16-10-2020, 11:04 PM
পর্ব ১৪
১৪ (ক)
দেখতে দেখতে পরশু দিন চলে আসে। রাজীব এর সঙ্গে আগেই সব সেড়ে রেখেছিল শান্তা। তুলিকেও বুঝিয়ে দিয়েছে - একটা কাজে খানিকটা দূরে যাচ্ছে মা। তুলি একটু প্রশ্ন করছিলো বটে। মা তো সাধারণত ওকে একলা রেখে দূরে কোথাও যায় না। তবে কি এমন কাজ? মেয়েকে বলেছে বাবার কিছু কাজ করতে খানিকটা দূরে যেতে হবে তাকে। পুরো দিনটাই লেগে যেতে পারে। তুলিকে সঙ্গ দেবার জন্য নীলা থাকবে ওর সঙ্গে। নীলার কথা শুনে তুলি আর প্রশ্ন করে নি। শান্তা যখন বলেছে কলেজ থেকে ওকে নীলাই বাড়িতে নিয়ে যাবে, তখনো নাচতে নাচতে শেষ তুলি।
তুলিকে কলেজে রেখে সোজা রাজীবদের বাড়িতেই চলে এসেছে শান্তা। রত্না ভাবীকে বাসার চাবি বুঝিয়ে দিচ্ছিল যখন, তখনই রাজীব আর নাজিম ভাই এসে উপস্থিত। ওরা এক সঙ্গেই বের হবে। রত্না ভাবী শান্তাকে খানিকটা আশ্বস্ত করে; “তুমি তুলির জন্য একদম চিন্তা কর না শান্তা। নীলা ওকে সোজা এখানে নিয়ে আসবে। আমার এখানেই খাবে দাবে তুলি। তারপর বিকেলের মধ্যে তুমি ফিরে এসে ওকে নিয়ে যেয়ো একেবারে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে ভাবী,” শান্তার অস্বস্তি কাটে না বটে, তবে রাজীব ওদিকে জলদী করতে বলায় আর দাড়ায় না শান্তা। বেড়িয়ে আসে ওদের সঙ্গে।
একটা গাড়ি যোগার করেছে নাজিম ভাই কোথা থেকে। সাদা রঙের একটা সেলুন, নব্বুই সালের টয়োটা কেরিনা। ড্রাইভার এর সিটে নাজিম ভাইই চেপে বসে। পেছনের সিটে রাজীব এর সঙ্গে উঠে শান্তা। কিছুক্ষনের মধ্যেই গাড়িটা বেড়িয়ে আসে গলির ভেতর থেকে। সিটে হেলান দিতে দিতে শান্তা ফিরে তাকায় রাজীব এর দিকে। ওর দিকেই তাকিয়ে আছে রাজীব। ঠোঁটে মুচকি হাসি ওর। চোখাচোখি হতেই নিজের হাতটা বাড়িয়ে শান্তার হাত চেপে ধরে রাজীব। লজ্জা পেয়ে নাজিম ভাই এর দিকে তাকায় শান্তা। গাড়ি চালাতে বেস্ত নাজিম ভাই। এদিকে তাকাবার সময় নেই তার। তারপরও লজ্জাটা কাটে না শান্তার।
“ভয় নেই শান্তা,” রাজীব শান্তার কোমল হাতে চাপ দিয়ে বলে; “মৃণাল বাবু খুব ভালো মানুষ। রত্না ভাবীকে তিনিই সাহায্য করেছিলেন। আমাদেরও করবেন। তার সঙ্গে আমার ফোনে আলাপ হয়েছে ভালো মত, বুঝলে?”
“তারপরও আমার যাওয়াটা - মানে… এখনো তো...”
“আহা ভাবছ কেন?” রাজীব একটু কাছে ঘেঁষে আসে। হাতটা বাড়িয়ে শান্তার ঘাড়ের উপর নিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে পাশ থেকে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে উঠে শান্তা।
“আহা কি করছ!” আঙ্গুল তুলে শান্তা নাজিম ভাই এর দিকে ইশারা করে। তখনি রেয়ার ভিউ মিররে নাজিম ভাই এদিকে তাকিয়েছে। ওর ইঙ্গিত দেখে নিজেই হ হ করে হেসে উঠে।
“আহা লজ্জা করতে হবে না তোমাদের, যা মন চায় কর পেছনে। ট্রাফিক পুলিশের চোখে না পড়লেই হল। হা হা হা...।”
রাজীব রসিকতায় যোগ দিলো না। শান্ত, দৃঢ় গলায় বলল; “ভেবো না সোনা, মুখে মুখে সামনা সামনি আলাপ করলে তুমি নিজেকে তৈরি করতে পাড়বে। মৃণাল বাবু তোমাকে একদম আইনি কায়দা শিখিয়ে দেবে… যেন ফয়সালের পক্ষের উকিল মোটেই কুল কিনারা করতে না পারে। আগে ভাগে এসব ব্যাপারে কাজ না করলে, পরে তুলির গার্জিয়ান কে হবে - এসব নিয়ে ঝামেলায় পড়বে। তুমি নিশ্চয়ই তুলিকে হারাতে চাও না!”
“কখনো না,” মাথা নাড়ে শান্তা। কেপে উঠে ওর ঠোঁট জোড়া।
“কাজেই তুমি দুশ্চিন্তা একদম কর না, আমরা যা করছি ভালোর জন্যই করছি আমাদের।” রাজীব হাসলে খানিকটা সাহস পায় ও। তাছাড়া দুদিন ব্যাপারটা নিয়ে বেশ ভেবেছে শান্তা ইতিমধ্যেই। ওর মনে আছে সুচিত্রা ভট্টাচার্যের কাচের দেয়াল বইটাতে পড়েছিল ডিভোর্স এর ব্যাপার নিয়ে সে। ওখানে নায়িকার ডিভোর্স এর পর মেয়ের কাস্টডি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো। মেয়ে বাবার সঙ্গে থাকবে নাকি মায়ের সঙ্গে - এ নিয়ে রীতিমত একটা যুদ্ধের চিত্র উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে।
“কতক্ষন লাগবে আমাদের?” জানতে চায় শান্তা এক সময়।
“বেশীক্ষণ লাগবে না,” রাজীব ওকে বলে। “যত দ্রুত যেতে পারবো তত জলদী ফিরতে পারবো আমরা। কি বল!”
“হ্যাঁ...” মাথা দোলায় শান্তা। ধিরে ধিরে শরীরটাকে ঢিল করে দেয়। রাজীব এর বাহুডোরের উষ্ণতা উপভোগ করার চেষ্টা করে।
হাইওয়েতে গাড়িটা উঠে আসতেই গতি বেড়ে যায় গাড়ির। নাজিম ভাই পাকা ড্রাইভার, তাতে সন্দেহ নেই। খানিকটা হাসাহাসি হয় ও নিয়ে ওদের মাঝে। নাজিম ভাই কি করে গাড়ি চালান শিখল, সে নিয়ে খুব চটায় রাজীব তাকে। পরিবেশটা ধিরে ধিরে সহজ হয়ে আসে শান্তার কাছে। রাজীব এর সঙ্গে গা ঘেঁষে বসতে আর অস্বস্তি লাগে না তার। বরং নিজের হাতটা আলগছে ফেলে রাখে রাজীব এর কোল এর উপর। কখনো বা আলতো করে মাথা রাখে রাজীব এর কাঁধে। কয়েকবার অবশ্য রেয়ার ভিউ মিররে নাজিম ভাই এর সঙ্গে চোখাচোখি হয় তার। কিন্তু আগের মত আর লজ্জা করে না শান্তার। বরং ওর কাছে যেন মনে হয় - প্রেমিক নয়, স্বামীর কাঁধেই মাথা রাখছে ও। আর নাজিম ভাই এর তো জানাই আছে ওদের সম্পর্কটা কতদুর এগিয়েছে! খামাকা আর লজ্জা করে লাভ কি!
গাজীপুরের কাছে একটা সরু পথ ধরে এগিয়ে যায় গাড়ি। দুধারে দোকানপাট এক সময় পাতলা হয়ে আসে। লোকালয় কমে আসে। গাছপালার সংখ্যা বেড়ে যায়। আরও কিছুদুর এগিয়ে ডান দিকে একটা শাখা রাস্তাতে নেমে আসে গাড়ি। দুধারে বনের মতন গাছপালা প্রায়। বাক খেয়ে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে সামনে। ধুলো ছুটিয়ে ছুটে যায় সাদা রঙের গাড়িটা। বাক খেতেই শান্তা গাছপালার মাঝে দোতালা বাড়িটাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে।
“চলে এসেছি আমরা,” ঘোষণা করে যেন নাজিম ভাই। নড়েচড়ে বসে রাজীব আর শান্তা পেছনে। খানিকটা ঝুকে তাকায় শান্তা। সামনে একটা লোহার ফটক। ভেতরে ছোট্ট একটা বাগান এর মত। বাড়িটা অপেক্ষাকৃত নতুনই বলা চলে। লাল ইটের গাঁথুনি দেয়া দেয়াল। দেখতে ভারী সুন্দর জায়গাটা। বাগানের মত জায়গাটায় ফুলের গাছ চোখে পড়ছে শান্তার। ফটক এর ভেতরে আরও একটা গাড়িও চোখে পড়ছে তার। নাজিম ভাই গেট এর সামনেই গাড়িটা থামায়। তারপর ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়। ঘুরে বসে ফিরে তাকায় শান্তার দিকে; “চলে এলাম, চল...”
“আসো,” রাজীব নেমে যায় ওপাশ দিয়ে। শান্তাও তার পাশের দরজাটা খুলে। এতক্ষন জার্নি করে এসে মাটিতে পা রাখতে কেমন দুলে উঠে শান্তা। এগিয়ে এসে পেছন থেকে ওর হাত চেপে ধরে রাজীব। খানিকটা স্বস্তি পায় ও। পায়ের নিচে ইট বিছানো রাস্তা। রাজীব এর সঙ্গে এগিয়ে যায় ফটক এর কাছে। আগেই গেট এর কাছে পৌঁছে গেছে নাজিম ভাই। ভেতরে হাত ঢুকিয়ে বেল এর মত সুইচে চাপ দিলো। ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই - তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই বাড়ির দরজা খুলে গেলো। বেড়িয়ে এলো প্যান্ট শার্ট পড়া - ভুঁড়ি বাগানো এক মাজ বয়সী পুরুষ। ঠোঁটের উপর প্রকাণ্ড একটা গোঁফ তার, সেই গোঁফ এর তলায় ঠোঁটে হাসি রয়েছে নাকি বুঝা মুশকিল। মাথায় ইয়া বড় একটা টাক। এগিয়ে আসতে আসতেই গলা চড়িয়ে লোকটি ওদের আমন্ত্রণ জানালো; “আসেন দাদারা, আসেন - আপনাদেরই অপেক্ষায় ছিলাম...”
কাছে এসে লোকটি পকেট থেকে একটা চাবির গোছা বার করলো। তারপর তালা খুলে ওদের ভেতরে আমন্ত্রন জানালো। নাজিম ভাই এর পেছন পেছনে ভেতরে পা রাখল শান্তা। লোকটি ওর দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাকিয়ে মৃদুভাবে স্বাগতম জানালো। তারপর রাজীব ঢুকতেই গেটে আবার তালা মেরে দিলো লোকটি। “এদিকে কোন বিশ্বাস নেই ভাই, সারাদিন রাত তালা মেরে রাখি গেটে… একে তো এডভোকেট আমি - শত্রুর তো কমতি নেই। হা হা হা… চলেন, ভেতরে যান,”
“এই হলেন আমাদের মৃণাল বাবু,” রাজীব পরিচয় করিয়ে দেয় শান্তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে। “এই বাড়িটা করেছেন বেশী দিন হয় নি। এখানেই একটা অফিস খুলে ফেলেছেন। ক্লাইন্ট দের সাথে এখানেই মিটিং করেন আর কি। কি মৃণাল বাবু?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক,” মাথা দোলায় মৃণাল বাবু পেছন থেকে। “নাজিম সাহেবের কেসটা তো আমিই ঠুকলাম। কি বলেন নাজিম সাহেব? রত্নাকে নিয়ে সুখী না এখন?”
“তা আর বলতে!” নাজিম ভাই চওড়া হাসি দেয়। কথা বলতে বলতে ওরা দরজার কাছে চলে এসেছে। দুই ধাপ সিড়ি এখানে। তারপর বিশাল কাঠের দরজা। দরজার ঠিক বাহিরেই এক জোড়া জুতো চোখে পড়লো শান্তার। রাজীব ওকে ইশারা করতে ভেতরে ঢুকল সে। দরজার ওপাশেই একটা বসার ঘর। প্রথমেই শান্তার চোখ পড়লো সোফাতে গা এলিয়ে বসে থাকা লোকটির দিকে। টিভি দেখছিল লোকটি আধশয়া হয়ে। শান্তা ঢুকতেই ওর দিকে জ্বলজ্বলে চোখে চাইলো। মৃণাল বাবুর বয়সীই মনে হল তাকে। তবে অন্য কাওকে আশা করে নি শান্তা। একটু ভড়কেই গেলো। দাড়িয়ে পড়লো রীতিমত। কথা বলতে বলতে আসছিল বলে ওর গায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো রাজীব।
“আস্তে সোনা লাগলো!”
“নাহ নাহ...” শান্তা নিজেকে সামলে নেয়। ততক্ষনে মৃণাল বাবুও ঢুকে গেছে ভেতরে। রাজীব এর চোখও পড়েছে লোকটির উপর।
“এই আমার বন্ধু দানেশ,” মৃণাল বাবু পরিচয় করিয়ে দেন। “একটা কেসের ব্যাপারে এসেছে আর কি… আপনারা এদিক আসুন… আমার অফিসে...”
মৃণাল বাবু ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলো। স্যান্ডেল, জুতো খুলে ডান দিকে একটা করিডোর ধরে এগোল তারা সারি বেঁধে। শেষ মাথায় একটা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ইশারা করলো মৃণাল বাবু। শান্তাই প্রথমে ভেতরে পা রাখল। পায়ের নিচে মোলায়েম কার্পেট এখানে। এক পাশে একটা ডেস্ক। দেয়াল ঘেঁষে ফাইল কেবিনেট - ওতে উপচে পড়া ফাইল পত্র। এপাশে দুটো চেয়ার, একটা লম্বা সোফা আর একটা কম্পিউটার টেবিলও আছে।
“বসুন, ফ্যান ছেড়ে দিচ্ছি - আপনারা একটু হাওয়া খান। দূর থেকে এসেছেন...” মৃণাল বাবু হাতে হাত ঘষতে ঘষতে ফ্যান ছেড়ে দিলেন। তারপর উইন্ডো এয়ারকুলারটাও ছেড়ে দিলেন। খানিকটা গমগম শব্দ করেই ওটা চলতে লাগলো। “আপনারা বিশ্রাম নিন… আমি আসছি,”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, আমাদের কোন তাড়া নেই,” নাজিম ভাই চেয়ার টেনে বসে পরে। রাজীবও শান্তাকে নিয়ে সোফাতে বসলো। দরজাটা টেনে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো মৃণাল বাবু।
রিয়ান খান