09-12-2020, 01:31 PM
6
স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে ওর শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, নিঃশাস প্রশ্বাস গভীর হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ওর সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ওর ঠোঁট, মুখ, পীঠ, হাত, সমস্ত। আমার সুহাস আজ আবার আমার। ওর হাতের স্পর্শও পাচ্ছি আমার ঘাড়ে, ওর অধর......, সমস্ত প্রাণ দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে আমায়। ওর পা আমার পায়ে ঠেকছে। এতটা উত্তেজনা; এতো ভালোবাসা; এও কি সম্ভব? স্বপ্ন?
কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি, ওকে বুকে ধরে? রাত পার হয়ে ভোরের আলো ফুটছে, দিক্চক্রবালের রেখা দেখা যায় অদূরে।
'চোখ খোলো', আমি এখানে।
ওর দৃষ্টি, আমার অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছে। ওর মুখে হাসি, "ভেতরে চল।"
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। অনুভব করলাম আবার।
"পাগল, কি করছো? চলো।" বাচ্চার মতো খিলখিল করে হেসে উঠলো।
কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, "তোমায় স্পর্শ করতে দাও, দেখি আমার সুহাসকে চিনতে পারি কি না! অন্ধ মানুষ যেমন শব্দ খোঁজে নিঃশব্দে, ছুঁয়ে দেখে ব্রেইলে!
সুহাসিনী আমার ঠোঁটটা ছুঁয়ে দুষ্টু ভাবে বললো, "তাই বুঝি, তাই চোখ বন্ধ!"
"তাই তো! আমার চোখ বন্ধ থাকলেই তো সুহাস কে চিনতে পারি। বুঝতে পারি নিঃসংশয়ে। "
সুহাস আরো কাছে টেনে নিলো আমায়, "চোখ খুলে আমায় বলো, কি দেখছো?"
চোখ খুললাম, দেখলাম সেই অসম্ভব সুন্দর মুখটা, আমার ঠিক মুখেরই কাছে। স্ফুরিত ঠোঁটটা একটু একটু কাঁপছে। শরীরের গন্ধ আমায় মাতাল করে তুলছে। এই নারী আমার চাই।
আস্তে করে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, "কি দেখছো?"
মুখে কথা ফুটছে না, অনেক কষ্টে বললাম, "সুন্দর নারীমূর্তি, সুন্দর হাসি, মোহিনী, আমার শরীরে আগুন ধরাতে এসেছে।"
"সেই মোহিনী তো তোমারি, ভেতরে এস। " ফিসফিস করে বললো ও।
"যাবো।"একটু দ্বিধা করলাম, "কিছু বলবো?"
"বল, কি বলবে, আজ আমি সব শুনবো।" বুকের ওপর মাথাটা রাখলো ও, জড়িয়ে ধরলো আরো জোরে।
কি করে বলবো? ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম মানসিক আবেগে। কথা বলা যে আমার পক্ষে অসম্ভব। ওর দিকে তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিলো।
"তুমি জানো, পুণা ছাড়ার পর আমি কি করেছিলাম? যেন, আমি দিল্লি ফিরে যেতে পারিনি?"
"তুমি গোয়া এসেছিলে, আমি জানি।"
আমি অবাক, "তুমি জানো? কেমন করে?"
আমি জানতাম তুমি দিল্লি ফিরে যাওনি, ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো।নিরুপায় হয়ে তোমার মোবাইল ট্র্যাক করেছিলাম।
"দুশ্চিন্তায় ছিলে? গত দু সপ্তাহ আমার ওপর দিয়ে কি গেছে তার কোনো ধারণা আছে তোমার? আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম না?
ও চুপ করে রইলো, দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো, "জানি।"
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষন, "তুমি কেন ডেকেছো জানি না, শুধু ইন্সট্রাকশন ফলো করছি। এখানে এলাম, তোমাকে পেলাম, আনকোরা নতুন রূপে।
ব্র্যান্ড নিউ সুহাসিনী, একদম নিখুঁত, মোহময়ী, এই স্বপ্নের বাড়িতে।
পারফেক্ট।
তুমি আমাদের কথা বললে। তোমার জীবনের দর্শন, এই দর্শন, এই ফিলসফি, তাও নতুন, তোমার মতন। তুমি কথা বলছো, আমি সম্মোহিত হয়ে শুনছি। যেন কুহকের দেশে এসেছি, যেন ইন্দ্রজাল। মোহিনী মায়া এলো। আঃ! কি আবোল তাবোল বকছি।
কিন্তু জানো? এ তো সুহাস নয়। আমি এ কার দিকে তাকিয়ে আছি, কার কথা শুনছি? আমি তো চিনি না। তুমি সুন্দর, তুমি নতুন, তুমি সেই সব যা আমি চাই, কামনা করি। এলে হৃদয় শিকারে, কিন্তু তুমি আমার সে সুহাস নও।
ওর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, "কি বলছো গো তুমি, কি বলছো?"
খুব কষ্ট একটা বুকে, "তোমার কথা শুনলাম, আগে কখনো শুনিনি। আমরা দুজনে এক হয়ে গেছি, আমাদের সত্তা এক গেছে হয়ে আর সেটাই আমাদের জীবনে এনেছে বিপর্যয়। যাকে বলে সেন্ট্রাল কোর অফ বিশৃঙ্খলতা। কি জটিল তত্ত্ব। আমি বুঝি না, বুঝতে চাইও না। এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন।
তুমি চাইছিলে আমি রাগ করি। দুঃখিত নয়, ব্যথিত নয়, ক্ষমাশীল নয়। তোমার চোখে এই কয়েকটা বৈশিষ্ট আমাকে মানায় না, তুমি চিন্তিত। হতে পারে। কিন্তু আমার চিন্তাধারা, আমার উপলব্ধি, তার কি কোনো মূল্য আছে?
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই আমরা একাত্ম হয়ে গেলাম। পরস্পরকে বরদাস্ত করতে লাগলাম, আরো সহিষ্ণু হলাম। নিজেদের প্রতি উদার হলাম, এক জন আর একজনের প্রতি যত্নবান হলাম। নিজেদের অজান্তেই ছোট ছোট আপোষ, ছোট ছোট রফা করলাম; সন্ধিস্থাপন হলো, যুদ্ধবিগ্রহ কমে গেলো।
কার জন্যে? আমাদের জন্যে। কাজটা কি খারাপ হলো? এই 'ছোটোখাটো ' দেয়ানেয়াগুলো করতে, আমাদের কি খুব অনুশোচনা হল? এই সামান্য স্যাক্রিফাইসগুলো আমাদের কি আরো কাছে নিয়ে আসেনি? আমি এতদিন তাই ভেবেছিলাম। আজ আমার মনে সংশয়, সবই কি ভুল?
তাই কোনো প্রশ্ন, কোনো জবাব চাইতে পারিনি। আমার মন বলেছিলো যে কোনো প্রশ্ন করাটা ভুল হবে কারণ আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে আমাদের একাত্মতাতেই, যা আমরা তৈরী করেছি অতি কষ্টে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে। কুড়ি বছরের চেষ্টায়। তাই তুমি যখন বললে চলে যেতে, আমি অবাক হলেও প্রশ্ন করতে পারলাম না। তুমি বলেছো, ব্যাস।
তুমি আমায় চলে যেতে বললে, আমি তোমাকে হারালাম। অন্তত, আমার তাই মনে হলো। তুমি বলছো আমার এই ধারণা অমূলক। সেদিন তা ছিলোনা কিন্তু।
তোমার মতে আমার রাগ না করাটাই তোমার দুখঃ। আর আমার কষ্ট কি জানো? তুমি আমাকে তোমার পাশে দাঁড়াতে দিলেনা। তোমার কষ্টে সান্তনা দেবার অধিকার আমার রইলো না। আমি পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক!! ঠিকই বলেছো। আমি কি বিচার করবো? যে সারাজীবনটা কাটিয়ে দিলো এই সংসারটাকে সাজাতে, অনেক দুঃখ অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে আমি তড়িঘড়ি শাস্তি দেব। এটা তো নিরপেক্ষ বিচারকও করেন না। সত্যি বলতে কি আমার কাছে এটা অচিন্তনীয়, অপবিত্র, অশুচি।
তুমি আদিকে ভালোবাসো, ভালো কথা। তুমি আমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসো, সেটাও ভালো। আমরা জীবনসঙ্গী, পরস্পরের মালিক নই। তুমি কি ভাবছো বা আমার কি ভাবা উচিত তা সম্পূর্ণভাবে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ নেই।
কিন্তু তুমি যখন বল যে ও তোমাকে আমার বিগত যৌবনের রূপটা মনে করিয়ে দেয়, তখন আমার অসম্পূর্ণতা, আমার খুঁত, আমার ত্রুটিগুলো, বড়ো করে আমার চোখে ধরা পরে। মজার কথা, এই ত্রুটিগুলোর উৎস, আমাদের নীতিগত প্রয়াস আর প্রচেষ্টার পরিনাম। হয়তো আমরা একটু এক্সট্রা সুখী হতে চেয়েছিলাম। ভুল করেছিলাম, অজান্তেই ।
সবারই একটা নিজস্ব মতবাদ বা ফিলসফি থাকতেই পারে, নয় কেন? আমার আছে কি? হয়তো আছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস আমার নেই। কারণ, আমার সেই ভিন্ন ভাবনাধারা আমাদের এই দুজনের জীবনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। তাই, এই আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই।
আজ সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে, তোমাকে আমি ফিরে পেয়েছি। আমার প্রিয়া আজ আমার বুকে, চোখ বুজে তার চুলের গন্ধ আমি পাচ্ছি। চোখ খুলে আমি বার বার তাকে দেখছি আর ভাবছি । আমি যে মানুষটাকে জানতাম কুড়ি বছর ধরে, সে তো তুমি নও। চোখ খুলে যাকে দেখছি, সে মহিলা আমার অপরিচিত।
তুমি আজ যা চাও আমিও তাই চাই কিন্তু তা যেন হয় আমার সুহাসকে সঙ্গে রেখে। আমার সেই সুহাস যে কখনো কোনো বুদ্ধির খেলা জানতো না। যার একমাত্র মগজাস্ত্র ছিল তার বিশাল হৃদয়। আজ হটাৎ আমরা দুজন দুই মেরুর প্রাণী।
একদিন তুমি আমাকে ঘরছাড়া করেছিলে আজ আমি নিজেকে ঘর থেকে তাড়াচ্ছি। তোমার দেওয়া সেই টুথব্রাশ উপমাটা খুব উপযুক্ত মনে হচ্ছে। আসলে আমিই সেই ‘পুরোনো টুথব্রাশ’ যাকে ফেলে দিলে কেউ ফিরেও তাকাবে না।
আমার কথা ফুরালো। আমি বিপর্যস্ত। আমি ক্লান্ত।
ও আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে।নিজের মনেই তাকিয়ে আছে। দূরে কোথাও, কি দেখছে কে জানে!
আমি ব্যাগটা বের করে আনলাম। দুমিনিট লাগলো সব গোছাতে। এবার যাবার সময়।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে, একবার ফিরে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে জল। মুখ ফিরিয়ে নিলাম, আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ছি।
ও শুধু একটাই কথা বললো, "আমায় ক্ষমা করো, যেও না।"
আমি বেরিয়ে গেলাম।
পিন্টো অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে।
স্পষ্ট বুঝতে পারছি যে ওর শরীর ছেড়ে দিচ্ছে, নিঃশাস প্রশ্বাস গভীর হয়ে আসছে। চোখ বন্ধ করে ওর সমস্ত শরীরে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। ওর ঠোঁট, মুখ, পীঠ, হাত, সমস্ত। আমার সুহাস আজ আবার আমার। ওর হাতের স্পর্শও পাচ্ছি আমার ঘাড়ে, ওর অধর......, সমস্ত প্রাণ দিয়ে আঁকড়ে ধরে আছে আমায়। ওর পা আমার পায়ে ঠেকছে। এতটা উত্তেজনা; এতো ভালোবাসা; এও কি সম্ভব? স্বপ্ন?
কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছি, ওকে বুকে ধরে? রাত পার হয়ে ভোরের আলো ফুটছে, দিক্চক্রবালের রেখা দেখা যায় অদূরে।
'চোখ খোলো', আমি এখানে।
ওর দৃষ্টি, আমার অন্তঃস্থলে প্রবেশ করেছে। ওর মুখে হাসি, "ভেতরে চল।"
আমি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললাম। অনুভব করলাম আবার।
"পাগল, কি করছো? চলো।" বাচ্চার মতো খিলখিল করে হেসে উঠলো।
কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, "তোমায় স্পর্শ করতে দাও, দেখি আমার সুহাসকে চিনতে পারি কি না! অন্ধ মানুষ যেমন শব্দ খোঁজে নিঃশব্দে, ছুঁয়ে দেখে ব্রেইলে!
সুহাসিনী আমার ঠোঁটটা ছুঁয়ে দুষ্টু ভাবে বললো, "তাই বুঝি, তাই চোখ বন্ধ!"
"তাই তো! আমার চোখ বন্ধ থাকলেই তো সুহাস কে চিনতে পারি। বুঝতে পারি নিঃসংশয়ে। "
সুহাস আরো কাছে টেনে নিলো আমায়, "চোখ খুলে আমায় বলো, কি দেখছো?"
চোখ খুললাম, দেখলাম সেই অসম্ভব সুন্দর মুখটা, আমার ঠিক মুখেরই কাছে। স্ফুরিত ঠোঁটটা একটু একটু কাঁপছে। শরীরের গন্ধ আমায় মাতাল করে তুলছে। এই নারী আমার চাই।
আস্তে করে আমায় জিজ্ঞাসা করলো, "কি দেখছো?"
মুখে কথা ফুটছে না, অনেক কষ্টে বললাম, "সুন্দর নারীমূর্তি, সুন্দর হাসি, মোহিনী, আমার শরীরে আগুন ধরাতে এসেছে।"
"সেই মোহিনী তো তোমারি, ভেতরে এস। " ফিসফিস করে বললো ও।
"যাবো।"একটু দ্বিধা করলাম, "কিছু বলবো?"
"বল, কি বলবে, আজ আমি সব শুনবো।" বুকের ওপর মাথাটা রাখলো ও, জড়িয়ে ধরলো আরো জোরে।
কি করে বলবো? ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলাম মানসিক আবেগে। কথা বলা যে আমার পক্ষে অসম্ভব। ওর দিকে তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিলো।
"তুমি জানো, পুণা ছাড়ার পর আমি কি করেছিলাম? যেন, আমি দিল্লি ফিরে যেতে পারিনি?"
"তুমি গোয়া এসেছিলে, আমি জানি।"
আমি অবাক, "তুমি জানো? কেমন করে?"
আমি জানতাম তুমি দিল্লি ফিরে যাওনি, ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো।নিরুপায় হয়ে তোমার মোবাইল ট্র্যাক করেছিলাম।
"দুশ্চিন্তায় ছিলে? গত দু সপ্তাহ আমার ওপর দিয়ে কি গেছে তার কোনো ধারণা আছে তোমার? আমি দুশ্চিন্তায় ছিলাম না?
ও চুপ করে রইলো, দূরে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বললো, "জানি।"
আমি অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম অনেকক্ষন, "তুমি কেন ডেকেছো জানি না, শুধু ইন্সট্রাকশন ফলো করছি। এখানে এলাম, তোমাকে পেলাম, আনকোরা নতুন রূপে।
ব্র্যান্ড নিউ সুহাসিনী, একদম নিখুঁত, মোহময়ী, এই স্বপ্নের বাড়িতে।
পারফেক্ট।
তুমি আমাদের কথা বললে। তোমার জীবনের দর্শন, এই দর্শন, এই ফিলসফি, তাও নতুন, তোমার মতন। তুমি কথা বলছো, আমি সম্মোহিত হয়ে শুনছি। যেন কুহকের দেশে এসেছি, যেন ইন্দ্রজাল। মোহিনী মায়া এলো। আঃ! কি আবোল তাবোল বকছি।
কিন্তু জানো? এ তো সুহাস নয়। আমি এ কার দিকে তাকিয়ে আছি, কার কথা শুনছি? আমি তো চিনি না। তুমি সুন্দর, তুমি নতুন, তুমি সেই সব যা আমি চাই, কামনা করি। এলে হৃদয় শিকারে, কিন্তু তুমি আমার সে সুহাস নও।
ওর দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে, "কি বলছো গো তুমি, কি বলছো?"
খুব কষ্ট একটা বুকে, "তোমার কথা শুনলাম, আগে কখনো শুনিনি। আমরা দুজনে এক হয়ে গেছি, আমাদের সত্তা এক গেছে হয়ে আর সেটাই আমাদের জীবনে এনেছে বিপর্যয়। যাকে বলে সেন্ট্রাল কোর অফ বিশৃঙ্খলতা। কি জটিল তত্ত্ব। আমি বুঝি না, বুঝতে চাইও না। এই দৃষ্টিভঙ্গি নতুন।
তুমি চাইছিলে আমি রাগ করি। দুঃখিত নয়, ব্যথিত নয়, ক্ষমাশীল নয়। তোমার চোখে এই কয়েকটা বৈশিষ্ট আমাকে মানায় না, তুমি চিন্তিত। হতে পারে। কিন্তু আমার চিন্তাধারা, আমার উপলব্ধি, তার কি কোনো মূল্য আছে?
বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যেই আমরা একাত্ম হয়ে গেলাম। পরস্পরকে বরদাস্ত করতে লাগলাম, আরো সহিষ্ণু হলাম। নিজেদের প্রতি উদার হলাম, এক জন আর একজনের প্রতি যত্নবান হলাম। নিজেদের অজান্তেই ছোট ছোট আপোষ, ছোট ছোট রফা করলাম; সন্ধিস্থাপন হলো, যুদ্ধবিগ্রহ কমে গেলো।
কার জন্যে? আমাদের জন্যে। কাজটা কি খারাপ হলো? এই 'ছোটোখাটো ' দেয়ানেয়াগুলো করতে, আমাদের কি খুব অনুশোচনা হল? এই সামান্য স্যাক্রিফাইসগুলো আমাদের কি আরো কাছে নিয়ে আসেনি? আমি এতদিন তাই ভেবেছিলাম। আজ আমার মনে সংশয়, সবই কি ভুল?
তাই কোনো প্রশ্ন, কোনো জবাব চাইতে পারিনি। আমার মন বলেছিলো যে কোনো প্রশ্ন করাটা ভুল হবে কারণ আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে আমাদের একাত্মতাতেই, যা আমরা তৈরী করেছি অতি কষ্টে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে। কুড়ি বছরের চেষ্টায়। তাই তুমি যখন বললে চলে যেতে, আমি অবাক হলেও প্রশ্ন করতে পারলাম না। তুমি বলেছো, ব্যাস।
তুমি আমায় চলে যেতে বললে, আমি তোমাকে হারালাম। অন্তত, আমার তাই মনে হলো। তুমি বলছো আমার এই ধারণা অমূলক। সেদিন তা ছিলোনা কিন্তু।
তোমার মতে আমার রাগ না করাটাই তোমার দুখঃ। আর আমার কষ্ট কি জানো? তুমি আমাকে তোমার পাশে দাঁড়াতে দিলেনা। তোমার কষ্টে সান্তনা দেবার অধিকার আমার রইলো না। আমি পক্ষপাতদুষ্ট বিচারক!! ঠিকই বলেছো। আমি কি বিচার করবো? যে সারাজীবনটা কাটিয়ে দিলো এই সংসারটাকে সাজাতে, অনেক দুঃখ অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে তাকে আমি তড়িঘড়ি শাস্তি দেব। এটা তো নিরপেক্ষ বিচারকও করেন না। সত্যি বলতে কি আমার কাছে এটা অচিন্তনীয়, অপবিত্র, অশুচি।
তুমি আদিকে ভালোবাসো, ভালো কথা। তুমি আমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসো, সেটাও ভালো। আমরা জীবনসঙ্গী, পরস্পরের মালিক নই। তুমি কি ভাবছো বা আমার কি ভাবা উচিত তা সম্পূর্ণভাবে আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ নেই।
কিন্তু তুমি যখন বল যে ও তোমাকে আমার বিগত যৌবনের রূপটা মনে করিয়ে দেয়, তখন আমার অসম্পূর্ণতা, আমার খুঁত, আমার ত্রুটিগুলো, বড়ো করে আমার চোখে ধরা পরে। মজার কথা, এই ত্রুটিগুলোর উৎস, আমাদের নীতিগত প্রয়াস আর প্রচেষ্টার পরিনাম। হয়তো আমরা একটু এক্সট্রা সুখী হতে চেয়েছিলাম। ভুল করেছিলাম, অজান্তেই ।
সবারই একটা নিজস্ব মতবাদ বা ফিলসফি থাকতেই পারে, নয় কেন? আমার আছে কি? হয়তো আছে। কিন্তু তা প্রকাশ করার সাহস আমার নেই। কারণ, আমার সেই ভিন্ন ভাবনাধারা আমাদের এই দুজনের জীবনটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। তাই, এই আলোচনার কোনো প্রয়োজন নেই।
আজ সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়েছে, তোমাকে আমি ফিরে পেয়েছি। আমার প্রিয়া আজ আমার বুকে, চোখ বুজে তার চুলের গন্ধ আমি পাচ্ছি। চোখ খুলে আমি বার বার তাকে দেখছি আর ভাবছি । আমি যে মানুষটাকে জানতাম কুড়ি বছর ধরে, সে তো তুমি নও। চোখ খুলে যাকে দেখছি, সে মহিলা আমার অপরিচিত।
তুমি আজ যা চাও আমিও তাই চাই কিন্তু তা যেন হয় আমার সুহাসকে সঙ্গে রেখে। আমার সেই সুহাস যে কখনো কোনো বুদ্ধির খেলা জানতো না। যার একমাত্র মগজাস্ত্র ছিল তার বিশাল হৃদয়। আজ হটাৎ আমরা দুজন দুই মেরুর প্রাণী।
একদিন তুমি আমাকে ঘরছাড়া করেছিলে আজ আমি নিজেকে ঘর থেকে তাড়াচ্ছি। তোমার দেওয়া সেই টুথব্রাশ উপমাটা খুব উপযুক্ত মনে হচ্ছে। আসলে আমিই সেই ‘পুরোনো টুথব্রাশ’ যাকে ফেলে দিলে কেউ ফিরেও তাকাবে না।
আমার কথা ফুরালো। আমি বিপর্যস্ত। আমি ক্লান্ত।
ও আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে।নিজের মনেই তাকিয়ে আছে। দূরে কোথাও, কি দেখছে কে জানে!
আমি ব্যাগটা বের করে আনলাম। দুমিনিট লাগলো সব গোছাতে। এবার যাবার সময়।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে, একবার ফিরে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে, চোখে জল। মুখ ফিরিয়ে নিলাম, আমি নিস্তেজ হয়ে পড়ছি।
ও শুধু একটাই কথা বললো, "আমায় ক্ষমা করো, যেও না।"
আমি বেরিয়ে গেলাম।
পিন্টো অপেক্ষা করছে গাড়ি নিয়ে।