। আমি বেশ ভাল ভাবে বুঝতে পারি ওর বুকের পাঁজর গুলো এক এক করে ভাঙছে, সেই নিস্তব্ধ রাতে ওর বুকের পাঁজরের ভাঙ্গার আওয়াজ আমার কানে ভীষণ ভাবে ধাক্কা দিতে থাকে।
আমি চুপ করে ঘরের মধ্যে ঢুকে বালিশে মুখ গুঁজে নিজেকে অন্ধকারে মিলিয়ে দিতে প্রানপন চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকি। প্রানপনে ডাকতে থাকি "তারা তারি যেন সকাল হয় আমি আর পারছিনা ওর চোখের সামনে থাকতে। আমি হয়তো মারা যাবো না হলে ও হয়তো নিজেকে শেষ করে দেবে।"
সেই বেদনাময় রাত বা মধুময় রাত, জানিনা সেই রাত কি ছিল, তবে সেই রাত আমার জীবনের সব থেকে বড় রাত। সকাল হতে আর যেন চায়না আকাশ, সূর্য্যি মামা যেন আর উঠতে চায়না তার বালিশ ছেড়ে। আমি প্রান পনে বালিশটাকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে আমার বুক ফাটার আওয়াজ লুকিয়ে রাখি, পাছে ও শুনতে পায় আমার কান্না, সেই ভয়ে।
........... ইতি অহনা।
======সমাপ্ত======