19-12-2020, 02:42 PM
কি বিশাল ছিলো একসময় এই মিয়াঁ বাড়ি । আর এখন , নিজেকে একটু একটু অপরাধী মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে জীর্ণ বাড়িটা রাগে চুপ করে আছে কিছু বলছেনা , বুকের জমানো ব্যাথা গুলি নিয়ে আমার কাছ থেকে মুখে ফিরিয়ে রেখেছে । বোবা কান্নায় বুঝিয়ে দিতে চাইছে তার এই দশার জন্য একমাত্র আমিই দায়ী । হঠাত করে তিরিশ বছর পর বাড়িটাকে খুব আপন বলে মনে হচ্ছে । মনে হচ্ছে আমি নিজের খুব আপন একজন কে অনেকদিন আগে ফেলে গিয়েছিলাম আজ হঠাত তাকে রাস্তায় জীর্ণশীর্ণ অবস্থায় খুঁজে পেয়েছি । বাড়িটাকে দেখে আমার বুকটা তেমনি করে হু হু করে উঠলো যেমনটা ত্রিশ বছর আগে একে ছেড়ে যাওয়ার সময় হয়েছিলো । যদিও পুরনো কেউই আর নেই তবুও বাড়িটা তো আছে , আর আছে সেই পুরনো সব প্রিয় মানুষ গুলর সৃতি । জীর্ণ বাড়িটি এখনো দাড়িয়ে আছে সেই সব প্রিয় সৃতি গুলর এ্যালবাম হয়ে ।
এখনো মনে পড়ে সেই দিনটি যেদিন আমি জানতে পেরেছিলাম এই বাড়ি ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে । আমার বাবা খুব ছোট বেলা থেকেই বাইরে থেকে পড়াশুনা করায় এই বাড়ির প্রতি তার তেমন কোন মায়া ছিলো না । বরং এই গ্রাম্য পরিবেশ থেকে দূরে থকার জন্য সে সবসময় হাঁসফাঁশ করতো । নিজে শহরে থাকতো সেখানে ব্যাবসা করতো । মাসে এক সপ্তাহের জন্য গ্রামে আসতো । কিন্তু বাবা এই এক সপ্তার জন্য ও এই গ্রাম কে সহ্য করতে পারতেন না । উনি চাইতেন আমাকে আর মা কে শহরে নিয়ে যেতে । কিন্তু পারতেন না আমার দাদাজান এর জন্য । আমার দাদাজান এর সাথে বাবার প্রায় এই নিয়ে কথা কাটাকাটি হতো । নাহ ঝগড়া নয় মিয়াঁ বাড়ির ছোটরা কখনই বড় দের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলতো না । তাই বাবা প্রায় দাদাজান কে অনুরোধ করতেন আমাদের শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য । কিন্তু দাদাজান কিছুতেই রাজি ছিলেন না । বলতেন “তোমার সমস্যা হলে তুমি ওখানে আর একটা বিয়ে করে নাও । কিন্তু আমার ছেলের বউ আর নাতি এই বাড়ির বাইরে যাবে না ।
যদিও মিয়াঁ বাড়িতে একাধিক বিয়ে করা তেমন কোন ব্যাপার ছিলো না তবুও আমার বাবা আর তৃতীয় বিয়ে করেন নি । অপেক্ষা করেছিলেন নিজের বাবার শেষ সময়ের জন্য । হ্যাঁ দাদাজান এর মৃত্যুর এক সপ্তার মাঝেই বাবা ঘোষণা করেছিলেন এই বাড়িতে আমাদের আর থাকা চলবে না । প্রতিবাদ করার বয়স ও সাহস কোনটাই আমার ছিলো না । তবে খুব কান্না পেয়েছিলো , আর সে কান্না আমি চেপে রাখিনি কেঁদেছিলাম সবার চোখের আড়ালে । সুধু একজন দেখেছিলো সেই কান্না সে ছিলো রাবু । এ বাড়ির এক আশ্রিতের মেয়ে ।
আমি বাদে অন্য আর একজন ছিলো যার চোখের জলেও সিক্ত হয়েছিলো এ বাড়ির উঠান , আমার মা । বাবা কে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলেছিলো তাকে যেন এই বাড়ি থেকে দূরে না নিয়ে যায় । কিন্তু কোন কাজ হয়নি । মিয়াঁ বাড়ির বউরা সুন্দর পুতুল এর চেয়ে বেশি কিছু নয় । যাদের কাজ সুধু সোভা বর্ধন এবং মনোরঞ্জন । মায়ের শত কান্নাভেজা অনুরধ গুলো বৃথা করে দিয়ে দাদাজানের চল্লিশার দিন আমারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই ।
আশা ছিলো অন্তত কিছুদিন পড়পড় এসে ঘুরে যেতে পারবো । কিন্তু সে আশাও আঁতুড় ঘরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো । ঢাকা গিয়েই আমারা জানতে পেরেছিলাম । আমারা ঢাকাও থাকছি না । আমারা চলে গেলাম স্পেন সেখান থেকে সপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র । যার জাকজমক এর কাছে মিয়াঁ বাড়ি কিছুই না । আর সেই জাঁকজমক অল্পদিনেই আমার কচি মন থেকে মিয়াঁ বাড়ি আর এই গ্রামে ফেলে যাওয়া মানুষ গুলির সৃতির উপর অন্ধকার একটি পর্দা টানিয়ে দিয়েছিলো । কিন্তু মায়ের উপর কোন আসর পরেনি মা কিছুতেই ভুলতে পারেনি তার প্রিয় বাড়ি কে । অবশ্য বেশিদিন মা কে সহ্য করতে হয়নি , মাত্র তিন বছর বেঁচে ছিলেন মা । অবশ্য একটা দুঃখ আমাকে সব সময় কুরেকুরে খায় সেটা হলো মায়ের কবর ওখানে হওয়া ।
“ ছোট মিয়াঁ খারাইয়া রইলেন যে বহেন না , কত দূর থাইকা আইসেন , হের উপরে ঐ ঝুমা বান্দিটা আপনেরে কতক্ষণ বাইরে খাড়া করাইয়া রাখসে কে জানে “
আজমত চাচার কথা শুনে ধ্যান ভাংলো , বললাম
“ কোন সমস্যা নেই চাচা , চার ঘণ্টা তো বাসে বসেই ছিলাম এখন দাড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে । “
“ কি দেখেন ছোট মিয়াঁ , বাড়ির অবস্থা তো , আমি জতদিন পারসি বাড়ির জৌলুশ নষ্ট হইতে দেই নাই , এহন আর পারি না বয়স হইসে তার উপর ভিলেজ পলিটিক্স এ পইড়া গেসিলাম , আমারে কিন্তু দোষ দিয়েন না । হ একটা অন্যায় আমি করসি ছোট মিয়াঁ সেইটা হইলো আপনের কাছ থাইকা টেকা আইন্না বাড়ির কাম করিনাই । কিন্তু বিশ্বাস করেন সেইটা আমি মিয়াঁ বাড়ির ভালার লইগাই করসি । দোকান ঘর গুলা উঠলে বাড়ির দশাও একটু বদলাইবো “
কথা গুলি একনাগাড়ে বলে একটু থামল আজমল চাচা । কি বলবো বুঝতে পারছি না , ওনার সাথে কি আমার এক মোট পোষণ করে কিছু বলা উচিৎ , উনি সত্যি সত্যি আমার কাছ থেকে টাকা এনে বাড়ির কাজে না খরচ করে লজ্জা বোধ করছেন কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না। তাই চুপ থকাই শ্রেয় মনে করলাম । কিন্তু আজমল চাচা থামলেন না ।
“ বুজলেন ছোট মিয়াঁ , হইতে পারি আমি এই বাড়ির কেউ না । কিন্তু আমার নাড়ি ও এই বারিতেই পোতা । হেইর লইগা এই বাড়ির লইগা জানের চাইতেও বেশি মায়া লাগে । ১৫ বচ্ছর টানা চেরমেন আসিলাম আমি । বাড়িটারে গেরামটারে ঠিক অমনেই চালাইসি যেমনে আপনের দাদাজান চালাইতো । কিন্তু ঐ ফকিরনীর পোলারা পলিটিক্স করলো আমার লগে । জেইলে পাঠাইল আমারে তার পর এই অবস্থা। তিনটা মানুষ আমারা আর কতোটুক জায়গা লাগে । পুরা বাড়ি জঙ্গল হইয়া পইড়া রইসে “
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো আজমল চাচার , মনে হচ্ছে এই বাড়িটাকে সত্য ওনার কিছু মায়া আছে । আর না হওয়ার কারন ও আমি দেখি না জন্ম থেকেই এই মিয়াঁ বাড়ি আছেন ।
“আচ্ছা চাচা ঐ দিকে একটা ঘর ছিলো না “
বাড়ির পূর্ব দিকে যেখানে লতানো জংলা গাছের একটি জঙ্গল তৈরি হয়েছে সেদিকে ইশারা করে বললাম আমি । শেষের দিকে ঐ ঘরটা আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলো । দিনে একবার হলেও ঐ ঘরে আমি যেতাম । একা নয়, এই আজমল চাচারই মেয়ে রাবেয়ার সাথে ।
“ কোন ঘর এর কথা বলছেন ? ঐ গুদাম ঘরের কথা ? নাহ ঘর আর নাই । একবার ঝর হইলো তখন ভাইঙ্গা গেসে । হের পর আর নতুন কইরা ঐ ঘর বানানোর দরকার হয় নাই “
“ আচ্ছা কাকা রাবু কোথায় , রাবুর মেয়ে এখানে থাকে আর রাবু কই “
“ মাইয়া আমার আর বাইচ্চা নাই ছোট মিয়াঁ , পোড়া কোপালি আসিলো , আপনেরা চইলা যাওয়ার মাস দুই এর মইদ্ধে বিয়া দিয়ে দিসিলো আব্বায় , আর বিয়ার দুই বচ্ছর পর স্বামী হারায় এর পর আমার কাছেই থাকতো । কিন্তু কি রোগ যে হইলো কোন ডাক্তার ধরতে পারলো না। শেষে মাইয়া আমার মইরা গেলো । “
বুকের ভেতর একটা মোচর অনুভব করলাম , রাবুর মৃত্যু সংবাদ শুনে । আমার অবশ্য আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো রাবু আর নেই । ও বেঁচে থাকলে ওর মেয়ের এ বাড়িতে সন্তান সহ থকার কথা না । জীবনে অনেক মেয়ে দেখছি নানা দেশের নানা রঙ এর কিন্তু গ্রাম্য মেয়ে রাবুর মত কোন মেয়ে আমি আজো দেখিনি । যেমনি সুন্দরী ছিলো তেমনি আকর্ষণীয় ছিলো ওর চাল চলন । ওকে দেখে মনে হতো ভুল সময়ে ভুল যায়গায় জন্ম হয়েছিলো ওর । আজকালের অনেক উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের চেয়ে রাবু ছিলো অনেক এগিয়ে । সব সময় হাঁসি খুসি থাকতো মেয়েটা , ও যেখানেই থাকতো ওখানটায় পজেটিভ একটা আলোতে আলোকিত হয়ে যেত । তখনকার অন্য মেয়েদের মতো অন্ধকার জরানো ছিলো না রাবুর মন মননে । এর জন্য অবশ্য ওকে নানা রকম কটু কথা শুনতে হতো । কিন্তু ওসব কিছুই রাবুর আলো ঝকঝকে মানসিকতার উপর ছায়া ফেলতে পারেনি । পাগলী ছিলো একটা ।
“ ঘর ঠিক হইসে নানাজান , ওনারে নিয়া আসেন । আমি পানি নিয়া আসি গোসলের লইগা । “
“ ঐ ছেমড়ি সাবধানে কথা ক , ওনারে কি? ওনারে কি ? হুজুর কবি বুঝছস “
“ ঐসব হুজুর টুজুর আমি কইতে পারুম না আপনের ইচ্ছা হইলে আপনে কন “ এই বলেই মেয়েটা চলে গলো কোমরে আচল গুজতে গুজতে ।
মেয়েটাকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি , কেমন ঝাঝালো এর কথা বার্তা , হ্যাঁ বাবুর চেয়ে অনেক বেশি । রাবু নিজেও অনেকটা এমন ছিলো নিয়ম কানুনের তেমন ধার ধারত না নিজের ইচ্ছে মতন চলতো । আমাদের মিয়াঁ বাড়ির কড়া শাসনের তোয়াক্কা না করে দিব্বি ঘুরে বেড়াতো । আর ওর ঐ ব্যাপারটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করতো ।
“ চলেন ছোট মিয়াঁ , আপনেরে ঘরে লইয়া যাই “
এখনো মনে পড়ে সেই দিনটি যেদিন আমি জানতে পেরেছিলাম এই বাড়ি ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে । আমার বাবা খুব ছোট বেলা থেকেই বাইরে থেকে পড়াশুনা করায় এই বাড়ির প্রতি তার তেমন কোন মায়া ছিলো না । বরং এই গ্রাম্য পরিবেশ থেকে দূরে থকার জন্য সে সবসময় হাঁসফাঁশ করতো । নিজে শহরে থাকতো সেখানে ব্যাবসা করতো । মাসে এক সপ্তাহের জন্য গ্রামে আসতো । কিন্তু বাবা এই এক সপ্তার জন্য ও এই গ্রাম কে সহ্য করতে পারতেন না । উনি চাইতেন আমাকে আর মা কে শহরে নিয়ে যেতে । কিন্তু পারতেন না আমার দাদাজান এর জন্য । আমার দাদাজান এর সাথে বাবার প্রায় এই নিয়ে কথা কাটাকাটি হতো । নাহ ঝগড়া নয় মিয়াঁ বাড়ির ছোটরা কখনই বড় দের সাথে উচ্চ স্বরে কথা বলতো না । তাই বাবা প্রায় দাদাজান কে অনুরোধ করতেন আমাদের শহরে নিয়ে যাওয়ার জন্য । কিন্তু দাদাজান কিছুতেই রাজি ছিলেন না । বলতেন “তোমার সমস্যা হলে তুমি ওখানে আর একটা বিয়ে করে নাও । কিন্তু আমার ছেলের বউ আর নাতি এই বাড়ির বাইরে যাবে না ।
যদিও মিয়াঁ বাড়িতে একাধিক বিয়ে করা তেমন কোন ব্যাপার ছিলো না তবুও আমার বাবা আর তৃতীয় বিয়ে করেন নি । অপেক্ষা করেছিলেন নিজের বাবার শেষ সময়ের জন্য । হ্যাঁ দাদাজান এর মৃত্যুর এক সপ্তার মাঝেই বাবা ঘোষণা করেছিলেন এই বাড়িতে আমাদের আর থাকা চলবে না । প্রতিবাদ করার বয়স ও সাহস কোনটাই আমার ছিলো না । তবে খুব কান্না পেয়েছিলো , আর সে কান্না আমি চেপে রাখিনি কেঁদেছিলাম সবার চোখের আড়ালে । সুধু একজন দেখেছিলো সেই কান্না সে ছিলো রাবু । এ বাড়ির এক আশ্রিতের মেয়ে ।
আমি বাদে অন্য আর একজন ছিলো যার চোখের জলেও সিক্ত হয়েছিলো এ বাড়ির উঠান , আমার মা । বাবা কে অনেক অনুনয় বিনয় করে বলেছিলো তাকে যেন এই বাড়ি থেকে দূরে না নিয়ে যায় । কিন্তু কোন কাজ হয়নি । মিয়াঁ বাড়ির বউরা সুন্দর পুতুল এর চেয়ে বেশি কিছু নয় । যাদের কাজ সুধু সোভা বর্ধন এবং মনোরঞ্জন । মায়ের শত কান্নাভেজা অনুরধ গুলো বৃথা করে দিয়ে দাদাজানের চল্লিশার দিন আমারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই ।
আশা ছিলো অন্তত কিছুদিন পড়পড় এসে ঘুরে যেতে পারবো । কিন্তু সে আশাও আঁতুড় ঘরেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলো । ঢাকা গিয়েই আমারা জানতে পেরেছিলাম । আমারা ঢাকাও থাকছি না । আমারা চলে গেলাম স্পেন সেখান থেকে সপ্নের দেশ যুক্তরাষ্ট্র । যার জাকজমক এর কাছে মিয়াঁ বাড়ি কিছুই না । আর সেই জাঁকজমক অল্পদিনেই আমার কচি মন থেকে মিয়াঁ বাড়ি আর এই গ্রামে ফেলে যাওয়া মানুষ গুলির সৃতির উপর অন্ধকার একটি পর্দা টানিয়ে দিয়েছিলো । কিন্তু মায়ের উপর কোন আসর পরেনি মা কিছুতেই ভুলতে পারেনি তার প্রিয় বাড়ি কে । অবশ্য বেশিদিন মা কে সহ্য করতে হয়নি , মাত্র তিন বছর বেঁচে ছিলেন মা । অবশ্য একটা দুঃখ আমাকে সব সময় কুরেকুরে খায় সেটা হলো মায়ের কবর ওখানে হওয়া ।
“ ছোট মিয়াঁ খারাইয়া রইলেন যে বহেন না , কত দূর থাইকা আইসেন , হের উপরে ঐ ঝুমা বান্দিটা আপনেরে কতক্ষণ বাইরে খাড়া করাইয়া রাখসে কে জানে “
আজমত চাচার কথা শুনে ধ্যান ভাংলো , বললাম
“ কোন সমস্যা নেই চাচা , চার ঘণ্টা তো বাসে বসেই ছিলাম এখন দাড়িয়ে থাকতেই ভালো লাগছে । “
“ কি দেখেন ছোট মিয়াঁ , বাড়ির অবস্থা তো , আমি জতদিন পারসি বাড়ির জৌলুশ নষ্ট হইতে দেই নাই , এহন আর পারি না বয়স হইসে তার উপর ভিলেজ পলিটিক্স এ পইড়া গেসিলাম , আমারে কিন্তু দোষ দিয়েন না । হ একটা অন্যায় আমি করসি ছোট মিয়াঁ সেইটা হইলো আপনের কাছ থাইকা টেকা আইন্না বাড়ির কাম করিনাই । কিন্তু বিশ্বাস করেন সেইটা আমি মিয়াঁ বাড়ির ভালার লইগাই করসি । দোকান ঘর গুলা উঠলে বাড়ির দশাও একটু বদলাইবো “
কথা গুলি একনাগাড়ে বলে একটু থামল আজমল চাচা । কি বলবো বুঝতে পারছি না , ওনার সাথে কি আমার এক মোট পোষণ করে কিছু বলা উচিৎ , উনি সত্যি সত্যি আমার কাছ থেকে টাকা এনে বাড়ির কাজে না খরচ করে লজ্জা বোধ করছেন কিনা সেটাও বুঝতে পারছি না। তাই চুপ থকাই শ্রেয় মনে করলাম । কিন্তু আজমল চাচা থামলেন না ।
“ বুজলেন ছোট মিয়াঁ , হইতে পারি আমি এই বাড়ির কেউ না । কিন্তু আমার নাড়ি ও এই বারিতেই পোতা । হেইর লইগা এই বাড়ির লইগা জানের চাইতেও বেশি মায়া লাগে । ১৫ বচ্ছর টানা চেরমেন আসিলাম আমি । বাড়িটারে গেরামটারে ঠিক অমনেই চালাইসি যেমনে আপনের দাদাজান চালাইতো । কিন্তু ঐ ফকিরনীর পোলারা পলিটিক্স করলো আমার লগে । জেইলে পাঠাইল আমারে তার পর এই অবস্থা। তিনটা মানুষ আমারা আর কতোটুক জায়গা লাগে । পুরা বাড়ি জঙ্গল হইয়া পইড়া রইসে “
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো আজমল চাচার , মনে হচ্ছে এই বাড়িটাকে সত্য ওনার কিছু মায়া আছে । আর না হওয়ার কারন ও আমি দেখি না জন্ম থেকেই এই মিয়াঁ বাড়ি আছেন ।
“আচ্ছা চাচা ঐ দিকে একটা ঘর ছিলো না “
বাড়ির পূর্ব দিকে যেখানে লতানো জংলা গাছের একটি জঙ্গল তৈরি হয়েছে সেদিকে ইশারা করে বললাম আমি । শেষের দিকে ঐ ঘরটা আমার খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলো । দিনে একবার হলেও ঐ ঘরে আমি যেতাম । একা নয়, এই আজমল চাচারই মেয়ে রাবেয়ার সাথে ।
“ কোন ঘর এর কথা বলছেন ? ঐ গুদাম ঘরের কথা ? নাহ ঘর আর নাই । একবার ঝর হইলো তখন ভাইঙ্গা গেসে । হের পর আর নতুন কইরা ঐ ঘর বানানোর দরকার হয় নাই “
“ আচ্ছা কাকা রাবু কোথায় , রাবুর মেয়ে এখানে থাকে আর রাবু কই “
“ মাইয়া আমার আর বাইচ্চা নাই ছোট মিয়াঁ , পোড়া কোপালি আসিলো , আপনেরা চইলা যাওয়ার মাস দুই এর মইদ্ধে বিয়া দিয়ে দিসিলো আব্বায় , আর বিয়ার দুই বচ্ছর পর স্বামী হারায় এর পর আমার কাছেই থাকতো । কিন্তু কি রোগ যে হইলো কোন ডাক্তার ধরতে পারলো না। শেষে মাইয়া আমার মইরা গেলো । “
বুকের ভেতর একটা মোচর অনুভব করলাম , রাবুর মৃত্যু সংবাদ শুনে । আমার অবশ্য আগেই বোঝা উচিৎ ছিলো রাবু আর নেই । ও বেঁচে থাকলে ওর মেয়ের এ বাড়িতে সন্তান সহ থকার কথা না । জীবনে অনেক মেয়ে দেখছি নানা দেশের নানা রঙ এর কিন্তু গ্রাম্য মেয়ে রাবুর মত কোন মেয়ে আমি আজো দেখিনি । যেমনি সুন্দরী ছিলো তেমনি আকর্ষণীয় ছিলো ওর চাল চলন । ওকে দেখে মনে হতো ভুল সময়ে ভুল যায়গায় জন্ম হয়েছিলো ওর । আজকালের অনেক উচ্চ শিক্ষিত মেয়েদের চেয়ে রাবু ছিলো অনেক এগিয়ে । সব সময় হাঁসি খুসি থাকতো মেয়েটা , ও যেখানেই থাকতো ওখানটায় পজেটিভ একটা আলোতে আলোকিত হয়ে যেত । তখনকার অন্য মেয়েদের মতো অন্ধকার জরানো ছিলো না রাবুর মন মননে । এর জন্য অবশ্য ওকে নানা রকম কটু কথা শুনতে হতো । কিন্তু ওসব কিছুই রাবুর আলো ঝকঝকে মানসিকতার উপর ছায়া ফেলতে পারেনি । পাগলী ছিলো একটা ।
“ ঘর ঠিক হইসে নানাজান , ওনারে নিয়া আসেন । আমি পানি নিয়া আসি গোসলের লইগা । “
“ ঐ ছেমড়ি সাবধানে কথা ক , ওনারে কি? ওনারে কি ? হুজুর কবি বুঝছস “
“ ঐসব হুজুর টুজুর আমি কইতে পারুম না আপনের ইচ্ছা হইলে আপনে কন “ এই বলেই মেয়েটা চলে গলো কোমরে আচল গুজতে গুজতে ।
মেয়েটাকে দেখছি আর অবাক হচ্ছি , কেমন ঝাঝালো এর কথা বার্তা , হ্যাঁ বাবুর চেয়ে অনেক বেশি । রাবু নিজেও অনেকটা এমন ছিলো নিয়ম কানুনের তেমন ধার ধারত না নিজের ইচ্ছে মতন চলতো । আমাদের মিয়াঁ বাড়ির কড়া শাসনের তোয়াক্কা না করে দিব্বি ঘুরে বেড়াতো । আর ওর ঐ ব্যাপারটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করতো ।
“ চলেন ছোট মিয়াঁ , আপনেরে ঘরে লইয়া যাই “