07-10-2020, 12:26 AM
পর্ব ২৯ (#০৩)
দেবায়নের অতি সঙ্গীন শারীরিক অবস্থা দেখে অনুপমার খুব ভয় হয়। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি খুব ধীরে ধীরে চলছে, মাথায়, হাতে পায়ে সব জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওর চঞ্চল পুচ্চুকে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। অনেকক্ষণ দেবায়নের ঠাণ্ডা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে পাশে বসে থাকে। পরাশর ততক্ষণ রঞ্জিত আর বাড়ির কর্তার সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। বাড়ির কর্তা ওদের জানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে কোন বড় হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে। রঞ্জিত জানায় দেরাদুনে ভালো হসপিটাল আছে সেইখানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে নিয়ে ওদের রওনা হওয়া উচিত। অনুপমা আর দেরি করেনা, রঞ্জিত দেরাদুনের একটা বড় হসপিটালের সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। ওদের সঙ্গের যে গাড়ি ছিল সেই গাড়িতে দেবায়নকে নিয়ে ওরা দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সামনের সিটে পরাশর আর রঞ্জিত পেছনে দেবায়নের মাথা কোলে অনুপমা। বাড়ির কর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা চারজনে দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
অসাড় দেবায়নের মাথা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে অনুপমা চাপা আশঙ্কায় প্রহর গুনতে গুনতে দেরাদুনের দিকে যাত্রা শুরু করে। পথে যেতে যেতে পরাশরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয়, “শোন এই খবর যেন কোন মতে কোলকাতা না পৌঁছায়, বুঝলি।”
পরাশর জিজ্ঞেস করে, “কেন রে, দেরাদুনে কেমন চিকিৎসা হবে সেটা ঠিক জানি না। কোলকাতা নিয়ে গেলে ভালো হত না? আর কাকিমাকেও এই বিষয়ে জানাতে হবে ত নাকি?”
অনুপমার গলা ধরে আসে, বুকের কাছে দেবায়নের মাথা চেপে ধরা গলায় পরাশরকে বলে, “খুব ভয় লাগছে রে, কি করব?”
পরাশর ওকে অভয় দিয়ে বলে, “কিছু হবে না। অত ওপর থেকে পরে যখন বেঁচে গেছে তখন ওর জীবন অনেক শক্ত। তুই চিন্তা করিস না দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে পরাশরকে উত্তর দেয়, “জানিনা রে, ওকে চোখের আড়াল করতে একদম ইচ্ছে করছে না। তুই একটা কাজ করবি?” পরাশর মাথা দুলিয়ে জানায় সব কিছু করতে রাজি। অনুপমা ওকে বলে, “ওকে হসপিটালে ভর্তি করে তুই কোলকাতা চলে যাস। মামনিকে বিশেষ কিছু এখন জানাস না। তুই প্লিস কিছু করে মামনিকে নিয়ে দেরাদুনে চলে আসিস।” কিছুক্ষণ থেমে বলে ভাবুক কণ্ঠে ওকে বলে, “কে আসল আততায়ী সেটা না জানা পর্যন্ত আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। দেবায়ন বেঁচে আছে জানতে পারলে আততায়ী সতর্ক হয়ে যাবে, দ্বিতীয় বার ওর ওপরে হামলা করতে পারে। আমরা এখন জানিনা আততায়ী আমাদের নিজেদের কেউ না বাইরের কেউ সুতরাং এই খবর কোন মতেই যেন কোলকাতা না পৌঁছায়। আততায়ী নিশ্চয় আমাদের ওপরে কড়া নজর রেখে চলেছে না হলে আততায়ী এত দুর এসে দেবায়নকে মারতে চেষ্টা করত না। সুতরাং শ্রেয়া পায়েলকেও এই খবর জানানো যাবে না। ওরা জানতে পারলে নিশ্চয় এইখানে আসতে চাইবে আর ওদের পিছু নিয়ে আততায়ী এইখানে এসে পৌঁছে যাবে।”
পরাশর বলে, “কিন্তু সেটা কাকিমার ক্ষেত্রেও হতে পারে। আমি যদি কাকিমাকে নিয়ে বের হই তাহলে আততায়ীর সন্দেহ হতে পারে। তার চেয়ে ভালো আমি এইখানে থাকি আর তুই কোলকাতা ফিরে যা। তোকে একা কোলকাতা ফিরতে দেখলে আততায়ীর সন্দেহ দুর হয়ে যাবে যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই। আর কাকিমাকে বলে বুঝিয়ে আনা একমাত্র তোর পক্ষেই সম্ভব। এরপরে দেবায়নকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হয়, মানে কোলকাতার বাইরে কোথাও যদি কোন বিস্বস্ত লোক থাকে তার কাছে হলে ভালো হয়।”
কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা ওকে বলে, “হ্যাঁ তুই ঠিক বলেছিস। দেখি একবার ব্যাঙ্গালোর ফোন করে। আমাদের এক হোটেলের মালিক দিলিপ বাবু নিশ্চয় আমাদের এই অবস্থায় সাহায্য করবেন।”
পরাশর ওকে বলে, “ঠিক আছে তুই দিলিপ বাবুকে ফোন করে দে আর আমি কাকুকে একটা ফোন করে দেই। আততায়ীকে খুঁজতে কাকুর সাহায্য আমাদের খুব দরকার পরবে।”
অনুপমা মাথা দোলায়, পরাশরের কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেকটর নিরঞ্জন বাবু, পায়েলের সময়ে ওদের খুব সাহায্য করেছিল। পরাশর সঙ্গে সঙ্গে কাকাকে ফোনে দেবায়নের নিরুদ্দেশের বিষয়ে কিঞ্চিত খবর দিয়ে বলে এই বিষয়ে যেন কাউকে না জানায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের জানায়, সব রকমের সাহায্য করবেন তিনি।
অনুপমা দিলিপ বাবুকে ফোন করে বিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে দিলিপ বাবু খুব ব্যাস্ত হয়ে পরেন, তিনি জানিয়ে দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি দেরাদুনে পৌঁছে যাবেন। এক সময়ে অনুপমা আর দেবায়ন তাঁর জন্য যা করেছিল তাঁর প্রতিদান এখন শোধ করা হয়নি। দেরাদুনে পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। হসপিটালে আগে থেকে কথা বলা ছিল তাই ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি ওদের।
ডাক্তার দেবায়নকে পরীক্ষা করে জানায়, বেশ কয়েক জায়গায় হাড় ভেঙ্গে গেছে, চার পাঁচ দিন ঠাণ্ডা জলে থাকার ফলে হাইপোথারমিয়া আর ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে। লিভারে আর ফুসফুসে জল ঢুকে গেছে। হৃদয় খুব ধীরে ধীরে চলছে। মাথার পেছনে আর ঘাড়ে বেশ জোর আঘাত পেয়েছে। দেবায়নকে বেশ কিছুদিন আই.সি.ইউ তে পর্যবেক্ষণের জন্য রাখতে চায়, জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অথবা বাহাত্তর ঘন্টা না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা অসম্ভব। সব শুনে অনুপমার কেঁদে ফেলে, দাঁতে দাঁত পিষে ছলছল চোখে দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে।
পরাশরের সাথে ডাক্তারের কথাবার্তা হয়। অনুপমা চুপচাপ আই.সি.ইউ তে বসে থাকে। ওইদিকে ওর ফোনে শ্রেয়া, পায়েল জারিনা রূপক এরা সবাই ফোন করে করে হয়রান। পরাশর ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। কাঁচের ঘরের মধ্যে শায়িত অচৈতন্য দেবায়ন আর তার পাশে কঠিন রক্তশূন্য থমথমে চেহারা নিয়ে বসে অনুপমা। পরাশর সবাইকে এক কথা জানায় ওরা এখন দেবায়নের খোঁজ করছে। দেবশ্রীর খবর জানতে চাইলে সবাই জানায়, কেউই আর ভয়ে দেবায়নের বাড়ি যায়নি।
পরেরদিন বিকেল নাগাদ দিলিপ বাবু দেরাদুনে এসে হাজির হন। পরাশর সংক্ষেপে দেবায়নের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানায়। দেবায়নকে নিস্তেজ নির্জীবের মতন পরে থাকতে দেখে ওনার মাথায় রক্ত উঠে যায়। দেবায়নের চোখ আর খোলে না দেখে অনুপমা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। ডাক্তারেরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যায় দেবায়নের জ্ঞান ফেরাবার জন্য কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয় না।
দিলিপ বাবুকে দেখে অনুপমার মনে কিঞ্চিত শক্তির সঞ্চার হয়, ছলছল চোখে দিলিপ বাবুর হাত ধরে অনুরোধ করে, “আমার খুব ভয় করছে। কার কাছে যাবো কিছুই ঠিক করতে পারছি না, একটু সাহায্য করবেন?”
দিলিপ বাবু ওর হাত ধরে অভয় দিয়ে বলে, “এই ভাবে কেন বলছ? আমার ওপরে তোমার অধিকার আছে, তুমি একবার আদেশ কর, সব কিছু করতে রাজি আছি আমি।”
পরাশর ওর হাত ধরতেই অনুপমা ভেঙ্গে পড়ে, “কি হবে রে, দুই দিন হয়ে গেল পুচ্চু যে চোখ খুলছে না।”
পরাশর ওকে জড়িয়ে ধরে অভয় প্রদান করে বলে, “এই মেয়ে, তুই চোখের জল ফেললে হবে কি করে? তোর বিয়ের পিঁড়ি উঠানো বাকি, ওর বিয়েতে নাচতে বাকি। এত তাড়াতাড়ি তুই ভেঙ্গে পড়লে কি করে হবে?”
অনুপমা কাতর কণ্ঠে দিলিপ বাবুকে বলে, “আপনি প্লিস দেবায়ন কে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যান, ওইখানে ওর চিকিৎসা করাতে শুরু করুন। আমি ওর মামনিকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবো।”
সারাটা রাত কঠিন চাপা উৎকণ্ঠায় আর বিনিদ্র রজনী কেটে যায়। অনুপমা ক্ষণিকের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারে না। দেবায়নের পাশে ঠায় বসে থাকে, এই অপেক্ষায় কখন চোখ খুলবে। ভোরের দিকে অনুপমার চোখে একটু তন্দ্রা ভাব লেগেছিল কিন্তু ওর তন্দ্রার ঘোর একটা যান্ত্রিক আওয়াজে কেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নার্সদের ডাক দেয় অনুপমা। নার্স এসে যন্ত্র দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে। ডাক্তার নার্সদের দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে অনুপমা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। অনুপমাকে বলা হয় রুমের বাইরে যেতে। ডাক্তারেরা বেশ কিছুক্ষণ অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ পত্র ইত্যাদি চালিয়ে দেবায়নকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে যায়। চাপা উৎকণ্ঠায় অনুপমার প্রান ওষ্ঠাগত। হটাত দেবায়নের কি হল? অপারেশান থিয়েটাররে সামনে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকে অনুপমা। একজন ডাক্তার বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে অপারেশান থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এসে ওদের খবর দেয় দেবায়ন কোমায় চলে গেছে। সেই খবর শুনে অনুপমা চোখে অন্ধকার দেখে। তিন রাত ঠিক ভাবে ঘুমায়নি, ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া হয়নি। এমনিতে নিজে খুব ক্লান্ত আর দুর্বল ছিল। তাই ওই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পরাশর ওকে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে।
জ্ঞান ফেরার পরে অনুপমা চোখ খুলে দেখে নিজেই একটা হসপিটালের বিছানায় শুয়ে। চোখ খুলেই দেখে ওর পাশে মাথা নিচু করে পরাশর আর দিলিপ বাবু বসে। ওদের এইভাবে নত মস্তক হয়ে থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। পরাশর কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। একা একা কত দিক সামলাবে কিছুই ঠিক করতে পারে না।
অনুপমা ছলছল চোখে পরাশরকে জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তারেরা কি বলছে রে?”
পরাশর আর দিলিপ বাবু দুই জনেই মাথা নিচু করে থাকে। ওদের ওইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমা নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।
পরাশর ওকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে, “এখন আমাদের হাতে বিশেষ কিছু নেই রে অনুপমা।”
অনুপমা বুক ভাঙ্গা চিৎকার করে ওঠে, “না……”
দিলিপ বাবু ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রবোধ দিয়ে বলেন, “এইখানে এই অবস্থায় দেবায়নকে রেখে লাভ নেই। আমি তোমাদের ব্যঙ্গালোর নিয়ে যেতে চাই। ওইখানে ভালো ডাক্তার আছে, ওইখানে না হলে বাইরে যাওয়া যাবে। তুমি চিন্তা কর না, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। সবার মুখে এক কথা দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু দেবায়ন যে কোমায় চলে গেছে। মামনিকে কি উত্তর দেবে, কতদিন পরে দেবায়ন চোখ খুলবে, আদৌ কি আর চোখ খুলবে?
অনুপমা অনেকক্ষণ পরে চোখের জল মুছে পরাশরকে বলে, “আমি একাই আততায়ীকে এর শাস্তি দেব।”
পরাশর প্রমাদ গোনে, এই অবস্থায় অনুপমার পক্ষে একা সব দিক সামলানো অসম্ভব ব্যাপার, নিজেও একা কি ভাবে কি সামলাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। পরাশর ওকে শান্ত করে বলে, “মাথা ঠাণ্ডা কর। তুই একা নস, আমি ও তোর পাশে আছি। যা হবার দেখা যাবে। আততায়ীর যদি সূর্য অথবা ধৃতিমান হয় তাহলে পরের আঘাত কাকিমার ওপরে আসবে। যত তাড়াতাড়ি কাকিমাকে কোলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলা ভালো। আর আততায়ী যদি অন্য কেউ হয় তাহলে পরের আঘাত তোর ওপরে হানবে, সেই মতন আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
অনুপমা দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “এর শেষ কোথায় দেখতে চাই।”
দিলিপ বাবু হসপিটাল কত্রিপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলে, আলোচনা সেরে দেবায়নকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে নেন। দিলিপ বাবু জানান ব্যাঙ্গালোরে তাঁর অনেক চেনাজানা ডাক্তার আর হসপিটাল আছে। সেখানে নিয়ে নিজেস্ব তত্তাবধনে দেবায়নের চিকিৎসা শুরু করবেন।
পরেরদিন সকালে প্লেনে দেবায়নকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় সবাই। দিল্লী হয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। ব্যাঙ্গালোরে দিলিপ বাবুর চেনাশোনা একটা বড় হসপিটালে দেবায়নকে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই কয়দিনে দেবায়নের আর অনুপমার খবর নেওয়ার জন্য সবাই কোলকাতা থেকে ফোন করে, কিন্তু অনুপমার নির্দেশ অনুযায়ী পরাশর সবাইকে এক কথা জানায়, যে এখন ওরা দেবায়নকে খুঁজে পায়নি। পারমিতা, সোমেশ বাবু মেয়ের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন, কিন্তু অনুপমা কারুর সাথে কথা বলে না। ওর মাথায় শুধু একটা চিন্তা, এই দুর্ঘটনার পেছনে আসল দোষী কে আর কি তার উদ্দেশ্য।
পরেদিন চাপা উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে পরাশরকে সঙ্গে করে অনুপমা কোলকাতার উদ্ধেশ্যে রওনা দেয়। বুকের মধ্যে চাপা ভয়, এই খবর শুনে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে। ব্যাঙ্গালোর থেকে প্লেনে চড়ার আগেই ফেরার টিকিট কেটে নিয়েছিল পরাশর, জানে, একবার এই খবর দেবায়নের মায়ের কাছে পৌঁছালে তৎক্ষণাৎ এক মা তাঁর ছেলের কাছে আসতে চাইবে। প্লেনে ওঠা মাত্রই অনুপমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। কোলকাতা নেমে মামনিকে কি বলবে, কি ভাবে মামনির সামনে দাঁড়াবে, কি বলে মামনিকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে আসবে, এই ভাবতে ভাবতে ওদের প্লেন কোলকাতা এয়ারপোর্টে নামে। পরাশর শুধু মাত্র জারিনাকে জানিয়ে রেখেছিল যে ওরা কোলকাতা আসছে। তাই জারিনা তার বাবাকে নিয়ে ওদের জন্য কোলকাতা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিল। পরাশরের মুখে দেবায়নের বিষয়ে সব কিছু শোনার পরে জারিনার বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি জানান তাঁর জানাশোনা ডাক্তার দের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন।
গাড়িতে উঠে লেকটাউনে দেবায়নের বাড়ির সামনে আসতেই অনুপমার হৃদপিণ্ড গলায় এসে আটকে যায়। বাড়ির মধ্যে মামনি নিশ্চয় নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজে ব্যাস্ত। ছেলে বেড়াতে গেছে, যেখানে গেছে সেখানে মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যায়না। ওদের কথা ছিল, খাটলিং থেকে ঘুট্টু ফিরে প্রায় দশ দিন পরে সবাই বাড়িতে ফোন করবে। ইতিমধ্যে যে এত কান্ড ঘটে গেছে সেই খবর দেবায়নের মাকে জানানোর সাহস কারুর মধ্যে কুলায়নি। পরাশর আর অনুপমা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
পরাশর ওর কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়ে বলে, “ভেতরে যা, আমি পেছনে আছি।”
অনুপমা চোখ বুজে একবার দেবায়নের নির্জীব চেহারা বুকের মধ্যে এঁকে নেয় তারপরে কলিং বেল বাজিয়ে চাপা উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দরজা খোলার অপেক্ষায়।
এই অসময়ে কলিং বেল বেজে উঠতে দেবশ্রী তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে অনুপমা কে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। স্মিত হেসে ওর গালে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস, “কেমন ঘুরলি রে তোরা? শরীর খারাপ করেনি তো?” তারপরে পেছনে পরাশরকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁরে বাকিরা কোথায়?”
মামনির মিষ্টি হাসি আর মাতৃসুলভ আচরন দেখে অনুপমার চোখ ফেটে জল চলে আসে। সেই মুক বেদনা দেবশ্রীর চোখ এড়াতে পারে না। বুক কেঁপে ওঠে দেবশ্রীর কম্পিত কণ্ঠে অনুপমা আর পরাশরকে প্রশ্ন করে, “দেবু কোথায় রে? তোদের সাথে আসেনি কেন?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, এইবারে ওকে গভীর জলে ঝাঁপ দিতে হবে। কি ভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারে না অনুপমা। মামনির দুই হাত ধরে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে বলে, “দেবায়ন কিছু কারনে আসতে পারেনি, মামনি।”
অনুপমার ধরা গলা আর ছলছল চোখ দেখে দেবশ্রীর সন্দেহ হয়, ওকে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে দেবায়নের?”
মামনির প্রশ্নের সঠিক উত্তর অনুপমার অজানা তাই চোয়াল চেপে অশ্রু সংবরণ করে চুপচাপ মাথা নিচু করে মামনির হাত ধরে বসে থাকে।
পরাশর বুক ঠুকে দেবশ্রীকে বলে, “তোমাকে আমাদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
শূন্য চোখে একবার পরাশরের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে তাকায় দেবশ্রী। ওর চোখের সামনে সারা পৃথিবী নড়তে শুরু করে দেয়। দেবশ্রী কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমার দেবু, ঠিক আছে না…..?”
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না দেবশ্রী। মায়ের হৃদয় ফাঁকা হয়ে যায় সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। খুব কম বয়সে নিজের স্বামীকে হারিয়েছে, এক মাত্র ছেলেকে বুকে করে ধরে মানুষ করেছে। চোখ বন্ধ করে ইষ্ট নাম নিয়ে কাতর প্রার্থনা জানায়, এক মাত্র সন্তানের চিতায় অগ্নি প্রদানের শাস্তি যেন ভগবান ওকে না দেয়।
পরাশর দেবশ্রীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত ধরে বলে, “তুমি গেলে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চল আমাদের সাথে।”
দেবশ্রীর প্রশ্ন করার মতন কোন শক্তি ছিল না। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে অনুপমার কোলে ঢলে পরে। পরাশর রান্না ঘর থেকে জল এনে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। শূন্য চাহনি নিয়ে অনুপমা আর পরাশরের দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে দেবশ্রী, ওর পৃথিবী খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে।
অনুপমার হাত ধরে দেবশ্রী প্রশ্ন করে, “সত্যি বল কি হয়েছে দেবুর?”
অনুপমার জানে ও ভেঙ্গে পড়লে ওর মামনি ভেঙ্গে পরবে তাই অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে অভয় দিয়ে বলে, “তুমি চল না আমাদের সাথে, তুমি গেলেই দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবশ্রী আর কথা বাড়ায় না, মেয়েটা ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। কোন রকমে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ওদের সাথে বেড়িয়ে পরে। আসার সময়ে রাতের প্লেনে ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েছিল। প্লেনে ওঠার আগেই পরাশর দিলিপ বাবুকে জানিয়ে দেয় যে ওরা দেবায়নের মাকে নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবে। ওদের নির্দেশ অনুযায়ী দিলিপ বাবু গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে সোজা হসপিটালে নিয়ে যায় দেবশ্রীকে। একমাত্র ছেলেকে নির্জীবের মতন বিছানায় পরে থাকতে দেখে দেবশ্রীর পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। ছলছল চোখে শুধু মাত্র অনুপমার রক্ত শূন্য বেদনা যুক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। অনুপমা এক এক করে সবিস্তারে দেবায়নের দুর্ঘটনা মামনির সামনে তুলে ধরে।
অনুপমার সাহস আর অনুপমার ধৈর্য শক্তি দেখে দেবশ্রী অবাক হয়ে যায়, ওকে প্রশ্ন করে, “তুই কি করে নিজেকে সামলে রেখেছিস?”
অনুপমা আর নিজেকে সামলাতে পারে না, “তোমার সামনে কি করে…..” মামনিকে জড়িয়ে ধরে শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পরে অনুপমা। ওর আশা ওর ভরসা ওর সব কিছু যেন জলে ভেসে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
পরেরদিন সকালে দিলিপ বাবু আর তাঁর স্ত্রী কণিকার তত্বাবধানে মামনি আর দেবায়নকে রেখে অনুপমা আর পরাশর আততায়ীর খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে। কোলকাতা ফিরে আসার আগে দিলিপ বাবু ওদের জানিয়ে দেয় আর কোন সাহায্যের দরকার হলে যেন তাঁকে জানাতে না ভোলে।
যাওয়ার আগে দেবশ্রীর পায়ে হাত দিয়ে সংকল্প করে অনুপমা, “আমি কথা দিচ্ছি মামনি…..”
দেবশ্রী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ছেলের কি হবে জানিনা তবে তোকে হারাতে আমি চাই না রে।”
পরাশর দেবশ্রীকে অভয় দিয়ে বলে, “আপনার ছেলেও হারাবে না আর অনুপমাও হারাবে না। দুই জনেই ভালো হয়ে ফিরে আসবে কথা দিলাম।”
প্লেনে উঠে অনুপমাকে প্রশ্ন করে পরাশর, “এই বারে কি করনীয়? কাকিমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর ফলে তোর ওপরে আততায়ীর নজর আরো বেড়ে যাবে। যেভাবে আততায়ী জঙ্গলের পথে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পালিয়ে গেছে তাতে মনে হয় ওই আততায়ী এক নয় ভাড়া করা পাহাড়ি লোক না হয় অনেকদিন থেকেই দেবায়ন কে মারার ষড়যন্ত্র করেছে।”
দেবায়নের অতি সঙ্গীন শারীরিক অবস্থা দেখে অনুপমার খুব ভয় হয়। হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি খুব ধীরে ধীরে চলছে, মাথায়, হাতে পায়ে সব জায়গায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। ওর চঞ্চল পুচ্চুকে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। অনেকক্ষণ দেবায়নের ঠাণ্ডা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে পাশে বসে থাকে। পরাশর ততক্ষণ রঞ্জিত আর বাড়ির কর্তার সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। বাড়ির কর্তা ওদের জানায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে কোন বড় হসপিটালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করে দিতে। রঞ্জিত জানায় দেরাদুনে ভালো হসপিটাল আছে সেইখানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেবায়নকে নিয়ে ওদের রওনা হওয়া উচিত। অনুপমা আর দেরি করেনা, রঞ্জিত দেরাদুনের একটা বড় হসপিটালের সাথে কথাবার্তা সেরে ফেলে। ওদের সঙ্গের যে গাড়ি ছিল সেই গাড়িতে দেবায়নকে নিয়ে ওরা দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সামনের সিটে পরাশর আর রঞ্জিত পেছনে দেবায়নের মাথা কোলে অনুপমা। বাড়ির কর্তাকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা চারজনে দেরাদুনের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
অসাড় দেবায়নের মাথা বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে অনুপমা চাপা আশঙ্কায় প্রহর গুনতে গুনতে দেরাদুনের দিকে যাত্রা শুরু করে। পথে যেতে যেতে পরাশরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেয়, “শোন এই খবর যেন কোন মতে কোলকাতা না পৌঁছায়, বুঝলি।”
পরাশর জিজ্ঞেস করে, “কেন রে, দেরাদুনে কেমন চিকিৎসা হবে সেটা ঠিক জানি না। কোলকাতা নিয়ে গেলে ভালো হত না? আর কাকিমাকেও এই বিষয়ে জানাতে হবে ত নাকি?”
অনুপমার গলা ধরে আসে, বুকের কাছে দেবায়নের মাথা চেপে ধরা গলায় পরাশরকে বলে, “খুব ভয় লাগছে রে, কি করব?”
পরাশর ওকে অভয় দিয়ে বলে, “কিছু হবে না। অত ওপর থেকে পরে যখন বেঁচে গেছে তখন ওর জীবন অনেক শক্ত। তুই চিন্তা করিস না দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে পরাশরকে উত্তর দেয়, “জানিনা রে, ওকে চোখের আড়াল করতে একদম ইচ্ছে করছে না। তুই একটা কাজ করবি?” পরাশর মাথা দুলিয়ে জানায় সব কিছু করতে রাজি। অনুপমা ওকে বলে, “ওকে হসপিটালে ভর্তি করে তুই কোলকাতা চলে যাস। মামনিকে বিশেষ কিছু এখন জানাস না। তুই প্লিস কিছু করে মামনিকে নিয়ে দেরাদুনে চলে আসিস।” কিছুক্ষণ থেমে বলে ভাবুক কণ্ঠে ওকে বলে, “কে আসল আততায়ী সেটা না জানা পর্যন্ত আমাদের খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। দেবায়ন বেঁচে আছে জানতে পারলে আততায়ী সতর্ক হয়ে যাবে, দ্বিতীয় বার ওর ওপরে হামলা করতে পারে। আমরা এখন জানিনা আততায়ী আমাদের নিজেদের কেউ না বাইরের কেউ সুতরাং এই খবর কোন মতেই যেন কোলকাতা না পৌঁছায়। আততায়ী নিশ্চয় আমাদের ওপরে কড়া নজর রেখে চলেছে না হলে আততায়ী এত দুর এসে দেবায়নকে মারতে চেষ্টা করত না। সুতরাং শ্রেয়া পায়েলকেও এই খবর জানানো যাবে না। ওরা জানতে পারলে নিশ্চয় এইখানে আসতে চাইবে আর ওদের পিছু নিয়ে আততায়ী এইখানে এসে পৌঁছে যাবে।”
পরাশর বলে, “কিন্তু সেটা কাকিমার ক্ষেত্রেও হতে পারে। আমি যদি কাকিমাকে নিয়ে বের হই তাহলে আততায়ীর সন্দেহ হতে পারে। তার চেয়ে ভালো আমি এইখানে থাকি আর তুই কোলকাতা ফিরে যা। তোকে একা কোলকাতা ফিরতে দেখলে আততায়ীর সন্দেহ দুর হয়ে যাবে যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই। আর কাকিমাকে বলে বুঝিয়ে আনা একমাত্র তোর পক্ষেই সম্ভব। এরপরে দেবায়নকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারলে খুব ভালো হয়, মানে কোলকাতার বাইরে কোথাও যদি কোন বিস্বস্ত লোক থাকে তার কাছে হলে ভালো হয়।”
কিছুক্ষণ ভেবে অনুপমা ওকে বলে, “হ্যাঁ তুই ঠিক বলেছিস। দেখি একবার ব্যাঙ্গালোর ফোন করে। আমাদের এক হোটেলের মালিক দিলিপ বাবু নিশ্চয় আমাদের এই অবস্থায় সাহায্য করবেন।”
পরাশর ওকে বলে, “ঠিক আছে তুই দিলিপ বাবুকে ফোন করে দে আর আমি কাকুকে একটা ফোন করে দেই। আততায়ীকে খুঁজতে কাকুর সাহায্য আমাদের খুব দরকার পরবে।”
অনুপমা মাথা দোলায়, পরাশরের কাকা ক্রাইম ব্রাঞ্চের ইনস্পেকটর নিরঞ্জন বাবু, পায়েলের সময়ে ওদের খুব সাহায্য করেছিল। পরাশর সঙ্গে সঙ্গে কাকাকে ফোনে দেবায়নের নিরুদ্দেশের বিষয়ে কিঞ্চিত খবর দিয়ে বলে এই বিষয়ে যেন কাউকে না জানায়। নিরঞ্জন বাবু ওদের জানায়, সব রকমের সাহায্য করবেন তিনি।
অনুপমা দিলিপ বাবুকে ফোন করে বিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে দিলিপ বাবু খুব ব্যাস্ত হয়ে পরেন, তিনি জানিয়ে দেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি দেরাদুনে পৌঁছে যাবেন। এক সময়ে অনুপমা আর দেবায়ন তাঁর জন্য যা করেছিল তাঁর প্রতিদান এখন শোধ করা হয়নি। দেরাদুনে পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। হসপিটালে আগে থেকে কথা বলা ছিল তাই ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি ওদের।
ডাক্তার দেবায়নকে পরীক্ষা করে জানায়, বেশ কয়েক জায়গায় হাড় ভেঙ্গে গেছে, চার পাঁচ দিন ঠাণ্ডা জলে থাকার ফলে হাইপোথারমিয়া আর ইন্টারনাল হ্যামারেজ হয়েছে। লিভারে আর ফুসফুসে জল ঢুকে গেছে। হৃদয় খুব ধীরে ধীরে চলছে। মাথার পেছনে আর ঘাড়ে বেশ জোর আঘাত পেয়েছে। দেবায়নকে বেশ কিছুদিন আই.সি.ইউ তে পর্যবেক্ষণের জন্য রাখতে চায়, জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অথবা বাহাত্তর ঘন্টা না যাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা অসম্ভব। সব শুনে অনুপমার কেঁদে ফেলে, দাঁতে দাঁত পিষে ছলছল চোখে দেবায়নের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে ওর পাশে বসে পড়ে।
পরাশরের সাথে ডাক্তারের কথাবার্তা হয়। অনুপমা চুপচাপ আই.সি.ইউ তে বসে থাকে। ওইদিকে ওর ফোনে শ্রেয়া, পায়েল জারিনা রূপক এরা সবাই ফোন করে করে হয়রান। পরাশর ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে। কাঁচের ঘরের মধ্যে শায়িত অচৈতন্য দেবায়ন আর তার পাশে কঠিন রক্তশূন্য থমথমে চেহারা নিয়ে বসে অনুপমা। পরাশর সবাইকে এক কথা জানায় ওরা এখন দেবায়নের খোঁজ করছে। দেবশ্রীর খবর জানতে চাইলে সবাই জানায়, কেউই আর ভয়ে দেবায়নের বাড়ি যায়নি।
পরেরদিন বিকেল নাগাদ দিলিপ বাবু দেরাদুনে এসে হাজির হন। পরাশর সংক্ষেপে দেবায়নের দুর্ঘটনার বিষয়ে জানায়। দেবায়নকে নিস্তেজ নির্জীবের মতন পরে থাকতে দেখে ওনার মাথায় রক্ত উঠে যায়। দেবায়নের চোখ আর খোলে না দেখে অনুপমা খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। ডাক্তারেরা যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যায় দেবায়নের জ্ঞান ফেরাবার জন্য কিন্তু দেবায়নের শারীরিক অবস্থার কোন উন্নতি হয় না।
দিলিপ বাবুকে দেখে অনুপমার মনে কিঞ্চিত শক্তির সঞ্চার হয়, ছলছল চোখে দিলিপ বাবুর হাত ধরে অনুরোধ করে, “আমার খুব ভয় করছে। কার কাছে যাবো কিছুই ঠিক করতে পারছি না, একটু সাহায্য করবেন?”
দিলিপ বাবু ওর হাত ধরে অভয় দিয়ে বলে, “এই ভাবে কেন বলছ? আমার ওপরে তোমার অধিকার আছে, তুমি একবার আদেশ কর, সব কিছু করতে রাজি আছি আমি।”
পরাশর ওর হাত ধরতেই অনুপমা ভেঙ্গে পড়ে, “কি হবে রে, দুই দিন হয়ে গেল পুচ্চু যে চোখ খুলছে না।”
পরাশর ওকে জড়িয়ে ধরে অভয় প্রদান করে বলে, “এই মেয়ে, তুই চোখের জল ফেললে হবে কি করে? তোর বিয়ের পিঁড়ি উঠানো বাকি, ওর বিয়েতে নাচতে বাকি। এত তাড়াতাড়ি তুই ভেঙ্গে পড়লে কি করে হবে?”
অনুপমা কাতর কণ্ঠে দিলিপ বাবুকে বলে, “আপনি প্লিস দেবায়ন কে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে যান, ওইখানে ওর চিকিৎসা করাতে শুরু করুন। আমি ওর মামনিকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবো।”
সারাটা রাত কঠিন চাপা উৎকণ্ঠায় আর বিনিদ্র রজনী কেটে যায়। অনুপমা ক্ষণিকের জন্য চোখের পাতা এক করতে পারে না। দেবায়নের পাশে ঠায় বসে থাকে, এই অপেক্ষায় কখন চোখ খুলবে। ভোরের দিকে অনুপমার চোখে একটু তন্দ্রা ভাব লেগেছিল কিন্তু ওর তন্দ্রার ঘোর একটা যান্ত্রিক আওয়াজে কেটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে নার্সদের ডাক দেয় অনুপমা। নার্স এসে যন্ত্র দেখে সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে। ডাক্তার নার্সদের দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে অনুপমা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। অনুপমাকে বলা হয় রুমের বাইরে যেতে। ডাক্তারেরা বেশ কিছুক্ষণ অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা, ওষুধ পত্র ইত্যাদি চালিয়ে দেবায়নকে নিয়ে অপারেশান থিয়েটারে নিয়ে যায়। চাপা উৎকণ্ঠায় অনুপমার প্রান ওষ্ঠাগত। হটাত দেবায়নের কি হল? অপারেশান থিয়েটাররে সামনে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকে অনুপমা। একজন ডাক্তার বেশ কয়েক ঘণ্টা বাদে অপারেশান থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এসে ওদের খবর দেয় দেবায়ন কোমায় চলে গেছে। সেই খবর শুনে অনুপমা চোখে অন্ধকার দেখে। তিন রাত ঠিক ভাবে ঘুমায়নি, ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া হয়নি। এমনিতে নিজে খুব ক্লান্ত আর দুর্বল ছিল। তাই ওই খবর শুনে সঙ্গে সঙ্গে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। পরাশর ওকে সঙ্গে সঙ্গে ধরে ফেলে।
জ্ঞান ফেরার পরে অনুপমা চোখ খুলে দেখে নিজেই একটা হসপিটালের বিছানায় শুয়ে। চোখ খুলেই দেখে ওর পাশে মাথা নিচু করে পরাশর আর দিলিপ বাবু বসে। ওদের এইভাবে নত মস্তক হয়ে থমথমে চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। পরাশর কি উত্তর দেবে ভেবে পায় না। একা একা কত দিক সামলাবে কিছুই ঠিক করতে পারে না।
অনুপমা ছলছল চোখে পরাশরকে জিজ্ঞেস করে, “ডাক্তারেরা কি বলছে রে?”
পরাশর আর দিলিপ বাবু দুই জনেই মাথা নিচু করে থাকে। ওদের ওইভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুপমা নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে।
পরাশর ওকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে, “এখন আমাদের হাতে বিশেষ কিছু নেই রে অনুপমা।”
অনুপমা বুক ভাঙ্গা চিৎকার করে ওঠে, “না……”
দিলিপ বাবু ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রবোধ দিয়ে বলেন, “এইখানে এই অবস্থায় দেবায়নকে রেখে লাভ নেই। আমি তোমাদের ব্যঙ্গালোর নিয়ে যেতে চাই। ওইখানে ভালো ডাক্তার আছে, ওইখানে না হলে বাইরে যাওয়া যাবে। তুমি চিন্তা কর না, দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
অনুপমা মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে। সবার মুখে এক কথা দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু দেবায়ন যে কোমায় চলে গেছে। মামনিকে কি উত্তর দেবে, কতদিন পরে দেবায়ন চোখ খুলবে, আদৌ কি আর চোখ খুলবে?
অনুপমা অনেকক্ষণ পরে চোখের জল মুছে পরাশরকে বলে, “আমি একাই আততায়ীকে এর শাস্তি দেব।”
পরাশর প্রমাদ গোনে, এই অবস্থায় অনুপমার পক্ষে একা সব দিক সামলানো অসম্ভব ব্যাপার, নিজেও একা কি ভাবে কি সামলাবে ঠিক করে উঠতে পারে না। পরাশর ওকে শান্ত করে বলে, “মাথা ঠাণ্ডা কর। তুই একা নস, আমি ও তোর পাশে আছি। যা হবার দেখা যাবে। আততায়ীর যদি সূর্য অথবা ধৃতিমান হয় তাহলে পরের আঘাত কাকিমার ওপরে আসবে। যত তাড়াতাড়ি কাকিমাকে কোলকাতা থেকে সরিয়ে ফেলা ভালো। আর আততায়ী যদি অন্য কেউ হয় তাহলে পরের আঘাত তোর ওপরে হানবে, সেই মতন আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।”
অনুপমা দাঁতে দাঁত পিষে উত্তর দেয়, “এর শেষ কোথায় দেখতে চাই।”
দিলিপ বাবু হসপিটাল কত্রিপক্ষের সাথে কথাবার্তা বলে, আলোচনা সেরে দেবায়নকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে নেন। দিলিপ বাবু জানান ব্যাঙ্গালোরে তাঁর অনেক চেনাজানা ডাক্তার আর হসপিটাল আছে। সেখানে নিয়ে নিজেস্ব তত্তাবধনে দেবায়নের চিকিৎসা শুরু করবেন।
পরেরদিন সকালে প্লেনে দেবায়নকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায় সবাই। দিল্লী হয়ে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। ব্যাঙ্গালোরে দিলিপ বাবুর চেনাশোনা একটা বড় হসপিটালে দেবায়নকে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই কয়দিনে দেবায়নের আর অনুপমার খবর নেওয়ার জন্য সবাই কোলকাতা থেকে ফোন করে, কিন্তু অনুপমার নির্দেশ অনুযায়ী পরাশর সবাইকে এক কথা জানায়, যে এখন ওরা দেবায়নকে খুঁজে পায়নি। পারমিতা, সোমেশ বাবু মেয়ের জন্য বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন, কিন্তু অনুপমা কারুর সাথে কথা বলে না। ওর মাথায় শুধু একটা চিন্তা, এই দুর্ঘটনার পেছনে আসল দোষী কে আর কি তার উদ্দেশ্য।
পরেদিন চাপা উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা নিয়ে পরাশরকে সঙ্গে করে অনুপমা কোলকাতার উদ্ধেশ্যে রওনা দেয়। বুকের মধ্যে চাপা ভয়, এই খবর শুনে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে। ব্যাঙ্গালোর থেকে প্লেনে চড়ার আগেই ফেরার টিকিট কেটে নিয়েছিল পরাশর, জানে, একবার এই খবর দেবায়নের মায়ের কাছে পৌঁছালে তৎক্ষণাৎ এক মা তাঁর ছেলের কাছে আসতে চাইবে। প্লেনে ওঠা মাত্রই অনুপমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে ওঠে। কোলকাতা নেমে মামনিকে কি বলবে, কি ভাবে মামনির সামনে দাঁড়াবে, কি বলে মামনিকে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে আসবে, এই ভাবতে ভাবতে ওদের প্লেন কোলকাতা এয়ারপোর্টে নামে। পরাশর শুধু মাত্র জারিনাকে জানিয়ে রেখেছিল যে ওরা কোলকাতা আসছে। তাই জারিনা তার বাবাকে নিয়ে ওদের জন্য কোলকাতা এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিল। পরাশরের মুখে দেবায়নের বিষয়ে সব কিছু শোনার পরে জারিনার বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি জানান তাঁর জানাশোনা ডাক্তার দের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করবেন।
গাড়িতে উঠে লেকটাউনে দেবায়নের বাড়ির সামনে আসতেই অনুপমার হৃদপিণ্ড গলায় এসে আটকে যায়। বাড়ির মধ্যে মামনি নিশ্চয় নিশ্চিন্ত মনে নিজের কাজে ব্যাস্ত। ছেলে বেড়াতে গেছে, যেখানে গেছে সেখানে মোবাইল টাওয়ার পাওয়া যায়না। ওদের কথা ছিল, খাটলিং থেকে ঘুট্টু ফিরে প্রায় দশ দিন পরে সবাই বাড়িতে ফোন করবে। ইতিমধ্যে যে এত কান্ড ঘটে গেছে সেই খবর দেবায়নের মাকে জানানোর সাহস কারুর মধ্যে কুলায়নি। পরাশর আর অনুপমা পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
পরাশর ওর কাঁধে হাত রেখে সাহস দিয়ে বলে, “ভেতরে যা, আমি পেছনে আছি।”
অনুপমা চোখ বুজে একবার দেবায়নের নির্জীব চেহারা বুকের মধ্যে এঁকে নেয় তারপরে কলিং বেল বাজিয়ে চাপা উৎকণ্ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে দরজা খোলার অপেক্ষায়।
এই অসময়ে কলিং বেল বেজে উঠতে দেবশ্রী তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে অনুপমা কে দেখে বিস্মিত হয়ে যায়। স্মিত হেসে ওর গালে হাত দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস, “কেমন ঘুরলি রে তোরা? শরীর খারাপ করেনি তো?” তারপরে পেছনে পরাশরকে দেখে কিঞ্চিত অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁরে বাকিরা কোথায়?”
মামনির মিষ্টি হাসি আর মাতৃসুলভ আচরন দেখে অনুপমার চোখ ফেটে জল চলে আসে। সেই মুক বেদনা দেবশ্রীর চোখ এড়াতে পারে না। বুক কেঁপে ওঠে দেবশ্রীর কম্পিত কণ্ঠে অনুপমা আর পরাশরকে প্রশ্ন করে, “দেবু কোথায় রে? তোদের সাথে আসেনি কেন?”
বুক ভরে শ্বাস নেয় অনুপমা, এইবারে ওকে গভীর জলে ঝাঁপ দিতে হবে। কি ভাবে শুরু করবে, কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ঠিক করে উঠতে পারে না অনুপমা। মামনির দুই হাত ধরে বসার ঘরের সোফায় বসিয়ে বলে, “দেবায়ন কিছু কারনে আসতে পারেনি, মামনি।”
অনুপমার ধরা গলা আর ছলছল চোখ দেখে দেবশ্রীর সন্দেহ হয়, ওকে প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে দেবায়নের?”
মামনির প্রশ্নের সঠিক উত্তর অনুপমার অজানা তাই চোয়াল চেপে অশ্রু সংবরণ করে চুপচাপ মাথা নিচু করে মামনির হাত ধরে বসে থাকে।
পরাশর বুক ঠুকে দেবশ্রীকে বলে, “তোমাকে আমাদের সাথে এক জায়গায় যেতে হবে।”
শূন্য চোখে একবার পরাশরের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে তাকায় দেবশ্রী। ওর চোখের সামনে সারা পৃথিবী নড়তে শুরু করে দেয়। দেবশ্রী কম্পিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “আমার দেবু, ঠিক আছে না…..?”
আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না দেবশ্রী। মায়ের হৃদয় ফাঁকা হয়ে যায় সামনের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে। খুব কম বয়সে নিজের স্বামীকে হারিয়েছে, এক মাত্র ছেলেকে বুকে করে ধরে মানুষ করেছে। চোখ বন্ধ করে ইষ্ট নাম নিয়ে কাতর প্রার্থনা জানায়, এক মাত্র সন্তানের চিতায় অগ্নি প্রদানের শাস্তি যেন ভগবান ওকে না দেয়।
পরাশর দেবশ্রীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুই হাত ধরে বলে, “তুমি গেলে দেবায়ন নিশ্চয় ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চল আমাদের সাথে।”
দেবশ্রীর প্রশ্ন করার মতন কোন শক্তি ছিল না। চোখের সামনে সব কিছু অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করে দেয়। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে অনুপমার কোলে ঢলে পরে। পরাশর রান্না ঘর থেকে জল এনে চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরায়। শূন্য চাহনি নিয়ে অনুপমা আর পরাশরের দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে দেবশ্রী, ওর পৃথিবী খন্ড খন্ড হয়ে ভেঙ্গে যাচ্ছে ওর চোখের সামনে।
অনুপমার হাত ধরে দেবশ্রী প্রশ্ন করে, “সত্যি বল কি হয়েছে দেবুর?”
অনুপমার জানে ও ভেঙ্গে পড়লে ওর মামনি ভেঙ্গে পরবে তাই অশ্রু রুদ্ধ কণ্ঠে অভয় দিয়ে বলে, “তুমি চল না আমাদের সাথে, তুমি গেলেই দেবায়ন ঠিক হয়ে যাবে।”
দেবশ্রী আর কথা বাড়ায় না, মেয়েটা ওকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেটা পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে না। কোন রকমে একটা ব্যাগ গুছিয়ে ওদের সাথে বেড়িয়ে পরে। আসার সময়ে রাতের প্লেনে ব্যাঙ্গালোর ফিরে যাওয়ার টিকিট কাটা হয়েছিল। প্লেনে ওঠার আগেই পরাশর দিলিপ বাবুকে জানিয়ে দেয় যে ওরা দেবায়নের মাকে নিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ব্যাঙ্গালোর পৌঁছে যাবে। ওদের নির্দেশ অনুযায়ী দিলিপ বাবু গাড়ি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি করে সোজা হসপিটালে নিয়ে যায় দেবশ্রীকে। একমাত্র ছেলেকে নির্জীবের মতন বিছানায় পরে থাকতে দেখে দেবশ্রীর পাথরের মূর্তি হয়ে যায়। ছলছল চোখে শুধু মাত্র অনুপমার রক্ত শূন্য বেদনা যুক্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। অনুপমা এক এক করে সবিস্তারে দেবায়নের দুর্ঘটনা মামনির সামনে তুলে ধরে।
অনুপমার সাহস আর অনুপমার ধৈর্য শক্তি দেখে দেবশ্রী অবাক হয়ে যায়, ওকে প্রশ্ন করে, “তুই কি করে নিজেকে সামলে রেখেছিস?”
অনুপমা আর নিজেকে সামলাতে পারে না, “তোমার সামনে কি করে…..” মামনিকে জড়িয়ে ধরে শেষ পর্যন্ত ভেঙ্গে পরে অনুপমা। ওর আশা ওর ভরসা ওর সব কিছু যেন জলে ভেসে যাচ্ছে বলে মনে হয়।
পরেরদিন সকালে দিলিপ বাবু আর তাঁর স্ত্রী কণিকার তত্বাবধানে মামনি আর দেবায়নকে রেখে অনুপমা আর পরাশর আততায়ীর খোঁজে বেড়িয়ে পড়ে। কোলকাতা ফিরে আসার আগে দিলিপ বাবু ওদের জানিয়ে দেয় আর কোন সাহায্যের দরকার হলে যেন তাঁকে জানাতে না ভোলে।
যাওয়ার আগে দেবশ্রীর পায়ে হাত দিয়ে সংকল্প করে অনুপমা, “আমি কথা দিচ্ছি মামনি…..”
দেবশ্রী ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “ছেলের কি হবে জানিনা তবে তোকে হারাতে আমি চাই না রে।”
পরাশর দেবশ্রীকে অভয় দিয়ে বলে, “আপনার ছেলেও হারাবে না আর অনুপমাও হারাবে না। দুই জনেই ভালো হয়ে ফিরে আসবে কথা দিলাম।”
প্লেনে উঠে অনুপমাকে প্রশ্ন করে পরাশর, “এই বারে কি করনীয়? কাকিমাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এর ফলে তোর ওপরে আততায়ীর নজর আরো বেড়ে যাবে। যেভাবে আততায়ী জঙ্গলের পথে পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে পালিয়ে গেছে তাতে মনে হয় ওই আততায়ী এক নয় ভাড়া করা পাহাড়ি লোক না হয় অনেকদিন থেকেই দেবায়ন কে মারার ষড়যন্ত্র করেছে।”