09-12-2020, 01:06 PM
2
নটা পয়ঁতাল্লিশ। আমি পুণা ক্লাবের দিকে হাঁটা দিলাম। উদ্দেশ্য সারপ্রাইজটা সেখানে গিয়ে দেওয়া। সবে গেটে ঢুকেছি, দেখি আদিত্যর গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেলো, সুহাশকে দেখতে পেলাম সামনের সিটে বসে কিন্তু ওরা আমাকে দেখতে পেলনা। কি মুশকিল, বোকারমতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দ্বিতীয় সিগারেটটা না খেলেই হতো। লোভে পাপ।
আবার প্ল্যান বদল।
আধঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে একটা বাসে চাপলাম, সেই নস্টালজিয়া ভরা পুণা বাস। ঠিক এগারোটায় বাড়ি পৌছালাম, দাঁড়ালাম দরজার সামনে। দারোয়ানজি পূনরায় অন্যত্র তাকিয়ে।
সেই আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন লক্ষ করেছিলাম যে সদর দরজাটা প্রচুর ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে তাই খুব করে WD ৪০ নামক একটা নবীন স্প্রে ব্যবহার করেছিলাম। তাই দরজা খুললো নিঃশব্দে, যেন রোলস রয়েস।
চমক দেবার সময় আগত। হুঁ হুঁ, বারে বারে ঘুঘু তুমি-------
বসার ঘরের কোনে একটা ছোট টেবিলল্যাম্প জ্বলছে। ছায়াগুলো ঘরটাকে আরো অন্ধকার করে তুলেছে।
শুধু একটা শব্দ আসছে। আমার শোবার ঘর থেকে।
আমি পাথরের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মতন নিরুদ্যম নির্বিকার মানুষও বুঝল সে কিসের অস্ফুট আওয়াজ, কিসের শীৎকার, আমি বুঝতে পারলাম।
নির্মম দুঃস্বপ্ন? এমনও হয়?
অন্যদের হয় জানতাম। আমার কেন হতে যাবে? এতো নিশাস্বপ্ন, এখুনি ভাঙবে দেখো!
কি অবাস্তব পরিস্থিতি। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
আমি এখন কি করি? দৌড়ে যাই; চিৎকার করি বা বাইরে চলে যাই। কি করি?
আবার সেই আরামকেদারায় গিয়ে বসলাম, দ্বিতীয়বারের জন্য।
আমি বাকশক্তিহীন, আওয়াজটা আস্তে আস্তে কমছে। অন্তে নীরবতা।
কতক্ষন? জানি না। সময়টা দেখিনি। বোধহয় থেমে গেছে।
ক্ষীণভাবে বুঝলাম, আমি আমার বসার ঘরে বসে।
সারপ্রাইসটা সম্পূর্ণভাবে আমাকেই গ্রাস করেছে।
মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম। আমার তো কোনো ফোন আসবে না। আমি চাই না যে ফোন আসুক।
দিনের সমস্ত ঘটনাগুলো যেন একটা ছন্নছাড়া সিনেমার স্ট্রিপের মতন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্লেন, গাড়ি, বাড়ি, পাল্প জয়েন্ট, টেলিফোন, গার্ড, রঞ্জু। আর আমি বসে আছি এখানে, কি করবো জানি না। কোনো প্রতিক্রিয়া কি দেওয়া উচিত?
আবার সেই ফোনের রিং, দূরে কোথাও। আমার কিচ্ছু যায় আসে কি?
শুধু তার একটা কথা কানে এলো, "কি বলছিস তুই?"
তার পর দীর্ঘ নীরবতা। আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে এসে ঢুকলো ঘরে। আমরা সামনাসামনি। ও আমার দিকে চেয়ে রইলো; আমিও।
কে বলবে কথা?
একটা ন্যুব্জ মানুষের আকৃতি নিঃশব্দে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো। মাথা নীচু। একটা ছায়ামূর্তি। কোথায় সেই সুশ্রী, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, সুঠাম ছেলেটা, যাকে আমি চিনতাম, ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম?
"আদির যাওয়া উচিত," আমি বললাম।
আমি নিজেকেই আশ্চর্য করে উঠে দাঁড়ালাম, স্বাভাবিক ভাবে বললাম, "আয়, তোকে ছেড়ে আসি।"
দরজাটা আরো একবার খুলে গেলো। আমি নামলাম, পেছনে তাকালাম না।
আদি হ্রস্ব কণ্ঠে বললো, "গাড়িটা বাইরে।"
একটু দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে উঠে ও আমার দিকে তাকালো, কিছু বলতে চায়।
"সাবধানে যাস।" আমি ফিরে গেলাম।
হটাৎ একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া শিরশিরিয়ে দিলো আমার সারা শরীর। আমার বুকের ভেতরের ঠান্ডাটা অনুভব করলাম।
এবার গার্ড আমায় দেখলো, "স্যার, আজ এলেন বুঝি?" ভালো আছেন?"
মাথা নাড়লাম।
"গেস্টদের বলবেন গাড়ি ভেতরে আনতে, আমি পার্ক করিয়ে দেব।"
"আচ্ছা" এই বলে আমি ঘরে ফিরলাম। আবার সেই বন্ধ দরজা। কি করি?
প্রায় বারোটা বাজে, হাসি পেলো। সময়টা যেন কেমন, শূন্যতা।
নক করবো, বেল বাজাব? দিশাহারা আমি
দরজাটা খুলে গেলো। প্রতিবারের মতো, শব্দহীন। ও একপাশে দাঁড়ালো দরজার।
বিষন্ন আতঙ্ক ওর চোখেমুখে, সারা শরীরে। আমরা দুজনে এক ভয়ঙ্কর নাটকের পাত্রপাত্রী, নাটক ভালোবাসি কিন্তু এই নাটকের টিকিট তো আমাদের কেনার কথা নয়। তবু, বসে আছি প্রথম সীটে। মিলনান্ত, বিয়োগান্ত নাকি প্রহসন?
দাঁড়িয়ে আছি, ও মুখ নিচু করে, বললো, "খেয়েছো?"
অন্যসময় হলে আজকের মেনুটা নিয়ে একচোট হয়ে যেত। আজ শুধু বললাম, "হ্যাঁ।"
"ঘুমাবে?"
"হ্যাঁ।"
বিহ্ববলভাবে শোবার ঘরে ঢুকলাম। এরমধ্যেই বিছানার চাদর পাল্টানো হয়েছে। শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে হাতের ওপর মাথাটা চেপে, জামাকাপড় না খুলেই।
ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার। এই কালিমা যে কত গাঢ় হতে পারে, আজ উপলব্ধি করলাম। আজ সমস্ত চেতনা স্তিমিত। গভীর আঁধার শুষে নিয়েছে আমাকে সম্পূর্ণভাবে।
বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, চোখটা খুলে গেলো, অন্ধকারটা কিছুটা সয়ে গেছে। আমার পিঠে ওর হাত আর মুখটা আমার হাতের ওপর, সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা। মুখটা ঘুরিয়ে দেখলাম, তার অবিরাম নীরব চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আমার হাত।
আমার কি করা উচিত?
এই নষ্ট মেয়েমানুষটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দি?
বা, চুপচাপ যেমন আছি তেমনি শুয়ে থাকি?
না, আমার সাথী, আমার প্রিয়া, তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দি?
আমি কি করি?
_________
নটা পয়ঁতাল্লিশ। আমি পুণা ক্লাবের দিকে হাঁটা দিলাম। উদ্দেশ্য সারপ্রাইজটা সেখানে গিয়ে দেওয়া। সবে গেটে ঢুকেছি, দেখি আদিত্যর গাড়িটা হুশ করে বেরিয়ে গেলো, সুহাশকে দেখতে পেলাম সামনের সিটে বসে কিন্তু ওরা আমাকে দেখতে পেলনা। কি মুশকিল, বোকারমতো দাঁড়িয়ে রইলাম। দ্বিতীয় সিগারেটটা না খেলেই হতো। লোভে পাপ।
আবার প্ল্যান বদল।
আধঘন্টা এদিক ওদিক ঘুরে একটা বাসে চাপলাম, সেই নস্টালজিয়া ভরা পুণা বাস। ঠিক এগারোটায় বাড়ি পৌছালাম, দাঁড়ালাম দরজার সামনে। দারোয়ানজি পূনরায় অন্যত্র তাকিয়ে।
সেই আগেরবার যখন এসেছিলাম তখন লক্ষ করেছিলাম যে সদর দরজাটা প্রচুর ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ করে তাই খুব করে WD ৪০ নামক একটা নবীন স্প্রে ব্যবহার করেছিলাম। তাই দরজা খুললো নিঃশব্দে, যেন রোলস রয়েস।
চমক দেবার সময় আগত। হুঁ হুঁ, বারে বারে ঘুঘু তুমি-------
বসার ঘরের কোনে একটা ছোট টেবিলল্যাম্প জ্বলছে। ছায়াগুলো ঘরটাকে আরো অন্ধকার করে তুলেছে।
শুধু একটা শব্দ আসছে। আমার শোবার ঘর থেকে।
আমি পাথরের মতন দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার মতন নিরুদ্যম নির্বিকার মানুষও বুঝল সে কিসের অস্ফুট আওয়াজ, কিসের শীৎকার, আমি বুঝতে পারলাম।
নির্মম দুঃস্বপ্ন? এমনও হয়?
অন্যদের হয় জানতাম। আমার কেন হতে যাবে? এতো নিশাস্বপ্ন, এখুনি ভাঙবে দেখো!
কি অবাস্তব পরিস্থিতি। মাথাটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
আমি এখন কি করি? দৌড়ে যাই; চিৎকার করি বা বাইরে চলে যাই। কি করি?
আবার সেই আরামকেদারায় গিয়ে বসলাম, দ্বিতীয়বারের জন্য।
আমি বাকশক্তিহীন, আওয়াজটা আস্তে আস্তে কমছে। অন্তে নীরবতা।
কতক্ষন? জানি না। সময়টা দেখিনি। বোধহয় থেমে গেছে।
ক্ষীণভাবে বুঝলাম, আমি আমার বসার ঘরে বসে।
সারপ্রাইসটা সম্পূর্ণভাবে আমাকেই গ্রাস করেছে।
মোবাইলটা বন্ধ করে দিলাম। আমার তো কোনো ফোন আসবে না। আমি চাই না যে ফোন আসুক।
দিনের সমস্ত ঘটনাগুলো যেন একটা ছন্নছাড়া সিনেমার স্ট্রিপের মতন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। প্লেন, গাড়ি, বাড়ি, পাল্প জয়েন্ট, টেলিফোন, গার্ড, রঞ্জু। আর আমি বসে আছি এখানে, কি করবো জানি না। কোনো প্রতিক্রিয়া কি দেওয়া উচিত?
আবার সেই ফোনের রিং, দূরে কোথাও। আমার কিচ্ছু যায় আসে কি?
শুধু তার একটা কথা কানে এলো, "কি বলছিস তুই?"
তার পর দীর্ঘ নীরবতা। আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
সে এসে ঢুকলো ঘরে। আমরা সামনাসামনি। ও আমার দিকে চেয়ে রইলো; আমিও।
কে বলবে কথা?
একটা ন্যুব্জ মানুষের আকৃতি নিঃশব্দে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো। মাথা নীচু। একটা ছায়ামূর্তি। কোথায় সেই সুশ্রী, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, সুঠাম ছেলেটা, যাকে আমি চিনতাম, ভালোবাসতাম, শ্রদ্ধা করতাম?
"আদির যাওয়া উচিত," আমি বললাম।
আমি নিজেকেই আশ্চর্য করে উঠে দাঁড়ালাম, স্বাভাবিক ভাবে বললাম, "আয়, তোকে ছেড়ে আসি।"
দরজাটা আরো একবার খুলে গেলো। আমি নামলাম, পেছনে তাকালাম না।
আদি হ্রস্ব কণ্ঠে বললো, "গাড়িটা বাইরে।"
একটু দূরে গাড়িটা দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িতে উঠে ও আমার দিকে তাকালো, কিছু বলতে চায়।
"সাবধানে যাস।" আমি ফিরে গেলাম।
হটাৎ একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া শিরশিরিয়ে দিলো আমার সারা শরীর। আমার বুকের ভেতরের ঠান্ডাটা অনুভব করলাম।
এবার গার্ড আমায় দেখলো, "স্যার, আজ এলেন বুঝি?" ভালো আছেন?"
মাথা নাড়লাম।
"গেস্টদের বলবেন গাড়ি ভেতরে আনতে, আমি পার্ক করিয়ে দেব।"
"আচ্ছা" এই বলে আমি ঘরে ফিরলাম। আবার সেই বন্ধ দরজা। কি করি?
প্রায় বারোটা বাজে, হাসি পেলো। সময়টা যেন কেমন, শূন্যতা।
নক করবো, বেল বাজাব? দিশাহারা আমি
দরজাটা খুলে গেলো। প্রতিবারের মতো, শব্দহীন। ও একপাশে দাঁড়ালো দরজার।
বিষন্ন আতঙ্ক ওর চোখেমুখে, সারা শরীরে। আমরা দুজনে এক ভয়ঙ্কর নাটকের পাত্রপাত্রী, নাটক ভালোবাসি কিন্তু এই নাটকের টিকিট তো আমাদের কেনার কথা নয়। তবু, বসে আছি প্রথম সীটে। মিলনান্ত, বিয়োগান্ত নাকি প্রহসন?
দাঁড়িয়ে আছি, ও মুখ নিচু করে, বললো, "খেয়েছো?"
অন্যসময় হলে আজকের মেনুটা নিয়ে একচোট হয়ে যেত। আজ শুধু বললাম, "হ্যাঁ।"
"ঘুমাবে?"
"হ্যাঁ।"
বিহ্ববলভাবে শোবার ঘরে ঢুকলাম। এরমধ্যেই বিছানার চাদর পাল্টানো হয়েছে। শুয়ে পড়লাম উপুড় হয়ে হাতের ওপর মাথাটা চেপে, জামাকাপড় না খুলেই।
ঘরটা পুরোপুরি অন্ধকার। এই কালিমা যে কত গাঢ় হতে পারে, আজ উপলব্ধি করলাম। আজ সমস্ত চেতনা স্তিমিত। গভীর আঁধার শুষে নিয়েছে আমাকে সম্পূর্ণভাবে।
বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, চোখটা খুলে গেলো, অন্ধকারটা কিছুটা সয়ে গেছে। আমার পিঠে ওর হাত আর মুখটা আমার হাতের ওপর, সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা। মুখটা ঘুরিয়ে দেখলাম, তার অবিরাম নীরব চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আমার হাত।
আমার কি করা উচিত?
এই নষ্ট মেয়েমানুষটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দি?
বা, চুপচাপ যেমন আছি তেমনি শুয়ে থাকি?
না, আমার সাথী, আমার প্রিয়া, তাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দি?
আমি কি করি?
_________