23-12-2020, 10:55 PM
৬২ পর্ব
অমিতের অস্থিরতা দেখে মনি শংকর বললো যা তুই যা। অমিত কেবিনের দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলো বেডে শায়িত আছে অঞ্জলী। চোখ দুটা মেলে আছে মুখে অক্সিজেন মাস্ক ডাঃ বলছে হয়ত বিকালের দিক থেকে আর কৃএিম শ্বাসের প্রয়োজন হবেনা। অঞ্জলীর এহেন রুপ দেখে অমিতের বুকের বা পাশটা ব্যথায় মুচড়ে উঠলো। গুটিগুটি পায়ে অঞ্জলীর বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই অঞ্জলী অমিতের দিকে তাকালো। চোখ দুটা ছল ছল করছে।অঞ্জলীর ওই অশ্রু সিক্ত ছল ছল চোখের দিকে তাকিয়ে অমিত আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো অমিত। কান্না জরানো কন্ঠেই বললো একি করলে আমার জন্য তুমি?তুমিই যদি না থাকো তো আমার বেঁচে থেকে কি লাভ হতো বলো? অমিতের চোখে জল দেখে অঞ্জলীর দু চোখের কোন বেঁয়ে শ্রাবণের বারিধারার মত অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। কেবিনের ভিতর কান্নার শব্দ শুনে একজন নার্স এসে দেখে রুমের ভিতর অন্য পরিবেশ যেটা রোগীর জন্য মোটেও ভালো না। নার্সটা এসেই অমিতকে বকাঝকা করতে লাগলো। একি করছেন?আপনাদের কতো করে মানা করছে।সামান্য বুদ্ধি নাই আপনারা রোগীর সামনে কান্নাকাটি করছেন এতে রোগীর ক্ষতি হতে পারে যান বাইরে জান। অমিত নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের চোখের কোন মুছে,নিজের হাতে অঞ্জলী চোখের কোন মুছিয়ে দিতে দিতে বললো সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না আমি তো আছি।
অমিত বেড়িয়ে যেতে মঞ্জু ঢুকলো বোনের কেবিনে। মঞ্জুর আজ নিজেকে সব থেকে বেশি দোষি মনে হচ্ছে। বোনটাকে এই বাড়িতে এনেছিলো ভালো একটা ভবিষৎ হবে সেই আশায় কিন্তু ভগবানের কি লীলা মেয়েটা একের পর এক কষ্টই পেয়ে যাচ্ছে।এক এক করে সবার দেখা করা শেষ হলো।সবশেষে এসেছিলো ম্যাগী অঞ্জলী মাগ্যীর হাত ধরে কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু মুখে মাস্ক থাকায় তা মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কিন্তু চোখের ইশারায় আর হাতের চাপের অনুভবে ম্যাগী যেটা বুঝেছিলো সেটা হলো অমিত কে দেখে রাখার করুণ মিনতি।
সবার বাসায় ফিরতে হবে রোগীকে কেবিনে দেওয়ার পর রোগীর সাথে কারো থাকার অনুমতি নেই এই হসপিটালে।অগ্রত সবাইকে ফিরে আসতে হলো,কিন্তু সবার মন পরে রইলো সেই হাসপাতালেই।
সময় বয়ে যায় তার নিজ মহিমায়,দেখতে দেখতে ১০ টা দিন পার হয়ে গেছে অমিতের হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডাঃ কিছু ওষুধ দিয়েছে আরো কিছুদিন খেয়ে যেতে হবে। এর মধ্যো একটা ভালো সংবাদ আর দুই দিন পর অঞ্জলীকে রিলিজ করে দেওয়া হবে এমনটাই জানিয়েছে ডাঃ সেন।
অঞ্জলী আসবে বলে বাড়িতে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। এই কয়দিন ম্যাগী অমিতের ঘরেই থেকেছে ওর সেবা যত্নের জন্য। ম্যাগী রাতে অমিতের সাথে থাকতে একটু আমতা আমতা করলেও মনি শংকর ওকে বুঝিয়েছে বিন্দু প্রেগনেন্ট তার উপর এতো মানসিক চাপ,আর বন্যা আর মঞ্জু দুজনে যদিও নিজেদের কে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে তবুও একজন সদ্য স্বামীহারা আর একজন সদ্য পিতৃহারা তাই ওদের দিয়ে একজনের দেখভাল সম্ভব না। অগ্রত ম্যাগীও মেনে নিয়েছে।
রাজ্যোর নির্বাচনী ফলাফল বের হয়েছে কমলেশ মুখার্জীর দল বিপুল ভোটে পাশ করেছে। দলের সবাই যখন আনন্দ উল্লাসে ব্যস্ত তখন দলের সদ্য মুখ্যমন্ত্রী কমলেশ মুখার্জী নিজের ফোন হাতে নিয়ে তার সাফল্যের পেছনে অদৃশ্য ভাবে কাজ করা সেই অদম্য জাগ্রত নারীকে ফোনে পেতে ব্যস্ত। কিন্তু বার দশেক ডায়েল করেও নম্বর বন্ধ পেয়ে,আশা ছেড়ে দিয়ে মনে মনে বললো যেখানেই থাকো ভালো থেকো অঞ্জলী তোমার দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি আমি পালন করবো। এই রাজ্যোর সকল নারীকে তার প্রাপ্য সন্মান দিতে আমি লড়ে যাবো। আর এটাই হবে আমার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে তোমার প্রতি আমার নিরব সন্মান।
আগামী কাল অঞ্জলী কে আনতে যেতে হবে। সবাই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলো।রাত দুইটা কি আড়াইটা হবে মনি শংকরের ফোন বেঁজে উঠলো,ঘুম ঘুম চোখেই কিছুটা বিরক্ত হয়েই ফোন ধরলো মনি শংকর,হ্যালো কে বলছেন?
-মনি শংকর বলছেন?
-হ্যাঁ!!আপনি?
-আমি ডাঃ সেন বলছি !
ডাঃ সেন বলছি শুনেই মনি শংকরের ঘুম ছুটে গেলো।ডাঃ সেন মানে অঞ্জলী যার আন্ডারে আছে।এতো রাতে তাহলে কি অঞ্জলীর!!?
-হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন আমাকে?অপর প্রান্ত নিরব থাকাতে ডাঃ সেন বললো।
-ওহ হ্যা শুনতে পারছি।এতো রাতে কি হয়েছে?কোন খারাপ কিছু ?
-দেখুন আপনি শান্ত হন। খারাপই বটে বাট আপনি যেমনটা ভাবছেন ঠিক তেমন না।আপনি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন এখন?
-মনি শংকর এবার একটু রেগেই গেল।আরে মশাই আমি তো যেতেই পারি।কিন্তু কি হয়েছে অঞ্জলীর সেটা তো আগে বলুন।
-শি ইজ মিসিং!!ডাঃ সেন বললো।
-হুয়াট???মিসিং মানে??
-আসলে অঞ্জলীর কন্ডিশন এখন ভালো ছিলো। আপনারাও জানেন কাল উনাকে রিলিজ দেওয়া হতো।কিন্তু হঠ্যৎই এই আধা ঘন্টা ধরে তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এক ঘন্টা আগে আমি তাকে লাষ্ট ভিজিট করেছি। আমার কাছে পারমিশন চাইলো একটু হাঁটাহাঁটি করার।দেখুন এটা খুব ভালো সিম্পটম ওনার এমনি আস্তে আস্তে হাটাহাটি করাটা এখন উপকারী তাই আমি ও পারমিশন দিয়েছি।এর মধ্যো মিনিট তিনেকের জন্য লোডশেডিং হয়।আমরা জেনারেটর স্টার্ট দেওয়া পর্যন্ত আমাদের সিসিটিভি অফ ছিলো।আর এর পরে উনাকে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ উনাকে গেটের সামনে হাটতে দেখা গেছিলো। দারোয়ান বলছে উনি কাউকে ওই সময় বের হতে দেখেনি। এখুন আপনিই বলুন আমরা কি করতে পারি?প্লিজ আপনারা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে আসুন।
-ওকে আসছি বলে ফোন রেখে দিলো মনি শংকর।
মনি শংকরের কথা শুনে অনেক আগেই বিন্দুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। অপেক্ষায় ছিলো কখন মনি ফোন রাখবে।
মনি শংকর ফোন রাখতেই বিন্দু বললো কি হয়েছে গো? অঞ্জলী ভালো আছে তো?কিচ্ছু ঠিক নেই বিন্দু কিচ্ছু ঠিক নেই।অঞ্জলী কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কি বলছো তুমি? খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা মানে?ওকে দেখে রাখা হাসপাতাল কতৃপক্ষের দ্বায়ীত্ব এমনি উনারা আমাদের থাকাটাও এলাউ করেনি। সেটা আমিও জানি বিন্দু এখন এসব বলে সময় নষ্ট করার সময় না আমাদের এখনি বের হতে হবে। মনি শংকর উঠে অমিতের ঘরের দিকে গেল আর বিন্দু গেল মঞ্জু আর বন্যাকে জাগাতে। এতো রাতে মনি শংকরকে দেখে অমিতের মনে কু ডেকে উঠলো তাহলে কি অঞ্জলীর কিছু হলো?
মনি শংকর অমিতের রুমে ঢুকে বললো তোরা রেডি হয়ে নে আমাদের এখনি হাসপাতালে যেতে হবে। কেন কি হয়েছে মনি দা? অঞ্জলী ঠিক আছে তো?সব বলছি আগে রেডি হয়ে নে। মনি শংকর বললো।
না মনিদা আমার মনে কু ডাকছে বলো কি হয়েছে? দেখ অঞ্জলী সুস্থ ছিলো আই থিং এখনো আছে বাট অঞ্জলীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তারপর ডাঃ সেনের সাথে সব কথোপকথন অমিতকে বললো মনি শংকর।নসব শুনে অমিত দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পরলো। এর মধ্যে মঞ্জুরা কখন এসে পিছনে দাড়িয়েছে মনি শংকর খেয়াল করেনি। খেয়াল করলো যখন মঞ্জু চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো। সদ্য স্বামীকে হারিয়েছে আবার এখন নিজের মায়ের পেটের বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা শুনেই নিজেকে আর সামলাতে পারেনি।
সবাই নিজেদের গাড়ি করে হাসপাতালে পৌছাতেই ডাঃ সেন ছুটে এসে বললো আমরা সব রকম চেষ্টা করেছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। অমিত চিৎকার করে উঠলো খুঁজে পাননি বললেই হলো।আপনাদের কি কোন রেস্পন্সিবিলিটি নেই? দেখুন আপনাদের কষ্টটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা তো চেষ্টা কম করিনি। এখন আপনাদের আসার অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা ঘটনা আমাদের হাসপাতালের জন্যও দুঃখজনক। আমাদের এখন বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত ডাঃ সেন বললো। সব শুনে অমিত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন।কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো জবা ফুলের মত হয়ে গেছে। শান্ত গলায় ডাঃ সেন কে উদ্দেশ্য করে বললো আমি একটু অঞ্জলীর কেবিনে যেতে চাই একা। ডাঃ সেন একবার অমিত আর একবার মনি শংকরের দিকে তাকিয়ে বললো আচ্ছা আসুন।
অমিত অঞ্জলী যে কেবিনে থাকতো সেই কেবিনে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। প্রায় দশ মিনিট পর বেড়িয়ে এসে বললো মনিদা বাড়ি চলো।অমিতের কথা শুনে সবাই অবাক। মেন্টালি শক পেল নাকি অমিত। বাড়ি যাবো মানে? অঞ্জলীকে খুঁজতে হবে। থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করতে হবে। হাত উঁচু করে অমিত মনি শংকরকে থামিয়ে দিয়ে বললো। কোন দরকার নেই মনিদা অঞ্জলীকে কেউ কিডনাপ করেনি যে থানায় যেতে হবে। আর অঞ্জলী যদি নিজেই নিজেকে মিসিং করে থাকে তাহলে দুনিয়ার কারো ক্ষমতা নেই ওকে খুঁজে বের করার। আমার মনে হয় আমার দ্বিতীয় সন্দেহ্যটায় সত্যি তাই বাড়ি চলো।ও এমনিতেই যেত শুধু সুস্থ হবার অপেক্ষায় ছিলো। ত্যাগ করাটা ওর রক্তে মিশে গেছে।ওকে ওর মত থাকতে দাও।অমিতের কথায় শুকনো মুখ আর অশ্রু সিক্ত চোখ নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরলো। ওরা চলে যেতেই ডাঃ সেনের পিছনে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো।
**************************
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না বাড়ির সকলের জোড়াজোড়িতে অমিত আর ম্যাগী সাত পাঁকে বাধা পরলো। যদিও অমিতের মত ছিলো না সে এভাবেই সারাজীবন কাঁটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।পরে ম্যাগীই অমিতকে বলেছিলো ম্যাগীর সাথে অঞ্জলীর শেষ কথা গুলো।
********
অঞ্জু মা আস্তে পরে যাবে সোনা। না না পরবো না মাম্মি। অঞ্জলী মা এমন দুষ্টুমি করে না ফিরে এসো আমাদের কাছে।রাস্তায় হাটা অবস্থায় বাবা মার থেকে দৌড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া এক দুষ্টু মিষ্টি পাঁচ বছরের মেয়েকে এভাবেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলো,মেয়েটার বাবা মা।
বাচ্চা মেয়েটার থেকে একটু দুরে সামনে হাঁটতে থাকা এক বৃদ্ধ অঞ্জলী নামটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলো একটা ফুটফুটে মিষ্টি একটা মেয়ে। বৃদ্ধটাকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটাও থেমে গিয়ে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকলো। তোমার নাম কি মামনি? প্রশ্ন করলো বৃদ্ধটা।
অঞ্জলী রায় চৌধুরী। ছোট্ট উত্তর মেয়েটার।
ততোক্ষণে মেয়েটার মা বাবা মেয়েটার কাছে এসে দাড়িয়েছে। কি হয়েছে অঞ্জুমা?কিছু না বাপি এই দাদুটা আমার নাম জানতে চাইলো। এবার বৃদ্ধটা মুখ তুলে চাইলো মেয়েটার বাবার দিকে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো আপনি অমিতাব রায় চৌধুরী না? হ্যাঁ!! আমি যদি চিনতে ভুলনা করি আপনি ডাঃ সেন?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন আমিই ডাঃ সেন অঞ্জলী আমার আন্ডারেই চিকিৎসায় ছিলো।অঞ্জলীর কথা মনে হতেই বুকের বা পাশটা আবার চিনচিন করে উঠলো। আর আপনি মিসেস রায় চৌধুরী? অঞ্জলী আপনাকে ম্যাগী বলতো তাই তো? ডাঃ সেন বললো।হ্যাঁ আমি ম্যাগী কিন্তু আপনার তো আমার নাম জানার কথা না? ম্যাগী বললো। ছোট মেয়েটা কিছুই বুঝছেনা আবার কে অঞ্জলী।
এবার ডাঃ সেন বললো অমিত বাবু আপনাদের একটু সময় হবে? কিছু বলার ছিলো আমার যে কথা আমি সেদিন বলতে পারিনি। ডাঃ সেনের এমন কথা শুনে অমিত ম্যাগী দুজনেই বুঝে গেল সেদিনের ঘটনার সাথে নিশ্চয়ই ডাঃ সেন জড়িত কিংবা কিছু জানে। সব শোনার জন্য এতো বছর পরও অমিত অতি উৎসুক হয়ে উঠলো। সে তো এখনো অপেক্ষায় আছে এই বুঝি তার অঞ্জলী ফিরলো।হ্যা ডাঃ সেন আপনি বলুন ।
ডাঃ সেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো।প্রথমে আমাকে ক্ষমা করবেন।আমার কোন সন্তান নেই তাই সেদিন অঞ্জলী মায়ের মুখে বাপি ডাক শুনে নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমি সেদিনের ঘটনার এক বছর পর রিটায়ার্ড করি চাকরি থেকে। আসলে অঞ্জলী মিসিং হয়নি সেদিন। আপনারা যখন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন তখনো অঞ্জলী ওখানেই ছিলো। আসলে অঞ্জলী কিছুটা সুস্থ হলে একদিন রাতে আমি ওর কেবিনে ভিজিটে গেলে। আমাকে বলে আমার সাথে ওর কিছু কথা আছে।তার আগে আপনাদের বলি অঞ্জলীর তলপেটে যে গুলিটা লেগেছিলো সেটার জন্য ও চিরতরে মা হবার সুখ থেকে বঞ্চিত হয়। আর যে গুলিটা রানের মাঝ দিয়ে যায় সেটা আসলে অঞ্জলীর ভ্যাজাইনায় আঘাত করেছিলো কিছুটা। যার কারণে অপারেশনের সময় অনেক কিছু কেঁটে বাদ দেওয়া লেগেছে। আসলে অঞ্জলী যে বেঁচে গেছে এটাই আমাদের কাছে বড় পাওয়া ছিলো।এর ফলে স্বাভাবিক মানুষের মত শারীরিক সম্পর্ক ওর দ্বারা আর সম্ভব ছিলো না।
এসব শুনে অমিত আর ম্যাগী দুজনেই কেঁদে উঠলো কিন্তু শব্দ করতে পারছেনা সাথে মেয়েটা আছে।ডাঃ সেনের চোখ ও ভিজে উঠলো। তো সেদিন রাতে অঞ্জলী আমাকে বললো ,,,,
স্যার আমার আর বিশিষ্ট জ্বালানী বিজ্ঞানী অমিতাব রায় চৌধুরির সাথে বিয়ের কথা ছিলো এর মাঝেই এসব হয়ে গেলো।আমি জানি আমি কি কি হারিয়েছি। প্রথমে কষ্ট পেয়েছি স্যার কিন্তু নিয়তি যা চায় তা তো হবেই। এখন আপনিই বলুন একজন অসম্পূর্ণ নারী হয়ে কিভাবে এমন একজন মানুষের গলায় ঝুলে পরি?!! কিন্তু অমিত এসব জানার পরও আমাকে বিয়ে করতে দ্বিধা করবেনা কিন্তু আমি তো এটা হতে দিতে পারিনা একটা মানুষের জন্য গোটা পরিবারটাকে সমস্যায় পরতে দিতে পারিনা।আমি অঞ্জলীর কথা শুনে অবাক হয়ে যাই কি বলতে চায় মেয়েটা। তারপর ও আমাকে শোনালো আপনাদের অমর প্রেমের কাহিনী।
সব শুনে আমি অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সব কথা শুনতে শুনতে কখন বোধহয় আমার চোখে জল এসে গেছিলো,অঞ্জলী নিজের হাতে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো।আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমি বললাম কি সাহায্য বলো? আমি ওদের থেকে দুরে চলে যেতে চাই এ ছাড়া আমার কোন উপায় নেই । আমি পালাতে চাই। কিন্তু এতো সিসিটিভি সিকিউরিটির ভিতর দিয়ে তা সম্ভব না। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন প্লিজ? আমি বুঝতে পারছিলাম কথা গুলা বলতে অঞ্জলীর কতো কষ্ট হচ্ছে। তবুও বললাম না না এটা কি করে সম্ভব আমি একজন ডাঃ আমি রোগীর কথা শুনে তার পরিবারের লোকের সাথে এমনটা করতে পারিনা। তখন অঞ্জলী আমার পাশে ধরে বললো আমি যদি আপনার মেয়ে হতাম পারতেন জেনে শুনে এমন একটা মেয়েকে একজন ভালো মানুষের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে শান্তিতে থাকতে। তারচেয়ে আমি পড়াশোনা জানা মেয়ে দুরে চলে গেলেও ঠিক কিছু জোগাড় করে নিবো। সত্যি বলতে নিজের মেয়ের কথা শুনে একজন নিঃসন্তান পিতার বুকটা হু হু করে উঠেছিলো। তাছাড়া অঞ্জলী ভুল কিছুও বলছেনা। তাই শেষ পর্যন্ত ওর কথা মেনে এসব করি। আমি লাইট অফ করে ওকে অন্য জায়গায় লুকাতে সাহায্য করি।আমিই অঞ্জলীর পাশে বসে মনি শংকর বাবু কে কল করে ওসব বলি।পরে আপনারা চলে গেলে আমি ওকে আমার বাসায় নিয়ে যাই। আমার ওখানে মাস খানিক ও ছিলো পরে আমার অনুমতি নিয়ে কোথায় যে চলে গেল মেয়েটা।মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ নেয় কিন্তু সেটা বিভিন্ন নম্বর থেকে।মানে আমাদের ওকে ধরা সম্ভব না। একবার শুনেছিলাম একটা বাচ্চাদের কলেজে পড়ায়। বলেছিলো গরীব বাচ্চাদের জন্য একটা কলেজ ও খুলবে।তারপর আর অনেক দিন যোগাযোগ নেই।
ডাঃ সেনের কথা শেষ হতেই অমিত রাস্তাতে বসে কেঁদে ফেললো শব্দ করে।ছোট্ট অঞ্জলী বাপিকে কাঁদতে দেখে বাপির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো কি হয়েছে বাপি তোমার? কাঁদছো কেন তুমি?মা বাপি কাঁদছে কেন? অমিত নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো কই আমি কাঁদছিনা তো মা। আমি কাঁদবো কেন আমার অঞ্জু থাকতে।,,,মেয়ে কোলে তুলে নিয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।ছোট্ট অঞ্জলী বাপির কোলে মুখ গুজে বললো,,বুঝেছি তুমি অন্য অঞ্জলীর জন্য কাঁদছো! কিন্তু শুধু অঞ্জলী নয়,আমিও তোমাকে আর অঞ্জলীকে ভালবাসি বাপি।ছোট্ট মেয়ের মুখে এ কথা শুনে অমিতের সারা শরীর কেঁপে উঠলো,বুকের মাঝের ব্যথাটা যেন তরল হয়ে আবারও চোখ দিয়ে বেড়িয়ে আসলো। শুধু মনে মনে বললো আমিও অঞ্জলী আর তোমাকে ভালবাসি ঠাকুমা। দুজন দুরে থেকেও আমাকে এখনো আগলে রাখছো।
নিজের চোখের জল মুছে মেয়েকে কোলে নিয়ে এক হাত দিয়ে ম্যাগীর হাত ধরে সামনের দিকে পা বাঁড়ালো বিদ্রোহী রাজকুমার।।
***************সমাপ্ত************
অমিতের অস্থিরতা দেখে মনি শংকর বললো যা তুই যা। অমিত কেবিনের দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখলো বেডে শায়িত আছে অঞ্জলী। চোখ দুটা মেলে আছে মুখে অক্সিজেন মাস্ক ডাঃ বলছে হয়ত বিকালের দিক থেকে আর কৃএিম শ্বাসের প্রয়োজন হবেনা। অঞ্জলীর এহেন রুপ দেখে অমিতের বুকের বা পাশটা ব্যথায় মুচড়ে উঠলো। গুটিগুটি পায়ে অঞ্জলীর বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই অঞ্জলী অমিতের দিকে তাকালো। চোখ দুটা ছল ছল করছে।অঞ্জলীর ওই অশ্রু সিক্ত ছল ছল চোখের দিকে তাকিয়ে অমিত আর নিজেকে সামলাতে পারলোনা। ঝড় ঝড় করে কেঁদে ফেললো অমিত। কান্না জরানো কন্ঠেই বললো একি করলে আমার জন্য তুমি?তুমিই যদি না থাকো তো আমার বেঁচে থেকে কি লাভ হতো বলো? অমিতের চোখে জল দেখে অঞ্জলীর দু চোখের কোন বেঁয়ে শ্রাবণের বারিধারার মত অশ্রু নির্গত হতে লাগলো। কেবিনের ভিতর কান্নার শব্দ শুনে একজন নার্স এসে দেখে রুমের ভিতর অন্য পরিবেশ যেটা রোগীর জন্য মোটেও ভালো না। নার্সটা এসেই অমিতকে বকাঝকা করতে লাগলো। একি করছেন?আপনাদের কতো করে মানা করছে।সামান্য বুদ্ধি নাই আপনারা রোগীর সামনে কান্নাকাটি করছেন এতে রোগীর ক্ষতি হতে পারে যান বাইরে জান। অমিত নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজের চোখের কোন মুছে,নিজের হাতে অঞ্জলী চোখের কোন মুছিয়ে দিতে দিতে বললো সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না আমি তো আছি।
অমিত বেড়িয়ে যেতে মঞ্জু ঢুকলো বোনের কেবিনে। মঞ্জুর আজ নিজেকে সব থেকে বেশি দোষি মনে হচ্ছে। বোনটাকে এই বাড়িতে এনেছিলো ভালো একটা ভবিষৎ হবে সেই আশায় কিন্তু ভগবানের কি লীলা মেয়েটা একের পর এক কষ্টই পেয়ে যাচ্ছে।এক এক করে সবার দেখা করা শেষ হলো।সবশেষে এসেছিলো ম্যাগী অঞ্জলী মাগ্যীর হাত ধরে কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু মুখে মাস্ক থাকায় তা মুখ ফুটে বলতে পারেনি। কিন্তু চোখের ইশারায় আর হাতের চাপের অনুভবে ম্যাগী যেটা বুঝেছিলো সেটা হলো অমিত কে দেখে রাখার করুণ মিনতি।
সবার বাসায় ফিরতে হবে রোগীকে কেবিনে দেওয়ার পর রোগীর সাথে কারো থাকার অনুমতি নেই এই হসপিটালে।অগ্রত সবাইকে ফিরে আসতে হলো,কিন্তু সবার মন পরে রইলো সেই হাসপাতালেই।
সময় বয়ে যায় তার নিজ মহিমায়,দেখতে দেখতে ১০ টা দিন পার হয়ে গেছে অমিতের হাতের ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ডাঃ কিছু ওষুধ দিয়েছে আরো কিছুদিন খেয়ে যেতে হবে। এর মধ্যো একটা ভালো সংবাদ আর দুই দিন পর অঞ্জলীকে রিলিজ করে দেওয়া হবে এমনটাই জানিয়েছে ডাঃ সেন।
অঞ্জলী আসবে বলে বাড়িতে একটা উৎসব মুখর পরিবেশ। এই কয়দিন ম্যাগী অমিতের ঘরেই থেকেছে ওর সেবা যত্নের জন্য। ম্যাগী রাতে অমিতের সাথে থাকতে একটু আমতা আমতা করলেও মনি শংকর ওকে বুঝিয়েছে বিন্দু প্রেগনেন্ট তার উপর এতো মানসিক চাপ,আর বন্যা আর মঞ্জু দুজনে যদিও নিজেদের কে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছে তবুও একজন সদ্য স্বামীহারা আর একজন সদ্য পিতৃহারা তাই ওদের দিয়ে একজনের দেখভাল সম্ভব না। অগ্রত ম্যাগীও মেনে নিয়েছে।
রাজ্যোর নির্বাচনী ফলাফল বের হয়েছে কমলেশ মুখার্জীর দল বিপুল ভোটে পাশ করেছে। দলের সবাই যখন আনন্দ উল্লাসে ব্যস্ত তখন দলের সদ্য মুখ্যমন্ত্রী কমলেশ মুখার্জী নিজের ফোন হাতে নিয়ে তার সাফল্যের পেছনে অদৃশ্য ভাবে কাজ করা সেই অদম্য জাগ্রত নারীকে ফোনে পেতে ব্যস্ত। কিন্তু বার দশেক ডায়েল করেও নম্বর বন্ধ পেয়ে,আশা ছেড়ে দিয়ে মনে মনে বললো যেখানেই থাকো ভালো থেকো অঞ্জলী তোমার দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি আমি পালন করবো। এই রাজ্যোর সকল নারীকে তার প্রাপ্য সন্মান দিতে আমি লড়ে যাবো। আর এটাই হবে আমার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে তোমার প্রতি আমার নিরব সন্মান।
আগামী কাল অঞ্জলী কে আনতে যেতে হবে। সবাই রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলো।রাত দুইটা কি আড়াইটা হবে মনি শংকরের ফোন বেঁজে উঠলো,ঘুম ঘুম চোখেই কিছুটা বিরক্ত হয়েই ফোন ধরলো মনি শংকর,হ্যালো কে বলছেন?
-মনি শংকর বলছেন?
-হ্যাঁ!!আপনি?
-আমি ডাঃ সেন বলছি !
ডাঃ সেন বলছি শুনেই মনি শংকরের ঘুম ছুটে গেলো।ডাঃ সেন মানে অঞ্জলী যার আন্ডারে আছে।এতো রাতে তাহলে কি অঞ্জলীর!!?
-হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন আমাকে?অপর প্রান্ত নিরব থাকাতে ডাঃ সেন বললো।
-ওহ হ্যা শুনতে পারছি।এতো রাতে কি হয়েছে?কোন খারাপ কিছু ?
-দেখুন আপনি শান্ত হন। খারাপই বটে বাট আপনি যেমনটা ভাবছেন ঠিক তেমন না।আপনি একটু হাসপাতালে আসতে পারবেন এখন?
-মনি শংকর এবার একটু রেগেই গেল।আরে মশাই আমি তো যেতেই পারি।কিন্তু কি হয়েছে অঞ্জলীর সেটা তো আগে বলুন।
-শি ইজ মিসিং!!ডাঃ সেন বললো।
-হুয়াট???মিসিং মানে??
-আসলে অঞ্জলীর কন্ডিশন এখন ভালো ছিলো। আপনারাও জানেন কাল উনাকে রিলিজ দেওয়া হতো।কিন্তু হঠ্যৎই এই আধা ঘন্টা ধরে তাকে খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা। এক ঘন্টা আগে আমি তাকে লাষ্ট ভিজিট করেছি। আমার কাছে পারমিশন চাইলো একটু হাঁটাহাঁটি করার।দেখুন এটা খুব ভালো সিম্পটম ওনার এমনি আস্তে আস্তে হাটাহাটি করাটা এখন উপকারী তাই আমি ও পারমিশন দিয়েছি।এর মধ্যো মিনিট তিনেকের জন্য লোডশেডিং হয়।আমরা জেনারেটর স্টার্ট দেওয়া পর্যন্ত আমাদের সিসিটিভি অফ ছিলো।আর এর পরে উনাকে পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ উনাকে গেটের সামনে হাটতে দেখা গেছিলো। দারোয়ান বলছে উনি কাউকে ওই সময় বের হতে দেখেনি। এখুন আপনিই বলুন আমরা কি করতে পারি?প্লিজ আপনারা যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এখানে আসুন।
-ওকে আসছি বলে ফোন রেখে দিলো মনি শংকর।
মনি শংকরের কথা শুনে অনেক আগেই বিন্দুর ঘুম ভেঙ্গে গেছে। অপেক্ষায় ছিলো কখন মনি ফোন রাখবে।
মনি শংকর ফোন রাখতেই বিন্দু বললো কি হয়েছে গো? অঞ্জলী ভালো আছে তো?কিচ্ছু ঠিক নেই বিন্দু কিচ্ছু ঠিক নেই।অঞ্জলী কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! কি বলছো তুমি? খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা মানে?ওকে দেখে রাখা হাসপাতাল কতৃপক্ষের দ্বায়ীত্ব এমনি উনারা আমাদের থাকাটাও এলাউ করেনি। সেটা আমিও জানি বিন্দু এখন এসব বলে সময় নষ্ট করার সময় না আমাদের এখনি বের হতে হবে। মনি শংকর উঠে অমিতের ঘরের দিকে গেল আর বিন্দু গেল মঞ্জু আর বন্যাকে জাগাতে। এতো রাতে মনি শংকরকে দেখে অমিতের মনে কু ডেকে উঠলো তাহলে কি অঞ্জলীর কিছু হলো?
মনি শংকর অমিতের রুমে ঢুকে বললো তোরা রেডি হয়ে নে আমাদের এখনি হাসপাতালে যেতে হবে। কেন কি হয়েছে মনি দা? অঞ্জলী ঠিক আছে তো?সব বলছি আগে রেডি হয়ে নে। মনি শংকর বললো।
না মনিদা আমার মনে কু ডাকছে বলো কি হয়েছে? দেখ অঞ্জলী সুস্থ ছিলো আই থিং এখনো আছে বাট অঞ্জলীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। তারপর ডাঃ সেনের সাথে সব কথোপকথন অমিতকে বললো মনি শংকর।নসব শুনে অমিত দু হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পরলো। এর মধ্যে মঞ্জুরা কখন এসে পিছনে দাড়িয়েছে মনি শংকর খেয়াল করেনি। খেয়াল করলো যখন মঞ্জু চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো। সদ্য স্বামীকে হারিয়েছে আবার এখন নিজের মায়ের পেটের বোনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা শুনেই নিজেকে আর সামলাতে পারেনি।
সবাই নিজেদের গাড়ি করে হাসপাতালে পৌছাতেই ডাঃ সেন ছুটে এসে বললো আমরা সব রকম চেষ্টা করেছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি। অমিত চিৎকার করে উঠলো খুঁজে পাননি বললেই হলো।আপনাদের কি কোন রেস্পন্সিবিলিটি নেই? দেখুন আপনাদের কষ্টটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু আমরা তো চেষ্টা কম করিনি। এখন আপনাদের আসার অপেক্ষায় ছিলাম এমন একটা ঘটনা আমাদের হাসপাতালের জন্যও দুঃখজনক। আমাদের এখন বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত ডাঃ সেন বললো। সব শুনে অমিত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো যেন কোন গভীর চিন্তায় মগ্ন।কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো জবা ফুলের মত হয়ে গেছে। শান্ত গলায় ডাঃ সেন কে উদ্দেশ্য করে বললো আমি একটু অঞ্জলীর কেবিনে যেতে চাই একা। ডাঃ সেন একবার অমিত আর একবার মনি শংকরের দিকে তাকিয়ে বললো আচ্ছা আসুন।
অমিত অঞ্জলী যে কেবিনে থাকতো সেই কেবিনে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলো। প্রায় দশ মিনিট পর বেড়িয়ে এসে বললো মনিদা বাড়ি চলো।অমিতের কথা শুনে সবাই অবাক। মেন্টালি শক পেল নাকি অমিত। বাড়ি যাবো মানে? অঞ্জলীকে খুঁজতে হবে। থানায় একটা মিসিং ডায়েরি করতে হবে। হাত উঁচু করে অমিত মনি শংকরকে থামিয়ে দিয়ে বললো। কোন দরকার নেই মনিদা অঞ্জলীকে কেউ কিডনাপ করেনি যে থানায় যেতে হবে। আর অঞ্জলী যদি নিজেই নিজেকে মিসিং করে থাকে তাহলে দুনিয়ার কারো ক্ষমতা নেই ওকে খুঁজে বের করার। আমার মনে হয় আমার দ্বিতীয় সন্দেহ্যটায় সত্যি তাই বাড়ি চলো।ও এমনিতেই যেত শুধু সুস্থ হবার অপেক্ষায় ছিলো। ত্যাগ করাটা ওর রক্তে মিশে গেছে।ওকে ওর মত থাকতে দাও।অমিতের কথায় শুকনো মুখ আর অশ্রু সিক্ত চোখ নিয়ে সবাই বাড়ি ফিরলো। ওরা চলে যেতেই ডাঃ সেনের পিছনে একটা ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়ালো।
**************************
সময় কারো জন্য অপেক্ষা করে না বাড়ির সকলের জোড়াজোড়িতে অমিত আর ম্যাগী সাত পাঁকে বাধা পরলো। যদিও অমিতের মত ছিলো না সে এভাবেই সারাজীবন কাঁটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো।পরে ম্যাগীই অমিতকে বলেছিলো ম্যাগীর সাথে অঞ্জলীর শেষ কথা গুলো।
********
অঞ্জু মা আস্তে পরে যাবে সোনা। না না পরবো না মাম্মি। অঞ্জলী মা এমন দুষ্টুমি করে না ফিরে এসো আমাদের কাছে।রাস্তায় হাটা অবস্থায় বাবা মার থেকে দৌড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া এক দুষ্টু মিষ্টি পাঁচ বছরের মেয়েকে এভাবেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছিলো,মেয়েটার বাবা মা।
বাচ্চা মেয়েটার থেকে একটু দুরে সামনে হাঁটতে থাকা এক বৃদ্ধ অঞ্জলী নামটা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে দেখলো একটা ফুটফুটে মিষ্টি একটা মেয়ে। বৃদ্ধটাকে ওভাবে দাঁড়াতে দেখে মেয়েটাও থেমে গিয়ে ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে থাকলো। তোমার নাম কি মামনি? প্রশ্ন করলো বৃদ্ধটা।
অঞ্জলী রায় চৌধুরী। ছোট্ট উত্তর মেয়েটার।
ততোক্ষণে মেয়েটার মা বাবা মেয়েটার কাছে এসে দাড়িয়েছে। কি হয়েছে অঞ্জুমা?কিছু না বাপি এই দাদুটা আমার নাম জানতে চাইলো। এবার বৃদ্ধটা মুখ তুলে চাইলো মেয়েটার বাবার দিকে।কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো আপনি অমিতাব রায় চৌধুরী না? হ্যাঁ!! আমি যদি চিনতে ভুলনা করি আপনি ডাঃ সেন?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন আমিই ডাঃ সেন অঞ্জলী আমার আন্ডারেই চিকিৎসায় ছিলো।অঞ্জলীর কথা মনে হতেই বুকের বা পাশটা আবার চিনচিন করে উঠলো। আর আপনি মিসেস রায় চৌধুরী? অঞ্জলী আপনাকে ম্যাগী বলতো তাই তো? ডাঃ সেন বললো।হ্যাঁ আমি ম্যাগী কিন্তু আপনার তো আমার নাম জানার কথা না? ম্যাগী বললো। ছোট মেয়েটা কিছুই বুঝছেনা আবার কে অঞ্জলী।
এবার ডাঃ সেন বললো অমিত বাবু আপনাদের একটু সময় হবে? কিছু বলার ছিলো আমার যে কথা আমি সেদিন বলতে পারিনি। ডাঃ সেনের এমন কথা শুনে অমিত ম্যাগী দুজনেই বুঝে গেল সেদিনের ঘটনার সাথে নিশ্চয়ই ডাঃ সেন জড়িত কিংবা কিছু জানে। সব শোনার জন্য এতো বছর পরও অমিত অতি উৎসুক হয়ে উঠলো। সে তো এখনো অপেক্ষায় আছে এই বুঝি তার অঞ্জলী ফিরলো।হ্যা ডাঃ সেন আপনি বলুন ।
ডাঃ সেন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো।প্রথমে আমাকে ক্ষমা করবেন।আমার কোন সন্তান নেই তাই সেদিন অঞ্জলী মায়ের মুখে বাপি ডাক শুনে নিজেকে সামলাতে পারিনি। আমি সেদিনের ঘটনার এক বছর পর রিটায়ার্ড করি চাকরি থেকে। আসলে অঞ্জলী মিসিং হয়নি সেদিন। আপনারা যখন হাসপাতালে উপস্থিত ছিলেন তখনো অঞ্জলী ওখানেই ছিলো। আসলে অঞ্জলী কিছুটা সুস্থ হলে একদিন রাতে আমি ওর কেবিনে ভিজিটে গেলে। আমাকে বলে আমার সাথে ওর কিছু কথা আছে।তার আগে আপনাদের বলি অঞ্জলীর তলপেটে যে গুলিটা লেগেছিলো সেটার জন্য ও চিরতরে মা হবার সুখ থেকে বঞ্চিত হয়। আর যে গুলিটা রানের মাঝ দিয়ে যায় সেটা আসলে অঞ্জলীর ভ্যাজাইনায় আঘাত করেছিলো কিছুটা। যার কারণে অপারেশনের সময় অনেক কিছু কেঁটে বাদ দেওয়া লেগেছে। আসলে অঞ্জলী যে বেঁচে গেছে এটাই আমাদের কাছে বড় পাওয়া ছিলো।এর ফলে স্বাভাবিক মানুষের মত শারীরিক সম্পর্ক ওর দ্বারা আর সম্ভব ছিলো না।
এসব শুনে অমিত আর ম্যাগী দুজনেই কেঁদে উঠলো কিন্তু শব্দ করতে পারছেনা সাথে মেয়েটা আছে।ডাঃ সেনের চোখ ও ভিজে উঠলো। তো সেদিন রাতে অঞ্জলী আমাকে বললো ,,,,
স্যার আমার আর বিশিষ্ট জ্বালানী বিজ্ঞানী অমিতাব রায় চৌধুরির সাথে বিয়ের কথা ছিলো এর মাঝেই এসব হয়ে গেলো।আমি জানি আমি কি কি হারিয়েছি। প্রথমে কষ্ট পেয়েছি স্যার কিন্তু নিয়তি যা চায় তা তো হবেই। এখন আপনিই বলুন একজন অসম্পূর্ণ নারী হয়ে কিভাবে এমন একজন মানুষের গলায় ঝুলে পরি?!! কিন্তু অমিত এসব জানার পরও আমাকে বিয়ে করতে দ্বিধা করবেনা কিন্তু আমি তো এটা হতে দিতে পারিনা একটা মানুষের জন্য গোটা পরিবারটাকে সমস্যায় পরতে দিতে পারিনা।আমি অঞ্জলীর কথা শুনে অবাক হয়ে যাই কি বলতে চায় মেয়েটা। তারপর ও আমাকে শোনালো আপনাদের অমর প্রেমের কাহিনী।
সব শুনে আমি অঞ্জলীর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। সব কথা শুনতে শুনতে কখন বোধহয় আমার চোখে জল এসে গেছিলো,অঞ্জলী নিজের হাতে আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বললো।আমাকে একটু সাহায্য করবেন? আমি বললাম কি সাহায্য বলো? আমি ওদের থেকে দুরে চলে যেতে চাই এ ছাড়া আমার কোন উপায় নেই । আমি পালাতে চাই। কিন্তু এতো সিসিটিভি সিকিউরিটির ভিতর দিয়ে তা সম্ভব না। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন প্লিজ? আমি বুঝতে পারছিলাম কথা গুলা বলতে অঞ্জলীর কতো কষ্ট হচ্ছে। তবুও বললাম না না এটা কি করে সম্ভব আমি একজন ডাঃ আমি রোগীর কথা শুনে তার পরিবারের লোকের সাথে এমনটা করতে পারিনা। তখন অঞ্জলী আমার পাশে ধরে বললো আমি যদি আপনার মেয়ে হতাম পারতেন জেনে শুনে এমন একটা মেয়েকে একজন ভালো মানুষের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে শান্তিতে থাকতে। তারচেয়ে আমি পড়াশোনা জানা মেয়ে দুরে চলে গেলেও ঠিক কিছু জোগাড় করে নিবো। সত্যি বলতে নিজের মেয়ের কথা শুনে একজন নিঃসন্তান পিতার বুকটা হু হু করে উঠেছিলো। তাছাড়া অঞ্জলী ভুল কিছুও বলছেনা। তাই শেষ পর্যন্ত ওর কথা মেনে এসব করি। আমি লাইট অফ করে ওকে অন্য জায়গায় লুকাতে সাহায্য করি।আমিই অঞ্জলীর পাশে বসে মনি শংকর বাবু কে কল করে ওসব বলি।পরে আপনারা চলে গেলে আমি ওকে আমার বাসায় নিয়ে যাই। আমার ওখানে মাস খানিক ও ছিলো পরে আমার অনুমতি নিয়ে কোথায় যে চলে গেল মেয়েটা।মাঝে মাঝে ফোন করে খোঁজ নেয় কিন্তু সেটা বিভিন্ন নম্বর থেকে।মানে আমাদের ওকে ধরা সম্ভব না। একবার শুনেছিলাম একটা বাচ্চাদের কলেজে পড়ায়। বলেছিলো গরীব বাচ্চাদের জন্য একটা কলেজ ও খুলবে।তারপর আর অনেক দিন যোগাযোগ নেই।
ডাঃ সেনের কথা শেষ হতেই অমিত রাস্তাতে বসে কেঁদে ফেললো শব্দ করে।ছোট্ট অঞ্জলী বাপিকে কাঁদতে দেখে বাপির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো কি হয়েছে বাপি তোমার? কাঁদছো কেন তুমি?মা বাপি কাঁদছে কেন? অমিত নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো কই আমি কাঁদছিনা তো মা। আমি কাঁদবো কেন আমার অঞ্জু থাকতে।,,,মেয়ে কোলে তুলে নিয়ে শক্ত করে জরিয়ে ধরলো।ছোট্ট অঞ্জলী বাপির কোলে মুখ গুজে বললো,,বুঝেছি তুমি অন্য অঞ্জলীর জন্য কাঁদছো! কিন্তু শুধু অঞ্জলী নয়,আমিও তোমাকে আর অঞ্জলীকে ভালবাসি বাপি।ছোট্ট মেয়ের মুখে এ কথা শুনে অমিতের সারা শরীর কেঁপে উঠলো,বুকের মাঝের ব্যথাটা যেন তরল হয়ে আবারও চোখ দিয়ে বেড়িয়ে আসলো। শুধু মনে মনে বললো আমিও অঞ্জলী আর তোমাকে ভালবাসি ঠাকুমা। দুজন দুরে থেকেও আমাকে এখনো আগলে রাখছো।
নিজের চোখের জল মুছে মেয়েকে কোলে নিয়ে এক হাত দিয়ে ম্যাগীর হাত ধরে সামনের দিকে পা বাঁড়ালো বিদ্রোহী রাজকুমার।।
***************সমাপ্ত************
""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !!