06-11-2020, 05:08 PM
ঋণ শোধ
চোখে আলো পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসল নলিনী। কাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি, বারবার শুধু সেই কথাটাই মনে পড়ছিল। হাতে মাত্র দুটোদিন সময় আছে...মাত্র দুটোদিন। তারপরেই যে কী হবে...!
ঘটনার শুরু মাস খানেক আগে। টানা কয়েকদিন ধরে নিম্নচাপের একঘেয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। সেদিন ওদের অফিসে আবার মাইনে পাবার দিন। ওদের অফিসে যাদের মাইনে কম, তাদের একটা কাগজে সই করে নগদে টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিমাসেই বড়বাবু টাকা দেওয়া শুরু করতে করতে বেশ দেরি করিয়ে দেন। তারপরেও বাথরুমে গিয়ে টাকা ক'টা গুনে নেয় ও। বলা যায় না টাকা কম পড়ে যায়! বড়বাবুর গুনতে ভুল হয় যদি? বলা তো যায় না, মানুষের তো ভুল হয় ই। তখন তো ওর সমস্যা হয়ে যাবে! ওর বাড়ির একমাত্র রোজগেরে তো ও ই। ওর মা আগে কাজকাম করত, এখন তো পুরোই শোয়া! তাই ওর এই সামান্য বেতনেই ওর বস্তির ঘর ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, মায়ের ওষুধ পত্র, সবকিছু। সেজন্য এক একটা টাকার দাম ও ওর কাছে অনেক! তারমধ্যে আবার ওদের অফিসের এক পিওন দাদার পাল্লায় পড়ে দু মাস আগে একাতা নতুন মোবাইল কিনেছে ও। বেশ সিনেমা টিনেমা দেখা যায়। প্রতি মাসে সেজন্য টাকা দিতে হয় ওই পিওন দাদা কে। উনি নিজের কার্ড দিয়ে কিনে দিয়েছেন। প্রতিবার ই মাইনে পাবার পর অফিসের পেছনের দিকে ওদের জন্য যে বাথরুম টা আছে, সেখানে চলে যায় ও। টাকা গুনে, দাদার কিস্তির টাকাটা বের করে নিয়ে, বুকের মধ্যে খাম টা ঢুকিয়ে রাখে। বাসে-ট্রেনে যাওয়া, বলা যায় না...কার কী মতলব।
সেদিন ও এই করতে গিয়েই দেরি হয়ে গেছিল খুব। তারমধ্যে অফিস থেকে বেরিয়েই দেখে এক কোমর জল রাস্তায়। আর এত বৃষ্টি যে, ছাতায় মানছিল না। খুব ই অসুবিধা হয়েছিল ওর বাস স্টপ অবধি আসতে। এই বৃষ্টিতে রাস্তায় কোথায় গর্ত টর্ত আছে বোঝাই তো যায় না! তাই সাবধানে পা ফেলতে হয়েছে। ও পড়ে গেলে, লেগে গেলে, চুন - হলুদ টুকুও লাগিয়ে দেবার কেউ নেই। আর তারচেয়েও বড় কথা, ওরা অফিস না গেলেই টাকা কাটে। তাই অফিসে যেতেই হয়, মরতে মরতেও।
বাস স্টপে পৌঁছে দেখে একটাও বাস নেই। এদিকে ভিড় আছে অনেক। সেদিন মেট্রো রেল ও চলছিল না। কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল নাকি! কেন যে এরা মরে যায়, লড়াই টুকু না করে! তাহলে ওর মতো জীবন হলে কী করত! ছোটবেলা থেকে দেখেছে বাপটা মাতাল, মা কে,ওকে ঠ্যাঙাত। তারপর তো একদিন মালের ঘোরে বাসের তলায় চাপা পড়ে মরেই গেল। আগে ইকলেজে যেত ও, বাপ মরে যাবার পর পাট চুকে গেল। পড়াতে মাথাও ছিল না। তারপর থেকেই কাজে লেগে গেল। আগে বাড়িতে কাজ করত, মায়ের সাথে। তারপর এক বাড়ির দাদাই অফিসে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। হাউজকিপিং এর কাজ। বাথরুম, প্যান্ট্রি পরিষ্কার করতে হয়। তা হোক! তবু 'লোকের বাড়ি কাজ করি' বলার চেয়ে 'অফিসে কাজ করি' বলায় প্রেস্টিজ বেশি! মা তখন কাজ করতেন, চলেও যেত। তারপর মায়ের শরীর ভাঙতে শুরু করল। প্রথমে কিছু করে নি ওরা। ওদের মতো ঘরে অত সহজে ডাক্তার দেখানো হয় না। কিন্তু একদিন যেতেই হলো, আর তাতেই জানা গেল মায়ের নার্ভের কিছু সমস্যা হয়েছে। হাত -পা কাঁপে সারাক্ষণ। তারপর থেকেই তো মা ঘরেই বসা! আর। এভাবেই চলছে! এখন মাসে হাজার টাকার ওষুধ ই চলে! কীভাবে যে চলে, ও ই জানে সেটা।
অথচ সব মেয়ের মতোই ওর ও ইচ্ছে ছিল...বিয়ে হবে। কিন্তু কে আর বিয়ে দেবে ওকে! ছেলেরা যে ছুঁকছুঁক করে নি, তা না। কিন্তু, বারবার বাপের কথাই মনে পড়ত ওর। ভাত দেবে না, কিন্তু রাতে মাতাল হয়ে এসে স্বামীর অধিকার দাবী করবে...মারবে... এই তো ওদের পাড়ার বেশিরভাগ মরদের ছিরি! আগে আগে ভেবেছিল একটা সন্তান যদি থাকত। কিন্তু, ছেলেরাও খুব অল্প বয়সেই মদ-গাঁজা ধরে ওদের ওখানে। তাই এমনিই ভালো আছে ও। এতটা দূর যাওয়া আসা...তারপর কাজের চাপ...যখন ঘুমোতে যায়, মনে হয় চোখ জুড়িয়ে আসছে...। ক্লান্তি আসে এতো...।
ঘুমের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ যেন জড়িয়ে আসছিল ওর। একটাও শিয়ালদা যাবার বাস আসছে না। ওদিকে নাকি খুব জল জমেছে। ক'জন বলাবলি করছিল। তারা তো হেঁটেই রওনা হয়ে গেল। এই বৃষ্টির দিনে ট্রেনে গোলমাল হলেই তো হয়ে গেল! কী যে আতান্তর!
শেষমেষ হেঁটেই শিয়ালদা আসতে হলো। কম দূর নাকি! ছ' সাতটা স্টপেজ। আর স্টেশানেও মেলা ভিড়! একটা ট্রেন ছেড়ে, দু নম্বর ট্রেন টায় উঠল ও। নামার সময় টানাটানিতে ওর কুর্তির হাতাটা ছিঁড়েই গেল! একে ওর বাইরে পরার জামা সেরকম নেই, তাতে এই কান্ড! প্ল্যাটফর্মে নামার পর চোখে জল এলো নলিনীর। অন্যদিন টোটো থাকে স্টেশানের বাইরে, আজ একটাও নেই। রাত ও হয়েছে অনেক। মোবাইল টা ব্যাগের ভেতরে, বৃষ্টিতে বের করতে পারছে না, তাও এগারোটা তো বেজেই গেছে নিশ্চয়ই। শিয়ালদা তেই তো সাড়ে দশটা বাজছিল। বাধ্য হয়ে হাঁটাই লাগালো নলিনী।
পাড়ায় ঢোকার মুখে দেখে শহীদ বেদীটার ওপর ছেলেগুলো আড্ডা জমিয়েছে। ক্লাবের ছেলে ওরা। কাজ নেই, কম্ম নেই, দিন রাত গজল্লা, মেয়েদের আজেবাজে কথা বলা, আর রাতে মদ গেলা...এই তো কাজ। তারমধ্যে ও কলকাতায় কাজ করে বলে ওরা অনেকে অনেক কথা বলে! টোন কাটে! ও নাকি অফিসের বাবু! অহঙ্কারী!
তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পেরোতে যাবে,হঠাৎ শোনে 'এই যে এলো অফিসের ম্যাডাম..' আরেকজন রসিয়ে রসিয়ে বলে উঠল 'ম্যাডামের জামা ছেঁড়া কেন?' 'আরে, শুধু কি জামা ই ছেঁড়া, না অন্য কিছুও?'...এইসব নোংরা কথা আর সমবেত অশ্লীল হাসির মধ্যেই হনহন করে ঘর ঢুকেছিল ও। ভেবেছিল স্নান করার সাথে সাথেই কথা গুলোর ক্লেদ বেরিয়ে যাবে মন থেকে..কিন্তু হতে দিল কই! বরং কীভাবে যেন পাড়ায় রটে গেল ও নাকি খারাপ পাড়ায় যায়! এই পাড়ার কে জানি দেখেছে। অথচ যে দেখেছে, সে কী করতে সেখানে গেছিল, সেটা জিজ্ঞেস করে নি কেউ! একেই মফঃস্বল, তাতে এইরকম রটনা। ঘরে অসুস্থ মা। অফিসে খ্যাঁচখ্যাঁচ, অপমান। আর পারছিল না নলিনী। বাধ্য হয়ে একদিন ক্লাব ঘরে গিয়ে ছেলেদের যে পান্ডা, সেই চিতু বলে ছেলেটাকে ডেকে বলল "তোরা আমাকে নিয়ে এসব রটাচ্ছিস কেন?" শুনে আবার অশ্লীল হেসেছিল চিতু। তারপর বলেছিল 'যেটা রটে, তার খানিকটা তো বটে, শোন, তোরা হয় ঘর ছেড়ে দে, নইলে আমাকেও কিছু ট্যাক্স দিয়ে দে...এখানে থেকে অফিসের ফুটানি চলবে না...'
আর, সেই ঘর ছেড়ে দেবার জন্য দেওয়া সময়ের মাত্র দুদিন বাকি। এর মধ্যে ওরা আরো কোণঠাসা হয়ে গেছে। ওদের বস্তিতে অনেক গুলো ঘরের একটাই এজমালি কল। সেখানে ওকে, ওর মা কে যেতে দিচ্ছে না কেউ। কী না...'এটা ভদ্রপাড়া...এখানে এসব চলে না!'
এবার বুঝি মরতেই হবে। কারণ এই মুহূর্তে কোথাও ঘর ভাড়া নেবার মতো টাকা ওর নেই।
দুটোদিন কেটে গেল। চিতুর দলবল আসবে আজ। মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না নলিনী। এই দু দিন অফিসেও যায় নি ও। কাজ টা চলে গেলে কী হবে, ভাবতে পারছে না...। এর মাঝেই অফিস থেকে ফোন...রিসেপশানে যে দিদি বসে, সেই দিদি ফোন করে বলেছে সোমবারে জয়েন করতে, না হলে নতুন লোক রেখে নেওয়া হবে।
পারছে না নলিনী আর!
"কি রে, বেশ্যা মাগী, নিজেকে নিয়ে ব্যবসা করতে হলে অন্য জায়গায় যা...এখানে থাকা চলবে না.." চিৎকার করে বলে উঠল কেউ।
মায়ের চোখে ভয়। ভীষন, ভীষন ভয়। হাত, পা, ঠোঁট...সব কাঁপছে মায়ের।
মায়ের দিকে তাকিয়ে কি যেন হয়ে গেল নলিনীর।
গু -মুত ঘেঁটে, পরিষ্কার করে খায়...কারো বাপের পয়সায় খায় না। ঘর ভাড়া দেয় সময় মতো। এই শালারা কে ওকে বের করে দেবার? কি প্রমাণ আছে ও বেশ্যা? ও তো অফিসে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে ও কি করে। হারামী গুলো নিজেরা কাজ করে না, তাই কাউকে করতেও দেবে না।
কি মনে হলো, বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে কথা ক'টা বলে দিল ও। বেজন্মার বাচ্চাগুলো বুঝুক, ও আর ভয় পায় না। সারাজীবন ছেলে গুলো পায়ের নীচে রেখেছে। বাবা, উঠতি বয়সের ছোঁড়া গুলো...আর এখন এই জানোয়ার গুলো...
'তবে রে শালী...' বলে ভেতরে ঢুকে এলো চিতু। চিরকালের চুপ করে থাকা মেয়ের এতো মুখ সহ্য করার বান্দা নয় চিতু! মেয়েদের জায়গা নিচে...আর তারমধ্যে এই গু ঘাঁটা মেয়ের বড় বড় কথা...আজ বুঝবে ছেলেদের জায়গা আসলে কী আর মেয়েদের কী...আর ট্যাক্স ওকে দিতেই হবে...হয় টাকায়...আর নইলে...ভাবতে ভাবতেই প্যান্টের জিপে হাত দেয় চিতু। আজ অফিসের বাবুর গুমোর ভাঙবে। এই গোটা এলাকায় কারো ক্ষমতা নেই চিতু গুন্ডার মুখের ওপর কিছু বলে...।
ওর দিকে এগোতেই, ওদের ঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দার রাখা বঁটি টা তুলে নেয়... তারপর চিতুর উদ্যত পুরুষাঙ্গে কোপ বসিয়ে দেয় নলিনী...তারপর...রক্তে ভেসে যাওয়া বঁটি নিয়ে ভিড় জমে যাওয়া বাইরে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে "আয় কে আসবি...আয়...আমি সব আমার মোবাইলে ভিডিও করে রেখেছি...পুলিশকে দেবো...আয়...অনেক বছর...বছরের পর বছর চুপ করিয়ে রেখেছিস...কর লাগবে তোদেএ? ট্যাক্স? মেয়েরা বেশ্যা হলে তোরা কী? তোরা কী? বল, বল... "
ওর একটানা বোবা চিৎকারে চুপ করে থাকে সারা এলাকা। খোলা চুল...হাতে রক্তমাখা বঁটি...রং জ্বলা নাইটি পরা নলিনী তখন যেন স্বয়ং নাঙ্গেলী, যিনি উনবিংশ শতাব্দীতে নিজের স্তন যুগল ঢাকার জন্য টাকা দিতে না পেরে স্তন কেটে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন...আর এই একবিংশ শতাব্দীতে অত্যাচারীর পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে নলিনী তাঁরই ঋণ শোধ করল...
সময়...মানসিকতা..সাহসিকতার সংজ্ঞা এইভাবেই হয়ত পালটে যায়...যুগ থেকে যুগে... কাল থেকে কালে...শিক্ষা দিয়ে...শিক্ষা নিয়ে...।।
চোখে আলো পড়তেই ধড়মড় করে উঠে বসল নলিনী। কাল সারারাত ঘুমোতে পারেনি, বারবার শুধু সেই কথাটাই মনে পড়ছিল। হাতে মাত্র দুটোদিন সময় আছে...মাত্র দুটোদিন। তারপরেই যে কী হবে...!
ঘটনার শুরু মাস খানেক আগে। টানা কয়েকদিন ধরে নিম্নচাপের একঘেয়ে বৃষ্টি পড়ছিল। সেদিন ওদের অফিসে আবার মাইনে পাবার দিন। ওদের অফিসে যাদের মাইনে কম, তাদের একটা কাগজে সই করে নগদে টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিমাসেই বড়বাবু টাকা দেওয়া শুরু করতে করতে বেশ দেরি করিয়ে দেন। তারপরেও বাথরুমে গিয়ে টাকা ক'টা গুনে নেয় ও। বলা যায় না টাকা কম পড়ে যায়! বড়বাবুর গুনতে ভুল হয় যদি? বলা তো যায় না, মানুষের তো ভুল হয় ই। তখন তো ওর সমস্যা হয়ে যাবে! ওর বাড়ির একমাত্র রোজগেরে তো ও ই। ওর মা আগে কাজকাম করত, এখন তো পুরোই শোয়া! তাই ওর এই সামান্য বেতনেই ওর বস্তির ঘর ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, মায়ের ওষুধ পত্র, সবকিছু। সেজন্য এক একটা টাকার দাম ও ওর কাছে অনেক! তারমধ্যে আবার ওদের অফিসের এক পিওন দাদার পাল্লায় পড়ে দু মাস আগে একাতা নতুন মোবাইল কিনেছে ও। বেশ সিনেমা টিনেমা দেখা যায়। প্রতি মাসে সেজন্য টাকা দিতে হয় ওই পিওন দাদা কে। উনি নিজের কার্ড দিয়ে কিনে দিয়েছেন। প্রতিবার ই মাইনে পাবার পর অফিসের পেছনের দিকে ওদের জন্য যে বাথরুম টা আছে, সেখানে চলে যায় ও। টাকা গুনে, দাদার কিস্তির টাকাটা বের করে নিয়ে, বুকের মধ্যে খাম টা ঢুকিয়ে রাখে। বাসে-ট্রেনে যাওয়া, বলা যায় না...কার কী মতলব।
সেদিন ও এই করতে গিয়েই দেরি হয়ে গেছিল খুব। তারমধ্যে অফিস থেকে বেরিয়েই দেখে এক কোমর জল রাস্তায়। আর এত বৃষ্টি যে, ছাতায় মানছিল না। খুব ই অসুবিধা হয়েছিল ওর বাস স্টপ অবধি আসতে। এই বৃষ্টিতে রাস্তায় কোথায় গর্ত টর্ত আছে বোঝাই তো যায় না! তাই সাবধানে পা ফেলতে হয়েছে। ও পড়ে গেলে, লেগে গেলে, চুন - হলুদ টুকুও লাগিয়ে দেবার কেউ নেই। আর তারচেয়েও বড় কথা, ওরা অফিস না গেলেই টাকা কাটে। তাই অফিসে যেতেই হয়, মরতে মরতেও।
বাস স্টপে পৌঁছে দেখে একটাও বাস নেই। এদিকে ভিড় আছে অনেক। সেদিন মেট্রো রেল ও চলছিল না। কেউ একজন ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল নাকি! কেন যে এরা মরে যায়, লড়াই টুকু না করে! তাহলে ওর মতো জীবন হলে কী করত! ছোটবেলা থেকে দেখেছে বাপটা মাতাল, মা কে,ওকে ঠ্যাঙাত। তারপর তো একদিন মালের ঘোরে বাসের তলায় চাপা পড়ে মরেই গেল। আগে ইকলেজে যেত ও, বাপ মরে যাবার পর পাট চুকে গেল। পড়াতে মাথাও ছিল না। তারপর থেকেই কাজে লেগে গেল। আগে বাড়িতে কাজ করত, মায়ের সাথে। তারপর এক বাড়ির দাদাই অফিসে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। হাউজকিপিং এর কাজ। বাথরুম, প্যান্ট্রি পরিষ্কার করতে হয়। তা হোক! তবু 'লোকের বাড়ি কাজ করি' বলার চেয়ে 'অফিসে কাজ করি' বলায় প্রেস্টিজ বেশি! মা তখন কাজ করতেন, চলেও যেত। তারপর মায়ের শরীর ভাঙতে শুরু করল। প্রথমে কিছু করে নি ওরা। ওদের মতো ঘরে অত সহজে ডাক্তার দেখানো হয় না। কিন্তু একদিন যেতেই হলো, আর তাতেই জানা গেল মায়ের নার্ভের কিছু সমস্যা হয়েছে। হাত -পা কাঁপে সারাক্ষণ। তারপর থেকেই তো মা ঘরেই বসা! আর। এভাবেই চলছে! এখন মাসে হাজার টাকার ওষুধ ই চলে! কীভাবে যে চলে, ও ই জানে সেটা।
অথচ সব মেয়ের মতোই ওর ও ইচ্ছে ছিল...বিয়ে হবে। কিন্তু কে আর বিয়ে দেবে ওকে! ছেলেরা যে ছুঁকছুঁক করে নি, তা না। কিন্তু, বারবার বাপের কথাই মনে পড়ত ওর। ভাত দেবে না, কিন্তু রাতে মাতাল হয়ে এসে স্বামীর অধিকার দাবী করবে...মারবে... এই তো ওদের পাড়ার বেশিরভাগ মরদের ছিরি! আগে আগে ভেবেছিল একটা সন্তান যদি থাকত। কিন্তু, ছেলেরাও খুব অল্প বয়সেই মদ-গাঁজা ধরে ওদের ওখানে। তাই এমনিই ভালো আছে ও। এতটা দূর যাওয়া আসা...তারপর কাজের চাপ...যখন ঘুমোতে যায়, মনে হয় চোখ জুড়িয়ে আসছে...। ক্লান্তি আসে এতো...।
ঘুমের কথা ভাবতে ভাবতেই চোখ যেন জড়িয়ে আসছিল ওর। একটাও শিয়ালদা যাবার বাস আসছে না। ওদিকে নাকি খুব জল জমেছে। ক'জন বলাবলি করছিল। তারা তো হেঁটেই রওনা হয়ে গেল। এই বৃষ্টির দিনে ট্রেনে গোলমাল হলেই তো হয়ে গেল! কী যে আতান্তর!
শেষমেষ হেঁটেই শিয়ালদা আসতে হলো। কম দূর নাকি! ছ' সাতটা স্টপেজ। আর স্টেশানেও মেলা ভিড়! একটা ট্রেন ছেড়ে, দু নম্বর ট্রেন টায় উঠল ও। নামার সময় টানাটানিতে ওর কুর্তির হাতাটা ছিঁড়েই গেল! একে ওর বাইরে পরার জামা সেরকম নেই, তাতে এই কান্ড! প্ল্যাটফর্মে নামার পর চোখে জল এলো নলিনীর। অন্যদিন টোটো থাকে স্টেশানের বাইরে, আজ একটাও নেই। রাত ও হয়েছে অনেক। মোবাইল টা ব্যাগের ভেতরে, বৃষ্টিতে বের করতে পারছে না, তাও এগারোটা তো বেজেই গেছে নিশ্চয়ই। শিয়ালদা তেই তো সাড়ে দশটা বাজছিল। বাধ্য হয়ে হাঁটাই লাগালো নলিনী।
পাড়ায় ঢোকার মুখে দেখে শহীদ বেদীটার ওপর ছেলেগুলো আড্ডা জমিয়েছে। ক্লাবের ছেলে ওরা। কাজ নেই, কম্ম নেই, দিন রাত গজল্লা, মেয়েদের আজেবাজে কথা বলা, আর রাতে মদ গেলা...এই তো কাজ। তারমধ্যে ও কলকাতায় কাজ করে বলে ওরা অনেকে অনেক কথা বলে! টোন কাটে! ও নাকি অফিসের বাবু! অহঙ্কারী!
তাড়াতাড়ি রাস্তাটা পেরোতে যাবে,হঠাৎ শোনে 'এই যে এলো অফিসের ম্যাডাম..' আরেকজন রসিয়ে রসিয়ে বলে উঠল 'ম্যাডামের জামা ছেঁড়া কেন?' 'আরে, শুধু কি জামা ই ছেঁড়া, না অন্য কিছুও?'...এইসব নোংরা কথা আর সমবেত অশ্লীল হাসির মধ্যেই হনহন করে ঘর ঢুকেছিল ও। ভেবেছিল স্নান করার সাথে সাথেই কথা গুলোর ক্লেদ বেরিয়ে যাবে মন থেকে..কিন্তু হতে দিল কই! বরং কীভাবে যেন পাড়ায় রটে গেল ও নাকি খারাপ পাড়ায় যায়! এই পাড়ার কে জানি দেখেছে। অথচ যে দেখেছে, সে কী করতে সেখানে গেছিল, সেটা জিজ্ঞেস করে নি কেউ! একেই মফঃস্বল, তাতে এইরকম রটনা। ঘরে অসুস্থ মা। অফিসে খ্যাঁচখ্যাঁচ, অপমান। আর পারছিল না নলিনী। বাধ্য হয়ে একদিন ক্লাব ঘরে গিয়ে ছেলেদের যে পান্ডা, সেই চিতু বলে ছেলেটাকে ডেকে বলল "তোরা আমাকে নিয়ে এসব রটাচ্ছিস কেন?" শুনে আবার অশ্লীল হেসেছিল চিতু। তারপর বলেছিল 'যেটা রটে, তার খানিকটা তো বটে, শোন, তোরা হয় ঘর ছেড়ে দে, নইলে আমাকেও কিছু ট্যাক্স দিয়ে দে...এখানে থেকে অফিসের ফুটানি চলবে না...'
আর, সেই ঘর ছেড়ে দেবার জন্য দেওয়া সময়ের মাত্র দুদিন বাকি। এর মধ্যে ওরা আরো কোণঠাসা হয়ে গেছে। ওদের বস্তিতে অনেক গুলো ঘরের একটাই এজমালি কল। সেখানে ওকে, ওর মা কে যেতে দিচ্ছে না কেউ। কী না...'এটা ভদ্রপাড়া...এখানে এসব চলে না!'
এবার বুঝি মরতেই হবে। কারণ এই মুহূর্তে কোথাও ঘর ভাড়া নেবার মতো টাকা ওর নেই।
দুটোদিন কেটে গেল। চিতুর দলবল আসবে আজ। মায়ের দিকে তাকাতে পারছে না নলিনী। এই দু দিন অফিসেও যায় নি ও। কাজ টা চলে গেলে কী হবে, ভাবতে পারছে না...। এর মাঝেই অফিস থেকে ফোন...রিসেপশানে যে দিদি বসে, সেই দিদি ফোন করে বলেছে সোমবারে জয়েন করতে, না হলে নতুন লোক রেখে নেওয়া হবে।
পারছে না নলিনী আর!
"কি রে, বেশ্যা মাগী, নিজেকে নিয়ে ব্যবসা করতে হলে অন্য জায়গায় যা...এখানে থাকা চলবে না.." চিৎকার করে বলে উঠল কেউ।
মায়ের চোখে ভয়। ভীষন, ভীষন ভয়। হাত, পা, ঠোঁট...সব কাঁপছে মায়ের।
মায়ের দিকে তাকিয়ে কি যেন হয়ে গেল নলিনীর।
গু -মুত ঘেঁটে, পরিষ্কার করে খায়...কারো বাপের পয়সায় খায় না। ঘর ভাড়া দেয় সময় মতো। এই শালারা কে ওকে বের করে দেবার? কি প্রমাণ আছে ও বেশ্যা? ও তো অফিসে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে ও কি করে। হারামী গুলো নিজেরা কাজ করে না, তাই কাউকে করতেও দেবে না।
কি মনে হলো, বাইরে বেরিয়ে চিৎকার করে কথা ক'টা বলে দিল ও। বেজন্মার বাচ্চাগুলো বুঝুক, ও আর ভয় পায় না। সারাজীবন ছেলে গুলো পায়ের নীচে রেখেছে। বাবা, উঠতি বয়সের ছোঁড়া গুলো...আর এখন এই জানোয়ার গুলো...
'তবে রে শালী...' বলে ভেতরে ঢুকে এলো চিতু। চিরকালের চুপ করে থাকা মেয়ের এতো মুখ সহ্য করার বান্দা নয় চিতু! মেয়েদের জায়গা নিচে...আর তারমধ্যে এই গু ঘাঁটা মেয়ের বড় বড় কথা...আজ বুঝবে ছেলেদের জায়গা আসলে কী আর মেয়েদের কী...আর ট্যাক্স ওকে দিতেই হবে...হয় টাকায়...আর নইলে...ভাবতে ভাবতেই প্যান্টের জিপে হাত দেয় চিতু। আজ অফিসের বাবুর গুমোর ভাঙবে। এই গোটা এলাকায় কারো ক্ষমতা নেই চিতু গুন্ডার মুখের ওপর কিছু বলে...।
ওর দিকে এগোতেই, ওদের ঘরের লাগোয়া এক চিলতে বারান্দার রাখা বঁটি টা তুলে নেয়... তারপর চিতুর উদ্যত পুরুষাঙ্গে কোপ বসিয়ে দেয় নলিনী...তারপর...রক্তে ভেসে যাওয়া বঁটি নিয়ে ভিড় জমে যাওয়া বাইরে এসে চিৎকার করে বলতে থাকে "আয় কে আসবি...আয়...আমি সব আমার মোবাইলে ভিডিও করে রেখেছি...পুলিশকে দেবো...আয়...অনেক বছর...বছরের পর বছর চুপ করিয়ে রেখেছিস...কর লাগবে তোদেএ? ট্যাক্স? মেয়েরা বেশ্যা হলে তোরা কী? তোরা কী? বল, বল... "
ওর একটানা বোবা চিৎকারে চুপ করে থাকে সারা এলাকা। খোলা চুল...হাতে রক্তমাখা বঁটি...রং জ্বলা নাইটি পরা নলিনী তখন যেন স্বয়ং নাঙ্গেলী, যিনি উনবিংশ শতাব্দীতে নিজের স্তন যুগল ঢাকার জন্য টাকা দিতে না পেরে স্তন কেটে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন...আর এই একবিংশ শতাব্দীতে অত্যাচারীর পুরুষাঙ্গ কেটে নিয়ে নলিনী তাঁরই ঋণ শোধ করল...
সময়...মানসিকতা..সাহসিকতার সংজ্ঞা এইভাবেই হয়ত পালটে যায়...যুগ থেকে যুগে... কাল থেকে কালে...শিক্ষা দিয়ে...শিক্ষা নিয়ে...।।