07-10-2020, 03:12 PM
অনুপমা ভাবতে বসে, “ঠিক বলেছিস, যে ভাবে আততায়ী সোজা রাস্তা না ধরে পাহাড়ি জঙ্গল ধরে পালিয়েছে তাতে দুটো তথ্য আমাদের সামনে আসছে। এক, আততায়ী ভাড়া করা পাহাড়ি লোক যে ওই এলাকা ভালো করে চেনে আর দ্বিতীয়, আততায়ী নিজেই ওই পাহাড়ে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছে। কিন্তু এইভাবে ঘুরে বেড়াতে হলে আততায়ী নিশ্চয় অনেকদিন বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। কোলকাতা ফিরে সব থেকে আগে আমাদের এইটা দেখতে হবে কে কে কতদিন ধরে বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। আর তাঁর সাথে সাথে আমাদের দেখতে হবে দেবায়নকে খুন করার পেছনে আসল কি কি কারন হতে পারে। কয়েকটা কারন অবশ্য আমাদের জানা কিন্তু কয়েকটা বিষয় আমাকে নিজেই একবার খুঁজে বের করতে হবে।”
পর্ব ২৯ (#০৪)
এয়ার হোস্টেস এসে খাবার দিয়ে গেল, কিন্তু সেই খাবার কিছুতেই আর অনুপমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। ওর মন পরে থাকে ব্যাঙ্গালোরে, ওর দেবায়নের পাশে আর ওর মামনির পাশে। কোলকাতা ফিরে নিজের বাড়িতে না দেবায়নের বাড়িতে, কোথায় উঠবে সেটা এখন ঠিক করে উঠতে পারেনি। চুপচাপ বসে খাবার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে উদাস চাহনি নিয়ে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পরাশর ওর মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে ওকে বলে, “এই ভাবে খাওয়া দাওয়া যদি ছেড়ে দিস তাহলে কি হবে বল। কোথায় যাবি কিছু ঠিক করলি? এখন পর্যন্ত কাউকে জানানো হয়নি যে আমরা কোলকাতা ফিরছি।”
শূন্য চোখে পরাশরের দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অনুপমা, “হ্যাঁ রে, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে তো?”
পরাশর ওর হাতের ওপরে হাত রেখে শক্তি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর, আজকে আমার বাড়িতে চল। কাল সকালে দেখা যাবে কি করা যায়।” কিছুক্ষণ থেমে কিছু চিন্তা করে ওকে বলে, “আমি বলছিলাম যে…..” অনুপমা ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। পরাশর ওকে বলে, “কোন নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে তদন্ত করালে ভালো হয়, মানে কাকুকে বলে। আমরা এমনিতে এফ.আই.আর করে এসেছি। এইবারে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অনায়াসে সেই তদন্তের ভার নিতে পারবে।”
কঠিন কণ্ঠে অনুপমা জানায়, “না, আমি একাই খুনিকে শাস্তি দেব।”
পরাশর ওকে বলে, “এতে অনেক ঝুঁকি আছে অনু। হিতে বিপরিত হতে পারে। আর সব থেকে বড় ব্যাপার, আমরা হয়ত এমন আসল লোককে এড়িয়ে যেতে পারি। হয়ত আততায়ী আমাদের খুব কাছের মানুষ যার ওপরে আমাদের সন্দেহ একদম হচ্ছে না।”
অনুপমা প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইছিস একটু খুলে বল।”
পরাশর উত্তরে বলে, “না মানে, এই দেখ। দেবায়ন কার পথ থেকে সরে গেলে সে বেশি লাভবান হবে।”
“বাবা” বলতে গিয়েও থেমে গেল অনুপমা, উল্টে প্রশ্ন করে, “কেন, ওকে সরাবার উদ্দেশ্য অনেকের থাকতে পারে। এই যেমন, ধৃতিমান, সূর্য, ইন্দ্রনীল, অনিমেশ, রজত পানিক্কর এরা।”
পরাশর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলে, “আরো একজন হতে পারে, রূপক আর শ্রেয়া।”
অনুপমা আঁতকে ওঠে, “না না, ওরা কখনই হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সব থেকে ভালো বান্ধবী আমার জন্য অনেক করেছে।”
পরাশর ওকে বলে, “জানি, কিন্তু সেটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের একটা চাল হতে পারে। একটু ভালো ভাবে চিন্তা করে দেখ। এই খাটলিং গ্লেসিয়ার যাওয়ার পরিকল্পনা কার? রুপকের। আর কি কেউ জানত যে আমরা খাটলিং গ্লেসিয়ার যাচ্ছি? হয়ত নয়।”
মাথা নাড়ায় অনুপমা, সত্যি, ওদের এই ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে শুধু মাত্র ওর বাবা আর রূপক জানে। অন্য কেউ হয়ত জানেই না এই বিষয়ে।
পরাশর আরো বলে, “কে সব থেকে বেশি লাভবান হল? রূপক আর শ্রেয়া। একটু ভালো ভাবে চিন্তা কর। তুই আসার আগে ওদের হাতে কোম্পানির ভার তুলে দিয়ে এলি। দেবায়ন না ফিরলে তোর কি হত সেটা অবশ্য জানা নেই। পায়েল প্রচন্ড শান্ত প্রকৃতির মেয়ে হয়ে গেছে আর অঙ্কন অনেক ছোট। ওদের অতি সহজে হাত করে নিতে পারবে রূপক আর শ্রেয়া। যদি বলি, ওরা এটাই চেয়েছিল?”
বাকশুন্য হয়ে যায় অনুপমা, এত গভীর দুরাভিসন্ধি করবে ওর বিরুদ্ধে? অনুপমা মাথা ঝাঁকায়, “না না, এটা হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সাথে এত বড় প্রতারনা করতে পারে না। কিন্তু দেবায়নের দুর্ঘটনার সময়ে, রূপক আর শ্রেয়া আমাদের সাথেই ছিল। ওদের চেহারা…..”
পরাশর ওকে বলে, “আমি বলছি না যে এটাই হয়েছে, তবে এটা হতে পারে। সুতরাং সর্ব প্রথম ওদের ওপরে আমাদের খুব কড়া নজর রাখতে হবে। নিজে হাতে করেনি তবে টাকা দিয়ে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে এই কাজ অনায়াসে করা যেতে পারে।”
অনুপমা চিন্তায় পরে যায়, “তাহলে কাকে বিশ্বাস করব, বল?”
পরাশর স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “কাউকে নয়, এমন কি আমাকেও নয়।” ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইয়ার্কির সুরে বলে, “দেবায়ন সরে গেলে আমার বড় লাভ হত, তোকে একা পেয়ে একটু প্রেম করতে পারতাম।”
অনুপমার চোখে অনেকদিন পরে খানিক হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। পরাশরের কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “হ্যাঁ, আর বলিস না তুই শয়তান ছেলে…..”
অনেকদিন পরে অনুপমার চেহারায় হাসি দেখে পরাশরের বেশ ভালো লাগে, ওর হাতের ওপরে হাত রেখে মনে সাহস দিয়ে বলে, “এই হাসিটাকে আর লুকাস না প্লিস, দেবু বড় কষ্ট পাবে।”
চোখ জোড়া ছলকে ওঠে অনুপমার, “বলছিস? কিন্তু কোলকাতা নামলে আমাদের চেহারার অভিব্যাক্তি একদম বদলে ফেলতে হবে। দেবায়ন যে নেই এটা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।”
পরাশর স্মিত হেসে বলে, “এই হাসি ভেতরে রাখ সেটাই অনেক কাজে দেবে। মন মরা হয়ে থাকলে উৎসাহ খুঁজে পাবি না।”
কোলকাতা নেমেই ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে দেবশ্রীকে জানিয়ে দেয় ওরা ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছে, সেই সাথে দেবায়নের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এখন ওর শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে….. বাকিটা আর শুনতে ইচ্ছে হল না অনুপমার। ওইদিকে মামনির ভাঙ্গা কণ্ঠ এদিকে ওর ভগ্ন হৃদয়। অনুপমা ঠিক করে রাতে দেবায়নের বাড়িতে কাটাবে। দেবায়ন না থাকুক, ওর বিছানায় শুয়ে ওর জামা পরে ওর ছোঁয়া গায়ে মেখে এক রাতের জন্য দেবায়নের শরীরের পুরাতন ঘ্রাণ নিতে চায়।
দেবায়নের বাড়ির দরজা খুলে ফাঁকা ঘর দেখে অনুপমার হৃদয় হুহু করে কেঁদে ওঠে, কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নেয় অনুপমা। আলো জ্বালিয়ে দেবায়নের ঘরে ঢুকে ওর জামা পরে চুপচাপ ওর বিছানার ওপরে শুয়ে ভাবতে বসে। সত্যি কি শ্রেয়া আর রূপকের চাল এটা না বাবার কোন ষড়যন্ত্র। দেবায়ন সরে গেলে শ্রেয়া আর রূপক সব থেকে বেশি লাভবান হবে অথবা হয়েছে। বাবাও প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ওরা যে খাটলিং যাবে এই কথা শুধু মাত্র বাবার আর রূপকের পক্ষেই জানা সম্ভব। কিন্তু বাবা কি শুধু প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে সরিয়েছে না এর পেছনে আরো কোন গভীর কারন আছে? হয়ত বাবার কোন গোপন কথা দেবায়ন জেনে ফেলেছে আর তাই হয়ত বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে দেবায়ন যার ফলে ওর বাবা দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু যদি দেবায়ন ওর বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করে থাকে তাহলে তার পরিবর্তে কি চেয়েছে? টাকা পয়সা, সম্পত্তি? দেবায়নের দুটো ব্যাংক একাউন্ট আছে যার মধ্যে একটা দেবায়নের নিজের। ল্যাপটপ খুলে সেই একাউন্ট চেক করে দেখে তাতে এমন কিছু টাকা নেই অথবা টাকার লেনদেন হয়নি। দ্বিতীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ওর সাথে জয়েন্ট, সেই ব্যাঙ্ক একাউন্ট বেশির ভাগ সময়ে নিজেই চালায়। দেবায়নের টাকার দরকার পড়লে ওর কাছ থেকে চেয়ে নেয়। তাহলে কি সম্পত্তি চেয়েছে দেবায়ন? এতটা নীচ কাজ কি দেবায়ন করবে? ভাবতেই ওর শরীর ঘৃণায় শিউরে ওঠে। না, এতটা নীচ দেবায়ন হয়ত হবে না। আসল কারন জানতে হলে বাবার ওপরে আর রূপকের ওপরে কড়া নজর রাখা দরকার।
সারাটা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা, ওর মাথা আর কাজ করছে না। আলমারি খুলে কাগজ পত্র ঘেঁটে দেখে যদি কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই সম্পত্তির বিষয়ে। কাগজ পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হটাত একটা ফাইলে ওর নজর পরে যায়। হলদে ফাইল, ওপরে লেখা “অফিস ওয়ার্কস” ভেতরে অজস্র কাগজ পত্র। ফাইল হাতে নিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে বসে পড়ে। কাগজ গুলো সব ব্যাবসা সংক্রান্ত। একটা কাগজ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। পুনের হোটেলের কাগজ। রজত পানিক্করের দুটো হোটেলের মালিকানার কাগজের জেরক্স। বহুদিন আগে মেহেকের সাহায্যে একটা হোটেল দেবায়ন হাতিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তারপরে আরো একটা হোটেল কি ভাবে করায়ত্ত করেছে সেই খবর জানার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। হতে পারে সেই প্রতিশোধে রজত পানিক্কর দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে এর সদুত্তর পাওয়া যাবে, কিন্তু বাবাও সন্দেহের ঘেরে রয়েছে।
কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পরে অনুপমা ঠিক করে একবার নিজের পরিচয় দিয়ে হোটেলে ফোন করবে। হোটেলের রিসেপশানে ফোন করে ম্যনেজারের সাথে কথা বলে অনুপমা জানতে পারে যে রজত পানিক্কর দুই মাস আগেই দেহ রক্ষা করেছেন। তাঁর দুই ছেলে রজত পানিক্করের দুটো হোটেল মিস্টার সোমেশ সেন কে বিক্রি করে দেন। এই খবর ওর জানা ছিল না, দেবায়ন অথবা ওর বাবা ব্যাবসার বেশির ভাগ খবর ওকে জানায় না। ওর সন্দেহের তালিকা থেকে রজত পানিক্করকে বাদ দিতে হয়।
কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরো একটা কাগজ উদ্ধার করে। ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানির একটা ইনিসিয়াল ড্রাফট। কাগজ খানা পড়ার পরে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায়। নিবেদিতার কন্সট্রাকশান কোম্পানির সাথে ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত হয়ে একটা কোম্পানি হয়ে যাবে, এবং সেই কোম্পানির কর্ণধার স্বয়ং নিবেদিতা। যদিও ওই কোম্পানি ওদের গ্রুপ কোম্পানির অধীনে থাকবে কিন্তু সিংহ ভাগ মালিকানা, সত্তর শতাংশের মালিকানা নিবেদিতার হাতে। হঠাৎ দেবায়ন নিবেদিতার ওপরে এতটা সহৃদয় কেন? ওর পেছনে কি নিবেদিতার সাথে দেবায়নের কোন গোপন সম্পর্ক গঠন হয়েছে? দুই কম্পানিকে মিলিত করার আসল চিন্তা ধারা কি নিবেদিতার না দেবায়নের? ওর বাবা কি আদৌ জানেন এই বিষয়ে? হয়ত এই বিষয়ে জেনে গেছেন ওর বাবা আর সেই জন্যেই দেবায়নকে সরিয়ে দিয়েছে। বহু প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে ভর করে আসে, কিন্তু সঠিক উত্তর কিছুতেই খুঁজে পায় না। দেবায়নের এই পরিনতির পেছনে কি আসলে দেবায়ন নিজেই দায়ী? ওর পুচ্চু কি সত্যি এক খলনায়ক? উত্তর গুলো ওকে জানতে হবেই।
পর্ব ২৯ (#০৪)
এয়ার হোস্টেস এসে খাবার দিয়ে গেল, কিন্তু সেই খাবার কিছুতেই আর অনুপমার গলা দিয়ে নামতে চায় না। ওর মন পরে থাকে ব্যাঙ্গালোরে, ওর দেবায়নের পাশে আর ওর মামনির পাশে। কোলকাতা ফিরে নিজের বাড়িতে না দেবায়নের বাড়িতে, কোথায় উঠবে সেটা এখন ঠিক করে উঠতে পারেনি। চুপচাপ বসে খাবার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে উদাস চাহনি নিয়ে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পরাশর ওর মনের অস্থিরতা বুঝতে পেরে ওকে বলে, “এই ভাবে খাওয়া দাওয়া যদি ছেড়ে দিস তাহলে কি হবে বল। কোথায় যাবি কিছু ঠিক করলি? এখন পর্যন্ত কাউকে জানানো হয়নি যে আমরা কোলকাতা ফিরছি।”
শূন্য চোখে পরাশরের দিকে তাকিয়ে কাতর কণ্ঠে প্রশ্ন করে অনুপমা, “হ্যাঁ রে, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে তো?”
পরাশর ওর হাতের ওপরে হাত রেখে শক্তি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ ঠিক হয়ে যাবে। এক কাজ কর, আজকে আমার বাড়িতে চল। কাল সকালে দেখা যাবে কি করা যায়।” কিছুক্ষণ থেমে কিছু চিন্তা করে ওকে বলে, “আমি বলছিলাম যে…..” অনুপমা ওর দিকে হাজার প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে থাকে। পরাশর ওকে বলে, “কোন নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে তদন্ত করালে ভালো হয়, মানে কাকুকে বলে। আমরা এমনিতে এফ.আই.আর করে এসেছি। এইবারে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অনায়াসে সেই তদন্তের ভার নিতে পারবে।”
কঠিন কণ্ঠে অনুপমা জানায়, “না, আমি একাই খুনিকে শাস্তি দেব।”
পরাশর ওকে বলে, “এতে অনেক ঝুঁকি আছে অনু। হিতে বিপরিত হতে পারে। আর সব থেকে বড় ব্যাপার, আমরা হয়ত এমন আসল লোককে এড়িয়ে যেতে পারি। হয়ত আততায়ী আমাদের খুব কাছের মানুষ যার ওপরে আমাদের সন্দেহ একদম হচ্ছে না।”
অনুপমা প্রশ্ন করে, “কি বলতে চাইছিস একটু খুলে বল।”
পরাশর উত্তরে বলে, “না মানে, এই দেখ। দেবায়ন কার পথ থেকে সরে গেলে সে বেশি লাভবান হবে।”
“বাবা” বলতে গিয়েও থেমে গেল অনুপমা, উল্টে প্রশ্ন করে, “কেন, ওকে সরাবার উদ্দেশ্য অনেকের থাকতে পারে। এই যেমন, ধৃতিমান, সূর্য, ইন্দ্রনীল, অনিমেশ, রজত পানিক্কর এরা।”
পরাশর ঠোঁটের কোনে বাঁকা হেসে বলে, “আরো একজন হতে পারে, রূপক আর শ্রেয়া।”
অনুপমা আঁতকে ওঠে, “না না, ওরা কখনই হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সব থেকে ভালো বান্ধবী আমার জন্য অনেক করেছে।”
পরাশর ওকে বলে, “জানি, কিন্তু সেটা একটা গভীর ষড়যন্ত্রের একটা চাল হতে পারে। একটু ভালো ভাবে চিন্তা করে দেখ। এই খাটলিং গ্লেসিয়ার যাওয়ার পরিকল্পনা কার? রুপকের। আর কি কেউ জানত যে আমরা খাটলিং গ্লেসিয়ার যাচ্ছি? হয়ত নয়।”
মাথা নাড়ায় অনুপমা, সত্যি, ওদের এই ঘুরতে যাওয়ার ব্যাপারে শুধু মাত্র ওর বাবা আর রূপক জানে। অন্য কেউ হয়ত জানেই না এই বিষয়ে।
পরাশর আরো বলে, “কে সব থেকে বেশি লাভবান হল? রূপক আর শ্রেয়া। একটু ভালো ভাবে চিন্তা কর। তুই আসার আগে ওদের হাতে কোম্পানির ভার তুলে দিয়ে এলি। দেবায়ন না ফিরলে তোর কি হত সেটা অবশ্য জানা নেই। পায়েল প্রচন্ড শান্ত প্রকৃতির মেয়ে হয়ে গেছে আর অঙ্কন অনেক ছোট। ওদের অতি সহজে হাত করে নিতে পারবে রূপক আর শ্রেয়া। যদি বলি, ওরা এটাই চেয়েছিল?”
বাকশুন্য হয়ে যায় অনুপমা, এত গভীর দুরাভিসন্ধি করবে ওর বিরুদ্ধে? অনুপমা মাথা ঝাঁকায়, “না না, এটা হতে পারে না। শ্রেয়া আমার সাথে এত বড় প্রতারনা করতে পারে না। কিন্তু দেবায়নের দুর্ঘটনার সময়ে, রূপক আর শ্রেয়া আমাদের সাথেই ছিল। ওদের চেহারা…..”
পরাশর ওকে বলে, “আমি বলছি না যে এটাই হয়েছে, তবে এটা হতে পারে। সুতরাং সর্ব প্রথম ওদের ওপরে আমাদের খুব কড়া নজর রাখতে হবে। নিজে হাতে করেনি তবে টাকা দিয়ে ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে এই কাজ অনায়াসে করা যেতে পারে।”
অনুপমা চিন্তায় পরে যায়, “তাহলে কাকে বিশ্বাস করব, বল?”
পরাশর স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “কাউকে নয়, এমন কি আমাকেও নয়।” ওর কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে ইয়ার্কির সুরে বলে, “দেবায়ন সরে গেলে আমার বড় লাভ হত, তোকে একা পেয়ে একটু প্রেম করতে পারতাম।”
অনুপমার চোখে অনেকদিন পরে খানিক হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। পরাশরের কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “হ্যাঁ, আর বলিস না তুই শয়তান ছেলে…..”
অনেকদিন পরে অনুপমার চেহারায় হাসি দেখে পরাশরের বেশ ভালো লাগে, ওর হাতের ওপরে হাত রেখে মনে সাহস দিয়ে বলে, “এই হাসিটাকে আর লুকাস না প্লিস, দেবু বড় কষ্ট পাবে।”
চোখ জোড়া ছলকে ওঠে অনুপমার, “বলছিস? কিন্তু কোলকাতা নামলে আমাদের চেহারার অভিব্যাক্তি একদম বদলে ফেলতে হবে। দেবায়ন যে নেই এটা সবাইকে জানিয়ে দিতে হবে।”
পরাশর স্মিত হেসে বলে, “এই হাসি ভেতরে রাখ সেটাই অনেক কাজে দেবে। মন মরা হয়ে থাকলে উৎসাহ খুঁজে পাবি না।”
কোলকাতা নেমেই ব্যাঙ্গালোরে ফোন করে দেবশ্রীকে জানিয়ে দেয় ওরা ঠিক ভাবে পৌঁছে গেছে, সেই সাথে দেবায়নের বিষয়ে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে এখন ওর শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। ডাক্তারেরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তবে….. বাকিটা আর শুনতে ইচ্ছে হল না অনুপমার। ওইদিকে মামনির ভাঙ্গা কণ্ঠ এদিকে ওর ভগ্ন হৃদয়। অনুপমা ঠিক করে রাতে দেবায়নের বাড়িতে কাটাবে। দেবায়ন না থাকুক, ওর বিছানায় শুয়ে ওর জামা পরে ওর ছোঁয়া গায়ে মেখে এক রাতের জন্য দেবায়নের শরীরের পুরাতন ঘ্রাণ নিতে চায়।
দেবায়নের বাড়ির দরজা খুলে ফাঁকা ঘর দেখে অনুপমার হৃদয় হুহু করে কেঁদে ওঠে, কিন্তু নিজেকে শক্ত করে নেয় অনুপমা। আলো জ্বালিয়ে দেবায়নের ঘরে ঢুকে ওর জামা পরে চুপচাপ ওর বিছানার ওপরে শুয়ে ভাবতে বসে। সত্যি কি শ্রেয়া আর রূপকের চাল এটা না বাবার কোন ষড়যন্ত্র। দেবায়ন সরে গেলে শ্রেয়া আর রূপক সব থেকে বেশি লাভবান হবে অথবা হয়েছে। বাবাও প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে। ওরা যে খাটলিং যাবে এই কথা শুধু মাত্র বাবার আর রূপকের পক্ষেই জানা সম্ভব। কিন্তু বাবা কি শুধু প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে দেবায়নকে সরিয়েছে না এর পেছনে আরো কোন গভীর কারন আছে? হয়ত বাবার কোন গোপন কথা দেবায়ন জেনে ফেলেছে আর তাই হয়ত বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে দেবায়ন যার ফলে ওর বাবা দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছে। কিন্তু যদি দেবায়ন ওর বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করে থাকে তাহলে তার পরিবর্তে কি চেয়েছে? টাকা পয়সা, সম্পত্তি? দেবায়নের দুটো ব্যাংক একাউন্ট আছে যার মধ্যে একটা দেবায়নের নিজের। ল্যাপটপ খুলে সেই একাউন্ট চেক করে দেখে তাতে এমন কিছু টাকা নেই অথবা টাকার লেনদেন হয়নি। দ্বিতীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ওর সাথে জয়েন্ট, সেই ব্যাঙ্ক একাউন্ট বেশির ভাগ সময়ে নিজেই চালায়। দেবায়নের টাকার দরকার পড়লে ওর কাছ থেকে চেয়ে নেয়। তাহলে কি সম্পত্তি চেয়েছে দেবায়ন? এতটা নীচ কাজ কি দেবায়ন করবে? ভাবতেই ওর শরীর ঘৃণায় শিউরে ওঠে। না, এতটা নীচ দেবায়ন হয়ত হবে না। আসল কারন জানতে হলে বাবার ওপরে আর রূপকের ওপরে কড়া নজর রাখা দরকার।
সারাটা রাত দুই চোখের পাতা এক করতে পারে না অনুপমা, ওর মাথা আর কাজ করছে না। আলমারি খুলে কাগজ পত্র ঘেঁটে দেখে যদি কিছু তথ্য পাওয়া যায় এই সম্পত্তির বিষয়ে। কাগজ পত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হটাত একটা ফাইলে ওর নজর পরে যায়। হলদে ফাইল, ওপরে লেখা “অফিস ওয়ার্কস” ভেতরে অজস্র কাগজ পত্র। ফাইল হাতে নিয়ে বিছানায় ছড়িয়ে বসে পড়ে। কাগজ গুলো সব ব্যাবসা সংক্রান্ত। একটা কাগজ হাতে নিয়ে অবাক হয়ে যায়। পুনের হোটেলের কাগজ। রজত পানিক্করের দুটো হোটেলের মালিকানার কাগজের জেরক্স। বহুদিন আগে মেহেকের সাহায্যে একটা হোটেল দেবায়ন হাতিয়ে নিয়েছিল কিন্তু তারপরে আরো একটা হোটেল কি ভাবে করায়ত্ত করেছে সেই খবর জানার জন্য উন্মুখ হয়ে ওঠে। হতে পারে সেই প্রতিশোধে রজত পানিক্কর দেবায়নকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করলে এর সদুত্তর পাওয়া যাবে, কিন্তু বাবাও সন্দেহের ঘেরে রয়েছে।
কিছুক্ষণ ভাবনা চিন্তা করার পরে অনুপমা ঠিক করে একবার নিজের পরিচয় দিয়ে হোটেলে ফোন করবে। হোটেলের রিসেপশানে ফোন করে ম্যনেজারের সাথে কথা বলে অনুপমা জানতে পারে যে রজত পানিক্কর দুই মাস আগেই দেহ রক্ষা করেছেন। তাঁর দুই ছেলে রজত পানিক্করের দুটো হোটেল মিস্টার সোমেশ সেন কে বিক্রি করে দেন। এই খবর ওর জানা ছিল না, দেবায়ন অথবা ওর বাবা ব্যাবসার বেশির ভাগ খবর ওকে জানায় না। ওর সন্দেহের তালিকা থেকে রজত পানিক্করকে বাদ দিতে হয়।
কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরো একটা কাগজ উদ্ধার করে। ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানির একটা ইনিসিয়াল ড্রাফট। কাগজ খানা পড়ার পরে আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায়। নিবেদিতার কন্সট্রাকশান কোম্পানির সাথে ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানি মিলিত হয়ে একটা কোম্পানি হয়ে যাবে, এবং সেই কোম্পানির কর্ণধার স্বয়ং নিবেদিতা। যদিও ওই কোম্পানি ওদের গ্রুপ কোম্পানির অধীনে থাকবে কিন্তু সিংহ ভাগ মালিকানা, সত্তর শতাংশের মালিকানা নিবেদিতার হাতে। হঠাৎ দেবায়ন নিবেদিতার ওপরে এতটা সহৃদয় কেন? ওর পেছনে কি নিবেদিতার সাথে দেবায়নের কোন গোপন সম্পর্ক গঠন হয়েছে? দুই কম্পানিকে মিলিত করার আসল চিন্তা ধারা কি নিবেদিতার না দেবায়নের? ওর বাবা কি আদৌ জানেন এই বিষয়ে? হয়ত এই বিষয়ে জেনে গেছেন ওর বাবা আর সেই জন্যেই দেবায়নকে সরিয়ে দিয়েছে। বহু প্রশ্ন ওর মাথার মধ্যে ভর করে আসে, কিন্তু সঠিক উত্তর কিছুতেই খুঁজে পায় না। দেবায়নের এই পরিনতির পেছনে কি আসলে দেবায়ন নিজেই দায়ী? ওর পুচ্চু কি সত্যি এক খলনায়ক? উত্তর গুলো ওকে জানতে হবেই।