09-12-2020, 08:25 PM
নতুন করে
স্নান করে বেরিয়ে ড্রায়ারে চুল শুকোতে শুকোতে আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন শম্পা। সাদা লম্বা ঝুলের চিকনের কাজের কুর্তি আর মানানসই পালাজোয় আজ নিজের চোখের নিজেকে অনন্যা লাগছিল ওঁর।
হয়ত, অন্যরকম পোষাকের জন্য।
নইলে তো, বিজনেস স্যুটেই কেটে যায় সোম থেকে শুক্র...কখনো কখনো শনিও। আর রবিবার পাজামা - টি শার্টের বাইরে বেরোতেই ইচ্ছে করে না। সারা সপ্তাহ ধরে যা ধকল যায়! রবিবার মনে হয় শুধুই রেস্ট নেবার দিন। আর এখন তো সিনেমা টিনেমা দেখার জন্যও বাড়ির বাইরে যেতে হয় না। বাজার -হাট, কেনাকাটা সব অ্যাপেই। আর সামান্য যদি কিছু আনার থাকে মা নিজেই চলে যান... ওঁদের এই বিলাসবহুল সোসাইটির এক পাশেই একটি সুপার মার্কেট আছে, সেখান থেকে কিনে কেটে আনেন।
এইভাবেই কেটে গেল কত গুলো বছর!
শৈবালের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকেই তো!
একসময়ের হাসিখুশি, মিষ্টি মেয়েটা যেন হারিয়ে গেলেন কোথায়! 'প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে' আর 'ভুলে থাকতে গেলে কাজ করতে হবে আরও বেশি করে' র জাঁতাকলে কত যে বসন্ত শীত হয়ে গেল! তখন মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করত...ভাবতেন, হেরেই গেলেন বুঝি...কিন্তু... ওই 'পারতেই হবে' টা কে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটা কোম্পানি টপকে আটবছর আগে নিজের কোম্পানি শুরু করেছিলেন। তখন মা একটু অসন্তুষ্ট ই হয়েছিলেন, অত ভালো চাকরি, পার্কস, সব ছেড়ে স্টার্ট আপের 'ভূত' মাথায় উঠেছিল বলে। মায়ের ও দোষ নেই, খুব মধ্যবিত্ত অবস্থা থেকে মেধাবী মেয়ের কল্যানেই যাবতীয় জাগতিক সুখ। যে ক'বছর বিয়ে হয়ে সংসার করেছিলেন, তখনও যথেষ্ট পাশে ছিলেন শম্পা মায়ের। আর, তারপর তো চলেই এলেন।
মাঝে মাঝে অভিমান হয় ওঁর, আজও। মা একবার ও নিজে থেকে চেষ্টা করেন নি সম্পর্কটাকে জোড়া লাগানোর। শৈবালের সাথে একবার ও কথা বলেন নি। এমনকি ওঁর মাথাতেও হাত বুলিয়ে দেন নি একবার ও...সেইসব বালিশ ভেজা বৃষ্টির দিনেও। আজকাল মনে হয়...বাবা থাকলে হয়ত...এমনি হতো না কিছুতেই। বাবা বুঝতেন। বোঝাতেন। আবার, মনে হয়... মায়ের ও তো বয়েস হয়েছে... হয়ত চাইছিলেন পাশে থাকুন উনি... রাতবিরেতে... হাঁপানির টানে আর প্রেসারের অনিয়মের দিনগুলিতে। তবে...অভিমান ও পাহাড়ের মতো হয়ে আছে যেন।
ভাবতে ভাবতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন শম্পা। কী আর হবে সেসব ভেবে! ভাবলেই মন খারাপ! বরং এখন একটা নতুন সময় আসতে চলেছে।
আর মায়ের তো সব ই খারাপ ছিল না! এই তো, ডিভোর্স হবার আগে সেই দমচাপা সময়ে উনি কত স্ট্রং, মনে করিয়ে দিয়েছেন বারবার। প্রতিবার প্রমোশান - ইনক্রিমেন্টের সময়ে, নতুন ফ্ল্যাট কিনে শিফট করার সময়, কালো রঙের নতুন গাড়ি কেনার সময়ে, বা হালে 'ফর্টি আন্ডার ফর্টি' লিস্টিতে নাম ওঠার পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা... আত্মীয়দের কাছে চোদ্দরকম ভাবে গল্প করে শোনানো... সব ই করেছেন সুচারু ভাবে। এমনকি, এই যে ইস্টার্ন বাইপাসের ওপরের এই ফ্ল্যাট...এতে এতটুকুও সময় দিতে হয় না শম্পাকে। সব মা একাই সামলে দেন। এই বয়সেও। এও তো অনেক কিছু করাই, তাই না?
তাও...মাঝে মাঝে কুট করে কামড়ায় বুকের মাঝে...যদি একবার মা ওকে বোঝাতেন...বিয়ের পরে একটু পরিবর্তন আসেই, অত গায়ে মাখতে নেই! আর শৈবালকে ফোন করে বলতেন "আর একবার চেষ্টা করো দেখি তোমরা!"
মা ছাড়া আর কেই বা ছিল ওঁর!
যাই হোক, 'সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়!' সময় নিজের মতো বয়ে গেছে। শৈবাল এখন নিউইয়র্ক না কোথায় একটা আছে! একবার ফেসবুকে খুঁজেছিলেন শম্পা। কভার ফটোতে এক মহিলার হাসিমুখের পাশে দেখে বুকটা খালি হয়েছিল অনেকক্ষণ! সে বড় কষ্ট! তাই আর খোঁজেন নি! কে আর চায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে!
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ভেঙে এলো শম্পার। বিছানায় রাখা রয়্যাল ব্লু বেনারসি কাজের দোপাট্টা টা পরে একবার নিজের প্রতিবিম্ব টা দেখলেন শম্পা। অন্যরকম সাজে দিব্যি মানিয়েছে তো আজ! হঠাৎ কি মনে হতে একটা ছোট্ট নীল বিন্দি পরে নিলেন কপালের মাঝটিতে। এই তো! আজকের দিনের উপযুক্ত সাজ।
আজ যে বড় ভালো দিন!
বড় ড্রয়িংরুমটার একপাশে ডাইনিং জোন। সেখানে এসে বসতেই মা এক গ্লাস জুস এনে রাখলেন। তারপর লাগোয়া কিচেনে চলে গেলেন। রোজকার মতোই।
জুসের গ্লাসটা দেখে একটু হাসলেন শম্পা। সোনালী রঙের জুস। পাইন আপেল কি? তাহলে খাবেন না আজ।
দুটো হোল হুইট ব্রেড, পিনাট বাটার দিয়ে খাওয়া অভ্যেস শম্পার। আর একটা এগ পোচ। মা প্লেট এনে রাখলেন। একটু হেসে শম্পা বলে উঠলেন, "মা, আজ ডিমটা খাব না...গন্ধ লাগছে...আর জুসটাও না। "
"গন্ধ লাগছে! সে কি! শরীর ঠিক আছে তো?" মায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
"হ্যাঁ হ্যাঁ,এমনিতে তো ঠিক ই আছে। কিন্তু ডিমটায় স্মেল লাগছে হঠাৎ করে। শুনেছি এমন হয়। আর পাইন আপেল খাওয়াও শুনেছি ঠিক না...গন্ধ নেই যদিও...দেখি ডক্টরকে একবার জিজ্ঞেস করে..." বলে ওঠে ও।
"গন্ধ লাগে! খাওয়া ঠিক না! কি হয়েছে তোমার?" কপালে হাত ছুঁইয়ে বলেন মা।
মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে শম্পা।
তারপর বলে "কিচ্ছু না...আমি খুব ভালো আছি...আসলে কাল ই জানতে পারলাম তো যে আমি পজিটিভ...মানে...প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ...তাই আর কি...আগে দেখি ডাক্তার কী বলেন..."
ওর কথা শেষ হবার আগেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন মা।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পরে জিজ্ঞেস করেন "প্রে...প্রেগনেন্সি...পজিটিভ...মানে?"
"মানে তো খুব সিম্পল মা, তুমি দিম্মি হতে চলেছ! তবে আমার তো চল্লিশ প্রায়, একটু সাবধানে থাকতে হবে আমাকে, এই যা!"
"বান্টি! তুমি জানো, তুমি কি বলছ! তুমি...তুমি প্রেগন্যান্ট! কে সে? না কি ওই...আই ভি এফ না কি বলে, সেটা করেছ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!" একটানা বলে থামেন মা।
একনজর মায়ের দিকে তাকান শম্পা।
কুসন্তান হলেও কুমাতা হতে পারেন না কখনো। তাও, অভিমান হয় বড্ড। ওর ও যে সংসার, স্বামী, সন্তানের প্রয়োজন হতে পারে...ডিভোর্স হলেও যে চাহিদা থেকে যায়, স্বপ্ন মরে না...বোঝেন নি মা। তাই ও...উনিই এবার, নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন...
"না মা, আই ভি এফ না...কোনো সম্পর্কেও নেই আমি। এরচেয়ে বেশি কিছু জানতে চেয়ো না, প্লিজ। তোমার ভালো লাগবে না। শুধু বলি, আমি চেয়েছিলাম... সঙ্গ এবং সন্তান, দুটোই, ঠিক যেভাবে আমি তোমার খেয়াল রাখি, রেখে এসেছি, তেমনি কেউ একটা থাকুক আমার ও। আমার নিজস্ব কেউ। তাই। "
"আমি এবার সবাইকে মুখ দেখাব কি করে! লোকে কি বলবে! " কাঁদতে কাঁদতে বলেন মা।
খারাপ লাগে শম্পার। টেবিলে রাখা মায়ের হাতটা আলতো জড়িয়ে ধরে বলেন "লোকে কি বলবে ভেবেই তো এতগুলো বছর নিজেকে কষ্ট দিয়েছি মা...আর পারলাম না! বরং লোকে কি বলবে না...ডাক্তারবাবু কী কী বলবেন, সেটাই আমার প্রায়োরিটি এখন। আমি খুব খুশি মা...জোর করছি না...তবে আমি চাই তুমিও খুশি হও আমার এই খুশিতে..." বলে টোস্টে কামড় বসান শম্পা।
অন্যহাত টা তখনও মায়ের হাতের ওপর রাখা।
বাইরে সোনাঝরা রোদ্দুর।
অথচ ঘরের ভেতরে, মনের মাঝে বর্ষণ!
কিন্তু, কিচ্ছু করার নেই শম্পার। এবার বাইরের লোক না, নিজের মনের মাঝে থাকা ঈশ্বরের কথা শোনার সময়।
মা পাশে থাকলে ভালো লাগত, এই যা!
একটা আওয়াজ হওয়ায় চমকে তাকান শম্পা।
হাত ছাড়িয়ে উঠে গেছেন মা।
মাথা নীচু করেন শম্পা। হাল ছাড়বেন না উনি, কিছুতেই না।
আরেকটা আওয়াজ।
ওঁর চেয়ারের পেছনেই।
মা এসেছেন...জড়িয়ে ধরেছেন পেছন দিক থেকে...হাত বুলোচ্ছেন মাথায়...
চোখে জল আসে শম্পার, সেই অভয়- স্পর্শে...
পাহাড় গলছে...
স্নান করে বেরিয়ে ড্রায়ারে চুল শুকোতে শুকোতে আয়নায় নিজেকে দেখছিলেন শম্পা। সাদা লম্বা ঝুলের চিকনের কাজের কুর্তি আর মানানসই পালাজোয় আজ নিজের চোখের নিজেকে অনন্যা লাগছিল ওঁর।
হয়ত, অন্যরকম পোষাকের জন্য।
নইলে তো, বিজনেস স্যুটেই কেটে যায় সোম থেকে শুক্র...কখনো কখনো শনিও। আর রবিবার পাজামা - টি শার্টের বাইরে বেরোতেই ইচ্ছে করে না। সারা সপ্তাহ ধরে যা ধকল যায়! রবিবার মনে হয় শুধুই রেস্ট নেবার দিন। আর এখন তো সিনেমা টিনেমা দেখার জন্যও বাড়ির বাইরে যেতে হয় না। বাজার -হাট, কেনাকাটা সব অ্যাপেই। আর সামান্য যদি কিছু আনার থাকে মা নিজেই চলে যান... ওঁদের এই বিলাসবহুল সোসাইটির এক পাশেই একটি সুপার মার্কেট আছে, সেখান থেকে কিনে কেটে আনেন।
এইভাবেই কেটে গেল কত গুলো বছর!
শৈবালের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর থেকেই তো!
একসময়ের হাসিখুশি, মিষ্টি মেয়েটা যেন হারিয়ে গেলেন কোথায়! 'প্রতিষ্ঠিত হতেই হবে' আর 'ভুলে থাকতে গেলে কাজ করতে হবে আরও বেশি করে' র জাঁতাকলে কত যে বসন্ত শীত হয়ে গেল! তখন মাঝে মাঝে হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করত...ভাবতেন, হেরেই গেলেন বুঝি...কিন্তু... ওই 'পারতেই হবে' টা কে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়েছিলেন। বেশ কয়েকটা কোম্পানি টপকে আটবছর আগে নিজের কোম্পানি শুরু করেছিলেন। তখন মা একটু অসন্তুষ্ট ই হয়েছিলেন, অত ভালো চাকরি, পার্কস, সব ছেড়ে স্টার্ট আপের 'ভূত' মাথায় উঠেছিল বলে। মায়ের ও দোষ নেই, খুব মধ্যবিত্ত অবস্থা থেকে মেধাবী মেয়ের কল্যানেই যাবতীয় জাগতিক সুখ। যে ক'বছর বিয়ে হয়ে সংসার করেছিলেন, তখনও যথেষ্ট পাশে ছিলেন শম্পা মায়ের। আর, তারপর তো চলেই এলেন।
মাঝে মাঝে অভিমান হয় ওঁর, আজও। মা একবার ও নিজে থেকে চেষ্টা করেন নি সম্পর্কটাকে জোড়া লাগানোর। শৈবালের সাথে একবার ও কথা বলেন নি। এমনকি ওঁর মাথাতেও হাত বুলিয়ে দেন নি একবার ও...সেইসব বালিশ ভেজা বৃষ্টির দিনেও। আজকাল মনে হয়...বাবা থাকলে হয়ত...এমনি হতো না কিছুতেই। বাবা বুঝতেন। বোঝাতেন। আবার, মনে হয়... মায়ের ও তো বয়েস হয়েছে... হয়ত চাইছিলেন পাশে থাকুন উনি... রাতবিরেতে... হাঁপানির টানে আর প্রেসারের অনিয়মের দিনগুলিতে। তবে...অভিমান ও পাহাড়ের মতো হয়ে আছে যেন।
ভাবতে ভাবতে অতীত থেকে বর্তমানে ফিরে এলেন শম্পা। কী আর হবে সেসব ভেবে! ভাবলেই মন খারাপ! বরং এখন একটা নতুন সময় আসতে চলেছে।
আর মায়ের তো সব ই খারাপ ছিল না! এই তো, ডিভোর্স হবার আগে সেই দমচাপা সময়ে উনি কত স্ট্রং, মনে করিয়ে দিয়েছেন বারবার। প্রতিবার প্রমোশান - ইনক্রিমেন্টের সময়ে, নতুন ফ্ল্যাট কিনে শিফট করার সময়, কালো রঙের নতুন গাড়ি কেনার সময়ে, বা হালে 'ফর্টি আন্ডার ফর্টি' লিস্টিতে নাম ওঠার পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠা... আত্মীয়দের কাছে চোদ্দরকম ভাবে গল্প করে শোনানো... সব ই করেছেন সুচারু ভাবে। এমনকি, এই যে ইস্টার্ন বাইপাসের ওপরের এই ফ্ল্যাট...এতে এতটুকুও সময় দিতে হয় না শম্পাকে। সব মা একাই সামলে দেন। এই বয়সেও। এও তো অনেক কিছু করাই, তাই না?
তাও...মাঝে মাঝে কুট করে কামড়ায় বুকের মাঝে...যদি একবার মা ওকে বোঝাতেন...বিয়ের পরে একটু পরিবর্তন আসেই, অত গায়ে মাখতে নেই! আর শৈবালকে ফোন করে বলতেন "আর একবার চেষ্টা করো দেখি তোমরা!"
মা ছাড়া আর কেই বা ছিল ওঁর!
যাই হোক, 'সময় চলিয়া যায়, নদীর স্রোতের প্রায়!' সময় নিজের মতো বয়ে গেছে। শৈবাল এখন নিউইয়র্ক না কোথায় একটা আছে! একবার ফেসবুকে খুঁজেছিলেন শম্পা। কভার ফটোতে এক মহিলার হাসিমুখের পাশে দেখে বুকটা খালি হয়েছিল অনেকক্ষণ! সে বড় কষ্ট! তাই আর খোঁজেন নি! কে আর চায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে!
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ভেঙে এলো শম্পার। বিছানায় রাখা রয়্যাল ব্লু বেনারসি কাজের দোপাট্টা টা পরে একবার নিজের প্রতিবিম্ব টা দেখলেন শম্পা। অন্যরকম সাজে দিব্যি মানিয়েছে তো আজ! হঠাৎ কি মনে হতে একটা ছোট্ট নীল বিন্দি পরে নিলেন কপালের মাঝটিতে। এই তো! আজকের দিনের উপযুক্ত সাজ।
আজ যে বড় ভালো দিন!
বড় ড্রয়িংরুমটার একপাশে ডাইনিং জোন। সেখানে এসে বসতেই মা এক গ্লাস জুস এনে রাখলেন। তারপর লাগোয়া কিচেনে চলে গেলেন। রোজকার মতোই।
জুসের গ্লাসটা দেখে একটু হাসলেন শম্পা। সোনালী রঙের জুস। পাইন আপেল কি? তাহলে খাবেন না আজ।
দুটো হোল হুইট ব্রেড, পিনাট বাটার দিয়ে খাওয়া অভ্যেস শম্পার। আর একটা এগ পোচ। মা প্লেট এনে রাখলেন। একটু হেসে শম্পা বলে উঠলেন, "মা, আজ ডিমটা খাব না...গন্ধ লাগছে...আর জুসটাও না। "
"গন্ধ লাগছে! সে কি! শরীর ঠিক আছে তো?" মায়ের উদ্বিগ্ন কন্ঠ।
"হ্যাঁ হ্যাঁ,এমনিতে তো ঠিক ই আছে। কিন্তু ডিমটায় স্মেল লাগছে হঠাৎ করে। শুনেছি এমন হয়। আর পাইন আপেল খাওয়াও শুনেছি ঠিক না...গন্ধ নেই যদিও...দেখি ডক্টরকে একবার জিজ্ঞেস করে..." বলে ওঠে ও।
"গন্ধ লাগে! খাওয়া ঠিক না! কি হয়েছে তোমার?" কপালে হাত ছুঁইয়ে বলেন মা।
মায়ের দিকে তাকিয়ে একটু হাসে শম্পা।
তারপর বলে "কিচ্ছু না...আমি খুব ভালো আছি...আসলে কাল ই জানতে পারলাম তো যে আমি পজিটিভ...মানে...প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ...তাই আর কি...আগে দেখি ডাক্তার কী বলেন..."
ওর কথা শেষ হবার আগেই ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন মা।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকার পরে জিজ্ঞেস করেন "প্রে...প্রেগনেন্সি...পজিটিভ...মানে?"
"মানে তো খুব সিম্পল মা, তুমি দিম্মি হতে চলেছ! তবে আমার তো চল্লিশ প্রায়, একটু সাবধানে থাকতে হবে আমাকে, এই যা!"
"বান্টি! তুমি জানো, তুমি কি বলছ! তুমি...তুমি প্রেগন্যান্ট! কে সে? না কি ওই...আই ভি এফ না কি বলে, সেটা করেছ! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!" একটানা বলে থামেন মা।
একনজর মায়ের দিকে তাকান শম্পা।
কুসন্তান হলেও কুমাতা হতে পারেন না কখনো। তাও, অভিমান হয় বড্ড। ওর ও যে সংসার, স্বামী, সন্তানের প্রয়োজন হতে পারে...ডিভোর্স হলেও যে চাহিদা থেকে যায়, স্বপ্ন মরে না...বোঝেন নি মা। তাই ও...উনিই এবার, নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন...
"না মা, আই ভি এফ না...কোনো সম্পর্কেও নেই আমি। এরচেয়ে বেশি কিছু জানতে চেয়ো না, প্লিজ। তোমার ভালো লাগবে না। শুধু বলি, আমি চেয়েছিলাম... সঙ্গ এবং সন্তান, দুটোই, ঠিক যেভাবে আমি তোমার খেয়াল রাখি, রেখে এসেছি, তেমনি কেউ একটা থাকুক আমার ও। আমার নিজস্ব কেউ। তাই। "
"আমি এবার সবাইকে মুখ দেখাব কি করে! লোকে কি বলবে! " কাঁদতে কাঁদতে বলেন মা।
খারাপ লাগে শম্পার। টেবিলে রাখা মায়ের হাতটা আলতো জড়িয়ে ধরে বলেন "লোকে কি বলবে ভেবেই তো এতগুলো বছর নিজেকে কষ্ট দিয়েছি মা...আর পারলাম না! বরং লোকে কি বলবে না...ডাক্তারবাবু কী কী বলবেন, সেটাই আমার প্রায়োরিটি এখন। আমি খুব খুশি মা...জোর করছি না...তবে আমি চাই তুমিও খুশি হও আমার এই খুশিতে..." বলে টোস্টে কামড় বসান শম্পা।
অন্যহাত টা তখনও মায়ের হাতের ওপর রাখা।
বাইরে সোনাঝরা রোদ্দুর।
অথচ ঘরের ভেতরে, মনের মাঝে বর্ষণ!
কিন্তু, কিচ্ছু করার নেই শম্পার। এবার বাইরের লোক না, নিজের মনের মাঝে থাকা ঈশ্বরের কথা শোনার সময়।
মা পাশে থাকলে ভালো লাগত, এই যা!
একটা আওয়াজ হওয়ায় চমকে তাকান শম্পা।
হাত ছাড়িয়ে উঠে গেছেন মা।
মাথা নীচু করেন শম্পা। হাল ছাড়বেন না উনি, কিছুতেই না।
আরেকটা আওয়াজ।
ওঁর চেয়ারের পেছনেই।
মা এসেছেন...জড়িয়ে ধরেছেন পেছন দিক থেকে...হাত বুলোচ্ছেন মাথায়...
চোখে জল আসে শম্পার, সেই অভয়- স্পর্শে...
পাহাড় গলছে...