25-12-2020, 06:54 PM
উপরের অংশের পর
আমি এসেছিলাম কটা দিন কাজ থেকে মুক্তি নিয়ে নির্জনে সময় কাটাতে. হয়তো হোটেল থেকে বেশি বেরোতামও না. বাবা মাও বলেছিলো একটু রেস্ট প্রয়োজন আমার. বাবা মাকেও আনতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবার বেশি বেরোনো মানা. তাই আমাকেই প্রায় জোর করেই বললো ঘুরে আসতে. আমিও ভাবলাম একটু মুক্তি প্রয়োজন. আগে কাজে ডুবে ছিলাম সাফল্যের লোভে আর এবং ডুবে থাকি অতীতের ভুল গুলো ভুলে থাকতে.
বেশ সুন্দর জায়গাটা. চারিদিকে গাছ আর গাছ. প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্যই আলাদা. একটু দূরে জলের দেখাও পেলাম. নিজের স্থান অধিকার করে নিজের স্রোতে বয়ে চলেছে সে. এপার থেকে ওপার যাবার জন্য ছোটো একটা লাল ব্রিজ. আমরা ব্রিজে উঠে এগোচ্ছি সামনের দিকে. বৌদি একটু ভয় পাচ্ছিলো বলে আমার বন্ধুটি তার হাত ধরে এগোচ্ছে. এটাই তো প্রয়োজন..... ভরসা. সামান্য ভরসা, পাশে থাকা. ওদের দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো. নিচে তাকিয়ে দেখলাম অনেক গুলো হাঁস জলে এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে. সূর্যের আলো জলে পড়ে সোনালী উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে তুলেছে স্থানটা. কি অসাধারণ রূপ. আমরা ওখানেই দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম. আমার পাশেই দাঁড়িয়ে সেই সুন্দরী সেই দৃশ্য দেখছে. আর আমি দেখছি তাকে. সে বোধহয় বুঝতে পারলো. তাই আমার কাছ থেকে সরে বান্ধবীর পাশে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে লাগলো. আমি মুচকি হেসে আবার নিচে হাঁসেদের দেখতে লাগলাম. বাচ্চা গুলো কেমন মায়ের পাশে পাশে চলছে. আবার জলে মুখ ডুবিয়েই মাথা ঝাড়া দিয়ে ওপরে তাকাচ্ছে.
তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠলো. দেখলাম অর্কর ফোন. ওর হাতেই সব দায়িত্ব দিয়ে এসেছি. কিছু দরকারে নিশ্চই ফোন করেছে. নইলে আমি বলে এসেছি ফোন না করতে. আমি ফোন রিসিভ করে ওর সাথে কথা বলতে লাগলাম. পেছন থেকে সঞ্জয় বললো - এই আমরা সামনে এগোলাম.... তোর হয়ে গেলে আসিস. আমি সামান্য মাথা ঘুরিয়ে আচ্ছা বলে আবার ফোনে মন দিলাম.
সেরকম কিছু নয়, একটা মিটিংয়ের ব্যাপারে. যেটা কয়েকদিন পর হবার কথা সেটা আরো পিছিয়ে গেছে. এই মুহূর্তে সেটা হচ্ছেনা. সেই ব্যাপারেই আমি আর ও কিছুক্ষন কথা বললাম সাথে সব কিছু ঠিক মতো চলছে কিনা জেনে নিলাম. বেশ কাজের ছেলে অর্ক. সব একদম নিজ দায়িত্বে সামলাচ্ছে. আমার ছোট ভাইয়ের মতো. বাবা মায়ের পাশাপাশি সেও প্রায় জোর করেই বলেছিলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে. সব ও সামলে নেবে. তাই একটু ফাঁকা পেতেই আমিও বেরিয়ে পড়ি.
কথা শেষ হলে ওই হাঁসেদের দলের একটা ফটো তুললাম. দামি ফোন...... অথচ বাবা মায়ের ছবি আর সেই চলে যাওয়া মানুষটার ছবি ছাড়া কিছুই নেই. পুরো ফাঁকা ফোন. ছবি টবি তোলাই হয়না. আজ এতদিন পরে একটা সুন্দর মুহুর্তকে ফোনে তুলে রাখলাম. তারপর এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে. ওরা বেশ দূরে এগিয়ে গেছে মনে হয়. আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম. কিছুদূর এগোতেই দেখি দম্পতি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে. দুজন খুব অন্তরঙ্গ হয়ে ছবি তুলছে. ঐখানে এই মুহূর্তে যাওয়াটা উচিত মনে করলাম না. তাই ওখান থেকে চলে এলাম. একটু এগোতেই একটা বসার জায়গা পেলাম. ওখানেই বসে পড়লাম. আমাদের মতো আরো অনেকে এদিকে ঘুরতে এসেছে. সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে. একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম একটা ছোট্ট কুকুর ছানাকে আদর করছে আর পাশে বাবা মা দাঁড়িয়ে. কুকুর ছানাটা আদর খাচ্ছে আজ লেজ নাড়ছে.
-কেমন আছো?
পেছন থেকে হটাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম. সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে. সামান্য হাসি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো - কেমন আছো?
আমিও সামান্য হেসে বললাম - এই... আছি.
সে - বাবা মা কেমন আছে? ওরা ঠিক আছে তো?
আমি - হ্যা... ভালো..... তোমার মা? ভালোতো উনি?
ও শুধু হ্যা সূচক মাথা নাড়লো.
আমি বললাম - বসোনা. আসলে এতদূর হেটে হেটে এলাম তো. তাই বসেছিলাম একটু.
ও সামান্য হেসে বললো - না ঠিকাছে তুমি বসো... আমি যাই কৃতির কাছে.
ও পাশে ঘুরতেই আমার মধ্যে কি যেন হলো. আমি একটু জোর করেই বললাম - না প্লিস..... একটু.... একটু বসোনা.
ও আমার দিকে আবার ঘুরলো. আমার চোখে কিছু দেখলো কিনা জানিনা কিন্তু এবারে আর কিছু না বলে বসলো. আমিও একটু দূরত্ব বজায় রেখে পাশে বসলাম. কিছু পরে তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলাম - তুমি কেমন আছো?
- এইতো... বেশ ভালোই আছি.
আমি এবারে তাকালাম ওর দিকে. ও সামনে তাকিয়ে আমার মতোই ওই বাচ্চাটা আর কুকুর ছানাকে দেখছে. এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও বাচ্চা মেয়েটার দিকে. ওই চোখে আমি কিছু যেন খুঁজে পেলাম. একটা অপূর্ন ইচ্ছে. নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলাম. তারপর আমার নজর গেলো ওর গলায়. আরে!... এটাতো ওই.....!
একটু সুখ পেলাম যেন. তারপর সামনে তাকিয়ে বললাম -
কি sweet না বাচ্চাটা? জিজ্ঞেস করলাম আমি. উত্তরে ও হেসে মাথা নেড়ে বললো খুবই. দেখো..... কেমন বাবাকে নিচে বসিয়ে জোর করে ওনাকে দিয়েও আদর খাওয়াচ্ছে কুকুরটাকে.
আমিও দেখলাম.... তিনজন সুখী মানুষকে আমাদের থেকে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে. বাবা মা মেয়ে তিনজনের মুখেই হাসি. লোকটা হয়তো সেই ভাবে পশু প্রেমিক নন তাও মেয়ের কথায় কুকুর ছানার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন আর মা দাঁড়িয়ে ওদের দেখে হাসছে.
আমি - একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
ও বললো - করো.
আমি - বিয়ে করলেনা কেন আর?
ও হালকা হাসলো. তারপর বললো - ধুর... আর..... ইচ্ছে করলোনা.... মা যদিও কানের সামনে ঘ্যানর ঘ্যানর করে... আমি কান দিই না.
আমি ওর দিকে তাকিয়ে - ইচ্ছে করেনা... নাকি.....
ও আমার কথা কেড়ে নিয়ে নিজেই এবারে আমায় জিজ্ঞেস করলো - তা তুমিও তো শুনলাম কাল ওদের বললে ডিভোর্সড. তুমি আর বিয়ে করোনি কেন? এখন তো বেশ সাকসেসফুল হয়েছো. দেখেই বোঝা যাচ্ছে.... আলাদাই ব্যাপার.... তাহলে?
আমি মাথা নামিয়ে হেসে বললাম - হ্যা টাকা পয়সার দিক থেকে সফল অবশ্যই..... কিন্তু আমি... আমিও আর পারিনি.... ইচ্ছে হয়নি.
ও এবারে হেসে জিজ্ঞেস করলো - ইচ্ছে হয়নি? নাকি......
দুজনেই হেসে ফেললাম. জানি দুজনের হাসিই নকল.
আমরা বসে আছি. দেখি দূর থেকে সঞ্জয় আর বৌদি আমাদের কেই দেখছে. দুজনের মুখেই হাসি. অঞ্জলি দেখেনি ওদের. ওরা আমাদের একসাথে বসে থাকতে দেখে কি ভাবলো কে জানে....হাতের ইশারায় আমাদের ওখানেই থাকতে বলে নিজেরা অন্যদিকে চলে গেলো. ওরা যেটা ভাবছে সেটা ভেবে হাসি পেলো আমার.
কি হলো? হাসছো কেন? ও জিজ্ঞেস করলো.
তোমার বান্ধবী আর আমার বন্ধু আমাদের এইভাবে একসাথে বসে থাকতে দেখে বোধহয় ভাবলো আমাদের মধ্যে........ তাই আমরা যাতে ডিস্টার্ব না হই তাই অন্যদিকে চলে গেলো.
ওমা! সেকি.....
-হুমম..... ওরা কাল থেকেই ভাবছে যে প্রথম দেখা থেকেই আমাদের মধ্যে......
-কি!! আমি যাই....
আমি - কোথায়?
ও চিন্তিত মুখে বললো - আরে.... ওরা আমাদের দেখে কিনা কি ভাবছে.... কৃতির কাছে গিয়ে বলি যে এরকম কিছু নয়....
আমি হেসে বললাম - আরে ছাড়ো তো....
ও বললো - না.... আমি যাই... ভুল বোঝাবুঝি আরো বাড়ুক তার আগেই ওকে গিয়ে বলি এসব কিছুই না.
ও প্রায় উঠেই যাচ্ছিলো. আমার কি মনে হতে ওর হাত ধরে ফেললাম. বা বলা উচিত অজান্তেই আমার হাত ওর হাত ধরে ফেললো. তারপর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো - প্লিস যেওনা.
ও ঘুরে আমার হাতের দিকে তাকালো. আমি সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত সরিয়ে নিলাম. ও বসে রইলো.
- সরি.
- কেন?
- না... মানে হাতটা ঐভাবে ধরলাম.
- ওহ..... না ঠিকাছে
- তাই ?
- মানে?
-সত্যি কি সব ঠিকাছে?
- কি বলছো?
- না কিছুনা.
কিছুক্ষন নীরবতা.
তারপর ওই বললো - বাবা মা কি এখনো আলাদা থাকেন নাকি তোমার সাথে এনে রেখেছো?
আমি - না একটা নতুন ফ্লাট নিয়েছি... আর বাবা মাকেও নিয়ে চলে এসেছি. এখন আমরা একসাথেই থাকি.
- বাহ্... খুব ভালো. ওদের খেয়াল রেখো....কাজ থেকে সময় বার কোরো ওদের জন্য.... বয়স হচ্ছে তো. এখন ওদের তোমাকে প্রয়োজন. অন্তত এখন আর সেই ভুল করোনা.... ওদের এখন তোমাকে প্রয়োজন.
আমি হেসে বললাম - জানি... ওহ.. শুনলাম তুমি নাকি আজ আসতে চাইছিলে না? বান্ধবী জোর করাতে বেরোতে রাজি হয়েছো?
- হ্যা.... ওই ভালো লাগছিলোনা... তাছাড়া আমি আর বেশি বেরোই টেরই না... ঘরে থাকলেও না.
আমি - অথচ একটা সময় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতে. ঘুরতে যাবার কথা বলতে....
ও হালকা হাসি মুখে বললো - কি করবো বলো.... একজনকে তো খুব বলতাম.... কিন্তু সে তো সময়ই পেতোনা আমাকে নিয়ে বেরোনোর. তারপর আমারও ওই ইচ্ছে চলে গেছে.
আমি - তখন সবে ব্যাবসা এগোচ্ছে.... প্রচন্ড চাপ.... দেখতে তো... সকাল যেতাম আর ফিরতাম সেই রাতে.
ও মুচকি হেসে বললো - হ্যা.... তা ঠিক.... নিজের জীবনের থেকে বেশি গুরুত্ব তুমি তোমার ব্যবসাতে দিয়েছো.... তাইতো আজ এতো সাকসেসফুল.
আমি - খোঁটা দিচ্ছ? জীবনে অর্থের প্রয়োজন কতটা সেটা আমি বুঝি.... আমি সেই জীবন দেখেছি.... টাকা ছাড়া যে কি অবস্থা হয়... সেটা আমি এক্সপেরিয়েন্স করেছি. তুমি সেটা বুঝবেনা.
ও বললো - না মোটেও না.... তুমি নিজের চেষ্টায় আজ সফল.... এখানে খোঁটা কেন দেবো.... যাকগে ছাড়ো..... তুমি তোমার মতো করে ভালো আছো... আমি আমার মতো.
নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম - একসাথে কি থাকা যেতোনা? ওই ডিসিশান নেওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিল?
এটা শুনে হাসলো অঞ্জলি. তারপর বললো - কি করবো বলো? যার সাথে সারাজীবন চলবো.... তার উপস্থিতির যদি অভাব বোধহয় হয়, যাকে পেয়েও না পাই তাহলে কি করবো? যাকে ভালোবে........
এইটুকু বলেই সে থেমে আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো. তারপর বললো - আমাদের বোধহয় এবারে ওদের কাছে যাওয়া উচিত.
আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি হটাৎ.....ওমা.... তখনি.... কোথা থেকে দেখি আরেকটা পুচকে কুকুর ছানা আমাদের সামনে এসে উপস্থিত. আমাদের দেখে ভয় পিছিয়েও যাচ্ছে আবার লেজও নাড়ছে. সেটাকে দেখে অঞ্জলি আয় আয় করে ডেকে তখনি কোলে তুলে নিলো.
আমিও এগিয়ে গেলাম ওর কাছে. দেখি সেই পুচকে নিজের ছোট্ট জিভ বার করে ওর গালে চেটে দিচ্ছে.
আমি বললাম - এ বাবা... তোমার গাল চেটে দিচ্ছে তো ইশ....
ও হেসে বললো - তাতে কি হয়েছে? বাবুর খিদে পেয়েছে? সাথে বিস্কুট নেই... ইশ..
ওর দিকে তাকালাম. ওই ছোট ছানাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে এক অসাধারণ রূপসী. না শুধু রূপসী নয়, একজন ভালো মনের মানুষও. যেভাবে ওই ছানাটি কোলে নিয়ে আদর করছে যেন........ যেন ওটা ওর কাছের কেউ.
আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম - জানতাম না তো.... তোমার কুকুর এতো ভালো লাগে. আগে বলোনি তো.
ও কুকুর ছানার থেকে চোখ না সরিয়েই বললো - আমি কুকুর বেড়াল সবই পছন্দ করি. তোমাকে বলা হয়নি.... ভেবেছিলাম আমাদের বাড়িতে..... একটা ল্যাব কিনবো...
আমি - ল্যাব? ও আচ্ছা লাব্রাডর..... বলোনি তো.....
ও না তাকিয়েই বললো - সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি.....হলেও কি তুমি রাজি হতে?
আমি - তখন কি বলতাম জানিনা....কিন্তু এখন.....
আমার দিকে একবার তাকালো ও. হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমি কি বলতে চাইছি.
ওদিকে ছানাটা যেন মায়ের কোলের খোঁজ পেয়েছে. চুপচাপ ওর কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে. আর ও কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে. আর তখন ওর আঙুলে চোখ গেলো. ডান হাতের আঙুলে একটা আংটি. আমার মুখে হালকা হাসি চলে এলো কোথা থেকে.
আমিও কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম - দেখো.... তোমার কোলে ঘুমিয়েই পড়লো মনে হয়. দুজনেই হাত বোলাতে লাগলাম ছানাটার মাথায়. বেশ কয়েকবার আমাদের দুজনের হাত স্পর্শ হলো.
আমি - তুমি ঠিকই বলেছো. তখন আমি অন্য মানুষ ছিলাম. আমার একটাই লক্ষ ছিল. টাকা. আমি তোমাকে নিয়ে ভাবার বা সময় বার করার চেষ্টাও করিনি. আমি...বোকা হাঁদা সবসময় ভেবেছি তোমায় দামি গয়না শাড়ী কিনে দিলেই দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেলো...আসলে সেই সময়টা এতো কাজের চাপ.... একটু একটু করে যত সাফল্য পাচ্ছিলাম ততই আরো ব্যাস্ত হয়ে পড়ছিলাম. আরো সাফল্যের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছিলো. জিনিস কিনে দেয়াকেই দায়িত্ব পালন করা বুঝতাম. অতীতের থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে খুঁজতে কখন যে পথটাই হারিয়ে ফেলেছি... বুঝতেই পারিনি. ভাবিনি জীবনের আসল দায়িত্ব পালন কি..... ইডিয়ট ছিলাম একটা !
হটাৎ আমার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে ও আমার দিকে তাকালো. আশ্চর্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে. হয়তো ভাবছে এ কোন লোককে দেখছে সে? এ কি সেই পরিচিত মানুষটা?
আমার মধ্যে কি হয়েছিল জানিনা. বার বার মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তটা যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে চিরদিনের মতো আমি সব হারিয়ে ফেলবো. ভয় ও সাহস দুই একসাথে কাজ করছিলো. হয়তো আমার ভেতরের সত্যিকারের পুরুষটা ওই কাপুরুষ কে হারিয়ে বেরিয়ে আসছিলো.
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম - আমি জানি..... আমার ওপর অনেক অভিমান জমে আছে তোমার. তুমি ঠিকই বলেছো... জীবনের একটা সুখের সময় যে মানুষটার সাথে কাটানোর কথা, যাকে সবসময় নিজের পাশে পেতে চেয়েছো..... তুমি তাকে সেই সময় পাশে পাওনি. আমি এর জন্য দায়ী. আমি ভুল.... আমি... আমি মানছি. কিন্তু এটাও ঠিক যে আমি নিজেও ওরকম হতে চাইনি. পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছিল. আমাদের নিজেদের কাছের মানুষকে ধোঁকা দিতে দেখেছি. বাবাকে প্রায় সবকিছু হারিয়ে ফেলতে দেখেছি. সেই সময় নিজের বাবাকে খাটতে খাটতে প্রায় শেষ হয়ে যেতে দেখেছি. মায়ের কান্না দেখেছি আমি. তাও বাবা মা আমার ওপর এসবের কিছুই আসতে দেননি. সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলো ওরা. আমার পড়াশোনার একটুও ক্ষতি হতে দেননি তারা. তাই আমিও ছোট থেকেই নিজেকে পাল্টে ফেলেছিলাম. আমার একটাই লক্ষ্য ছিল বাবা মা কে আবার সেই সুখের জীবন ফিরিয়ে দেওয়া. কিন্তু সেই লড়াই লড়তে লড়তে কখন যে আমিও পাল্টে গেছি বুঝিনি. বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছি যেমন.... তেমনি তাদেরকেও ভুলে শুধু নিজের ব্যবসা নিয়েই ভেবেছি. অতীতের সেই দিন যাতে আর ফিরে না আসে সেই চেষ্টায় বিলিয়ে দিয়েছি নিজেকে কিন্তু ভুলে গেছি জীবনে ভারসাম্য কতটা প্রয়োজন. ব্যালান্স রক্ষা করা. হ্যা এটা ঠিক যে আমি আমার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারিনি.... কিন্তু এটাও ঠিক যে আমি কোনো কুপথেও যায়নি. আজকে আমি যে স্থানে পৌঁছেছি তার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছি. কিন্তু এই পরিশ্রমকে আমি কুপথে গিয়ে বা নিজের সভ্যতা বর্জন করে অপমান করিনি. এটা ঠিক যে ওই সময় আমি অন্য মানুষ হয়ে গেছিলাম কিন্তু...... কিন্তু আজ আমি অন্য মানুষ. আর আমার এই পরিবর্তনের কারণ তুমি. তোমাকে হারিয়ে আমি বুঝেছি তোমার গুরুত্ব. ওই যে তখন জিজ্ঞেস করলে না .... ইচ্ছে করে আর বিয়ে করিনি নাকি অন্য ব্যাপার..... হ্যা অন্য ব্যাপার. প্রথমত নিজের কাছেই আমি ছোট হয়ে গেছিলাম আর দ্বিতীয়ত........
-দ্বিতীয়ত কি?
ছানাটা আবার ওর গাল চাটছে... কিন্তু ওর নজর আমার দিকে. সোজা তাকিয়ে আমার দিকে সে.
আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম - দ্বিতীয় কারণটা তুমি. আমার পাশে আর অন্য কাউকে আমি..... আমি ভাবতেও পারিনা. যে সময়টা তোমার সাথে কাটিয়েছি..... তখন না বুঝলেও আজ বুঝি ওই সময়টার মূল্য কি ছিল. আজ এটা বলতে দ্বিধা নেই যে তোমার জায়গা আর কেউ নিতে পারবেনা. আসলে কি বলতো....? আমাদের দুজনেরই পরিস্থিতি এমন ছিল যে তুমিও ভুল নয়..... আর সেই সময় মনে হতো আমিও ভুল নয়. আমি যা করছি আমার পরিবারের জন্যই তো করছি. কিন্তু ঐযে ব্যালান্স..... ওখানেই প্রব্লেমটা হলো. আজ বিত্তবান হয়েছি কিন্তু পেয়েছি নিঃসঙ্গতা, সফল হয়েছি কিন্তু হারিয়েছি সুখ. বাবা মায়ের ভালোবাসা আশীর্বাদ তো সবসময় সন্তানের সাথে থেকেই কিন্তু মানুষ হিসেবে কাছের মানুষকে ভালোবাসার সুখ থেকে আজ বঞ্চিত আমি. বার বার মনে হয়েছে তোমার সাথে দেখা করি কিন্তু...... পারিনি.
-তা হটাৎ এই উপলব্ধি?
আমি - মানুষ মাত্রেই তো ভুল করে... তাইনা? আমি ভুল করেছি আর সেটা যে কি ভুল আজ বুঝতেও পারছি...
ও আমার থেকে চোখ সরিয়ে বললো - এখন এসব কেন বলছো আমায় ?
আমি - অঞ্জু...
নামটা শুনেই ও অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো. আমার কাছ থেকে নিজের মুখ লুকিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে রইলো.
আমি থামলাম না. বললাম- ভালো আমিও তোমায় বেসেছি..... বা বলতে পারো.... যদি কাউকে ভালোবেসে থাকি সে শুধু তুমি. শুধু ওই সময় আমি...... আমি তোমায় বুঝিয়ে উঠতে পারিনি.... হ্যা আমি ভুল ছিলাম..... কিন্তু... কিন্তু..আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছি... সবসময়.... তাইতো আমি... আমি পারিনি আবার নতুন করে পথ চলতে. আবার তোমার সামনেও যেতে পারিনি. সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো? তোমায় যত ভুলতে চেয়েছি.... ততোই তোমায় মনে পড়েছে. আসলে আমরা যাকে ভুলতে চাই... তাকেই সবথেকে বেশি মনে করি.
- কি বলতে চাইছো তুমি?
আমি নিজের সব টুকু সাহস করে বলেই ফেললাম - বলতে এটাই চাই যে..... আমরা কি আবার..... আবার নতুন করে সব শুরু করতে পারিনা? একসাথে পথ চলতে পারিনা আবার? বিশ্বাস করো.... আমি আর আগের সেই মানুষটা নই... আমি পাল্টে গেছি.
অঞ্জু আমার দিকে না তাকিয়েই বললো - না..... আর না.....আমিও বদলে গেছি... একা পথ চলতে শিখে গেছি.. প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো.... কিন্তু এখন আর হয়না. এই আছি.. বেশ আছি.
আমি ওর আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম. আমি জানি ও আমার থেকে নিজেকে লুকোচ্ছে. হয়তো দুচোখে একটু জলও জমেছে .যেটা আমাকে ও দেখাতে চায়না না.
আমি - জানি... আমার ওপর খুব অভিমান তোমার... আমি তার যোগ্যও..... তুমি হয়তো ভাবছো আজ যখন সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছি তখন তোমার কাছে এসেছি. তার আগে তো আসিনি. খোঁজও নিই নি. আসলে ওই ভাবে আমরা হটাৎ আলাদা হয়ে গেলাম... তুমিও আমার ওপর রাগ করে ছিলে, আমিও রাগ করে... দুজনেই রেগে ছিলাম. তারপর আমি পারিনি তোমার সামনে আসতে.... না পেরেছি তোমায় ভুলতে, না পেরেছি তোমার কাছে যেতে. এই অনুভূতি যে কি তা আমি ছাড়া কেউ বুঝবেনা. কিন্তু একদিন পরিস্থিতি আমাদের দূরে করেছিল আজ সেই পরিস্থিতিই আবার আমাদের একে অপরের সামনে নিয়ে এসেছে. হয়তো কেউ একজন চাইছে যে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু হোক. নইলে ভাবো... আমাদের হটাৎ করে আবার দেখা আমার বন্ধুর মাধ্যমে. আজ যখন এতদিন পর আমরা আবার মুখোমুখি হয়েছি তখন......
অঞ্জলি - আমি তো বললাম আমি আর সেই আগের অঞ্জলি নেই যে একা থাকতে পারতোনা..... আমি আজ একা থাকতেই পছন্দ করি. আমি শিখে গেছি একা থাকতে. আমার আর কাউকে পাশে প্রয়োজন নেই.
দৃঢ়তার সাথে বললো অঞ্জলি. কিন্তু একবারের জন্যও তাকায়নি আমার দিকে.
আমি - কিন্তু আমার যে প্রয়োজন. খুব..... কি করবো বলো? এক নম্বরের স্বার্থপর যে আমি. তাইনা?
ও - হুমম. একদমই তাই.
আমি - তা এই স্বার্থপর লোকটাকে শোধরানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে আবার নিতে পারবেনা? আমি কি পাশে পেতে পারিনা তোমায় আবার?
ও - না..... আর.... আর না.... আমি আর চাইনা তোমায়. একটুও না.
আমার দিকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে ও তবে ওর গলার স্বরে হালকা কম্পনটা স্পষ্ট বুঝলাম আমি.
আমি - তাই? তা আমায় বলতো.... ভুল আমি করেছি তাও তুমি কেন নিজের জীবন নতুন করে শুরু করলেনা?
অঞ্জু - আর সাহস হয়নি.
আমি - সাহস হয়নি? নাকি তুমিও আমায় আজও ভুলতে পারোনি?
ও - তোমায় আমি কবে ভুলে গেছি. তোমার মতো লোককে কে মনে রাখবে?
আমি মুচকি হেসে আবার বললাম.- তা ঠিক..... তা আমার মতো একটা বাজে লোককে মনে যদি নাই রাখো... তাহলে তোমার গলায় আমার দেওয়া ওই কমদামি পেন্ডেন্টটা কেন?ওটা তোমার জন্মদিনে তোমায় কিনে দিয়েছিলাম তাই?
ও নিজের গলার কাছে একবার হাত রেখে তারপর বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো.
আমি আরেকটু এগিয়ে ও যে হাতে বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাচ্ছে সেই হাতের ওপর হাত রেখে বললাম - আর আমার এই রাস্তা থেকে কিনে দেওয়া এই কমদামি আংটিটা কেন? আমরা মেলায় বেড়াতে গেছিলাম আমাদের বিয়ের পর পরেই. তখনই একটা দোকানে আমার নজর পড়ে এই A লেখা আংটিটার ওপর. তোমায় কিনে দি তখন. তখন তোমার হাতে বেশ টাইট হতো কিন্তু এখন তো বেশ ফিট. সামান্য এই ফালতু আংটিটা খালি খালি কেন পড়ে আছো আজও?
আমার দিকে একটু ক্রুদ্ধ নজর নিয়ে ঘুরে তাকালো ও. জল চিক চিক করছে সেই চোখে. হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো - তুমি একটুও পাল্টাওনি..... একটুও না.
আমি - রাগ হচ্ছে আমার ওপর? ওগুলোকে সস্তা কমদামি ফালতু বললাম বলে? তাইনা?
ও - কি বলতে চাইছো?
আমি ওর একদম কাছে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বললাম - আমি এটাই বলতে চাইছি যে আমি পাল্টে গেছি.... কিন্তু তুমি?....তুমি একটুও পাল্টাওনি. আজও.. আজও আমাকে ভুলতে পারোনি তুমি. তুমিও আমার মতোই ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছ. আমরা কাগজে কলমে আলাদা হলেও মন থেকে আলাদা হতে পারিনি আর পারবোও না. আজ এতদিন পরেও তুমি সেই একি রয়ে গেছো. তাই আজও আমার দেওয়া এই জিনিস গুলো ফেলে দাওনি... বলো ভুল বলছি?
ও বাচ্চাটাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো - আমি আর এই বিষয়ে কথা বলতে চাইনা... আমি আসছি.
আমি হালকা স্বর তুলে বললাম - দাড়াও.... আমায় উত্তর দিয়ে যাও.
ও রাগী ভাবে - বললাম তো এই বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা.... আমি ভুলে গেছি তোমায়.
আমি - তাহলে দুই চোখে জল কেন তোমার? কাকে ঠকাচ্ছ? আমায়? না..... তুমি নিজেকে ঠকাচ্ছ... নিজেকে.
ও ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জলে ভেজা ক্রুদ্ধ নয়নে চেয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত... তারপর ঠাস করে একটা চড় মারলো আমার গালে. তারপর কোনোরকমে নিজের কান্না আটকে বললো - I hate you.... Hate you..
ব্যাথা লাগলোনা....আমি সেই চড়ের যোগ্য ছিলাম. দুঃখও পেলাম না... বরং বিপরীত অনুভূতিটাই বৃদ্ধি পেলো. আমার দুই চোখেও কখন জানি জল এসেছে গেছে. সেই জল চোখেই মুখে হাসি এনে বললাম - ব্যাস..... আর কিছু বলার নেই, জানারও নেই .... আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি.... পেয়ে গেছি.... আজ আমি... খুব খুশি.. খুব.
আমাকে হাসতে দেখে আমায় একটা হালকা ধাক্কা দিয়ে ও বললো - বাজে লোক একটা.... জঘন্য লোক... I hate you. কেন এতদিন....
আর কিছু বলতে পারলোনা ও. চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো ওই জায়গা ছেড়ে. আমি যেন অনেকটা হালকা অনুভব করছিলাম. কেউ - কেউ আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি ওই বাচ্চাটা ওর ভাই বোনদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে, কামড়াকামড়ি করছে. হটাৎ ঘেউ করে একটা আওয়াজ পেয়ে ওরা সবাই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দ্রুত একটা বড়ো কুকুরের দিকে দৌড়ে গেলো. সবাই ঘিরে ফেললো মাকে. ওদের মা সবার গায়ে মাথায় জিভ বোলাতে বোলাতে শুয়ে পড়লো আর পুচকে গুলো মাতৃদুগ্ধ পানে ব্যাস্ত হয়ে গেলো.
আমি দেখতে লাগলাম ওদের. ওদের মা দূরে কোথাও গেছিলো খাবার খুঁজতে হয়তো. এতক্ষন পর মা সন্তানের মাঝে দূরত্ব মিটেছে.
আর অন্যদিকে আরেকটি দূরত্বও হয়তো এতদিনে......
বেশ সুন্দর জায়গাটা. চারিদিকে গাছ আর গাছ. প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্যই আলাদা. একটু দূরে জলের দেখাও পেলাম. নিজের স্থান অধিকার করে নিজের স্রোতে বয়ে চলেছে সে. এপার থেকে ওপার যাবার জন্য ছোটো একটা লাল ব্রিজ. আমরা ব্রিজে উঠে এগোচ্ছি সামনের দিকে. বৌদি একটু ভয় পাচ্ছিলো বলে আমার বন্ধুটি তার হাত ধরে এগোচ্ছে. এটাই তো প্রয়োজন..... ভরসা. সামান্য ভরসা, পাশে থাকা. ওদের দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো. নিচে তাকিয়ে দেখলাম অনেক গুলো হাঁস জলে এদিক থেকে ওদিক যাচ্ছে. সূর্যের আলো জলে পড়ে সোনালী উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে তুলেছে স্থানটা. কি অসাধারণ রূপ. আমরা ওখানেই দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতে লাগলাম. আমার পাশেই দাঁড়িয়ে সেই সুন্দরী সেই দৃশ্য দেখছে. আর আমি দেখছি তাকে. সে বোধহয় বুঝতে পারলো. তাই আমার কাছ থেকে সরে বান্ধবীর পাশে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে লাগলো. আমি মুচকি হেসে আবার নিচে হাঁসেদের দেখতে লাগলাম. বাচ্চা গুলো কেমন মায়ের পাশে পাশে চলছে. আবার জলে মুখ ডুবিয়েই মাথা ঝাড়া দিয়ে ওপরে তাকাচ্ছে.
তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠলো. দেখলাম অর্কর ফোন. ওর হাতেই সব দায়িত্ব দিয়ে এসেছি. কিছু দরকারে নিশ্চই ফোন করেছে. নইলে আমি বলে এসেছি ফোন না করতে. আমি ফোন রিসিভ করে ওর সাথে কথা বলতে লাগলাম. পেছন থেকে সঞ্জয় বললো - এই আমরা সামনে এগোলাম.... তোর হয়ে গেলে আসিস. আমি সামান্য মাথা ঘুরিয়ে আচ্ছা বলে আবার ফোনে মন দিলাম.
সেরকম কিছু নয়, একটা মিটিংয়ের ব্যাপারে. যেটা কয়েকদিন পর হবার কথা সেটা আরো পিছিয়ে গেছে. এই মুহূর্তে সেটা হচ্ছেনা. সেই ব্যাপারেই আমি আর ও কিছুক্ষন কথা বললাম সাথে সব কিছু ঠিক মতো চলছে কিনা জেনে নিলাম. বেশ কাজের ছেলে অর্ক. সব একদম নিজ দায়িত্বে সামলাচ্ছে. আমার ছোট ভাইয়ের মতো. বাবা মায়ের পাশাপাশি সেও প্রায় জোর করেই বলেছিলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসতে. সব ও সামলে নেবে. তাই একটু ফাঁকা পেতেই আমিও বেরিয়ে পড়ি.
কথা শেষ হলে ওই হাঁসেদের দলের একটা ফটো তুললাম. দামি ফোন...... অথচ বাবা মায়ের ছবি আর সেই চলে যাওয়া মানুষটার ছবি ছাড়া কিছুই নেই. পুরো ফাঁকা ফোন. ছবি টবি তোলাই হয়না. আজ এতদিন পরে একটা সুন্দর মুহুর্তকে ফোনে তুলে রাখলাম. তারপর এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে. ওরা বেশ দূরে এগিয়ে গেছে মনে হয়. আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম. কিছুদূর এগোতেই দেখি দম্পতি একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছে. দুজন খুব অন্তরঙ্গ হয়ে ছবি তুলছে. ঐখানে এই মুহূর্তে যাওয়াটা উচিত মনে করলাম না. তাই ওখান থেকে চলে এলাম. একটু এগোতেই একটা বসার জায়গা পেলাম. ওখানেই বসে পড়লাম. আমাদের মতো আরো অনেকে এদিকে ঘুরতে এসেছে. সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে. একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখলাম একটা ছোট্ট কুকুর ছানাকে আদর করছে আর পাশে বাবা মা দাঁড়িয়ে. কুকুর ছানাটা আদর খাচ্ছে আজ লেজ নাড়ছে.
-কেমন আছো?
পেছন থেকে হটাৎ একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে উঠে ঘুরে দাঁড়ালাম. সে আমার সামনে দাঁড়িয়ে. সামান্য হাসি দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো - কেমন আছো?
আমিও সামান্য হেসে বললাম - এই... আছি.
সে - বাবা মা কেমন আছে? ওরা ঠিক আছে তো?
আমি - হ্যা... ভালো..... তোমার মা? ভালোতো উনি?
ও শুধু হ্যা সূচক মাথা নাড়লো.
আমি বললাম - বসোনা. আসলে এতদূর হেটে হেটে এলাম তো. তাই বসেছিলাম একটু.
ও সামান্য হেসে বললো - না ঠিকাছে তুমি বসো... আমি যাই কৃতির কাছে.
ও পাশে ঘুরতেই আমার মধ্যে কি যেন হলো. আমি একটু জোর করেই বললাম - না প্লিস..... একটু.... একটু বসোনা.
ও আমার দিকে আবার ঘুরলো. আমার চোখে কিছু দেখলো কিনা জানিনা কিন্তু এবারে আর কিছু না বলে বসলো. আমিও একটু দূরত্ব বজায় রেখে পাশে বসলাম. কিছু পরে তার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলাম - তুমি কেমন আছো?
- এইতো... বেশ ভালোই আছি.
আমি এবারে তাকালাম ওর দিকে. ও সামনে তাকিয়ে আমার মতোই ওই বাচ্চাটা আর কুকুর ছানাকে দেখছে. এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও বাচ্চা মেয়েটার দিকে. ওই চোখে আমি কিছু যেন খুঁজে পেলাম. একটা অপূর্ন ইচ্ছে. নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিলাম. তারপর আমার নজর গেলো ওর গলায়. আরে!... এটাতো ওই.....!
একটু সুখ পেলাম যেন. তারপর সামনে তাকিয়ে বললাম -
কি sweet না বাচ্চাটা? জিজ্ঞেস করলাম আমি. উত্তরে ও হেসে মাথা নেড়ে বললো খুবই. দেখো..... কেমন বাবাকে নিচে বসিয়ে জোর করে ওনাকে দিয়েও আদর খাওয়াচ্ছে কুকুরটাকে.
আমিও দেখলাম.... তিনজন সুখী মানুষকে আমাদের থেকে কিছুদূরে দাঁড়িয়ে থাকতে. বাবা মা মেয়ে তিনজনের মুখেই হাসি. লোকটা হয়তো সেই ভাবে পশু প্রেমিক নন তাও মেয়ের কথায় কুকুর ছানার গায়ে হাত বোলাচ্ছেন আর মা দাঁড়িয়ে ওদের দেখে হাসছে.
আমি - একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
ও বললো - করো.
আমি - বিয়ে করলেনা কেন আর?
ও হালকা হাসলো. তারপর বললো - ধুর... আর..... ইচ্ছে করলোনা.... মা যদিও কানের সামনে ঘ্যানর ঘ্যানর করে... আমি কান দিই না.
আমি ওর দিকে তাকিয়ে - ইচ্ছে করেনা... নাকি.....
ও আমার কথা কেড়ে নিয়ে নিজেই এবারে আমায় জিজ্ঞেস করলো - তা তুমিও তো শুনলাম কাল ওদের বললে ডিভোর্সড. তুমি আর বিয়ে করোনি কেন? এখন তো বেশ সাকসেসফুল হয়েছো. দেখেই বোঝা যাচ্ছে.... আলাদাই ব্যাপার.... তাহলে?
আমি মাথা নামিয়ে হেসে বললাম - হ্যা টাকা পয়সার দিক থেকে সফল অবশ্যই..... কিন্তু আমি... আমিও আর পারিনি.... ইচ্ছে হয়নি.
ও এবারে হেসে জিজ্ঞেস করলো - ইচ্ছে হয়নি? নাকি......
দুজনেই হেসে ফেললাম. জানি দুজনের হাসিই নকল.
আমরা বসে আছি. দেখি দূর থেকে সঞ্জয় আর বৌদি আমাদের কেই দেখছে. দুজনের মুখেই হাসি. অঞ্জলি দেখেনি ওদের. ওরা আমাদের একসাথে বসে থাকতে দেখে কি ভাবলো কে জানে....হাতের ইশারায় আমাদের ওখানেই থাকতে বলে নিজেরা অন্যদিকে চলে গেলো. ওরা যেটা ভাবছে সেটা ভেবে হাসি পেলো আমার.
কি হলো? হাসছো কেন? ও জিজ্ঞেস করলো.
তোমার বান্ধবী আর আমার বন্ধু আমাদের এইভাবে একসাথে বসে থাকতে দেখে বোধহয় ভাবলো আমাদের মধ্যে........ তাই আমরা যাতে ডিস্টার্ব না হই তাই অন্যদিকে চলে গেলো.
ওমা! সেকি.....
-হুমম..... ওরা কাল থেকেই ভাবছে যে প্রথম দেখা থেকেই আমাদের মধ্যে......
-কি!! আমি যাই....
আমি - কোথায়?
ও চিন্তিত মুখে বললো - আরে.... ওরা আমাদের দেখে কিনা কি ভাবছে.... কৃতির কাছে গিয়ে বলি যে এরকম কিছু নয়....
আমি হেসে বললাম - আরে ছাড়ো তো....
ও বললো - না.... আমি যাই... ভুল বোঝাবুঝি আরো বাড়ুক তার আগেই ওকে গিয়ে বলি এসব কিছুই না.
ও প্রায় উঠেই যাচ্ছিলো. আমার কি মনে হতে ওর হাত ধরে ফেললাম. বা বলা উচিত অজান্তেই আমার হাত ওর হাত ধরে ফেললো. তারপর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো - প্লিস যেওনা.
ও ঘুরে আমার হাতের দিকে তাকালো. আমি সঙ্গে সঙ্গে নিজের হাত সরিয়ে নিলাম. ও বসে রইলো.
- সরি.
- কেন?
- না... মানে হাতটা ঐভাবে ধরলাম.
- ওহ..... না ঠিকাছে
- তাই ?
- মানে?
-সত্যি কি সব ঠিকাছে?
- কি বলছো?
- না কিছুনা.
কিছুক্ষন নীরবতা.
তারপর ওই বললো - বাবা মা কি এখনো আলাদা থাকেন নাকি তোমার সাথে এনে রেখেছো?
আমি - না একটা নতুন ফ্লাট নিয়েছি... আর বাবা মাকেও নিয়ে চলে এসেছি. এখন আমরা একসাথেই থাকি.
- বাহ্... খুব ভালো. ওদের খেয়াল রেখো....কাজ থেকে সময় বার কোরো ওদের জন্য.... বয়স হচ্ছে তো. এখন ওদের তোমাকে প্রয়োজন. অন্তত এখন আর সেই ভুল করোনা.... ওদের এখন তোমাকে প্রয়োজন.
আমি হেসে বললাম - জানি... ওহ.. শুনলাম তুমি নাকি আজ আসতে চাইছিলে না? বান্ধবী জোর করাতে বেরোতে রাজি হয়েছো?
- হ্যা.... ওই ভালো লাগছিলোনা... তাছাড়া আমি আর বেশি বেরোই টেরই না... ঘরে থাকলেও না.
আমি - অথচ একটা সময় ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতে. ঘুরতে যাবার কথা বলতে....
ও হালকা হাসি মুখে বললো - কি করবো বলো.... একজনকে তো খুব বলতাম.... কিন্তু সে তো সময়ই পেতোনা আমাকে নিয়ে বেরোনোর. তারপর আমারও ওই ইচ্ছে চলে গেছে.
আমি - তখন সবে ব্যাবসা এগোচ্ছে.... প্রচন্ড চাপ.... দেখতে তো... সকাল যেতাম আর ফিরতাম সেই রাতে.
ও মুচকি হেসে বললো - হ্যা.... তা ঠিক.... নিজের জীবনের থেকে বেশি গুরুত্ব তুমি তোমার ব্যবসাতে দিয়েছো.... তাইতো আজ এতো সাকসেসফুল.
আমি - খোঁটা দিচ্ছ? জীবনে অর্থের প্রয়োজন কতটা সেটা আমি বুঝি.... আমি সেই জীবন দেখেছি.... টাকা ছাড়া যে কি অবস্থা হয়... সেটা আমি এক্সপেরিয়েন্স করেছি. তুমি সেটা বুঝবেনা.
ও বললো - না মোটেও না.... তুমি নিজের চেষ্টায় আজ সফল.... এখানে খোঁটা কেন দেবো.... যাকগে ছাড়ো..... তুমি তোমার মতো করে ভালো আছো... আমি আমার মতো.
নিচের দিকে তাকিয়ে বললাম - একসাথে কি থাকা যেতোনা? ওই ডিসিশান নেওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিল?
এটা শুনে হাসলো অঞ্জলি. তারপর বললো - কি করবো বলো? যার সাথে সারাজীবন চলবো.... তার উপস্থিতির যদি অভাব বোধহয় হয়, যাকে পেয়েও না পাই তাহলে কি করবো? যাকে ভালোবে........
এইটুকু বলেই সে থেমে আমার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকলো. তারপর বললো - আমাদের বোধহয় এবারে ওদের কাছে যাওয়া উচিত.
আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি হটাৎ.....ওমা.... তখনি.... কোথা থেকে দেখি আরেকটা পুচকে কুকুর ছানা আমাদের সামনে এসে উপস্থিত. আমাদের দেখে ভয় পিছিয়েও যাচ্ছে আবার লেজও নাড়ছে. সেটাকে দেখে অঞ্জলি আয় আয় করে ডেকে তখনি কোলে তুলে নিলো.
আমিও এগিয়ে গেলাম ওর কাছে. দেখি সেই পুচকে নিজের ছোট্ট জিভ বার করে ওর গালে চেটে দিচ্ছে.
আমি বললাম - এ বাবা... তোমার গাল চেটে দিচ্ছে তো ইশ....
ও হেসে বললো - তাতে কি হয়েছে? বাবুর খিদে পেয়েছে? সাথে বিস্কুট নেই... ইশ..
ওর দিকে তাকালাম. ওই ছোট ছানাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে এক অসাধারণ রূপসী. না শুধু রূপসী নয়, একজন ভালো মনের মানুষও. যেভাবে ওই ছানাটি কোলে নিয়ে আদর করছে যেন........ যেন ওটা ওর কাছের কেউ.
আমি ওর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম - জানতাম না তো.... তোমার কুকুর এতো ভালো লাগে. আগে বলোনি তো.
ও কুকুর ছানার থেকে চোখ না সরিয়েই বললো - আমি কুকুর বেড়াল সবই পছন্দ করি. তোমাকে বলা হয়নি.... ভেবেছিলাম আমাদের বাড়িতে..... একটা ল্যাব কিনবো...
আমি - ল্যাব? ও আচ্ছা লাব্রাডর..... বলোনি তো.....
ও না তাকিয়েই বললো - সেই সুযোগ হয়ে ওঠেনি.....হলেও কি তুমি রাজি হতে?
আমি - তখন কি বলতাম জানিনা....কিন্তু এখন.....
আমার দিকে একবার তাকালো ও. হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো আমি কি বলতে চাইছি.
ওদিকে ছানাটা যেন মায়ের কোলের খোঁজ পেয়েছে. চুপচাপ ওর কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে. আর ও কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে. আর তখন ওর আঙুলে চোখ গেলো. ডান হাতের আঙুলে একটা আংটি. আমার মুখে হালকা হাসি চলে এলো কোথা থেকে.
আমিও কুকুর ছানাটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম - দেখো.... তোমার কোলে ঘুমিয়েই পড়লো মনে হয়. দুজনেই হাত বোলাতে লাগলাম ছানাটার মাথায়. বেশ কয়েকবার আমাদের দুজনের হাত স্পর্শ হলো.
আমি - তুমি ঠিকই বলেছো. তখন আমি অন্য মানুষ ছিলাম. আমার একটাই লক্ষ ছিল. টাকা. আমি তোমাকে নিয়ে ভাবার বা সময় বার করার চেষ্টাও করিনি. আমি...বোকা হাঁদা সবসময় ভেবেছি তোমায় দামি গয়না শাড়ী কিনে দিলেই দায়িত্ব পালন করা হয়ে গেলো...আসলে সেই সময়টা এতো কাজের চাপ.... একটু একটু করে যত সাফল্য পাচ্ছিলাম ততই আরো ব্যাস্ত হয়ে পড়ছিলাম. আরো সাফল্যের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছিলো. জিনিস কিনে দেয়াকেই দায়িত্ব পালন করা বুঝতাম. অতীতের থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে খুঁজতে কখন যে পথটাই হারিয়ে ফেলেছি... বুঝতেই পারিনি. ভাবিনি জীবনের আসল দায়িত্ব পালন কি..... ইডিয়ট ছিলাম একটা !
হটাৎ আমার মুখ থেকে এরকম কথা শুনে ও আমার দিকে তাকালো. আশ্চর্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে. হয়তো ভাবছে এ কোন লোককে দেখছে সে? এ কি সেই পরিচিত মানুষটা?
আমার মধ্যে কি হয়েছিল জানিনা. বার বার মনে হচ্ছিলো এই মুহূর্তটা যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে চিরদিনের মতো আমি সব হারিয়ে ফেলবো. ভয় ও সাহস দুই একসাথে কাজ করছিলো. হয়তো আমার ভেতরের সত্যিকারের পুরুষটা ওই কাপুরুষ কে হারিয়ে বেরিয়ে আসছিলো.
আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললাম - আমি জানি..... আমার ওপর অনেক অভিমান জমে আছে তোমার. তুমি ঠিকই বলেছো... জীবনের একটা সুখের সময় যে মানুষটার সাথে কাটানোর কথা, যাকে সবসময় নিজের পাশে পেতে চেয়েছো..... তুমি তাকে সেই সময় পাশে পাওনি. আমি এর জন্য দায়ী. আমি ভুল.... আমি... আমি মানছি. কিন্তু এটাও ঠিক যে আমি নিজেও ওরকম হতে চাইনি. পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছিল. আমাদের নিজেদের কাছের মানুষকে ধোঁকা দিতে দেখেছি. বাবাকে প্রায় সবকিছু হারিয়ে ফেলতে দেখেছি. সেই সময় নিজের বাবাকে খাটতে খাটতে প্রায় শেষ হয়ে যেতে দেখেছি. মায়ের কান্না দেখেছি আমি. তাও বাবা মা আমার ওপর এসবের কিছুই আসতে দেননি. সবকিছু উজাড় করে দিয়েছিলো ওরা. আমার পড়াশোনার একটুও ক্ষতি হতে দেননি তারা. তাই আমিও ছোট থেকেই নিজেকে পাল্টে ফেলেছিলাম. আমার একটাই লক্ষ্য ছিল বাবা মা কে আবার সেই সুখের জীবন ফিরিয়ে দেওয়া. কিন্তু সেই লড়াই লড়তে লড়তে কখন যে আমিও পাল্টে গেছি বুঝিনি. বাবা মায়ের মুখে হাসি ফুটিয়েছি যেমন.... তেমনি তাদেরকেও ভুলে শুধু নিজের ব্যবসা নিয়েই ভেবেছি. অতীতের সেই দিন যাতে আর ফিরে না আসে সেই চেষ্টায় বিলিয়ে দিয়েছি নিজেকে কিন্তু ভুলে গেছি জীবনে ভারসাম্য কতটা প্রয়োজন. ব্যালান্স রক্ষা করা. হ্যা এটা ঠিক যে আমি আমার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারিনি.... কিন্তু এটাও ঠিক যে আমি কোনো কুপথেও যায়নি. আজকে আমি যে স্থানে পৌঁছেছি তার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেছি. কিন্তু এই পরিশ্রমকে আমি কুপথে গিয়ে বা নিজের সভ্যতা বর্জন করে অপমান করিনি. এটা ঠিক যে ওই সময় আমি অন্য মানুষ হয়ে গেছিলাম কিন্তু...... কিন্তু আজ আমি অন্য মানুষ. আর আমার এই পরিবর্তনের কারণ তুমি. তোমাকে হারিয়ে আমি বুঝেছি তোমার গুরুত্ব. ওই যে তখন জিজ্ঞেস করলে না .... ইচ্ছে করে আর বিয়ে করিনি নাকি অন্য ব্যাপার..... হ্যা অন্য ব্যাপার. প্রথমত নিজের কাছেই আমি ছোট হয়ে গেছিলাম আর দ্বিতীয়ত........
-দ্বিতীয়ত কি?
ছানাটা আবার ওর গাল চাটছে... কিন্তু ওর নজর আমার দিকে. সোজা তাকিয়ে আমার দিকে সে.
আমি ওর চোখে চোখ রেখে বললাম - দ্বিতীয় কারণটা তুমি. আমার পাশে আর অন্য কাউকে আমি..... আমি ভাবতেও পারিনা. যে সময়টা তোমার সাথে কাটিয়েছি..... তখন না বুঝলেও আজ বুঝি ওই সময়টার মূল্য কি ছিল. আজ এটা বলতে দ্বিধা নেই যে তোমার জায়গা আর কেউ নিতে পারবেনা. আসলে কি বলতো....? আমাদের দুজনেরই পরিস্থিতি এমন ছিল যে তুমিও ভুল নয়..... আর সেই সময় মনে হতো আমিও ভুল নয়. আমি যা করছি আমার পরিবারের জন্যই তো করছি. কিন্তু ঐযে ব্যালান্স..... ওখানেই প্রব্লেমটা হলো. আজ বিত্তবান হয়েছি কিন্তু পেয়েছি নিঃসঙ্গতা, সফল হয়েছি কিন্তু হারিয়েছি সুখ. বাবা মায়ের ভালোবাসা আশীর্বাদ তো সবসময় সন্তানের সাথে থেকেই কিন্তু মানুষ হিসেবে কাছের মানুষকে ভালোবাসার সুখ থেকে আজ বঞ্চিত আমি. বার বার মনে হয়েছে তোমার সাথে দেখা করি কিন্তু...... পারিনি.
-তা হটাৎ এই উপলব্ধি?
আমি - মানুষ মাত্রেই তো ভুল করে... তাইনা? আমি ভুল করেছি আর সেটা যে কি ভুল আজ বুঝতেও পারছি...
ও আমার থেকে চোখ সরিয়ে বললো - এখন এসব কেন বলছো আমায় ?
আমি - অঞ্জু...
নামটা শুনেই ও অস্থির হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলো. আমার কাছ থেকে নিজের মুখ লুকিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে রইলো.
আমি থামলাম না. বললাম- ভালো আমিও তোমায় বেসেছি..... বা বলতে পারো.... যদি কাউকে ভালোবেসে থাকি সে শুধু তুমি. শুধু ওই সময় আমি...... আমি তোমায় বুঝিয়ে উঠতে পারিনি.... হ্যা আমি ভুল ছিলাম..... কিন্তু... কিন্তু..আমি শুধু তোমাকেই চেয়েছি... সবসময়.... তাইতো আমি... আমি পারিনি আবার নতুন করে পথ চলতে. আবার তোমার সামনেও যেতে পারিনি. সবচেয়ে মজার ব্যাপার কি জানো? তোমায় যত ভুলতে চেয়েছি.... ততোই তোমায় মনে পড়েছে. আসলে আমরা যাকে ভুলতে চাই... তাকেই সবথেকে বেশি মনে করি.
- কি বলতে চাইছো তুমি?
আমি নিজের সব টুকু সাহস করে বলেই ফেললাম - বলতে এটাই চাই যে..... আমরা কি আবার..... আবার নতুন করে সব শুরু করতে পারিনা? একসাথে পথ চলতে পারিনা আবার? বিশ্বাস করো.... আমি আর আগের সেই মানুষটা নই... আমি পাল্টে গেছি.
অঞ্জু আমার দিকে না তাকিয়েই বললো - না..... আর না.....আমিও বদলে গেছি... একা পথ চলতে শিখে গেছি.. প্রথম প্রথম অসুবিধা হতো.... কিন্তু এখন আর হয়না. এই আছি.. বেশ আছি.
আমি ওর আরেকটু কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম. আমি জানি ও আমার থেকে নিজেকে লুকোচ্ছে. হয়তো দুচোখে একটু জলও জমেছে .যেটা আমাকে ও দেখাতে চায়না না.
আমি - জানি... আমার ওপর খুব অভিমান তোমার... আমি তার যোগ্যও..... তুমি হয়তো ভাবছো আজ যখন সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছি তখন তোমার কাছে এসেছি. তার আগে তো আসিনি. খোঁজও নিই নি. আসলে ওই ভাবে আমরা হটাৎ আলাদা হয়ে গেলাম... তুমিও আমার ওপর রাগ করে ছিলে, আমিও রাগ করে... দুজনেই রেগে ছিলাম. তারপর আমি পারিনি তোমার সামনে আসতে.... না পেরেছি তোমায় ভুলতে, না পেরেছি তোমার কাছে যেতে. এই অনুভূতি যে কি তা আমি ছাড়া কেউ বুঝবেনা. কিন্তু একদিন পরিস্থিতি আমাদের দূরে করেছিল আজ সেই পরিস্থিতিই আবার আমাদের একে অপরের সামনে নিয়ে এসেছে. হয়তো কেউ একজন চাইছে যে আবার সবকিছু নতুন করে শুরু হোক. নইলে ভাবো... আমাদের হটাৎ করে আবার দেখা আমার বন্ধুর মাধ্যমে. আজ যখন এতদিন পর আমরা আবার মুখোমুখি হয়েছি তখন......
অঞ্জলি - আমি তো বললাম আমি আর সেই আগের অঞ্জলি নেই যে একা থাকতে পারতোনা..... আমি আজ একা থাকতেই পছন্দ করি. আমি শিখে গেছি একা থাকতে. আমার আর কাউকে পাশে প্রয়োজন নেই.
দৃঢ়তার সাথে বললো অঞ্জলি. কিন্তু একবারের জন্যও তাকায়নি আমার দিকে.
আমি - কিন্তু আমার যে প্রয়োজন. খুব..... কি করবো বলো? এক নম্বরের স্বার্থপর যে আমি. তাইনা?
ও - হুমম. একদমই তাই.
আমি - তা এই স্বার্থপর লোকটাকে শোধরানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে আবার নিতে পারবেনা? আমি কি পাশে পেতে পারিনা তোমায় আবার?
ও - না..... আর.... আর না.... আমি আর চাইনা তোমায়. একটুও না.
আমার দিকে পেছন ঘুরে দাঁড়িয়ে ও তবে ওর গলার স্বরে হালকা কম্পনটা স্পষ্ট বুঝলাম আমি.
আমি - তাই? তা আমায় বলতো.... ভুল আমি করেছি তাও তুমি কেন নিজের জীবন নতুন করে শুরু করলেনা?
অঞ্জু - আর সাহস হয়নি.
আমি - সাহস হয়নি? নাকি তুমিও আমায় আজও ভুলতে পারোনি?
ও - তোমায় আমি কবে ভুলে গেছি. তোমার মতো লোককে কে মনে রাখবে?
আমি মুচকি হেসে আবার বললাম.- তা ঠিক..... তা আমার মতো একটা বাজে লোককে মনে যদি নাই রাখো... তাহলে তোমার গলায় আমার দেওয়া ওই কমদামি পেন্ডেন্টটা কেন?ওটা তোমার জন্মদিনে তোমায় কিনে দিয়েছিলাম তাই?
ও নিজের গলার কাছে একবার হাত রেখে তারপর বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাতে লাগলো.
আমি আরেকটু এগিয়ে ও যে হাতে বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাচ্ছে সেই হাতের ওপর হাত রেখে বললাম - আর আমার এই রাস্তা থেকে কিনে দেওয়া এই কমদামি আংটিটা কেন? আমরা মেলায় বেড়াতে গেছিলাম আমাদের বিয়ের পর পরেই. তখনই একটা দোকানে আমার নজর পড়ে এই A লেখা আংটিটার ওপর. তোমায় কিনে দি তখন. তখন তোমার হাতে বেশ টাইট হতো কিন্তু এখন তো বেশ ফিট. সামান্য এই ফালতু আংটিটা খালি খালি কেন পড়ে আছো আজও?
আমার দিকে একটু ক্রুদ্ধ নজর নিয়ে ঘুরে তাকালো ও. জল চিক চিক করছে সেই চোখে. হালকা মাথা নাড়িয়ে বললো - তুমি একটুও পাল্টাওনি..... একটুও না.
আমি - রাগ হচ্ছে আমার ওপর? ওগুলোকে সস্তা কমদামি ফালতু বললাম বলে? তাইনা?
ও - কি বলতে চাইছো?
আমি ওর একদম কাছে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বললাম - আমি এটাই বলতে চাইছি যে আমি পাল্টে গেছি.... কিন্তু তুমি?....তুমি একটুও পাল্টাওনি. আজও.. আজও আমাকে ভুলতে পারোনি তুমি. তুমিও আমার মতোই ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছ. আমরা কাগজে কলমে আলাদা হলেও মন থেকে আলাদা হতে পারিনি আর পারবোও না. আজ এতদিন পরেও তুমি সেই একি রয়ে গেছো. তাই আজও আমার দেওয়া এই জিনিস গুলো ফেলে দাওনি... বলো ভুল বলছি?
ও বাচ্চাটাকে নিচে নামিয়ে দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো - আমি আর এই বিষয়ে কথা বলতে চাইনা... আমি আসছি.
আমি হালকা স্বর তুলে বললাম - দাড়াও.... আমায় উত্তর দিয়ে যাও.
ও রাগী ভাবে - বললাম তো এই বিষয় নিয়ে আমি কিছু বলতে চাইনা.... আমি ভুলে গেছি তোমায়.
আমি - তাহলে দুই চোখে জল কেন তোমার? কাকে ঠকাচ্ছ? আমায়? না..... তুমি নিজেকে ঠকাচ্ছ... নিজেকে.
ও ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জলে ভেজা ক্রুদ্ধ নয়নে চেয়ে থাকলো কয়েক মুহূর্ত... তারপর ঠাস করে একটা চড় মারলো আমার গালে. তারপর কোনোরকমে নিজের কান্না আটকে বললো - I hate you.... Hate you..
ব্যাথা লাগলোনা....আমি সেই চড়ের যোগ্য ছিলাম. দুঃখও পেলাম না... বরং বিপরীত অনুভূতিটাই বৃদ্ধি পেলো. আমার দুই চোখেও কখন জানি জল এসেছে গেছে. সেই জল চোখেই মুখে হাসি এনে বললাম - ব্যাস..... আর কিছু বলার নেই, জানারও নেই .... আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি.... পেয়ে গেছি.... আজ আমি... খুব খুশি.. খুব.
আমাকে হাসতে দেখে আমায় একটা হালকা ধাক্কা দিয়ে ও বললো - বাজে লোক একটা.... জঘন্য লোক... I hate you. কেন এতদিন....
আর কিছু বলতে পারলোনা ও. চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলো ওই জায়গা ছেড়ে. আমি যেন অনেকটা হালকা অনুভব করছিলাম. কেউ - কেউ আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখি ওই বাচ্চাটা ওর ভাই বোনদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করছে, কামড়াকামড়ি করছে. হটাৎ ঘেউ করে একটা আওয়াজ পেয়ে ওরা সবাই ছোট্ট ছোট্ট পায়ে দ্রুত একটা বড়ো কুকুরের দিকে দৌড়ে গেলো. সবাই ঘিরে ফেললো মাকে. ওদের মা সবার গায়ে মাথায় জিভ বোলাতে বোলাতে শুয়ে পড়লো আর পুচকে গুলো মাতৃদুগ্ধ পানে ব্যাস্ত হয়ে গেলো.
আমি দেখতে লাগলাম ওদের. ওদের মা দূরে কোথাও গেছিলো খাবার খুঁজতে হয়তো. এতক্ষন পর মা সন্তানের মাঝে দূরত্ব মিটেছে.
আর অন্যদিকে আরেকটি দূরত্বও হয়তো এতদিনে......
সমাপ্ত.
কেমন লাগলো এই ছোট গল্প? জানাবেন বন্ধুরা