Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
#41
গরিব জ্যোৎস্নার পৃথিবী
     শ্রীজাত
সকালের জলখাবার আর নানান টুকিটাকি ঘরের কাজ সেরে সবে বিছানায় একটু এলিয়েছি, এমন সময় দরজায় বেল করোনার কারণে সারাক্ষণ দুর্বলতা আর ক্লান্তির এক বোধ আচ্ছন্ন করে রেখেছে তাও কোনওরকমে নিজেকে টেনে নিয়ে চললাম দরজার দিকে -সময়ে কেউ বড় একটা আসার কথা নয়, তাছাড়া আমাদেরও দরজা খুলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলা ঠিক নয়, তাঁদেরই স্বাস্থ্যের কারণে যেতে যেতে আরও একবার বেজে উঠল বেল বেশ তাড়ায় আছেন, যিনিই এসে থাকুন না কেন  
দেখি, পক্ককেশ এক প্রৌঢ় চারতলার সিঁড়ি ভেঙে উঠে দেয়ালে হাত রেখে হাঁপাচ্ছেন অপর হাতে মলিন একটি পলিথিন ব্যাগ আঁকড়ে ধরা দেখে চিনতে পারলাম না আমার চোখে সেই ধন্দ দেখেই তিনি নিজের মাস্ক কিছুটা নামিয়েচিনতে পারছেন?’ লে নিজের নাম বললেন আমি প্রথমে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়েই ওঁকে মাস্ক পরে নিয়ে দূরে সরে যেতে বললাম এবং জানালাম যে, আমি কোন রোগে আক্রান্ত উনি তাতে বিশেষ ভয় পেলেন বা গা করলেন বলে মনে হল না বরং নিজের পেশার কথা জাহির করলেন, ওই হাঁপাতে হাঁপাতেই 
হ্যাঁ, এবার আবছা চেনা লাগছে ঠিকই খুব নিয়মিত না হলেও, কারও কারও সঙ্গে ওঁকে মঞ্চে বসতে দেখেছি, যেদিকটায় কখনওই বেশি আলো এসে পড়ে না, সেইদিকে ভদ্রলোক পারকাশন আর্টিস্ট বাজনা ওঁর পেশা, ওঁর শিল্প আমি ওঁর পরিচিতির উত্তরে সামান্যহুঁবললাম বটে, কিন্তু বুঝে উঠতে পারলাম না, কেন হঠাৎ আমার বাড়ি এসে হাজির হয়েছেন 
উত্তরটার জন্য অবশ্য প্রশ্ন বা অপেক্ষা, কোনওটাই করতে হলো না কপালের ঘাম মুছে নিজেই বললেন, ‘অনেকের সঙ্গে বাজিয়েছি এত বছর কী আর বলব আপনাকে কিন্তু আজ সাত মাস হলো একটাও অনুষ্ঠান নেই, রেকর্ডিং নেই হাতে টাকা নেই এখন অবস্থা এমন হয়েছে, আপনারা সাহায্য না করলে খেতে পাবো না কথাটা শুনে আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম দরজায় ঠিক কেমন মনে হচ্ছে নিজের, সেটা বুঝে উঠতেও যেন সময় লেগে যাচ্ছে কিছুটা সেই ফাঁকেই ভদ্রলোক বললেন, ‘অনেকে দিয়েছেন কিছু কিছু লে, কয়েকজন গানবাজনার সতীর্থের নাম করলেন তারপর বললেন, ‘তাই হেঁটে হেঁটে বাড়ি বাড়ি ঘুরছি অনেক কষ্টে আপনার বাড়ি খুঁজে পাওয়া একটু কিছু দেবেন?’ 
আমার মাথা আপনা থেকেই হেঁট হয়ে গেল লজ্জায়, ব্যর্থতায় একজন প্রবীণ, যিনি সারাটা জীবন বইয়ে দিয়েছেন গানবাজনার জন্য, আমরা বদলে তাঁকে এটুকু সচ্ছলতাও দিতে পারিনি, যাতে বিপদে তাঁকে অন্যের দ্বারস্থ না হতে হয় -লজ্জা আমাদেরই, -ব্যর্থতাও আমাদের বরং সফল উনি, যিনি নিজের মধ্যে সাহস জাগিয়ে তুলতে পেরেছেন, এভাবে মানুষের দরজায় পৌঁছনোর  
ওঁকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে ভিতরে গিয়ে দূর্বাকে বললাম, শুনে ওরও মন নিভে গেল এই অসুস্থতার মধ্যেই আমরা আমাদের সাধ্যমতো যেটুকু পারলাম, ওঁর জন্য বার করে আনলাম দেরাজ থেকে কোনও সাহায্য নয় মানুষকে সাহায্য করবার স্পর্ধা আমাদের নেই, কোনওদিন হবেও না কেবল নিজেদের থেকে অপরের সঙ্গে কিছুটা ভাগ করে নেওয়া একটাই তো সংসার, ওঁর আর আমার মঞ্চও তো একটাই একদিকে টান পড়লে অন্যদিক থেকে আপনিই চলে যাবে 
দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম ফের অন্যান্য বছর এমন সময়ে অপরিচিত মানুষ এলেও রেওয়াজ তাঁকে জল আর মিষ্টি এগিয়ে দেওয়ার বিজয়া চলছে কিন্তু -বছর এতটাই দুঃসময় যে, দূর থেকে হেঁটে আসা ক্লান্ত মানুষটিকে সেটুকুও দিতে পারলাম না আমাদের হাতের খাবার এখন অস্পৃশ্য কিন্তু টাকা সেসবের অনেক উর্ধ্বে তার স্পর্শদোষ হয় না, হতে নেই 
আমি সংকুচিত হাতে টাকাটা এগিয়ে দিতেই ভদ্রলোক হাত পাতলেন নিচু হয়ে ঘর্মাক্ত, কম্পমান হাতের পাতা, রেখায় রেখায় অনেক বছরের কাটাকুটি এক সময়ে কত খঞ্জনি চমকে উঠেছে এই হাতের পাতায়, গানের লয় বাঁক থেকে বাঁকে ঘুরে গেছে এই হাতেরই খঞ্জিরায় আজ সেই হাত আমার সামনে পাতা টা টাকার জন্য ভাতের জন্য জীবনের জন্য এই দৃশ্যের সামনে এসে আমি প্রস্তরবৎ স্থাণু হয়ে গেলাম কোন পৃথিবীতে এসে দাঁড়িয়েছি আমরা? মঞ্চের বাইরে কোন সাজঘরে দেখা হচ্ছে আমাদের
পেতে রাখা হাতের পাতাটার দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না কেবল বললাম, ‘ওভাবে নেবেন না সোজা হাতে নিন কী ভাবলেন কে জানে আমি তখনও মেঝের দিকে তাকিয়ে ওঁর প্রতি হাত বাড়িয়ে আছি তবু, নিচ্ছেন যখন, একবার সাহস করে তাকালাম ওঁর দিকে হাত সোজা করেছেন ঠিকই, কিন্তু কাঁদছেন ভদ্রলোক সন্তানের বয়সী একজনের কাছ থেকে টাকা নিতে গিয়ে চোখে জল এসে গেছে তাঁর মর্যাদা বড় স্রোতস্বী একটা নুড়ি পড়লেও ছিটকে এসে গায়ে লাগে জল আর তো পাথরের কাহিনি 
অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল, পারলাম না গলা ধরে আসছে আমারও কেবল বলতে পারলাম, ‘সাবধানে যাবেন উনিও সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আমায় নমস্কার জানিয়ে বললেন, ‘আপনি কিন্তু লেখা ছাড়বেন না দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম নিজেকে এত বেশি ছোট মনে হতে লাগল, এত বেশি অসফল, ভুলে যেতে চাইছিলাম ঘটনাটা এতদিনকার লেখালেখির কী দাম, কী মূল্য এত বছরের গানবাজনার, যদি মানুষ খেতে না পায়? আমার দরজা থেকে বেরিয়ে মানুষটি তখন রোদ মাথায় হাঁটছেন, আরও কোনও দরজার দিকে মলিন একখানা পলিথিন ব্যাগে আমাদের অর্জিত ব্যর্থতা জমা হচ্ছে একে একে 
এই অতিমারী কয়েক মাসে আমাদের অনেক কিছু নিয়ে গেল কিন্তু আমাদের অহং আর দম্ভ, সে কি মরবে না এর প্রকোপে? নিজের খ্যাতি, মান, অর্থ, সাফল্য, কীর্তি নিয়ে ব্যস্ত থাকা লোকজন কি বুঝবে না এরপরেও যে, একজন নিঃস্ব মানুষের সামনে দাঁড়ালে এই গৌরবের সিন্দুকই বড় দৈন্যের কুঠুরি হয়ে যায়? সে কি এরপরেও বুঝবে না যে, পরিস্থিতির এক ঝাপটার সামনে তার সমস্ত অর্জন কুটোর মতো উড়ে যেতে পারে? আর তাকেও একদিন সব ছেড়ে নেমে আসতে হতে পারে মাটিতেই, যেখান থেকে সে শুরু করেছিল? কে জানে 
কাল কোজাগরী পূর্ণিমা লক্ষ্মীপুজো আমাদের অন্নের দেবী, আমাদের প্রাচুর্যের প্রতিমা ঘরে ঘরে পূজিত হবেন তিনি, ধানের ছড়ায়, মঙ্গলঘটে যাঁরা বিশ্বাসী, তাঁরা যেন নিজেরটুকুর বাইরে গিয়েও চাইতে পারেন, এই আমার চাওয়া আর যাঁরা আমার মতো, যাঁরা বহমান এই মহাসময়কেই জীবনদেবতা মেনে চলেন, তাঁদের জন্য দেবীর বরাভয়ের মুদ্রায় আগামীকাল ফুটে উঠবে প্রবীণ এক হাতের পাতা ঘর্মাক্ত, কম্পমান, রেখায় রেখায় কাটাকুটি আর সামনে রাখা ঘটে পবিত্র জলের জায়গায় ভরা থাকবে এক প্রৌঢ়ের চোখের জল অভাবের, উপোসের, দারিদ্রের এই নিরন্নের দেশে এটুকুই আমার উপাচার, এমনই আমার কোজাগরী কে জাগবে, সত্যিই জানি না এই গরিব জ্যোৎস্নার পৃথিবীতে নিজেকে যেন জাগিয়ে রাখতে পারি
[+] 6 users Like ddey333's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.


Messages In This Thread
RE: কিছু মনের সত্যি কথা - by ddey333 - 31-10-2020, 07:14 PM



Users browsing this thread: 19 Guest(s)