25-12-2020, 03:14 PM
পর্ব ২২
পর্ব ২২ (ক)
কতক্ষন স্থির হয়ে বসে ছিল শান্তা, বলতে পাড়বে না। গতকালের ঘটনার রেশ এখনো ভুলতে পাড়ি নি শান্তা। এরই মধ্যে এমন একটা ফোন কল যেন নাড়িয়ে দিল তাকে। নির্দেশ গুলো এখনো তার কানে বাজছে। শান্তা কি পুলিশকে জানাবে? কিন্তু কিই বা বলবে? পুলিশ জানতে পারলে নিশ্চয়ই বাসায় এসে তদন্ত শুরু করবে। জানতে চাইবে শান্তা কোথায় যায়, কার সঙ্গে পরিচয় - কার সঙ্গে তাঁদের শত্রুতা। কতটা সামলাতে পাড়বে শান্তা নিজেকে?
একবার শান্তা ভাবলো রাজীব এর কথা। তাকে জানাবে নাকি! কিন্তু রাজীব এর ভাবনাই যেন শান্তাকে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। ওর জীবনটাকে এভাবে খোলা সাগরে ভাসিয়ে দেবার পেছনে রাজীব এরই হাত দেখতে পারছে শান্তা। ঘৃণা, দুঃখ, আর কষ্টে মুখ বিকৃত হয়ে আসছে তার। অবশেষে অনেক চিন্তা ভাবনার পর শান্তা ঠিক করল - লোকটি যেভাবে বলেছে তাই করবে শান্তা। লোকটি তাকে জানিয়েছে বেলা দশটার দিকে ফোন করবে আবার। তখন ফয়সালের সাথে কথা বলতে চাইবে শান্তা। ফয়সাল যদি কথা বলে ওর সঙ্গে - তবে নিশ্চয়ই লোকটির নির্দেশ না মেনে আর উপায় থাকবে না শান্তার কাছে।
তুলি ঘুম থেকে উঠলে তাকে নাস্তা খাইয়ে দিল শান্তা। আজ আর ওদের ফোন দিতে মন চাইলো না। বরং দোতলার প্রতিবেশীর কাছে রেখে এলো ও তুলিকে। ভদ্রমহিলা একটু অবাকই হলেন, তবে কিছু বললেন না। বাসায় এসে শান্তা ফোন এর অপেক্ষা করতে লাগলো। ঠিক দশটা বারো মিনিট এ এলো ফোনটা। ফোন ধরতেই শান্তা ফয়সালের কান্নামাখা আওয়াজ শুনতে পেল।
“শান্তা-- শান্তা… ওরা আমাকে মেরে ফেলবে… তুমি ওটা নিয়ে চলে আসো… ওরা যা বলে শুন… ওরা ওরা...”
ফোনটা কেড়ে নেয়া হয়েছে ফয়সালের হাত থেকে। শান্তার গলা কাপছে। ও হ্যালো হ্যালো করে গেলো। তারপর ওপাশে গম্ভীর গলাটা ফিরে এলো। “রাস্তার মোরে - সাদা রঙের একটা সিডান দাড়িয়ে। জিনিষ নিয়ে ওটায় চলে আসো...”
শান্তা আরও কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করল - তবে ফোন কেটে দেয়া হয়েছে। আর কিছু করার নেই শান্তার। এইবার শোবার ঘরে গিয়ে ও আলমারি থেকে ফয়সালের ব্রিফকেসটা বার করল। তাকে যারা আটকে রেখেছে - তাঁদের এই ব্রিফকেসটাই চাই। কিন্তু কেন? ঘর থেকে বেরতে গিয়েও থমকে গেলো শান্তা। কৌতূহল এর কাছে পরাজিত হল সে। বিছানায় ব্রিফকেসটা রেখে ডায়ালটা ঘুরাল। নম্বরটা জানাই আছে তার - ৪৫৩। ব্রিফকেসটা খুলে ভেতরে তাকাল শান্তা অনেক দিন পর। ওদিন রাতে ফয়সাল ভেতরে জিনিষ পত্র অনেক কিছুই পুরিয়ে ফেলেছিল। আগের তুলনায় খুব কম জিনিষপত্রই রয়েছে এই ব্রিফকেসে। কিছু কাগজ পত্র আর কিছু ক্যামেরার রীল। ওসব আগেও দেখেছে শান্তা - তাই আর ঘাটতে ইচ্ছে করল না তার। ও বেড়িয়ে এলো ব্রিফকেস হাতে বাড়ি থেকে।
মোর এর উপর সাদা রঙের গাড়িটা দাড়িয়েই আছে। এগোতে এগোতে শান্তা ভাবছিল পরিচিত কারও মুখই দেখতে পাবে সে। কিন্তু গাড়ির কাছে সম্পূর্ণ অপিরিচিত এক লোক দাড়িয়ে। শান্তা কাছে এগোতে পেছনের দরজাটা খুলে দারাল সে। শান্তা একবার তার দিকে তাকাল, তারপর বড় করে দম নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। লোকটি কথা কথাও না বলে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে চড়ল। গাড়ি ছেড়ে দিতেই শান্তার হাত ঘামতে শুরু করল। কই নিয়ে যাচ্ছে লোকটি তাকে!
#
রাস্তাটা অচেনা শান্তার কাছে। তবে যতই সময় কাটছে আশে পাশের লোকালয় পাতলা হচ্ছে। প্রায় মিনিট ত্রিশেক গাড়ি ছুটে চলল। একটা ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এরিয়াতে চলে এসেছে গাড়ি। বা দিকে মোর নিয়ে ইট বিছানো পথ ধরে ঝাকি খেতে খেতে এগিয়ে গেলো গাড়ি। সামনে একটা বিরাট ফ্যাক্টরি - পরিতেক্ত মনে হচ্ছে। মুল ফটকে দাড়িয়ে আছে দুজন লোক। গাড়িটাকে এগোতে দেখে ওরা গেট খুলে দিল। গাড়িটা ভেতরে ঢুকতেই আবার লাগিয়ে দিল পিছনে।
শান্তা গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো। শরীর কাপছে ওর। দুই হাতে ব্রিফকেসটা জাপটে ধরে রেখেছে ও বুকের সঙ্গে। আশে পাশে তাকাল শান্তা। চারিদিকে বড় বড় মেশিন পড়ে আছে। সামনে একটা ছাউনি দেয়া বিশাল ভবন। ভবনের ভেতরে সারি সারি মেশিন। ড্রাইভার লোকটি এতক্ষণে কথা বলল; “ভেতরে চলে যান… বস আপনার জন্য বসে আছে...”
শান্তা ঢোক গিলে। কাপা কাপা পদক্ষেপে এগোয় সে ফ্যাক্টরির ভেতরে। কাছেই কোথাও বড় বড় মেশিন চলছে। গো গো একটা আওয়াজ হচ্ছে। তারপরও শান্তা নিজের পায়ের শব্দ নিজেই শুনতে পারছে। দুই সারি মেশনের মাঝ দিয়ে এগিয়ে গেলো শান্তা শেষ প্রান্তে। ওদিকে একটা অফিস ঘরের মত আছে। দরজার কাছে বসে আছে একটা গুন্ডা মত লোক। শান্তাকে দেখে লাফিয়ে উঠে দাড়াল। হাত তুলে তাকে থামতে নির্দেশ দিয়ে অফিস কামরার দরজা খুলে ভেতরে উকি দিল। তারপর সোজা হয়ে শান্তাকে ভেতরে ঢুকতে নির্দেশ দিল। “ভেতরে যান।”
দরজা খোলাই রেখেছে লোকটি। শান্তা ধির পায়ে এগোল ওদিকে। দরজার ভেতরে পা রেখে চাইলো ডেস্ক এর পেছনে বসে থাকা লোকটির দিকে। লোকটির চেহারা দেখে মোটেই ওর মনে হল না - ফয়সালকে কিডনাপ করে খুনের হুমকি দিতে পারে সে।
“আসুন মিসেস শান্তা,” হাসি মুখে নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলো লোকটি। “বসুন...ভয় পাবেন না - আপনার স্বামী আশে পাশেই আছে...”
শান্তা ব্রিফকেসটা টেবিলের উপর রাখে। ওর চোখ ছলছল করছে। “এই তো এটা এনেছি - এখন ফয়সালকে ছেড়ে দিন...”
“ফয়সালকে ছাড়ব আপনাকে ছাড়ব না?” হাসি মুখে প্রশ্ন করতে করতে ব্রিফকেসটা টেনে নেয় লোকটি। তারপর লক নম্বর জানতে চায়। “বলুন এটার লক নম্বর কত...”
“৪৫৩...”
“বাহ বাহ বাহ…...” চমকে উথার ভান করে লোকটি। ব্রিফকেস ছেড়ে চেয়ারে হেলান দেয়। “নম্বরটা নিশ্চয়ই ফয়সাল আপনাকে জানায় নি… নিজে থেকে জেনেছেন?”
“নাহ - মানে -...” নিজের ভুল বুঝতে পারলো শান্তা। ঢোক গিলল ও। লোকটির সঙ্গে চোখ মেলাতে পারলো না। “একদিন খোলা পড়ে ছিল দেখে ছিলাম...। তাই মনে আছে...”
“বেশ - আপনার কথাই সত্য ধরে দিলাম,” লোকটি ব্রিফকেস মেলে ধরে। তারপর ভেতরে হাৎড়াতে থাকে। যতই সময় কাটে - ততই ভ্রু কুচকে যায় তার। এক সময় শান্তাকে হাতের ইশারায় বসতে ইঙ্গিত দেয়।
শান্তা নিজের পায়ের ভার রাখতে পারছে না বলেই চেয়ারে বসে পড়ে। লোকটি ঝুকে আসে ব্রিফকেস ঠেলে। “দেখুন - আমার রীলটা এখানে নেই… সেটা কোথায় আপনি ভালো বলতে পাড়বেন!”
“আ-আম-আমি জানি না...”
“ঠিক আছে, আমরা ফয়সালকে জিজ্ঞাসা করি,” লোকটি গলা ছেড়ে ডাকে। “এই মঞ্জু - ফয়সালকে নিয়ে আয়...”
কিছুক্ষনের মধ্যেই হাতাহাতির শব্দ শুনা যায়। রুমের দরজা খুলে যায়। শান্তা ঘুরে বসে। দুটো লোক দুপাশ থেকে ফয়সালকে ধরে রেখেছে। ফয়সালের গায়ের শার্ট ছিড়া, মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে, চোখ এর আশে পাশে ফুলে কালো হয়ে গেছে। শান্তা আতকে উঠে লাফিয়ে উঠে দাড়ায়। ছুটে যেতে চায় ফয়সালের দিকে। কিন্তু লোকগুলো ওকে ঠেলে দেয়। ফয়সালকে জোর করে বসিয়ে দেয় একটা চেয়ারে। তারপর ওর হাতে লাগানো হ্যান্ডকাফটা লাগিয়ে দেয় দেয়ালের একটা হুকের সঙ্গে।
“এই তো ফয়সাল সাহেব চলে এসেছেন,” লোকটি উঠে দাঁড়িয়েছে। “বলুন তো ফয়সাল সাহেব - কোথায় আপনার সেই রীল!”
“আমি বলেছি - ওটা আমি পুরিয়ে ফেলেছি ওদিনের পরই… সত্যি বলছি...”
“আপনি সত্যি বলছেন নাকি সেটা প্রমান করছি,” মাথা দোলায় লোকটি। এগিয়ে এসে ফয়সাল আর শান্তার মাঝে টেবিলে হেলান দেয়। একবার তাকায় ফয়সালের দিকে আর একবার শান্তার দিকে। তারপর হাতের ইশারায় লোক গুলোকে চলে যেতে ইশারা করে।
লোকগুলো দরজা লাগিয়ে বেড়িয়ে গেলেই লোকটি কথা বলে উঠে। “শান্তা মেডাম - আপনি নিশ্চয়ই আচ করতে পেরেছেন আমরা আপনার সাদা সিদে স্বামীকে কেন এভাবে মারধর করেছি - আটকে রেখেছি… কি পেরেছেন তো?”
শান্তা মাথা নাড়ে। ও কিছুই বুঝতে পারছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওর। ফয়সালের দিকে তাকাতে পারছে না ও। চোখ ফেটে কান্না বেরোচ্ছে। কোন কুলক্ষণে ছায়া যে এসে পড়েছে ওদের পরিবারের উপর! এর থেকে যেন শাশুড়ি মায়ের অত্যাচার আর ফয়সালের অবজ্ঞা হাজার গুন ভালো ছিল বলে মনে হচ্ছে শান্তার কাছে।
“পারছেন না! বেশ - আমি বলে দিচ্ছি,” গলা খাঁকারি দেয় লোকটি। “কি বলেন ফয়সাল সাহেব? আপনার স্ত্রীর কাছে আপনার জোরাজুরি সব ফাস করে দেই কেমন!”
“নাসির ভাই - বিশ্বাস করেন আমি কিছুই জানি না আমাদের ছেড়ে দিন… প্লিজ...” ফয়সাল কাঁতরে উঠে। তবে ওর আবেদন যেন শুনতেই পারেন না নাসির হোসেন। শান্তার দিকে ঘুরে বসে বলতে শুরু করেন ফয়সালের কির্তী...।
##
রিয়ান খান