01-11-2020, 07:10 PM
(31-10-2020, 10:42 AM)ddey333 Wrote: শ্রী...
এবার লক্ষীপুজো দুদিনেই করা যাবে বটে, তবে নিয়ম মেনে আজই পুজো করছেন শিখা। এবার অবশ্য অন্যান্যবারের তুলনায় একটু ছোট করেই হচ্ছে পুজো, আত্মীয় স্বজনেরা কেউই সেভাবে আসতে পারবেন না বলে। তবে এই দিনটাও তো বচ্ছরকারের দিন... মা কে আরাধনা না করলে হয়?
পুজোর ভোগ রান্না, গুছোনো সব শেষ, এদিকে কিছুটা খড়িমাটি ভেজানো আছে এখনও, তাই ফ্ল্যাটের দরজার সামনে একটু আলপনা দেবেন বলে দরজা টা খুললেন শিখা। দরজার দুই পাশে মঙ্গলঘট, তার কাছে মা লক্ষীর পদচিহ্ন আগেই এঁকেছিলেন, এখন একটু ধানের শীষ ও আঁকবেন।
দরজা খুলেই দেখেন পাশের ফ্ল্যাটের ও দরজা খোলা। আর সেখানে দুটো পুঁচকে প্রদীপ রাখছে মেয়েটা।
মেয়েটাকে দেখেই কেমন যেন গা টা শিরশির করে ওঠে শিখার, প্রতিবার। ওরা এখানে নতুন ভাড়া এসেছে, লকডাউন হবার আগে আগে। প্রথম কদিন ফ্ল্যাটবাড়ির চাপা স্বভাব অনুযায়ী দেখেন নি কে এসেছে, বাড়িতে ক'জন আছে, এইসব। কিন্তু তিনতলার বি ফ্ল্যাটের বৌদি বলার পরে জানতে পারেন কর্তা, গিন্নি আর এক মেয়ের সংসার। বছর কুড়ি -বাইশের মেয়েটাকে তিনবছর আগে কেউ অ্যাসিড ছুঁড়ে দিয়েছিল, প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক অপারেশানের পর মেয়েটা এখন খানিকটা সুস্থ, তবু, মেয়েটাকে দেখলে কেমন লাগে একটা! বাচ্চা মেয়ে...শুনেছিলেন পড়াশুনায় তুখোড় মেয়ে...কিন্তু তাও নিজের অজান্তেই মেয়েটিকে... এড়িয়ে চলেন উনি। নইলে পাশের বাড়ি, লাগোয়া ফ্ল্যাট...হৃদ্যতা তৈরি হতো না?
মেয়েটি দরজার কাছে প্রদীপ রেখে দাঁড়িয়েই রইল। একটু অবাক হলেন শিখা। আজ কি দীপাবলি নাকি, যে এইভাবে প্রদীপ রাখতে হবে!
এদিকে আলপনা দেবেন বলে বাবু হয়ে বসেছেন উনি, একদম দরজার মুখোমুখি, তাই অস্বস্তি হলেও ওঠা যাবে না...
"কাকিমা, কী সুন্দর তোমার আঁকার হাত গো! কী সুন্দর করে মায়ের পা আঁকছ!" বলে মেয়েটি। বেশ রিনরিনে কন্ঠ তো মেয়ের!
একটু হাসলেন শিখা। তারপর বললেন "থ্যাংকইউ! "
"তোমাদের পুজো কখন হবে কাকিমা? তোমার সব কাজ হয়ে গেছে? আমি হেল্প করব? আমার কিন্তু কাচা জামাকাপড়... " বলে মেয়েটি।
আগে থেকে আলাপ নেই, তাও এইভাবে আপন করা স্বর...শুনতে খুব ভালো লাগছিল।
"হ্যাঁ মা, সব গুছোনোই আছে, এই পূর্ণিমা পড়বে,,তারপর ঠাকুরমশাই এলে পুজো হবে..." বলতে বলতেই আলপনা দেওয়া শেষ। খড়িমাটির বাটিটা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পা টা টনটন করে উঠল ওনার।
সেই যে অপারেশান হলো,বাদ গেল কিছু অঙ্গ, সেই থেকেই ওজন বাড়ছে সমানে। সকালে উঠে লেবু-মধুর জল, হাঁটা, ভাত না খাওয়া...কোনো কিছুই ওজন কমাতে পারেনি। ফলে পা ব্যথা হয় খুব। বসতে-উঠতে গেলে যেন প্রান বেড়িয়ে যায়!
ওনার বিকৃত মুখ দেখে এগিয়ে আসে মেয়েটা। হাতটা ধরে বলে ওঠে "লাগল কাকিমা?"
"তা লাগবে না? বাড়িতে বসে বসে ওজন টা বাড়িয়েছে দেখেছ? পুরো ফুটবল! তোমার যা বয়স, তারচেয়ে তোমার হাঁটুর বয়স বেশি!" পিছন থেকে বলে ওঠেন বীরেনবাবু, শিখার স্বামী।
আজকাল এভাবেই ঠেস দিয়ে কথা বলেন উনি। খিটখিটে বুড়ো কোথাকার! এক একবার ইয়ার্কির ছলে বললে মানা যায়, কিন্তু তা বলে এইভাবে, সবসময়! চোখে জল আসছিল শিখার। ধুত, ভাল্লাগে না!
"উঁহু, কাকু, নট ফেয়ার! কাকিমা সারাদিন ধরে অনেক কাজ করেছেন, এখন এই এত আলপনা দিয়ে উঠতে গিয়ে পায়ে লেগেছে, আর তুমি খোঁটা দিচ্ছ? জানো না, এইভাবে চেহারা নিয়ে কথা বলাকে বডি শেমিং বলে? আর সেটা খুউউউব বাজে জিনিস?... এই যে তোমার কেমন ঝাঁটার মতো গোঁফ, আমি যদি তোমাকে 'হেডঅফিসের বড়বাবু' বলে রাগাই সেটা তো গোঁফ শেমিং হবে, তোমার কি ভালো লাগবে সেটা?" হাসতে হাসতে বলে মেয়েটি।
শুনে কেমন অপ্রস্তুত হয়ে বোকা বোকা হাসেন বীরেন বাবু। "সে তো বটেই" বলতে বলতে।
"বেশ হয়েছে, যোগ্য জবাব পেয়ে চুপ করে গেছে লোকটা" মনে মনে ভাবেন শিখা। আর শোনেন মেয়েটি যোগ করল "এই ধরো, তুমি বা কাকিমা যদি আমার এই অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া স্কিন নিয়ে কিছু বলো, আমার ও তো খারাপ লাগবে, বলো? সেটাও শেমিং হবে। যে যেমন ই হোক, আসলে আমাদের গ্রেটফুল...ইয়ে কৃতজ্ঞ থাকা দরকার। এই ধরো, আমিও কৃতজ্ঞ, ভাগ্যিস বেঁচে আছি, তাই তো আজ তোমাদের বাড়িতে পুজো হয়ে যাবার পরে প্রসাদ খেতে পাব.." কলকল করে বলে মেয়েটি।
কৃতজ্ঞ থাকা...এই মেয়েটিও কৃতজ্ঞ জীবনের কাছে...আহা কী অপূর্ব জীবনবোধ!
একটু আগে ব্যথা লাগা পা টা কে ই একটু উঁচু করে দাঁড়ান শিখা। তারপর মেয়েটির কপালে একটা চুমু খান।
আহা, এমনি ঋজু যার চিন্তা, সেই তো স্বয়ং শ্রী...
এটা দারুন সত্যিই।