23-11-2020, 01:00 AM
পর্ব ১৯
১৯ (ক)
কদিন পর এক সন্ধ্যায় হাসিখুশি মনে দরজা খুলতে গিয়ে থমকে যেতে হয় শান্তাকে। ওপাশে ফয়সালের চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। দরদর করে ঘামছে ফয়সাল। চুল-গুল উস্কখুস্ক্ শার্ট এর একটা বোতামও মনে হচ্ছে ছেড়া। শান্তা যে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে, সেটাও যেন টের পাচ্ছে না ফয়সাল। দাড়িয়ে দাড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলছে জোরে জোরে। যেন এই মাত্র ভুত দেখে এসেছে ফয়সাল।
“কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?” শান্তা খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়েই জানতে চায়। হাত বাড়িয়ে ফয়সালকে চেপে ধরে। ওর স্পর্শে যেন কেপে উঠে ফয়সাল। চট করে একবার পেছনে ফিরে তাকায়। যেন ভয় করছে ভুতটি এখনো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। “তুলির বাবা… কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?”
শান্তাও চিন্তিত হয়ে উঠেছে। ফয়সাল তো ভয় পাবার লোক নয়! কি ঘটেছে তার সঙ্গে। ওর গলা চড়ে উঠতে যেন নিজেকে একটু সামলে নেয় ফয়সাল। ঘরের ভেতরে ঢুকে। শান্তা দরজা লাগাচ্ছিল, ওকে ঠেলে ফয়সাল নিজেই দরজা লাগিয়ে দেয়। তারপর হাপাতে হাপাতে সোফাতে ধপাস করে গিয়ে বসে। “পানি… পানি দাও...”
“দিচ্ছি...” শান্তা দৌড়ে আসে ফ্রিজের কাছে। ঠাণ্ডা পানির বোতলটা বার করে গ্লাসে পানি ঢালে। তারপর সেটা নিয়ে আবার চলে আসে ফয়সালের কাছে। ওর হাত থেকে কাপা হাতে পানির গ্লাসটা ধরে ফয়সাল। তারপর ঢকঢক করে পুরো গ্লাসটা শেষ করে ফেলে। শান্তা ততক্ষণে ফ্যান ছেড়ে দিয়েছে। পাশে বসে ফয়সালের কপালে হাত রাখল - জ্বর এলো না তো আবার?
নাহ জ্বর নয়। ফয়সাল যখন মুখ খুলল, তখন সবই জানতে পারলো শান্তা। “ওর- ওরা - ওরা আমাকে ধরতে এসেছিলো...”
“ওরা!” ভ্রূ কুঁচকায় শান্তা। ওর মাঝেও ভয়টা সঞ্চারিত হতে শুরু করেছে। “পুলিশ না তো?”
“না...” মাথা নাড়ে ফয়সাল। “পুলিশ না… ওরা… তিনটে লোক। আমাকে ধরতে এসেছিলো…”
“ছিনতাইকারী?” শান্তা বিস্মিত হয়ে উঠেছে। এই এলাকায় তো ছিনতাই এর ঘটনা আদৌ শুনে নি সে। তবে দিন কালের যে অবস্থা, তাতে ছিনতাইকারীর হাতে পড়তে এলাকা লাগে না। যখন তখন, দিনে দুপুরে ছিনতাই হচ্ছে আজকাল। “কিছু করে নি তো! সব ঠিক আছে তো?”
“নাহ… ওরা...” ফয়সাল যেন নিজেকে ব্রেক কষে থামিয়ে ফেলে। “যাগ গে… আর ওদিকে যাওয়া যাবে না...” ফয়সাল উঠে দাড়াতে গিয়ে টলে উঠে। ওকে ধরে ফেলে শান্তা। শরীরের ভারটা ধরে রাখতে পারে না। আবার বসে পড়ে ফয়সাল। তারপর মুখ তুলে তাকায় স্ত্রীর দিকে। “ওরা আমায় চিনে ফেলেছে… বুঝলে শান্তা? তুলিকে কলেজে একা যেতে দিও না...”
“আশ্চর্য! তুলি কলেজে একা কেন যাবে!” শান্তা ভ্রূ কুচকে বলে। “আর কারাই বা তোমাকে চিনে ফেলেছে? কি বলছ এসব আবল তাবল বল তো!”
“কিছু না...। তুমি বুঝবে না...” ফয়সাল আনমনে মাথা নাড়ে। তারপর উঠে দাড়ায়। শান্তা ওকে ধরতে গেলে ওর হাত ছাড়িয়ে নেয় ফয়সাল। তারপর খোঁড়াতে খোঁড়াতে শোবার ঘরের দিকে এগোয়।
শান্তা ভেবেছিলো, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ভয় পেয়েছে হয়তো ফয়সাল। কিন্তু রাত বাড়লেও ফয়সালের ভয় বাড়ল না। বারাণ্ডায় গিয়ে এক মনে দাড়িয়ে থাকলো ফয়সাল। শান্তা দুইবার গিয়ে খেতে ডেকে এলেও সাড়া দিলো না। অগত্যা তুলিকে খাইয়ে দিয়ে, শোবার ঘরে পাঠিয়ে আবার ডাকতে চলল ফয়সালকে শান্তা। এইবার সাড়া দিলো ফয়সাল। শান্তার সঙ্গে খেতে এলো।
খেতে খেতে প্রসঙ্গটা তুলতে চাইলো শান্তা। তবে ফয়সালের ভীত চেহারার দিকে চেয়ে আর এই প্রসঙ্গ তোলা হলো না তার। এক মনে খেয়ে গেলো ফয়সাল। ডালে একটু লবন কম হয়েছিলো বোধহয় - একবারও মুখ ফুটে বলল না সে কথা। খেয়ে দেয়ে উঠে চলে গেলো আবার শোবার ঘরে। শান্তা যখন বাসন কসন গুছিয়ে, তুলিকে ঘুম পারিয়ে শোবার ঘরে এলো - তখন দেখতে পেলো খাটের উপর ব্রিফকেসটা খুলে বসে আছে ফয়সাল। শান্তাকে দেখে চট করে বন্ধ করে দিলো ব্রিফকেস। একটু সন্দেহ জাগল শান্তার মনে। তবে ফয়সালকে বুঝতে দিলো না সেটা। ওদিকে না তাকিয়ে চলে গেলো বাথরুমে।
বাথরুমের দরজা লাগিয়ে শান্তা কান চেপে ধরল দরজায়। ওপাশে কিছুক্ষন পর আবার খোলা হল ব্রিফকেস। শব্দটা মৃদু হলেও টের পেলো শান্তা। ওর পেটের মধ্যে একটা শিহরণ খেলে গেলো। কি রেখেছে ফয়সাল ব্রিফকেসে? ওর পরকীয়ার প্রমাণ? শান্তার মনে পড়লো, ওতে একটা ছবির রীল ছিল। সেটা দেখা হয় নি শান্তার এখনো। রাজীব আর নাজিম ভাই দেখেছে। কিন্তু ফয়সাল ওটা দেখছে কেন লুকিয়ে লুকিয়ে?
ব্রিফকেসটা লাগাবার শব্দ হল। তারপর আলমারিতে তুলে রাখার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পেলো শান্তা। এর পরে সব আবার নিসচুপ। দরজায় আর কান পেতে কাজ নেই। কাজ সেরে, হাত মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে এলো শান্তা শোবার ঘরে। তবে ওখানে তখন ফয়সাল নেই আর। কোথায় গেলো এই রাতে? অন্য বাথরুমে? শান্তা আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল গুলো বেঁধে, খোপা করছে - তখন হঠাৎই নাক কুচকে উঠলো তার। কি পুড়ছে মনে হচ্ছে! কি পুড়ছে? আসার সময় কি ও চুলোতে কিছু বসিয়ে এসেছিলো?
তারপরই শান্তার বুকের ভেতরে ছ্যাঁত করে উঠে। ও ঘাবড়ে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাড়ায়। কি চলছে বুঝতে অসুবিধে হয় না শান্তার। রান্নাঘরের দিকে দৌড় দেয় শান্তা। কাছে যেতে যেতেই টের পায়, ওর আশংকা সত্ত্ব। চুলোর পাশে দাড়িয়ে ফয়সাল কিছু কাগজ পুরিয়ে ছারখার করছে।
“কি- কি করছ তুমি এসব!” শান্তা কাপা গলায় জানতে চায়। ওর কাছে মনে হয় কেউ যেন ওর গলা চেপে ধরেছে। ওর মুক্তির পথ আটকে দিচ্ছে। চোখের সামনে ফয়সাল হয়তো সব তথ্য প্রমাণ পুরিয়ে দিচ্ছে। “ফয়সাল! কি করছ তুমি...”
ফয়ালের কাঁধে হাত রাখতেই ফয়সাল ঘুরে দাড়ায়। হাসি হাসি মুখ তার। বলে; “অফিসের কিছু কাগজ পুরাচ্ছি। এগুলো না থাকলে আর চিন্তা নেই। একটা কথা আছে না! না রেহেগা বাশ, বা বাজেগি বাশুরি… হা হা হা...”
“কি পুরাচ্ছ তুমি এসব? করছ কি তুমি ফয়সাল?” শান্তা শেষ চেষ্টা করতে ওর হাত ধরে টানে। ওর চোখে পড়ে কি পুরাচ্ছে ফয়সাল। কিছু কাগজ পত্র - সঙ্গে ক্যামেরার রীল। ওর হাত থেমে যায়।
“আহা - যাও তো তুমি শান্তা… বিরক্ত কর না। ঘুমাও গিয়ে। আমি আসছি।”
শান্তা আর দাঁড়ায় না। ওর কান্না পাচ্ছে। মনে হচ্ছে এত কিছুর পরেও কেমন করে সব প্রমাণ মুছে গেলো ওর জীবন থেকে। এত গুলো দিন যে নতুন স্বপ্ন নিয়ে বাচতে শিখেছিল শান্তা, তা যেন আজ পুরিয়ে দিলো ফয়সাল। ফয়সালের উপর তীব্র ঘৃণা আর রাগ জন্মে উঠে শান্তার। মনে মনে ভেবেই ফেলে - ছিনতাই কারী গুলো আজ ফয়সালকে জখম করে ফেলল না কেন? রোজ কতো লোকই তো খুন হচ্ছে ছিনতাই কারীর হাতে। যদি…
শান্তা কাদতে আরম্ভ করলো। ওর চোখ গড়িয়ে আশ্রু পড়ছে। শোবার ঘরে আর গেলো না সে। নিজের বালিশ নিয়ে চলে গেলো তুলির পাশের বিছানায়। এক পাশে ঘুরে কান্না আটকে রেখে চোখ বুজে রাখল।
বেশ অনেকক্ষণ পর টের পেলো শান্তা ফয়সাল ঘুমাতে গেছে। হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা তুলে নিলো সে। ফোন দিলো রাজীবকে। ওপাশে বেজেই চলল মোবাইলটা। কেউ ধরছে না...
রিয়ান খান