06-10-2020, 09:11 PM
পাপ কাম ভালোবাসা [পর্ব ২৯][শেষ পর্ব]
পর্ব ২৯ (#০১)
মুখের ওপরে জলের ছিটা পড়তেই অনুপমার জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলে শ্রেয়াকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে অনুপমা, “পুচ্চুকে পেলি?”
শ্রেয়া ওর কপালে হাত বুলিয়ে মৃদু মাথা নাড়িয়ে বলে, “না রে এখন পাওয়া যায়নি। তবে তুই চিন্তা করিস না…..”
চারপাশে সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে, সবার চোখে মুখে চাপা উৎকণ্ঠার ছাপ। সবাই এইখানে আনন্দ ফুর্তি করতে এসেছিল, অকস্মাৎ এই দুর্ঘটনায় সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। রূপক, শান্তনু রঞ্জিত খাদের চারপাশে খুঁজে খুঁজে কোন চিহ্ন না পেয়ে হয়রান হয়ে ফিরে এসেছে। অনুপমা চুপচাপ বসে ভাঙ্গা বুক আর অসীম বেদনা নিয়ে সবার দিকে ছলছল চোখে তাকায়। এক ধাক্কায় ওর সাধের পৃথিবী উজাড় হয়ে গেছে। ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দেবায়ন ছাড়া কোলকাতা ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। দেবায়ন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারছে না কিছুতেই। ওর অঙ্গে, ওর হৃদয়ের সর্বত্রে ওর ভালোবাসার ছাপ অঙ্কিত। অনামিকার আংটি ওকে বারবার মনে করিয়ে দেয় এই ডিসেম্বরে ওদের বিয়ের কথা চলছিল। স্বপ্ন দেখেছিল এই পাহাড়ের কোলে ঘর বাঁধবে। শ্রেয়ার বাহুপাশ থেকে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কুঁকড়ে বসে যায়। ওকে ছাড়া ওর জীবনে রঙ উবে গেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পরে গাইড রঞ্জিতকে অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “তোমার দলের একটা পোর্টার এসেছিল ওকে ডাকতে, সে নিশ্চয় জানে দেবায়ন কোথায়। তাকে ডাক।”
রূপক উত্তরে বলে, “না রে ওই ছেলেটা ভুয়ো। রাজু নামে আমাদের দলে কোন পোর্টার নেই। আমার মনে হয়…..”
অনুপমা বিস্ফোরিত চোখে রূপকের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “ওই নামে পোর্টার নেই মানে? তাহলে পুচ্চুকে…..”
দৃষ্টি আবার ঝাপসা হয়ে আসে অনুপমার, কিছু আর ভাবতে পারছে। কম্পিত কণ্ঠে রূপককে জিজ্ঞেস করে, “তুই কোথায় কোথায় পুচ্চকে খুঁজেছিস?”
রূপক, শান্তনু সবাই জানায় ওরা চারদিকে দেবায়নকে খুঁজেছে কিন্তু কোথাও ওর চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অনুপমা নিজেই ওকে খুঁজতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকট করে। সবার মানা করা সত্ত্বেও অনুপমা একাই যেদিকে দেবায়ন গিয়েছিল সেদিকে হাঁটা দেয়। ওকে ওইভাবে উন্মাদিনীর মতন হাঁটতে দেখে পায়েল আর শ্রেয়া দৌড়ে এসে ওকে ধরে ফেলে। কিন্তু অনুপমা ওদের হাত ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাদের কিনারায় চলে আসে। চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা, শুধু মাত্র ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর গভীর খাদের নীচে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না।
গলা ছেড়ে ডাক দেয় অনুপমা, “পুচ্চুউউউউউউ…… তুই কোথায়?”
ওর হৃদয় ভাঙ্গা বেদনা যুক্ত কণ্ঠস্বর সামনের পাহাড়ে আর জঙ্গলে প্রতিধ্বনি হয়ে ওর কানে ফিরে আসে। অনুপমা বারেবারে ডাক দেয় কিন্তু পাথরের পাহাড় থেকে কোন উত্তর আসে না। বাকিরা সবাই টর্চ নিয়ে খাদের নিচের দিকে খোঁজে কিন্তু কোথাও দেবায়নের চিহ্ন পাওয়া যায় না। এপাশ ওপাশ খুঁজতে খুঁজতে অঙ্কন কিছু একটা দেখতে পেয়ে বাকিদের ডাক দেয়। অনুপমা দৌড়ে যেতেই অঙ্কন ওর হাতে দেবায়নের পার্স ধরিয়ে দেয়। পার্স দেখেই অনুপমার চোখ ছলছল করে ওঠে, বুকের মধ্যে পার্স লুকিয়ে দেবায়নের নাম ধরে বারেবারে ডাক দেয়। কিন্তু ওর শূন্য ডাকের সারা আর পাওয়া যায়না। টর্চের আলোয় খাদের পাশে রক্তের দাগ দেখে অনুপমার বুক আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পুচ্চু কি সত্যি সত্যি ওকে ছেড়ে চলে গেছে?
দেবায়নের বিরহে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায় অনুপমা। বাম হাত বুকের কাছে চেপে পুনরায় গলা ফাটিয়ে ডাক দেয় অনুপমা, “পুচ্চুউউউউ প্লিস সোনা তুই এইভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না।”
টর্চের আলোয় চারপাশে খুঁজে দেবায়নের পার্স ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়না। খাদের কিনারা থেকে বেশ কিছু মাটি পাথর ধ্বসে গেছে। ওই দেখে বাকিদের ধারনা হয় যে দেবায়ন এই খাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কিন্তু অনুপমার হৃদয় কিছুতেই মানতে নারাজ যে দেবায়ন আর ওদের মাঝে নেই। অনুপমা খাদের কিনারায় চুপচাপ কুঁকড়ে বসে পড়ে, দেবায়নের পার্স বুকের কাছে চেপে ধরে উচ্চস্বরে বারেবারে ডাক দেয়। শ্রেয়া, পায়েল ওকে ধরে থাকে পাশে বেদনায় অনুপমা খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয় এই আশঙ্কায়। বাকিরা সবাই টর্চ নিয়ে এপাশ ওপাশ খুঁজে ক্লান্ত এক সময়ে টেন্টের দিকে হাঁটা দেয়, কিন্তু অনুপমা ওই জায়গা থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। অনুপমা জেদ ধরে বসে থাকে, দড়ি নিয়ে আসো, এই রাতেই দড়ি বেয়ে ওই খাদের মধ্যে নামতে চায়। নদীর তীরে নিশ্চয় কোথাও দেবায়নকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই কনকনে ঠাণ্ডা জলে দেবায়ন বেশিক্ষণ থাকলে ওর হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে, ওর মৃত্যুর আশঙ্কা আরো বেড়ে যাবে।
অনুপমাকে কিছুতেই শান্ত করা সম্ভব হয় না দেখে শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওকে খুব বকুনি দিয়ে বলে, “এই রাতে এই খাদের মধ্যে নামবি, তুই পাগল হয়েছিস নাকি?”
সারা রাত অনুপমা ওই খাদের কিনারায় কনকনে ঠাণ্ডায় বসে থাকে। নিরুপায় হয়ে শ্রেয়া আর পায়েল একটা স্লিপিং ব্যাগ ওর শরীরে জড়িয়ে দেয়। জানে ওই খাদে না নামা পর্যন্ত অনুপমাকে এইখান থেকে নড়ানো সম্ভবপর নয়। অগত্যা বাকিরাও সবাই পালা করে অনুপমাকে পাহারা দেয়।
সারা রাত বসে ভাবে অনুপমা, কে ওর দেবায়ন কে এই নির্জন স্থানে এসে মারতে চেষ্টা করতে পারে। ওর সন্দেহের তালিকার মধ্যে অনেকের নাম আসে, কিন্তু কারুর দিকে সন্দেহের তীর হানার আগে তথ্য প্রমান সংগ্রহ করতে হবে। ওকে এই ভাবে কাঁদলে চলবে না। এই খবর মামনির কানে পৌঁছালে মামনি খুব ভেঙ্গে পরবে, মামনিকে সামলাতে হবে।
সকালের সূর্য পুব দিক থেকে উঁকি মারতেই অনুপমা রঞ্জিতকে অনুরোধ করে দেবায়নকে খোঁজার জন্য। নিজেই খাদের কিনারা ভালো ভাবে তল্লাসি চালিয়ে বেশ কিছু তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দেবায়নের পায়ে স্নিকার পরা ছিল, সেই পায়ের ছাপের সাথে সাথে আরো এক জোড়া জুতোর ছাপ পাওয়া যায়। জুতোর ছাপে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে দেবায়ন আর আততায়ীর মাঝে বেশ ধস্তাধস্তি হয়েছিল। আশেপাশে ঝোপ ঝাড়ে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েই অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। খাদের বেশ নীচে বেশ কিছু ঝোপ ঝাড় উপড়ে গেছে, মাটি ধসে নিচের দিকে নেমে গেছে। একদিকের একটা ঝোপের মধ্যে একটা সিগারেট প্যাকেট আর একটা আধা খাওয়া সিগারেট পাওয়া যায়। সিগারেট প্যাকেট দেখে অনুপমা জানায় এই ব্রান্ডের সিগারেট দেবায়ন খায়। আততায়ীর পায়ের ছাপ জঙ্গলের দিকে মিলিয়ে গেছে। রূপক ধীমান প্রবাল সবাই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেই আততায়ীকে খোঁজার জন্য কিন্তু পায়ের ছাপ কিছু দুর গিয়ে পাতা ভর্তি মাটির ওপরে হারিয়ে যাওয়াতে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। সবাই ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে ফিরে আসে জঙ্গল থেকে।
রঞ্জিত গ্রাম থেকে আরো ছেলে জোগাড় করে দড়ি দিয়ে খাদের মধ্যে নদীর কিনারায় নামিয়ে তল্লাসি চালায়। শান্তনু জানায় এটা খুনের মামলা সুতরাং একবার পুলিসকে খবর দেওয়া উচিত। রীহ থেকে সব থেকে কাছের পুলিস স্টেসান, ঘনসিয়ালি পৌঁছাতে একদিন লেগে যাবে। শান্তনু আর পরাশর, একজন পোর্টার নিয়ে ঘুট্টু হয়ে ঘনসিয়ালি চলে যায় পুলিসকে খবর দিতে।
সন্ধ্যের পরে অনুপমার বাবা, মিস্টার সোমেশ সেন রীহতে এসে হাজির হন। সেই সাথে শান্তনু আর পরাশর পুলিস নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। বাবাকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায় অনুপমা। বাবাকে কে খবর দিয়েছে, বাবা কি করে এত তাড়াতাড়ি এইখানে এসে পৌঁছাল?!
অনুপমা অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে এই ঘটনার খবর কে দিল?”
শান্তনু জানায়, “আমি তোমার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কাকিমা জানালেন যে সেন কাকু দেরাদুনে কাজের জন্য এসেছিলেন।”
অনুপমার মনে ভয় ঢোকে, যদি এই দুর্ঘটনার খবর মামনির কানে পৌঁছায় তাহলে কি হবে। চরম উৎকণ্ঠায় শান্তনুর দিকে ছলছল চোখে তাকাতে শান্তনু জানায়, “চিন্তা নেই দেবায়নের মাকে এই বিষয়ে কিছুই এখন জানানো হয়নি।”
অনুপমা হিমশীতল চাহনি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “তোমার দেরাদুনে আসার কথা ছিল না। হঠাৎ এমন কি কাজ পড়ল যে তুমি দেরাদুনে এসেছ?”
মেয়ের হিমশীতল কণ্ঠস্বর শুনে সোমেশবাবু অবাক হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “কি বলতে চাস তুই?”
অনুপমা একভাবে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয়, “না কিছু না, এখন কিছুই বলতে চাই না আমি।”
পুলিস ইনস্পেকটর রোহন কাটিয়াল ঘটনা স্থল তল্লাসি করে সুত্র প্রমান একত্রিত করে ফেলেন। অনুপমা পুলিসকে জানায় একটা পাহাড়ি কম বয়সী ছেলে দেবায়নকে ডাকতে এসেছিল, ওকে খুঁজে বের করতে পারলে দেবায়নের খবর আর আততায়ীর পরিচয় জানা সম্ভব হবে। পুলিস খুনের মামলার দায়ের করে জানায় ওদের থানায় স্কেচ আর্টিস্ট নেই। আততায়ীর সাথের ছেলেটার স্কেচ তৈরি করার জন্য ওদের নিউ তেহেরি থানায় অথবা দেরাদুনে অথবা হৃষীকেশে যেতে হবে। রূপক একটু আধটু আঁকতে জানত, যে ছেলেটা এসেছিল তার একটা স্কেচ বানিয়ে পুলিসের হাতে তুলে দেয়। পুলিস ইন্সপেক্টর অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে ওর কাকে সন্দেহ। অনুপমা ছলছল চোখে সবার দিকে একবার তাকায়। কাকে সন্দেহ করবে অনুপমা? ওর যে চিন্তা শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। অনুপমা পুলিসকে জানায় ওদের ব্যাবসা অনেক বিস্তৃত, ব্যাবসা ক্ষেত্রে দেবায়নের প্রচুর শত্রু থাকতে পারে কিন্তু এই নির্জন স্থানে এসে একেবারে ওকে খুন করার মতন পরিকল্পনা করতে পারে এমন কাউকে ওর সন্দেহ হয় না। তবে কারুর দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তোলার আগে নিজেই একবার খুনের উদ্দেশ্য যাচাই করে দেখতে চায়। প্রাথমিক তদন্ত সেরে পুলিস ইন্সপেক্টর জানায় এই ছেলেটার খোঁজ পেলে ওদের জানিয়ে দেবে।
সেদিন সারাদিনে নদীর দুইপাড় খানাতল্লাসি চালিয়েও দেবায়নের কোন খোঁজ পাওয়া যায়না। সন্ধ্যের পরেও অনুপমাকে কিছুতেই ওই খাদের কিনারা থেকে নড়ানো সম্ভব হয়না। দুইদিন টানা অনুপমা ওইখানে একভাবে বসে থাকে দেবায়নের প্রতীক্ষায়। ওর মন যে কিছুতেই মানতে নারাজ যে ওর পুচ্চু আর এই পৃথিবীতে নেই।
শ্রেয়া আর পায়েল, ঋতুপর্ণা সঙ্গীতা সবাই ওকে একা ছাড়তে নারাজ। যা হবার সবাই একসাথে মোকাবিলা করবে বলে বদ্ধপরিকর। আশায় বুক বেঁধে বসে থাকে অনুপমা এই বুঝি হটাত করে ওর পুচ্চু ওর পাশে এসে দাঁড়াবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে, ওর গালে চুমু খেয়ে বলে উঠবে, “এই একটু লুকিয়ে মজা দেখছিলাম।” কিন্তু না, আরো একদিন কেটে যায়….. দেবায়নের পরশ ওর কাঁধে আর স্পর্শ করে না।
দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার দুর্ঘটনায় সবার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, সবাই সারাদিন মন মরা হয়ে বসে থাকে। কেউই আর রীহতে ওইভাবে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। পরের দিন পুলিসের লোকের সাথে রঞ্জিতের লোকেরাও খাদের মধ্যে নেমে নদীর দুই পাড়ে খানা তল্লাসি চালায় কিন্তু দেবায়নের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়না দেখে সবার সংশয় হয় যে দেবায়ন সলীল সমাধি নিয়েছে। সেই কথা অনুপমা কিছুতেই মানতে চায় না, ওর মন বলছে দেবায়ন এখুনি কোথা থেকে বেড়িয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরবে। পুলিস, রঞ্জিত শান্তনু সবাই অনুপমাকে অনুরোধ করে কোলকাতা ফিরে যেতে। সবার ধারনা বদ্ধমূল হয় যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই, এই উঁচু খাদ থেকে ওই পাহাড়ি নদীতে পরে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।
ভগ্ন হৃদয়ে চতুর্থ দিন সকালে সবাই রীহ থেকে ঘুট্টুর পথ ধরে। ভাঙ্গা বুক নিয়ে অনুপমা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আর বারেবারে দেবায়নের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলে। বারেবারে ওর আর্ত কণ্ঠস্বর পাহাড়ের গায়ে লেগে ওর কানে ফাঁকা আওয়াজ হয়েই ফিরে আসে। ওদের গাড়ি ঘুট্টুতে অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়ি করে সবাই হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গাড়ি ঘুট্টু ছাড়তেই ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে অনুপমা। শ্রেয়া আর পায়েল ওকে চেপে ধরে সিটে বসিয়ে দেয়। একদম সামনের সিটে চুপচাপ ওর বাবা বসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে খুব মুষড়ে পড়েন। কি কারনে মেয়ে ওনাকে সন্দেহ করে বসল সেটা এখন তাঁর কাছে পরিস্কার হলো না।
হৃষীকেশ পৌঁছাতে ওদের বেশ রাত হয়ে যায়। সারা রাত অনুপমা চোখের পাতা এক করতে পারে না, যেই ওর চোখ বুজে আসে তখনি ওর মনে হয় এই বুঝি দেবায়ন এসে ওকে ডাকবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে। সারা রাত শ্রেয়া আর পায়েল ওকে ঘিরে বসে থেকে থেকে শেষ রাতে দুইজনে ওর পাশে ঘুমিয়ে পরে। সকালের দিকে অনুপমা নিজের ব্যাগ ঘুছিয়ে নেয়, এই ভাবে দেবায়নকে ফেলে চলে যেতে ওর মন মানতে চায় না।
সকালে অনুপমা শ্রেয়াকে ডেকে বলে, “আমি পুচ্চুকে ছাড়া এইখান থেকে এক পা নড়ব না।”
শ্রেয়া আর পায়েল প্রমাদ গোনে, একা একা ওকে এইভাবে এইখানে ছাড়তে কিছুতেই ওদের মন মানতে চায় না। শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, “তুই না গেলে আমিও কোথাও যাবো না।”
শ্রেয়ার এই গভীর বন্ধু প্রীতি দেখে অনুপমার ভগ্ন হৃদয় আরো ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওর হাত ধরে বলে, “তুই কেন এইখানে আমার সাথে পড়ে থাকবি? তুই বাড়ি যা।”
পায়েল ওর হাত ধরে ধরা গলায় উত্তর দেয়, “আমাকে দেবায়ন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, ওকে না ফিরিয়ে নিয়ে আসা পর্যন্ত আমিও তোর পাশ ছাড়ছি না।”
ম্লান হেসে উত্তর দেয় অনুপমা, “তুই একটা পাগলী মেয়ে।” ভাইয়ের হাত কাছে টেনে ওর হাতের মধ্যে পায়েলের হাত দিয়ে বলে, “তোর সাথে ভাই আছে রে পায়েল। পুচ্চু ছাড়া আমার আর কে আছে, বল? আমাদের সম্বন্ধে তুই অনেক কিছু জানিস না, সেইগুলো তোর অজানা থাকাই ভালো। শুধু এইটুকু জেনে রাখ পুচ্চু আর মামনি ছাড়া আমার নিজের বলতে এই পৃথিবীতে কেউ নেই। ওকে যদি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি তাহলে কোলকাতা ফিরব না হলে আর ফিরব না।”
পায়েল আর অঙ্কন কেঁদে ফেলে ওর কথা শুনে, “দিদিভাই প্লিস এই ভাবে আমাদের ছেড়ে যাস না।”
শ্রেয়া ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “ফিরবি না মানে? আমার মন বলছে দেবায়নের কিছু হয়নি, ওই শয়তানটা এইখানে কোথাও লুকিয়ে আমাদের সাথে মজা করছে।” চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, “একবার শালাকে হাতের কাছে পাই পেদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে তবে ছাড়ব।”
অনুপমা ওর হাত ধরে বলে, “শোন শ্রেয়া, তুই আমার একটা কাজ করবি?”
শ্রেয়া ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করে, “কি?”
অনুপমা ওর হাত ধরে অনুরোধ করে, “লক্ষ্মীটি তুই বাড়ি ফিরে যা। আমি ওকে খুঁজে তবেই ফিরব। যদি আমি না ফিরি…..”
বলতে বলতে ওর গলা ধরে আসে। শ্রেয়া আর পায়েল ওকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে। অনুপমা শ্রেয়াকে বলে, “তাহলে তুই মামনির খেয়াল রাখিস। দেবায়ন ছাড়া মামনির আর কেউ নেই রে…..”
বলতে বলতে ভেঙ্গে পড়ে অনুপমা। ওর কানে মামনির হাহাকার আর্তনাদ ভেসে আসে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে সেটা অনুধাবন করতে পেরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। চোখের জল মুছে শ্রেয়ার হাত ধরে অনুরোধ করে, “দয়া করে তুই পায়েল আর ভাইয়ের খেয়াল রাখিস আর অফিসের সবার খেয়াল রাখিস।”
পর্ব ২৯ (#০১)
মুখের ওপরে জলের ছিটা পড়তেই অনুপমার জ্ঞান ফেরে। চোখ খুলে শ্রেয়াকে দেখেই ডুকরে কেঁদে ওঠে অনুপমা, “পুচ্চুকে পেলি?”
শ্রেয়া ওর কপালে হাত বুলিয়ে মৃদু মাথা নাড়িয়ে বলে, “না রে এখন পাওয়া যায়নি। তবে তুই চিন্তা করিস না…..”
চারপাশে সবাই ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে, সবার চোখে মুখে চাপা উৎকণ্ঠার ছাপ। সবাই এইখানে আনন্দ ফুর্তি করতে এসেছিল, অকস্মাৎ এই দুর্ঘটনায় সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। রূপক, শান্তনু রঞ্জিত খাদের চারপাশে খুঁজে খুঁজে কোন চিহ্ন না পেয়ে হয়রান হয়ে ফিরে এসেছে। অনুপমা চুপচাপ বসে ভাঙ্গা বুক আর অসীম বেদনা নিয়ে সবার দিকে ছলছল চোখে তাকায়। এক ধাক্কায় ওর সাধের পৃথিবী উজাড় হয়ে গেছে। ওর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দেবায়ন ছাড়া কোলকাতা ফিরে যাওয়া ওর পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। দেবায়ন ছাড়া নিজেকে ভাবতে পারছে না কিছুতেই। ওর অঙ্গে, ওর হৃদয়ের সর্বত্রে ওর ভালোবাসার ছাপ অঙ্কিত। অনামিকার আংটি ওকে বারবার মনে করিয়ে দেয় এই ডিসেম্বরে ওদের বিয়ের কথা চলছিল। স্বপ্ন দেখেছিল এই পাহাড়ের কোলে ঘর বাঁধবে। শ্রেয়ার বাহুপাশ থেকে থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কুঁকড়ে বসে যায়। ওকে ছাড়া ওর জীবনে রঙ উবে গেছে।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পরে গাইড রঞ্জিতকে অনুপমা জিজ্ঞেস করে, “তোমার দলের একটা পোর্টার এসেছিল ওকে ডাকতে, সে নিশ্চয় জানে দেবায়ন কোথায়। তাকে ডাক।”
রূপক উত্তরে বলে, “না রে ওই ছেলেটা ভুয়ো। রাজু নামে আমাদের দলে কোন পোর্টার নেই। আমার মনে হয়…..”
অনুপমা বিস্ফোরিত চোখে রূপকের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “ওই নামে পোর্টার নেই মানে? তাহলে পুচ্চুকে…..”
দৃষ্টি আবার ঝাপসা হয়ে আসে অনুপমার, কিছু আর ভাবতে পারছে। কম্পিত কণ্ঠে রূপককে জিজ্ঞেস করে, “তুই কোথায় কোথায় পুচ্চকে খুঁজেছিস?”
রূপক, শান্তনু সবাই জানায় ওরা চারদিকে দেবায়নকে খুঁজেছে কিন্তু কোথাও ওর চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অনুপমা নিজেই ওকে খুঁজতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকট করে। সবার মানা করা সত্ত্বেও অনুপমা একাই যেদিকে দেবায়ন গিয়েছিল সেদিকে হাঁটা দেয়। ওকে ওইভাবে উন্মাদিনীর মতন হাঁটতে দেখে পায়েল আর শ্রেয়া দৌড়ে এসে ওকে ধরে ফেলে। কিন্তু অনুপমা ওদের হাত ছাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে খাদের কিনারায় চলে আসে। চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা, শুধু মাত্র ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর গভীর খাদের নীচে বয়ে চলা পাহাড়ি নদীর গর্জন ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায় না।
গলা ছেড়ে ডাক দেয় অনুপমা, “পুচ্চুউউউউউউ…… তুই কোথায়?”
ওর হৃদয় ভাঙ্গা বেদনা যুক্ত কণ্ঠস্বর সামনের পাহাড়ে আর জঙ্গলে প্রতিধ্বনি হয়ে ওর কানে ফিরে আসে। অনুপমা বারেবারে ডাক দেয় কিন্তু পাথরের পাহাড় থেকে কোন উত্তর আসে না। বাকিরা সবাই টর্চ নিয়ে খাদের নিচের দিকে খোঁজে কিন্তু কোথাও দেবায়নের চিহ্ন পাওয়া যায় না। এপাশ ওপাশ খুঁজতে খুঁজতে অঙ্কন কিছু একটা দেখতে পেয়ে বাকিদের ডাক দেয়। অনুপমা দৌড়ে যেতেই অঙ্কন ওর হাতে দেবায়নের পার্স ধরিয়ে দেয়। পার্স দেখেই অনুপমার চোখ ছলছল করে ওঠে, বুকের মধ্যে পার্স লুকিয়ে দেবায়নের নাম ধরে বারেবারে ডাক দেয়। কিন্তু ওর শূন্য ডাকের সারা আর পাওয়া যায়না। টর্চের আলোয় খাদের পাশে রক্তের দাগ দেখে অনুপমার বুক আতঙ্কে কেঁপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত পুচ্চু কি সত্যি সত্যি ওকে ছেড়ে চলে গেছে?
দেবায়নের বিরহে সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যায় অনুপমা। বাম হাত বুকের কাছে চেপে পুনরায় গলা ফাটিয়ে ডাক দেয় অনুপমা, “পুচ্চুউউউউ প্লিস সোনা তুই এইভাবে আমাকে ছেড়ে যেতে পারিস না।”
টর্চের আলোয় চারপাশে খুঁজে দেবায়নের পার্স ছাড়া কিছুই পাওয়া যায়না। খাদের কিনারা থেকে বেশ কিছু মাটি পাথর ধ্বসে গেছে। ওই দেখে বাকিদের ধারনা হয় যে দেবায়ন এই খাদের মধ্যে হারিয়ে গেছে। কিন্তু অনুপমার হৃদয় কিছুতেই মানতে নারাজ যে দেবায়ন আর ওদের মাঝে নেই। অনুপমা খাদের কিনারায় চুপচাপ কুঁকড়ে বসে পড়ে, দেবায়নের পার্স বুকের কাছে চেপে ধরে উচ্চস্বরে বারেবারে ডাক দেয়। শ্রেয়া, পায়েল ওকে ধরে থাকে পাশে বেদনায় অনুপমা খাদের মধ্যে ঝাঁপ দেয় এই আশঙ্কায়। বাকিরা সবাই টর্চ নিয়ে এপাশ ওপাশ খুঁজে ক্লান্ত এক সময়ে টেন্টের দিকে হাঁটা দেয়, কিন্তু অনুপমা ওই জায়গা থেকে কিছুতেই নড়তে চায় না। অনুপমা জেদ ধরে বসে থাকে, দড়ি নিয়ে আসো, এই রাতেই দড়ি বেয়ে ওই খাদের মধ্যে নামতে চায়। নদীর তীরে নিশ্চয় কোথাও দেবায়নকে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই কনকনে ঠাণ্ডা জলে দেবায়ন বেশিক্ষণ থাকলে ওর হাইপোথারমিয়া হয়ে যাবে, ওর মৃত্যুর আশঙ্কা আরো বেড়ে যাবে।
অনুপমাকে কিছুতেই শান্ত করা সম্ভব হয় না দেখে শেষ পর্যন্ত শ্রেয়া ওকে খুব বকুনি দিয়ে বলে, “এই রাতে এই খাদের মধ্যে নামবি, তুই পাগল হয়েছিস নাকি?”
সারা রাত অনুপমা ওই খাদের কিনারায় কনকনে ঠাণ্ডায় বসে থাকে। নিরুপায় হয়ে শ্রেয়া আর পায়েল একটা স্লিপিং ব্যাগ ওর শরীরে জড়িয়ে দেয়। জানে ওই খাদে না নামা পর্যন্ত অনুপমাকে এইখান থেকে নড়ানো সম্ভবপর নয়। অগত্যা বাকিরাও সবাই পালা করে অনুপমাকে পাহারা দেয়।
সারা রাত বসে ভাবে অনুপমা, কে ওর দেবায়ন কে এই নির্জন স্থানে এসে মারতে চেষ্টা করতে পারে। ওর সন্দেহের তালিকার মধ্যে অনেকের নাম আসে, কিন্তু কারুর দিকে সন্দেহের তীর হানার আগে তথ্য প্রমান সংগ্রহ করতে হবে। ওকে এই ভাবে কাঁদলে চলবে না। এই খবর মামনির কানে পৌঁছালে মামনি খুব ভেঙ্গে পরবে, মামনিকে সামলাতে হবে।
সকালের সূর্য পুব দিক থেকে উঁকি মারতেই অনুপমা রঞ্জিতকে অনুরোধ করে দেবায়নকে খোঁজার জন্য। নিজেই খাদের কিনারা ভালো ভাবে তল্লাসি চালিয়ে বেশ কিছু তথ্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। দেবায়নের পায়ে স্নিকার পরা ছিল, সেই পায়ের ছাপের সাথে সাথে আরো এক জোড়া জুতোর ছাপ পাওয়া যায়। জুতোর ছাপে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে দেবায়ন আর আততায়ীর মাঝে বেশ ধস্তাধস্তি হয়েছিল। আশেপাশে ঝোপ ঝাড়ে রক্তের দাগ দেখতে পেয়েই অনুপমার বুক কেঁপে ওঠে। খাদের বেশ নীচে বেশ কিছু ঝোপ ঝাড় উপড়ে গেছে, মাটি ধসে নিচের দিকে নেমে গেছে। একদিকের একটা ঝোপের মধ্যে একটা সিগারেট প্যাকেট আর একটা আধা খাওয়া সিগারেট পাওয়া যায়। সিগারেট প্যাকেট দেখে অনুপমা জানায় এই ব্রান্ডের সিগারেট দেবায়ন খায়। আততায়ীর পায়ের ছাপ জঙ্গলের দিকে মিলিয়ে গেছে। রূপক ধীমান প্রবাল সবাই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ে সেই আততায়ীকে খোঁজার জন্য কিন্তু পায়ের ছাপ কিছু দুর গিয়ে পাতা ভর্তি মাটির ওপরে হারিয়ে যাওয়াতে আর খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয় না। সবাই ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে ফিরে আসে জঙ্গল থেকে।
রঞ্জিত গ্রাম থেকে আরো ছেলে জোগাড় করে দড়ি দিয়ে খাদের মধ্যে নদীর কিনারায় নামিয়ে তল্লাসি চালায়। শান্তনু জানায় এটা খুনের মামলা সুতরাং একবার পুলিসকে খবর দেওয়া উচিত। রীহ থেকে সব থেকে কাছের পুলিস স্টেসান, ঘনসিয়ালি পৌঁছাতে একদিন লেগে যাবে। শান্তনু আর পরাশর, একজন পোর্টার নিয়ে ঘুট্টু হয়ে ঘনসিয়ালি চলে যায় পুলিসকে খবর দিতে।
সন্ধ্যের পরে অনুপমার বাবা, মিস্টার সোমেশ সেন রীহতে এসে হাজির হন। সেই সাথে শান্তনু আর পরাশর পুলিস নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যায়। বাবাকে দেখে খুব অবাক হয়ে যায় অনুপমা। বাবাকে কে খবর দিয়েছে, বাবা কি করে এত তাড়াতাড়ি এইখানে এসে পৌঁছাল?!
অনুপমা অবাক হয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে এই ঘটনার খবর কে দিল?”
শান্তনু জানায়, “আমি তোমার বাড়িতে ফোন করেছিলাম। কাকিমা জানালেন যে সেন কাকু দেরাদুনে কাজের জন্য এসেছিলেন।”
অনুপমার মনে ভয় ঢোকে, যদি এই দুর্ঘটনার খবর মামনির কানে পৌঁছায় তাহলে কি হবে। চরম উৎকণ্ঠায় শান্তনুর দিকে ছলছল চোখে তাকাতে শান্তনু জানায়, “চিন্তা নেই দেবায়নের মাকে এই বিষয়ে কিছুই এখন জানানো হয়নি।”
অনুপমা হিমশীতল চাহনি নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “তোমার দেরাদুনে আসার কথা ছিল না। হঠাৎ এমন কি কাজ পড়ল যে তুমি দেরাদুনে এসেছ?”
মেয়ের হিমশীতল কণ্ঠস্বর শুনে সোমেশবাবু অবাক হয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “কি বলতে চাস তুই?”
অনুপমা একভাবে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দেয়, “না কিছু না, এখন কিছুই বলতে চাই না আমি।”
পুলিস ইনস্পেকটর রোহন কাটিয়াল ঘটনা স্থল তল্লাসি করে সুত্র প্রমান একত্রিত করে ফেলেন। অনুপমা পুলিসকে জানায় একটা পাহাড়ি কম বয়সী ছেলে দেবায়নকে ডাকতে এসেছিল, ওকে খুঁজে বের করতে পারলে দেবায়নের খবর আর আততায়ীর পরিচয় জানা সম্ভব হবে। পুলিস খুনের মামলার দায়ের করে জানায় ওদের থানায় স্কেচ আর্টিস্ট নেই। আততায়ীর সাথের ছেলেটার স্কেচ তৈরি করার জন্য ওদের নিউ তেহেরি থানায় অথবা দেরাদুনে অথবা হৃষীকেশে যেতে হবে। রূপক একটু আধটু আঁকতে জানত, যে ছেলেটা এসেছিল তার একটা স্কেচ বানিয়ে পুলিসের হাতে তুলে দেয়। পুলিস ইন্সপেক্টর অনুপমাকে জিজ্ঞেস করে ওর কাকে সন্দেহ। অনুপমা ছলছল চোখে সবার দিকে একবার তাকায়। কাকে সন্দেহ করবে অনুপমা? ওর যে চিন্তা শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। অনুপমা পুলিসকে জানায় ওদের ব্যাবসা অনেক বিস্তৃত, ব্যাবসা ক্ষেত্রে দেবায়নের প্রচুর শত্রু থাকতে পারে কিন্তু এই নির্জন স্থানে এসে একেবারে ওকে খুন করার মতন পরিকল্পনা করতে পারে এমন কাউকে ওর সন্দেহ হয় না। তবে কারুর দিকে সন্দেহের আঙ্গুল তোলার আগে নিজেই একবার খুনের উদ্দেশ্য যাচাই করে দেখতে চায়। প্রাথমিক তদন্ত সেরে পুলিস ইন্সপেক্টর জানায় এই ছেলেটার খোঁজ পেলে ওদের জানিয়ে দেবে।
সেদিন সারাদিনে নদীর দুইপাড় খানাতল্লাসি চালিয়েও দেবায়নের কোন খোঁজ পাওয়া যায়না। সন্ধ্যের পরেও অনুপমাকে কিছুতেই ওই খাদের কিনারা থেকে নড়ানো সম্ভব হয়না। দুইদিন টানা অনুপমা ওইখানে একভাবে বসে থাকে দেবায়নের প্রতীক্ষায়। ওর মন যে কিছুতেই মানতে নারাজ যে ওর পুচ্চু আর এই পৃথিবীতে নেই।
শ্রেয়া আর পায়েল, ঋতুপর্ণা সঙ্গীতা সবাই ওকে একা ছাড়তে নারাজ। যা হবার সবাই একসাথে মোকাবিলা করবে বলে বদ্ধপরিকর। আশায় বুক বেঁধে বসে থাকে অনুপমা এই বুঝি হটাত করে ওর পুচ্চু ওর পাশে এসে দাঁড়াবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে, ওর গালে চুমু খেয়ে বলে উঠবে, “এই একটু লুকিয়ে মজা দেখছিলাম।” কিন্তু না, আরো একদিন কেটে যায়….. দেবায়নের পরশ ওর কাঁধে আর স্পর্শ করে না।
দেবায়নের নিখোঁজ হওয়ার দুর্ঘটনায় সবার হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে, সবাই সারাদিন মন মরা হয়ে বসে থাকে। কেউই আর রীহতে ওইভাবে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পড়ে থাকতে চায় না। পরের দিন পুলিসের লোকের সাথে রঞ্জিতের লোকেরাও খাদের মধ্যে নেমে নদীর দুই পাড়ে খানা তল্লাসি চালায় কিন্তু দেবায়নের কোন চিহ্ন পাওয়া যায়না দেখে সবার সংশয় হয় যে দেবায়ন সলীল সমাধি নিয়েছে। সেই কথা অনুপমা কিছুতেই মানতে চায় না, ওর মন বলছে দেবায়ন এখুনি কোথা থেকে বেড়িয়ে এসে ওকে জড়িয়ে ধরবে। পুলিস, রঞ্জিত শান্তনু সবাই অনুপমাকে অনুরোধ করে কোলকাতা ফিরে যেতে। সবার ধারনা বদ্ধমূল হয় যে দেবায়ন আর বেঁচে নেই, এই উঁচু খাদ থেকে ওই পাহাড়ি নদীতে পরে কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।
ভগ্ন হৃদয়ে চতুর্থ দিন সকালে সবাই রীহ থেকে ঘুট্টুর পথ ধরে। ভাঙ্গা বুক নিয়ে অনুপমা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আর বারেবারে দেবায়নের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলে। বারেবারে ওর আর্ত কণ্ঠস্বর পাহাড়ের গায়ে লেগে ওর কানে ফাঁকা আওয়াজ হয়েই ফিরে আসে। ওদের গাড়ি ঘুট্টুতে অপেক্ষা করছিল। সেই গাড়ি করে সবাই হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। গাড়ি ঘুট্টু ছাড়তেই ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে অনুপমা। শ্রেয়া আর পায়েল ওকে চেপে ধরে সিটে বসিয়ে দেয়। একদম সামনের সিটে চুপচাপ ওর বাবা বসে মেয়ের এই অবস্থা দেখে খুব মুষড়ে পড়েন। কি কারনে মেয়ে ওনাকে সন্দেহ করে বসল সেটা এখন তাঁর কাছে পরিস্কার হলো না।
হৃষীকেশ পৌঁছাতে ওদের বেশ রাত হয়ে যায়। সারা রাত অনুপমা চোখের পাতা এক করতে পারে না, যেই ওর চোখ বুজে আসে তখনি ওর মনে হয় এই বুঝি দেবায়ন এসে ওকে ডাকবে, ওকে জড়িয়ে ধরবে। সারা রাত শ্রেয়া আর পায়েল ওকে ঘিরে বসে থেকে থেকে শেষ রাতে দুইজনে ওর পাশে ঘুমিয়ে পরে। সকালের দিকে অনুপমা নিজের ব্যাগ ঘুছিয়ে নেয়, এই ভাবে দেবায়নকে ফেলে চলে যেতে ওর মন মানতে চায় না।
সকালে অনুপমা শ্রেয়াকে ডেকে বলে, “আমি পুচ্চুকে ছাড়া এইখান থেকে এক পা নড়ব না।”
শ্রেয়া আর পায়েল প্রমাদ গোনে, একা একা ওকে এইভাবে এইখানে ছাড়তে কিছুতেই ওদের মন মানতে চায় না। শ্রেয়া মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, “তুই না গেলে আমিও কোথাও যাবো না।”
শ্রেয়ার এই গভীর বন্ধু প্রীতি দেখে অনুপমার ভগ্ন হৃদয় আরো ডুকরে কেঁদে ওঠে। ওর হাত ধরে বলে, “তুই কেন এইখানে আমার সাথে পড়ে থাকবি? তুই বাড়ি যা।”
পায়েল ওর হাত ধরে ধরা গলায় উত্তর দেয়, “আমাকে দেবায়ন ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল, ওকে না ফিরিয়ে নিয়ে আসা পর্যন্ত আমিও তোর পাশ ছাড়ছি না।”
ম্লান হেসে উত্তর দেয় অনুপমা, “তুই একটা পাগলী মেয়ে।” ভাইয়ের হাত কাছে টেনে ওর হাতের মধ্যে পায়েলের হাত দিয়ে বলে, “তোর সাথে ভাই আছে রে পায়েল। পুচ্চু ছাড়া আমার আর কে আছে, বল? আমাদের সম্বন্ধে তুই অনেক কিছু জানিস না, সেইগুলো তোর অজানা থাকাই ভালো। শুধু এইটুকু জেনে রাখ পুচ্চু আর মামনি ছাড়া আমার নিজের বলতে এই পৃথিবীতে কেউ নেই। ওকে যদি ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারি তাহলে কোলকাতা ফিরব না হলে আর ফিরব না।”
পায়েল আর অঙ্কন কেঁদে ফেলে ওর কথা শুনে, “দিদিভাই প্লিস এই ভাবে আমাদের ছেড়ে যাস না।”
শ্রেয়া ছলছল চোখে ধরা কণ্ঠে ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “ফিরবি না মানে? আমার মন বলছে দেবায়নের কিছু হয়নি, ওই শয়তানটা এইখানে কোথাও লুকিয়ে আমাদের সাথে মজা করছে।” চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, “একবার শালাকে হাতের কাছে পাই পেদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে তবে ছাড়ব।”
অনুপমা ওর হাত ধরে বলে, “শোন শ্রেয়া, তুই আমার একটা কাজ করবি?”
শ্রেয়া ছলছল চোখে জিজ্ঞেস করে, “কি?”
অনুপমা ওর হাত ধরে অনুরোধ করে, “লক্ষ্মীটি তুই বাড়ি ফিরে যা। আমি ওকে খুঁজে তবেই ফিরব। যদি আমি না ফিরি…..”
বলতে বলতে ওর গলা ধরে আসে। শ্রেয়া আর পায়েল ওকে জড়িয়ে ধরে ভেঙ্গে পরে। অনুপমা শ্রেয়াকে বলে, “তাহলে তুই মামনির খেয়াল রাখিস। দেবায়ন ছাড়া মামনির আর কেউ নেই রে…..”
বলতে বলতে ভেঙ্গে পড়ে অনুপমা। ওর কানে মামনির হাহাকার আর্তনাদ ভেসে আসে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে ওর মামনির কি অবস্থা হতে পারে সেটা অনুধাবন করতে পেরে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। চোখের জল মুছে শ্রেয়ার হাত ধরে অনুরোধ করে, “দয়া করে তুই পায়েল আর ভাইয়ের খেয়াল রাখিস আর অফিসের সবার খেয়াল রাখিস।”