06-11-2020, 06:44 PM
পর্ব পাঁচ – (#5-22)
ওই ভাবে রিশুর মুখের সামনে আচমকা দরজা বন্ধ করার পরে প্রচন্ড অনুতাপে ঝিনুকের শরীরের সকল শিরা উপশিরা কুঁকড়ে যায়। নিজের ওপরে ধিক্কার বোধে হাতের ফোন বিছানার ওপরে ছুঁড়ে মারে, চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে মনে হয় যেন কেউ লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে ওর সারা গায়ে। মাথার চুল আঁকড়ে ধরে থম মেরে বিছানার ওপরে বসে পরে ঝিনুক। এই নিস্তব্দ রাতে নিজের পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পায়। একি করল এটা, যতটা সময় রিশু ওর সাথে ছিল, এক বারের জন্যেও রিশু ওর সাথে কোন খারাপ ব্যাবহার করেনি বরং সব কিছু মানিয়ে নিয়ে সুচারু মার্জিত ব্যাবহার করে গেছে ওর সাথে। এক বারের জন্যেও কোন ছুতো খুঁজে অসভ্য ইতরের মতন ওকে ছুঁতেও চায়নি। ভীষণ একা মনে হয় নিজেকে এই সংসারে, সত্যি বড় ভুল করে ফেলেছে। যদি পার্থের আসল পরিচয় আগে থেকে পেয়ে যেত তাহলে অনেক আগেই পার্থকে ছেড়ে দিত, হয়ত নতুন করে অন্য কারুর সাথে প্রেম করত, নিজের মতন একটা জগত গড়তে পারত, কিন্তু এখন সব পথ বন্ধ ওর সামনে। কোন রকম দুরব্যাবহার করলে নিশ্চয় মাতৃ ভক্ত ডাক্তার আম্বালিকা আন্টিকে জানিয়ে দেবে আর সেই সাথে ওর জগত আরো ছোট হয়ে যাবে। ঘরের দেয়াল গুলো যেন ধিরে ধিরে ওর চারপাশ থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ধিরে ধিরে ছাদটা মাথার ওপরে নেমে আসছে ওকে চেপে ধরতে। জুতো খুলে বিছানার ওপরে হাঁটু মুড়ে কুঁকড়ে বসে পরে ঝিনুক। চিন্তা শক্তি ধিরে ধিরে লোপ পেতে শুরু করে। নিজের আসন্ন ভবিতব্যের কথা ভেবে হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে গুমরে কেঁদে ওঠে শেষ পর্যন্ত, “একটু বিষ পেলে ভালো হত।”
চুপ করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পরে মাকে একটা মেসেজ করে দেয় রিশু যে ঠিক করে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। যদিও জানে যে ওর মা জেগে তাও এতরাতে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না, কি বলবে। অন্য সময় হলে বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মাকে ফোনে জানিয়ে দিত কিন্তু ঝিনুকের এহেন আচরনে প্রচন্ড ভাবেই আহত হয়েছিল। মায়ের প্রিয় বান্ধবীর মেয়ে, মায়ের পছন্দ তাই মায়ের কথা ফেলতে পারেনি না হলে এমন বদরাগী জেদি মেয়েকে কোনদিন বিয়ে করত না। গত রাত থেকে এক বারের জন্যেও ঝিনুকের সাথে কোন বিরূপ আচরন করেনি, তাও কেন এই ভাবে ওর মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল তার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। খাটে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পরে, বড় জোর তিন চার ঘন্টা ঘুমাতে পারবে, সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে ট্রমা সেন্টারে। এর মাঝে ওর কলিগ ব্রিজেশের ফোন আসে, ব্রিজেশ জানায় যে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে ওর নতুন স্ত্রীকে দেখার জন্য। ক্ষুন্ন মনে হেসে ফেলে রিশু, হায়রে পোড়া কপাল, দুষ্টু গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো।
চোখ বন্ধ করতে যাবে কি ফোন বেজে ওঠে, ফোনের স্ক্রিনে মায়ের মুখ দেখে হেসে ফেলে রিশু, “মেসেজ করলাম ত, ঘুম নেই নাকি তোমার চোখে?”
অন্য পাশে আম্বালিকা স্নেহ ভরা কন্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “তোরা কিছু খেলি? প্লেনে ত কিছুই খেতে দেয়নি।”
মায়ের কাছে মিথ্যে কথা কি করে বলে, “না মানে, ওই আর কি এত রাতে আর খেতে ভালো লাগলো না।”
ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করে, “ঝিনুক ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”
জানা নেই রিশুর তাও উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, খুব টায়ারড ছিল।”
আম্বালিকা একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “পাশের ঘরে, দরজা বন্ধ করে?”
ওর মা সব জানে, মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “তুমি কি এখানে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগিয়েছ নাকি?”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “লাগাতে হয় নাকি? তোর চোখ আছে ত।” একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছেলেকে বলে, “মনে আছে, তুই ও যখন প্রথম বার ডাক্তারি পড়তে গেলি তখন কিন্তু প্রথমের বেশ কয়েকদিন...”
হেসে ফেলে রিশু, “হ্যাঁ জানি, ওকে নিয়ে তোমাকে কিছু বলেছি নাকি?”
আম্বালিকা হাসে, জানে ওর পুত্র বেশ বিচক্ষন, “তোকে নিয়ে সেই চিন্তা আমার নেই, তাও...”
রিশু উত্তর দেয়, “ঠিক আছে এবারে ঘুমাও ত।”
আম্বালিকা একটু হেসে বলে, “আচ্ছা কাল সকালে তাহলে কথা হবে, এখন ঘুমো, কাল থেকে তোর আবার মর্নিং ডিউটি তাই না?”
রিশু মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, চল গুড নাইট।”
অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষন জানা নেই ঝিনুকের, কাঁদতে কাঁদতে কখন যে বিছানায় এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই ওর। ঠান্ডায় কেঁপে উঠে বিছানায় বসে চোখ ডলতে ডলতে খেয়াল হয়, সেই যে এই ঘরে ঢুকেছিল তারপর জামা কাপড় পর্যন্ত খোলা হয়নি। এই বাড়িতে আরো একটা মানুষ আছে সে কথা মনে পড়তেই কুন্ঠা বোধ করে। খানিকক্ষন চুপ করে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে আশেপাশের আওয়াজ, নিস্তব্দ নিঝুম রাতে ওর কানে কোন আওয়াজ পৌঁছায় না। অতি সন্তর্পণে দরজা একটু খুলে বসার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করে কেউ আছে কি না। অন্ধকার বসার ঘর দেখে একটু আসস্থ বোধ করে। পা টিপে বাইরে বেড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে রিশু কি করছে। পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখতে পায় যে খাটের ওপরে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে রিশু। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দরজায় দাঁড়িয়ে রিশুর দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে ছেলেটা এক বারের জন্যেও ওর এই আচরনের জন্য কঠিন ভাষায় কিছুই বলেনি, সকাল থেকে দেখে এসেছে ছেলেটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত আর মার্জিত স্বভাবের। নাকের পাটা ফুলে যায়, চোখ ভেসে যায় ওর, কি করবে কিছুই ভেবে পায় না।
বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরে আবার নিজের ঘরে ঢুকে পরে ঝিনুক। জামা কাপড় বদলে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার, সেই বিকেল থেকে এক জামা কাপড় পরে রয়েছে। পার্থের সাথে বিয়ে হবে বলে নিজের পছন্দের জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়েছিল ওর বড় সুটকেসের মধ্যে, সেটার দিকে এক বারের জন্যেও তাকানো হয়নি, যেমন ছিল সেটা তেমন ভাবেই নিয়ে আসা হয়েছে। সুটকেস খুলে একটা তোয়ালে বের করতে গিয়ে চোখে পরে কিছু লঞ্জারি, পার্থের পছন্দ মতন বেশ কয়েকটা ফিনফিনে জালের রাত্রি পোশাক কিনেছিল, হাই হিল জুতো কিনেছিল, ছোট ছোট স্কারট আর হাতা বিহিন ছোট পারটি ড্রেস কিনেছিল, পেটের চারপাশে পড়ার জন্য একটা পাতলা সোনালি রঙের চেন কিনেছিল। এক রাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে সেই সব পোশাক আর জিনিসপত্রের দিকে দেখে মনে হয় যেন সব জ্বালিয়ে দেয়। ছোট সুটকেসে ওর দৈনন্দিনের ঘরে পড়ার জামা কাপড়, সেখান থেকে কাপ্রি আর টপ নিয়ে শোয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমটা বেশ ছোট, দরজার পেছনে তিন চারটে হুক লাগানো, তাতেই একটা গামছা ঝুলছে, একপাশে একটা বেসিন অন্যপাশে কমোড, দেয়ালে একটা গিজার লাগানো আছে। হুকের মধ্যে নিজের তোয়ালে আর রাতে পড়ার জামা কাপড় ঝুলিয়ে পরনের পোশাক খুলে ফেলে। সালোয়ার কামিজ খুলতেই ভীষণ ঠান্ডায় হুহু করে কেঁপে ওঠে সারা শরীর, কি ভীষণ ঠান্ডা রে বাবা একদম হাড় কাঁপিয়ে দিল ঝিনুকের। বেসিনের কল খুলে হাত পাততেই মনে হল যেন ওর আঙ্গুল কেউ কেটে নিয়ে গেছে। উফফফফ, মরে যাবে এবারে, সঙ্গে সঙ্গে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে নেয়। এমন সময়ে বাথরুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে স্থম্ভিত হয়ে যায় ঝিনুক, গলা শুকিয়ে আসে ওর।
দরজার ওপাশ থেকে ঘুম জড়ান গম্ভির কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে, “এত রাতে কি করছ?”
যা বাবা, রাতে কি বাথরুমে যাওয়া বারন নাকি? আমতা আমতা করে উত্তর দেয় ঝিনুক, “না মানে এই একটু ফ্রেস হচ্ছিলাম।”
মেয়েটা একটা কান্ড ঘটাবেই ঠিক করেছে, এত রাতে এই ভাবে জল ঘাঁটলে হাইপোথারমিয়া হবে। রিশু বলে, “গিজার চালিয়ে নাও না হলে এই ঠান্ডা জলে শরীর খারাপ করবে।”
আ মরন আমার, ঠান্ডা জলে ইতিমধ্যে ওর আঙ্গুল কেটে বেড়িয়ে গেছে। উত্তর দেয় ঝিনুক, “গিজারের সুইচ কোনটা দেখতে পাচ্ছি না ত।”
সব কিছু বুঝিয়ে দিত রিশু, কিন্তু ঘরে ঢোকা সাথে সাথে যা খারাপ ব্যাবহার করল তাতে কথা বলার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল। রিশু উত্তর দেয়, “ওই গিজারের পেছনে দেখ একটা তার ঝুলছে তার সাথে আছে।”
গিজারের দিকে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক, হ্যাঁ গিজারের পেছনে একটা তার ঝুলছে সেই সাথে সুইচ। উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি।”
রিশু বলে, “চটি পরে তবেই সুইচ অন করবে ওটা আবার কারেন্ট মারে।”
মরন দশা ওর পায়ে চটি নেই, নিচু গলায় উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
একটু ভেবে রিশু ওকে বলে, “না থাক, তুমি দরজা খোল আমি অন করে দিচ্ছি তোমাকে অন করতে হবে না।”
এমা কি হবে, ঝিনুক যে শুধু মাত্র ব্রা আর প্যান্টি পরে। লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় ওর, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “না আমি অন করে নিতে পারব।”
রিশু বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, “কারেন্ট লাগলে আমি জানি না কিন্তু।”
ইয়ার্কির হাসি শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঝিনুক, এতরাতে মস্কারি করা হচ্ছে ওর সাথে, দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংবরণ করে উত্তর দেয়, “আমি অন করে নেব।”
রিশু বলে, “ঠিক আছে, তবে বেশিক্ষন খালি গায়ে থেকো না হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে।”
কি বলল কথাটা সোজা ভাষায় কি বলতে পারে না নাকি কিছু। না বুঝেই উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা দেখা যাবে।”
হেসে ফেলে রিশু, “আরে বাবা আমি বললাম যে এত রাতে বেশি জল ঘাঁটলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ওহ আচ্ছা, কিন্তু কতক্ষন ছেলেটা দরজার ওপাশে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিরক্তি ঝড়ে পরে ঝিনুকের গলায়, “আপনি কি এইভাবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?”
ঝিনুকের ওপরে আর রাগ করে থাকতে পারে না শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে রিশু, “এখন ওই আপনি ধরেই বসে আছো।”
অন্যপাশে হেসে ফেলে ঝিনুক, “আচ্ছা বাবা, কিন্তু এইভাবে দাঁড়িয়ে কেন?”
রিশু উত্তর দেয়, “তোমার কিছু হলে আমাকেই ত দেখতে হবে তাই...”
ঝিনুক গিজারের সুইচ অন করতেই যথারীতি কারেন্ট খেয়ে আঁতকে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে রিশু বাথরুমের দরজা ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করে, “কি হল, ঠিক আছো?”
উফফ আঙ্গুল দুটো জ্বলছে, আঙ্গুলের ডগায় ফু দিতে দিতে উত্তর দেয়, “কারেন্ট মারে যে...”
হেসে ফেলে রিশু, “বলেছিলাম কারেন্ট মারবে, নাও এবারে দরজা খোল আমি অন করে দিচ্ছি।”
লজ্জায় লাল হয়ে যায় ঝিনুক, “না মানে...”
ঝিনুকের গলা শুনে রিশুর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এতক্ষনে জামা কাপড় খুলে ফেলেছে, তাই আসস্থ করে ওকে বলে, “হুকে দেখো একটা গামছা ঝুলছে সেটা জড়িয়ে নাও।”
ওরে বাবা ওটা গামছা নাকি, ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “না বাবা না, ওই নোংরা গামছা আমি গায়ে দেব না।”
হেসে ফেলে রিশু, “তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো সারা রাত ওই ভাবে।”
বেগতিক দেখে নিরুপায় হয়ে ঝিনুক বলে, “চোখ বন্ধ করে ঢুকলে তবেই দরজা খুলবো।”
রিশু হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, “আচ্ছা বাবা চোখ নাক কান সব বন্ধ করে নেব হয়েছে, নাও এবারে দরজা খোল।”
অতি সন্তর্পণে বাথরুমের দরজা খুলে, দরজার পেছনে নিজেকে আড়াল করে একরাশ বিরক্তি আর একটু ভিতি নিয়ে রিশুর দিকে তাকায়। ঝিনুকের সাথে চোখ মেলাতেই মুচকি হাসে রিশু।
রিশুর ঠোঁটে হাসি দেখে রেগে যায় ঝিনুক, “আমার ঠান্ডা লাগছে, তাড়াতাড়ি করুন... আই মিন কর”
সুইচ অন করে ওর সামনে নিজের চটি খুলে বলে, “এটা পরে নাও। আর মিনিট পনেরো পরে সুইচ বন্ধ করে দেবে।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ঝিনুক, যেন বলতে চায় এরপরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলবে।
ওই ভাবে রিশুর মুখের সামনে আচমকা দরজা বন্ধ করার পরে প্রচন্ড অনুতাপে ঝিনুকের শরীরের সকল শিরা উপশিরা কুঁকড়ে যায়। নিজের ওপরে ধিক্কার বোধে হাতের ফোন বিছানার ওপরে ছুঁড়ে মারে, চোখ জোড়া জ্বালা করে ওঠে মনে হয় যেন কেউ লঙ্কার গুঁড়ো ছিটিয়ে দিয়েছে ওর সারা গায়ে। মাথার চুল আঁকড়ে ধরে থম মেরে বিছানার ওপরে বসে পরে ঝিনুক। এই নিস্তব্দ রাতে নিজের পাঁজর ভাঙ্গার শব্দ শুনতে পায়। একি করল এটা, যতটা সময় রিশু ওর সাথে ছিল, এক বারের জন্যেও রিশু ওর সাথে কোন খারাপ ব্যাবহার করেনি বরং সব কিছু মানিয়ে নিয়ে সুচারু মার্জিত ব্যাবহার করে গেছে ওর সাথে। এক বারের জন্যেও কোন ছুতো খুঁজে অসভ্য ইতরের মতন ওকে ছুঁতেও চায়নি। ভীষণ একা মনে হয় নিজেকে এই সংসারে, সত্যি বড় ভুল করে ফেলেছে। যদি পার্থের আসল পরিচয় আগে থেকে পেয়ে যেত তাহলে অনেক আগেই পার্থকে ছেড়ে দিত, হয়ত নতুন করে অন্য কারুর সাথে প্রেম করত, নিজের মতন একটা জগত গড়তে পারত, কিন্তু এখন সব পথ বন্ধ ওর সামনে। কোন রকম দুরব্যাবহার করলে নিশ্চয় মাতৃ ভক্ত ডাক্তার আম্বালিকা আন্টিকে জানিয়ে দেবে আর সেই সাথে ওর জগত আরো ছোট হয়ে যাবে। ঘরের দেয়াল গুলো যেন ধিরে ধিরে ওর চারপাশ থেকে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, ধিরে ধিরে ছাদটা মাথার ওপরে নেমে আসছে ওকে চেপে ধরতে। জুতো খুলে বিছানার ওপরে হাঁটু মুড়ে কুঁকড়ে বসে পরে ঝিনুক। চিন্তা শক্তি ধিরে ধিরে লোপ পেতে শুরু করে। নিজের আসন্ন ভবিতব্যের কথা ভেবে হাঁটুর মাঝে মাথা গুঁজে গুমরে কেঁদে ওঠে শেষ পর্যন্ত, “একটু বিষ পেলে ভালো হত।”
চুপ করে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পরে মাকে একটা মেসেজ করে দেয় রিশু যে ঠিক করে বাড়িতে পৌঁছে গেছে। যদিও জানে যে ওর মা জেগে তাও এতরাতে কথা বলার ইচ্ছে ছিল না, কি বলবে। অন্য সময় হলে বাড়িতে ঢোকা মাত্রই মাকে ফোনে জানিয়ে দিত কিন্তু ঝিনুকের এহেন আচরনে প্রচন্ড ভাবেই আহত হয়েছিল। মায়ের প্রিয় বান্ধবীর মেয়ে, মায়ের পছন্দ তাই মায়ের কথা ফেলতে পারেনি না হলে এমন বদরাগী জেদি মেয়েকে কোনদিন বিয়ে করত না। গত রাত থেকে এক বারের জন্যেও ঝিনুকের সাথে কোন বিরূপ আচরন করেনি, তাও কেন এই ভাবে ওর মুখের সামনে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দিল তার সঠিক উত্তর খুঁজে পায় না। খাটে শুয়ে গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পরে, বড় জোর তিন চার ঘন্টা ঘুমাতে পারবে, সকালে উঠেই দৌড়াতে হবে ট্রমা সেন্টারে। এর মাঝে ওর কলিগ ব্রিজেশের ফোন আসে, ব্রিজেশ জানায় যে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে ওর নতুন স্ত্রীকে দেখার জন্য। ক্ষুন্ন মনে হেসে ফেলে রিশু, হায়রে পোড়া কপাল, দুষ্টু গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো।
চোখ বন্ধ করতে যাবে কি ফোন বেজে ওঠে, ফোনের স্ক্রিনে মায়ের মুখ দেখে হেসে ফেলে রিশু, “মেসেজ করলাম ত, ঘুম নেই নাকি তোমার চোখে?”
অন্য পাশে আম্বালিকা স্নেহ ভরা কন্ঠে ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “তোরা কিছু খেলি? প্লেনে ত কিছুই খেতে দেয়নি।”
মায়ের কাছে মিথ্যে কথা কি করে বলে, “না মানে, ওই আর কি এত রাতে আর খেতে ভালো লাগলো না।”
ওর মা ওকে জিজ্ঞেস করে, “ঝিনুক ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?”
জানা নেই রিশুর তাও উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, খুব টায়ারড ছিল।”
আম্বালিকা একটু থেমে জিজ্ঞেস করে, “পাশের ঘরে, দরজা বন্ধ করে?”
ওর মা সব জানে, মুচকি হেসে উত্তর দেয়, “তুমি কি এখানে সিসি টিভি ক্যামেরা লাগিয়েছ নাকি?”
হেসে ফেলে আম্বালিকা, “লাগাতে হয় নাকি? তোর চোখ আছে ত।” একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ছেলেকে বলে, “মনে আছে, তুই ও যখন প্রথম বার ডাক্তারি পড়তে গেলি তখন কিন্তু প্রথমের বেশ কয়েকদিন...”
হেসে ফেলে রিশু, “হ্যাঁ জানি, ওকে নিয়ে তোমাকে কিছু বলেছি নাকি?”
আম্বালিকা হাসে, জানে ওর পুত্র বেশ বিচক্ষন, “তোকে নিয়ে সেই চিন্তা আমার নেই, তাও...”
রিশু উত্তর দেয়, “ঠিক আছে এবারে ঘুমাও ত।”
আম্বালিকা একটু হেসে বলে, “আচ্ছা কাল সকালে তাহলে কথা হবে, এখন ঘুমো, কাল থেকে তোর আবার মর্নিং ডিউটি তাই না?”
রিশু মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, চল গুড নাইট।”
অনেকক্ষণ নাকি অল্পক্ষন জানা নেই ঝিনুকের, কাঁদতে কাঁদতে কখন যে বিছানায় এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই ওর। ঠান্ডায় কেঁপে উঠে বিছানায় বসে চোখ ডলতে ডলতে খেয়াল হয়, সেই যে এই ঘরে ঢুকেছিল তারপর জামা কাপড় পর্যন্ত খোলা হয়নি। এই বাড়িতে আরো একটা মানুষ আছে সে কথা মনে পড়তেই কুন্ঠা বোধ করে। খানিকক্ষন চুপ করে কান পেতে শুনতে চেষ্টা করে আশেপাশের আওয়াজ, নিস্তব্দ নিঝুম রাতে ওর কানে কোন আওয়াজ পৌঁছায় না। অতি সন্তর্পণে দরজা একটু খুলে বসার ঘরের মধ্যে উঁকি মেরে দেখতে চেষ্টা করে কেউ আছে কি না। অন্ধকার বসার ঘর দেখে একটু আসস্থ বোধ করে। পা টিপে বাইরে বেড়িয়ে এপাশ ওপাশ তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে রিশু কি করছে। পাশের ঘরে উঁকি মেরে দেখতে পায় যে খাটের ওপরে একটা কম্বল গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়েছে রিশু। বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ দরজায় দাঁড়িয়ে রিশুর দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে ছেলেটা এক বারের জন্যেও ওর এই আচরনের জন্য কঠিন ভাষায় কিছুই বলেনি, সকাল থেকে দেখে এসেছে ছেলেটা অদ্ভুত ধরনের শান্ত আর মার্জিত স্বভাবের। নাকের পাটা ফুলে যায়, চোখ ভেসে যায় ওর, কি করবে কিছুই ভেবে পায় না।
বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরে আবার নিজের ঘরে ঢুকে পরে ঝিনুক। জামা কাপড় বদলে একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার, সেই বিকেল থেকে এক জামা কাপড় পরে রয়েছে। পার্থের সাথে বিয়ে হবে বলে নিজের পছন্দের জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়েছিল ওর বড় সুটকেসের মধ্যে, সেটার দিকে এক বারের জন্যেও তাকানো হয়নি, যেমন ছিল সেটা তেমন ভাবেই নিয়ে আসা হয়েছে। সুটকেস খুলে একটা তোয়ালে বের করতে গিয়ে চোখে পরে কিছু লঞ্জারি, পার্থের পছন্দ মতন বেশ কয়েকটা ফিনফিনে জালের রাত্রি পোশাক কিনেছিল, হাই হিল জুতো কিনেছিল, ছোট ছোট স্কারট আর হাতা বিহিন ছোট পারটি ড্রেস কিনেছিল, পেটের চারপাশে পড়ার জন্য একটা পাতলা সোনালি রঙের চেন কিনেছিল। এক রাশ বিতৃষ্ণা নিয়ে সেই সব পোশাক আর জিনিসপত্রের দিকে দেখে মনে হয় যেন সব জ্বালিয়ে দেয়। ছোট সুটকেসে ওর দৈনন্দিনের ঘরে পড়ার জামা কাপড়, সেখান থেকে কাপ্রি আর টপ নিয়ে শোয়ার ঘর থেকে বেড়িয়ে বাথরুমে ঢুকে পরে। বাথরুমটা বেশ ছোট, দরজার পেছনে তিন চারটে হুক লাগানো, তাতেই একটা গামছা ঝুলছে, একপাশে একটা বেসিন অন্যপাশে কমোড, দেয়ালে একটা গিজার লাগানো আছে। হুকের মধ্যে নিজের তোয়ালে আর রাতে পড়ার জামা কাপড় ঝুলিয়ে পরনের পোশাক খুলে ফেলে। সালোয়ার কামিজ খুলতেই ভীষণ ঠান্ডায় হুহু করে কেঁপে ওঠে সারা শরীর, কি ভীষণ ঠান্ডা রে বাবা একদম হাড় কাঁপিয়ে দিল ঝিনুকের। বেসিনের কল খুলে হাত পাততেই মনে হল যেন ওর আঙ্গুল কেউ কেটে নিয়ে গেছে। উফফফফ, মরে যাবে এবারে, সঙ্গে সঙ্গে গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে নেয়। এমন সময়ে বাথরুমের দরজায় ঠকঠক আওয়াজ শুনে স্থম্ভিত হয়ে যায় ঝিনুক, গলা শুকিয়ে আসে ওর।
দরজার ওপাশ থেকে ঘুম জড়ান গম্ভির কন্ঠের আওয়াজ ভেসে আসে, “এত রাতে কি করছ?”
যা বাবা, রাতে কি বাথরুমে যাওয়া বারন নাকি? আমতা আমতা করে উত্তর দেয় ঝিনুক, “না মানে এই একটু ফ্রেস হচ্ছিলাম।”
মেয়েটা একটা কান্ড ঘটাবেই ঠিক করেছে, এত রাতে এই ভাবে জল ঘাঁটলে হাইপোথারমিয়া হবে। রিশু বলে, “গিজার চালিয়ে নাও না হলে এই ঠান্ডা জলে শরীর খারাপ করবে।”
আ মরন আমার, ঠান্ডা জলে ইতিমধ্যে ওর আঙ্গুল কেটে বেড়িয়ে গেছে। উত্তর দেয় ঝিনুক, “গিজারের সুইচ কোনটা দেখতে পাচ্ছি না ত।”
সব কিছু বুঝিয়ে দিত রিশু, কিন্তু ঘরে ঢোকা সাথে সাথে যা খারাপ ব্যাবহার করল তাতে কথা বলার ইচ্ছেটাই মরে গিয়েছিল। রিশু উত্তর দেয়, “ওই গিজারের পেছনে দেখ একটা তার ঝুলছে তার সাথে আছে।”
গিজারের দিকে তাকিয়ে দেখে ঝিনুক, হ্যাঁ গিজারের পেছনে একটা তার ঝুলছে সেই সাথে সুইচ। উত্তর দেয় ঝিনুক, “হ্যাঁ দেখতে পেয়েছি।”
রিশু বলে, “চটি পরে তবেই সুইচ অন করবে ওটা আবার কারেন্ট মারে।”
মরন দশা ওর পায়ে চটি নেই, নিচু গলায় উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
একটু ভেবে রিশু ওকে বলে, “না থাক, তুমি দরজা খোল আমি অন করে দিচ্ছি তোমাকে অন করতে হবে না।”
এমা কি হবে, ঝিনুক যে শুধু মাত্র ব্রা আর প্যান্টি পরে। লজ্জায় কান লাল হয়ে যায় ওর, আমতা আমতা করে উত্তর দেয়, “না আমি অন করে নিতে পারব।”
রিশু বাঁকা হাসি দিয়ে বলে, “কারেন্ট লাগলে আমি জানি না কিন্তু।”
ইয়ার্কির হাসি শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ঝিনুক, এতরাতে মস্কারি করা হচ্ছে ওর সাথে, দাঁতে দাঁত পিষে রাগ সংবরণ করে উত্তর দেয়, “আমি অন করে নেব।”
রিশু বলে, “ঠিক আছে, তবে বেশিক্ষন খালি গায়ে থেকো না হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে।”
কি বলল কথাটা সোজা ভাষায় কি বলতে পারে না নাকি কিছু। না বুঝেই উত্তর দেয় ঝিনুক, “আচ্ছা দেখা যাবে।”
হেসে ফেলে রিশু, “আরে বাবা আমি বললাম যে এত রাতে বেশি জল ঘাঁটলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ওহ আচ্ছা, কিন্তু কতক্ষন ছেলেটা দরজার ওপাশে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে। বিরক্তি ঝড়ে পরে ঝিনুকের গলায়, “আপনি কি এইভাবে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?”
ঝিনুকের ওপরে আর রাগ করে থাকতে পারে না শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে রিশু, “এখন ওই আপনি ধরেই বসে আছো।”
অন্যপাশে হেসে ফেলে ঝিনুক, “আচ্ছা বাবা, কিন্তু এইভাবে দাঁড়িয়ে কেন?”
রিশু উত্তর দেয়, “তোমার কিছু হলে আমাকেই ত দেখতে হবে তাই...”
ঝিনুক গিজারের সুইচ অন করতেই যথারীতি কারেন্ট খেয়ে আঁতকে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে রিশু বাথরুমের দরজা ধাক্কা মেরে জিজ্ঞেস করে, “কি হল, ঠিক আছো?”
উফফ আঙ্গুল দুটো জ্বলছে, আঙ্গুলের ডগায় ফু দিতে দিতে উত্তর দেয়, “কারেন্ট মারে যে...”
হেসে ফেলে রিশু, “বলেছিলাম কারেন্ট মারবে, নাও এবারে দরজা খোল আমি অন করে দিচ্ছি।”
লজ্জায় লাল হয়ে যায় ঝিনুক, “না মানে...”
ঝিনুকের গলা শুনে রিশুর বুঝতে অসুবিধে হয় না যে এতক্ষনে জামা কাপড় খুলে ফেলেছে, তাই আসস্থ করে ওকে বলে, “হুকে দেখো একটা গামছা ঝুলছে সেটা জড়িয়ে নাও।”
ওরে বাবা ওটা গামছা নাকি, ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঝিনুক, “না বাবা না, ওই নোংরা গামছা আমি গায়ে দেব না।”
হেসে ফেলে রিশু, “তাহলে দাঁড়িয়ে থাকো সারা রাত ওই ভাবে।”
বেগতিক দেখে নিরুপায় হয়ে ঝিনুক বলে, “চোখ বন্ধ করে ঢুকলে তবেই দরজা খুলবো।”
রিশু হাসতে হাসতে উত্তর দেয়, “আচ্ছা বাবা চোখ নাক কান সব বন্ধ করে নেব হয়েছে, নাও এবারে দরজা খোল।”
অতি সন্তর্পণে বাথরুমের দরজা খুলে, দরজার পেছনে নিজেকে আড়াল করে একরাশ বিরক্তি আর একটু ভিতি নিয়ে রিশুর দিকে তাকায়। ঝিনুকের সাথে চোখ মেলাতেই মুচকি হাসে রিশু।
রিশুর ঠোঁটে হাসি দেখে রেগে যায় ঝিনুক, “আমার ঠান্ডা লাগছে, তাড়াতাড়ি করুন... আই মিন কর”
সুইচ অন করে ওর সামনে নিজের চটি খুলে বলে, “এটা পরে নাও। আর মিনিট পনেরো পরে সুইচ বন্ধ করে দেবে।”
নিচের ঠোঁট কামড়ে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ঝিনুক, যেন বলতে চায় এরপরে এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে তুলবে।