18-03-2019, 02:58 PM
-“আপ ক্যা গোর্খা হ্যাঁয়?”, আমার সামনের দীর্ঘকায় লোকটিকে, যার নাম করণ বলেছিল এজেন্ট বি ১, হাফাতে হাফাতে প্রশ্ন করলাম। করণ আর বাকি সবাই কে ছেড়ে আমরা রেল লাইনের পাশের মাটির রাস্তা দিয়ে কোনও এক দিকে যাচ্ছিলাম। আন্দাজ করেছিলাম হয়তো এটাই অবন্তিপুর যাওয়ার শর্ট কাট। আমার সঙ্গী একই লয়ে কোনও ভাবে না থেমে জগিং করতে করতে চলেছে। আমি ওঁর পিছু পিছু ঘর্মাক্ত কলেবরে কখনও জোরে হেঁটে, কখনও দৌড়ে দূরত্ব কমানর চেষ্টা করে যাচ্ছি। একটু নিরস প্রকৃতির লোক যাকে বলে, কথাবার্তা খুবই কম বলছে। করণের সাথে এদের কি সম্পর্ক আমি এখনো কিছুই বুঝে উঠতে না পারলেও ধরে নিয়েছিলাম যে এরা ভালো লোকই হবে। কি যেন বলল তখন করণ “এসএফএফ” আর একটা “এস্তাব্লিশমেন্ত ২২”, মনে মনে অনেক হাতড়েছি তারপরে। কোথাও একটা শুনেছি বা পড়েছি মনে হচ্ছে কিন্তু এর বেশী কিছু বেরোল না মাথা থেকে। করণ কি পয়সা দিয়ে ভাড়াটে সিকিউরিটি রেখেছিল নাকি? যা খেয়ালি আর পয়সা ওয়ালা ছেলে, অনেক কিছুই করতে পারে। আর্মি বা আধা সামরিক বাহিনির অনেকেই অবসর নেওয়ার পর প্রাইভেট বডি গার্ডের কাজ করে থাকে। আমার সাথিও সেরকম কিছু হতে পারে ভেবে একটু বাজিয়ে দেখব বলে ঠিক করলাম। তাছাড়া উত্তর দেওয়ার ছলে যদি একটু দাঁড়িয়ে যায় তাহলে একটু দম নিতে পারবো।
-“নহি!”, একটুকুও না থেমে ছোট্ট উত্তর দিল বি ১। হ্যাঁ গোর্খা নাও হতে পারে। নর্থ ইস্টের পাহাড়ি লোকে দেরও এরকম মঙ্গোলয়েড ফিচার হয়। তবে সাধারনত ওদের উচ্চতা ছয় ফিটের কাছাকাছি হয়না বলেই জানতাম। এর যেমন লম্বা চওড়া চেহারা তেমনি বাহারি নাম “বি ১” হাহহ!
-“তো ফির আপ কহাসে হ্যাঁয়? মতলব কউন্সি স্টেট”, শুকনো গলায় আমার কথা গুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে শোনাল। বেশ চেঁচিয়েই বলতে হল এবার, অনেক টা এগিয়ে গেছে ও। এবার না দাঁড়ালে কুয়াশা তে একটু পরেই হারিয়েই ফেলবো।
চেঁচানোতে কাজ হয়েছে দেখলাম, লোকটা থেমে গিয়ে আমার দিকে মুখ ঘুড়িয়ে দাঁড়ালো।
-“সাব, মেরা আপনা দেশ তো দিলমে ম্যায়, ভগ্বান করে তো একদিন উস্কি জমিন পে জরুর সর ঝুকানে কা মওকা মিলেগা। পর উসদিন তক ইয়ে ভারত হি মেরা দেশ আউর ইয়েহি মেরি ওয়াতন”, বলল লোকটা, “আপ থোড়া আওয়াজ নিচে নহি করেঙ্গে তো আপকো ইধারি রোক দেনা পরেগা”, ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসিটা সব সময়ি আছে দেখলাম। ওঁর কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পারলেও বেশ করে মাথা নেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চেঁচানো টা উচিত হয়নি বুঝতে পারলাম। কাছেপিঠে যদি আরও কেউ ওঁত পেতে থাকে তাহলে উচু গলার আওয়াজ তাদের কে অকারণে আমন্ত্রন জানানো ছাড়া আর কিছু করবে না।
-“থোড়া রুক যাও ভাই”, আমার বুকের ভিতর থেকে সাই সাই শব্দ করে কথা গুলো বেড়িয়ে এলো। বালিগঞ্জ এর জিমে রোজ বিকেলে এক ঘণ্টা করে দৌড়ানো খুব একটা কাজে আসছে না দেখলাম। এতদিনের মাটন কাটলেট আর চিকেন চপ কি আর বিকেলের একঘণ্টার দৌড়ে ঝরানো যায়? তাও উদিতা জোর করে ঠেলে পাঠায় বলে যেতে হয়।
-“দ্যো মিনট”, বি ১ ভদ্রলোকের একটু দয়া হয়েছে বোধহয় আমার অবস্থা থেকে। সন্ধ্যে থেকে আমার ওপর দিয়ে যা ধকল যাচ্ছে তাতে দু মিনিটেও খুব একটা উপকার হবে বলে মনে হলনা।
ও নিশ্চিত আমার মুখের ভাব পড়ে ফেলেছিল। একটু ঝুঁকে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “আপকে বিবি ঊনকে কব্জে মে হ্যাঁয়, জিত্নি দের আপ ইধার করেঙ্গে উত্নি হি মুশকিল সহেনি পরেগি উনকো”।
এই প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রমে উদিতার ভাবনা মাথার এক কোনায় চলে গেছিলো। ওঁর এক কথায় যেন সেটা টনিকের মতো কাজ করলো। আমার সব ক্লান্তি, দুর্বলতা নিমেষে যেন উধাও হয়ে গেল কোথাও। আমার উদিতা কে কিছু শয়তান তুলে নিয়ে গেছে তাদের কোনও এক ধূর্ত মতলব সিদ্ধির জন্যে। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছাতে হবে ওঁর কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। বসে জিরানোর সময় নেই। সুরাজপুরে আসার প্রথম দিনের মধ্যেই যেরকম যৌন অত্যাচার আর লালসার নমুনা দেখেছি, অনেক দেরি না হয়ে যায় আমার উদিতাকে বাঁচাতে। ওকে যখন ছেড়ে এসেছি, ও শুধু অন্তর্বাস পড়ে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছিল। ওকে কি ওরা সেই অবস্থাতেই তুলে নিয়ে গেছে? তাহলে কি আর ওঁর শরীর কে ভোগ না করে ছাড়বে এই শয়তান গুলো? অম্লান দাই কেমন ক্ষুদারত কুকুরের মতন ওঁর পরনের সায়া তুলে দিয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল, আর এরা তো জানোয়ার বল্লেও কম হয়। বুকের কোনও এক কোনায় একটা হাহাকার যেন বেজে উঠল। করণের কথা মতো আমরা অবন্তিপুর কোঠা তে যাচ্ছি, আর ও সুরাজপুরের বাকি জায়গা গুলো খুঁজে দেখবে বলেছে, না পেলে আমাদের কে কোঠা তেই মিট করবে। ভগবান কে খুব করে ডাকলাম, “সব যেন ঠিক হয়ে যায়”।
-“আপকি বন্দুক মুঝে দিজিয়ে”, মাথার পিছন থেকে আমার সাথী বলে উঠল, “থোড়া হল্কা হোঙ্গে তো আসানি হোগা”।
আমি বন্দুক টা চালান করে দিলাম ওঁর হাতে। সত্যিই ওটা আর বইতে পারছিলাম না। বেবাক বাংলায় অভ্যেস মতো বলে ফেললাম, “ধন্যবাদ”।
-“আমি বাংলা জানি”, ওঁর মুখে পরিষ্কার বাংলা কথা শুনে হতচকিত হয়ে গেলাম, “চমকাবেন না আমি এরকম ভাবে আরও দশ টা ভাষায় কথা বোলতে পারি”, হালকা হাসি মুখে বলল ও, “এ সবই আমাদের ট্রেনিং এর ফল”।
লোকটার কথায় আমার মাথায় বিদ্যুতের মতন চলে এলো ভাবনা গুলো। কলেজ কলেজে পড়াশোনায় খারাপ ফল করিনি কোনোদিন। একবার কোনও কিছু পড়লে বা শুনলে ভুলতে পারতাম না সহজে। লোকটার একটু আগের কথা গুলো আমার কানে বাজছিল, ওঁর দেশ ওঁর হৃদয়ে, এখন ভারতে থাকে তাই ভারতই ওঁর বাসভূমি, কিন্তু মাতৃভূমি নয়। কারণ ওঁর দেশ এখন অন্য কারোর দখলে, “তিব্বত”, আমি অস্ফুটে বলে ফেললাম। ১৯৫০ এ চিন দখল করে নিয়েছিল দক্ষিণে হিমালয় আর উত্তরে গোবি মরুভূমির মাঝের বৌদ্ধ গুম্ফা আর লামাদের প্রাগঐতিহাসিক শান্তিকামী দেশ তিব্বত কে। সেই সাথে চলে গেছিলো এশিয়ার দুই প্রাচিন সভ্যতা ভারত আর চিনের মাঝখানের একমাত্র বাফার যার গুরুত্ব একশো বছর আগে ইংরেজ রা বুঝলেও বুঝিনি আমরা। ফল সরূপ বারো বছরের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে তিব্র সংঘাত আর রক্তপাত। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসা স্বাধিনতাকামী তিব্বতি দের নিয়ে তৈরি হয় “স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোরস” বা এসএফএফ। যার কাজ ঠিক করা হয়েছিল, ভবিষ্যতের কোনও এক ভারত-চিন যুদ্ধের সময়ে সিমানার ওপারে গিয়ে খবর জোগাড় করে আনা বা তেমন হলে চিনের সামরিক বাহিনির উপরে গুপ্ত আঘাত হানা। পরবর্তী কালে চিনের সাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা কমে আসলে এসএফএফ কে ভারতের আন্তরদেশিয় গুপ্তচর সংস্থার অংশ বানিয়ে দেওয়া হয় যার নাম হয় “এস্তাব্লিশ্মেন্ত ২২”। পাহাড় আর জঙ্গলের যুদ্ধে অত্যন্ত পটু এই অদৃশ্য আধা সামরিক বাহিনি একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের নিদর্শন রেখেছিল চট্টগ্রাম এলাকা স্বাধীন করতে। সব মনে পড়ে গিয়েছে আমার। বিআরও তে থাকা কালিন আর্মি জেনারেল ব্রার এর বইয়ে এদের কথা পড়েছিলাম। আজকের ঘটনার ঘনঘটায় মাথা টা খালি হয়ে গেছিলো, কিন্তু এখন সব পরিষ্কার আমার চোখের সামনে।
-“আপনি র তে আছেন?”, আমি ওঁর চোখে চোখ রেখে জিগাসা করলাম। আমার কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে চলল এজেন্ট বি ১। এই অদ্ভুত নামকরনের রহস্যও এখন বুঝতে পারলাম। ওঁর আসল নাম হয়তো ও নিজেই ভুলে গেছে। আমার এই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ওঁর নেই।
-“আর করণ?”, এটারও কোনও সাড়া আসবেনা জেনেও বলে ফেললাম। আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতাও চলে গেছে যেন। ক্রমানুসারে একধাপ থেকে ওপর ধাপে উঠে যাচ্ছি আর তার সাথেসাথে আগের ঘটনা গুলোকে ফেলনা মনে হচ্ছে। করণের এখানে থাকার কারণ তাহলে কি? লাল পার্টি না রনবির সেনা?
সত্তরের দশকের নকশাল বাড়ির ছোটো টাউনে যা শুরু হয়েছিল টা আজ দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। একের পর এক গ্রাম জেলা সদর লাল ডট এ ঢাকা পড়েছে তার পর থেকে। রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির বেড়াজালে চাপা পড়ে যাওয়া পিছিয়ে পড়া গ্রাম জঙ্গলের সহজ সরল মানুষ গুলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। বিহার ঝাড়খণ্ডের এই সব এলাকায় রনবির সেনার তাণ্ডবের কথা সকলেই প্রায় জানে। প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় তারা ধিরে ধিরে রাক্ষসে পরিনত হয়েছে। এখানে লাল পার্টির বার বারন্তের প্রত্যখ্য আর পরোক্ষ কারণ এরা আর চরম দুর্নীতি। কিন্তু এসকলি তো আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে আর তার জন্যে তো আইবি আছে! এসএফএফ এখানে আজ রাতে কি করছে?
-“আপনারা এখানে কেন? রনবির সেনা কে আটকাতে? না লাল পার্টি”, আমি জিগাসা না করে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম এবারেও কি জবাব দেবে না?
-“সবারই হদিশ আমরা রাখি বটে কিন্তু ওদের আটকানো টা আমাদের বর্তমান লক্ষ্য নয়। আজ রাতেই লাল পার্টি অবন্তিপুরের ইয়াদবের কোঠা, কয়লার খাদান হামলা করবে। তার সাথেই শেষ হবে রনবির সেনা”, বি ১ উত্তর দিল।
-“কিন্তু লাল পার্টি তো থেকে যাবে এখানে? এত সেই শাঁখের করাত হবে?”, আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
-“লাল পার্টির পিছনেই ওই সুরাজপুর জঙ্গলের ভিতরের ওয়াকিং ট্রেল ধরে এগিয়ে আসছে দু কম্পানি কোবরা কমান্ডো। আজ ভোরের মধ্যেই অবন্তিপুরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সমস্থ এক্সিট পয়েন্ট এ বসবে পুলিশ আর সিআরপির ব্যারিকেড। লাল পার্টির অনেকেই হয়তো আজকেই গ্রেপ্তার হবে”, ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দিল ও।
তারমানে এক ঢিলে দুই পাখি। লাল পার্টি কে দিয়ে রনবির সেনা কে খতম করা আর তারপরে তাদের কেই গ্রেফতার করা। বেশ স্মার্ট প্ল্যান বলেই মনে হচ্ছে। তবু এর মধ্যে করণ আর এদের ভূমিকা টা স্পষ্ট হল না। লোকটা আবার আমার মনের ভাব পড়ে ফেলল। বলল, “এখনো ভাবছেন তো আমরা এখানে কি করছি? চিনা চাচা বলে কিছু শুনেছেন?”
আমি ঘাড় নেড়ে বোঝালাম এটা আমার একেবারেই অজানা। আন্দাজেই বলার চেষ্টা করলাম, “মাও যে দং এর কথা বলছেন?”। বি ১ বলল, “নাহ, থাক পড়ে নিজেই জানতে পারবেন”।
আমাদের কথা আর বিশেষ এগোল না। আমি উদিতার সেফটি নিয়ে আরও আরও অনেক বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। করণের আমার সাথে না আসার উদ্দেশ্য উদিতা কে অন্য জায়গায় খোঁজা নাকি ওঁর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে? খুব অভিমান হচ্ছিল ওঁর ওপরে। সব জেনে শুনেও কেন টেনে আনল আমাদের এই বিপদের মধ্যে? উদিতা কে যদি এরা কোঠা তেই নিয়ে রাখে আর সেখানেই যদি অ্যাটাক হয় তাহলে তো ঘোর বিপদ।
একটু পরেই আমরা রেল লাইন ছেড়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটা পথ ধরলাম। কোনও কারণে ও স্টেশনের পাশের রাস্তা টা দিয়ে গেলনা। আমি এখন ওর সমান তালে দৌড়াতে পারছি। ভিতর থেকে উঠে আসছে জোর টা, ক্লান্তি এখন অনেক দূরের কোনও জিনিস। মিনিট দশেক চলার পর কুয়াশা টা একটু হালকা হতেই দেখতে পেলাম ইয়াদবের কোঠা। অবন্তিপুরের একচালা ঘর গুলোর মাঝে দোতলা বাড়ীটা বেশ রাজ প্রাসাদের মতই লাগছে। আমাদের চলার গতি আরও বেড়ে গেল। বি ১ এর কথা মতন আমরা পিছনের গোডাউনের দরজা দিয়ে ঢুকব বলে ঠিক করলাম।
-“এটাকে আঙটির মতো করে পড়ে নিন বা গলায় লকেটের সাথে ঝুলিয়ে দিন”, বি ১ আমার দিকে একটা সরু গোল মেটে রঙের রিঙ এগিয়ে দিল, ওপরে যেখানে পাথর বসানো থাকার কথা সেখানে একটা খুব ছোট্ট মেটালিক বক্স এর মতন কিছু একটা রয়েছে। আঙ্গুলে দেখলাম ভালোই ফিট করলো, রিঙ টা একটু যেন ইলাস্তিক টাইপের, সবার হাতের সমান ভাবে লেগে থাকবে। জিগাসা করলাম, “কি জিনিস এটা?”
-“এটা একটা মাইক্রো ট্রান্সমিটার, প্রতি তিরিশ সেকেন্ড পরপর একটা খুব হাই ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যাল রিলিজ করে যেটা শুধু মাত্র একরকম স্পেশাল রিসিভার দিয়েই ট্র্যাক করা যায়”, ও বলল। আমি বুঝে গেলাম জিনিস টা কি আর আমাকে কেন দেওয়া হচ্ছে। করণ মউয়া কে এরকমই কোনও একটা জিনিস দিয়ে খুঁজে বের করেছিল হয়তো। আমি বন্দুক টা ওঁর কাছ থেকে নিয়ে নিলাম। মনে মনে নিজেকে আর একটা লড়াই এর জন্যে প্রস্তুত করলাম।
ইয়াদবের গোডাউনের দরজার কাছে গিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। একটা লোক ছেঁড়া ফাটা জামা কাপড় পড়ে দরজার ঠিক বাইরে হাঁটুর ওপরে বসে আছে। যেন কেউ ওকে কোনও শাস্তি দিয়েছে। মার খেয়ে চোখ এতটাই ফুলে আছে যে খুলতেই পারছেনা, গালের কাছে গভীর কাঁটা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। আমাদের দেখেই কিছু একটা বলে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু বি ১ ক্ষিপ্র হাতে লোকটার মুখ চেপে ধরে টেনে দেওয়ালের পাশে টেনে নিয়ে আসলো। গলার নিচ দিয়ে হাত টা এমন ভাবে নিয়েছে যাতে লোক টা চাইলেও চেঁচাতে না পারে। আস্তে করে মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল তারপরে।
-“…দশরথ…চেতনা…মেরি বিবি…অন্দর ইয়াদব কে পাস”, ফিস ফিস করে বোলতে পারলো শুধু লোকটা।
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, বেশ বুঝতে পারলাম এর বউকেও তুলে নিয়ে এসেছে ইয়াদবের লোকজন। এদের পাশবিক অত্যাচারের কি কোনও শেষ নেই? উদিতার কথা ভেবে চোখ ছলছল করে এলো আমার। প্রাণপণে বন্দুক টা চেপে ধরে দরজাটা ঠেলে খুললাম। আমাকে ইশারায় পিছু নিতে বলে বি ১ ওঁর হাতের ছোট্ট কারবাইন টা কাঁধের কাছে তুলে হলগ্রাফিক সাইটে চোখ লাগিয়ে পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকল। আমি ভিতরে পা দিয়েই থতমত খেয়ে গেলাম। দেওয়ালে একটা টিমটিমে বাল্ব লাগানো আছে, আর তার মৃদু আলোতে দেখতে পেলাম মাটিতে বস্তা গুলোর কাছে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা লোকের দেহ। রক্তের একটা ধারা ওঁর পেটের কাছ থেকে বেড়িয়ে পাশের নর্দমায় গিয়ে মিশেছে। বি ১ ওঁর হাত টা খুব আস্তে করে পড়ে থাকা লোকটার গলার কাছে নিয়ে গেল। হাতের ইঙ্গিতে আমাকে বোঝাল যে প্রাণ দেহত্যাগ করেছে। দশরথ ও আমার পিছন পিছন ঢুকেছিল। বিড়বিড় করে বোলতে শুনলাম “খিলাওন”, বুঝলাম এটাই এই মৃত ব্যাক্তির নাম। কিন্তু ওকে মারল কে?
বি ১, বডি টাকে পাস কাটিয়ে টিনের দরজা টা ঠেলে গোডাউনের ভিতরে পা রাখল আর তার পিছনেই আমি। আমাদের অবাক হওয়া যেন আরও বাকি ছিল। ঘরের ভিতরে আর একটা মৃতদেহ আর তার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে এক নগ্ন নারী শরীর, পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে রক্ত মাখা ছুড়ি। মাথার চুল তাঁর আলুথালু আর একটু ঝুঁকে পড়া ক্লান্ত মুখ ঢেকে গিয়েছে লাল রক্তে।
“…চেতনা…”, দশরথ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মেয়েটার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
“আপনি এখানেই থাকুন, আমি এদের কে বের করে সেফ জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসছি দু মিনিটে”, খুব চাপা গলায় বলল বি ১।
-“নহি!”, একটুকুও না থেমে ছোট্ট উত্তর দিল বি ১। হ্যাঁ গোর্খা নাও হতে পারে। নর্থ ইস্টের পাহাড়ি লোকে দেরও এরকম মঙ্গোলয়েড ফিচার হয়। তবে সাধারনত ওদের উচ্চতা ছয় ফিটের কাছাকাছি হয়না বলেই জানতাম। এর যেমন লম্বা চওড়া চেহারা তেমনি বাহারি নাম “বি ১” হাহহ!
-“তো ফির আপ কহাসে হ্যাঁয়? মতলব কউন্সি স্টেট”, শুকনো গলায় আমার কথা গুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে শোনাল। বেশ চেঁচিয়েই বলতে হল এবার, অনেক টা এগিয়ে গেছে ও। এবার না দাঁড়ালে কুয়াশা তে একটু পরেই হারিয়েই ফেলবো।
চেঁচানোতে কাজ হয়েছে দেখলাম, লোকটা থেমে গিয়ে আমার দিকে মুখ ঘুড়িয়ে দাঁড়ালো।
-“সাব, মেরা আপনা দেশ তো দিলমে ম্যায়, ভগ্বান করে তো একদিন উস্কি জমিন পে জরুর সর ঝুকানে কা মওকা মিলেগা। পর উসদিন তক ইয়ে ভারত হি মেরা দেশ আউর ইয়েহি মেরি ওয়াতন”, বলল লোকটা, “আপ থোড়া আওয়াজ নিচে নহি করেঙ্গে তো আপকো ইধারি রোক দেনা পরেগা”, ঠোঁটের কোনায় মৃদু হাসিটা সব সময়ি আছে দেখলাম। ওঁর কথার মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পারলেও বেশ করে মাথা নেড়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে কোমর ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চেঁচানো টা উচিত হয়নি বুঝতে পারলাম। কাছেপিঠে যদি আরও কেউ ওঁত পেতে থাকে তাহলে উচু গলার আওয়াজ তাদের কে অকারণে আমন্ত্রন জানানো ছাড়া আর কিছু করবে না।
-“থোড়া রুক যাও ভাই”, আমার বুকের ভিতর থেকে সাই সাই শব্দ করে কথা গুলো বেড়িয়ে এলো। বালিগঞ্জ এর জিমে রোজ বিকেলে এক ঘণ্টা করে দৌড়ানো খুব একটা কাজে আসছে না দেখলাম। এতদিনের মাটন কাটলেট আর চিকেন চপ কি আর বিকেলের একঘণ্টার দৌড়ে ঝরানো যায়? তাও উদিতা জোর করে ঠেলে পাঠায় বলে যেতে হয়।
-“দ্যো মিনট”, বি ১ ভদ্রলোকের একটু দয়া হয়েছে বোধহয় আমার অবস্থা থেকে। সন্ধ্যে থেকে আমার ওপর দিয়ে যা ধকল যাচ্ছে তাতে দু মিনিটেও খুব একটা উপকার হবে বলে মনে হলনা।
ও নিশ্চিত আমার মুখের ভাব পড়ে ফেলেছিল। একটু ঝুঁকে আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “আপকে বিবি ঊনকে কব্জে মে হ্যাঁয়, জিত্নি দের আপ ইধার করেঙ্গে উত্নি হি মুশকিল সহেনি পরেগি উনকো”।
এই প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রমে উদিতার ভাবনা মাথার এক কোনায় চলে গেছিলো। ওঁর এক কথায় যেন সেটা টনিকের মতো কাজ করলো। আমার সব ক্লান্তি, দুর্বলতা নিমেষে যেন উধাও হয়ে গেল কোথাও। আমার উদিতা কে কিছু শয়তান তুলে নিয়ে গেছে তাদের কোনও এক ধূর্ত মতলব সিদ্ধির জন্যে। আমাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পৌছাতে হবে ওঁর কাছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি আবার হাঁটা শুরু করলাম। বসে জিরানোর সময় নেই। সুরাজপুরে আসার প্রথম দিনের মধ্যেই যেরকম যৌন অত্যাচার আর লালসার নমুনা দেখেছি, অনেক দেরি না হয়ে যায় আমার উদিতাকে বাঁচাতে। ওকে যখন ছেড়ে এসেছি, ও শুধু অন্তর্বাস পড়ে নিঃসাড়ে ঘুমাচ্ছিল। ওকে কি ওরা সেই অবস্থাতেই তুলে নিয়ে গেছে? তাহলে কি আর ওঁর শরীর কে ভোগ না করে ছাড়বে এই শয়তান গুলো? অম্লান দাই কেমন ক্ষুদারত কুকুরের মতন ওঁর পরনের সায়া তুলে দিয়ে চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছিল, আর এরা তো জানোয়ার বল্লেও কম হয়। বুকের কোনও এক কোনায় একটা হাহাকার যেন বেজে উঠল। করণের কথা মতো আমরা অবন্তিপুর কোঠা তে যাচ্ছি, আর ও সুরাজপুরের বাকি জায়গা গুলো খুঁজে দেখবে বলেছে, না পেলে আমাদের কে কোঠা তেই মিট করবে। ভগবান কে খুব করে ডাকলাম, “সব যেন ঠিক হয়ে যায়”।
-“আপকি বন্দুক মুঝে দিজিয়ে”, মাথার পিছন থেকে আমার সাথী বলে উঠল, “থোড়া হল্কা হোঙ্গে তো আসানি হোগা”।
আমি বন্দুক টা চালান করে দিলাম ওঁর হাতে। সত্যিই ওটা আর বইতে পারছিলাম না। বেবাক বাংলায় অভ্যেস মতো বলে ফেললাম, “ধন্যবাদ”।
-“আমি বাংলা জানি”, ওঁর মুখে পরিষ্কার বাংলা কথা শুনে হতচকিত হয়ে গেলাম, “চমকাবেন না আমি এরকম ভাবে আরও দশ টা ভাষায় কথা বোলতে পারি”, হালকা হাসি মুখে বলল ও, “এ সবই আমাদের ট্রেনিং এর ফল”।
লোকটার কথায় আমার মাথায় বিদ্যুতের মতন চলে এলো ভাবনা গুলো। কলেজ কলেজে পড়াশোনায় খারাপ ফল করিনি কোনোদিন। একবার কোনও কিছু পড়লে বা শুনলে ভুলতে পারতাম না সহজে। লোকটার একটু আগের কথা গুলো আমার কানে বাজছিল, ওঁর দেশ ওঁর হৃদয়ে, এখন ভারতে থাকে তাই ভারতই ওঁর বাসভূমি, কিন্তু মাতৃভূমি নয়। কারণ ওঁর দেশ এখন অন্য কারোর দখলে, “তিব্বত”, আমি অস্ফুটে বলে ফেললাম। ১৯৫০ এ চিন দখল করে নিয়েছিল দক্ষিণে হিমালয় আর উত্তরে গোবি মরুভূমির মাঝের বৌদ্ধ গুম্ফা আর লামাদের প্রাগঐতিহাসিক শান্তিকামী দেশ তিব্বত কে। সেই সাথে চলে গেছিলো এশিয়ার দুই প্রাচিন সভ্যতা ভারত আর চিনের মাঝখানের একমাত্র বাফার যার গুরুত্ব একশো বছর আগে ইংরেজ রা বুঝলেও বুঝিনি আমরা। ফল সরূপ বারো বছরের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে তিব্র সংঘাত আর রক্তপাত। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতে পালিয়ে আসা স্বাধিনতাকামী তিব্বতি দের নিয়ে তৈরি হয় “স্পেশাল ফ্রন্টিয়ার ফোরস” বা এসএফএফ। যার কাজ ঠিক করা হয়েছিল, ভবিষ্যতের কোনও এক ভারত-চিন যুদ্ধের সময়ে সিমানার ওপারে গিয়ে খবর জোগাড় করে আনা বা তেমন হলে চিনের সামরিক বাহিনির উপরে গুপ্ত আঘাত হানা। পরবর্তী কালে চিনের সাথে সরাসরি সংঘাতের সম্ভাবনা কমে আসলে এসএফএফ কে ভারতের আন্তরদেশিয় গুপ্তচর সংস্থার অংশ বানিয়ে দেওয়া হয় যার নাম হয় “এস্তাব্লিশ্মেন্ত ২২”। পাহাড় আর জঙ্গলের যুদ্ধে অত্যন্ত পটু এই অদৃশ্য আধা সামরিক বাহিনি একাত্তরের বাংলাদেশ যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের নিদর্শন রেখেছিল চট্টগ্রাম এলাকা স্বাধীন করতে। সব মনে পড়ে গিয়েছে আমার। বিআরও তে থাকা কালিন আর্মি জেনারেল ব্রার এর বইয়ে এদের কথা পড়েছিলাম। আজকের ঘটনার ঘনঘটায় মাথা টা খালি হয়ে গেছিলো, কিন্তু এখন সব পরিষ্কার আমার চোখের সামনে।
-“আপনি র তে আছেন?”, আমি ওঁর চোখে চোখ রেখে জিগাসা করলাম। আমার কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে চলল এজেন্ট বি ১। এই অদ্ভুত নামকরনের রহস্যও এখন বুঝতে পারলাম। ওঁর আসল নাম হয়তো ও নিজেই ভুলে গেছে। আমার এই সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স ওঁর নেই।
-“আর করণ?”, এটারও কোনও সাড়া আসবেনা জেনেও বলে ফেললাম। আমার অবাক হওয়ার ক্ষমতাও চলে গেছে যেন। ক্রমানুসারে একধাপ থেকে ওপর ধাপে উঠে যাচ্ছি আর তার সাথেসাথে আগের ঘটনা গুলোকে ফেলনা মনে হচ্ছে। করণের এখানে থাকার কারণ তাহলে কি? লাল পার্টি না রনবির সেনা?
সত্তরের দশকের নকশাল বাড়ির ছোটো টাউনে যা শুরু হয়েছিল টা আজ দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। একের পর এক গ্রাম জেলা সদর লাল ডট এ ঢাকা পড়েছে তার পর থেকে। রাজনৈতিক আর প্রশাসনিক দুর্নীতির বেড়াজালে চাপা পড়ে যাওয়া পিছিয়ে পড়া গ্রাম জঙ্গলের সহজ সরল মানুষ গুলো প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। বিহার ঝাড়খণ্ডের এই সব এলাকায় রনবির সেনার তাণ্ডবের কথা সকলেই প্রায় জানে। প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তায় তারা ধিরে ধিরে রাক্ষসে পরিনত হয়েছে। এখানে লাল পার্টির বার বারন্তের প্রত্যখ্য আর পরোক্ষ কারণ এরা আর চরম দুর্নীতি। কিন্তু এসকলি তো আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার মধ্যে পড়ে আর তার জন্যে তো আইবি আছে! এসএফএফ এখানে আজ রাতে কি করছে?
-“আপনারা এখানে কেন? রনবির সেনা কে আটকাতে? না লাল পার্টি”, আমি জিগাসা না করে থাকতে পারলাম না। ভাবলাম এবারেও কি জবাব দেবে না?
-“সবারই হদিশ আমরা রাখি বটে কিন্তু ওদের আটকানো টা আমাদের বর্তমান লক্ষ্য নয়। আজ রাতেই লাল পার্টি অবন্তিপুরের ইয়াদবের কোঠা, কয়লার খাদান হামলা করবে। তার সাথেই শেষ হবে রনবির সেনা”, বি ১ উত্তর দিল।
-“কিন্তু লাল পার্টি তো থেকে যাবে এখানে? এত সেই শাঁখের করাত হবে?”, আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।
-“লাল পার্টির পিছনেই ওই সুরাজপুর জঙ্গলের ভিতরের ওয়াকিং ট্রেল ধরে এগিয়ে আসছে দু কম্পানি কোবরা কমান্ডো। আজ ভোরের মধ্যেই অবন্তিপুরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে সমস্থ এক্সিট পয়েন্ট এ বসবে পুলিশ আর সিআরপির ব্যারিকেড। লাল পার্টির অনেকেই হয়তো আজকেই গ্রেপ্তার হবে”, ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দিল ও।
তারমানে এক ঢিলে দুই পাখি। লাল পার্টি কে দিয়ে রনবির সেনা কে খতম করা আর তারপরে তাদের কেই গ্রেফতার করা। বেশ স্মার্ট প্ল্যান বলেই মনে হচ্ছে। তবু এর মধ্যে করণ আর এদের ভূমিকা টা স্পষ্ট হল না। লোকটা আবার আমার মনের ভাব পড়ে ফেলল। বলল, “এখনো ভাবছেন তো আমরা এখানে কি করছি? চিনা চাচা বলে কিছু শুনেছেন?”
আমি ঘাড় নেড়ে বোঝালাম এটা আমার একেবারেই অজানা। আন্দাজেই বলার চেষ্টা করলাম, “মাও যে দং এর কথা বলছেন?”। বি ১ বলল, “নাহ, থাক পড়ে নিজেই জানতে পারবেন”।
আমাদের কথা আর বিশেষ এগোল না। আমি উদিতার সেফটি নিয়ে আরও আরও অনেক বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ছিলাম। করণের আমার সাথে না আসার উদ্দেশ্য উদিতা কে অন্য জায়গায় খোঁজা নাকি ওঁর কাছে আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে? খুব অভিমান হচ্ছিল ওঁর ওপরে। সব জেনে শুনেও কেন টেনে আনল আমাদের এই বিপদের মধ্যে? উদিতা কে যদি এরা কোঠা তেই নিয়ে রাখে আর সেখানেই যদি অ্যাটাক হয় তাহলে তো ঘোর বিপদ।
একটু পরেই আমরা রেল লাইন ছেড়ে মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটা পথ ধরলাম। কোনও কারণে ও স্টেশনের পাশের রাস্তা টা দিয়ে গেলনা। আমি এখন ওর সমান তালে দৌড়াতে পারছি। ভিতর থেকে উঠে আসছে জোর টা, ক্লান্তি এখন অনেক দূরের কোনও জিনিস। মিনিট দশেক চলার পর কুয়াশা টা একটু হালকা হতেই দেখতে পেলাম ইয়াদবের কোঠা। অবন্তিপুরের একচালা ঘর গুলোর মাঝে দোতলা বাড়ীটা বেশ রাজ প্রাসাদের মতই লাগছে। আমাদের চলার গতি আরও বেড়ে গেল। বি ১ এর কথা মতন আমরা পিছনের গোডাউনের দরজা দিয়ে ঢুকব বলে ঠিক করলাম।
-“এটাকে আঙটির মতো করে পড়ে নিন বা গলায় লকেটের সাথে ঝুলিয়ে দিন”, বি ১ আমার দিকে একটা সরু গোল মেটে রঙের রিঙ এগিয়ে দিল, ওপরে যেখানে পাথর বসানো থাকার কথা সেখানে একটা খুব ছোট্ট মেটালিক বক্স এর মতন কিছু একটা রয়েছে। আঙ্গুলে দেখলাম ভালোই ফিট করলো, রিঙ টা একটু যেন ইলাস্তিক টাইপের, সবার হাতের সমান ভাবে লেগে থাকবে। জিগাসা করলাম, “কি জিনিস এটা?”
-“এটা একটা মাইক্রো ট্রান্সমিটার, প্রতি তিরিশ সেকেন্ড পরপর একটা খুব হাই ফ্রিকোয়েন্সির সিগন্যাল রিলিজ করে যেটা শুধু মাত্র একরকম স্পেশাল রিসিভার দিয়েই ট্র্যাক করা যায়”, ও বলল। আমি বুঝে গেলাম জিনিস টা কি আর আমাকে কেন দেওয়া হচ্ছে। করণ মউয়া কে এরকমই কোনও একটা জিনিস দিয়ে খুঁজে বের করেছিল হয়তো। আমি বন্দুক টা ওঁর কাছ থেকে নিয়ে নিলাম। মনে মনে নিজেকে আর একটা লড়াই এর জন্যে প্রস্তুত করলাম।
ইয়াদবের গোডাউনের দরজার কাছে গিয়ে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। একটা লোক ছেঁড়া ফাটা জামা কাপড় পড়ে দরজার ঠিক বাইরে হাঁটুর ওপরে বসে আছে। যেন কেউ ওকে কোনও শাস্তি দিয়েছে। মার খেয়ে চোখ এতটাই ফুলে আছে যে খুলতেই পারছেনা, গালের কাছে গভীর কাঁটা থেকে রক্ত গড়াচ্ছে। আমাদের দেখেই কিছু একটা বলে ওঠার চেষ্টা করলো কিন্তু বি ১ ক্ষিপ্র হাতে লোকটার মুখ চেপে ধরে টেনে দেওয়ালের পাশে টেনে নিয়ে আসলো। গলার নিচ দিয়ে হাত টা এমন ভাবে নিয়েছে যাতে লোক টা চাইলেও চেঁচাতে না পারে। আস্তে করে মুখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে নিল তারপরে।
-“…দশরথ…চেতনা…মেরি বিবি…অন্দর ইয়াদব কে পাস”, ফিস ফিস করে বোলতে পারলো শুধু লোকটা।
আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, বেশ বুঝতে পারলাম এর বউকেও তুলে নিয়ে এসেছে ইয়াদবের লোকজন। এদের পাশবিক অত্যাচারের কি কোনও শেষ নেই? উদিতার কথা ভেবে চোখ ছলছল করে এলো আমার। প্রাণপণে বন্দুক টা চেপে ধরে দরজাটা ঠেলে খুললাম। আমাকে ইশারায় পিছু নিতে বলে বি ১ ওঁর হাতের ছোট্ট কারবাইন টা কাঁধের কাছে তুলে হলগ্রাফিক সাইটে চোখ লাগিয়ে পা টিপে টিপে ভিতরে ঢুকল। আমি ভিতরে পা দিয়েই থতমত খেয়ে গেলাম। দেওয়ালে একটা টিমটিমে বাল্ব লাগানো আছে, আর তার মৃদু আলোতে দেখতে পেলাম মাটিতে বস্তা গুলোর কাছে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা লোকের দেহ। রক্তের একটা ধারা ওঁর পেটের কাছ থেকে বেড়িয়ে পাশের নর্দমায় গিয়ে মিশেছে। বি ১ ওঁর হাত টা খুব আস্তে করে পড়ে থাকা লোকটার গলার কাছে নিয়ে গেল। হাতের ইঙ্গিতে আমাকে বোঝাল যে প্রাণ দেহত্যাগ করেছে। দশরথ ও আমার পিছন পিছন ঢুকেছিল। বিড়বিড় করে বোলতে শুনলাম “খিলাওন”, বুঝলাম এটাই এই মৃত ব্যাক্তির নাম। কিন্তু ওকে মারল কে?
বি ১, বডি টাকে পাস কাটিয়ে টিনের দরজা টা ঠেলে গোডাউনের ভিতরে পা রাখল আর তার পিছনেই আমি। আমাদের অবাক হওয়া যেন আরও বাকি ছিল। ঘরের ভিতরে আর একটা মৃতদেহ আর তার পাশে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে এক নগ্ন নারী শরীর, পায়ের কাছে পড়ে রয়েছে রক্ত মাখা ছুড়ি। মাথার চুল তাঁর আলুথালু আর একটু ঝুঁকে পড়া ক্লান্ত মুখ ঢেকে গিয়েছে লাল রক্তে।
“…চেতনা…”, দশরথ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে মেয়েটার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো।
“আপনি এখানেই থাকুন, আমি এদের কে বের করে সেফ জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসছি দু মিনিটে”, খুব চাপা গলায় বলল বি ১।