16-03-2019, 10:26 AM
- ১১ -
বুকুন চলে যাওয়ার পরে ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে মা ফিরল। বুকুনের মা আর ওর ছেলে ওই রিকশাতেই বাড়ি চলে গেল।
মা বলল, 'উফ কী দারুণ হল রে!'
'আর সিনেমাটা?'
'বইটাও দারুণ, তবে এরকম হল আমি জীবনেও দেখি নি। বসতেই গা ডুবে গেল চেয়ারে। বুকুনের ছেলে আবার আমাদের শেখালো চেয়ারটা কীভাবে হেলানো যায়। টাউনে আগে যেসব সিনেমা দেখেছি - সব কাঠের চেয়ার।'
'দেখলে তো? আমি জোর করে পাঠালাম বলে এরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স হল!'
'সত্যি রে! চা খাবি তো?'
মা একটু পরে চা করে এনে দিল।
চা খেয়ে আমি বললাম 'একটু আড্ডা দিতে বেরচ্ছি। দেরী হতে পারে, চিন্তা করো না।'
'বেশী দেরী করিস না।'
'তুমি খেয়ে নিও।'
এক বন্ধুকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আরেকজনের বাড়িতে আড্ডায় বসা হল। আরও কয়েকজন জুটল। চা, সিঙাড়া, চানাচুর আর আড্ডা - শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিলাম।
মনে হল বউ-ছেলের সঙ্গে পুজোর মধ্যে সেভাবে কথাই হয় নি। মজাতেই আছে নিশ্চই, তবু ফোন করাটা আমার কর্তব্য।
পিয়ালীর মোবাইলে ফোন করলাম – তিন চার বার – বেজে গেল, কেউ ধরল না।
তারপর বাড়ির ল্যান্ড কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ঘুম জড়ানো গলায় ফোনটা ধরল ছেলে।
‘কেমন আছিস রে? বাবাকে ভুলেই গেলি?’
‘খুব ঘুরছি দুদিন ধরে। টায়ার্ড.. তুমি ভাল আছ? ঠাম্মা?’
‘ভাল আছি.. এলি না তো এখানে.. অন্যরকম পুজোর মজা হত!’
‘হুম..রাখি?’
‘তোর মাকে দে..’
‘মা নেই তো! পার্টি করতে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে’
‘তুই একা আছিস নাকি!! এত রাতেও ফেরে নি? কোথায় গেছে রে?’
‘মঞ্জুমাসি আছে বাড়িতে.. কোথায় গেছে মা জানি না। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গেল..’
মঞ্জু আমাদের বাড়ির কাজের মাসি। তার কাছে ছেলেকে রেখে দিয়ে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কোথায় পার্টি করতে গেছে পিয়ালী? ফোনও তো ধরছে না!
চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি!
ছেলেকে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ঘুমিয়ে পড়.. ভয় পাস না।‘
আবার একটা সিগারেট ধরালাম.. আমার চিন্তা হচ্ছিল – এত রাত অবধি একা একা পার্টি করতে তো কখনও দেখি নি পিয়ালীকে – তাও আবার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে!! কোন বন্ধু, কোথায় গেছে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না.. হঠাৎই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল।
কানে দিয়ে হ্যালো বলতে ওপার থেকে তারস্বরে গান আর হুল্লোড়ের আওয়াজ। তার মধ্যেই একটা পুরুষ কন্ঠ বলার চেষ্টা করছিল যে সে পিয়ালীর বন্ধু! পিয়ালী তাদের সঙ্গেই একটা পার্টিতে আছে, আমার ফোন ধরতে পারে নি, তাই পিয়ালীই বলেছে আমাকে ফোন করে জানাতে যে সে ঠিক আছে।
পুরুষ কন্ঠটা কার, চিনতে পারলাম না।
তবে শেষে সে বলল, পিয়ালী যে ঠিক আছে, সেটা বোঝানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও পাঠাচ্ছে একটু পরে।
অপেক্ষা করতে থাকলাম আমি বউ যে ঠিকঠাক আছে, সেই প্রমান আসার।
আবারও একটা সিগারেট।
টিং টিং করে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকল। এই নম্বরটাও অচেনা।
একটা ভিডিয়ো এসেছে।
খুললাম সেটা – দেখতে দেখতে কখন যে আমার দুই আঙ্গুলের মাঝখান থেকে সিগারেটটা পড়ে গেছে, খেয়ালই করি নি।
প্রচন্ড জোরে গান-বাজনার আওয়াজ আর কিছুটা আধো অন্ধকার ঘরে উদ্দাম নাচানাচি করছে কিছু মহিলা-পুরুষ।
ওই মহিলাদের মধ্যেই একজনকে চিনতে পারলাম – আমার বউ!
সে ছোটবেলায় নাচ শিখেছে জানতাম বিয়ের সময়েই। কিন্তু এখনও যে এরকম শরীর দুলিয়ে নাচতে পারে, সেটা জানতাম না।
ভিডিয়োতেই দেখতে পেলাম তিনচারটে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে উদ্দাম নৃত্য চলছে। মধ্যমনি আমার বউ।
তার যে বুক থেকে আঁচল খসে গেছে, সেটা তার খেয়ালই নেই, কিন্তু আমার নজর এড়ালো না।
নাচের মধ্যেই দেখলাম দুদিক থেকে দুজন পুরুষ – তারা কারা চিনতে পারলাম না – পিয়ালীর শরীরের নানা জায়গায় হাত বোলাচ্ছে। আমার বউও একজনের কাঁধে হাত দিয়ে কোমর দোলাচ্ছে, আরেকজনের বুকের খুব কাছাকাছি আমার বউয়ের আঁচল খসে যাওয়া উদ্ধত বুক।
এ যদি আমার বউ না হত, তাহলে হয়তো দৃশ্যটা বেশ উপভোগই করতাম। কিন্তু ছেলেকে বাড়িতে একা রেখে দিয়ে পিয়ালী এ কাদের সঙ্গে কোথায় গেছে এসব করতে!!!
ভিডিয়োটা দেখা শেষ হওয়ার আগেই একটা টেক্সট মেসেজ এলো – কী বস, তোমার বউ ঠিকঠাক আছে কী না দেখলে তো? আমরা বারাসাতের দিকে এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে এসেছি – সকালের মধ্যে তোমার বউকে বাড়ি দিয়ে আসার দায়িত্ব আমার। আমি তমাল – পিয়ালীর সঙ্গে কলেজে পড়তাম।
সকাল হতে অনেক দেরী! ততক্ষণ আমাকে না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে বুঝলাম!
কিন্তু একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে যে কখন চোখটা লেগে এসেছিল, খেয়ালই করি নি।
মোবাইলের আওয়াজে তন্দ্রাটা কাটল।
বুকুনের ফোন।
মোবাইলেই দেখলাম রাত প্রায় দুটো। পিয়ালীর খোঁজ করতে গিয়ে আর বুকুনকে ফোন করা হয় নি রাতে। কিন্তু তা বলে এত রাতে ফোন করছে কেন?
গলাটা নামিয়ে বললাম, ‘বল, কী হল? এত রাতে?’
‘ও এখনও ফেরে নি রবিদা!’
‘কে?’
‘বর’
‘মানে? কোথায় গেছে? ফোন করিস নি?’
‘করেছিলাম, ধরছে না। কোথায় গেছে জানি না। সন্ধ্যেবেলায় টাউনের কোন বন্ধুর বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে – মদ খাওয়ার আসর নিশ্চই। রাত করেই ফেরে, কিন্তু কখনও এত রাত হয় নি, আর ফোনও সবসময়ে ধরে। কী করব আমি এখন রবিদা?’
‘কার বাড়ি গেছে জানিস? কোন পাড়ায়?’
‘নতুন পাড়ায় একজন আছে জানি, শিবেন বলে। বাড়িও চিনি। কিন্তু তার কাছেই গেছে না অন্য কোথাও জানি না তো!’ বুকুনের গলাটা ভেজা ভেজা লাগল।
‘কারও ফোন নম্বর নেই?’
‘না রে’
মনে মনে ভাবলাম কী অবস্থা – একদিকে আমার বউ তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে উদ্দাম পার্টি করছে এদিকে বুকুনের বর কোথায় মাল খেতে গিয়ে এখনও বাড়ি ফেরে নি!!
কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আমি সাইকেল নিয়ে বেরচ্ছি। তোকেও যেতে হবে! আমি তো ওই শিবেনের বাড়ি চিনি না!’
‘এত রাতে বেরবো তোর সঙ্গে?’
‘কী করবি আর? না হলে অপেক্ষা কর সকাল অবধি। আমাকেও সকাল অবধি ওয়েট করতে হবে – বউ পার্টি করতে গেছে তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে – ছেলে বাড়িতে কাজের মাসির কাছে একা!’
‘অ্যাঁ !!! সে কি!!’
তারপরেই বুকুন বলল, ‘তুই আয় সাইকেল নিয়ে। আমি মাকে ঘুম থেকে তুলে বলি ব্যাপারটা।‘
‘হুম।‘
আমি মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দিলাম কয়েকবার।
ঘুম জড়ানো গলায় মা বলল, ‘কে রে? রবি?
‘মা শোনো আমি একটু বেরচ্ছি। বুকুনের বর এই রাত দুটোর সময়েও বাড়ি ফেরে নি। ও ফোন করেছিল। সে ফোনও ধরছে না। আমি একটু বেরিয়ে দেখি।‘
‘দাঁড়া বাবা। আসছি।‘
ঘরের লাইট জ্বালিয়ে বাইরে বেরলো মা।
‘কী ব্যাপার রে! রাত আড়াইটে বাজতে চলল, এখনও বাড়ি ফেরে নি!’
আমি আর বললাম না যে তার পুত্রবধূও বাড়ি ফেরে নি এখনও – সারা রাত ফিরবেও না।
‘কোথায় খোঁজ করতে যাবি এখন তুই?’
মাকে আর বললাম না যে টাউনে হারা উদ্দেশ্যে খুঁজতে বেরতে হবে পুরণো প্রেমিকার স্বামীকে।
‘তুমি চিন্তা কর না। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি। তুমি ঘুমোও গিয়ে।‘
‘টর্চ নিয়ে যাস একটা।‘
‘তোমার দরকার হলে ফোন কর। মোবাইল সঙ্গে আছে।‘
একহাতে টর্চ অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে দরজা খুলে বেরিয়ে তালা দিয়ে দিলাম।
পুজোর নবমী আজ। হাল্কা কুয়াশা আছে। শীতের আমেজ রয়েছে, তবে ঠান্ডা লাগছে না।
বুকুনের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে ওকে ফোন করলাম একটা। দরজায় নক করা ঠিক হবে না।
রিং হতেই ও ফোন ধরে বলল, ‘এসে গেছিস? বেরচ্ছি।‘
ওর মা দরজা খুলল।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কাকিমার ঘুম লাগা চোখে উদ্বেগ।
গলা নামিয়ে বলল, ‘দেখ রবি রাত আড়াইটে বাজল, তার বাড়ি ফেরার নাম নেই। মেয়েটাকে এখন বেরতে হচ্ছে। তুই দুদিনের জন্য এসে ঝামেলায় পড়লি। ওইসব ছাইপাশ খেয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে কাল সকালে যদি কেউ দেখে ফেলে বেইজ্জতের একশেষ হব আমরা! সবই কপাল!!‘
‘ঝামেলার কী আছে কাকিমা। এটা তো কর্তব্য!’
আমার বউকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কর্তব্যও তো করবে তার কলেজের কোন বন্ধু তমাল!!
বুকুন বেরিয়ে এল ভেতর থেকে।
কাকিমা বলল, ‘বেশী দেরী করিস না তোরা। এদিক ওদিক দেখে চলে আয়।
‘তুমি দরজা দিয়ে দাও। রবিদা আছে তো। চিন্তা কর না।‘
কাকিমা দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাইকেলটা হাঁটিয়েই নিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। বুকুন সাইকেলের অন্য দিকে।
ওদের বাড়ির মোড়টা ঘোরার পরে বললাম, ‘বস সাইকেলে।‘
একবার তাকাল আমার দিকে, তারপর কথা না বলে সাইকেলের সামনের রডে উঠে বসল।
বুকুন এভাবেই যখন ছোটবেলায় সাইকেলের রডে বসত, তখন কতকিছুই না ভাবতাম মনে মনে।
ওকে কী বলব আমার বউয়ের ব্যাপারটা?
নাহ থাক! এমনিতেই বেচারা চিন্তায় রয়েছে, তার ওপরে ওকে আবার এসব বলে চিন্তা বাড়ানোটা ঠিক হবে না।
জিগ্যেস করলাম, ‘ওই শিবেন ছাড়া আর কারও বাড়ি চিনিস – যেখানে তোর বর গিয়ে থাকতে পারে?’
‘আরেকটা বাড়ি চিনি, কিন্তু তার নাম ভুলে গেছি। একবার আসার পথে বাড়িটা দেখিয়ে বলেছিল তার বন্ধুর বাড়ি।‘
‘কোন দিকে সেটা?’
‘দূর আছে তাদের বাড়ি। হাইওয়ের দিকে যেতে হবে টাউন পেরিয়ে।‘
‘ও আচ্ছা। চল দেখা যাক।‘
বুকুনের বগলের তলা দিয়ে গিয়ে আমার দুটো হাত সাইকেলের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে রয়েছে। প্যাডেল করতে গিয়ে ওর কোমরে আমার থাইয়ের ছোঁয়া লাগছে। ওর চুলের গন্ধ লাগছে নাকে। ওর চুলের গন্ধটা নেওয়ার জন্য মাথাটা একটু ঝুঁকিয়েছিলাম। ও বোধহয় টের পেয়েছিল আমার নিশ্বাস। মাথাটা একটু আমার দিকে ঘুরিয়ে হাতে একটা আলতো করে চিমটি কেটে বলল, ‘দুপুরে তোর আশ মেটে নি রবিদা?’
‘এত বছরের না পাওয়া – অত অল্পে কি আশ মেটে?’
এবার আর শুধু চুলের গন্ধ নেওয়ার জন্য না, মুখটাই নামিয়ে দিলাম ওর চুলের মধ্যে, তারপরে কানের লতিতে।
‘এরকম দুষ্টুমি করতে গিয়ে আবার কিন্তু ফেলে দিবি তুই আমাকে সাইকেল থেকে! মনে আছে সাইকেল চালানো শেখাতে গিয়ে ফেলে দিয়েছিলি!’
‘মমম মনে থাকবে না?’
---
- ১২ -
গ্রামের রাস্তা থেকে আমরা ততক্ষণে টাউনের রাস্তা ধরে নিয়েছি। কোথাও কোনও কাকপক্ষী নেই – মানুষ তো দূরের কথা।
অথচ এটাই যদি কলকাতা শহর হতো, তাহলে পুজোর সময়ে এত রাতেও রাস্তায় গাড়ির জ্যাম লেগে থাকত, শয়ে শয়ে লোকের সামনে এভাবে পুরণো প্রেমিকাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে তার বরের খোঁজ করতে যাওয়ার আগে দুবার ভাবতে হত।
আবার এটাই যদি কলকাতা হত, আর আমি শহরে থাকতাম পুজোর সময়ে, তাহলে পিয়ালীও হয়তো তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বারাসাতের কোনও বাগানবাড়িতে সারারাতের পার্টিতে গিয়ে মদ খেয়ে উত্তাল নাচ করত না!
কিছুক্ষণ আর বিশেষ কোনও কথা হল না আমার আর বুকুনের।
সামনে একটা গলি দেখিয়ে বুকুন বলল, ‘ওই গলিটায় চল রবিদা। এবার আমাকে সাইকেল থেকে নামিয়ে দে রে।‘
‘শিবেনের বাড়ি এই গলিতে?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘হুম’ বলে ছোট্ট জবাব দিল বুকুন।
গলির ভেতরটা বেশ অন্ধকার। টর্চ জ্বালালাম আমি।
কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বুকুন বলল, ‘এই বাড়ি।‘
আমি সাইকেলটা স্ট্যান্ড করিয়ে ওকে নিয়ে সামনের ছোট্ট গ্রিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। সদর দরজায় টর্চ মেরে দেখলাম কোথায় বেল রয়েছে।
চারদিক নিস্তব্ধ, তাই বেলটা বেশ জোরে বেজে উঠল।
কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। আবারও একবার বেল দিতে যাব, ভেতরের কোনও ঘরে একটা আলো জ্বলে উঠল – দেখতে পেলাম জানলা দিয়ে।
আরও মিনিট খানেক পরে এক মহিলার গলা পেলাম, ঘুমে জড়ানো।
‘কে?’
জবাব দিল বুকুন, ‘দিদি, আমি শিবেনদার বন্ধু অর্ণবের স্ত্রী বুকুন।‘
কয়েক মুহুর্তে দরজাটা একটু ফাঁক হল। সদরের বাইরে কোলাপসিবল গেট লাগানো রয়েছে।
উঁকি দিল একটা মুখ।
‘আরে দিদি, আপনি, এত রাত্তিরে? কী হয়েছে?’ জিগ্যেস করলেন ওই মহিলা।
‘সরি এত রাতে ডিসটার্ব করলাম। অর্ণব এখনও বাড়ি ফেরে নি, মোবাইলও ধরছে না। ওর এখানকার আর কোনও বন্ধুর বাড়ি তো চিনি না, তাই আমার পাড়ার দাদাকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে এসেছি। শিবেনদা কি বাড়িতে?’ জানতে চাইল বুকুন।
মহিলা আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘আসুন আসুন ভেতরে।‘
চাবি দিয়ে কোলাপসিবল গেটটা খুলতে খুলতে বললেন শিবেনের বউ।
‘না না ভেতরে আর আসব না। শিবেনদা কি আছে বাড়িতে? অর্ণব কোথায় যে গেছে, সেটাও কিছু তো বলে যায় নি।‘
শিবেনের বউ বললেন, ‘শিবেন বাড়ি ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। কোথায় গিয়েছিল সেটা তো জানি না। প্রচুর মদ খেয়ে এসে মরার মতো ঘুমোচ্ছে। আপনারা ভেতরে আসুন। ওদের কয়েকজন বন্ধুর নম্বর আছে আমার কাছে। ফোন করে দেখছি অর্ণবদা কোথায় আছে কেউ বলতে পারে কী না।‘
আমরা দুজনের উনার পেছন পেছন গিয়ে বসার ঘরে ঢুকলাম। শিবেনের বউ ভেতরের ঘরে গিয়ে একটু জোর গলাতেই বরকে ডাকছে শুনতে পেলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে নেশা জড়ানো একটা গলার আওয়াজ পেলাম ভেতরের ঘর থেকে।
নিশ্চই শিবেনেরই গলা, কিন্তু কী বলছে সে বাইরের ঘরে বসে বুঝতে পারলাম না।
তবে আরও কিছুক্ষণ পরে প্রথমে শিবেনের স্ত্রী বেরিয়ে এল, পেছনে টলোমলো পায়ে একটা পেটমোটা লোক – হাফপ্যান্ট পড়ে।
জড়ানো গলায় শিবেন যা বলল তার অর্থ হল বুকুনের বর আর শিবেন এক সঙ্গেই ছিল। কিন্তু অর্ণবের নেশাটা একটু বেশী-ই হয়ে গেছে, তাই ওরা যার বাড়িতে বসে মদ খাচ্ছিল, সেই আশুতোষের বাড়িতেই শুয়ে পড়েছে। বাড়িটা টাউনের অনেকটা বাইরে – হাইওয়ের দিকে। শিবেনের সঙ্গে আরেক বন্ধু ছিল, সে-ই বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে গেছে ওকে, নাহলে ও-ও বাড়ি ফেরার মতো অবস্থায় ছিল না।
বুকুনের মুখটা কালো হয়ে গেছে, ও মাথা নীচু করে শুনে গেল সবটা। তারপরে শিবেনের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি দিদি আপনাদের এত রাতে অসুবিধা করলাম এভাবে। আসি আমরা। নমস্কার।‘
‘আরে না না, অসুবিধার কী আছে। কর্তা বাড়ি না ফিরলে, কোনও খোঁজ না পেলে চিন্তা তো হবেই। তারপর আপনারা এখানে থাকেন না!’ বলতে বলতে আমাদের পেছন পেছন শিবেনের বউও এগিয়ে এসেছিল দরজার দিকে।
প্রায় যখন দরজার বাইরে চলে এসেছি, তখন শিবেন পেছন থেকে জড়ানো গলায় বলে উঠল, ‘আসলে আশুর বউ আর শালী ছিল তো আজ – যা নাচছিল ওরা দুই বোন মাল খেয়ে, সেই দেখে আমাদেরও সকলেরই একটু বেশী চড়ে গিয়েছিল। আশুর শালীর সঙ্গে নাচতে নাচতেই ওর গায়ে পড়ে গিয়ে অর্ণব সেই যে বিছানা নিল, তারপরে আর তোলাই গেল না। ওর সঙ্গেই বোধহয় শুয়ে আছে.. হেহেহেহে।‘
আমি, বুকুন আর শিবেনের বউ স্তব্ধ, আমাদের পা নড়ছে না।
শিবেনের বউ মাথাটা নামিয়ে নিয়েছে। বোধহয় ভাবতে পারে নি অর্ণবের কীর্তিটা এভাবে তার বউয়ের সামনে ফাঁস করে দেবে নিজের বর।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা সামাল দিতে স্বামীর দিকে ঘুরে বলল, ‘অনেক বকবক করেছ – যাও ঘুমোও গিয়ে। নেশার ঘোরে কোথায় কী বলছ সেটা খেয়াল রাখতে পার না!!‘
তারপর আমাদের দিকে তাকাল শিবেনের স্ত্রী – আবারও মাথাটা নামিয়ে নিল।
ধীর গলায় বলল, ‘না করলাম মুখ খুলতে, শুনল না।‘
বুকুন আমার জামাটা ধরে সামান্য টান দিল, ‘চল রবিদা। আসি দিদি।‘
বাইরে বেরিয়ে এসে সাইকেলের স্ট্যান্ডটা তুলে ধীরে ধীরে প্রায় অন্ধকার গলি দিয়ে এগিয়ে চললাম আমি আর বুকুন।
বড়রাস্তা থেকে সামান্য আলো আসছিল।
--
বুকুন চলে যাওয়ার পরে ঘরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পরে মা ফিরল। বুকুনের মা আর ওর ছেলে ওই রিকশাতেই বাড়ি চলে গেল।
মা বলল, 'উফ কী দারুণ হল রে!'
'আর সিনেমাটা?'
'বইটাও দারুণ, তবে এরকম হল আমি জীবনেও দেখি নি। বসতেই গা ডুবে গেল চেয়ারে। বুকুনের ছেলে আবার আমাদের শেখালো চেয়ারটা কীভাবে হেলানো যায়। টাউনে আগে যেসব সিনেমা দেখেছি - সব কাঠের চেয়ার।'
'দেখলে তো? আমি জোর করে পাঠালাম বলে এরকম একটা এক্সপেরিয়েন্স হল!'
'সত্যি রে! চা খাবি তো?'
মা একটু পরে চা করে এনে দিল।
চা খেয়ে আমি বললাম 'একটু আড্ডা দিতে বেরচ্ছি। দেরী হতে পারে, চিন্তা করো না।'
'বেশী দেরী করিস না।'
'তুমি খেয়ে নিও।'
এক বন্ধুকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে আরেকজনের বাড়িতে আড্ডায় বসা হল। আরও কয়েকজন জুটল। চা, সিঙাড়া, চানাচুর আর আড্ডা - শেষ হতে হতে বেশ রাত হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে তাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিলাম।
মনে হল বউ-ছেলের সঙ্গে পুজোর মধ্যে সেভাবে কথাই হয় নি। মজাতেই আছে নিশ্চই, তবু ফোন করাটা আমার কর্তব্য।
পিয়ালীর মোবাইলে ফোন করলাম – তিন চার বার – বেজে গেল, কেউ ধরল না।
তারপর বাড়ির ল্যান্ড কয়েকবার রিং হওয়ার পরে ঘুম জড়ানো গলায় ফোনটা ধরল ছেলে।
‘কেমন আছিস রে? বাবাকে ভুলেই গেলি?’
‘খুব ঘুরছি দুদিন ধরে। টায়ার্ড.. তুমি ভাল আছ? ঠাম্মা?’
‘ভাল আছি.. এলি না তো এখানে.. অন্যরকম পুজোর মজা হত!’
‘হুম..রাখি?’
‘তোর মাকে দে..’
‘মা নেই তো! পার্টি করতে গেছে বন্ধুদের সঙ্গে’
‘তুই একা আছিস নাকি!! এত রাতেও ফেরে নি? কোথায় গেছে রে?’
‘মঞ্জুমাসি আছে বাড়িতে.. কোথায় গেছে মা জানি না। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গেল..’
মঞ্জু আমাদের বাড়ির কাজের মাসি। তার কাছে ছেলেকে রেখে দিয়ে রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত কোথায় পার্টি করতে গেছে পিয়ালী? ফোনও তো ধরছে না!
চিন্তায় পড়ে গেলাম আমি!
ছেলেকে বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ঘুমিয়ে পড়.. ভয় পাস না।‘
আবার একটা সিগারেট ধরালাম.. আমার চিন্তা হচ্ছিল – এত রাত অবধি একা একা পার্টি করতে তো কখনও দেখি নি পিয়ালীকে – তাও আবার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে!! কোন বন্ধু, কোথায় গেছে, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না.. হঠাৎই একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল।
কানে দিয়ে হ্যালো বলতে ওপার থেকে তারস্বরে গান আর হুল্লোড়ের আওয়াজ। তার মধ্যেই একটা পুরুষ কন্ঠ বলার চেষ্টা করছিল যে সে পিয়ালীর বন্ধু! পিয়ালী তাদের সঙ্গেই একটা পার্টিতে আছে, আমার ফোন ধরতে পারে নি, তাই পিয়ালীই বলেছে আমাকে ফোন করে জানাতে যে সে ঠিক আছে।
পুরুষ কন্ঠটা কার, চিনতে পারলাম না।
তবে শেষে সে বলল, পিয়ালী যে ঠিক আছে, সেটা বোঝানোর জন্য হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও পাঠাচ্ছে একটু পরে।
অপেক্ষা করতে থাকলাম আমি বউ যে ঠিকঠাক আছে, সেই প্রমান আসার।
আবারও একটা সিগারেট।
টিং টিং করে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ ঢুকল। এই নম্বরটাও অচেনা।
একটা ভিডিয়ো এসেছে।
খুললাম সেটা – দেখতে দেখতে কখন যে আমার দুই আঙ্গুলের মাঝখান থেকে সিগারেটটা পড়ে গেছে, খেয়ালই করি নি।
প্রচন্ড জোরে গান-বাজনার আওয়াজ আর কিছুটা আধো অন্ধকার ঘরে উদ্দাম নাচানাচি করছে কিছু মহিলা-পুরুষ।
ওই মহিলাদের মধ্যেই একজনকে চিনতে পারলাম – আমার বউ!
সে ছোটবেলায় নাচ শিখেছে জানতাম বিয়ের সময়েই। কিন্তু এখনও যে এরকম শরীর দুলিয়ে নাচতে পারে, সেটা জানতাম না।
ভিডিয়োতেই দেখতে পেলাম তিনচারটে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবে উদ্দাম নৃত্য চলছে। মধ্যমনি আমার বউ।
তার যে বুক থেকে আঁচল খসে গেছে, সেটা তার খেয়ালই নেই, কিন্তু আমার নজর এড়ালো না।
নাচের মধ্যেই দেখলাম দুদিক থেকে দুজন পুরুষ – তারা কারা চিনতে পারলাম না – পিয়ালীর শরীরের নানা জায়গায় হাত বোলাচ্ছে। আমার বউও একজনের কাঁধে হাত দিয়ে কোমর দোলাচ্ছে, আরেকজনের বুকের খুব কাছাকাছি আমার বউয়ের আঁচল খসে যাওয়া উদ্ধত বুক।
এ যদি আমার বউ না হত, তাহলে হয়তো দৃশ্যটা বেশ উপভোগই করতাম। কিন্তু ছেলেকে বাড়িতে একা রেখে দিয়ে পিয়ালী এ কাদের সঙ্গে কোথায় গেছে এসব করতে!!!
ভিডিয়োটা দেখা শেষ হওয়ার আগেই একটা টেক্সট মেসেজ এলো – কী বস, তোমার বউ ঠিকঠাক আছে কী না দেখলে তো? আমরা বারাসাতের দিকে এক বন্ধুর বাগানবাড়িতে এসেছি – সকালের মধ্যে তোমার বউকে বাড়ি দিয়ে আসার দায়িত্ব আমার। আমি তমাল – পিয়ালীর সঙ্গে কলেজে পড়তাম।
সকাল হতে অনেক দেরী! ততক্ষণ আমাকে না ঘুমিয়েই কাটাতে হবে বুঝলাম!
কিন্তু একের পর এক সিগারেট খেতে খেতে যে কখন চোখটা লেগে এসেছিল, খেয়ালই করি নি।
মোবাইলের আওয়াজে তন্দ্রাটা কাটল।
বুকুনের ফোন।
মোবাইলেই দেখলাম রাত প্রায় দুটো। পিয়ালীর খোঁজ করতে গিয়ে আর বুকুনকে ফোন করা হয় নি রাতে। কিন্তু তা বলে এত রাতে ফোন করছে কেন?
গলাটা নামিয়ে বললাম, ‘বল, কী হল? এত রাতে?’
‘ও এখনও ফেরে নি রবিদা!’
‘কে?’
‘বর’
‘মানে? কোথায় গেছে? ফোন করিস নি?’
‘করেছিলাম, ধরছে না। কোথায় গেছে জানি না। সন্ধ্যেবেলায় টাউনের কোন বন্ধুর বাড়িতে যাবে বলে বেরিয়েছে – মদ খাওয়ার আসর নিশ্চই। রাত করেই ফেরে, কিন্তু কখনও এত রাত হয় নি, আর ফোনও সবসময়ে ধরে। কী করব আমি এখন রবিদা?’
‘কার বাড়ি গেছে জানিস? কোন পাড়ায়?’
‘নতুন পাড়ায় একজন আছে জানি, শিবেন বলে। বাড়িও চিনি। কিন্তু তার কাছেই গেছে না অন্য কোথাও জানি না তো!’ বুকুনের গলাটা ভেজা ভেজা লাগল।
‘কারও ফোন নম্বর নেই?’
‘না রে’
মনে মনে ভাবলাম কী অবস্থা – একদিকে আমার বউ তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে উদ্দাম পার্টি করছে এদিকে বুকুনের বর কোথায় মাল খেতে গিয়ে এখনও বাড়ি ফেরে নি!!
কয়েক সেকেন্ড ভেবে নিয়ে বললাম, ‘আমি সাইকেল নিয়ে বেরচ্ছি। তোকেও যেতে হবে! আমি তো ওই শিবেনের বাড়ি চিনি না!’
‘এত রাতে বেরবো তোর সঙ্গে?’
‘কী করবি আর? না হলে অপেক্ষা কর সকাল অবধি। আমাকেও সকাল অবধি ওয়েট করতে হবে – বউ পার্টি করতে গেছে তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে – ছেলে বাড়িতে কাজের মাসির কাছে একা!’
‘অ্যাঁ !!! সে কি!!’
তারপরেই বুকুন বলল, ‘তুই আয় সাইকেল নিয়ে। আমি মাকে ঘুম থেকে তুলে বলি ব্যাপারটা।‘
‘হুম।‘
আমি মায়ের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে টোকা দিলাম কয়েকবার।
ঘুম জড়ানো গলায় মা বলল, ‘কে রে? রবি?
‘মা শোনো আমি একটু বেরচ্ছি। বুকুনের বর এই রাত দুটোর সময়েও বাড়ি ফেরে নি। ও ফোন করেছিল। সে ফোনও ধরছে না। আমি একটু বেরিয়ে দেখি।‘
‘দাঁড়া বাবা। আসছি।‘
ঘরের লাইট জ্বালিয়ে বাইরে বেরলো মা।
‘কী ব্যাপার রে! রাত আড়াইটে বাজতে চলল, এখনও বাড়ি ফেরে নি!’
আমি আর বললাম না যে তার পুত্রবধূও বাড়ি ফেরে নি এখনও – সারা রাত ফিরবেও না।
‘কোথায় খোঁজ করতে যাবি এখন তুই?’
মাকে আর বললাম না যে টাউনে হারা উদ্দেশ্যে খুঁজতে বেরতে হবে পুরণো প্রেমিকার স্বামীকে।
‘তুমি চিন্তা কর না। আমি বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছি। তুমি ঘুমোও গিয়ে।‘
‘টর্চ নিয়ে যাস একটা।‘
‘তোমার দরকার হলে ফোন কর। মোবাইল সঙ্গে আছে।‘
একহাতে টর্চ অন্য হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল ধরে দরজা খুলে বেরিয়ে তালা দিয়ে দিলাম।
পুজোর নবমী আজ। হাল্কা কুয়াশা আছে। শীতের আমেজ রয়েছে, তবে ঠান্ডা লাগছে না।
বুকুনের বাড়ির কাছাকাছি গিয়ে ওকে ফোন করলাম একটা। দরজায় নক করা ঠিক হবে না।
রিং হতেই ও ফোন ধরে বলল, ‘এসে গেছিস? বেরচ্ছি।‘
ওর মা দরজা খুলল।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কাকিমার ঘুম লাগা চোখে উদ্বেগ।
গলা নামিয়ে বলল, ‘দেখ রবি রাত আড়াইটে বাজল, তার বাড়ি ফেরার নাম নেই। মেয়েটাকে এখন বেরতে হচ্ছে। তুই দুদিনের জন্য এসে ঝামেলায় পড়লি। ওইসব ছাইপাশ খেয়ে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকলে কাল সকালে যদি কেউ দেখে ফেলে বেইজ্জতের একশেষ হব আমরা! সবই কপাল!!‘
‘ঝামেলার কী আছে কাকিমা। এটা তো কর্তব্য!’
আমার বউকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার কর্তব্যও তো করবে তার কলেজের কোন বন্ধু তমাল!!
বুকুন বেরিয়ে এল ভেতর থেকে।
কাকিমা বলল, ‘বেশী দেরী করিস না তোরা। এদিক ওদিক দেখে চলে আয়।
‘তুমি দরজা দিয়ে দাও। রবিদা আছে তো। চিন্তা কর না।‘
কাকিমা দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইলেন।
সাইকেলটা হাঁটিয়েই নিয়ে যাচ্ছিলাম আমি। বুকুন সাইকেলের অন্য দিকে।
ওদের বাড়ির মোড়টা ঘোরার পরে বললাম, ‘বস সাইকেলে।‘
একবার তাকাল আমার দিকে, তারপর কথা না বলে সাইকেলের সামনের রডে উঠে বসল।
বুকুন এভাবেই যখন ছোটবেলায় সাইকেলের রডে বসত, তখন কতকিছুই না ভাবতাম মনে মনে।
ওকে কী বলব আমার বউয়ের ব্যাপারটা?
নাহ থাক! এমনিতেই বেচারা চিন্তায় রয়েছে, তার ওপরে ওকে আবার এসব বলে চিন্তা বাড়ানোটা ঠিক হবে না।
জিগ্যেস করলাম, ‘ওই শিবেন ছাড়া আর কারও বাড়ি চিনিস – যেখানে তোর বর গিয়ে থাকতে পারে?’
‘আরেকটা বাড়ি চিনি, কিন্তু তার নাম ভুলে গেছি। একবার আসার পথে বাড়িটা দেখিয়ে বলেছিল তার বন্ধুর বাড়ি।‘
‘কোন দিকে সেটা?’
‘দূর আছে তাদের বাড়ি। হাইওয়ের দিকে যেতে হবে টাউন পেরিয়ে।‘
‘ও আচ্ছা। চল দেখা যাক।‘
বুকুনের বগলের তলা দিয়ে গিয়ে আমার দুটো হাত সাইকেলের হ্যান্ডেলটা শক্ত করে ধরে রয়েছে। প্যাডেল করতে গিয়ে ওর কোমরে আমার থাইয়ের ছোঁয়া লাগছে। ওর চুলের গন্ধ লাগছে নাকে। ওর চুলের গন্ধটা নেওয়ার জন্য মাথাটা একটু ঝুঁকিয়েছিলাম। ও বোধহয় টের পেয়েছিল আমার নিশ্বাস। মাথাটা একটু আমার দিকে ঘুরিয়ে হাতে একটা আলতো করে চিমটি কেটে বলল, ‘দুপুরে তোর আশ মেটে নি রবিদা?’
‘এত বছরের না পাওয়া – অত অল্পে কি আশ মেটে?’
এবার আর শুধু চুলের গন্ধ নেওয়ার জন্য না, মুখটাই নামিয়ে দিলাম ওর চুলের মধ্যে, তারপরে কানের লতিতে।
‘এরকম দুষ্টুমি করতে গিয়ে আবার কিন্তু ফেলে দিবি তুই আমাকে সাইকেল থেকে! মনে আছে সাইকেল চালানো শেখাতে গিয়ে ফেলে দিয়েছিলি!’
‘মমম মনে থাকবে না?’
---
- ১২ -
গ্রামের রাস্তা থেকে আমরা ততক্ষণে টাউনের রাস্তা ধরে নিয়েছি। কোথাও কোনও কাকপক্ষী নেই – মানুষ তো দূরের কথা।
অথচ এটাই যদি কলকাতা শহর হতো, তাহলে পুজোর সময়ে এত রাতেও রাস্তায় গাড়ির জ্যাম লেগে থাকত, শয়ে শয়ে লোকের সামনে এভাবে পুরণো প্রেমিকাকে সাইকেলের রডে বসিয়ে তার বরের খোঁজ করতে যাওয়ার আগে দুবার ভাবতে হত।
আবার এটাই যদি কলকাতা হত, আর আমি শহরে থাকতাম পুজোর সময়ে, তাহলে পিয়ালীও হয়তো তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে বারাসাতের কোনও বাগানবাড়িতে সারারাতের পার্টিতে গিয়ে মদ খেয়ে উত্তাল নাচ করত না!
কিছুক্ষণ আর বিশেষ কোনও কথা হল না আমার আর বুকুনের।
সামনে একটা গলি দেখিয়ে বুকুন বলল, ‘ওই গলিটায় চল রবিদা। এবার আমাকে সাইকেল থেকে নামিয়ে দে রে।‘
‘শিবেনের বাড়ি এই গলিতে?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘হুম’ বলে ছোট্ট জবাব দিল বুকুন।
গলির ভেতরটা বেশ অন্ধকার। টর্চ জ্বালালাম আমি।
কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে একটা দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বুকুন বলল, ‘এই বাড়ি।‘
আমি সাইকেলটা স্ট্যান্ড করিয়ে ওকে নিয়ে সামনের ছোট্ট গ্রিলের গেট খুলে ভেতরে ঢুকলাম। সদর দরজায় টর্চ মেরে দেখলাম কোথায় বেল রয়েছে।
চারদিক নিস্তব্ধ, তাই বেলটা বেশ জোরে বেজে উঠল।
কিন্তু ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পেলাম না। আবারও একবার বেল দিতে যাব, ভেতরের কোনও ঘরে একটা আলো জ্বলে উঠল – দেখতে পেলাম জানলা দিয়ে।
আরও মিনিট খানেক পরে এক মহিলার গলা পেলাম, ঘুমে জড়ানো।
‘কে?’
জবাব দিল বুকুন, ‘দিদি, আমি শিবেনদার বন্ধু অর্ণবের স্ত্রী বুকুন।‘
কয়েক মুহুর্তে দরজাটা একটু ফাঁক হল। সদরের বাইরে কোলাপসিবল গেট লাগানো রয়েছে।
উঁকি দিল একটা মুখ।
‘আরে দিদি, আপনি, এত রাত্তিরে? কী হয়েছে?’ জিগ্যেস করলেন ওই মহিলা।
‘সরি এত রাতে ডিসটার্ব করলাম। অর্ণব এখনও বাড়ি ফেরে নি, মোবাইলও ধরছে না। ওর এখানকার আর কোনও বন্ধুর বাড়ি তো চিনি না, তাই আমার পাড়ার দাদাকে নিয়ে আপনাদের বাড়িতে এসেছি। শিবেনদা কি বাড়িতে?’ জানতে চাইল বুকুন।
মহিলা আমার দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, ‘আসুন আসুন ভেতরে।‘
চাবি দিয়ে কোলাপসিবল গেটটা খুলতে খুলতে বললেন শিবেনের বউ।
‘না না ভেতরে আর আসব না। শিবেনদা কি আছে বাড়িতে? অর্ণব কোথায় যে গেছে, সেটাও কিছু তো বলে যায় নি।‘
শিবেনের বউ বললেন, ‘শিবেন বাড়ি ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। কোথায় গিয়েছিল সেটা তো জানি না। প্রচুর মদ খেয়ে এসে মরার মতো ঘুমোচ্ছে। আপনারা ভেতরে আসুন। ওদের কয়েকজন বন্ধুর নম্বর আছে আমার কাছে। ফোন করে দেখছি অর্ণবদা কোথায় আছে কেউ বলতে পারে কী না।‘
আমরা দুজনের উনার পেছন পেছন গিয়ে বসার ঘরে ঢুকলাম। শিবেনের বউ ভেতরের ঘরে গিয়ে একটু জোর গলাতেই বরকে ডাকছে শুনতে পেলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে নেশা জড়ানো একটা গলার আওয়াজ পেলাম ভেতরের ঘর থেকে।
নিশ্চই শিবেনেরই গলা, কিন্তু কী বলছে সে বাইরের ঘরে বসে বুঝতে পারলাম না।
তবে আরও কিছুক্ষণ পরে প্রথমে শিবেনের স্ত্রী বেরিয়ে এল, পেছনে টলোমলো পায়ে একটা পেটমোটা লোক – হাফপ্যান্ট পড়ে।
জড়ানো গলায় শিবেন যা বলল তার অর্থ হল বুকুনের বর আর শিবেন এক সঙ্গেই ছিল। কিন্তু অর্ণবের নেশাটা একটু বেশী-ই হয়ে গেছে, তাই ওরা যার বাড়িতে বসে মদ খাচ্ছিল, সেই আশুতোষের বাড়িতেই শুয়ে পড়েছে। বাড়িটা টাউনের অনেকটা বাইরে – হাইওয়ের দিকে। শিবেনের সঙ্গে আরেক বন্ধু ছিল, সে-ই বাইকে করে নামিয়ে দিয়ে গেছে ওকে, নাহলে ও-ও বাড়ি ফেরার মতো অবস্থায় ছিল না।
বুকুনের মুখটা কালো হয়ে গেছে, ও মাথা নীচু করে শুনে গেল সবটা। তারপরে শিবেনের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সরি দিদি আপনাদের এত রাতে অসুবিধা করলাম এভাবে। আসি আমরা। নমস্কার।‘
‘আরে না না, অসুবিধার কী আছে। কর্তা বাড়ি না ফিরলে, কোনও খোঁজ না পেলে চিন্তা তো হবেই। তারপর আপনারা এখানে থাকেন না!’ বলতে বলতে আমাদের পেছন পেছন শিবেনের বউও এগিয়ে এসেছিল দরজার দিকে।
প্রায় যখন দরজার বাইরে চলে এসেছি, তখন শিবেন পেছন থেকে জড়ানো গলায় বলে উঠল, ‘আসলে আশুর বউ আর শালী ছিল তো আজ – যা নাচছিল ওরা দুই বোন মাল খেয়ে, সেই দেখে আমাদেরও সকলেরই একটু বেশী চড়ে গিয়েছিল। আশুর শালীর সঙ্গে নাচতে নাচতেই ওর গায়ে পড়ে গিয়ে অর্ণব সেই যে বিছানা নিল, তারপরে আর তোলাই গেল না। ওর সঙ্গেই বোধহয় শুয়ে আছে.. হেহেহেহে।‘
আমি, বুকুন আর শিবেনের বউ স্তব্ধ, আমাদের পা নড়ছে না।
শিবেনের বউ মাথাটা নামিয়ে নিয়েছে। বোধহয় ভাবতে পারে নি অর্ণবের কীর্তিটা এভাবে তার বউয়ের সামনে ফাঁস করে দেবে নিজের বর।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ব্যাপারটা সামাল দিতে স্বামীর দিকে ঘুরে বলল, ‘অনেক বকবক করেছ – যাও ঘুমোও গিয়ে। নেশার ঘোরে কোথায় কী বলছ সেটা খেয়াল রাখতে পার না!!‘
তারপর আমাদের দিকে তাকাল শিবেনের স্ত্রী – আবারও মাথাটা নামিয়ে নিল।
ধীর গলায় বলল, ‘না করলাম মুখ খুলতে, শুনল না।‘
বুকুন আমার জামাটা ধরে সামান্য টান দিল, ‘চল রবিদা। আসি দিদি।‘
বাইরে বেরিয়ে এসে সাইকেলের স্ট্যান্ডটা তুলে ধীরে ধীরে প্রায় অন্ধকার গলি দিয়ে এগিয়ে চললাম আমি আর বুকুন।
বড়রাস্তা থেকে সামান্য আলো আসছিল।
--