09-12-2020, 01:23 PM
4
আমার কাছে আদৌ কি কোনো বিকল্প আছে? অনুনয় বিনয় করার সময় পেরিয়ে গেছে। দিল্লি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। রঞ্জুর প্রশ্নের উত্তর আপাতত আমার কাছে নেই! তাছাড়া আমার দ্বারা লুকোচুরি হয় না।
কিন্তু এখানে আর থাকা যাবে না, কোনোমতেই। নটার মধ্যেই তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেলাম। কয়েকটা মাত্র কথা হলো আমাদের মধ্যে।
"আই প্যাডটা ফেরত নিয়ে যাবো কি?"
"ওরা কি ফেরত নেবে?"
"না।"
"তবে রেখে যাও।"
কোনো বাই বাই' কোনো হাত ধরা বা নিদেন পক্ষে, "পৌঁছে ফোন করে দিও" কিছুই হলো না।
কি মনে হয়? আমাকে লাথি মেরে তাড়ালো?
নিশ্চয়ই!
দোষটা কি আমার?
কক্ষনোই না!
এই অপমান কি আমার প্রাপ্য?
না, না, না।
একটা অটোরিকশা নিয়ে স্টেশন চলে গেলাম। অনেকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই। স্টেশনের বাইরে একটা ড্রাইভার প্যাসেঞ্জার খুঁজছে। বসে গেলাম। এক সহযাত্রী দুএকটা ছোটোখাটো প্রশ্ন করলো। আমি উত্তর দিলাম না।
দু দিন এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ালাম। মঙ্গলবার সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছালাম। রঞ্জু দরজা খুলে দিলো।
"মা’র আই প্যাডটা পছন্দ হলো?" ওর উৎসাহিত প্রশ্ন।
"খুব!"
"তুমি সব ফীচারগুলো দেখিয়েছো তো, তোমার তো অর্ধেক কথা মনে থাকে না?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ দেখিয়েছি, তুই আমাকে কি মনে করিস বল তো?" আমি বিরক্ত।
রঞ্জু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওর ফোন বেজে উঠলো? আমি ছাড়া পেলাম।
গতানুগতিক জীবন, কোনো উত্তেজনা নেই; দিনগত পাপক্ষয়। কিছুই বদলায়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় যে 'বদল' শব্দটা আমার রোজনামচায় একটা 'অবসেশন ' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দু সপ্তাহ কেটেছে, তার কোনো খবর নেই। আমি পাগলের মতো চুপি চুপি প্রতিটি বৈদ্যুতিন ঠিকানা চেক করি, প্রতিদিন। কিছু নেই। নিরুৎসাহ হয়ে পড়ছি। আজ আবার মঙ্গলবার, ঠিক চোদ্দদিন হলো। একটা ছোট্ট মেসেজ, 'চেক মেল্ '!
তড়িঘড়ি করে মেল্ খুললাম। একটা মেসেজ আর একটা এটাচমেন্ট।
"কিছদিনের ছুটি নিয়ে আসবে? জন পিন্টো এয়ারপোর্টে থাকবে।"
সঙ্গে প্লেনের টিকিট; ডাবোলিম, গোয়া ।
আমার হাতে চব্বিশ ঘন্টা, এসবের মানে কি? গোয়া কেন? যাই হোক, একটা 'ওকে' বার্তা পাঠিয়ে দিলাম।
ছুটি পেতে কোনো সমস্যা হলনা। রঞ্জুকে ফোনে করে জানালাম যে একটা বিশেষ সরকারি দরকারে আমাকে যেতে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ, ও কোনো অস্বস্তিকর জেরা করলো না। বিকালে আমরা দিল্লির 'সাকেত" মলে ডিনার করতে গেলাম। সামনেই 'ফ্যাবিন্ডিয়া', ঢুকে পড়লাম; একটা জ্যাকেট চোখে লেগে গেলো, রঞ্জুকে দেখলাম। ও চট করে দামটা দেখে ভুরুটাকে ছাত পর্যন্ত তুলে দিলো। যেমন মা তেমনি মেয়ে। চুলোয় যাক দাম, কিনে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম রঞ্জু আড়চোখে আমাকে দেখছে।
কাকভোরের এই অদ্ভুত আকস্মিক যাত্রা আমাকে চিন্তা করার পাথেয় যোগালো। কেমন যেন রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার। অনেকটা কিরীটি রায়ের গল্প। জন পিন্টো (নির্ঘাত দুঁদে পর্তুগিজ ডাকাত) আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? চোখটা কি বাঁধবে? তারপর? নিজের মনেই হেসে ফেললাম! পাশের ভদ্রলোক কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি একটু লজ্জা পেতেই উনি হেসে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনিও হয়তো কোনো রোমাঞ্চের পেছনে ধাওয়া করে চলেছেন!! সূর্যের প্রথম আলো আমার উত্তেজনা অনেকটা বাড়িয়ে তুললো।
ডাবোলিম এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিলাম। মুখে চুরুট, চোখে গগলস আর বিশাল দেহধারী লোকের সন্ধান করছিলাম। কৈ? নেই তো! একটা চটি পড়া প্যাংলা টেকো লোক একটা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে আমার নামের বানান ভুল। 'পিন্টো' বলে হাঁক দিতেই সেই ভয়ঙ্কর ‘চটি পড়া’ গ্যাংস্টার আমার দিকে এগিয়ে এলো, মুখে হাসি। খোঁয়াড়ি সবে ভেঙেছে বলে বোধ হলো। এসেই সে বললো, 'নাস্তা করিঙ্গা ক্যা?"
একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে গাড়ি আমাকে গোয়ার দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে চলেছে। পিন্টো সাহেব দুঃখ করলেন, আজকালকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর দল 'ফেনি'র গুণমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আগে আধ বোতলে যা নেশা হতো আজ দু বোতলেও তা হয় না। গোয়া উচ্ছন্নে গেছে। ওনার হা-হুতাশে সায় দিলাম, পাছে ঘুমিয়ে না পড়েন। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি যে আমরা কোথায় যাচ্ছি, তারপর ভাবলাম দেখাই যাক না এই রাস্তার শেষ কোথায়।
মারগাও পার হতেই আমার সন্দেহ হলো যে আমার গন্তব্যস্থল আমাদের এক অনেক পুরোনো জায়গা। বহু বছর আগে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর ক্যানকোনা আসতেই আমার মনে পড়ে গেলো আমাদের সেই পালোলেম বীচ, সেই আশ্চর্য সুন্দর জায়গা, যা কুড়ি বছর আগে আমরা খুঁজে বার করেছিলাম। আমাদের দাম্পত্য স্বপ্নের পূর্ণতা এখানেই, 'ডি'সুজার শ্যাকে।' 'এনচ্যান্টিং' সন্ধ্যার মাধুর্য্ আর সবথেকে বড় কথা যে এখানে পর্যটকদের ভীড় কম। যেমন ছিল তেমনি আছে। পিন্টোকে বললাম আমাকে এখানেই ছাড়তে, আমি জানি কোথায় যেতে হবে।
"তুমকো ডি'সুজা কা শ্যাক মালুম হ্যায় ক্যা?" পিন্টোর সওয়াল।
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। পিন্টো একটা জীর্ণ কার্ড বের করে খুব নম্রভাবে বললো, "কার মাংতা তো ফোন করনে কা, পন রাত কো ছোড়কর ।" তারপর একটু ঝুঁকে বললো, "থোড়া ফেনি চলতা ক্যা?"
মাথাটা নাড়িয়ে বীচের ওপর হাঁটতে লাগলাম। পিন্টো উত্তম ফেনির সন্ধানে হাওয়া হয়ে গেলো।
এইবার, আসল কাজ।
ডিসুজার শ্যাকে পৌঁছতে মুহূর্তেকের জন্যে অবাক... সময় কি এখানে থমকে আছে? কুড়ি বছর আগে যেমনটি ছিল, এখনও সেই...
ডি'সুজার শ্যাকে একটা চমৎকার গাজীবো, দূর থেকে দেখতে পেলাম এক মহিলার আবছায়া অবয়ব, রঙিন কাপড়ে ঢাকা। রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। প্রায় পাঁচ মিনিট লাগলো হেঁটে পৌঁছাতে; এক্কেবারে সুহাসিনীর মুখোমুখি। অসম্ভব সুন্দরী দেখতে লাগছিলো ওকে। সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। ওর চুল, ওর জামাকাপড়, ওর হাঁটা চলা, সব।
ও নেমে এলো আমার সামনে, একটু হেসে ঝুঁকে আমার জ্যাকেটটা স্পর্শ করে অস্ফুটস্বরে বললো, "সুন্দর!"
আমি হতবাক, কি বলবো, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো।
আমার অবস্থাটা ও ভালোই বুঝলো, আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন দেখাচ্ছে আমায়?"
ভেবেচিন্তে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম, "পরস্ত্রী।"
ও হেসে গড়িয়ে পড়লো, খুব খুশি। ওর মোহময় কণ্ঠস্বর, অঙ্গনারূপ, সংযম হারানোর পক্ষে যথেষ্ট।
ও হাত ধরে আমাকে টেনে নিলো সিঁড়ির ওপর, দুটো কৌচ পাশাপাশি রাখা। আমাকে শুইয়ে দিলো আর পেছন থেকে আমার চুলের ভেতরে ওর আঙ্গুলগুলো অনুভব করলাম। আঃ, কি আরাম। আস্তে আস্তে কপালটা টিপতে লাগলো, আমার চোখ বুজে আসছে। ওর চুলের গন্ধ, ওর নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর, কানে কানে আমাকে বললো, "কেমন আছো গো?"
চোখ খুলে তাকালাম ওর সুন্দর মুখের দিকে, কথা ফুটলো না। আমার এ কি অবস্থা!
ও অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথায় হাত বুলোতে থাকলো। কোনো কথা নেই কারো মুখে।
সামনে বিশাল সমুদ্র, গাঢ় নীল রঙের খেলা চলছে বুকের ওপর, তবু প্রশান্ত। শান্ত আমরাও। আলোড়ন যা, সবই প্রচ্ছন্ন, লুক্কায়িত।
আজ সব কিছুই নিখুঁত, যেন নিৰ্ভুল সুরের মূর্ছনা। পরিবেশ, স্বাচ্ছন্দ্য, আবহাওয়া এবং এই মোহময়ী সুন্দরী নারী... আমার নারী।
প্রকৃতির নিয়মে এলো মধুর সন্ধ্যা যার উজ্জ্বল রঙের ঝলকানি ঢেলে দিলো গলানো সোনা। সন্ধ্যা বদলে হলো রাত; সমুদ্র পাল্টালো, ধীরগতিতে নামলো অন্ধকার!
দুজনে পাশাপাশি বসে। সুহাসিনী আজ মুহূর্তের জন্যেও আমার হাত ছাড়েনি, আঁকড়ে ধরে আছে। চোখ বন্ধ করে আমি এই নতুন নারীর স্পর্শ অনুভব করেছি আজ, আমার কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো নিবেদন নেই। ও নিঃসন্দেহে আমারই। কবিকল্পিত, অবাস্তব, কাল্পনিক। এ কোন স্বপ্ন?
রাত আরো অন্ধকার, আরো গাঢ, দুজন মানুষ, নির্বাক, শব্দহীন। শুধু সৈকতে ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জন। মধুর গর্জন!
আজ আমার কোনো রাগ, অভিমান, কিছু নেই। আজ এক নতুন জীবন।আজ আমি ফিরে পেতে চাই আমার সুহাসকে। সেই কুড়ি বছরের সুহাসকে।
আমি টেনে নিলাম ওকে আমার কাছে। ও বাধা দিলো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম!
একটু তাকিয়ে ওই আমাকে বুকে টেনে নিলো, আমার ঠোঁটে আলতো চুমু খেলো, "তোমাকে আমি কিছু বলবো।শুনবে?"
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, "কি দরকার সুহাস, কি বলবে?"
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। তারপর কান্না ভেজা গলায় বললো, "আজ তোমার সুহাস, তোমায় সত্যিটা বলবে।"
আমার কাছে আদৌ কি কোনো বিকল্প আছে? অনুনয় বিনয় করার সময় পেরিয়ে গেছে। দিল্লি ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। রঞ্জুর প্রশ্নের উত্তর আপাতত আমার কাছে নেই! তাছাড়া আমার দ্বারা লুকোচুরি হয় না।
কিন্তু এখানে আর থাকা যাবে না, কোনোমতেই। নটার মধ্যেই তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেলাম। কয়েকটা মাত্র কথা হলো আমাদের মধ্যে।
"আই প্যাডটা ফেরত নিয়ে যাবো কি?"
"ওরা কি ফেরত নেবে?"
"না।"
"তবে রেখে যাও।"
কোনো বাই বাই' কোনো হাত ধরা বা নিদেন পক্ষে, "পৌঁছে ফোন করে দিও" কিছুই হলো না।
কি মনে হয়? আমাকে লাথি মেরে তাড়ালো?
নিশ্চয়ই!
দোষটা কি আমার?
কক্ষনোই না!
এই অপমান কি আমার প্রাপ্য?
না, না, না।
একটা অটোরিকশা নিয়ে স্টেশন চলে গেলাম। অনেকটা উদ্দেশ্যহীন ভাবেই। স্টেশনের বাইরে একটা ড্রাইভার প্যাসেঞ্জার খুঁজছে। বসে গেলাম। এক সহযাত্রী দুএকটা ছোটোখাটো প্রশ্ন করলো। আমি উত্তর দিলাম না।
দু দিন এলোমেলোভাবে ঘুরে বেড়ালাম। মঙ্গলবার সন্ধ্যার ফ্লাইটে দিল্লি পৌঁছালাম। রঞ্জু দরজা খুলে দিলো।
"মা’র আই প্যাডটা পছন্দ হলো?" ওর উৎসাহিত প্রশ্ন।
"খুব!"
"তুমি সব ফীচারগুলো দেখিয়েছো তো, তোমার তো অর্ধেক কথা মনে থাকে না?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ দেখিয়েছি, তুই আমাকে কি মনে করিস বল তো?" আমি বিরক্ত।
রঞ্জু একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
ওর ফোন বেজে উঠলো? আমি ছাড়া পেলাম।
গতানুগতিক জীবন, কোনো উত্তেজনা নেই; দিনগত পাপক্ষয়। কিছুই বদলায়নি। মাঝে মাঝে মনে হয় যে 'বদল' শব্দটা আমার রোজনামচায় একটা 'অবসেশন ' হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দু সপ্তাহ কেটেছে, তার কোনো খবর নেই। আমি পাগলের মতো চুপি চুপি প্রতিটি বৈদ্যুতিন ঠিকানা চেক করি, প্রতিদিন। কিছু নেই। নিরুৎসাহ হয়ে পড়ছি। আজ আবার মঙ্গলবার, ঠিক চোদ্দদিন হলো। একটা ছোট্ট মেসেজ, 'চেক মেল্ '!
তড়িঘড়ি করে মেল্ খুললাম। একটা মেসেজ আর একটা এটাচমেন্ট।
"কিছদিনের ছুটি নিয়ে আসবে? জন পিন্টো এয়ারপোর্টে থাকবে।"
সঙ্গে প্লেনের টিকিট; ডাবোলিম, গোয়া ।
আমার হাতে চব্বিশ ঘন্টা, এসবের মানে কি? গোয়া কেন? যাই হোক, একটা 'ওকে' বার্তা পাঠিয়ে দিলাম।
ছুটি পেতে কোনো সমস্যা হলনা। রঞ্জুকে ফোনে করে জানালাম যে একটা বিশেষ সরকারি দরকারে আমাকে যেতে হবে। সৌভাগ্যবশতঃ, ও কোনো অস্বস্তিকর জেরা করলো না। বিকালে আমরা দিল্লির 'সাকেত" মলে ডিনার করতে গেলাম। সামনেই 'ফ্যাবিন্ডিয়া', ঢুকে পড়লাম; একটা জ্যাকেট চোখে লেগে গেলো, রঞ্জুকে দেখলাম। ও চট করে দামটা দেখে ভুরুটাকে ছাত পর্যন্ত তুলে দিলো। যেমন মা তেমনি মেয়ে। চুলোয় যাক দাম, কিনে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম রঞ্জু আড়চোখে আমাকে দেখছে।
কাকভোরের এই অদ্ভুত আকস্মিক যাত্রা আমাকে চিন্তা করার পাথেয় যোগালো। কেমন যেন রহস্যময় ব্যাপারস্যাপার। অনেকটা কিরীটি রায়ের গল্প। জন পিন্টো (নির্ঘাত দুঁদে পর্তুগিজ ডাকাত) আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? চোখটা কি বাঁধবে? তারপর? নিজের মনেই হেসে ফেললাম! পাশের ভদ্রলোক কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকালেন। আমি একটু লজ্জা পেতেই উনি হেসে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনিও হয়তো কোনো রোমাঞ্চের পেছনে ধাওয়া করে চলেছেন!! সূর্যের প্রথম আলো আমার উত্তেজনা অনেকটা বাড়িয়ে তুললো।
ডাবোলিম এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চারদিকটা একবার দেখে নিলাম। মুখে চুরুট, চোখে গগলস আর বিশাল দেহধারী লোকের সন্ধান করছিলাম। কৈ? নেই তো! একটা চটি পড়া প্যাংলা টেকো লোক একটা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাতে আমার নামের বানান ভুল। 'পিন্টো' বলে হাঁক দিতেই সেই ভয়ঙ্কর ‘চটি পড়া’ গ্যাংস্টার আমার দিকে এগিয়ে এলো, মুখে হাসি। খোঁয়াড়ি সবে ভেঙেছে বলে বোধ হলো। এসেই সে বললো, 'নাস্তা করিঙ্গা ক্যা?"
একটু পরেই বুঝতে পারলাম যে গাড়ি আমাকে গোয়ার দক্ষিণ প্রান্তে নিয়ে চলেছে। পিন্টো সাহেব দুঃখ করলেন, আজকালকার কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর দল 'ফেনি'র গুণমান নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আগে আধ বোতলে যা নেশা হতো আজ দু বোতলেও তা হয় না। গোয়া উচ্ছন্নে গেছে। ওনার হা-হুতাশে সায় দিলাম, পাছে ঘুমিয়ে না পড়েন। একবার ভাবলাম জিজ্ঞাসা করি যে আমরা কোথায় যাচ্ছি, তারপর ভাবলাম দেখাই যাক না এই রাস্তার শেষ কোথায়।
মারগাও পার হতেই আমার সন্দেহ হলো যে আমার গন্তব্যস্থল আমাদের এক অনেক পুরোনো জায়গা। বহু বছর আগে এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর ক্যানকোনা আসতেই আমার মনে পড়ে গেলো আমাদের সেই পালোলেম বীচ, সেই আশ্চর্য সুন্দর জায়গা, যা কুড়ি বছর আগে আমরা খুঁজে বার করেছিলাম। আমাদের দাম্পত্য স্বপ্নের পূর্ণতা এখানেই, 'ডি'সুজার শ্যাকে।' 'এনচ্যান্টিং' সন্ধ্যার মাধুর্য্ আর সবথেকে বড় কথা যে এখানে পর্যটকদের ভীড় কম। যেমন ছিল তেমনি আছে। পিন্টোকে বললাম আমাকে এখানেই ছাড়তে, আমি জানি কোথায় যেতে হবে।
"তুমকো ডি'সুজা কা শ্যাক মালুম হ্যায় ক্যা?" পিন্টোর সওয়াল।
হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। পিন্টো একটা জীর্ণ কার্ড বের করে খুব নম্রভাবে বললো, "কার মাংতা তো ফোন করনে কা, পন রাত কো ছোড়কর ।" তারপর একটু ঝুঁকে বললো, "থোড়া ফেনি চলতা ক্যা?"
মাথাটা নাড়িয়ে বীচের ওপর হাঁটতে লাগলাম। পিন্টো উত্তম ফেনির সন্ধানে হাওয়া হয়ে গেলো।
এইবার, আসল কাজ।
ডিসুজার শ্যাকে পৌঁছতে মুহূর্তেকের জন্যে অবাক... সময় কি এখানে থমকে আছে? কুড়ি বছর আগে যেমনটি ছিল, এখনও সেই...
ডি'সুজার শ্যাকে একটা চমৎকার গাজীবো, দূর থেকে দেখতে পেলাম এক মহিলার আবছায়া অবয়ব, রঙিন কাপড়ে ঢাকা। রেলিঙের ওপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে। প্রায় পাঁচ মিনিট লাগলো হেঁটে পৌঁছাতে; এক্কেবারে সুহাসিনীর মুখোমুখি। অসম্ভব সুন্দরী দেখতে লাগছিলো ওকে। সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। ওর চুল, ওর জামাকাপড়, ওর হাঁটা চলা, সব।
ও নেমে এলো আমার সামনে, একটু হেসে ঝুঁকে আমার জ্যাকেটটা স্পর্শ করে অস্ফুটস্বরে বললো, "সুন্দর!"
আমি হতবাক, কি বলবো, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। নিজেকে সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলো।
আমার অবস্থাটা ও ভালোই বুঝলো, আমাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলো, "কেমন দেখাচ্ছে আমায়?"
ভেবেচিন্তে সত্যি কথাটা বলে ফেললাম, "পরস্ত্রী।"
ও হেসে গড়িয়ে পড়লো, খুব খুশি। ওর মোহময় কণ্ঠস্বর, অঙ্গনারূপ, সংযম হারানোর পক্ষে যথেষ্ট।
ও হাত ধরে আমাকে টেনে নিলো সিঁড়ির ওপর, দুটো কৌচ পাশাপাশি রাখা। আমাকে শুইয়ে দিলো আর পেছন থেকে আমার চুলের ভেতরে ওর আঙ্গুলগুলো অনুভব করলাম। আঃ, কি আরাম। আস্তে আস্তে কপালটা টিপতে লাগলো, আমার চোখ বুজে আসছে। ওর চুলের গন্ধ, ওর নিঃশ্বাস আমার মুখের ওপর, কানে কানে আমাকে বললো, "কেমন আছো গো?"
চোখ খুলে তাকালাম ওর সুন্দর মুখের দিকে, কথা ফুটলো না। আমার এ কি অবস্থা!
ও অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথায় হাত বুলোতে থাকলো। কোনো কথা নেই কারো মুখে।
সামনে বিশাল সমুদ্র, গাঢ় নীল রঙের খেলা চলছে বুকের ওপর, তবু প্রশান্ত। শান্ত আমরাও। আলোড়ন যা, সবই প্রচ্ছন্ন, লুক্কায়িত।
আজ সব কিছুই নিখুঁত, যেন নিৰ্ভুল সুরের মূর্ছনা। পরিবেশ, স্বাচ্ছন্দ্য, আবহাওয়া এবং এই মোহময়ী সুন্দরী নারী... আমার নারী।
প্রকৃতির নিয়মে এলো মধুর সন্ধ্যা যার উজ্জ্বল রঙের ঝলকানি ঢেলে দিলো গলানো সোনা। সন্ধ্যা বদলে হলো রাত; সমুদ্র পাল্টালো, ধীরগতিতে নামলো অন্ধকার!
দুজনে পাশাপাশি বসে। সুহাসিনী আজ মুহূর্তের জন্যেও আমার হাত ছাড়েনি, আঁকড়ে ধরে আছে। চোখ বন্ধ করে আমি এই নতুন নারীর স্পর্শ অনুভব করেছি আজ, আমার কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো নিবেদন নেই। ও নিঃসন্দেহে আমারই। কবিকল্পিত, অবাস্তব, কাল্পনিক। এ কোন স্বপ্ন?
রাত আরো অন্ধকার, আরো গাঢ, দুজন মানুষ, নির্বাক, শব্দহীন। শুধু সৈকতে ঢেউ আছড়ে পড়ার গর্জন। মধুর গর্জন!
আজ আমার কোনো রাগ, অভিমান, কিছু নেই। আজ এক নতুন জীবন।আজ আমি ফিরে পেতে চাই আমার সুহাসকে। সেই কুড়ি বছরের সুহাসকে।
আমি টেনে নিলাম ওকে আমার কাছে। ও বাধা দিলো। আমি অবাক হয়ে তাকালাম!
একটু তাকিয়ে ওই আমাকে বুকে টেনে নিলো, আমার ঠোঁটে আলতো চুমু খেলো, "তোমাকে আমি কিছু বলবো।শুনবে?"
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, "কি দরকার সুহাস, কি বলবে?"
ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো অনেকক্ষণ। তারপর কান্না ভেজা গলায় বললো, "আজ তোমার সুহাস, তোমায় সত্যিটা বলবে।"