17-10-2020, 10:34 PM
পর্ব তিন – (#1-10)
রাত প্রায় সাড়ে নটা। বিকেলের দিকে একবার মায়ের সাথে কথা হয়েছিল, মা বলছিল কোন এক বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে তাই সেই বাড়িতে যাবে। এতদিন দিল্লীতে থেকে দিল্লীর ঠান্ডা অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। কাজের লোক রাতের খাওয়া বানিয়েই গিয়েছিল, খাওয়া সেরে বসে বসে টিভি দেখছিল। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কাল ভোরবেলা ট্রমা সেন্টারে ডিউটি। শীতকাল এলেই গাড়ির এক্সিডেন্ট খুব বেড়ে যায়, রোজ দিন অন্তত দশ বারোটা এক্সিডেন্টের কেস দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। এমন সময়ে ফোন বেজে উঠতেই চমকে যায় রিশু।
ফোনের ওপাশে দিপের আর্ত চিৎকার শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, “দাদাভাই আমার হাত ভেঙ্গে গেছে তুমি তাড়াতাড়ি এস।”
ভাই বোনকে ভীষণ ভালোবাসে রিশু, ওর দুটো চোখের মনি দুই ভাই বোন। রিশু যখন ডাক্তারি পড়তে দিল্লী যায় তখন দিপের জন্ম হয়, পরাশুনা আর দুরত্তের ফলে দিপকে সেইভাবে বড় হতে দেখতে পারেনি বলে ওর খুব দুঃখ। তাই বাড়িতে এলেই দিপকে নিয়ে পরে থাকত রিশু। ওর ইচ্ছে ছিল দুইজনকে দিল্লীতে নিজের কাছে নিয়ে আসার, কিন্তু ওর নিজের খুব ইচ্ছে মায়ের কাছে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার তাই আর ওদের নিয়ে আসেনি। বেশ কয়েক বছর আগে, যখন রিশু সবে মাত্র এমএস পড়ছে, তখন একবার দিপ সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছিল। ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে তখুনি বাড়ি গিয়েছিল এবং যতদিন না দিপের পা ঠিক হয় ততদিন দিপের পাশে ছিল।
রিশু ধরমর করে উঠে বসে বলে, “কি রে কি করে হয়েছে?”
অন্যদিকে দিপ কপট হেসে, মুখ বেঁকিয়ে কাঁদার ভঙ্গি করে বলে, “আমি বাথরুমে পিছলে পরে গেছি দাদাভাই। ডান হাতের কুনুই খুব ব্যাথা দাদাভাই, দাদাভাই হাত সোজা করতে পারছি না দাদাভাই। তুমি এস তাড়াতাড়ি...”
দিপের এহেন কপট কান্নার ভঙ্গিমা দেখে সবাই মুখ চেপে হেসে ফেলে। রিশু বলে, “মাম্মাকে ফোন দে।”
দিপ কপট ব্যাথায় চেঁচিয়ে ওঠে, “দাদাভাই... প্লিজ এস।”
রিশু, “আচ্ছা তুই মাম্মাকে দে।”
দিপ নাছোড়বান্দা, “তুমি না এলে আমি কিন্তু হসপিটাল যাবো না। লোকে কি বলবে, আমার দাদাভাই এতবড় অরথপেডিক সারজেন আর নিজের ভাইয়ের বেলায় লবডঙ্কা।”
রিশু কি করবে ভেবে পায় না তাও বলে, “আচ্ছা বাবা, আমি আসছি, তুই মাম্মাকে ফোন দে।”
আম্বালিকা দিপের হাত থেকে ফোন নিতেই অন্যদিক থেকে রিশু বলে, “কি দেখ, কোথায় থাক তোমরা? হটাত করে কি ভাবে বাথরুমে পরে গেল?”
ছেলের রাগ দেখে হেসে ফেলে আম্বালিকা তাও রিশুকে শান্ত করে বলে, “আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। আমি যত বলছি যে হসপিটাল নিয়ে যাবো, তোর ভাই কিছুতেই শুনছে না।”
রিশু মাকে বলে, “তুমি ওকে নিয়ে এখুনি হসপিটাল যাও, এসএসকেএম এ নীলেশ আছে আমি ফোন করে দিচ্ছি, আমি কাল সকালের ফ্লাইটে পৌঁছে যাবো।”
দিপ মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “তুমি এখুনি না এলে আমি কোথাও যাবো না। আমার হাত বেঁকে যাক ভেঙ্গে যাক তোমার তাতে কি।”
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে রিশু, একটু ভেবে বলে, “আচ্ছা আমি আসছি তবে তুই হসপিটাল যা আমি নীলেশকে একটা ফোন করে দিচ্ছি ও পৌঁছে যাবে এমারজেন্সিতে।”
মায়ের ফোন রেখে নীলেশকে ফোনে জানিয়ে দেয় ভাইয়ের কথা। ল্যাপটপ খুলে বসে পরে, ভাই নাছোড়বান্দা ওকে ছাড়া কিছুতেই হসপিটাল যাবে না। ফ্লাইট চেক করে দেখে রাত বারোটায় কোলকাতার একটা ফ্লাইট আছে, কোন মতে ল্যাপটপের ব্যাগ আর একটা ছোট ব্যাগে কিছু জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পরে। জামা কাপড় নেওয়ার দরকার পরে না, কারন কোলকাতার বাড়িতে ওর সব কিছু আছে। ট্যাক্সিতে বসে আবার ফোন করে দিপকে, দিপের কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে বেশ চিন্তায় পরে যায়। কি হল, গিয়েই একটা এক্সরে করাতে হবে, রিপোরট দেখেই বুঝতে পারবে কতটা কি হয়েছে। এইচওডি কে ফোন করে দিয়েছিল যে কয়েকদিনের জন্য ছুটি চাই, ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেই সাথে ওর বন্ধু ইন্দ্রজিতকে ফোন করে দেয়। এমবিবিএস এর সময় থেকেই ইন্দ্রজিতের সাথে ওর বন্ধুত্ত, বেশ কয়েক বার ইন্দ্রজিত আর ওর স্ত্রী শালিনী কোলকাতায় রিশুদের বাড়িতে গেছে।
সিকুরিটি চেকের পরে প্লেনের দিকে যেতে যেতে মাকে ফোন করে রিশু, “কি হল কোথায় আছো, হসপিটাল নিয়ে গেলে?”
আম্বালিকা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি ফ্লাইটে বসে গেছিস?”
রিশু, “হ্যাঁ। আমি এবারে ভাইকে নিয়ে আসব আমার কাছে।”
দিপ আর দিয়া, হাতের মুঠো হাওয়ার মধ্যে উঁচিয়ে লাফিয়ে ওঠে, “মিশন একমপ্লিসড মাম্মা, কাজ হাসিল।” মাকে জড়িয়ে ধরে একটু নেচে নেয় দুই ভাই বোন, এবারে ওদের দাদাভাইয়ের বিয়ে হবে প্রিয় ঝিনুক দিদির সাথে।
ছেলের এহেন মনের অবস্থা দেখে আম্বালিকা হেসে ফেলে, “আচ্ছা বাবা নিয়ে যাস, তোর ভাই তোর কাছে থাকবে না ত কি আমার কাছে থাকবে নাকি? বহাল তবিয়েতে আছে তোর ভাই, কিছুই হয়নি তোর ভাইয়ের।” বুক ভরে শ্বাস নিয়ে একটু থেমে বলে, “কিন্তু বাবা ভাইকে যে নিয়ে যাবি তুই ত সারাদিন বাড়িতে থাকিস না, কে দেখবে তোর ভাইকে?”
ভাই ভালো আছে শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রিশু, “এত রাতে এইসবের মানে কি? ভাইয়ের কিছু হয়নি মানে?” এতক্ষন ওর মনের মধ্যে অনেক কিছু চলছিল।
আম্বালিকা ছেলেকে শান্ত হতে অনুরোধ করে বলে, “কাল বলছিলাম না যে আমার বান্ধবী পীয়ালির বড় মেয়ে সঙ্ঘমিত্রার বিয়ে।” রিশু ছোট উত্তর দেয়, “হুম”। আম্বালিকা বলে, “তোর জন্যেও একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজেছি, ভাবছি এক সাথেই এক মন্ডপে দুই জনের বিয়ে দিয়ে দেব।”
প্লেনের সিটে বসতে গিয়েও থেমে যায় রিশু, “কি বলছ?”
আম্বালিকা বুঝতে পারে এইবারে একটা ঝড় শুরু হবে, তাও ছেলেকে বলে, “তুই আয় সব বলছি। দিপের কান্না না শুনলে তুই আসতিস না তাই বদমাশটা ওই ভাবে তোকে ডেকে এনেছে।”
শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে রিশু, “আমি দিপের এবারে সত্যি হাত ভেঙ্গে দেব।”
প্লেন দিল্লীর মাটি ছাড়তেই এক বিমান সেবিকা এসে ওদের জলের বোতল দিয়ে যায়। সেই সুন্দরী বিমান সেবিকার বুকের নেম প্লেট দেখে থমকে যায় ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, “চন্দনা”। একবার সেই বিমান সেবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই হেসে ফেলে। পাঁচ বছর আগের এক ভীষণ বর্ষার বিকেলে দেখা হয়েছিল এক সুন্দরী ললনার সাথে, নাম তার চন্দনা নয়, সেই ললনার নাম ছিল চন্দ্রিকা পশুপতি। মাছের বাজারে দেখা, সি আর পার্কের মাছের বাজারে অনেকেই আসে মাছ কিনতে। সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা তবে আকাশ দেখে মনে হয়নি যে হটাত করেই বৃষ্টি নামবে। কাজের মেয়েটা শুধু নিরামিশ রান্না করে যায়, গতবার মা এসে ওকে হাতে ধরে মাছ ভাজা বানাতে শিখিয়ে গেছে। এমনিতে মা যখন আসে, তখনি এক গাদা মাছ কিনে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়। কাটা রুই ছাড়া আর কি বানাবে সেই কিনে মাছের বাজার থেকে বাইরে আসতেই ঝমঝমিয়ে তুমুল বৃষ্টি নামে। বাজার থেকে ওর বাড়িটা বেশি দূরে নয়, ভেবেছিল এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে যাবে। পরের দিন রবিবার ছিল, হসপিটাল যাওয়ার ছিল না, তখন ওর ওপিডিতে ডিউটি ছিল। বৃষ্টির জন্য একটা দোকানের শেডে বেশ কয়েক জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে এক সুন্দরী গোলগাল গড়নের মেয়ের দিকে ওর নজর যায়, পরনে সালোয়ার কামিজ, পিঠ ছাড়িয়ে লম্বা বেনুনি, গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও চেহারার গড়নে একটা মাধুর্য আছে। বৃষ্টির ছাঁটে কামিজ একটু ভিজে গেছে, তাও নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্য সব লোকের সাথে ধাক্কা ধাক্কি করে সেই সেডের নিচে দাঁড়াতে যেন সেই ললনার মনে দ্বিধা জাগে। রিশু আড় চোখে বার কয়েক ওর দিকে দেখে, তৃতীয় বার দেখতেই দুইজনার চার চোখ এক হয়ে যায়। রিশু অসহায়ের মতন একটু হাসি দেয় ওকে দেখে, প্রত্যুত্তরে ললনা ভুরু কুঁচকে রিশুর দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ঠিক সেই সময়ে রিশুর পাশের বাড়ির একজন ওকে দেখে চিনতে পেরে বলে, “আরে ডাক্তারবাবু যে, কি মাছ কিনলেন ইলিশ না পমফ্রেট?”
রিশু একটু হেসে উত্তর দেয়, “কাটা রুই, ইলিশের দিকে ত হাত দেওয়া যাচ্ছে না।”
হেসে ফেলে সেই ভদ্রলোক, “আপনি মশাই এমএসএর ডাক্তার তাও বলবেন যে ইলিশে হাত দেওয়া যাচ্ছে না? তাহলে ত মশাই আমাদের কুচো চিংরি খেয়ে থাকতে হয়।”
হেসে ফেলে রিশু, “আরে না না, আসলে আমি ঠিক মাছ রান্না করতে জানি না, মা আসলে তবেই মাছ খাওয়া হয়।”
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই রিশু বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই একটু ভিজলেও ক্ষতি নেই। কিছুদুর যেতেই পেছনে বেশ কয়েক জন লোকের মিলিত আওয়াজ পায়, সেদিকে তাকিয়ে একটা জটলা দেখে। ওর বুঝতে দেরি হয় না, যে এই বর্ষার রাস্তায় কারুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। ডাক্তার মানুষ তাই স্বভাব বশত এগিয়ে যায় জটলার দিকে। সেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার এক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাইক এই বর্ষার মধ্যে ঠিক সময়ে ব্রেক লাগাতে না পারায় পেছন থেকে ধাক্কা মেরে দিয়েছে যার ফলে মেয়েটা রাস্তায় পরে যায়। বাইকের লোকটাকে সবাই মিলে ধরে খুব বকাঝকা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে রিশু, মেয়েটার ভেজা কামিজের পেছনে রাস্তার নোংরা লেগে গেছে, পরনের চাপা লেগিন্সটাও বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। হাঁটুর জায়গায় লেগিন্সের বেশ কিছুটা ছিঁড়ে গেছে, দেখেই বুঝতে পারে হাঁটুতে চোট লেগেছে, কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে তবে বেশি নয়। ডাক্তারি চোখে জরিপ করে নেয় মেয়েটাকে।
রিশুর সেই চেনাজানা লোকটা ওই জটলার মধ্যেই ছিল, ওকে দেখে বলল, “আরে ডক্টর বাবু ত।”
সেই শুনে বাকিরা একটু তফাতে সরে গেল। ডাক্তারির অভ্যেসবশত রিশু মেয়েটার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় কোথায় লেগেছে?” মেয়েটা কপাল আর কুনুই দেখিয়ে দিতে, রিশু ওর কপাল আর কুনুই দেখে বলে, “তেমন বিশেষ কিছু হয়নি একটু ফারস্ট এড করলেই ঠিক হয়ে যাবে।” মেয়েটার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “পাশেই আমার বাড়ি, যদি যেতে চান তাহলে আমি ফারস্ট এড করিয়ে দিতে পারি।”
চেনাজানা লোকটা রিশুর পরিচয় দিতেই বাকিরাও সমস্বরে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এত বেশ ভালো কথা।”
মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল রিশু, “আমার বাড়ি যেতে কি আপত্তি আছে?”
ব্যাথা হওয়া সত্তেও কোন রকমে একটু হেসে উত্তর দেয় মেয়েটা, “না না তা নেই।” হাটার জন্য পা বাড়াতেই বুঝতে পারে হাঁটুতেও বেশ লেগেছে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বলে, “হাঁটুতেও ব্যাথা, ঠিক ভাবে হাঁটতে পারছি না।”
পাশ দিয়ে একটা অটো যাচ্ছিল, সেটাকে থামিয়ে দিয়ে রিশু আর মেয়েটা সেই অটোতে উঠে পরে। অভ্যেস বশত রিশু জিজ্ঞেস করে, “আর কোথায় কোথায় লেগেছে ঠিক করে বলুন।”
মেয়েটা একটু হেসে বলে, “ধুপ করে ওইভাবে পরে গেছি তাই পেছনেও লেগেছে।” তারপর ডান হাত বাড়িয়ে দেয় রিশুর দিকে, “আমি চন্দ্রিকা, এই কাছেই আমার বাড়ি।”
রিশুও চন্দ্রিকার সাথে হাত মিলিয়ে নিজের পরিচয় দেয়, “অম্বরীশ, এমএসএ আছি।”
সেই শুরু চন্দ্রিকা আর রিশুর পরিচয়ের সুত্রপাত।
রাত প্রায় সাড়ে নটা। বিকেলের দিকে একবার মায়ের সাথে কথা হয়েছিল, মা বলছিল কোন এক বান্ধবীর মেয়ের বিয়ে তাই সেই বাড়িতে যাবে। এতদিন দিল্লীতে থেকে দিল্লীর ঠান্ডা অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে। কাজের লোক রাতের খাওয়া বানিয়েই গিয়েছিল, খাওয়া সেরে বসে বসে টিভি দেখছিল। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে, কাল ভোরবেলা ট্রমা সেন্টারে ডিউটি। শীতকাল এলেই গাড়ির এক্সিডেন্ট খুব বেড়ে যায়, রোজ দিন অন্তত দশ বারোটা এক্সিডেন্টের কেস দেখতে দেখতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে। এমন সময়ে ফোন বেজে উঠতেই চমকে যায় রিশু।
ফোনের ওপাশে দিপের আর্ত চিৎকার শুনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়, “দাদাভাই আমার হাত ভেঙ্গে গেছে তুমি তাড়াতাড়ি এস।”
ভাই বোনকে ভীষণ ভালোবাসে রিশু, ওর দুটো চোখের মনি দুই ভাই বোন। রিশু যখন ডাক্তারি পড়তে দিল্লী যায় তখন দিপের জন্ম হয়, পরাশুনা আর দুরত্তের ফলে দিপকে সেইভাবে বড় হতে দেখতে পারেনি বলে ওর খুব দুঃখ। তাই বাড়িতে এলেই দিপকে নিয়ে পরে থাকত রিশু। ওর ইচ্ছে ছিল দুইজনকে দিল্লীতে নিজের কাছে নিয়ে আসার, কিন্তু ওর নিজের খুব ইচ্ছে মায়ের কাছে কোলকাতা ফিরে যাওয়ার তাই আর ওদের নিয়ে আসেনি। বেশ কয়েক বছর আগে, যখন রিশু সবে মাত্র এমএস পড়ছে, তখন একবার দিপ সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গেছিল। ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে তখুনি বাড়ি গিয়েছিল এবং যতদিন না দিপের পা ঠিক হয় ততদিন দিপের পাশে ছিল।
রিশু ধরমর করে উঠে বসে বলে, “কি রে কি করে হয়েছে?”
অন্যদিকে দিপ কপট হেসে, মুখ বেঁকিয়ে কাঁদার ভঙ্গি করে বলে, “আমি বাথরুমে পিছলে পরে গেছি দাদাভাই। ডান হাতের কুনুই খুব ব্যাথা দাদাভাই, দাদাভাই হাত সোজা করতে পারছি না দাদাভাই। তুমি এস তাড়াতাড়ি...”
দিপের এহেন কপট কান্নার ভঙ্গিমা দেখে সবাই মুখ চেপে হেসে ফেলে। রিশু বলে, “মাম্মাকে ফোন দে।”
দিপ কপট ব্যাথায় চেঁচিয়ে ওঠে, “দাদাভাই... প্লিজ এস।”
রিশু, “আচ্ছা তুই মাম্মাকে দে।”
দিপ নাছোড়বান্দা, “তুমি না এলে আমি কিন্তু হসপিটাল যাবো না। লোকে কি বলবে, আমার দাদাভাই এতবড় অরথপেডিক সারজেন আর নিজের ভাইয়ের বেলায় লবডঙ্কা।”
রিশু কি করবে ভেবে পায় না তাও বলে, “আচ্ছা বাবা, আমি আসছি, তুই মাম্মাকে ফোন দে।”
আম্বালিকা দিপের হাত থেকে ফোন নিতেই অন্যদিক থেকে রিশু বলে, “কি দেখ, কোথায় থাক তোমরা? হটাত করে কি ভাবে বাথরুমে পরে গেল?”
ছেলের রাগ দেখে হেসে ফেলে আম্বালিকা তাও রিশুকে শান্ত করে বলে, “আচ্ছা বাবা, ঘাট হয়েছে। আমি যত বলছি যে হসপিটাল নিয়ে যাবো, তোর ভাই কিছুতেই শুনছে না।”
রিশু মাকে বলে, “তুমি ওকে নিয়ে এখুনি হসপিটাল যাও, এসএসকেএম এ নীলেশ আছে আমি ফোন করে দিচ্ছি, আমি কাল সকালের ফ্লাইটে পৌঁছে যাবো।”
দিপ মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে বলে, “তুমি এখুনি না এলে আমি কোথাও যাবো না। আমার হাত বেঁকে যাক ভেঙ্গে যাক তোমার তাতে কি।”
কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকে রিশু, একটু ভেবে বলে, “আচ্ছা আমি আসছি তবে তুই হসপিটাল যা আমি নীলেশকে একটা ফোন করে দিচ্ছি ও পৌঁছে যাবে এমারজেন্সিতে।”
মায়ের ফোন রেখে নীলেশকে ফোনে জানিয়ে দেয় ভাইয়ের কথা। ল্যাপটপ খুলে বসে পরে, ভাই নাছোড়বান্দা ওকে ছাড়া কিছুতেই হসপিটাল যাবে না। ফ্লাইট চেক করে দেখে রাত বারোটায় কোলকাতার একটা ফ্লাইট আছে, কোন মতে ল্যাপটপের ব্যাগ আর একটা ছোট ব্যাগে কিছু জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পরে। জামা কাপড় নেওয়ার দরকার পরে না, কারন কোলকাতার বাড়িতে ওর সব কিছু আছে। ট্যাক্সিতে বসে আবার ফোন করে দিপকে, দিপের কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে বেশ চিন্তায় পরে যায়। কি হল, গিয়েই একটা এক্সরে করাতে হবে, রিপোরট দেখেই বুঝতে পারবে কতটা কি হয়েছে। এইচওডি কে ফোন করে দিয়েছিল যে কয়েকদিনের জন্য ছুটি চাই, ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছে, সেই সাথে ওর বন্ধু ইন্দ্রজিতকে ফোন করে দেয়। এমবিবিএস এর সময় থেকেই ইন্দ্রজিতের সাথে ওর বন্ধুত্ত, বেশ কয়েক বার ইন্দ্রজিত আর ওর স্ত্রী শালিনী কোলকাতায় রিশুদের বাড়িতে গেছে।
সিকুরিটি চেকের পরে প্লেনের দিকে যেতে যেতে মাকে ফোন করে রিশু, “কি হল কোথায় আছো, হসপিটাল নিয়ে গেলে?”
আম্বালিকা ছেলেকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কি ফ্লাইটে বসে গেছিস?”
রিশু, “হ্যাঁ। আমি এবারে ভাইকে নিয়ে আসব আমার কাছে।”
দিপ আর দিয়া, হাতের মুঠো হাওয়ার মধ্যে উঁচিয়ে লাফিয়ে ওঠে, “মিশন একমপ্লিসড মাম্মা, কাজ হাসিল।” মাকে জড়িয়ে ধরে একটু নেচে নেয় দুই ভাই বোন, এবারে ওদের দাদাভাইয়ের বিয়ে হবে প্রিয় ঝিনুক দিদির সাথে।
ছেলের এহেন মনের অবস্থা দেখে আম্বালিকা হেসে ফেলে, “আচ্ছা বাবা নিয়ে যাস, তোর ভাই তোর কাছে থাকবে না ত কি আমার কাছে থাকবে নাকি? বহাল তবিয়েতে আছে তোর ভাই, কিছুই হয়নি তোর ভাইয়ের।” বুক ভরে শ্বাস নিয়ে একটু থেমে বলে, “কিন্তু বাবা ভাইকে যে নিয়ে যাবি তুই ত সারাদিন বাড়িতে থাকিস না, কে দেখবে তোর ভাইকে?”
ভাই ভালো আছে শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠে রিশু, “এত রাতে এইসবের মানে কি? ভাইয়ের কিছু হয়নি মানে?” এতক্ষন ওর মনের মধ্যে অনেক কিছু চলছিল।
আম্বালিকা ছেলেকে শান্ত হতে অনুরোধ করে বলে, “কাল বলছিলাম না যে আমার বান্ধবী পীয়ালির বড় মেয়ে সঙ্ঘমিত্রার বিয়ে।” রিশু ছোট উত্তর দেয়, “হুম”। আম্বালিকা বলে, “তোর জন্যেও একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজেছি, ভাবছি এক সাথেই এক মন্ডপে দুই জনের বিয়ে দিয়ে দেব।”
প্লেনের সিটে বসতে গিয়েও থেমে যায় রিশু, “কি বলছ?”
আম্বালিকা বুঝতে পারে এইবারে একটা ঝড় শুরু হবে, তাও ছেলেকে বলে, “তুই আয় সব বলছি। দিপের কান্না না শুনলে তুই আসতিস না তাই বদমাশটা ওই ভাবে তোকে ডেকে এনেছে।”
শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলে রিশু, “আমি দিপের এবারে সত্যি হাত ভেঙ্গে দেব।”
প্লেন দিল্লীর মাটি ছাড়তেই এক বিমান সেবিকা এসে ওদের জলের বোতল দিয়ে যায়। সেই সুন্দরী বিমান সেবিকার বুকের নেম প্লেট দেখে থমকে যায় ডক্টর অম্বরীশ সান্যাল, “চন্দনা”। একবার সেই বিমান সেবিকার মুখের দিকে তাকিয়ে আপন মনেই হেসে ফেলে। পাঁচ বছর আগের এক ভীষণ বর্ষার বিকেলে দেখা হয়েছিল এক সুন্দরী ললনার সাথে, নাম তার চন্দনা নয়, সেই ললনার নাম ছিল চন্দ্রিকা পশুপতি। মাছের বাজারে দেখা, সি আর পার্কের মাছের বাজারে অনেকেই আসে মাছ কিনতে। সেদিন বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা তবে আকাশ দেখে মনে হয়নি যে হটাত করেই বৃষ্টি নামবে। কাজের মেয়েটা শুধু নিরামিশ রান্না করে যায়, গতবার মা এসে ওকে হাতে ধরে মাছ ভাজা বানাতে শিখিয়ে গেছে। এমনিতে মা যখন আসে, তখনি এক গাদা মাছ কিনে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়। কাটা রুই ছাড়া আর কি বানাবে সেই কিনে মাছের বাজার থেকে বাইরে আসতেই ঝমঝমিয়ে তুমুল বৃষ্টি নামে। বাজার থেকে ওর বাড়িটা বেশি দূরে নয়, ভেবেছিল এক দৌড়ে বাড়ি পৌঁছে যাবে। পরের দিন রবিবার ছিল, হসপিটাল যাওয়ার ছিল না, তখন ওর ওপিডিতে ডিউটি ছিল। বৃষ্টির জন্য একটা দোকানের শেডে বেশ কয়েক জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সেই ভিড়ের মধ্যে একটু তফাতে দাঁড়িয়ে এক সুন্দরী গোলগাল গড়নের মেয়ের দিকে ওর নজর যায়, পরনে সালোয়ার কামিজ, পিঠ ছাড়িয়ে লম্বা বেনুনি, গায়ের রঙ একটু চাপা হলেও চেহারার গড়নে একটা মাধুর্য আছে। বৃষ্টির ছাঁটে কামিজ একটু ভিজে গেছে, তাও নিজেকে বাঁচানোর জন্য অন্য সব লোকের সাথে ধাক্কা ধাক্কি করে সেই সেডের নিচে দাঁড়াতে যেন সেই ললনার মনে দ্বিধা জাগে। রিশু আড় চোখে বার কয়েক ওর দিকে দেখে, তৃতীয় বার দেখতেই দুইজনার চার চোখ এক হয়ে যায়। রিশু অসহায়ের মতন একটু হাসি দেয় ওকে দেখে, প্রত্যুত্তরে ললনা ভুরু কুঁচকে রিশুর দিকে তাকিয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।
ঠিক সেই সময়ে রিশুর পাশের বাড়ির একজন ওকে দেখে চিনতে পেরে বলে, “আরে ডাক্তারবাবু যে, কি মাছ কিনলেন ইলিশ না পমফ্রেট?”
রিশু একটু হেসে উত্তর দেয়, “কাটা রুই, ইলিশের দিকে ত হাত দেওয়া যাচ্ছে না।”
হেসে ফেলে সেই ভদ্রলোক, “আপনি মশাই এমএসএর ডাক্তার তাও বলবেন যে ইলিশে হাত দেওয়া যাচ্ছে না? তাহলে ত মশাই আমাদের কুচো চিংরি খেয়ে থাকতে হয়।”
হেসে ফেলে রিশু, “আরে না না, আসলে আমি ঠিক মাছ রান্না করতে জানি না, মা আসলে তবেই মাছ খাওয়া হয়।”
বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই রিশু বাড়ির দিকে পা বাড়ায়, এখানে দাঁড়িয়ে লাভ নেই একটু ভিজলেও ক্ষতি নেই। কিছুদুর যেতেই পেছনে বেশ কয়েক জন লোকের মিলিত আওয়াজ পায়, সেদিকে তাকিয়ে একটা জটলা দেখে। ওর বুঝতে দেরি হয় না, যে এই বর্ষার রাস্তায় কারুর এক্সিডেন্ট হয়েছে। ডাক্তার মানুষ তাই স্বভাব বশত এগিয়ে যায় জটলার দিকে। সেই দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার এক্সিডেন্ট হয়েছে, রাস্তা পার হতে গিয়ে একটা বাইক এই বর্ষার মধ্যে ঠিক সময়ে ব্রেক লাগাতে না পারায় পেছন থেকে ধাক্কা মেরে দিয়েছে যার ফলে মেয়েটা রাস্তায় পরে যায়। বাইকের লোকটাকে সবাই মিলে ধরে খুব বকাঝকা। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখে রিশু, মেয়েটার ভেজা কামিজের পেছনে রাস্তার নোংরা লেগে গেছে, পরনের চাপা লেগিন্সটাও বৃষ্টিতে ভিজে গেছে। হাঁটুর জায়গায় লেগিন্সের বেশ কিছুটা ছিঁড়ে গেছে, দেখেই বুঝতে পারে হাঁটুতে চোট লেগেছে, কপাল থেকে রক্ত বের হচ্ছে তবে বেশি নয়। ডাক্তারি চোখে জরিপ করে নেয় মেয়েটাকে।
রিশুর সেই চেনাজানা লোকটা ওই জটলার মধ্যেই ছিল, ওকে দেখে বলল, “আরে ডক্টর বাবু ত।”
সেই শুনে বাকিরা একটু তফাতে সরে গেল। ডাক্তারির অভ্যেসবশত রিশু মেয়েটার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় কোথায় লেগেছে?” মেয়েটা কপাল আর কুনুই দেখিয়ে দিতে, রিশু ওর কপাল আর কুনুই দেখে বলে, “তেমন বিশেষ কিছু হয়নি একটু ফারস্ট এড করলেই ঠিক হয়ে যাবে।” মেয়েটার দিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “পাশেই আমার বাড়ি, যদি যেতে চান তাহলে আমি ফারস্ট এড করিয়ে দিতে পারি।”
চেনাজানা লোকটা রিশুর পরিচয় দিতেই বাকিরাও সমস্বরে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, এত বেশ ভালো কথা।”
মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল রিশু, “আমার বাড়ি যেতে কি আপত্তি আছে?”
ব্যাথা হওয়া সত্তেও কোন রকমে একটু হেসে উত্তর দেয় মেয়েটা, “না না তা নেই।” হাটার জন্য পা বাড়াতেই বুঝতে পারে হাঁটুতেও বেশ লেগেছে। ব্যাথায় ককিয়ে উঠে বলে, “হাঁটুতেও ব্যাথা, ঠিক ভাবে হাঁটতে পারছি না।”
পাশ দিয়ে একটা অটো যাচ্ছিল, সেটাকে থামিয়ে দিয়ে রিশু আর মেয়েটা সেই অটোতে উঠে পরে। অভ্যেস বশত রিশু জিজ্ঞেস করে, “আর কোথায় কোথায় লেগেছে ঠিক করে বলুন।”
মেয়েটা একটু হেসে বলে, “ধুপ করে ওইভাবে পরে গেছি তাই পেছনেও লেগেছে।” তারপর ডান হাত বাড়িয়ে দেয় রিশুর দিকে, “আমি চন্দ্রিকা, এই কাছেই আমার বাড়ি।”
রিশুও চন্দ্রিকার সাথে হাত মিলিয়ে নিজের পরিচয় দেয়, “অম্বরীশ, এমএসএ আছি।”
সেই শুরু চন্দ্রিকা আর রিশুর পরিচয়ের সুত্রপাত।