09-12-2020, 01:25 PM
5
শুনেছিলাম, চার্চের পাদ্রীরা কনফেশন শুনে থাকেন, কিন্তু আমি তো পাদ্রী নই। কি হবে আমার সত্যিটা শুনে?
উপায় তো নেই, মাথা নাড়লাম।
ও আমার কাছে এসে বসলো, হাতটা ধরে ছিল।
"সেই রাতে যখন তুমি আমাকে আদির সাথে দেখলে। সেটা প্রথমবার নয়। আমি আদিকে ভালোবাসি।
তোমার সাথে এই ২০ বছরের দীর্ঘ সময়, আজ এক প্রহেলিকা। জানো, প্রথম তিন বছর, আমরা দুজন দুই পৃথক, স্বতন্ত্র মানুষ, একসাথে থাকতাম মাত্র। পরবর্তী তিন বছরে আমরা চিনতে আরম্ভ করলাম নিজেদের, পরস্পরকেও। আমরা দুজন খুঁজলাম, ভালোবাসলাম, ভিন্নমতও হলাম। আমরা জোর ঝগড়া করতাম, কথা বন্ধ থাকতো, দুদিন পরই মিটমাট করে নিয়ে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতাম। কখনো দশদিন একটাও কথা হতো না আবার পরের দশদিন আমরা এক মন এক প্রাণ, এক দেহ। মনে আছে?
তুমি ট্যুর থেকে ফেরার দিন ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবতাম আজ কি পরব, কীভাবে সাজবো, কীভাবে তোমাকে চমকে দেব। তুমিও তাই ছিলে। একবার আমাকে ইমপ্রেস করতে একটা নকল 'রেব্যান' কিনেছিলে।
এই আবিষ্কারের দিনগুলো দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। আমাদের গ্রাস করলো ‘আদর্শ পরিবার’ নামক এক ভয়ানক ব্যাধি । হটাৎ লক্ষ করলাম যে আমাদের পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো গ্রহণযোগ্য হতে আরম্ভ করেছে। আইডিয়াটা ভালোই মনে হচ্ছে। আমাদের ঝগড়াঝাঁটি মন্ত্রবলে কমে গেলো। আমরা আদর্শ দম্পতি। আমি হলাম তুমি আর তুমি হলে আমি; আমাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র, আমাদের এন্টিটি হারিয়ে গেলো।
আমাদের এই একাত্ম হয়ে যাওয়াটা প্রভাব ফেললো আমাদের রোমান্সের ওপর। অফিস থেকে ফিরলে ভালো লাগে কিন্তু বুক ধড়ফড় করে না। আমরা পরস্পরের প্রতি যত্নবান হলাম কিন্তু ভুলে গেলাম প্রেম করতে। তোমার কথা ভাবতাম বেশি, তোমাকে ভালো দেখতে লাগছে কিনা, কি পরলে, চুল কাটলে কিনা তাই দেখতাম। ভুলে গেলাম নিজের কথা। কি করলে তুমি আমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না, ভ্রুক্ষেপই করতাম না; তুমিও তাই করলে। আমি সারাদিন একটা বেঢপ নাইটি আর তুমি খালি গায়ে একটা কদাকার বারমুডা পরে ভুঁড়ি বাগিয়ে ঘুরতে। আমার চোখে বা তোমার চোখে আমাদের যে দর্শনযোগ্য হওয়া উচিত, তা বেমালুম ভুলে গেলাম।
আমার পছন্দের জিনিস তোমার আজকাল বেশ ভালো লাগে। মজার কথা, তুমি অনেক কিছু বর্জন করেছো, কারণ আমি তা ভালোবাসি না। আমরাও ব্যাপারটা একই রকম। আমাদের দুই সত্তা রীতিমতো কোল্যাপ্স করে এক হয়ে গেছে। আমাদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, পছন্দ, অপছন্দ সব এক! আমাদের আর তর্ক বিতর্ক হয় না, দুরকম তো ভাবিনা আর। দুজনেরই বক্তব্য এক। যেমন রঞ্জু বলে, 'তোমাদের দুজনেরই এক রা।'
কি ভয়াবহ পরিস্থিতি। কিন্তু সমাজের চোখে? আমরা 'ওয়েল এডজাস্টেড কাপল'; খাপ খাওয়া দম্পতি। "
সুহাসিনী চুপ করলো। ও কি বলছে? আমি তো জানতাম আমাদের বিবাহিত জীবন পারফেক্ট। সবই তাহলে মিথ্যা? রূপকথা?
ও আমার হাত ছেড়ে বারান্দার রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলো, আমি সঙ্গে গেলাম। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের ওপর। আজ আরব মহাসাগর শান্ত।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন ও কী যেন ভাবলো তারপর আবার ও বলতে শুরু করলো, "সেইভাবেই, আমার লজ্জা আজ তোমার। তুমি আমাকে আদির সঙ্গে এক বিছানায় ধরে ফেললে। লজ্জা পেলে বেশি, রাগ করলে কম । লজ্জাটা আমার একার হওয়ার কথা ছিল, অথচ তুমি লজ্জিত হলে আমার তরফ থেকে, on my behalf । তুমি বেশি বিব্রত, যেন দোষটা তোমার; না জানিয়ে নিজের বাড়িতে এসে গেছো।
অসভ্য ছেলেকে বাঁচাতে বাবা যা করে তুমি তাই করলে, দোষটা ঢাকলে। অবৈধ প্রণয়ী বা নষ্ট স্ত্রীর ওপর স্বামীর রাগে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার অধিকার তুমি দাবি করলে না।
তুমি আদিকে কিছুই বললে না। ওকে শান্তভাবে ছেড়ে এলে। এমন ভাব করলে যেন ও একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। 'সিলি মিসটেক,' যা উপেক্ষা করা চলে।
কখনো তোমাকে জিন্স পরে ঘুমাতে দেখিনি, আরামের ব্যাপারে তুমি বেশ পিটপিটে। সারারাত অস্বস্তিতে, ঘুম হলো না। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না, এ আমি কী করলাম? আমার সবসময় নিজের সংযমের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গর্ব ছিল, আমি কেন এটা ভাঙতে দিলাম। রাগে দুঃখে আমি কাঁদলাম, কিন্তু কোনো সান্তনা? নাঃ, পেলাম না। আমি হেরে গেলাম।
দিনভর তুমি আমাকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলে, আমার দুঃখ তাতে হাজারগুণ বেড়ে গেলো। তুমি যদি রাগ করতে, জবাব চাইতে তাহলেও একটা কথা ছিল। তোমার চোখে রাগের চিহ্নমাত্র ছিল না, শুধু বিষন্নতা আর ভয়!! কেন? আমাকে হারাবার?
আমার দোষটা তোমার কাছে গৌণ, যেন কোনো ব্যাপারই নয়। আমাকে কোনো প্রশ্ন নয়। আদির সাথে আমার কি সম্পর্ক, তাও তোমার জানার কোনো আগ্রহ নেই। তুমি ভীত, যদি আমি বলি, আমি চলে যাবো। যদি তাই বলতাম, তুমি যেতে দিতে, আমার ভালো লাগাতেই যে তোমার ভালো লাগা! আর তোমার খারাপ লাগা? কোনো ব্যাপারই নয়।
জানো, আমি সেই 'পুরোনো টুথব্রাশ', অনেকদিন ধরে আছি তোমার জীবনে, মায়া পড়ে গেছে, ফেলে দিতে পারছো না। যদিও কোনো কাজেরই নয়। তবু গুছিয়ে রেখে দিয়েছো, সেন্টিমেন্টের ব্যাপার; অভ্যাস।"
ওর গলাটা যেন ভেঙে আসছে? অনুভব করতে পারছি। কেন ও নিজেকে এতো ঘৃণা করে? আমি করি না।
ও খুব কষ্টে, কথা বলতে পারছে না আর, তবুও জোর করে ....
"যতবার তোমার দেওয়া গিফটটা দেখেছি, ততবার মনটা বিকল হয়েছে, নিজের কর্মের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। বেশি কিছু ভাবতে হয়নি। আদি অল্পবয়সী, তরুণ, আমাকে ভালোবাসে। আমার জন্য সব করতে পারে, এমনকি মারাত্মক কিছুও, হতে পারে অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক।
আর তুমি, তোমার অস্তিত্ব আমার প্রেমিক হিসেবে অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি নিজের হাতে, সেই সুইচটা অফ করে দিয়েছিলাম। তুমি আমি তো এক। কিন্তু আদি? আমার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে, প্রচন্ড আবেগ সৃষ্টি করতে পারে। আমার সমস্ত সংযম, সমস্ত নিয়ন্ত্রণ নিমেষের মধ্যে ধূলিসাৎ করে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে রাখে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষমতা, যা আমার সমস্ত সংকল্প ভেঙে দেয়।
সেদিন কতবার চেয়েছি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, সেই পুরোনো দিনের মতো। কতবার ভেবেছি কাঁধে মাথা রেখে কাঁদি, ক্ষমা চাই অকপটে। কিন্তু তোমার চোখের দৃষ্টি, সেই দুঃখ, আমাকে থামিয়েছে। আমি জানতাম, তুমি সম্পূর্ণভাবে একমত হবে আমি যাই বলি না কেন। যা জবাবদিহি দেব, যা সত্যি, যা মিথ্যা বলবো, তা তুমি একবাক্যে মেনে নেবে। তোমার আদালতে আমি সবসময় নিরপরাধী, কারণ তুমি একচোখো, পক্ষপাতদুষ্ট হাকিম। তুমি কোনো বিচারকই নও, তোমার বিচার বিচারই নয়। “
স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। আমি পক্ষপাতদুষ্ট? আমি? জীবনের এক নতুন পরিচ্ছেদ যোগ হলো বটে। নতুন করে চিনছি নিজেকে।
"সেই রবিবার, যখন তোমাকে চলে যেতে বললাম, সেদিন প্রথমবার তোমার চোখে রাগ ফুটে উঠলো। রাগ, ঘৃণা নয়। তুমি আমাকে উপহারের কথা জিজ্ঞাসা করলে। ওটা কি ফিরিয়ে দিতে পারি, তোমার স্পর্শ যে আছে তার মধ্যে। তার কি কোনো দাম হয়?
আর রঞ্জু? ও আমার সন্তান, আমার রক্ত, ওর আর আমার মধ্যে নয় মাসের সংযোগ। ও আমার প্রাণ কিন্তু আমার দুর্বলতা বা অক্ষমতা নয়। কখনোই নয়। আমি ওকে কোনো জবাবদিহি দিতে বাধ্য নই।
কিন্তু তোমার কাছে? আমি বাধ্য। আমরা দুজন, যাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই; এক হয়েছিলাম সমাজের এক অলঙ্ঘনীয় বন্ধনে, শপথ করেছিলাম যে এর মর্যাদা রক্ষা করবো। আমি পারিনি।
আমি প্রতারক, তুমি জানো। রঞ্জু জানে বা না জানে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আমি ওর মা, এক ভুলেভরা, অপূর্ণ মেয়েলোক। ঈশ্বর নই।
আমার বিষয়ে ওর ধারণা যা খুশি হতে পারে। কিন্তু তুমি কি ভাব আমার বিষয়ে আর আমি নিজের বিষয়ে কি ভাবি সেটাই জরুরি, সেটাই সমস্যা।
আমি আদিকেই কেন পছন্দ করলাম। অনেক ভেবেও এর উত্তর পাইনি। আজ দূর থেকে যখন দেখলাম তুমি আসছো সেই মুহূর্তে ধাঁধাটার সমাধান খুঁজে পেলাম। তোমাকে ওই জ্যাকেটে কি ভীষণ ফিট, হ্যান্ডসম আর ভালো দেখাচ্ছিলো। আমি উপলব্ধি করলাম যে আমি আদিকে দেখতে পাচ্ছি। তোমার ক্লোন, আদি তোমার যৌবনের রূপ। আমার অবচেতন মন আদির মধ্যে তোমাকে দেখতে পেয়েছিলো।
কিন্তু তাতে আমার অপরাধ কিছুমাত্র কম হয় কি? হয় না, হতে পারে না। কখনোই না।
সুহাস আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো, অস্ফুটস্বরে বললো, " আজ, আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই, আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত রূপ, সমস্ত দোষী হৃদয়ের অন্তঃস্থল দিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমার সেই বিচারকের কাছে নির্লজ্জ হয়ে মিনতি করি। আমায় ক্ষমা করো। আমার আত্মসমর্থনের যোগ্যতা নেই। অনুরোধ মাত্র, এই ঠক বেহায়া মেয়েমানুষটাকে যদি মার্জনা করো।
সমুদ্রের গর্জন যেন বেড়ে গেছে, জোয়ার এলো কি? ভোর হয়ে আসছে। সুহাস হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ওকে তুলে ধরলাম, আমার বুকের কাছে, কি সুন্দর ওর মুখটা, গভীর চুমুতে ভরিয়ে দিলাম ওকে।
ওর চোখের কোনে জল।
শুনেছিলাম, চার্চের পাদ্রীরা কনফেশন শুনে থাকেন, কিন্তু আমি তো পাদ্রী নই। কি হবে আমার সত্যিটা শুনে?
উপায় তো নেই, মাথা নাড়লাম।
ও আমার কাছে এসে বসলো, হাতটা ধরে ছিল।
"সেই রাতে যখন তুমি আমাকে আদির সাথে দেখলে। সেটা প্রথমবার নয়। আমি আদিকে ভালোবাসি।
তোমার সাথে এই ২০ বছরের দীর্ঘ সময়, আজ এক প্রহেলিকা। জানো, প্রথম তিন বছর, আমরা দুজন দুই পৃথক, স্বতন্ত্র মানুষ, একসাথে থাকতাম মাত্র। পরবর্তী তিন বছরে আমরা চিনতে আরম্ভ করলাম নিজেদের, পরস্পরকেও। আমরা দুজন খুঁজলাম, ভালোবাসলাম, ভিন্নমতও হলাম। আমরা জোর ঝগড়া করতাম, কথা বন্ধ থাকতো, দুদিন পরই মিটমাট করে নিয়ে ভীষণ ভীষণ ভালোবাসতাম। কখনো দশদিন একটাও কথা হতো না আবার পরের দশদিন আমরা এক মন এক প্রাণ, এক দেহ। মনে আছে?
তুমি ট্যুর থেকে ফেরার দিন ঘন্টার পর ঘন্টা ভাবতাম আজ কি পরব, কীভাবে সাজবো, কীভাবে তোমাকে চমকে দেব। তুমিও তাই ছিলে। একবার আমাকে ইমপ্রেস করতে একটা নকল 'রেব্যান' কিনেছিলে।
এই আবিষ্কারের দিনগুলো দ্রুত ফুরিয়ে গেলো। আমাদের গ্রাস করলো ‘আদর্শ পরিবার’ নামক এক ভয়ানক ব্যাধি । হটাৎ লক্ষ করলাম যে আমাদের পরস্পরের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো গ্রহণযোগ্য হতে আরম্ভ করেছে। আইডিয়াটা ভালোই মনে হচ্ছে। আমাদের ঝগড়াঝাঁটি মন্ত্রবলে কমে গেলো। আমরা আদর্শ দম্পতি। আমি হলাম তুমি আর তুমি হলে আমি; আমাদের নিজেদের স্বাতন্ত্র, আমাদের এন্টিটি হারিয়ে গেলো।
আমাদের এই একাত্ম হয়ে যাওয়াটা প্রভাব ফেললো আমাদের রোমান্সের ওপর। অফিস থেকে ফিরলে ভালো লাগে কিন্তু বুক ধড়ফড় করে না। আমরা পরস্পরের প্রতি যত্নবান হলাম কিন্তু ভুলে গেলাম প্রেম করতে। তোমার কথা ভাবতাম বেশি, তোমাকে ভালো দেখতে লাগছে কিনা, কি পরলে, চুল কাটলে কিনা তাই দেখতাম। ভুলে গেলাম নিজের কথা। কি করলে তুমি আমার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারবে না, ভ্রুক্ষেপই করতাম না; তুমিও তাই করলে। আমি সারাদিন একটা বেঢপ নাইটি আর তুমি খালি গায়ে একটা কদাকার বারমুডা পরে ভুঁড়ি বাগিয়ে ঘুরতে। আমার চোখে বা তোমার চোখে আমাদের যে দর্শনযোগ্য হওয়া উচিত, তা বেমালুম ভুলে গেলাম।
আমার পছন্দের জিনিস তোমার আজকাল বেশ ভালো লাগে। মজার কথা, তুমি অনেক কিছু বর্জন করেছো, কারণ আমি তা ভালোবাসি না। আমরাও ব্যাপারটা একই রকম। আমাদের দুই সত্তা রীতিমতো কোল্যাপ্স করে এক হয়ে গেছে। আমাদের ভালো লাগা, খারাপ লাগা, পছন্দ, অপছন্দ সব এক! আমাদের আর তর্ক বিতর্ক হয় না, দুরকম তো ভাবিনা আর। দুজনেরই বক্তব্য এক। যেমন রঞ্জু বলে, 'তোমাদের দুজনেরই এক রা।'
কি ভয়াবহ পরিস্থিতি। কিন্তু সমাজের চোখে? আমরা 'ওয়েল এডজাস্টেড কাপল'; খাপ খাওয়া দম্পতি। "
সুহাসিনী চুপ করলো। ও কি বলছে? আমি তো জানতাম আমাদের বিবাহিত জীবন পারফেক্ট। সবই তাহলে মিথ্যা? রূপকথা?
ও আমার হাত ছেড়ে বারান্দার রেলিঙের দিকে এগিয়ে গেলো, আমি সঙ্গে গেলাম। চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে সমুদ্রের ওপর। আজ আরব মহাসাগর শান্ত।
সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন ও কী যেন ভাবলো তারপর আবার ও বলতে শুরু করলো, "সেইভাবেই, আমার লজ্জা আজ তোমার। তুমি আমাকে আদির সঙ্গে এক বিছানায় ধরে ফেললে। লজ্জা পেলে বেশি, রাগ করলে কম । লজ্জাটা আমার একার হওয়ার কথা ছিল, অথচ তুমি লজ্জিত হলে আমার তরফ থেকে, on my behalf । তুমি বেশি বিব্রত, যেন দোষটা তোমার; না জানিয়ে নিজের বাড়িতে এসে গেছো।
অসভ্য ছেলেকে বাঁচাতে বাবা যা করে তুমি তাই করলে, দোষটা ঢাকলে। অবৈধ প্রণয়ী বা নষ্ট স্ত্রীর ওপর স্বামীর রাগে উন্মাদ হয়ে যাওয়ার অধিকার তুমি দাবি করলে না।
তুমি আদিকে কিছুই বললে না। ওকে শান্তভাবে ছেড়ে এলে। এমন ভাব করলে যেন ও একটা ছোট্ট ভুল করে ফেলেছে। 'সিলি মিসটেক,' যা উপেক্ষা করা চলে।
কখনো তোমাকে জিন্স পরে ঘুমাতে দেখিনি, আরামের ব্যাপারে তুমি বেশ পিটপিটে। সারারাত অস্বস্তিতে, ঘুম হলো না। আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিলাম না, এ আমি কী করলাম? আমার সবসময় নিজের সংযমের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, গর্ব ছিল, আমি কেন এটা ভাঙতে দিলাম। রাগে দুঃখে আমি কাঁদলাম, কিন্তু কোনো সান্তনা? নাঃ, পেলাম না। আমি হেরে গেলাম।
দিনভর তুমি আমাকে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলে, আমার দুঃখ তাতে হাজারগুণ বেড়ে গেলো। তুমি যদি রাগ করতে, জবাব চাইতে তাহলেও একটা কথা ছিল। তোমার চোখে রাগের চিহ্নমাত্র ছিল না, শুধু বিষন্নতা আর ভয়!! কেন? আমাকে হারাবার?
আমার দোষটা তোমার কাছে গৌণ, যেন কোনো ব্যাপারই নয়। আমাকে কোনো প্রশ্ন নয়। আদির সাথে আমার কি সম্পর্ক, তাও তোমার জানার কোনো আগ্রহ নেই। তুমি ভীত, যদি আমি বলি, আমি চলে যাবো। যদি তাই বলতাম, তুমি যেতে দিতে, আমার ভালো লাগাতেই যে তোমার ভালো লাগা! আর তোমার খারাপ লাগা? কোনো ব্যাপারই নয়।
জানো, আমি সেই 'পুরোনো টুথব্রাশ', অনেকদিন ধরে আছি তোমার জীবনে, মায়া পড়ে গেছে, ফেলে দিতে পারছো না। যদিও কোনো কাজেরই নয়। তবু গুছিয়ে রেখে দিয়েছো, সেন্টিমেন্টের ব্যাপার; অভ্যাস।"
ওর গলাটা যেন ভেঙে আসছে? অনুভব করতে পারছি। কেন ও নিজেকে এতো ঘৃণা করে? আমি করি না।
ও খুব কষ্টে, কথা বলতে পারছে না আর, তবুও জোর করে ....
"যতবার তোমার দেওয়া গিফটটা দেখেছি, ততবার মনটা বিকল হয়েছে, নিজের কর্মের বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি। বেশি কিছু ভাবতে হয়নি। আদি অল্পবয়সী, তরুণ, আমাকে ভালোবাসে। আমার জন্য সব করতে পারে, এমনকি মারাত্মক কিছুও, হতে পারে অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক।
আর তুমি, তোমার অস্তিত্ব আমার প্রেমিক হিসেবে অনেক আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমি নিজের হাতে, সেই সুইচটা অফ করে দিয়েছিলাম। তুমি আমি তো এক। কিন্তু আদি? আমার শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে, প্রচন্ড আবেগ সৃষ্টি করতে পারে। আমার সমস্ত সংযম, সমস্ত নিয়ন্ত্রণ নিমেষের মধ্যে ধূলিসাৎ করে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। সে রাখে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষমতা, যা আমার সমস্ত সংকল্প ভেঙে দেয়।
সেদিন কতবার চেয়েছি তোমাকে জড়িয়ে ধরতে, সেই পুরোনো দিনের মতো। কতবার ভেবেছি কাঁধে মাথা রেখে কাঁদি, ক্ষমা চাই অকপটে। কিন্তু তোমার চোখের দৃষ্টি, সেই দুঃখ, আমাকে থামিয়েছে। আমি জানতাম, তুমি সম্পূর্ণভাবে একমত হবে আমি যাই বলি না কেন। যা জবাবদিহি দেব, যা সত্যি, যা মিথ্যা বলবো, তা তুমি একবাক্যে মেনে নেবে। তোমার আদালতে আমি সবসময় নিরপরাধী, কারণ তুমি একচোখো, পক্ষপাতদুষ্ট হাকিম। তুমি কোনো বিচারকই নও, তোমার বিচার বিচারই নয়। “
স্তব্ধ হয়ে বসে আছি। আমি পক্ষপাতদুষ্ট? আমি? জীবনের এক নতুন পরিচ্ছেদ যোগ হলো বটে। নতুন করে চিনছি নিজেকে।
"সেই রবিবার, যখন তোমাকে চলে যেতে বললাম, সেদিন প্রথমবার তোমার চোখে রাগ ফুটে উঠলো। রাগ, ঘৃণা নয়। তুমি আমাকে উপহারের কথা জিজ্ঞাসা করলে। ওটা কি ফিরিয়ে দিতে পারি, তোমার স্পর্শ যে আছে তার মধ্যে। তার কি কোনো দাম হয়?
আর রঞ্জু? ও আমার সন্তান, আমার রক্ত, ওর আর আমার মধ্যে নয় মাসের সংযোগ। ও আমার প্রাণ কিন্তু আমার দুর্বলতা বা অক্ষমতা নয়। কখনোই নয়। আমি ওকে কোনো জবাবদিহি দিতে বাধ্য নই।
কিন্তু তোমার কাছে? আমি বাধ্য। আমরা দুজন, যাদের রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই; এক হয়েছিলাম সমাজের এক অলঙ্ঘনীয় বন্ধনে, শপথ করেছিলাম যে এর মর্যাদা রক্ষা করবো। আমি পারিনি।
আমি প্রতারক, তুমি জানো। রঞ্জু জানে বা না জানে তা নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।
আমি ওর মা, এক ভুলেভরা, অপূর্ণ মেয়েলোক। ঈশ্বর নই।
আমার বিষয়ে ওর ধারণা যা খুশি হতে পারে। কিন্তু তুমি কি ভাব আমার বিষয়ে আর আমি নিজের বিষয়ে কি ভাবি সেটাই জরুরি, সেটাই সমস্যা।
আমি আদিকেই কেন পছন্দ করলাম। অনেক ভেবেও এর উত্তর পাইনি। আজ দূর থেকে যখন দেখলাম তুমি আসছো সেই মুহূর্তে ধাঁধাটার সমাধান খুঁজে পেলাম। তোমাকে ওই জ্যাকেটে কি ভীষণ ফিট, হ্যান্ডসম আর ভালো দেখাচ্ছিলো। আমি উপলব্ধি করলাম যে আমি আদিকে দেখতে পাচ্ছি। তোমার ক্লোন, আদি তোমার যৌবনের রূপ। আমার অবচেতন মন আদির মধ্যে তোমাকে দেখতে পেয়েছিলো।
কিন্তু তাতে আমার অপরাধ কিছুমাত্র কম হয় কি? হয় না, হতে পারে না। কখনোই না।
সুহাস আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো, অস্ফুটস্বরে বললো, " আজ, আমি তোমাকে ফিরে পেতে চাই, আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত রূপ, সমস্ত দোষী হৃদয়ের অন্তঃস্থল দিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি। আমার সেই বিচারকের কাছে নির্লজ্জ হয়ে মিনতি করি। আমায় ক্ষমা করো। আমার আত্মসমর্থনের যোগ্যতা নেই। অনুরোধ মাত্র, এই ঠক বেহায়া মেয়েমানুষটাকে যদি মার্জনা করো।
সমুদ্রের গর্জন যেন বেড়ে গেছে, জোয়ার এলো কি? ভোর হয়ে আসছে। সুহাস হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।
ওকে তুলে ধরলাম, আমার বুকের কাছে, কি সুন্দর ওর মুখটা, গভীর চুমুতে ভরিয়ে দিলাম ওকে।
ওর চোখের কোনে জল।