12-12-2020, 12:56 PM
এক বারবনিতার গল্প
Written By Lekhak (লেখক)
রোজ বিকেলে এমনভাবে সেজেগুজে পার্ক স্ট্রীটের পোষ্ট অফিসের ঠিক সামনেটায় দাঁড়িয়ে থাকে রীতু। শহরের এক ডাকসাইটে বেশ্যা। নিন্দুকেরা বলে থাকে, রীতু নাকি তার শরীরের প্রলোভনে অনেক মানুষকে ভেড়া বানাতে পারে। নিয়মিত খদ্দেরদের তালিকায় সমাজের নামী দামী উঠতি বড়লোকদের পাশাপাশি বেশ কিছু মস্তানও ভীড় জমিয়েছে। আশেপাশে যারা সেইসব শরীর সোহাগিনীর দল, তারা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে ভাবে, কি আছে রীতুর শরীরে, যা তাদের নেই।
রীতু যেন বসরার এক রক্তগোলাপ। তাই তো রাত্রি যখন গভীর থেকে গভীরতর হয়, যখন শেঠ হরিভাইয়ের পানের দোকানে রাত পিয়াসী বাবুদের আনাগোনা বাড়তে থাকে, তখনও রীতুর মেহফিল থেকে নুপুরের শব্দ উধাও হয় না মাঝ আকাশে। তখনও তারস্বরে বাজতে থাকে তার স্টিরিওতে চটুল হিন্দী গানের সুর। আর সেই গানের তালে তালে রীতু তার ল্যাংটো শরীরটাকে ঘরজোড়া আয়নার সামনে মেলে ধরে। নেচে চলে সর্পিনীর মত। কখনো বা তার নাচের মুদ্রায় করিশমার আভাস ধরা পড়ে। আবার কখনো তার চোখের বাণে মাধুরীর চাউনি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সত্যি নাচতে পারে সে। নাচের তালে তালে যে কোন পুরুষচিত্ত জ্বালাতে পারে কামনার দাউদাউ আগুন। মাথার ওপর গোবলেটে ছলাক ছলাক নেচে যায় বীয়ার অথবা হুইস্কি। এতটুকু স্থানচ্যুত হয় না মেয়েটি। কি আশ্চর্য অনুশীলনে রীতু রপ্ত করেছে ছেনালীপনার এইসব আশ্চর্য গুনাবলীকে। তা দেখতেই তার বারমহলে ভিড় জমায় নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা পুরুষ মৌমাছির দল। উপচে পড়ে টাকা। আর রীতুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফুলে ফেঁপে ওঠে।
কিন্তু রীতু কেন এই অবেলায় দাঁড়িয়ে আছে পোষ্ট অফিসের সামনে?
অনেকদিন ধরেই এইভাবে তারই অপেক্ষাতে মগ্ন ছিল রীতু। কিন্তু দেখা হয় নি তার সাথে। একটা হতাশা এসে শেষ পর্যন্ত আচ্ছন্ন করেছে তার সমস্ত শরীর। ক্লান্ত পায়ে পার্কস্ট্রীট থেকে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ পার হয়ে ফিরে গেছে সে তার গোপণ ডেরাতে।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসন্ন সান্ধ্য উৎসবের জন্য নিজেকে প্রসাধনে রঞ্জিতা করতে করতে রীতু ভেবেছে, এ জীবনে বোধহয় তার সাথে আর দেখা হবে না। কিন্তু সেকী ভুলতে পারে তাকে? ঠিক তখনই খুলতে থাকা উলের গোলার মত অনেক স্মৃতি এসে ভরিয়ে দিয়েছে তার মনের আকাশ।
সেই যে কবে প্রথম দেখা হয়েছিল তার সাথে। প্রসেনজিতদা। অপরিচয়ের নিষেধ পার হয়ে অচিরেই মানুষটি হয়ে উঠেছিল তার একান্ত আপনজন। এমন তো কত খদ্দেরই আসে। জিভ থেকে লালা ঝরিয়ে তার যৌবনবতী দেহের এখানে ওখানে দংশন দিতে থাকে। তাদের কেউ কেউ স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, রীতুর দেহে রেখে যায় ভালোবাসার সংরাগী চিহ্ন। কিন্তু প্রসেনজিতদা?
রীতুর মনে হয়েছিল, প্রসেনজিতদার সাথে মিলনের শেষতম মূহুর্ত যদি আরো একবার জীবনে ফিরে পেত সে? তাহলে প্রসেনজিতদাকেই করতো তার ইহজীবনের পথচলার সাথী। কিন্তু তাতো আর হওয়ার নয়। কথায় কথায় প্রসেনজিতদা জানিয়েছিল তার ইতিহাস। কলকাতার এক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সে। স্ত্রী আর সন্তান নিয়ে জমজমাট সংসার। তবুও দেহের টানে মাঝে মাঝে সে পা রাখে এই নিষিদ্ধ প্রান্তরে। এর এভাবেই কাটা ঘুড়ির মত উড়তে উড়তে একদিন গোত্তা খেয়ে পড়েছিল রীতুর ছাদের কার্ণিসে।
দেখা হয়ে গেল অবশেষে। রোজই যেমন দাঁড়িয়ে থাকে রীতু। তেমনই ছিল অপেক্ষাতে। পার্কস্ট্রীটের পোষ্টঅফিসের সামনে। তারপর পায়ে হেঁটে হেঁটে ফিরছে নিজের ডেরাতে। হঠাৎই চোখ পড়ল রীতুর। ওই তো প্রসেনজিতদা। কোথায় ছিলে এতদিন তুমি আমাকে ভুলে?
দীর্ঘ ছমাস দেখা হয়নি। প্রসেনজিতদা যেন আপনভোলা। যখন আসে সঙ্গে বয়ে আনে টাটকা তাজা বাসন্তি বাতাস। যখন চলে যায়, তার আর ফিরে আসার সময় থাকে না।
রীতুর সঙ্গে চোখে চোখে মিলন হল। রীতু যেন আজ আর কিছুতেই প্রসেনজিতদাকে ছাড়বে না। মনের মধ্যে অনেক না বলা কথা জমে আছে। কার কাছে বলবে সে? প্রসেনজিতদাকে বলে, এসো প্রসেনজিতদা, আমার পিছু পিছু এসো।
রীতুকে অনুসরণ করতে করতে প্রসেনজিত পৌঁছে যায় তার সাজানো ঘরে। রীতু বলে এতদিন আমাকে ভুলে ছিলে প্রসেনজিতদা?
প্রসেনজিত সিগারেটের ধোঁয়া ওড়ায়। কবজি উল্টে ঘড়িতে সময় দেখে নেয়। তার সমস্ত শরীরে ক্লান্তির সামান্য ছায়া। থির থির করে কাঁপছে। বলে শুকনো গলায়, রীতু অফিসের কাজে হঠাৎ শিলিগুড়িতে বদলি হয়ে গিয়েছিলাম। তিনদিন হল কলকাতায় ফিরেছি। এসেই তোমার কথা মনে হয়েছে। তুমি না এলেও আমি আসতাম। সত্যি।
এবার একটু স্ফুরিত হয়েছে রীতুর দুটি ওষ্ঠ সামান্য বুক চাপা অভিমানে। তবুও সে জানে তারমত ছেনালী মেয়েমানুষের অভিধানে এসব শব্দেরা কবে উধাও হয়ে গেছে।
-কেমন আছো বলো?
প্রসেনজিত জানতে চায়। গলাতে ফিরে এসেছে সেই পুরোন আন্তরিকতার স্বর। এই রীতুকে নিয়ে কত খেলাই সে করেছিল একসময়। খেলা শব্দটার প্রতি যদিও তার প্রচন্ড অনীহা। কিন্তু এছাড়া আর কি-ই বা বলতে পারে সে তার এহেন আচরণটাকে। রীতুকে শিক্ষিত করে তুলবে। ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্টও খুলেছিল তার নামে। নিয়মিত তাকে নিয়ে যেত কলকাতার নামকরা জিমনাসিয়ামে। সাউথ ক্যালকাটা সুইমিং পুলেও তাকে করে দিয়েছিল সদস্য। রীতুকে নিয়ে অনেক স্বপ্নের জাল বুনেছিল প্রসেনজিত বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু যখন ফুরিয়ে গেছে তার স্বপ্ন।
ভেবেছে সে এইভাবেই কোন বারবনিতাকে বোধহয় পৃথিবীর আলোক সরণীর অভিযাত্রিণী করা সম্ভব নয়। যে জীবন তারা বেছে নিয়েছে। একেবারেই সেই জীবনে অন্ধ বিবরেই সময় কাটবে তাদের।
তবুও পরাজয়টা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল প্রসেনজিতের। প্রফেশনাল মানুষ যারা, এই প্রসেনজিতের মতন। জীবনের প্রতিটি মূহূর্তকে সফলতার নিক্তিতে বিচার করে। যখন বুঝতে পারলো তার অবশ্যম্ভাবী হতাশার মূহূর্তগুলি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। তখন ইচ্ছে করেই সরে গিয়েছিল রীতুর জীবন থেকে। হয়তো আর কোনদিনই সে পা রাখত না এই নীড়ে। অথবা হয়তো কোন একদিন কোন আবেগী মূহূর্তে তার দেখা হত রীতুর সাথে। রীতুকে বলত, ভাল আছো রীতু?
প্রসেনজিত তখন চলে গিয়েও প্রতিশ্রুতি রেখে গিয়েছিল। রীতুর নামে ব্যাঙ্কে নিয়মিত টাকা জমা করত সে। মাঝে মাঝে একটু খোঁজ খবর নেওয়া, রীতু নিয়মিত সুইমিং ক্লাবে যাচ্ছে কিনা? বেশীর ভাগ সময়ই কিন্তু রীতু যেত না। জিমন্যাসিয়ামের মাষ্টারমশাই প্রসেনজিতের কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল। তিনি আসলে রীতুর আসল পরিচয়টা জানেন না। প্রসেনজিত আর খোঁজ খবর নেয় নি। জানে, রীতুর জীবনটা এমন ভাবে জড়িয়ে গেছে নানা কাজের সাথে। বাইরে যাবার ফুরসত সে পাবে কি করে?
হয়তো আগের দিন সারারাত চলেছিল বেহিসাবী উন্মাদনা। পাকস্থলীতে আলোড়ণ তুলেছিল কোন দেশী মদের বিষ। তারই আনুষাঙ্গিক ক্রিয়াতে রীতু হয়ে গেছে এখন আচ্ছন্ন। হয়তো এখান থেকে যাওয়ার আগে হাজির হয়েছিল কোন রইস আদমী। পকেট ভর্তি টাকার ঝনঝনানি শুনতে শুনতে রীতু ভুলে গেছে তার ক্লাসে যাবার কথা।
এ জীবন তার নিজস্ব খাতেই বইতে থাকে। এ জীবনের সাথে অন্যজীবনের ভাব ভালোবাসা হয় না, হতে পারে না কোনমতেই।
এই সরল সত্যিটা উপলব্ধি করার সাথে সাথেই প্রসেনজিত নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিল রীতুর জীবন থেকে। আজ অনেক দিন বাদে, সেই পরিচিত খাটে বসে, ঐ অনিন্দ্য সুন্দরী রূপসী মুখের দিকে তাকিয়ে প্রসেনজিতের মনের আকাশে অনেক স্মৃতির চিল উড়তে থাকে। রীতুর সঙ্গে প্রথম দেখা। শরীরে শরীর রেখে ভালবাসার মূহূর্তগুলোকে ভাগ করা। রীতুর হাতে হাত রেখে হেঁটে যাওয়া। দীঘা অথবা চাঁদিপুরের সমুদ্রবেলায়, সব ছবিগুলোই আবার যেন ফিরে আসছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে মন। পাল্টে গেছে পরিবেশ। বেশ কয়েকবার পৃথিবী ঘুরেছে নিজের অক্ষের ওপর।
রীতু বলল, প্রসেনজিতদা, তুমি আমার ওপর রাগ করেছো? কি করবো বলো? আমি এমন একটা ঘৃণিত বিকৃত জীবনের বাসিন্দা যে তোমার দেওয়া আলোর পরশ আমি ধরে রাখতে পারলাম না।
বলতে বলতে চোখের জলে ভাসিয়ে রীতু কেঁদে ফেললো। এই মূহুর্তটির জন্য নিজেকে সে অনেক্ষণ ধরে অভিমানী সজ্জ্বাতে সাজিয়েছিলো। আজ প্রসেনজিতদা তার সামনে বসে আছে। অথচ তার সমস্ত শরীর জুড়ে কেঁপে ওঠা এক আশ্চর্য উদাসীনতা। রীতু লক্ষ্য করেছে। নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে সে আরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।
ঘরের দরজা বন্ধ। পাশের ঘরের হৈ হুল্লোরের শব্দ ভেসে আসছে। প্রসেনজিত নিস্পৃহ হয়ে তাকিয়ে আছে রীতুর দিকে। দেখছে তার কান্নায় ফুলে ওঠা শরীর। পাশের ঘরে যারা আছে তারা জানে না এই বন্ধ ঘরের ভেতর এখন এক বিয়োগান্ত নাটকের করুন দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। এরকম কত বারবণিতাই তো সমাজের এধারে ওধারে ছিটিয়ে রয়েছে রীতুর মত। হয়তো তাদের জীবনেও প্রসেনজিতদার মতন কেউ এসেছিল। ভালোবাসার মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত হারাতে হয়েছে নিজের ভাগ্য দোষে।
আজ যেন এত কেঁদেও রীতুর দোষ কাটল না। শেষ পর্যন্ত ওর হাতটা ধরে প্রসেনজিত বলল, যদি পারো আমাকে ভুলে যেও রীতু। মনে করো তোমার জীবনে প্রসেনজিত বলে কেউ আসেনি। আর আসবেও না কোনদিন। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও রীতু। ভুলে যেও। আমি তাহলে এখন যাই।
সমাপ্ত