13-10-2020, 07:27 PM
ধর্মতলাটা লোকে লোকারণ্য। এই ভীড়ের মধ্যে সিরিজাকে নিয়ে হাঁটতেও রজতের ইচ্ছে হচ্ছিল না। তার থেকে নিরিবিলিতে কোথাও গিয়ে বসলে কত ভালো হতো। রেষ্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে সিরিজাকে নিয়ে কিছুটা পায়ে হেঁটে রজত দুম করে আবার একটা ট্যাক্সি ধরে বসলো।
- "একি আবার কোথায় যাবে? ট্যাক্সি ধরলে যে?"
-- "ওঠো না বলছি।"
সিরিজাকে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে তুলে রজত ওর পাশে উঠে বসল। একটু বিরক্ত হয়েই সিরিজা বললো, "তোমাকে বললাম, আমি ঘুরবো, আর তুমি কিনা আমাকে ট্যাক্সিতে ওঠালে?"
রজত বললো, "কেন এবার আমরা ট্যাক্সিতে করে ঘুরব।"
- "দূর। ট্যাক্সি করে ঘোরার মধ্যে কোন আনন্দ আছে নাকি?"
-- "তোমাকে এবার এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, তোমার ওখানে গেলেই দারুন লাগবে, আনন্দও পাবে।"
- "কোথায়?"
-- "চলোই না বলছি"
রজত কিছু বললো না সিরিজাকে। একটু পরে ড্রাইভারটাও জিজ্ঞাসা করলো, "কোথায় যাবো স্যার?"
রজত ওকেও কিছু না বলে শুধু বললো, "সোজা চলুন, আমি একটু পরে বলছি।"
বেশ অবাক হলো সিরিজা। রজত ড্রাইভারকেও কিছু বলছে না। অথচ ওকে ট্যাক্সি করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
ধর্মতলা পেরিয়ে চৌরঙ্গী। তারপরে পার্কস্ট্রীট। ডানদিকে ময়দান। একটু দূরে সামনের দিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। রজত জানালার কাঁচ দিয়ে সিরিজাকে দেখালো, "ঐ দেখ ভিক্টোরিয়া।"
- "এ মা, তুমি নামবে না?"
-- "আজ নয় সিরিজা, আর একদিন।"
- "তাহলে তুমি এখন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?"
রজত এখনও জায়গাটার কথা বলছে না। সিরিজা অবাক হচ্ছে, সেই সাথে ড্রাইভারও। একটা সিগারেট ধরিয়ে এবার সিরিজার দিকে হেসে বললো, "কেন, আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?"
- "বিশ্বাস হবে না কেন? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করছি তোমায়। আমায় বলতে কোনো অসুবিধে?"
আরো খানিকটা এগিয়ে এসে ড্রাইভার বললো, "স্যার এবার অন্তত বলুন, কোথায় যাবো? ডানদিকে না বাঁদিকে?"
রজত বললো, "সোজা নিন, একেবারে হাজরার মুখ থেকে মনোহরপুকুর ধরবেন।"
মনোহরপুকুর? সিরিজা রজতকে প্রশ্ন করলো, "সেখানে কে আছে?"
রজত বললো, "কেন রেশমি?"
- "রেশমি? তুমি যে বললে ওর বাড়ী তুমি চেনো না।"
-- "বাড়ী আমি সত্যিই চিনি না। তবে মনোহরপুকুরে ও থাকতো সেটা জানতাম। ওখানে তোমাকে নিয়ে পৌঁছে দিবাকরকে একটা ফোন করবো। বলবো সিরিজাকে নিয়ে খুঁজতে এসেছি তোমার রেশমীকে? কোন বাড়ীটায় থাকতো সেটা এখন বলো।"
রজত যে তড়িঘড়ি সিরিজার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করে দেবে, সিরিজা কল্পনাও করতে পারেনি। অবাক হয়ে যাচ্ছিলো রজতের হঠাৎই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া দেখে। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রজতকে বলে বসলো, "তুমি সত্যি রেশমীকে খুঁজতে বেরিয়েছো, আমি ভাবতেই পারিনি।"
রজত বললো, "কেন তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?"
- "সত্যি?"
-- "হ্যাঁ সত্যিই তো। রেশমীকে খুঁজতেই তো যাচ্ছি।"
একেবারে মোহিত হয়ে সিরিজা কিছুক্ষণ রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখে কোনো কথা নেই। রজত বললো, "কি, এবারে খুশী তো?"
- "খুশী।"
-- "তাহলে একটা চুমু খাই।"
সিরিজা বললো, "কি?"
-- "বলছি তাহলে একটা চুমু খাই।"
- "তুমি কি বলছো টা কি? এই গাড়ীর মধ্যে?"
-- "হ্যাঁ গাড়ীর মধ্যে। অসুবিধাটা কি?"
- "যাঃ। দুষ্টু কোথাকার!"
-- "বাঃ। যেই চুমু খেতে চাইলাম অমনি দুষ্টু হয়ে গেলাম। ঘরে খেতে পারি, আর গাড়ীতে খেলেই যত দোষ। ট্যাক্সিতে তো অনেকেই চুমু খায়,আমিও খাই না একটা।"
ট্যাক্সি ড্রাইভারটা এবার রজতের কথা শুনে মুচকী মুচকী হাসছিল। সিরিজা রজতকে বাধা দিয়ে আসতে আসতে বললো, "এই না এখন না, লোকটা কি ভাববে।"
-- "ভাবুক।"
রজত সিরিজার ঠোঁটে যেই চুমুটা খেতে যাচ্ছিলো অমনি সিরিজা এবার বললো, "দাঁড়াও। আগে রেশমী, তারপরে চুমু।"
বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হতাশ হয়ে গেল রজত, সিরিজাকে বললো, "আশ্চর্য, রেশমীর খোঁজার সাথে চুমু খাওয়ার শর্তের কি আছে? রেশমী তো দিবাকরের জন্য। রজতের জন্য যে, তাকে চুমু খেতে পারবো না কেন? এমন শর্তের কোনো মানে হয়?"
সিরিজা মুচকী মুচকী হাসছিল জানালার দিকে মুখ করে, রজত যেন টাইট খেয়ে গেছে সিরিজার কাছে। বললো, "সিরিজা তুমি এমন শর্ত আরোপ করে বসলে, আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।"
সিরিজা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো রজতের দিকে। যেন বুঝতে পারেনি রজতের কথাটা। বললো, "কেন?"
-- "আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, যে বাড়ীটায় ও থাকতো, সেখানে ও এখন থাকে না। দিবাকরকে এখন ফোন করলে দিবাকরও সেই কথাই বলবে, তবুও বাড়ীটা খোঁজার জন্য যাচ্ছি, শুধু তোমার জন্য। যদি ওর কোন হদিশ পাওয়া যায়। জানি ওকে পাব না, তবুও যাচ্ছি, তোমার মনটা রাখবো বলে। আর তুমি কিনা বললে আগে রেশমী, তারপরে চুমু। তাহলে আমার কি হবে?"
কথাটা বলে এবার রজতও জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সিরিজা বুঝলো রজত বেশ সিরিয়াস হয়ে গেছে। ও রজতের মুখ ঘোরানো অবধি অপেক্ষা করতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে নিজেই রজতকে খুশী করার জন্য বললো, "এই শোনো।"
রজত মুখ ঘোরালো।
সিরিজা বললো, "চুমুটা খাবে বলছিলে। খাও।"
হঠাৎ এমন মত পরিবর্তন। রজত তবু বললো, "চুমু খাওয়ার জন্য এত কষ্ট, আগে কখনও পাইনি তোমার কাছ থেকে।"
মনে মনে বললো, "দেখো দিবাকর, তোমার রেশমীর জন্য আমার কি দশা হয়েছে!"
গাড়ীতে সিরিজার দিকে জানালার কাঁচটা পুরোটা খোলা, রজত কাঁচটা একটু ওপরে তুলে দিয়েই মুখটা বাড়ালো সিরিজার ঠোঁটের দিকে। গাড়ীর মধ্যে চুমু খাওয়ার সাধ পূর্ণ হতে চলেছে, ওদিকে ট্রাফিক সিগনালে আটকে গেছে গাড়ী। এদিকে সিরিজার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে রজত তখন মাতোয়ারা। পাশাপাশি একটা লাল মারুতী গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়েছে সিগন্যালে। জানালার কাঁচ দিয়ে মুখ বার করে একটা বাচ্চা ছেলে পাশে দাঁড়ানো রজতের ট্যাক্সিটাকে দেখছে। রজত অপেক্ষা করছিল, গাড়ীটা ছেড়ে দিলেই ঝপ করে চুমুটা খেয়ে নেবে সিরিজার ঠৌঁটে। বাচ্চাটা তখন চোখ বড় বড় করে ওদের দুজনকে দেখছিল। ছেলেটার গায়ের রঙ ধবধবে সাদা, ফুটফুটে বাচ্চা।
সিরিজা রজতকে বললো, "দেখ কি সুন্দর ঐ বাচ্চাটা। আমাদের দুজনকে দেখছে।"
বলে ও নিজেও তাকিয়ে দেখতে লাগলো বাচ্চাটাকে। ট্যাক্সির মধ্যে থেকে বাচ্চাটার সাথে অঙ্গভঙ্গী করতে লাগলো সিরিজা। দূর থেকে বাচ্চাটাকে চুমু ছুঁড়ে ওর সাথে কথাও বলতে লাগলো ও।
আর এদিকে বিরক্ত হতে লাগলো রজত। এতক্ষণ রেশমীর জন্য ওর সিরিজাকে চুমু খাওয়া হচ্ছিল না, এবার আবার একটা বাচ্চা এসে চুমু খাওয়াটাকে আরো বিলম্ব করে দিচ্ছে। গাড়ীটা এবার ছাড়তেই রজত যেন স্বস্তি পেল, বাচ্চাটার দিকে ও নিজেও হাত নেড়ে টা টা করে দিল। তারপর সিরিজার শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটের একদম কাছে ঠোঁটটা নিয়ে এসে বললো, "এবার?"
সিরিজা চোখ বুঁজে বললো, "তাড়াতাড়ি খাও।"
রজত যেই সিরিজার ঠোঁটে ঠোঁটটা ছোঁয়াতে গেল, ড্রাইভারটা সঙ্গে সঙ্গে বললো, "দাদা মনোহরপুকুর এসে গেছে। এবার কোথায় যাবেন?"
এতো মহা জ্বালায় পড়া গেছে দেখছি। যখনই চুমু খেতে যাবো, তখনই বিপত্তি। সবাই এমন চুমু খাওয়ার সাথে শত্রুতা করছে কেন? রজতের আর চুমু খাওয়া এ যাত্রায় হলো না। ও ভীষন আপসেট হলো। সিরিজা মজা পেয়ে এমন হাসি দিল, যেটা রজত অনেকদিন মনে রাখবে।
ড্রাইভারকে গাড়ীটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করাতে বললো রজত। তআরপর বললো, "দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি একজনকে ফোন করে নিই। বাড়ীটা আসলে ঠিক কোথায় এই লোকই বলতে পারবে।"
দিবাকরকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করলো রজত।
-- "হ্যালো কে দিবাকর?"
- "বলছি।"
-- "আমি রজত বলছি। এখন আমি ঠিক মনোহরপুকুরে ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। সিরিজাও আছে আমার সাথে।"
- "তোমরা ঘুরতে বেরিয়েছো?"
-- "না তোমার রেশমীকে খুঁজতে বেরিয়েছি।"
- "রেশমীকে? কি বলছো টা কি?"
-- "ঠিকই বলছি। বাড়ীটা এক্সাক্টলি কোথায় বলতে পারবে?"
- "কিন্তু রজত সে বাড়ীতে তো ও এখন থাকে না। আমি অনেকদিন আগে একবার গিয়েছিলাম, পাইনি।"
রজতকে যেন সিরিজার মন রক্ষা করতে হবে। ও সেভাবেই দিবাকরকে বললো, "সে তো আমিও জানি। তবুও সিরিজাকে নিয়ে একবার অন্তত যেতে চাই। ও খুব করে বলছে রেশমীর কথা। চোখের দেখা না পেলেও একবার যদি কোন হদিশ পাই।"
দিবাকর রজতের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। ভেবে পাচ্ছিল না রজত হঠাৎ এত উতলা হয়ে পড়েছে কেন রেশমীকে পুনরায় পাওয়ার জন্য। বুঝলো এসবই সিরিজার জন্য হচ্ছে। রজতের ফ্ল্যাটে সিরিজার সাথে ওর ঐ ঘটনা ঘটার পর থেকে সিরিজা বুঝতে পেরেছে দিবাকরের মনের ব্যাথাটা। এরকম ভাবে একা একা থাকতে আর কার ভালো লাগে? সত্যি যদি রেশমীর হদিশ একবার পাওয়া যায়?
সেটা ভেবে দিবাকর রজতকে বললো, "তুমি মনোহরপুকুরের ঠিক কোন জায়গাটায় এখন রয়েছ বলতে পারবে? আমি তাহলে বলে দিচ্ছি বাড়ীটা ঠিক কোথায়?"
রজত বললো, "আমি এখন চলে এসেছি ঠিক দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। ট্যাক্সিটা পার্কের একটু আগে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। এবার বলো কি করবো?"
- "তুমি তো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছ। ওটা ল্যান্সডাউন রোড। ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তোমাকে ব্যাক করে আসতে হবে। বাঁদিকে ধরে একটু এলেই বাঁহাতে মনোহরপুকুর রোড পড়বে। ট্যাক্সিটা ঘুরিয়েই দেখবে, একটা সরু গলি ঢুকেছে, ডানহাতে ঠিক দুনম্বর বাড়ীটায় একতলায় ও থাকতো।"
রজত বললো, "ইস তুমি থাকলে কত ভালো হতো। আমি কি এতো মনে রাখতে পারবো?"
সিরিজা এতক্ষণ পাশে বসে ওদের কথা শুনছিল। বললো, "মনে না রাখার কি আছে? চল না আমিও ঠিক খুঁজে নেব।"
অবাক হয়ে গেল রজত। গ্রামের মেয়ে সিরিজা একদিনেই ট্যাক্সিতে বেরিয়ে শহর চিনে নিল। ওকে বললো, "বেশ, তাহলে তো আমার চিন্তা নেই।"
ড্রাইভারকে ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে নিতে বললো রজত। দিবাকরকে বললো, "ঠিক আছে রাখো। আমি পরে তোমাকে আবার ফোন করছি।"
যেতে যেতে রজতের একটা চিন্তা মাথায় কিন্তু ভালোমতন এল। সিরিজাকে নিয়ে ও যাচ্ছে রেশমীর বাড়ীতে। যদিও রেশমী ওখানে এখন থাকে না। শুনেছে ও নাকি ভাড়া থাকতো ওখানে। দোতলায় নিশ্চয়ই বাড়ীওয়ালা থাকেন। তিনিই যদি কোনো হদিশ দিতে পারেন। যদি বলে দিতে পারেন রেশমীর নতুন ঠিকানাটা। কিন্তু সত্যিই রেশমী যদি ঐ বাড়ীতে থাকতো, তাহলে সিরিজাকে রজতের সাথে দেখে রেশমী কি ভাবতো? রজত কি জবাব দিহি করতো রেশমীর কাছে? কি পরিচয় দিত সিরিজার? বলো তো এককালে তুমি ছিলে আমার পুরোনো সঙ্গিনী। আর এখন আমার নতুন সঙ্গিনী হচ্ছে সিরিজা। আজ তাকে সাথে করে নিয়ে এসেছি, তোমায় দেখাবো বলে?
কি ভাবতো রেশমী? ভালোবাসার ছল করেও সাধ মেটেনি? আবার নতুন করে এসেছ কাটা ঘায়ে নুনের ছেটা দিতে? সত্যি কথাটা বলতে চেষ্টা করেও রজত হয়তো থমকে যেত রেশমীর কাছে। দিবাকরের জন্য হঠাৎ তার এত বন্ধু প্রীতি? রেশমী হয়তো বিশ্বাসই করতো না। রজত মনে মনে ভাবছিল সিরিজার চাপে পড়ে সত্যিই কেমন যেন দূঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছে ও।
ট্যক্সিওয়ালা বললো, "বাঁ দিকে মনোহরপুকুর রোড। এবার গাড়ীটা ঘোরাবো?"
- "হ্যাঁ ঘোরান ঘোরান। বাঁদিকেই একটা গলি পড়বে।"
ঠিক গলির মুখটাতে ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ীটা দাঁড় করাতে বললো রজত। সিরিজাকে বললো, "তুমি বসো, আমি দেখে আসছি।"
সিরিজা হেসে বললো, "কেন, আমি যাবো না?"
-- "না না, তোমায় যেতে হবে না। আমিই দেখে আসছি। আমি শুধু দেখব বাড়ীওয়ালা আছে কিনা? রেশমীর খোঁজ যদি কেউ দিতে পারে তাহলে উনিই দিতে পারবেন। তুমি ট্যাক্সিতেই বসে থাকো, আমি এক্ষুনি আসছি।"
রজত গাড়ী থেকে নেমে গেল। সিরিজা ট্যাক্সিতে একা বসে। দুটো এলাকার ছেলে সামনের চায়ের দোকানটায় বসে সিরিজাকে বিস্ময় সহকারে দেখছে। সিরিজা একবার ওদেরকে দেখেও খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলো না। ও আপন মনে ট্যাক্সিতে বসে রইলো। রজত তখন গলির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। গলিতে ঢুকেই ডানদিকের দু নম্বর বাড়ীটা। সাদা রঙের দোতলা বাড়ীটা। এখানে থাকতো রজতের একসময়ের সঙ্গিনী রেশমী।
একজন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। রজতকে জিজ্ঞেস করলো, "কাকে খুঁজছেন?"
- "না এখানেই একজন থাকতো"
-- "কে?"
- "আপনি চিনবেন কি তাকে?"
-- "কেন চিনবো না? আমি এ পাড়াতে বাস করছি তিরিশ বছর হলো। আপনি স্বচ্ছন্দে আমাকে বলতে পারেন।"
- "একটি মেয়ে।"
-- "মেয়ে? কি নাম?"
- "রেশমী।"
-- "রেশমী? ও সে তো অনেকদিন আগেই চলে গেছে এখান থেকে।"
- "কোথায় গেছে সেটা বলতে পারবেন?"
-- "সে তো আমি বলতে পারবো না দাদা। আপনি বরং দোতলায় বাড়ীওয়ালা থাকেন। ওনাকে জিজ্ঞাসা করুন।"
রজত মনে মনে বললো, "সে তো আমিও জানি। দিবাকর একটু আগে এই কথাটাই ওকে ফোনে বলেছে। এখন বাড়ীওয়ালাই একমাত্র সহায়। তাছাড়া কোনো উপায় নেই।"
রজত লক্ষ করলো সিরিজা ট্যাক্সি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখছে। রেশমীর হদিশ পাওয়া গেল কিনা সেটাই হয়তো অনুমান করার চেষ্টা করছে। রজতকে কে ও যে কতটা কর্তব্য পরায়ণ করে ফেলেছে সেটা রজত ভালো করেই জানে।
বাড়ীর সামনে গিয়ে দরজার সামনে কলিংবেল টিপলো রজত। এই বিকেলবেলা ভদ্রলোক এখন বাড়ী আছে কিনা কে জানে? বাড়ীওয়ালা সামনে এলে রজত কি বলবে সেটাও মনে মনে ঠিক করে নিল। এখন শুধু রেশমীর খোঁজটা ওকে নিতে হবে।
একতলার ফ্ল্যাটটায় সামনে একটা বারান্দা। ঢোকার প্রবেশ পথ ওখান দিয়েই। দেখে মনে হচ্ছে একতলাটা খালি পড়ে আছে। রেশমীরা চলে যাবার পর হয়তো নতুন কোনো ভাড়াটে আসেনি এই ফ্ল্যাটে। রজত খেয়াল করলো দোতলাতেও একটা বারান্দা রয়েছে। কলিংবেলের শব্দ শুনে হয়তো ওখান দিয়ে কেউ মুখ বাড়াবে। ঠিক তাই হলো। আর একবার কলিংবেলের বাজানোর পরেই একজন বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে মুখ বাড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন কে? তবে তিনি কোনো ভদ্রলোক নন। একজন মহিলা। মনে হয় বাড়ীওয়ালার স্ত্রী।
-- "কাকে খুঁজছেন?"
- "আমার নাম রজত।"
-- "কোথা থেকে আসছেন?"
- "আমি কলকাতাতেই থাকি। রেশমীদের আত্মীয়। ওরা এখানে থাকতো না? এখন কোথায় আছে বলতে পারবেন? আমি ঠিকানাটা জানি না। তাই এসেছিলাম।"
ভদ্রমহিলা একটু ভূরু কূঁচকালেন। বললেন, "রেশমী? আচ্ছা দাঁড়ান। আমি নিচে আসছি।"
হঠাৎ যেন রেশমীর নাম শুনে ভদ্রমহিলা একটু বিরক্ত হলেন। রজত ভাবলো, কি হলো ব্যাপারটা? হঠাৎ রেশমীর নাম শুনে অস্বস্তি কেন? কিছু প্রবলেম হলো নাকি?
নিচে এসে মহিলা দরজা খুললেন। রজত তখন সামনে দাঁড়িয়ে। মহিলাটি বললেন, "কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি আত্মীয়। কলকাতায় থাকেন। অথচ ওরা কোথায় গেছে সেটা জানেন না? আমাকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছেন?"
একটু থতমত খেলো রজত। ইতস্তত করে বলতে চেষ্টা করলো, "না মানে......"
-- "রেশমী আমাকে ঠিকানা দিয়ে যেতে বারণ করে গেছে। বলেছে ওর যাকে যা দরকার। ওই জানিয়ে দেবে তাকে। বলেছে ওর খোঁজে কেউ এলে আমি যেন তাকে ঠিকানা না দিই। আমাকে বারণ করে গেছে রেশমী।"
- "বারণ করে গেছে?"
-- "হ্যাঁ কি করবো বলুন? আমি তো কাউকে চিনি না। উটকো কোনো লোক। কেউ এলেই তাকে বিশ্বাস করে ঠিকানা কি করে বলবো? ও যখন থাকতো, তখন একটা ছেলে তো খুব আসতো। কি যেন নাম ছেলেটার? হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, দিবাকর। রেশমী চলে যাবার পরও ও অনেকবার এখানে এসেছে। আমাকে অনেকবার ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছে। আমি দিই নি। কারন রেশমী আমাকে বারণ করে গেছে ওকেও ঠিকানা না বলার জন্য। সেই যে আপনাকে পাঠায় নি? আমি কি করে বিশ্বাস করবো?"
রজত মনে মনে বললো, এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল। মহিলাটি একবারে ঝানু মহিলা। সহজে পটানো যাবে না মনে হচ্ছে।
- "কিন্তু আপনি যা ভাবছেন, তাতো আমি নই।"
-- "আপনি কে?"
- "বললাম তো আমি রেশমীর আত্মীয়।"
-- "ঠিক আছে আত্মীয় যখন, আপনি আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, আমি রেশমীকে বলব, আপনাকে ফোন করে নিতে।"
- "আপনার কাছে রেশমীর নম্বর আছে?"
-- "আছে কেন?"
- "নম্বরটা দিন না? তাহলে আমি ফোন করে কথা বলে নেব।"
-- "তাহলে সেই একই ব্যাপার হলো, রেশমী যদি আমাকে পরে কিছু বলে, যে তুমি ফোন নম্বর কেন দিয়েছ? আমার কোনো আত্মীয় নেই। আমি কেন কথা শুনব? তার থেকে আপনিই ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, সেটাই বরং ভালো হবে।"
রজত বুঝতে পারছিল, ভদ্রমহিলা বেশ চালু মহিলা। খুব সহজে রেশমীর হদিশ বার করতে পারবে না ওনার থেকে। আমতা আমতা করে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো মহিলাটিকে। হঠাৎ দেখলো ট্যাক্সি থেকে সিরিজা এবার নেমে এগিয়ে আসছে ঐ বাড়ীটারই দিকে।
- "একি আবার কোথায় যাবে? ট্যাক্সি ধরলে যে?"
-- "ওঠো না বলছি।"
সিরিজাকে তাড়াতাড়ি ট্যাক্সিতে তুলে রজত ওর পাশে উঠে বসল। একটু বিরক্ত হয়েই সিরিজা বললো, "তোমাকে বললাম, আমি ঘুরবো, আর তুমি কিনা আমাকে ট্যাক্সিতে ওঠালে?"
রজত বললো, "কেন এবার আমরা ট্যাক্সিতে করে ঘুরব।"
- "দূর। ট্যাক্সি করে ঘোরার মধ্যে কোন আনন্দ আছে নাকি?"
-- "তোমাকে এবার এমন জায়গায় নিয়ে যাবো, তোমার ওখানে গেলেই দারুন লাগবে, আনন্দও পাবে।"
- "কোথায়?"
-- "চলোই না বলছি"
রজত কিছু বললো না সিরিজাকে। একটু পরে ড্রাইভারটাও জিজ্ঞাসা করলো, "কোথায় যাবো স্যার?"
রজত ওকেও কিছু না বলে শুধু বললো, "সোজা চলুন, আমি একটু পরে বলছি।"
বেশ অবাক হলো সিরিজা। রজত ড্রাইভারকেও কিছু বলছে না। অথচ ওকে ট্যাক্সি করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
ধর্মতলা পেরিয়ে চৌরঙ্গী। তারপরে পার্কস্ট্রীট। ডানদিকে ময়দান। একটু দূরে সামনের দিকে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল। রজত জানালার কাঁচ দিয়ে সিরিজাকে দেখালো, "ঐ দেখ ভিক্টোরিয়া।"
- "এ মা, তুমি নামবে না?"
-- "আজ নয় সিরিজা, আর একদিন।"
- "তাহলে তুমি এখন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?"
রজত এখনও জায়গাটার কথা বলছে না। সিরিজা অবাক হচ্ছে, সেই সাথে ড্রাইভারও। একটা সিগারেট ধরিয়ে এবার সিরিজার দিকে হেসে বললো, "কেন, আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না?"
- "বিশ্বাস হবে না কেন? আমি তো শুধু জিজ্ঞেস করছি তোমায়। আমায় বলতে কোনো অসুবিধে?"
আরো খানিকটা এগিয়ে এসে ড্রাইভার বললো, "স্যার এবার অন্তত বলুন, কোথায় যাবো? ডানদিকে না বাঁদিকে?"
রজত বললো, "সোজা নিন, একেবারে হাজরার মুখ থেকে মনোহরপুকুর ধরবেন।"
মনোহরপুকুর? সিরিজা রজতকে প্রশ্ন করলো, "সেখানে কে আছে?"
রজত বললো, "কেন রেশমি?"
- "রেশমি? তুমি যে বললে ওর বাড়ী তুমি চেনো না।"
-- "বাড়ী আমি সত্যিই চিনি না। তবে মনোহরপুকুরে ও থাকতো সেটা জানতাম। ওখানে তোমাকে নিয়ে পৌঁছে দিবাকরকে একটা ফোন করবো। বলবো সিরিজাকে নিয়ে খুঁজতে এসেছি তোমার রেশমীকে? কোন বাড়ীটায় থাকতো সেটা এখন বলো।"
রজত যে তড়িঘড়ি সিরিজার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করে দেবে, সিরিজা কল্পনাও করতে পারেনি। অবাক হয়ে যাচ্ছিলো রজতের হঠাৎই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া দেখে। একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে রজতকে বলে বসলো, "তুমি সত্যি রেশমীকে খুঁজতে বেরিয়েছো, আমি ভাবতেই পারিনি।"
রজত বললো, "কেন তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?"
- "সত্যি?"
-- "হ্যাঁ সত্যিই তো। রেশমীকে খুঁজতেই তো যাচ্ছি।"
একেবারে মোহিত হয়ে সিরিজা কিছুক্ষণ রজতের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মুখে কোনো কথা নেই। রজত বললো, "কি, এবারে খুশী তো?"
- "খুশী।"
-- "তাহলে একটা চুমু খাই।"
সিরিজা বললো, "কি?"
-- "বলছি তাহলে একটা চুমু খাই।"
- "তুমি কি বলছো টা কি? এই গাড়ীর মধ্যে?"
-- "হ্যাঁ গাড়ীর মধ্যে। অসুবিধাটা কি?"
- "যাঃ। দুষ্টু কোথাকার!"
-- "বাঃ। যেই চুমু খেতে চাইলাম অমনি দুষ্টু হয়ে গেলাম। ঘরে খেতে পারি, আর গাড়ীতে খেলেই যত দোষ। ট্যাক্সিতে তো অনেকেই চুমু খায়,আমিও খাই না একটা।"
ট্যাক্সি ড্রাইভারটা এবার রজতের কথা শুনে মুচকী মুচকী হাসছিল। সিরিজা রজতকে বাধা দিয়ে আসতে আসতে বললো, "এই না এখন না, লোকটা কি ভাববে।"
-- "ভাবুক।"
রজত সিরিজার ঠোঁটে যেই চুমুটা খেতে যাচ্ছিলো অমনি সিরিজা এবার বললো, "দাঁড়াও। আগে রেশমী, তারপরে চুমু।"
বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হতাশ হয়ে গেল রজত, সিরিজাকে বললো, "আশ্চর্য, রেশমীর খোঁজার সাথে চুমু খাওয়ার শর্তের কি আছে? রেশমী তো দিবাকরের জন্য। রজতের জন্য যে, তাকে চুমু খেতে পারবো না কেন? এমন শর্তের কোনো মানে হয়?"
সিরিজা মুচকী মুচকী হাসছিল জানালার দিকে মুখ করে, রজত যেন টাইট খেয়ে গেছে সিরিজার কাছে। বললো, "সিরিজা তুমি এমন শর্ত আরোপ করে বসলে, আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম।"
সিরিজা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো রজতের দিকে। যেন বুঝতে পারেনি রজতের কথাটা। বললো, "কেন?"
-- "আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, যে বাড়ীটায় ও থাকতো, সেখানে ও এখন থাকে না। দিবাকরকে এখন ফোন করলে দিবাকরও সেই কথাই বলবে, তবুও বাড়ীটা খোঁজার জন্য যাচ্ছি, শুধু তোমার জন্য। যদি ওর কোন হদিশ পাওয়া যায়। জানি ওকে পাব না, তবুও যাচ্ছি, তোমার মনটা রাখবো বলে। আর তুমি কিনা বললে আগে রেশমী, তারপরে চুমু। তাহলে আমার কি হবে?"
কথাটা বলে এবার রজতও জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। সিরিজা বুঝলো রজত বেশ সিরিয়াস হয়ে গেছে। ও রজতের মুখ ঘোরানো অবধি অপেক্ষা করতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে নিজেই রজতকে খুশী করার জন্য বললো, "এই শোনো।"
রজত মুখ ঘোরালো।
সিরিজা বললো, "চুমুটা খাবে বলছিলে। খাও।"
হঠাৎ এমন মত পরিবর্তন। রজত তবু বললো, "চুমু খাওয়ার জন্য এত কষ্ট, আগে কখনও পাইনি তোমার কাছ থেকে।"
মনে মনে বললো, "দেখো দিবাকর, তোমার রেশমীর জন্য আমার কি দশা হয়েছে!"
গাড়ীতে সিরিজার দিকে জানালার কাঁচটা পুরোটা খোলা, রজত কাঁচটা একটু ওপরে তুলে দিয়েই মুখটা বাড়ালো সিরিজার ঠোঁটের দিকে। গাড়ীর মধ্যে চুমু খাওয়ার সাধ পূর্ণ হতে চলেছে, ওদিকে ট্রাফিক সিগনালে আটকে গেছে গাড়ী। এদিকে সিরিজার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল পেয়ে রজত তখন মাতোয়ারা। পাশাপাশি একটা লাল মারুতী গাড়ী দাঁড়িয়ে পড়েছে সিগন্যালে। জানালার কাঁচ দিয়ে মুখ বার করে একটা বাচ্চা ছেলে পাশে দাঁড়ানো রজতের ট্যাক্সিটাকে দেখছে। রজত অপেক্ষা করছিল, গাড়ীটা ছেড়ে দিলেই ঝপ করে চুমুটা খেয়ে নেবে সিরিজার ঠৌঁটে। বাচ্চাটা তখন চোখ বড় বড় করে ওদের দুজনকে দেখছিল। ছেলেটার গায়ের রঙ ধবধবে সাদা, ফুটফুটে বাচ্চা।
সিরিজা রজতকে বললো, "দেখ কি সুন্দর ঐ বাচ্চাটা। আমাদের দুজনকে দেখছে।"
বলে ও নিজেও তাকিয়ে দেখতে লাগলো বাচ্চাটাকে। ট্যাক্সির মধ্যে থেকে বাচ্চাটার সাথে অঙ্গভঙ্গী করতে লাগলো সিরিজা। দূর থেকে বাচ্চাটাকে চুমু ছুঁড়ে ওর সাথে কথাও বলতে লাগলো ও।
আর এদিকে বিরক্ত হতে লাগলো রজত। এতক্ষণ রেশমীর জন্য ওর সিরিজাকে চুমু খাওয়া হচ্ছিল না, এবার আবার একটা বাচ্চা এসে চুমু খাওয়াটাকে আরো বিলম্ব করে দিচ্ছে। গাড়ীটা এবার ছাড়তেই রজত যেন স্বস্তি পেল, বাচ্চাটার দিকে ও নিজেও হাত নেড়ে টা টা করে দিল। তারপর সিরিজার শরীরটাকে জড়িয়ে ধরে ওর ঠোঁটের একদম কাছে ঠোঁটটা নিয়ে এসে বললো, "এবার?"
সিরিজা চোখ বুঁজে বললো, "তাড়াতাড়ি খাও।"
রজত যেই সিরিজার ঠোঁটে ঠোঁটটা ছোঁয়াতে গেল, ড্রাইভারটা সঙ্গে সঙ্গে বললো, "দাদা মনোহরপুকুর এসে গেছে। এবার কোথায় যাবেন?"
এতো মহা জ্বালায় পড়া গেছে দেখছি। যখনই চুমু খেতে যাবো, তখনই বিপত্তি। সবাই এমন চুমু খাওয়ার সাথে শত্রুতা করছে কেন? রজতের আর চুমু খাওয়া এ যাত্রায় হলো না। ও ভীষন আপসেট হলো। সিরিজা মজা পেয়ে এমন হাসি দিল, যেটা রজত অনেকদিন মনে রাখবে।
ড্রাইভারকে গাড়ীটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করাতে বললো রজত। তআরপর বললো, "দাঁড়ান দাঁড়ান, আমি একজনকে ফোন করে নিই। বাড়ীটা আসলে ঠিক কোথায় এই লোকই বলতে পারবে।"
দিবাকরকে মোবাইলে ধরার চেষ্টা করলো রজত।
-- "হ্যালো কে দিবাকর?"
- "বলছি।"
-- "আমি রজত বলছি। এখন আমি ঠিক মনোহরপুকুরে ট্যাক্সি নিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি। সিরিজাও আছে আমার সাথে।"
- "তোমরা ঘুরতে বেরিয়েছো?"
-- "না তোমার রেশমীকে খুঁজতে বেরিয়েছি।"
- "রেশমীকে? কি বলছো টা কি?"
-- "ঠিকই বলছি। বাড়ীটা এক্সাক্টলি কোথায় বলতে পারবে?"
- "কিন্তু রজত সে বাড়ীতে তো ও এখন থাকে না। আমি অনেকদিন আগে একবার গিয়েছিলাম, পাইনি।"
রজতকে যেন সিরিজার মন রক্ষা করতে হবে। ও সেভাবেই দিবাকরকে বললো, "সে তো আমিও জানি। তবুও সিরিজাকে নিয়ে একবার অন্তত যেতে চাই। ও খুব করে বলছে রেশমীর কথা। চোখের দেখা না পেলেও একবার যদি কোন হদিশ পাই।"
দিবাকর রজতের কথার উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। ভেবে পাচ্ছিল না রজত হঠাৎ এত উতলা হয়ে পড়েছে কেন রেশমীকে পুনরায় পাওয়ার জন্য। বুঝলো এসবই সিরিজার জন্য হচ্ছে। রজতের ফ্ল্যাটে সিরিজার সাথে ওর ঐ ঘটনা ঘটার পর থেকে সিরিজা বুঝতে পেরেছে দিবাকরের মনের ব্যাথাটা। এরকম ভাবে একা একা থাকতে আর কার ভালো লাগে? সত্যি যদি রেশমীর হদিশ একবার পাওয়া যায়?
সেটা ভেবে দিবাকর রজতকে বললো, "তুমি মনোহরপুকুরের ঠিক কোন জায়গাটায় এখন রয়েছ বলতে পারবে? আমি তাহলে বলে দিচ্ছি বাড়ীটা ঠিক কোথায়?"
রজত বললো, "আমি এখন চলে এসেছি ঠিক দেশপ্রিয় পার্কের কাছে। ট্যাক্সিটা পার্কের একটু আগে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। এবার বলো কি করবো?"
- "তুমি তো বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছ। ওটা ল্যান্সডাউন রোড। ট্যাক্সিটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে তোমাকে ব্যাক করে আসতে হবে। বাঁদিকে ধরে একটু এলেই বাঁহাতে মনোহরপুকুর রোড পড়বে। ট্যাক্সিটা ঘুরিয়েই দেখবে, একটা সরু গলি ঢুকেছে, ডানহাতে ঠিক দুনম্বর বাড়ীটায় একতলায় ও থাকতো।"
রজত বললো, "ইস তুমি থাকলে কত ভালো হতো। আমি কি এতো মনে রাখতে পারবো?"
সিরিজা এতক্ষণ পাশে বসে ওদের কথা শুনছিল। বললো, "মনে না রাখার কি আছে? চল না আমিও ঠিক খুঁজে নেব।"
অবাক হয়ে গেল রজত। গ্রামের মেয়ে সিরিজা একদিনেই ট্যাক্সিতে বেরিয়ে শহর চিনে নিল। ওকে বললো, "বেশ, তাহলে তো আমার চিন্তা নেই।"
ড্রাইভারকে ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে নিতে বললো রজত। দিবাকরকে বললো, "ঠিক আছে রাখো। আমি পরে তোমাকে আবার ফোন করছি।"
যেতে যেতে রজতের একটা চিন্তা মাথায় কিন্তু ভালোমতন এল। সিরিজাকে নিয়ে ও যাচ্ছে রেশমীর বাড়ীতে। যদিও রেশমী ওখানে এখন থাকে না। শুনেছে ও নাকি ভাড়া থাকতো ওখানে। দোতলায় নিশ্চয়ই বাড়ীওয়ালা থাকেন। তিনিই যদি কোনো হদিশ দিতে পারেন। যদি বলে দিতে পারেন রেশমীর নতুন ঠিকানাটা। কিন্তু সত্যিই রেশমী যদি ঐ বাড়ীতে থাকতো, তাহলে সিরিজাকে রজতের সাথে দেখে রেশমী কি ভাবতো? রজত কি জবাব দিহি করতো রেশমীর কাছে? কি পরিচয় দিত সিরিজার? বলো তো এককালে তুমি ছিলে আমার পুরোনো সঙ্গিনী। আর এখন আমার নতুন সঙ্গিনী হচ্ছে সিরিজা। আজ তাকে সাথে করে নিয়ে এসেছি, তোমায় দেখাবো বলে?
কি ভাবতো রেশমী? ভালোবাসার ছল করেও সাধ মেটেনি? আবার নতুন করে এসেছ কাটা ঘায়ে নুনের ছেটা দিতে? সত্যি কথাটা বলতে চেষ্টা করেও রজত হয়তো থমকে যেত রেশমীর কাছে। দিবাকরের জন্য হঠাৎ তার এত বন্ধু প্রীতি? রেশমী হয়তো বিশ্বাসই করতো না। রজত মনে মনে ভাবছিল সিরিজার চাপে পড়ে সত্যিই কেমন যেন দূঃসাহসিক কাজ করে ফেলেছে ও।
ট্যক্সিওয়ালা বললো, "বাঁ দিকে মনোহরপুকুর রোড। এবার গাড়ীটা ঘোরাবো?"
- "হ্যাঁ ঘোরান ঘোরান। বাঁদিকেই একটা গলি পড়বে।"
ঠিক গলির মুখটাতে ট্যাক্সিওয়ালাকে গাড়ীটা দাঁড় করাতে বললো রজত। সিরিজাকে বললো, "তুমি বসো, আমি দেখে আসছি।"
সিরিজা হেসে বললো, "কেন, আমি যাবো না?"
-- "না না, তোমায় যেতে হবে না। আমিই দেখে আসছি। আমি শুধু দেখব বাড়ীওয়ালা আছে কিনা? রেশমীর খোঁজ যদি কেউ দিতে পারে তাহলে উনিই দিতে পারবেন। তুমি ট্যাক্সিতেই বসে থাকো, আমি এক্ষুনি আসছি।"
রজত গাড়ী থেকে নেমে গেল। সিরিজা ট্যাক্সিতে একা বসে। দুটো এলাকার ছেলে সামনের চায়ের দোকানটায় বসে সিরিজাকে বিস্ময় সহকারে দেখছে। সিরিজা একবার ওদেরকে দেখেও খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলো না। ও আপন মনে ট্যাক্সিতে বসে রইলো। রজত তখন গলির ভেতরে ঢুকে পড়েছে। গলিতে ঢুকেই ডানদিকের দু নম্বর বাড়ীটা। সাদা রঙের দোতলা বাড়ীটা। এখানে থাকতো রজতের একসময়ের সঙ্গিনী রেশমী।
একজন পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। রজতকে জিজ্ঞেস করলো, "কাকে খুঁজছেন?"
- "না এখানেই একজন থাকতো"
-- "কে?"
- "আপনি চিনবেন কি তাকে?"
-- "কেন চিনবো না? আমি এ পাড়াতে বাস করছি তিরিশ বছর হলো। আপনি স্বচ্ছন্দে আমাকে বলতে পারেন।"
- "একটি মেয়ে।"
-- "মেয়ে? কি নাম?"
- "রেশমী।"
-- "রেশমী? ও সে তো অনেকদিন আগেই চলে গেছে এখান থেকে।"
- "কোথায় গেছে সেটা বলতে পারবেন?"
-- "সে তো আমি বলতে পারবো না দাদা। আপনি বরং দোতলায় বাড়ীওয়ালা থাকেন। ওনাকে জিজ্ঞাসা করুন।"
রজত মনে মনে বললো, "সে তো আমিও জানি। দিবাকর একটু আগে এই কথাটাই ওকে ফোনে বলেছে। এখন বাড়ীওয়ালাই একমাত্র সহায়। তাছাড়া কোনো উপায় নেই।"
রজত লক্ষ করলো সিরিজা ট্যাক্সি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে ওকে দেখছে। রেশমীর হদিশ পাওয়া গেল কিনা সেটাই হয়তো অনুমান করার চেষ্টা করছে। রজতকে কে ও যে কতটা কর্তব্য পরায়ণ করে ফেলেছে সেটা রজত ভালো করেই জানে।
বাড়ীর সামনে গিয়ে দরজার সামনে কলিংবেল টিপলো রজত। এই বিকেলবেলা ভদ্রলোক এখন বাড়ী আছে কিনা কে জানে? বাড়ীওয়ালা সামনে এলে রজত কি বলবে সেটাও মনে মনে ঠিক করে নিল। এখন শুধু রেশমীর খোঁজটা ওকে নিতে হবে।
একতলার ফ্ল্যাটটায় সামনে একটা বারান্দা। ঢোকার প্রবেশ পথ ওখান দিয়েই। দেখে মনে হচ্ছে একতলাটা খালি পড়ে আছে। রেশমীরা চলে যাবার পর হয়তো নতুন কোনো ভাড়াটে আসেনি এই ফ্ল্যাটে। রজত খেয়াল করলো দোতলাতেও একটা বারান্দা রয়েছে। কলিংবেলের শব্দ শুনে হয়তো ওখান দিয়ে কেউ মুখ বাড়াবে। ঠিক তাই হলো। আর একবার কলিংবেলের বাজানোর পরেই একজন বারান্দা দিয়ে নিচের দিকে মুখ বাড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন কে? তবে তিনি কোনো ভদ্রলোক নন। একজন মহিলা। মনে হয় বাড়ীওয়ালার স্ত্রী।
-- "কাকে খুঁজছেন?"
- "আমার নাম রজত।"
-- "কোথা থেকে আসছেন?"
- "আমি কলকাতাতেই থাকি। রেশমীদের আত্মীয়। ওরা এখানে থাকতো না? এখন কোথায় আছে বলতে পারবেন? আমি ঠিকানাটা জানি না। তাই এসেছিলাম।"
ভদ্রমহিলা একটু ভূরু কূঁচকালেন। বললেন, "রেশমী? আচ্ছা দাঁড়ান। আমি নিচে আসছি।"
হঠাৎ যেন রেশমীর নাম শুনে ভদ্রমহিলা একটু বিরক্ত হলেন। রজত ভাবলো, কি হলো ব্যাপারটা? হঠাৎ রেশমীর নাম শুনে অস্বস্তি কেন? কিছু প্রবলেম হলো নাকি?
নিচে এসে মহিলা দরজা খুললেন। রজত তখন সামনে দাঁড়িয়ে। মহিলাটি বললেন, "কি ব্যাপার বলুন তো? আপনি আত্মীয়। কলকাতায় থাকেন। অথচ ওরা কোথায় গেছে সেটা জানেন না? আমাকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করছেন?"
একটু থতমত খেলো রজত। ইতস্তত করে বলতে চেষ্টা করলো, "না মানে......"
-- "রেশমী আমাকে ঠিকানা দিয়ে যেতে বারণ করে গেছে। বলেছে ওর যাকে যা দরকার। ওই জানিয়ে দেবে তাকে। বলেছে ওর খোঁজে কেউ এলে আমি যেন তাকে ঠিকানা না দিই। আমাকে বারণ করে গেছে রেশমী।"
- "বারণ করে গেছে?"
-- "হ্যাঁ কি করবো বলুন? আমি তো কাউকে চিনি না। উটকো কোনো লোক। কেউ এলেই তাকে বিশ্বাস করে ঠিকানা কি করে বলবো? ও যখন থাকতো, তখন একটা ছেলে তো খুব আসতো। কি যেন নাম ছেলেটার? হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, দিবাকর। রেশমী চলে যাবার পরও ও অনেকবার এখানে এসেছে। আমাকে অনেকবার ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছে। আমি দিই নি। কারন রেশমী আমাকে বারণ করে গেছে ওকেও ঠিকানা না বলার জন্য। সেই যে আপনাকে পাঠায় নি? আমি কি করে বিশ্বাস করবো?"
রজত মনে মনে বললো, এ তো মহা ফ্যাসাদে পড়া গেল। মহিলাটি একবারে ঝানু মহিলা। সহজে পটানো যাবে না মনে হচ্ছে।
- "কিন্তু আপনি যা ভাবছেন, তাতো আমি নই।"
-- "আপনি কে?"
- "বললাম তো আমি রেশমীর আত্মীয়।"
-- "ঠিক আছে আত্মীয় যখন, আপনি আপনার ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, আমি রেশমীকে বলব, আপনাকে ফোন করে নিতে।"
- "আপনার কাছে রেশমীর নম্বর আছে?"
-- "আছে কেন?"
- "নম্বরটা দিন না? তাহলে আমি ফোন করে কথা বলে নেব।"
-- "তাহলে সেই একই ব্যাপার হলো, রেশমী যদি আমাকে পরে কিছু বলে, যে তুমি ফোন নম্বর কেন দিয়েছ? আমার কোনো আত্মীয় নেই। আমি কেন কথা শুনব? তার থেকে আপনিই ফোন নম্বরটা দিয়ে যান, সেটাই বরং ভালো হবে।"
রজত বুঝতে পারছিল, ভদ্রমহিলা বেশ চালু মহিলা। খুব সহজে রেশমীর হদিশ বার করতে পারবে না ওনার থেকে। আমতা আমতা করে কি যেন বলতে যাচ্ছিলো মহিলাটিকে। হঠাৎ দেখলো ট্যাক্সি থেকে সিরিজা এবার নেমে এগিয়ে আসছে ঐ বাড়ীটারই দিকে।