Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
#72
নিজের জন্য

আজ সকাল থেকেই খুব মন ভার অনিমার। আজ ওনার জন্মদিন। সেই উপলক্ষ্যেই বাড়িতে নাকি আজ অনেক লোকজন আসার কথা। আর, তাদের সামনে নতুন শাড়ি পরে, হাসি হাসি মুখে উপস্থিত থাকতে হবে ওনাকে। গদগদ মুখে বলা "হ্যাপি বার্থডে" র উত্তরে আরো গদগদ হয়ে "থ্যাংকইউ" বলতে হবে...।
বলতেই হবে।
নাহলে ওনার ছেলে আর মেয়ের স্টেটাস ঠিক থাকবে কীভাবে?
এমনিতে সারাবছর ই বিভিন্নভাবে অপমানিত হন উনি। না, খাওয়া -পরার অভাব হয় না কখনো। প্রতিবছর পুজোতে মেয়ে জোর করে নামী মলের দামী দোকানের শাড়ি কিনে দেয়। ছেলে কোনোবছর মোবাইল, কোনোবছর অন্য কিছু 'দরকারী' জিনিস কিনে দেয়। এইভাবেই আলমারি ভরে গেছে বহুমূল্য শাড়িতে...বাড়িতে ইলেক্ট্রনিক গ্যাজেটস এর ও অভাব নেই। এমন কি, ব্লু টুথ হেডফোন ও আছে...যেখানে ওঁর কানে হেডফোন গুঁজে গান শোনার অভ্যেস নেই একটুও...তাও "সব ই তো মায়ের আছে" লিস্টে যোগ হয়েছে সেটিও। কিন্তু যে জিনিসটির জন্য ওঁনার মাতৃহৃদয় কাঁদে - সন্তানদের কাছে সম্মান, ভালোবাসা, নিদেন পক্ষে মাঝে সাঝে একটু মিষ্টি কথা...কিচ্ছু পান না উনি। বরং বারবার মনে করিয়ে দেওয়া হয় উনি স্বল্প শিক্ষিত, তাই ছেলে বা মেয়ের জন্য 'কিছুই করেন নি!' উনি নেহাতই একজন জড়বস্তু যেন! মাঝে মাঝে ভাবেন, এই কি সেই বাপ্পা আর গিনু? বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাপ্পা এসেছিল কোল জুড়ে। তার পাঁচবছর পরে গিনু। তখন ওঁকে ঘিরেই রাজ্যপাট ছিল ওদের। কত বড় বয়স পর্যন্ত গিনুকে ভাত মেখে খাইয়ে দিতে হয়েছে...বাপ্পা তো কোনো চাকরির ইন্টারভিউ থাকলে সকালে উঠে অন্য কারো মুখ ও দেখত না, ওনার মুখ ই দেখবে বলে....।
পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে চোখে জল এলো অনিমার। সময় কীভাবে পালটে যায়! ওনার স্বামীর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল। ক্যান্সারের চিকিৎসা যথেষ্ট খরচাসাপেক্ষ...সেইসব সামলাতে গিয়ে যেটুকু সঞ্চয় ছিল, চলে গেছে সবটাই। উনিও আর রইলেন কই! আর, তারপর থেকেই শুরু হলো এই অবমাননা। এক ই বাড়িতে থাকলেও বাপ্পা দিনের পর দেখাই করে না। গিনু ফোন করে রোজ ই প্রায়, কিন্তু 'কেমন আছো?' র পরে আর কথা এগোয় না! না, বৌমার দোষ দেন না উনি। কিন্তু, ছেলেটা এমন হলো কেন?কখনো কথা বলার জন্য ওর কাছে গেলেই 'পরে বলো,এখন একটু কাজ করছি!' শুনতে হয় ওনাকে। আর সেই পর টা আর আসেই না! কিন্তু এত কিছুর মাঝেও, প্রতিবছর ঘটা করে ওনার জন্মদিন পালন করা হয়, যেখানে বাপ্পা ওর অফিসের লোকজন, বিজনেস অ্যাসোসিয়েটস দের ডাকে। গিনুর শ্বশুরবাড়ির কয়েকজন ও আসেন। সবমিলিয়ে একটাই জিনিস প্রকট হয় 'দেখো আমরা আমাদের মা কে কত ভালো রেখেছি...আমরা কত ভালো ছেলে আর মেয়ে!'
"এই যে রেডি হও নি তুমি এখনও? লোকজন চলে এলে কি এই রং চটা নাইটি পরেই যাবে নাকি?" খরখর করে বলে নিজের ঘরে গেল গিনু। ও আজ সকালেই চলে এসেছে এই বাড়ি। দুপুরে খাওয়া দাওয়া গজল্লা সব হয়েছে...কিন্তু...একবার ও প্রনাম করার কথা মনে পড়েনি মেয়ে বা ছেলে কারো।
খাট থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে একটু জল দিলেন অনিমা। ভাদ্র মাসের পচা গরম। বৃষ্টি পড়ছে ঠিক ই, কিন্তু গরম ও কমছে না। তারমধ্যে পঁচাত্তর হয়ে গেল! ডায়মন্ড জুবিলি! ভাবা যায়!
ঘরে এসে আলমারি খুলে কী পরবেন ভাবছেন...শাড়ি তো অজস্র...কিন্তু...
হঠাৎ চোখ আটকে গেল কিছুদিন আগেই লন্ড্রি থেকে কাচিয়ে আনা একটা শাড়ির দিকে। শাড়িটা এখনও খবরের কাগজ দিয়ে মোড়া আছে, কিন্তু একটা হেডলাইন নজর কাড়ল ওঁর। "মহানগরে অবসাদ বৃদ্ধদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, জানাল সমীক্ষা"। হেডলাইন টা দেখেই কেমন একটা শিহরণ বয়ে গেল ওনার মধ্যে। অবসাদ! হ্যাঁ, তীব্র একটা অবসাদ তো আছেই। নিজেকে ছেলে মেয়ের মুখাপেক্ষী ভাবা, ওদের করুণার পাত্রী ভাবা.. আর সেই থেকে আসা অবসাদ...কিন্তু উনি যে সারাজীবন জেনে আর মেনে এসেছেন, সংসারে সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ? উনি নিজে হাউজ ওয়াইফ ছিলেন, যাকে আজকাল ঘটা করে 'হোম মেকার' বলা হয়। ওনাদের সময় এই পরিভাষা না থাকলেও ওনার স্বামী বিশ্বাস করে এসেছেন ঘর তৈরি উনিই করেন! আর সেই ভাবনাতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা ছিল সমান তালে। হয়ত, বাপ্পা, গিনু কে সেটাই মনে করিয়ে দেবার সময় এসেছে! ভেবে, আলমারির নিচের তাক থেকে একটা শাড়ি বের করে নিলেন উনি। একটা তাঁতের শাড়ি। চলে যাবার আগে ওঁনার দেওয়া শেষ উপহার। ছানার জল রঙের ওপর সবুজ পাড়। আজ এটাই পরবেন উনি।
শাড়ি পরে নিয়ে মুখে আলতো করে পাউডার বোলাচ্ছেন, ঘরে এলো গিনু। লাল শিফনে অপরূপা লাগছে ওকে। ওনাকে দেখে অবাক হয়ে বলল "এই শাড়িটা কেন পরেছ মা? তোমার আর শাড়ি নেই? অন্য কিছু পরো...একটা গর্জাস কিছু... এত তো দেওয়া হয় তোমাকে!"
মেয়ের মনে নেই এই শাড়িটার কথা!
একটু চুপ করে রইলেন উনি। তারপর একটু আগে নিজেকে করা প্রতিজ্ঞার কথা মনে রেখে বললেন "সোহাগিনী, এই শাড়িটা তোমার মনে নেই নিশ্চয়ই, এটা তোমাদের বাবার আমাকে দেওয়া শেষ উপহার। তাই আমি আজ এটাই পরব। আর তোমরা নিজেদের ইচ্ছেমতো কিনে দাও আমাকে, বরং সেসব না করে একটু কাছ্র এসে বসলে ভালো লাগত আমার।"
অবাক হয়ে ওঁর দিকে একবার তাকালো গিনু! গিনু নয়...সোহাগিনী! মা কি খুব রেগে আছেন? আর কতদিন হয়ে গেল...মায়ের সাথে কথাই বলা হয় না...সত্যিই তো...বাবার দেওয়া শাড়ি...মায়ের কাছে তো আলাদা ইমোশান হবেই।
এর ই মধ্যে ফোনে বাড়ির পথনির্দেশ দিতে দিতে ঘরে ঢুকল বাপ্পা। পাঞ্জাবি পরেছে...বেশ সুপুরুষ লাগছে ওকে। কিন্তু সে ও ওঁকে দেখে কেমন অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল "মা তুমি রেডি হয়েছ? সবাই চলে আসছে তো!"
একবার ছেলের দিলে তাকালেন উনি, তারপর ম্লান হেসে বললেন "তাও, ভাগ্যিস সবাই আসছেন, সুমন্ত্র, তাই তো তুমি আজ নিজে থেকে এই ঘরে এলে, 'মা' বলে ডাকলে! সবাই আসুন, যদিও আমি কাউকে আমন্ত্রণ জানাই নি, কিন্তু তোমাদের সম্মানের কথা মাথায় রেখে আমি সামনে যাব...কিছুক্ষণ থাকবও, কিন্তু আজ আমার একটু একা থাকতেই বেশি ভালো লাগবে, আমাকে জোর করো না তোমরা কেউ!"
চিরজীবনের ভালোমানুষ, চুপ করে থাকা মায়ের কথা শুনে একটু চুপ করে রইল ছেলেও। তারপর বলল "স্যরি মা, সত্যিই আসা হয় না তোমার কাছে...কাজে ব্যস্ত থাকি...তবে আর কোনো অজুহাত দেব না...এবার থেকে রোজ আসব তোমার কাছে...অন্তত অফিস থেকে ফিরে, যাবার আগে যদি সময় না ও পাই..."। তখনই গিনুও বলে উঠল "মা, আজ আমি তোমার সাথে শোব রাতে, সেই আগের মতো?"
একটু চুপ করে রইলেন অনিমা। তারপর একটু হাসলেন। ওনার স্বামী বারবার বলতেন "শুধুই সর্বংসহা 'মা' হোয়ো না...মাঝে মাঝে বারণ করা 'না' হতেও শেখো..."। আর আজ সেই "না" ই হয়ত ছেলে-মেয়ের কাছে মনে করিয়ে দিল, উনি আছেন এখনও, নিছক জড়বস্তু না হয়ে...একজন রক্তমাংসের মানুষ হয়ে।
এই যে সবকিছু মেনে নেওয়া 'মা' থেকে নিজের কথা, নিজের 'না' বলার মানুষে উত্তরণ...এই পঁচাত্তরে এটাই ওনার উপহার, নিজের জন্য, নিজেকে।
[+] 3 users Like ddey333's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 13-11-2020, 02:53 PM



Users browsing this thread: 19 Guest(s)