08-10-2020, 12:32 AM
পর্ব ২৯ (#০৫)
অনুপমার চিন্তার গতিতে বাধা প্রাপ্তি হয় পায়েলের হাতের ছোঁয়ায়, “কোথায় হারিয়ে গেলিরে? খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি রে। আমারো খুব দুঃখ লাগছে, কিন্তু কি করতে পারি বল। পুলিস কি কিছু করছে?”
অনুপমা ছলছল চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে, একে কি দেবায়নের বিষয়ে বলা ঠিক হবে? শ্রেয়া আর রূপকের ওপরে সন্দেহ করেছে ভেবেই মনের ভেতরে কুণ্ঠাবোধ জেগে ওঠে। মন পরে থাকে নির্জীব শায়িত দেবায়নের পাশে। চোখ মুছে বহু কষ্টে হাসি টেনে বলে, “না রে, হারিয়ে যায়নি আমি। তোর সাথে একটু গোপন কথা আছে। ভাই ছাড়া আর কাউকে বলসি না যেন।”
পায়েল অধীর চিত্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধরা গলায় বলে, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি।”
কথাটা কানে যেতেই দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পায়েলের, অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কোথায় কেমন আছে, আমাকে এখুনি নিয়ে চল আমি ওকে দেখতে চাই।”
নির্জীব দেবায়নের মুখ মনে পড়তেই কেঁদে ফেলে অনুপমা, “কোমায় চলে গেছে রে আমার পুচ্চু…..”
আঁতকে ওঠে পায়েল, “না…..” বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে।
ধীরে ধীরে এক এক করে সব ঘটনা ব্যাক্ত করে পায়েলের কাছে। পায়েল ওকে প্রবোধ দেয় যে একদিন দেবায়ন ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। এই প্রবোধ নিশ্চিত কিনা জানা নেই তাও বান্ধবীর মুখে সান্ত্বনা বাক্য শুনে অনুপমার মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হয়। শ্রেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, পায়েল জানায়, অনুপমার নির্দেশ মতন ওদের দেখাশোনার ভার শ্রেয়া করে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাড়িতে এসে পায়েলকে সঙ্গে নিয়েই অফিসে যায়। নিজেকে অনুপমার স্থানে বসাতে চেষ্টা করেনি অবশ্য কিন্তু বেশ ভালো ভাবেই অফিস আর পায়েল অঙ্কনকে সামলে রেখেছে।
রোজদিনের মতন একটু পরেই শ্রেয়া ওদের বাড়িতে আসে। অনুপমাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিরে তুই এলি আর আমাদের খবর পর্যন্ত দিলি না? কি হয়েছে? কেমন আছিস? দেবুকে খুঁজে পেলি?”
ঝড়ের মতন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অনুপমা উত্তরের খেই হারিয়ে ফেলে। শ্রেয়ার ওপরে অহেতুক সন্দেহ করেছিল ভাবতেই ওর চোখে জল চলে আসে। কোনরকমে নিজেকে সামলে শেষ পর্যন্ত দেবায়নের বিষয়ে বিস্তারে সব কথা জানায়। সব কিছু শোনার পরে শ্রেয়াও পায়েলের মতন অধৈর্য হয়ে ওঠে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার জন্য। অনুপমা জানায় এখন ওর কোলকাতায় কিছু কাজ বাকি আছে। ওরা জানতে চাইলে সত্য লুকিয়ে জানায় যে ধৃতিমানের বিষয়ে বিস্তারে খোঁজ নিতে চায়। এখুনি সবাই মিলে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে কিছুই করার নেই। পায়েল আর শ্রেয়াকে অফিসে চলে যেতে বলে।
পায়েল আর শ্রেয়া অফিসে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনুপমা ব্যাগ খুলে দেবায়নের বাড়ি থেকে আনা ফাইল খুলে বসে পড়ে। কন্সট্রাকশান কোম্পানির কাগজ খানা বারেবারে পড়ে দেখে। এই কাগজের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই কাগজের আসল অর্থ বের করতে পারলে দেবায়নের আসল উদ্দেশ্য অথবা খুনির আসল উদ্দেশ্য হয়ত জানা যাবে। দেবায়ন বিশেষ কিছুই জানায়নি নিবেদিতার সম্পর্কে। যদিও ওর বাবার সাথে নিবেদিতার অনেকদিনের পরিচয় কিন্তু কোনোদিন ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিল না নিবেদিতার। আর তার আসল কারন, মায়ের আর নিবেদিতার মনোমালিন্য। কি কারনে এই মনোমালিন্য, আর কি কারনে বাবার সাথে এত সুহৃদ সম্পর্ক। নিবেদিতার বিষয়ে বিস্তারে জানা দরকার। নিবেদিতার বিয়ে চোদ্দ বছর আগে একজন এন.আর.আইয়ের সাথে হয়েছিল, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। নিবেদিতার ছেলে, অঙ্কুশের জন্ম ডিভোর্সের এক দেড় বছর পরে হয়। অঙ্কুশের পিতার পরিচয় অনুপমার অজানা, হয়ত এই পৃথিবীর অজানা। কোন গুপ্ত প্রেমের ফল স্বরূপ অঙ্কুশের জন্ম। হয়ত দেবায়ন এই বিষয়ে জেনে গিয়েছিল আর নিবেদিতাকে ব্ল্যাকমেিল করেছে। তাই কি নিবেদিতা ওকে সরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু কোম্পানির কাগজ অন্য কথা বলছে। এই কাগজ অনুযায়ী, দুটি কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত করে একটা বড় কোম্পানির মালিক হতে চলেছে নিবেদিতা। কিন্তু কন্সট্রাকশান কোম্পানি মালিকানা নিবেদিতার নামে তাহলে দেবায়নের কি লাভ এইখানে?
ভাবতে ভাবতে হটাত মাথায় ঝিলিক খেলে যায় অনুপমার। অঙ্কুশ অবিকল ভাইয়ের ছোট বেলার মতন দেখতে, ঠিক সেই নাক সেই রকম কোঁকড়ানো চুল, গাল দুটো টোপাটোপা আর চেহারায় বুদ্ধিদীপ্তের ছটা। বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক। অঙ্ক মেলাতে অসুবিধে হয় না। অঙ্কুশের পিতার সম্বন্ধে জানা দরকার। এই উত্তর পেয়ে গেলে ওর কাছে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে।
মা নিবেদিতাকে দেখতে পারে না। মানুষ বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খবর বেশি রাখে। নিবেদিতার সম্বন্ধে মায়ের কাছ থেকে হয়ত অনেক কিছু জানা যেতে পারে ভেবেই অনুপমা কাগজ হাতে পারমিতার কাছে যায়।
পারমিতার ঘরে ঢুকে অনুপমা মাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
মেয়েকে ওইভাবে বিদ্ধস্ত রূপে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিতা প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ, বল কি হয়েছে?”
অনুপমা একটু খানি থেমে জিজ্ঞেস করে, “নিবেদিতার সম্বন্ধে কিছু জানার ছিল। তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনিবনা হয়না, তার কারন কি জানতে পারি?”
পারমিতা মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে জরিপ করে উত্তর দেয়, “হঠাৎ নিবেদিতার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিস কেন? নিবেদিতার ওপরে কি তোর সন্দেহ হচ্ছে নাকি?” একটু থেমে, ওকে বসতে বলে, “দেখ অনু, পায়েলের কাছ থেকে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমি সব শুনেছি। আমি জানিনা আততায়ী কে। কিন্তু আর যাই হোক নিবেদিতা এই কাজ করতে পারে না ও সেই রকমের মেয়ে নয়।”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না মা, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক কিন্তু তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনে না?”
পারমিতা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, নিবেদিতার সাথে কোনোদিন আমার সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। তোকে শুরু থেকে বলি তাহলে। শ্বশুর মশায় মানে তোর ঠাকুরদা বেঁচে থাকার সময় থেকেই নিবেদিতার বাবা, মিস্টার চৌধুরী আর তোর জেঠু, রাজেশ এই কোম্পানি চালাত। তারপরে এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি সম্পূর্ণ রূপে আমার হাতে চলে আসে। কি ভাবে আসে সেটা তোর অজানা নয়।”
কথাটা বলার সময়ে কুণ্ঠাবোধে পারমিতার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, “ততদিনে নিবেদিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরে নিবেদিতার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপরে নিবেদিতার ডিভোর্স হয়ে যায় আর নিবেদিতা কোলকাতা ফিরে এসে কোম্পানির ভার সামলায়। আমার মাথায় এই ব্যাবসার প্যাঁচ কলাকৌশল কোনোদিন ঢুকত না তাই আমি বিশেষ কোনোদিন অফিসে যেতাম না। আমার কাজ ছিল অন্য, ক্লায়েন্ট ধরার জন্য আমি কি করতাম সেটাও তোর অবিদিত নয়। তোর বাবা নিজের অফিস আর এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি নিয়েই পড়ে থাকত। তবে তোর বাবার চেয়ে নিবেদিতা নিজের ঘাড়ে পুরো কন্সট্রাকশান কোম্পানির তত্তাবধনের ভার তুলে নেয়। এত কিছু করার পরেও ওর অংশ খুব কম ছিল আর সেই নিয়ে অখুশি ছিল। মাস গেলে আমার একাউন্টে মোটা টাকা আর তার তুলনায় যে সব কাজ করে তার একাউন্টে আমার চেয়ে অনেক কম টাকা। আমি অফিসে গেলেই আমার থেকে দূরে থাকত, আমার দিকে এক ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাত। এই নিয়ে অবশ্য আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোন বচসা হয়নি কিন্তু নিবেদিতা আমাকে দেখতে পারত না। আমি অফিসের মালিক হয়েও কর্মচারীদের মধ্যে আমার বিশেষ কোন স্থান ছিল না। ওর এই নাক উঁচু ভাব, অফিসে সবাই ওকে সমীহ করে, সেই হিংসা, এইসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে নিবেদিতা খুব কর্মঠ মেয়ে, মার্জিত কিন্তু কঠোর, সুনিপুণ দক্ষতায় কোম্পানি দাঁড় করিয়েছে।”
মায়ের মুখে নিবেদিতার স্তুতি শুনতে পাবে সেটা অনুপমার পক্ষে আশাতীত ছিল। ভেবেছিল হয়ত মা, নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, কিন্তু নিবেদিতার চরিত্রে কোন খুঁত ওর মা ওকে জানাতে পারল না। সব শুনে অনুপমা একটু চিন্তায় পরে যায়, “হুম, বুঝলাম সব কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে যার উত্তর পাচ্ছি না। নিবেদিতার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, তাই না?”
পারমিতা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “ডিভোর্সের এক থেকে দেড় বছর পরে অঙ্কুশের জন্ম। অঙ্কুশের পিতা কে, সেই নিয়ে তোমার মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি?”
পারমিতার চেহারা হঠাৎ করে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে আসে। বার কতক ঢোঁক গিলে মেয়েকে প্রশ্ন করে, “হঠাৎ এই নিয়ে প্রশ্ন করলি কেন? কি জানিস তুই?”
মায়ের চেহারার এই ফ্যাকাসে রঙ অনুপমার তীক্ষ্ণ চাহনি এড়াতে পারে না। মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি জানো, অঙ্কুশের বাবা কে?”
পারমিতা কঠিন ভাবে অনুপমার দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে, “এই খবর তোর জেনে কি লাভ? অঙ্কুশের পিতার পরিচয়ের সাথে দেবায়নের এই দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক?”
পারমিতার চোখের এই কঠোর চাহনির পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে। এর উত্তর জানার জন্য ওকে শেষ পর্যন্ত কোম্পানির কাগজ বের করতে হয়। কোম্পানির কাগজ হাতে নিয়েই পারমিতা রুদ্ধশ্বাসে অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জোড়া ছলকে ওঠে পারমিতার, অস্ফুট কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, “এই কাগজ কোথা থেকে পেয়েছিস তুই?”
অনুপমা মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে প্রশ্ন করে, “আমি শুধু এর উত্তর জানতে চাই মা। আততায়ী যেই হোক কিন্তু এই কাগজ পড়ার পরে আমার মনে একটা সন্দেহ হয়েছে। কে আসল দোষী। এই দেবায়ন কি আসলে আমার ভালোবাসার পুচ্চু নয়?”
পারমিতা মুখে হাত চাপা দিয়ে অস্ফুট আঁতকে ওঠে, “না, হ্যান্ডসামের মতন ছেলে হয় না। তোর পুচ্চু তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে রে অনু।”
ওর দেবায়ন যে ওকে খুব ভালোবাসে সেটা জানে কিন্তু সেই কথা মায়ের মুখ থেকে শোনার পরে ওর চোখ জোড়া ভেসে যায়। পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে মনে শক্তি জুগিয়ে বলে, “হ্যান্ডসাম ওর বিশাল হাতের মাঝে সবাইকে আগলে রাখতে চায়। সবাইকে মানে, তোকে, আমাকে, তোর বাবাকে পায়েল অঙ্কন সব্বাইকে। কোন কিছু ভেঙ্গে যাক সেটা কিছুতেই হ্যান্ডসাম চায় না। এই সম্পর্কের সম্বন্ধে আর এই কাগজের ব্যাপারে কিছু নাই বা জানলি।”
মায়ের চোখের জল দেখে অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না, অঙ্কুশ কেন অবিকল ওর ভাইয়ের মতন দেখতে। মায়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে, “তাহলে তুমি জানতে আগে থেকে?”
সম্মতি জানিয়ে মৃদু মাথা দোলায় পারমিতা, “হ্যাঁ, আমি সব জানি তবে আগে জানতাম না। দেবায়ন কি ভাবে যেন এই সব কিছু জেনে গিয়েছিল আর সেই আমাকে বুঝিয়ে বলে। প্রথমে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু হ্যান্ডসামের কথা শুনে মনে হল, ভালো কি শুধু একটা মাত্র মানুষ কেই বাসা যায়? তোর বাবা আগে আমাকে সেই ভাবে ভালবাসত না, আর সেই কারনেই নিবেদিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আমি এতদিন তোর বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমি এতদিন এরতার বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছি। নিবেদিতা আর তোর বাবা একসাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে আর এই দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে কাটাতে সাথে তোর বাবার সাথে নিবেদিতার প্রেম হয়ে যায়। আর…..”
অনুপমা ছলছল চোখে কম্পিত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, “অঙ্কুশ তাহলে আমার ভাই?”
পারমিতা সম্মতি জানিয়ে মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, অঙ্কুশ তোর ভাই, তোর রক্ত।”
অনুপমার মাথার শিরা ঝনঝন করে ওঠে। পারমিতা মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তবে দেবায়ন কাউকে আঘাত করতে চায়নি তাই তোকে ধীরে ধীরে নিবেদিতার সাথে পরিচয় করায়। শুরুতেই যদি দেবায়ন তোকে সব কিছু বলে দিত তাহলে তুই কাউকেই ঠিক ভালো চোখে দেখতিস না তাই তোর সাথে নিবেদিতার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটাই চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তুই যেমন আমাকে ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল অন্তত নিবেদিতার সাথে তোর বান্ধবীর মতন সম্পর্ক গড়ে উঠুক। অঙ্কনকে যেমন ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল ঠিক সেই ভাবে অঙ্কুশের ওপরে তোর যেন সেই স্নেহ গড়ে ওঠে। তারপরে তোর হাত ধরে নিবেদিতার সাথে পায়েল আর অঙ্কনের সুহৃদ সম্পর্ক গড়ে উঠত। এই গ্রুপ কোম্পানি আমাদের পরিবারের মধ্যেই রয়েছে। নিবেদিতাকে কন্সট্রাকশান কোম্পানির সম্পূর্ণ ভার দেওয়া দেবায়নের মাথার উপজ। তোর বাবা আর দেবায়ন হোটেল নিয়ে থাকবে এই ঠিক হয়, আর তুই পায়েল আর অঙ্কন তোর আই.টি কোম্পানি নিয়ে থাকবি। এই ভাবেই দুই পরিবার এক করতে চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তোর বাবা সব শুনে সেদিন দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। সেই প্রথম সোমেশকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। ভালোবাসা বড় কঠিন বস্তু, তাই নয় কি অনু?”
সব কিছু শোনার পরে অনুপমা চোখ বন্ধ করে বসে পরে। ওর দুই চোখ বেয়ে অঝোর ঝারায় অশ্রুর বন্যা বয়ে চলে, এত ভালোবাসা রাখবে কোথায়? একটি মাত্র জীবন ওর কাছে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, অবুঝের মতন কিছু না জেনেই বাবাকে, নিবেদিতাকে, রূপককে সন্দেহ করেছিল। এরা সবাই ওর জন্য ভাবে, ওর জন্য চিন্তা করে, ওর দুঃখে দুঃখিত হয়, ওর হাসিতে হাসে।
পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “জানি দেবায়ন চলে যাওয়াতে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। জানি তোর জীবনে দেবায়নের জায়গা আমরা কেউই পূরণ করতে পারব না তবে আমরা সবাই তোর পাশে আছি রে অনু।”
অনুপমা ফুঁপিয়ে ওঠে, মায়ের সান্ত্বনা বাক্য শোনার পরে মনে হয় মাকে সত্যি বলা ভালো, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি। তবে…..”
পারমিতা ওই শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এই কথা কেন আমাদের জানাস নি?”
অনুপমা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “তখন ঠিক বুঝতে পারিনি কে আসল দোষী তাই।”
পারমিতা ওকে প্রশ্ন করে, “দেবায়ন কোথায়, কেমন আছে?”
অনুপমা ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “খুব খারাপ অবস্থায় আছে মা। জানি না কি হবে। ওর অনেক হাড় ভেঙ্গে গেছে। দেবায়ন কোমায় চলে গেছে, মা। আমি কি করব মা?” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনুপমা।
মেয়ের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “দেবায়নকে যখন খুঁজে পেয়েছিস তখন কোমায় থাকুক আর যেখানেই থাকুক ও তোর কাছে ফিরে আসবেই। তুই চিন্তা করিস না। দেবশ্রীদি এই বিষয়ে জানে?”
অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ জানে। মামনি খুব ভেঙ্গে পড়েছে।”
পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি কোথায়, দেবায়ন কোথায়?”
চোখের জল মুছে অনুপমা উত্তরে বলে, “দেবায়নকে আমি দিলিপ বাবুর কাছে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছি। মামনি দেবায়নের কাছে।” তারপরে মাকে সব কথা বিস্তারে জানায় অনুপমা।
সব কিছু শোনার পরে পারমিতা ব্যাস্ত হয়ে যায়, ওকে বলে, “আমি এখুনি তোর বাবাকে ফোন করছি। আমরা থাকতে এই সময়ে দেবশ্রীদি একা থাকতে পারে না। আমি এখুনি তোর বাবাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেতে চাই।”
পারমিতা সঙ্গে সঙ্গে, সোমেশ বাবুকে ফোন করে সব কিছু জানিয়ে দেয়। অনুপমার বাবা সব কিছু শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছে যান। বাবাকে সন্দেহ করেছিল বলে বাবার সামনে যেতে দ্বিধা বোধ করে অনুপমা। কিন্তু ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, এই কথা ওর বাবা জানতে পারবে না। পারমিতা ওকে সঙ্গে নিতে চায় কিন্তু অনুপমা জানায় ওর বদলে পায়েলকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যাক। অনুপমা একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। ওর সন্দেহের তালিকার শেষ ব্যাক্তি, ধৃতিমানের বিষয়ে কিছুই তল্লাসি করা হয়নি। হয়ত এইবারে ওর তীর সঠিক স্থানে লাগবে।
অনুপমার চিন্তার গতিতে বাধা প্রাপ্তি হয় পায়েলের হাতের ছোঁয়ায়, “কোথায় হারিয়ে গেলিরে? খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি রে। আমারো খুব দুঃখ লাগছে, কিন্তু কি করতে পারি বল। পুলিস কি কিছু করছে?”
অনুপমা ছলছল চোখে পায়েলের দিকে তাকিয়ে থাকে, একে কি দেবায়নের বিষয়ে বলা ঠিক হবে? শ্রেয়া আর রূপকের ওপরে সন্দেহ করেছে ভেবেই মনের ভেতরে কুণ্ঠাবোধ জেগে ওঠে। মন পরে থাকে নির্জীব শায়িত দেবায়নের পাশে। চোখ মুছে বহু কষ্টে হাসি টেনে বলে, “না রে, হারিয়ে যায়নি আমি। তোর সাথে একটু গোপন কথা আছে। ভাই ছাড়া আর কাউকে বলসি না যেন।”
পায়েল অধীর চিত্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে ধরা গলায় বলে, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি।”
কথাটা কানে যেতেই দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে পায়েলের, অধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কোথায় কেমন আছে, আমাকে এখুনি নিয়ে চল আমি ওকে দেখতে চাই।”
নির্জীব দেবায়নের মুখ মনে পড়তেই কেঁদে ফেলে অনুপমা, “কোমায় চলে গেছে রে আমার পুচ্চু…..”
আঁতকে ওঠে পায়েল, “না…..” বলেই ওকে জড়িয়ে ধরে।
ধীরে ধীরে এক এক করে সব ঘটনা ব্যাক্ত করে পায়েলের কাছে। পায়েল ওকে প্রবোধ দেয় যে একদিন দেবায়ন ঠিক হয়ে ওর কাছে ফিরে আসবে। এই প্রবোধ নিশ্চিত কিনা জানা নেই তাও বান্ধবীর মুখে সান্ত্বনা বাক্য শুনে অনুপমার মনে কিঞ্চিত আশার সঞ্চার হয়। শ্রেয়ার কথা জিজ্ঞেস করলে, পায়েল জানায়, অনুপমার নির্দেশ মতন ওদের দেখাশোনার ভার শ্রেয়া করে। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাড়িতে এসে পায়েলকে সঙ্গে নিয়েই অফিসে যায়। নিজেকে অনুপমার স্থানে বসাতে চেষ্টা করেনি অবশ্য কিন্তু বেশ ভালো ভাবেই অফিস আর পায়েল অঙ্কনকে সামলে রেখেছে।
রোজদিনের মতন একটু পরেই শ্রেয়া ওদের বাড়িতে আসে। অনুপমাকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “কিরে তুই এলি আর আমাদের খবর পর্যন্ত দিলি না? কি হয়েছে? কেমন আছিস? দেবুকে খুঁজে পেলি?”
ঝড়ের মতন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে অনুপমা উত্তরের খেই হারিয়ে ফেলে। শ্রেয়ার ওপরে অহেতুক সন্দেহ করেছিল ভাবতেই ওর চোখে জল চলে আসে। কোনরকমে নিজেকে সামলে শেষ পর্যন্ত দেবায়নের বিষয়ে বিস্তারে সব কথা জানায়। সব কিছু শোনার পরে শ্রেয়াও পায়েলের মতন অধৈর্য হয়ে ওঠে ব্যাঙ্গালোর যাওয়ার জন্য। অনুপমা জানায় এখন ওর কোলকাতায় কিছু কাজ বাকি আছে। ওরা জানতে চাইলে সত্য লুকিয়ে জানায় যে ধৃতিমানের বিষয়ে বিস্তারে খোঁজ নিতে চায়। এখুনি সবাই মিলে ব্যাঙ্গালোর গিয়ে কিছুই করার নেই। পায়েল আর শ্রেয়াকে অফিসে চলে যেতে বলে।
পায়েল আর শ্রেয়া অফিসে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনুপমা ব্যাগ খুলে দেবায়নের বাড়ি থেকে আনা ফাইল খুলে বসে পড়ে। কন্সট্রাকশান কোম্পানির কাগজ খানা বারেবারে পড়ে দেখে। এই কাগজের মধ্যে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। এই কাগজের আসল অর্থ বের করতে পারলে দেবায়নের আসল উদ্দেশ্য অথবা খুনির আসল উদ্দেশ্য হয়ত জানা যাবে। দেবায়ন বিশেষ কিছুই জানায়নি নিবেদিতার সম্পর্কে। যদিও ওর বাবার সাথে নিবেদিতার অনেকদিনের পরিচয় কিন্তু কোনোদিন ওদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিল না নিবেদিতার। আর তার আসল কারন, মায়ের আর নিবেদিতার মনোমালিন্য। কি কারনে এই মনোমালিন্য, আর কি কারনে বাবার সাথে এত সুহৃদ সম্পর্ক। নিবেদিতার বিষয়ে বিস্তারে জানা দরকার। নিবেদিতার বিয়ে চোদ্দ বছর আগে একজন এন.আর.আইয়ের সাথে হয়েছিল, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওদের ডিভোর্স হয়ে যায়। নিবেদিতার ছেলে, অঙ্কুশের জন্ম ডিভোর্সের এক দেড় বছর পরে হয়। অঙ্কুশের পিতার পরিচয় অনুপমার অজানা, হয়ত এই পৃথিবীর অজানা। কোন গুপ্ত প্রেমের ফল স্বরূপ অঙ্কুশের জন্ম। হয়ত দেবায়ন এই বিষয়ে জেনে গিয়েছিল আর নিবেদিতাকে ব্ল্যাকমেিল করেছে। তাই কি নিবেদিতা ওকে সরিয়ে দিয়েছে? কিন্তু কোম্পানির কাগজ অন্য কথা বলছে। এই কাগজ অনুযায়ী, দুটি কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত করে একটা বড় কোম্পানির মালিক হতে চলেছে নিবেদিতা। কিন্তু কন্সট্রাকশান কোম্পানি মালিকানা নিবেদিতার নামে তাহলে দেবায়নের কি লাভ এইখানে?
ভাবতে ভাবতে হটাত মাথায় ঝিলিক খেলে যায় অনুপমার। অঙ্কুশ অবিকল ভাইয়ের ছোট বেলার মতন দেখতে, ঠিক সেই নাক সেই রকম কোঁকড়ানো চুল, গাল দুটো টোপাটোপা আর চেহারায় বুদ্ধিদীপ্তের ছটা। বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক। অঙ্ক মেলাতে অসুবিধে হয় না। অঙ্কুশের পিতার সম্বন্ধে জানা দরকার। এই উত্তর পেয়ে গেলে ওর কাছে অনেক কিছুর উত্তর পাওয়া যাবে।
মা নিবেদিতাকে দেখতে পারে না। মানুষ বন্ধুর চেয়ে শত্রুর খবর বেশি রাখে। নিবেদিতার সম্বন্ধে মায়ের কাছ থেকে হয়ত অনেক কিছু জানা যেতে পারে ভেবেই অনুপমা কাগজ হাতে পারমিতার কাছে যায়।
পারমিতার ঘরে ঢুকে অনুপমা মাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথে কিছু কথা ছিল।”
মেয়েকে ওইভাবে বিদ্ধস্ত রূপে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিতা প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ, বল কি হয়েছে?”
অনুপমা একটু খানি থেমে জিজ্ঞেস করে, “নিবেদিতার সম্বন্ধে কিছু জানার ছিল। তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনিবনা হয়না, তার কারন কি জানতে পারি?”
পারমিতা মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েকে জরিপ করে উত্তর দেয়, “হঠাৎ নিবেদিতার সম্বন্ধে প্রশ্ন করছিস কেন? নিবেদিতার ওপরে কি তোর সন্দেহ হচ্ছে নাকি?” একটু থেমে, ওকে বসতে বলে, “দেখ অনু, পায়েলের কাছ থেকে এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে আমি সব শুনেছি। আমি জানিনা আততায়ী কে। কিন্তু আর যাই হোক নিবেদিতা এই কাজ করতে পারে না ও সেই রকমের মেয়ে নয়।”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না মা, আমি শুধু জানতে চাইছিলাম বাবার সাথে নিবেদিতার বেশ ভালো সম্পর্ক কিন্তু তোমার সাথে নিবেদিতার কেন বনে না?”
পারমিতা বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, নিবেদিতার সাথে কোনোদিন আমার সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। তোকে শুরু থেকে বলি তাহলে। শ্বশুর মশায় মানে তোর ঠাকুরদা বেঁচে থাকার সময় থেকেই নিবেদিতার বাবা, মিস্টার চৌধুরী আর তোর জেঠু, রাজেশ এই কোম্পানি চালাত। তারপরে এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি সম্পূর্ণ রূপে আমার হাতে চলে আসে। কি ভাবে আসে সেটা তোর অজানা নয়।”
কথাটা বলার সময়ে কুণ্ঠাবোধে পারমিতার গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে যায়। একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে, “ততদিনে নিবেদিতার বিয়ে হয়ে গেছে। তারপরে নিবেদিতার বাবার হার্ট অ্যাটাক হয়। তারপরে নিবেদিতার ডিভোর্স হয়ে যায় আর নিবেদিতা কোলকাতা ফিরে এসে কোম্পানির ভার সামলায়। আমার মাথায় এই ব্যাবসার প্যাঁচ কলাকৌশল কোনোদিন ঢুকত না তাই আমি বিশেষ কোনোদিন অফিসে যেতাম না। আমার কাজ ছিল অন্য, ক্লায়েন্ট ধরার জন্য আমি কি করতাম সেটাও তোর অবিদিত নয়। তোর বাবা নিজের অফিস আর এই কন্সট্রাকশান কোম্পানি নিয়েই পড়ে থাকত। তবে তোর বাবার চেয়ে নিবেদিতা নিজের ঘাড়ে পুরো কন্সট্রাকশান কোম্পানির তত্তাবধনের ভার তুলে নেয়। এত কিছু করার পরেও ওর অংশ খুব কম ছিল আর সেই নিয়ে অখুশি ছিল। মাস গেলে আমার একাউন্টে মোটা টাকা আর তার তুলনায় যে সব কাজ করে তার একাউন্টে আমার চেয়ে অনেক কম টাকা। আমি অফিসে গেলেই আমার থেকে দূরে থাকত, আমার দিকে এক ঘৃণ্য দৃষ্টিতে তাকাত। এই নিয়ে অবশ্য আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোন বচসা হয়নি কিন্তু নিবেদিতা আমাকে দেখতে পারত না। আমি অফিসের মালিক হয়েও কর্মচারীদের মধ্যে আমার বিশেষ কোন স্থান ছিল না। ওর এই নাক উঁচু ভাব, অফিসে সবাই ওকে সমীহ করে, সেই হিংসা, এইসব আমি সহ্য করতে পারতাম না। তবে নিবেদিতা খুব কর্মঠ মেয়ে, মার্জিত কিন্তু কঠোর, সুনিপুণ দক্ষতায় কোম্পানি দাঁড় করিয়েছে।”
মায়ের মুখে নিবেদিতার স্তুতি শুনতে পাবে সেটা অনুপমার পক্ষে আশাতীত ছিল। ভেবেছিল হয়ত মা, নিবেদিতাকে সন্দেহের চোখে দেখবে, কিন্তু নিবেদিতার চরিত্রে কোন খুঁত ওর মা ওকে জানাতে পারল না। সব শুনে অনুপমা একটু চিন্তায় পরে যায়, “হুম, বুঝলাম সব কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে যার উত্তর পাচ্ছি না। নিবেদিতার বিয়ে হয়েছিল আজ থেকে চোদ্দ বছর আগে, বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ওর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল, তাই না?”
পারমিতা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ।”
অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “ডিভোর্সের এক থেকে দেড় বছর পরে অঙ্কুশের জন্ম। অঙ্কুশের পিতা কে, সেই নিয়ে তোমার মনে কোনোদিন প্রশ্ন জাগেনি?”
পারমিতার চেহারা হঠাৎ করে ফ্যাকাসে হয়ে যায়, গলা শুকিয়ে আসে। বার কতক ঢোঁক গিলে মেয়েকে প্রশ্ন করে, “হঠাৎ এই নিয়ে প্রশ্ন করলি কেন? কি জানিস তুই?”
মায়ের চেহারার এই ফ্যাকাসে রঙ অনুপমার তীক্ষ্ণ চাহনি এড়াতে পারে না। মায়ের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি জানো, অঙ্কুশের বাবা কে?”
পারমিতা কঠিন ভাবে অনুপমার দিকে তাকিয়ে উল্টে প্রশ্ন করে, “এই খবর তোর জেনে কি লাভ? অঙ্কুশের পিতার পরিচয়ের সাথে দেবায়নের এই দুর্ঘটনার কি সম্পর্ক?”
পারমিতার চোখের এই কঠোর চাহনির পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে। এর উত্তর জানার জন্য ওকে শেষ পর্যন্ত কোম্পানির কাগজ বের করতে হয়। কোম্পানির কাগজ হাতে নিয়েই পারমিতা রুদ্ধশ্বাসে অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ জোড়া ছলকে ওঠে পারমিতার, অস্ফুট কণ্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করে, “এই কাগজ কোথা থেকে পেয়েছিস তুই?”
অনুপমা মায়ের হাতের ওপরে হাত রেখে প্রশ্ন করে, “আমি শুধু এর উত্তর জানতে চাই মা। আততায়ী যেই হোক কিন্তু এই কাগজ পড়ার পরে আমার মনে একটা সন্দেহ হয়েছে। কে আসল দোষী। এই দেবায়ন কি আসলে আমার ভালোবাসার পুচ্চু নয়?”
পারমিতা মুখে হাত চাপা দিয়ে অস্ফুট আঁতকে ওঠে, “না, হ্যান্ডসামের মতন ছেলে হয় না। তোর পুচ্চু তোকে প্রচন্ড ভালোবাসে রে অনু।”
ওর দেবায়ন যে ওকে খুব ভালোবাসে সেটা জানে কিন্তু সেই কথা মায়ের মুখ থেকে শোনার পরে ওর চোখ জোড়া ভেসে যায়। পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে মনে শক্তি জুগিয়ে বলে, “হ্যান্ডসাম ওর বিশাল হাতের মাঝে সবাইকে আগলে রাখতে চায়। সবাইকে মানে, তোকে, আমাকে, তোর বাবাকে পায়েল অঙ্কন সব্বাইকে। কোন কিছু ভেঙ্গে যাক সেটা কিছুতেই হ্যান্ডসাম চায় না। এই সম্পর্কের সম্বন্ধে আর এই কাগজের ব্যাপারে কিছু নাই বা জানলি।”
মায়ের চোখের জল দেখে অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না, অঙ্কুশ কেন অবিকল ওর ভাইয়ের মতন দেখতে। মায়ের হাত ধরে প্রশ্ন করে, “তাহলে তুমি জানতে আগে থেকে?”
সম্মতি জানিয়ে মৃদু মাথা দোলায় পারমিতা, “হ্যাঁ, আমি সব জানি তবে আগে জানতাম না। দেবায়ন কি ভাবে যেন এই সব কিছু জেনে গিয়েছিল আর সেই আমাকে বুঝিয়ে বলে। প্রথমে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম কিন্তু হ্যান্ডসামের কথা শুনে মনে হল, ভালো কি শুধু একটা মাত্র মানুষ কেই বাসা যায়? তোর বাবা আগে আমাকে সেই ভাবে ভালবাসত না, আর সেই কারনেই নিবেদিতাকে ভালোবেসে ফেলেছিল। আমি এতদিন তোর বাবার ভালোবাসা পাইনি। আমি এতদিন এরতার বিছানায় শুয়ে কাটিয়েছি। নিবেদিতা আর তোর বাবা একসাথে প্রচুর সময় কাটিয়েছে আর এই দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে কাটাতে সাথে তোর বাবার সাথে নিবেদিতার প্রেম হয়ে যায়। আর…..”
অনুপমা ছলছল চোখে কম্পিত কণ্ঠে মাকে জিজ্ঞেস করে, “অঙ্কুশ তাহলে আমার ভাই?”
পারমিতা সম্মতি জানিয়ে মাথা দোলায়, “হ্যাঁ, অঙ্কুশ তোর ভাই, তোর রক্ত।”
অনুপমার মাথার শিরা ঝনঝন করে ওঠে। পারমিতা মেয়ের চোখের জল মুছিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তবে দেবায়ন কাউকে আঘাত করতে চায়নি তাই তোকে ধীরে ধীরে নিবেদিতার সাথে পরিচয় করায়। শুরুতেই যদি দেবায়ন তোকে সব কিছু বলে দিত তাহলে তুই কাউকেই ঠিক ভালো চোখে দেখতিস না তাই তোর সাথে নিবেদিতার ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটাই চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তুই যেমন আমাকে ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল অন্তত নিবেদিতার সাথে তোর বান্ধবীর মতন সম্পর্ক গড়ে উঠুক। অঙ্কনকে যেমন ভালবাসিস, দেবায়ন চেয়েছিল ঠিক সেই ভাবে অঙ্কুশের ওপরে তোর যেন সেই স্নেহ গড়ে ওঠে। তারপরে তোর হাত ধরে নিবেদিতার সাথে পায়েল আর অঙ্কনের সুহৃদ সম্পর্ক গড়ে উঠত। এই গ্রুপ কোম্পানি আমাদের পরিবারের মধ্যেই রয়েছে। নিবেদিতাকে কন্সট্রাকশান কোম্পানির সম্পূর্ণ ভার দেওয়া দেবায়নের মাথার উপজ। তোর বাবা আর দেবায়ন হোটেল নিয়ে থাকবে এই ঠিক হয়, আর তুই পায়েল আর অঙ্কন তোর আই.টি কোম্পানি নিয়ে থাকবি। এই ভাবেই দুই পরিবার এক করতে চেয়েছিল হ্যান্ডসাম। তোর বাবা সব শুনে সেদিন দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছিল। সেই প্রথম সোমেশকে ওই ভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। ভালোবাসা বড় কঠিন বস্তু, তাই নয় কি অনু?”
সব কিছু শোনার পরে অনুপমা চোখ বন্ধ করে বসে পরে। ওর দুই চোখ বেয়ে অঝোর ঝারায় অশ্রুর বন্যা বয়ে চলে, এত ভালোবাসা রাখবে কোথায়? একটি মাত্র জীবন ওর কাছে। মনে মনে নিজেকে ধিক্কার জানায়, অবুঝের মতন কিছু না জেনেই বাবাকে, নিবেদিতাকে, রূপককে সন্দেহ করেছিল। এরা সবাই ওর জন্য ভাবে, ওর জন্য চিন্তা করে, ওর দুঃখে দুঃখিত হয়, ওর হাসিতে হাসে।
পারমিতা মেয়ের মুখ আঁজলা করে ধরে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “জানি দেবায়ন চলে যাওয়াতে তোর খুব কষ্ট হচ্ছে। জানি তোর জীবনে দেবায়নের জায়গা আমরা কেউই পূরণ করতে পারব না তবে আমরা সবাই তোর পাশে আছি রে অনু।”
অনুপমা ফুঁপিয়ে ওঠে, মায়ের সান্ত্বনা বাক্য শোনার পরে মনে হয় মাকে সত্যি বলা ভালো, “পুচ্চুকে খুঁজে পেয়েছি। তবে…..”
পারমিতা ওই শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এই কথা কেন আমাদের জানাস নি?”
অনুপমা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “তখন ঠিক বুঝতে পারিনি কে আসল দোষী তাই।”
পারমিতা ওকে প্রশ্ন করে, “দেবায়ন কোথায়, কেমন আছে?”
অনুপমা ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে উত্তর দেয়, “খুব খারাপ অবস্থায় আছে মা। জানি না কি হবে। ওর অনেক হাড় ভেঙ্গে গেছে। দেবায়ন কোমায় চলে গেছে, মা। আমি কি করব মা?” বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনুপমা।
মেয়ের মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে পারমিতা। মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “দেবায়নকে যখন খুঁজে পেয়েছিস তখন কোমায় থাকুক আর যেখানেই থাকুক ও তোর কাছে ফিরে আসবেই। তুই চিন্তা করিস না। দেবশ্রীদি এই বিষয়ে জানে?”
অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ জানে। মামনি খুব ভেঙ্গে পড়েছে।”
পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি কোথায়, দেবায়ন কোথায়?”
চোখের জল মুছে অনুপমা উত্তরে বলে, “দেবায়নকে আমি দিলিপ বাবুর কাছে ব্যাঙ্গালোরে পাঠিয়ে দিয়েছি। মামনি দেবায়নের কাছে।” তারপরে মাকে সব কথা বিস্তারে জানায় অনুপমা।
সব কিছু শোনার পরে পারমিতা ব্যাস্ত হয়ে যায়, ওকে বলে, “আমি এখুনি তোর বাবাকে ফোন করছি। আমরা থাকতে এই সময়ে দেবশ্রীদি একা থাকতে পারে না। আমি এখুনি তোর বাবাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর যেতে চাই।”
পারমিতা সঙ্গে সঙ্গে, সোমেশ বাবুকে ফোন করে সব কিছু জানিয়ে দেয়। অনুপমার বাবা সব কিছু শুনে সঙ্গে সঙ্গে প্লেনের টিকিট কেটে বাড়িতে পৌঁছে যান। বাবাকে সন্দেহ করেছিল বলে বাবার সামনে যেতে দ্বিধা বোধ করে অনুপমা। কিন্তু ওর মা ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, এই কথা ওর বাবা জানতে পারবে না। পারমিতা ওকে সঙ্গে নিতে চায় কিন্তু অনুপমা জানায় ওর বদলে পায়েলকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যাক। অনুপমা একটা শেষ চেষ্টা করতে চায়। ওর সন্দেহের তালিকার শেষ ব্যাক্তি, ধৃতিমানের বিষয়ে কিছুই তল্লাসি করা হয়নি। হয়ত এইবারে ওর তীর সঠিক স্থানে লাগবে।