26-11-2020, 02:18 PM
নীলা - শেষ পর্ব
রোশনির ফুলে ফুলে কান্নাটা কিছুতেই ভুলতে পারছিল না নীলা ! সত্যি রোশনি তো পয়সা চায় নি, দামী জীবনযাত্রা চায় নি, শাড়ি-গয়না চায় নি, শুধু একটু সিঁথির সিঁদুরের অধিকার চেয়েছিল ! এটাই কি ওর অপরাধ ? সেখানে নীলা দামী জীবনযাত্রার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার লোভে দেবাশিসের ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, ক্ষণিকের আনন্দ, অর্থের লোভে নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে হেলায় ভাসিয়ে দিয়ে উদ্দাম জীবনযাত্রায় মেতে উঠেছে | ধীরে ধীরে নরকের পাঁকে তলিয়ে গেছে, যেখান থেকে ওর ফেরার উপায় নেই ! কিন্তু এই ছোট্ট মেয়েটাকে সে কি করে এই নরকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় ! মেয়েটা যে ওকে কি মায়ায় জড়িয়েছে | নীলা তো জানে এই পেশার কি যন্ত্রণা.... সাময়িক মোহে যে নরকের আগুনে নীলা তলিয়ে গেছে ও জানে তার থেকে মুক্তি নেই, প্রাণপণে চাইলেও মুক্তি মেলে না ! ও দেবাশিসকে আঘাত করেছে, দেবশিসের নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে আঘাত করেছে | নিজের সাধারণ, ঘরোয়া, গৃহবধূর জীবন ছেড়ে বিলাসবহুল জীবনযাপনের খেসারত দিয়েছে... এখনো দিয়ে চলেছে | প্রত্যেকেরই যৌবন একদিন শেষ হয়, যতই চড়া মেকআপ আর দামী সাজগোজ দিয়ে বয়সটাকে আড়াল করার চেষ্টা করুক না কেন... শেষের সেদিন কাউকে রেয়াত করে না | ওর যৌবনও তো একদিন শেষ হবে, সেইদিনের কথা ভাবলেই নীলার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায় | কে থাকবে ওর পাশে ? হয় একা থাকতে থাকতে পাগল হয়ে যাবে নয় মরে পড়ে থাকবে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের শূন্য অন্দরমহলে | শূন্যতার জ্বালা মেটানোর ক্ষমতা সোনালি তরলের নেই | ভোগের পথ, বাসনার পথ বেয়ে আজ নীলা অনেকদূর এগিয়ে গেছে... এই প্যাঁচালো সর্পিল চক্রব্যূহে ঢোকা সহজ কিন্তু নিজের সমস্ত আত্মা দিয়ে চাইলেও মৃত্যুর আবেষ্টনী ছাড়া বেরোনোর কোনো রাস্তা নেই ..... আর আত্মহত্যা করার ক্ষমতা বা সাহস কোনোটাই নীলার নেই | তবে চেষ্টা করলে এই মেয়েটাকে ও বাঁচাতে পারে | নীলা তো ক্লায়েন্টের চাহিদা মেটাতে মেটাতে একটা যান্ত্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে গেছিল, সোনালি তরল, ঘুমের ওষুধের ঘোরে কেটে যেত অভ্যস্ত দিনলিপি | কতদিন বাদে এমন লম্বা ছুটি পেল নীলা |রোশনির কোমল মুখছবি ওকে মনে পরিয়ে দেয় ওর ছোটবেলার দিনগুলোর কথা | বহুদিন বাদে একটা ভালো কাজ করার ইচ্ছে মনে জাগছে ! কিন্তু এতদিনকার এসকর্ট এজেন্সি সঙ্গে আবার অমানুষ সুপ্রতীক... এদের সঙ্গে কি একাকী লড়তে পারবে নীলা ? ওর কাছে কি সত্যি নীলার মতো জাদু ক্ষমতা আছে ! জীবন রোশনির বেশে ওর কাছে এসেছে একটা প্রশ্নচিহ্ন নিয়ে.... জীবন উত্তর চায় ! এই যুদ্ধে নীলা কি জিততে পারবে ? না কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষে কর্ণের মতো ওরও মৃতদেহ পড়ে থাকবে ....... অস্তগামী সূর্যের প্রান্তরে |
সকাল রাত্তির ভাবতে থাকল নীলা | ওর দুচোখের নীচে গাঢ় কালির পোঁচ বলে দিচ্ছে নীলা কতগুলো রাত্রি নির্ঘুম কাটিয়েছে | সারাক্ষণ নীলা কি যেন ভাবতে থাকে... হাসিখুশি দিদিকে এভাবে বদলে যেতে দেখে রোশনি ওর দিকে অবাক চোখে তাকায়, ওর আর বাক্যস্ফূর্তি হয় না | মাঝে মাঝেই নীলার মনে হয় ওরা অনেক ক্ষমতা ধরে ওদের বিরুদ্ধে নীলা একা কিসসু করে উঠতে পারবে না | তখন ওর নিজের উপরই ভীষণ রাগ হয়, মনে হয় একটা মেয়েকে বাঁচাতেও ও অপারগ | সেই রাগটা গিয়ে পড়ে ঘরে থাকা জিনিসপত্রের উপর | একে একে ভাঙে কাঁচের ফ্লাওয়ার ভাস, কাঁচের দামী দামী ক্রকারিজ | রোশনি নিশ্চুপে ঝাঁট দিয়ে কাঁচগুলো পরিস্কার করে .... মেয়েটার শূন্য দৃষ্টি দেখে বুকের ভিতরটা উথালপাথাল করে নীলার | ঝাঁট দেওয়া শেষে নীলা প্রাণপণে রোশনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে ! দেবাশিসের সঙ্গে যদি ভালো করে সংসার করত তবে ওরও কি এরকম একটা মিষ্টি মেয়ে হতো ! যাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ও নিজের সমস্ত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিগুলোকে ভুলে যেতে পারত ! যদি এমনটা হতো দিবাস্বপ্ন দেখতে লাগে নীলা ! কি সে তো কোনদিনই সম্ভব হবে না | তার চেয়ে অন্ততঃ ও যদি রোশনিকে বাঁচাতে পারে ! আজকাল নীলার দার্জিলিংয়ে হানিমুনের স্মৃতিগুলো ভীষণ মনে পড়ে | দেবাশিসকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার পর ও বুঝতে পেরেছে দেবাশিস ওকে কতটা ভালোবাসত, কতটা যত্ন করে আগলে রাখত | দেবাশিস ভালোবাসার কাঙাল ছিল, শুধু নীলা চেয়েছিল বলে দেবাশিস দার্জিলিংয়ের কনকনে ঠান্ডায় রাত্রিবেলা হোটেল থেকে বেরিয়ে আইসক্রিম নিয়ে এসেছিল | আইসক্রিমটা হাতে ধরে কি যে ভীষণ কাঁপছিল তখন, নীলা ওর গায়ে কম্বলটা জড়িয়ে দিতে তবে বাবুর কাঁপুনি থামে | নীলা চেটে চেটে আইসক্রিম খাচ্ছিল, দেবাশিস ওকে সতৃষ্ণ নয়নে দেখছিল | ভয়ে ভয়ে ঠোঁট থেকে ক্রিম চেটে নিচ্ছিল | পরের দিন সকালবেলা ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে একসঙ্গে টাইগার হিল দেখা | রেলিংয়ের ধারে কি বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিল দেবাশিস, টাইগার হিলের সূর্যোদয় দেখা নীলা মাথায় ওঠেছিল, ভয়ে দেবাশিসকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠেছিল | সন্ধ্যেবেলা ম্যালের দোকান থেকে নীলাকে লুকিয়ে বেরিয়েছিল দেবাশিস | ওখান একটা সুদৃশ্য চাদর কিনে এনে ওর গায়ে জড়িয়ে ধরে বলছিল আঃ ! আমার বউটা কি সুন্দর, কি মিষ্টি ! নীলা আবেগে দেবাশিসকে জড়িয়ে ধরেছিল | আর কাজু কিনা কটা পয়সার জন্য নিজের বিয়ে করা বউটাকেই বেচে দিল..... না, যেভাবেই হোক রোশনিকে সে বাঁচাবেই, প্রয়োজনে সে নিজের প্রাণ দিয়ে দেবে | ওর মতো মেয়ে বেঁচে থেকেই বা পৃথিবীর কোন কাজে আসবে ?
দশদিন শেষ হতে আর মাত্র একদিন বাকি ! সুপ্রতীকের রোশনিকে নিতে আসার সময় প্রায় হয়ে এলো | একটা লাইসেন্স বিহীন রিভলবার অনেক টাকায় কিনেছে নীলা | এই কাজে নেমে সমাজের অনেকতলার মানুষের সঙ্গেই নীলার পরিচয় হয়েছে, তাই সামান্য একটা রিভলবার জোগাড় করতে ওকে তেমন বেগ পেতে হয় নি ! নীলা সম্পূর্ণ প্রস্তুত, এবার শুধু সুপ্রতীকের ফোনের অপেক্ষা | তা ফোনটা এলো, ঠিক সন্ধ্যে নাগাদ ফোনটা করল সুপ্রতীক | রোশনির নতুন কাস্টমার ঠিক হয়ে গেছে | সব ঠিক থাকলে এসকর্ট এজেন্সির হয়ে এটাই হবে রোশনির প্রথম কাজ | কাল রাতে সুপ্রতীক ওর বাড়িতে এসে রোশনিকে নিয়ে যাবে | ফোনটা রেখে নীলা কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল | রোশনি ওর দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে দেখে নীলা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, " ভয় কি আমি তো আছি ! তোর দিদি থাকতে কেউ তোর কিচ্ছু করতে পারবে না | "
পরেরদিন ঠিক সন্ধ্যেবেলা সুপ্রতীক এসে বেল বাজাল | হাসিমুখে বলল, " কি রোশনি রেডি তো ? কাল থেকে কিন্তু কাজ শুরু | মন দিয়ে কাজ করতে হবে | মালদার ক্লায়েন্ট, ভালো সার্ভিস দিতে পারলে পয়সা হি পয়সা .... এই দিদিকে দেখছিস তো ! কত আসবাবপত্র, কত বড় ফ্ল্যাট ".... কথাটা বলে নীলার দিকে চেয়ে চোখ মারল |
বিলোল কটাক্ষে সুপ্রতীককে মাত করে নীলা বলল, " সে তো যাবেই তার আগে চলো ডিনারটা সেরে নেবে | কতদিন বাদে আমার কাছে এলে বলো তো ! আগেরদিন তো কিছু না খেয়েই চলে গেলে ! আজ তোমার জন্য স্পেশাল ডিনার বানিয়েছি | ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন কষা | "
" আর ? ওটা আছে তো ? " সুপ্রতীক হাত দিয়ে বোতলের ইঙ্গিত করল |
" হ্যাঁ | তোমার পছন্দের ব্র্যান্ডের হুইস্কিও আছে | " নীলা ইঙ্গিতপূর্ণ হেসে টেবিল সাজাতে চলে গেল |
খাওয়া দাওয়া শেষে মৌজ করে সিগারেট ধরিয়েছে সুপ্রতীক | তৃতীয় পেগ শেষে একটু নেশা চড়েছে, আয়েশ করে সুপ্রতীক চতুর্থ পেগে চুমুকটা দিতে যাবে এমন সময় নীলার ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠল | বোধহয় কোন প্রতিবেশী হবে... কথাটা বলে চট করে সোফা ছেড়ে উঠে দরজা খুলতে এগিয়ে গেল নীলা | দরজাটা খুলতেই ইন্সপেক্টর সমেত পুলিশের দল ঘরে ঢুকে পড়ল |
" এত রাতে আবার কে এলো ? "কথাটা বলতে বলতে সুপ্রতীক তখন বসার ঘরে এসে পড়েছে... ঘরভর্তি পুলিশ দেখেই চেঁচিয়ে উঠলো " শালি গদ্দার ! " নীলাকে লক্ষ্য করে পলকে সুপ্রতীকের রিভলবার ঝলসে উঠল |
সুপ্রতীক নেশার ঘোরে থাকায় গুলিটা নীলার মাথার রগ ঘেঁষে বেরিয়ে গেল | পলকের মধ্যে পুলিশ সুপ্রতীককে ঘিরে ফেলল | ইন্সপেক্টর দাস একজন পুলিশকে ডেকে বললেন, " অ্যাম্বুলেন্স ডেকে অবিলম্বে নীলাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে...."
ওদিকে একজন মহিলা পুলিশ রোশনির কাছে গিয়ে কোমল স্বরে বলল, " তোমার আর কোন ভয় নেই | কি হয়েছিল আমাদের খুলে বলো | যদি তুমি বাড়ি যেতে চাও তাহলে আমরা তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেব | আর নইলে তুমি নাবালক/নাবালিকাদের জন্য নির্মিত হোস্টেলে থাকবে | "
রোশনি প্রথম থেকে ওর সঙ্গে যা যা হয়েছে, কাজুর সঙ্গে ওর বিয়ের কথা, কলকাতায় আসার কথা, ওকে সুপ্রতীকের কাছে বেচে দেওয়ার কথা... সবটাই পুলিশকে খুলে বলল | রোশনি পুলিশকে জানালো ওর পক্ষে আর গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়... ওর ছোট ভাই-বোন আছে... বাড়ির কেউই আর ওকে মেনে নেবে না | পুলিশের তরফ থেকে রোশনিকে হোমে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়া হল ! হাওয়ায় এসব খবর শুনে কাজু পালাবার চেষ্টা করেছিল | কিন্তু ওর পক্ষে পালানো আর সম্ভব হল না, পালানোর সময়টাতেই বাস ডিপোতে সাদা পোশাকে অপেক্ষারত স্থানীয় পুলিশের হাতে কাজু ধরা পড়ে গেল | বিচারে ওর তিনবছর সশ্রম কারাদণ্ড হল, সঙ্গে হাজার পাঁচেক টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছ'মাস জেল | আর সুপ্রতীক যখন বুঝলো পুলিশের হাত থেকে বাঁচা ওর পক্ষে কোনমতেই সম্ভব নয়, তখন ওই এসকর্ট এজেন্সির বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হিসাবে আদালতে বয়ান দিল | এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তিরা তাদের কৃতকর্মের শাস্তি পেল | হাসপাতালের চিকিৎসায় নীলা ধীরে ধীরে সাড়া দিলেও ডাক্তার বললেন ওর মাথার রগ ছুঁয়ে বুলেটটা বেরিয়ে গেলেও ওই আকস্মিক আঘাতে নীলার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে | ভুলভাল বকছে, পুরোনো কথা কিছু মনে করতে পারছে না.... শুধু ওর ছোটবেলার কথা বলে যাচ্ছে, বাচ্চাদের মতো করছে | তবে আশার কথা নীলা ওর পিতৃদত্ত নামটা ভোলেনি কেউ ওর নাম জিজ্ঞেস করলে বলছে তোমরা জানো না আমার নাম নীলা, আ রেয়ার জেম | কিন্তু কেউ ওর কাছে যেতে গেলেই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠছে, হাসপাতালের নার্সকেও আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে | শেষপর্যন্ত একপ্রকার বাধ্য হয়েই পুলিশ নীলাকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে দিল | ওখানকার খোলা জানলার ধারে বসে নীলা শুধু একটা কথাই বিড়বিড় করে বলে চলে, " আমার নাম নীলা | নীলা খুব রেয়ার জেম | ছোটবেলায় বাবা বলত নীলা সকলের সহ্য হয় না ! "
( সমাপ্ত )