09-12-2020, 07:35 PM
তিন।
তারপর, আমরা কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দি দিল্লি। রাজধানী টেনে নেয় আমাদের কর্মব্যস্ততার আবর্তে, আস্তে আস্তে সেই গভীর বন্ধন ক্ষীণ হতে থাকে। তিন বছর পর সুকুমারের সাথে আকস্মিক ঘটনাচক্রে দেখা কিন্তু মনটা না জানি কেন উদাস হয়ে গেলো।
রাত্রে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আমি ওদের কথাটা না তুলে পারলাম না। কিন্তু দেখলাম যে এ ব্যাপারে আমার বর বেশ প্রাকটিক্যাল। "বেশি চিন্তা কোরোনা তো, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, নিজের চরকায় তেল দাও," বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। অসভ্য ইনসেন্সিটিভ লোক।
পরের কয়েক দিন আমরা কলকাতার তীর্থস্থানগুলোর দর্শনে মশগুল রইলাম। এই যেমন নিউমার্কেট, একাডেমী, বলরাম মল্লিক, হাটারি, রবীন্দ্র সদন, কফি হাউস আর কত কি! সম্মোহিতের মতো আমরা ঘুরে বেড়ালাম। সকালে বের হই আর রাত্রে ঢুকি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কিন্তু উজ্জীবিত, প্রফুল্লিত, উচ্ছসিত। পরের দিন কি করা হবে সেই প্লানে নিবিষ্ট।
পরের দিন, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণাপন, মধুসূদন মঞ্চে নাটক, বেদুঈনের রোল, গিরিশের কাঁচাগোল্লা, বাসন্তী দেবী কলেজের সামনে দাঁড়ানো বুড়োটার কাছে ফুচ্কা খেয়ে পেট আইঢাই হয়ে করুণ অবস্থা। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে হয়ে এলো, আমরা তখনো দিশাহীন ভাবে গড়িয়াহাটের এ রাস্তা ওই গলি ঘুরে বেড়াচ্ছি হটাৎ আমার বর একটা খোঁচা দিলো আমার পিঠে । ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি ও একটা নিয়ন বোর্ডের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ঝলমলে আলোতে লেখা 'মিতালি ক্রিয়েশন্স।' আমাদের মিতালি নাকি? পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো কলকাতায় 'মিতালি' নামটা মোটেও বিরল নয়। বরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে ঠিকানা ভুল হয়নি। আমার পাদুটো আপনাআপনি চললো সে দিকে।
বিশাল বড় বুটিক, সুন্দর সাজানো, দুর্দান্ত উদ্ভাবনী পরিকল্পনা। রঙের বর্ণবিন্যাস, পরিধান, কস্টিউম , দেয়ালে ঝোলানো রঙিন চিত্রাঙ্কন সবের মধ্যেই ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যবোধের পরিচয়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটি ছিমছাম সেলসকন্যা এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো, জানতে চাইলো সে আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে। আমি বিব্রত হলাম ; সত্যিই তো, আমার তো কিছু কেনার নেই। আমার বরটা দেখি বুদ্ধি ধরে; খুব কায়দা করে বললো যে আমরা মিতালি দেবীর সাথে দেখা করতে এসেছি। "উনি তো এখন নেই, আপনি আপনার কন্টাক্ট নম্বরটা দিয়ে যান" মেয়েটা অনুরোধ করলো। আমার বর্বর বর খসখস করে আমার নাম আর মোবাইল নম্বর অতিথিপুস্তকে লিখে দিলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম। ফিরে তাকালাম। যথার্থই নাক্ষত্রিক বিন্যাস, স্টেলার শো।
আমি কি খুব আশ্চর্য হলাম? মিতালির কাছে আমার এটাই তো প্রত্যাশা ছিল? কিন্তু অঙ্কটা মিলছে কই?
জবাবটা এলো পরদিন ভোরে, ঘুম ভাঙল ফোনের ডাকে। দেখি অজানা নম্বর তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটু ইতস্তত করে শেষমেশ পিক করলাম। ওপারে মিতালি, সেই অতি পরিচিত মিষ্টি স্বর। সে আর আমি দুজনেই কিঞ্চিৎ কুন্ঠিত , কি কথা বলব বুঝতেই পারছি না। ও আজ আসতে চায় মানে আসবেই। আমার ঘুমন্ত বরটা হটাৎ জেগে উঠে হাত পা নেড়ে বলবার চেষ্টা করলো যে কাটিয়ে দাও। মিতালীও জানিয়ে দিলো যে সে শুধুমাত্র আসবেই তা নয়, লাঞ্চও খাবে। বেচারা বর , তার মেনল্যান্ড বুফেটার চোদ্দটা বাজলো। ভদ্রলোক দেখলাম মনে কষ্ট পেলেও বাজারে গিয়ে যাবতীয় কেনাকাটা করে আনলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় যে লোকটা খুব একটা মন্দ নয়। তবে আমার একটু সন্দেহ হয় যে ব্যাটা বাজারে যাবার নাম করে সিগারেট খায়।
মিতালি ঠিক বারোটার সময় ঢুকলো, নিজের গাড়িতে। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। সেই মিতালি যাকে আমি চিনতাম সে কোথায়? আমাদের সেই রোগারোগা লাজুক মেয়েটা যে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ বাড়ি ও বাড়ি মোটরবাইকে ঘুরে বেড়াতো, ঝোড়ো কাকের মতন, এই মেয়ে তো সেই মেয়ে নয়। স্মার্ট, অসীম সুন্দরী, নির্ভীক 'ওম্যান অফ সাবস্টেন্স', জীবনযুদ্ধে জয়ী নারী আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে। সে তো এসেই ঝড় বইয়ে দিলো, আমার বরের সাথে খুনসুটি, আমার এলোমেলো চুল আঁচড়ে দেওয়া, সবই হলো। আমি আমার রান্না করা অল্প কয়েকটা পদের কথা ভেবে লজ্জা পেলাম। তার সামনে, আমরা যেন টিমটিমে, ম্যাড়ম্যাড়ে।
আমি ভেবেছিলাম আমাদের মিতু আসবে কোনো সিইও না। এমনকি আমার 'অতিচালাক' বরের অবস্থাও দেখলাম বেশ সঙ্গিন, সেনা ছত্রভঙ্গ।
তারপর, আমরা কলকাতা ছেড়ে পাড়ি দি দিল্লি। রাজধানী টেনে নেয় আমাদের কর্মব্যস্ততার আবর্তে, আস্তে আস্তে সেই গভীর বন্ধন ক্ষীণ হতে থাকে। তিন বছর পর সুকুমারের সাথে আকস্মিক ঘটনাচক্রে দেখা কিন্তু মনটা না জানি কেন উদাস হয়ে গেলো।
রাত্রে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আমি ওদের কথাটা না তুলে পারলাম না। কিন্তু দেখলাম যে এ ব্যাপারে আমার বর বেশ প্রাকটিক্যাল। "বেশি চিন্তা কোরোনা তো, আপনি বাঁচলে বাপের নাম, নিজের চরকায় তেল দাও," বলে পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। অসভ্য ইনসেন্সিটিভ লোক।
পরের কয়েক দিন আমরা কলকাতার তীর্থস্থানগুলোর দর্শনে মশগুল রইলাম। এই যেমন নিউমার্কেট, একাডেমী, বলরাম মল্লিক, হাটারি, রবীন্দ্র সদন, কফি হাউস আর কত কি! সম্মোহিতের মতো আমরা ঘুরে বেড়ালাম। সকালে বের হই আর রাত্রে ঢুকি ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত কিন্তু উজ্জীবিত, প্রফুল্লিত, উচ্ছসিত। পরের দিন কি করা হবে সেই প্লানে নিবিষ্ট।
পরের দিন, যাদবপুর ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণাপন, মধুসূদন মঞ্চে নাটক, বেদুঈনের রোল, গিরিশের কাঁচাগোল্লা, বাসন্তী দেবী কলেজের সামনে দাঁড়ানো বুড়োটার কাছে ফুচ্কা খেয়ে পেট আইঢাই হয়ে করুণ অবস্থা। ক্রমে অন্ধকার ঘনিয়ে হয়ে এলো, আমরা তখনো দিশাহীন ভাবে গড়িয়াহাটের এ রাস্তা ওই গলি ঘুরে বেড়াচ্ছি হটাৎ আমার বর একটা খোঁচা দিলো আমার পিঠে । ঘুরে দাঁড়াতেই দেখি ও একটা নিয়ন বোর্ডের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ঝলমলে আলোতে লেখা 'মিতালি ক্রিয়েশন্স।' আমাদের মিতালি নাকি? পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো কলকাতায় 'মিতালি' নামটা মোটেও বিরল নয়। বরের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে ঠিকানা ভুল হয়নি। আমার পাদুটো আপনাআপনি চললো সে দিকে।
বিশাল বড় বুটিক, সুন্দর সাজানো, দুর্দান্ত উদ্ভাবনী পরিকল্পনা। রঙের বর্ণবিন্যাস, পরিধান, কস্টিউম , দেয়ালে ঝোলানো রঙিন চিত্রাঙ্কন সবের মধ্যেই ব্যতিক্রমী সৌন্দর্যবোধের পরিচয়। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। একটি ছিমছাম সেলসকন্যা এগিয়ে এসে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো, জানতে চাইলো সে আমাদের কীভাবে সাহায্য করবে। আমি বিব্রত হলাম ; সত্যিই তো, আমার তো কিছু কেনার নেই। আমার বরটা দেখি বুদ্ধি ধরে; খুব কায়দা করে বললো যে আমরা মিতালি দেবীর সাথে দেখা করতে এসেছি। "উনি তো এখন নেই, আপনি আপনার কন্টাক্ট নম্বরটা দিয়ে যান" মেয়েটা অনুরোধ করলো। আমার বর্বর বর খসখস করে আমার নাম আর মোবাইল নম্বর অতিথিপুস্তকে লিখে দিলেন। আমরা বেরিয়ে এলাম। ফিরে তাকালাম। যথার্থই নাক্ষত্রিক বিন্যাস, স্টেলার শো।
আমি কি খুব আশ্চর্য হলাম? মিতালির কাছে আমার এটাই তো প্রত্যাশা ছিল? কিন্তু অঙ্কটা মিলছে কই?
জবাবটা এলো পরদিন ভোরে, ঘুম ভাঙল ফোনের ডাকে। দেখি অজানা নম্বর তাকিয়ে আছে আমার দিকে। একটু ইতস্তত করে শেষমেশ পিক করলাম। ওপারে মিতালি, সেই অতি পরিচিত মিষ্টি স্বর। সে আর আমি দুজনেই কিঞ্চিৎ কুন্ঠিত , কি কথা বলব বুঝতেই পারছি না। ও আজ আসতে চায় মানে আসবেই। আমার ঘুমন্ত বরটা হটাৎ জেগে উঠে হাত পা নেড়ে বলবার চেষ্টা করলো যে কাটিয়ে দাও। মিতালীও জানিয়ে দিলো যে সে শুধুমাত্র আসবেই তা নয়, লাঞ্চও খাবে। বেচারা বর , তার মেনল্যান্ড বুফেটার চোদ্দটা বাজলো। ভদ্রলোক দেখলাম মনে কষ্ট পেলেও বাজারে গিয়ে যাবতীয় কেনাকাটা করে আনলেন। মাঝে মাঝে মনে হয় যে লোকটা খুব একটা মন্দ নয়। তবে আমার একটু সন্দেহ হয় যে ব্যাটা বাজারে যাবার নাম করে সিগারেট খায়।
মিতালি ঠিক বারোটার সময় ঢুকলো, নিজের গাড়িতে। আমি চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। সেই মিতালি যাকে আমি চিনতাম সে কোথায়? আমাদের সেই রোগারোগা লাজুক মেয়েটা যে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে এ বাড়ি ও বাড়ি মোটরবাইকে ঘুরে বেড়াতো, ঝোড়ো কাকের মতন, এই মেয়ে তো সেই মেয়ে নয়। স্মার্ট, অসীম সুন্দরী, নির্ভীক 'ওম্যান অফ সাবস্টেন্স', জীবনযুদ্ধে জয়ী নারী আজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে। সে তো এসেই ঝড় বইয়ে দিলো, আমার বরের সাথে খুনসুটি, আমার এলোমেলো চুল আঁচড়ে দেওয়া, সবই হলো। আমি আমার রান্না করা অল্প কয়েকটা পদের কথা ভেবে লজ্জা পেলাম। তার সামনে, আমরা যেন টিমটিমে, ম্যাড়ম্যাড়ে।
আমি ভেবেছিলাম আমাদের মিতু আসবে কোনো সিইও না। এমনকি আমার 'অতিচালাক' বরের অবস্থাও দেখলাম বেশ সঙ্গিন, সেনা ছত্রভঙ্গ।