05-10-2020, 07:49 PM
পর্ব ২৭ (#০৬)
রেডিসনে এনুয়াল মিটেই রূপক, বন্ধুদের কাছে খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিংয়ের কথা বলেছিল। সেই শুনে অনেকে যেতে রাজি হয়ে যায়। পরাশর যেতে রাজি হয়ে যায়, জারিনা জানায় যাওয়ার জন্য ওর আব্বাজানকে রাজি করিয়ে নেবে। সঙ্গীতা লাফাতে শুরু করে দেয় ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে, অগত্যা প্রবালের তাই কিছু আর বলার থাকে না। ঋতুপর্ণা, ধীমান এক কথায় রাজি। শ্রেয়া আর পায়েল এই অজানা অচেনা জায়গায় যেতে একটু দ্বিধাবোধ ব্যাক্ত করে, কারন ওদের দলের মধ্যে কারুর ট্র্যাকিঙে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। দেবায়ন বুঝিয়ে বলে, কোন কিছুর প্রথমদিন সবার জীবনে একদিন না একদিন আসে। অনুপমার ভাই, অঙ্কন প্রেয়সী পায়েলের চাপে পড়ে আর না করে না, তবে বড়দের সাথে যেতে একটু দোনামোনা করে, বিশেষ করে জানে রূপক আর দেবায়ন কি রকমের ছেলে। ওর একবার কারুর পেছনে লাগলে তাকে না কাঁদিয়ে ছাড়ে না। রূপকের ওপরে সব কিছু পরিকল্পনার করার ভার কারন ওই বেশ উৎসাহী। ইন্টারনেট ঘেঁটে একটা ট্রেকিঙ্গের সাইটে লগইন করে একজনের সাথে আলোচনা করে অনেক কিছুর খোঁজ খবর ইতিমধ্যে নিয়ে নিয়েছে। অনুপমা আর দেবায়ন জানায়, খরচের সিংহ ভাগ ওরা দিতে রাজি। সেই সাথে অনুপমা আরো জানায় একজন অভিজ্ঞ চেনাজানা লোক সঙ্গে থাকলে বড় ভালো হয়। অফিসে এই নিয়ে কথাবার্তা চলে, সেই সময়ে ওরা জানতে পারে যে শান্তনু দিল্লীতে থাকার সময়ে বার পাঁচেক বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিংয়ে গেছে। ঠিক হয় যে শান্তনু আর মনীষাকেও সঙ্গে নেওয়া হবে। মনীষা পাহাড়ের মেয়ে, কিন্তু কোনোদিন ট্রেকিংয়ে যায়নি, তাই বেশ উৎসাহী। সব মিলিয়ে চোদ্দ জনের দল, বেশ বড় দল হলে যাওয়া সুবিধা। শান্তনুকে দলের নেতা হিসাবে মনোনীত করা হয়, আর বড় কারন সে অভিজ্ঞ আর দ্বিতীয়, দলের সব থেকে বড়, ওদের চেয়ে চার বছরের বড়। দলে সব থেকে বড় শান্তনু আর সব থেকে ছোট জারিনা আর অঙ্কন, বাকিদের বয়স মোটামুটি এক সবাই কলেজের বন্ধু।
পুজোর আগেই একদিন বিকেলে অফিসের পরে অনুপমাদের অফিসের কনফারেন্স রুমে ট্রেকিংয়ের আলোচনা পরিকল্পনার সভা বসে। ঠিক হয় একাদশীর দিনে ওরা সবাই কোলকাতা থেকে রওনা দেবে। শান্তনু আর রুপকের ওপরে সব কিছুর ভার। অনুপমা দেশ বিদেশে অনেক পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি ওকে প্রবল ভাবে ডাক দেয়। শ্রেয়া, পায়েল ঋতুপর্ণা বেশ উৎসাহী ওদের কাছে পাহাড় বলতে দার্জিলিং, সিমলা কুলু মানালি আর সিকিম এর চেয়ে বেশি দুর কোথাও যায়নি। জারিনা আর সঙ্গীতা কোনোদিন পাহাড়ে যায়নি। ছেলেদের একমাত্র দেবায়ন ছাড়া মধ্যে অনেকে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে।
ওই টিম মিটিঙে দেবায়ন বিশেষ করে জারিনা আর অঙ্কনকে বলে, “দেখ ভাই আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, ওইখানে কিন্তু কেউ বড় কেউ ছোট নয় আর জানিস তো আমাদের অবস্থা…..”
রূপক ওর কথা টেনে নিয়ে বলে, “আমাদের কিন্তু কোন ট্যাক্স নেই, না কথাবার্তার, না…..”
পায়েল মুখ না খুললেও পাশে বসা অনুপমাকে আলতো ধাক্কা মেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “ওই সব হলে কিন্তু আমি আর অঙ্কন যাবো না।”
অনুপমা ওকে অভয় দিয়ে বলে, “আরে না না এইবারে ওইসব উল্টোপাল্টা কিছুই হবে না সেই নিয়ে তোর চিন্তা নেই।”
দেবায়ন সেটা শুনে ফেলে ইয়ার্কি মেরে বলে, “আমি তোর জন্য চার প্যাকেট কনডোম নিয়ে যাবো, হয়েছে?”
জারিনার কান লজ্জায় লাল হয়ে যায় সেই শুনে। মনীষা হেসে ফেলে দেবায়নের কথা শুনে।
শান্তনু ওদের এই আলোচনা থামিয়ে বলে, “সব থেকে আগে আমাদের শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে। খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিং বেশ কষ্টকর ট্রেকিং, দিন দশেকের মতন তাঁবুতে থাকা আর হাঁটা। কখন উঁচু চড়াই কখন উতরাই। সেই মতন প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রত্যেককে আমি মর্নিং ওয়াক করতে উপদেশ দেব।”
মনীষা ওকে আলতো ঠ্যালা মেরে বলে, “বাপরে, চোরের মায়ের বড় গলা, রোজদিন ঠিক সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠবে আর তড়িঘড়ি করে অফিসে আসবে। তোমার জন্য প্রায় দিন আমার লেট হয়ে যায়।”
শান্তনু কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে বলে, “যার বউ অফিসের এইচ.আর. সেই অফিসে লেট আসাতে ক্ষতি কি।”
ওই শুনে সবাই হেসে ফেলে।
জারিনা জানায়, বাবার কাছ থেকে সব ওষুধপত্র যোগাড় করে একটা বড় ফার্স্ট এইডবক্স আর বেশ কিছু ঠাণ্ডার জন্য ইনজেকশান নিয়ে যাবে। সেদিনের মতন সভা শেষ হলে সবাই কেনা কাটা করতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। রূপক আর শান্তনুর ওপরে সব ভার, দলের নেতা শান্তনু আর রূপক ডান হাত, অনুপমা আর দেবায়ন ওদের পকেট। সবার একটা করে রাকস্যাক আর একটা ছোট ব্যাগ কেনা হয়। অনুপমার কাছে প্রচুর ভারী জ্যাকেট ছিল তাই শ্রেয়া আর পায়েলকে কোন জ্যাকেট কিনতে হয় না, তবে বাকিদের জন্য জ্যাকেট দস্তানা ইত্যাদি কেনা হয়। তাঁবুর সরঞ্জাম ঘনসিয়ালি থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, গাইড আর মালবাহক লোকের ব্যাবস্থা ঘুট্টু নামক গ্রামে হয়ে যাবে বলে শান্তনু জানায়। এডমিনে থাকার ফলে এইসবের খবর আর ব্যাবস্থা করার কৌশল ওর বেশ ভালো করেই জানা।
ঠিক হয় একদশীর দিন বিকেলে প্লেনে চেপে সোজা দিল্লী। ধীরে ধীরে ঘুরতে যাওয়ার দিন কাছে চলে আসে। পুজো এক রকম হইহুল্লোড়ে কাটিয়ে একাদশীর দিন বিকেলে সবাই নিজেদের জিনিস পত্র নিয়ে কোলকাতা এয়ারপোর্টে উপস্থিত। ওদের ছাড়তে বাড়ির অনেকে এসেছে, বিশেষ করে জারিনার বাবা মা। প্রথম বার মেয়েকে এইভাবে একা বাইরে ছাড়ছে বলে একটু উদ্বেগ প্রকাশ করে। এয়ারপোর্টে পারমিতা এসেছিল, সেই জারিনার বাবাকে অভয় দিয়ে বলে এতগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে যাচ্ছে কোন অসুবিধে হবে না। বিশেষ করে শান্তনু ওদের দলের মধ্যে সব থেকে বড়, বাকিদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।
প্লেন কোলকাতার মাটি ছাড়তেই সবাই নেচে ওঠে, মুক্তির স্বাদ, সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি, হিমশীতল গ্লেসিয়াররে ডাক, পনেরো দিন শুধু মাত্র প্রকৃতির কোলে কাটাবে। এই কয়দিনে অনুপমা আর পায়েল ছাড়া কেউই মর্নিং অয়াক করেনি সেই নিয়ে একটু হাসা হাসি হয় প্লেনে। প্লেনের বাকি যাত্রীরা চোদ্দ জনের একটা ট্রেকিং টিম দেখে ভির্মি খেয়ে যায়। সাধারনত যে ভারতীয়রা ট্রেকিংয়ে যায় তারা অধিকাংশ ট্রেনে যাতায়াত করে, তাই অনুপমাদের দেখে করে প্লেনের বাকিরা একটু তাকিয়ে থাকে। ওরা কি আর চুপ করে থাকার মানুষ?
রূপক প্লেনে উঠেই পেছনে বসা পরাশরকে চেঁচিয়ে বলে, “এই শালা কেউ একটু জানালা খুলে দে বড্ড গরম লাগছে। এইখানে মনে হয় এসি নেই।”
সেই শুনে সবার হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। শ্রেয়া একজন বিমান সেবিকাকে ডেকে ইয়ার্কি মেরে বলে, “আচ্ছা, ওই টয়লেটে কেউ পটি করলে কি নীচে পড়ে যাবে?”
এয়ার হোস্টেস হাসবে না কাঁদবে কিছু ভেবে পায় না। ভাবে এইগুলো একদম গেঁয়ো নাকি? ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে বলে, “না না, তোর পটি এই শুন্যে উড়তে উড়তে পাখীদের খাদ্য হয়ে যাবে।”
শ্রেয়া হঠাৎ শান্তনুকে বলে, “টিম লিডার আমাদের খিদে পেয়েছে। ডিনারের কি ব্যাবস্থা।”
শান্তনু পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে, “সুন্দরীরা একটু চুপচাপ বসে থাকো, একটু পরেই খাবার সার্ভ করা হবে।”
মনীষা আর ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ আমাদের নিরামিষ।”
এক কোনা থেকে পরাশর চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি কিন্তু মাছের ঝোল আর ভাত।”
দেবায়ন চেঁচিয়ে ওঠে, “টিম লিডার আমার হুইস্কি কোথায়?”
সেই সাথে তাল মেলায় রূপক আর ধীমান, “স্কচ অন রক্স বেবি।”
ওদের চেঁচামেচিতে প্লেনের বাকি যাত্রীরা রিতিমতন ভিরমি খেয়ে যায়।
প্লেনে ওঠার পর থেকে প্রবাল মুখে কুলুপ এঁটে চুপ। হাওয়ার চাপ কমে যাওয়ার ফলে ওর কান ভোভো করছে। সঙ্গীতার হাত খানি মুঠি করে ধরে চুপচাপ সিটে বসে। সেটা ধীমান দেখতে পেয়ে মজা করে বলে, “ওরে বাল, তোর বউ নিয়ে কেউ পালিয়ে যাবে না। প্লেনের মধ্যে কেউ নিয়ে আর পালাবে কোথায়। এইবারে একটু ছেড়ে দে।”
সঙ্গীতা উল্টে ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে, “চুপ কর, প্লেনে চাপলে ওর মাথা ঘোরে।”
দেবায়ন সিট থেকে উঠে ওর মাথায় চাঁটি মেরে ইয়ার্কি মেরে বলে, “তোর জিন্স নয়, শাড়ি পরে আসা উচিত ছিল। ওকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখতিস তাহলে ভালো হত।”
অনুপমা ওদের বলে, “আরে আরে আঁচলের তলায় অনেক কিছু লুকানো আছে রে প্রবাল, লাগা একটু মুখ লাগা।”
এই ভাবে মজা করতে করতে ওরা রাতের বেলা দিল্লী পৌঁছায়। শান্তনু জানায়, ভোর বেলা একটা চোদ্দ সিটের বাস ওদের জন্য ঠিক করা হয়েছে। দিল্লী থেকে এই বাসে চেপেই ওরা হৃষীকেশ হয়ে ঘুট্টু যাবে। ঘুট্টু থেকে ওদের ট্রেকিংয়ের শুরু।
দিল্লীতে রাত কাটিয়ে তারপরের দিন সকাল বেলায় একটা ছোট বাসে চেপে সবাই হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দিল্লী ছাড়ার আগে, দেবায়ন রূপক আর ধীমান বেশ কয়েক বোতল হুইস্কি, রাম ইত্যাদি মদ কিনে নিয়েছিল। সারাটা রাস্তা হাসি মজা করতে করতে কেটে যায়। হৃষীকেশ পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। দেবায়ন, অঙ্কন আর অনুপমা ছাড়া বাকিদের হৃষীকেশ আগে থেকে ঘোরা ছিল। তাও সন্ধ্যের পরে সবাই হৃষীকেশ ঘুরে বেড়িয়ে দেখে। পুজোর পরে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব এসে গেছে পাহাড়ের পাদদেশে। হৃষীকেশ থেকে পাহাড় শুরু, ওদের হোটেলের পেছনে পাহাড়, গঙ্গার জল এইখানে খুব ঠাণ্ডা। এর ওপরে গেলে জলের তাপমাত্রা কত কম্বে সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। হৃষীকেশে ওরা দশ দিনের খাবার দাবার কেনাকাটা করে নেয়। ম্যাগি, চাল ডাল, আলু ইত্যাদি। শান্তনু জানিয়েছে, রাতে যদি নিজেরা রান্না না করতে পারে তাহলে একটা রান্নার লোক সাথে নিয়ে যাবে। জারিনা আর ঋতুপর্ণা জানিয়ে দেয় ওরা রান্না করতে রাজি। পরাশর হেসে বলে, পাহাড়ি পথে হাটার পরে দেহে আর শক্তি থাকবে না যে রান্না করতে বসবে।
মেয়েদের মধ্যে বিশেষ করে শ্রেয়া, ঋতুপর্ণা আর অনুপমার খুব চিন্তা স্নান করবে কি করে। দেবায়ন মজা করে বলে, “ভিলাঙ্গনা নদীর ঠাণ্ডা জলে তোরা স্নান করে আমাদের কোলে চেপে যাস আমরা তোদের ঠিক গরম করে দেব।”
ধীমান একটু নেচে নেয় সেই শুনে, “এইবারে কে কার কোলে চাপবে সেটা কিন্তু আমি ঠিক করে দেব।”
রূপক হেসে শান্তনুর কাঁধ চাপড়ে বলে, “কি বস, আমরা সবাই কিন্তু ঠোঁট কাটা, মুখে কোন ট্যাক্স নেই।”
মনীষার দিকে চোখ টিপে উত্তর দেয় শান্তনু হেসে বলে, “তাতে অসুবিধে নেই শুধু আমার বউটা যেন বেঁচে ফিরে আসে।”
সেই শুনে লজ্জায় মনীষার কান গাল লাল হয়ে যায়। এমন একটা দলের সাথে আগে কোনোদিন কোথাও যায়নি। ওরা যে এতটা ঠোঁট কাটা আর এই সব বিষয়ে কথাবার্তা বলবে সেটা ভাবেনি।
দেবায়ন চোখ টিপে শান্তনুকে জিজ্ঞেস করে, “বস, আজ রাতে কি কান খুচাবে না অন্য কিছু?”
শান্তনু মুখ গোমড়া করে বলে, “না রে ভাই, কান খুচাবো….. কি করি বলো পাউরুটিতে জ্যাম লেগে আছে। আশা করি কাল শেষ হয়ে যাবে।”
মনীষা সেই শুনে ওকে মারতে শুরু করে দেয় আর বাকিরা সবাই হেসে ফেলে।
হৃষীকেশ থেকে কাক ভোরে ওরা সবাই বাসে চেপে বেড়িয়ে পড়ে ঘুট্টুর উদ্দেশ্যে। একশো সত্তর কিলোমিটার পথ, এরপরে যেতে হবে তেহেরি, ঘনসিয়ালি হয়ে ওদের যেতে হবে ঘুট্টু। তেহেরি শহর আর নেই, বাঁধের ফলে গঙ্গার স্তর বেড়ে গেছে যার ফলে শহর উঠে গেছে। হৃষীকেশ ছাড়াতেই ওদের বাস ধীরে ধীরে সরু আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে ধরে চড়াই উঠতে শুরু করে দেয়। সরু পথ, দুই ধারে উঁচু সবুজ পাহাড়। বাস একবার ডানদিকে মোড় নেয় কিছুপরেই আবার বাম দিকে মোড় নেয়। বারকোট পার হতেই পায়েল বমি করতে শুরু করে দেয়, সেই দেখাদেখি সঙ্গীতা আর শ্রেয়ার বমি পেয়ে যায়। বারকোটের পরে একটা ছোট বসতি জায়গায় থেমে জল খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। প্রবাল, পরাশরের শরীর একটু খারাপ হয়ে যায় পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথে। শান্তনু দেবায়ন বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। জারিনা সঙ্গে ওষুধ এনেছিল সেই গুলো খেয়ে মোটামুটি সবাই সুস্থ হয়ে যায়। তেহেরি ড্যাম ছাড়িয়ে, গঙ্গা পার হয়ে আরো দুর ওদের যেতে হবে। তেহেরি পৌঁছাতেই দুপুর, ঘনসিয়ালি পৌঁছাতে আরো বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। ড্যামের জন্য বড় ভারী গাড়ি চলার ফলে তেহেরির পর থেকেই রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। ঘনসিয়ালির পরে বলতে গেলে রাস্তা আর নেই। কালী বাগি থেকে ছোট ব্রিজ পার করে ভিলাঙ্গনা নদীর ওপাড়ে যায় ওদের বাস। দুর উত্তরে সুউচ্চ তুষারে ঢাকা হিমালয় পর্বত মালা দেখে সবার দেহ মন ভালো হয়ে ওঠে। ওই দুরের তুষারে ঢাকা কোন এক শৃঙ্গের নীচে ওদের গন্তব্য স্থল। খাটলিং গ্লেসিয়ার গলে তৈরি হয়েছে ভিলাঙ্গনা নদী।
ঘুট্টুতে একটা রেস্ট হাউসে ওদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। মেয়েদের সেই রেস্ট হাউস বিশেষ পছন্দের নয়, বিশেষ করে পায়েল আর অনুপমার। সেটা হওয়ার কথা, বড় লোকের মেয়ে সর্বদা ফাইভ স্টার হোটেলে থেকে এসেছে, ছোট রেস্ট হাউসে কি করে কাটাবে।
এই নিয়ে অনুপমার সাথে শান্তনুর একটু বচসা হয়ে যায়, “এই খানে রাত কাটানো যায় নাকি? সবাই এত ক্লান্ত হয়ে এসেছে আর এই জায়গায় কিছুই পাওয়া যায় না।”
শেষ মেশ দেবায়ন ওদের বুঝিয়ে বলে, “পুচ্চি আমরা এইখানে ফাইভ স্টার রিসোর্টে কাটাতে আসিনি। এটাই শেষ রেস্ট হাউস, এরপরে টেন্টে থাকতে হবে।”
অনুপমা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “বেশ তো, টেন্টে থাকব সেটাই ভালো।”
দেবায়ন শান্তনুকে অন্যদিকে পাঠিয়ে অনুপমাকে শান্ত করে, “আচ্ছা বাবা, এর চেয়ে ভালো কিছু এইখানে পাওয়া সম্ভব নয়। একটা রাতের ব্যাপার, এরপরে যখন ঘুরে আসবি তখন দেখবি এই রেস্ট হাউস তোর কাছে ফাইভ স্টার মনে হবে।”
কথাটা না বুঝতে পেরে অনুপমা পায়েল ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি করে?”
দেবায়ন হেসে বলে, “এরপরে শুধু মাত্র টেন্ট আর আমাদের মুখ দেখতে পাবি। এই ঘুট্টুর পর থেকে আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাবো। দশ দিন পরে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসব তখন এই বিছানা দেখে মনে হবে, আহহহ….. কি আরাম।”
দুইজনেই সেই শুনে হেসে ফেলে। উত্তরের তুষারে ঢাকা পর্বত মালা থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের কাঁপিয়ে দেয়। ঘুট্টুতে ওদের জন্য গাইড, রঞ্জিত আর জনা দশেক পোর্টার(কুলি) তৈরি ছিল। রঞ্জিতের বাড়ি তেহেরিতে ছিল, কিন্তু সেই শহর উঠে যাওয়ার পরে নিজের গ্রামে ফিরে যায়। এইখানে অথবা উত্তরকাশিতে গিয়ে বিভিন্ন ট্রেকিংয়ের গাইডের কাজ করে। মালবাহী ছেলে গুলো বাড়ি এই ঘুট্টু, গাঙ্গি, রীহ এইসব ছোট ছোট গ্রামে। রেস্ট হাউসের সামনের খোলা জায়গায় রাতের বেলা ক্যাম্প ফায়ার তৈরি করে সবাই গল্পে মেতে ওঠে। রঞ্জিত জানিয়ে দেয়, ঘুট্টু থেকে রীহ দশ কিলোমিটার পথ। রাস্তার প্রথম দিকে একটু চরাই তারপরে বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে ওদের এগোতে হবে। এতটা পথ বাসে যাত্রা করার পরে কারুর দেহে বেশিক্ষণ রাত জাগার শক্তি ছিল না। কোন রকমে খাওয়া সেরে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে সবাই সেঁধিয়ে যায়।
ভোর পাঁচটায় ওদের গাইড রঞ্জিত এসে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম ঘুম চোখে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে অনুপমা কাতর কণ্ঠে বলে, “উঠতে হবে নাকি? কটা বাজে?”
দেবায়ন গভীর নিদ্রায় ছিল তাই ওর কথা শুনতে পায়নি। স্লিপিং ব্যাগে অন্যদিকে ফিরে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। অনুপমা ওকে আরো জড়িয়ে ধরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। এই ঠাণ্ডায় ওর গায়ের গরমে সকালের ঘুম আর কিছুতেই ছাড়তে চায় না। এমন সময়ে শ্রেয়া আর ঋতুপর্ণা এসে ওদের ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বেশি দেরি করলে রীহ পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। সবার এই প্রথম বার ট্রেকিংয়ে যাওয়া তাই সবাই বেশ উৎসাহী। গরম জলে স্নান সেরে, ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই বেরিয়ে পড়ে রীহের উদ্দেশ্যে। খাবারের ব্যাটারি, তাঁবুর সরঞ্জাম, বড় বড় ব্যাগ নিয়ে মালবাহী ছেলেরা অনেক আগেই রীহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। ওরা আগে থেকেই একটা ভালো জায়গা দেখে তাঁবু খাটিয়ে দুপুরের রান্নার যোগাড় করবে বলে ওদের গাইড রঞ্জিত ওদের জানিয়ে দেয়। ছেলেদের পিঠে নিজেদের একটা ব্যাগ আর মেয়েদের কাছে ছোট ব্যাগে শুধু মাত্র জলের বোতল। ঋতুপর্ণা, অনুপমা আর জারিনা বেশ শক্তপোক্ত, তাই নিজেদের ছোট ব্যাগ নিজেরাই বহন করে। অন্যদিকে শ্রেয়া নিজের ব্যাগ রুপকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, মনীষা এক প্রকার খালি হাতেই নাচতে নাচতে যাত্রা শুরু করে। অঙ্কন পায়েলের পাশ আর ছাড়ে না, সেই নিয়ে ওদের সবার মধ্যে বেশ হাসাহাসি হয়।
রেডিসনে এনুয়াল মিটেই রূপক, বন্ধুদের কাছে খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিংয়ের কথা বলেছিল। সেই শুনে অনেকে যেতে রাজি হয়ে যায়। পরাশর যেতে রাজি হয়ে যায়, জারিনা জানায় যাওয়ার জন্য ওর আব্বাজানকে রাজি করিয়ে নেবে। সঙ্গীতা লাফাতে শুরু করে দেয় ঘুরতে যাওয়ার কথা শুনে, অগত্যা প্রবালের তাই কিছু আর বলার থাকে না। ঋতুপর্ণা, ধীমান এক কথায় রাজি। শ্রেয়া আর পায়েল এই অজানা অচেনা জায়গায় যেতে একটু দ্বিধাবোধ ব্যাক্ত করে, কারন ওদের দলের মধ্যে কারুর ট্র্যাকিঙে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। দেবায়ন বুঝিয়ে বলে, কোন কিছুর প্রথমদিন সবার জীবনে একদিন না একদিন আসে। অনুপমার ভাই, অঙ্কন প্রেয়সী পায়েলের চাপে পড়ে আর না করে না, তবে বড়দের সাথে যেতে একটু দোনামোনা করে, বিশেষ করে জানে রূপক আর দেবায়ন কি রকমের ছেলে। ওর একবার কারুর পেছনে লাগলে তাকে না কাঁদিয়ে ছাড়ে না। রূপকের ওপরে সব কিছু পরিকল্পনার করার ভার কারন ওই বেশ উৎসাহী। ইন্টারনেট ঘেঁটে একটা ট্রেকিঙ্গের সাইটে লগইন করে একজনের সাথে আলোচনা করে অনেক কিছুর খোঁজ খবর ইতিমধ্যে নিয়ে নিয়েছে। অনুপমা আর দেবায়ন জানায়, খরচের সিংহ ভাগ ওরা দিতে রাজি। সেই সাথে অনুপমা আরো জানায় একজন অভিজ্ঞ চেনাজানা লোক সঙ্গে থাকলে বড় ভালো হয়। অফিসে এই নিয়ে কথাবার্তা চলে, সেই সময়ে ওরা জানতে পারে যে শান্তনু দিল্লীতে থাকার সময়ে বার পাঁচেক বিভিন্ন জায়গায় ট্রেকিংয়ে গেছে। ঠিক হয় যে শান্তনু আর মনীষাকেও সঙ্গে নেওয়া হবে। মনীষা পাহাড়ের মেয়ে, কিন্তু কোনোদিন ট্রেকিংয়ে যায়নি, তাই বেশ উৎসাহী। সব মিলিয়ে চোদ্দ জনের দল, বেশ বড় দল হলে যাওয়া সুবিধা। শান্তনুকে দলের নেতা হিসাবে মনোনীত করা হয়, আর বড় কারন সে অভিজ্ঞ আর দ্বিতীয়, দলের সব থেকে বড়, ওদের চেয়ে চার বছরের বড়। দলে সব থেকে বড় শান্তনু আর সব থেকে ছোট জারিনা আর অঙ্কন, বাকিদের বয়স মোটামুটি এক সবাই কলেজের বন্ধু।
পুজোর আগেই একদিন বিকেলে অফিসের পরে অনুপমাদের অফিসের কনফারেন্স রুমে ট্রেকিংয়ের আলোচনা পরিকল্পনার সভা বসে। ঠিক হয় একাদশীর দিনে ওরা সবাই কোলকাতা থেকে রওনা দেবে। শান্তনু আর রুপকের ওপরে সব কিছুর ভার। অনুপমা দেশ বিদেশে অনেক পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, কিন্তু সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি ওকে প্রবল ভাবে ডাক দেয়। শ্রেয়া, পায়েল ঋতুপর্ণা বেশ উৎসাহী ওদের কাছে পাহাড় বলতে দার্জিলিং, সিমলা কুলু মানালি আর সিকিম এর চেয়ে বেশি দুর কোথাও যায়নি। জারিনা আর সঙ্গীতা কোনোদিন পাহাড়ে যায়নি। ছেলেদের একমাত্র দেবায়ন ছাড়া মধ্যে অনেকে পাহাড়ে বেড়াতে গেছে।
ওই টিম মিটিঙে দেবায়ন বিশেষ করে জারিনা আর অঙ্কনকে বলে, “দেখ ভাই আমরা বেড়াতে যাচ্ছি, ওইখানে কিন্তু কেউ বড় কেউ ছোট নয় আর জানিস তো আমাদের অবস্থা…..”
রূপক ওর কথা টেনে নিয়ে বলে, “আমাদের কিন্তু কোন ট্যাক্স নেই, না কথাবার্তার, না…..”
পায়েল মুখ না খুললেও পাশে বসা অনুপমাকে আলতো ধাক্কা মেরে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, “ওই সব হলে কিন্তু আমি আর অঙ্কন যাবো না।”
অনুপমা ওকে অভয় দিয়ে বলে, “আরে না না এইবারে ওইসব উল্টোপাল্টা কিছুই হবে না সেই নিয়ে তোর চিন্তা নেই।”
দেবায়ন সেটা শুনে ফেলে ইয়ার্কি মেরে বলে, “আমি তোর জন্য চার প্যাকেট কনডোম নিয়ে যাবো, হয়েছে?”
জারিনার কান লজ্জায় লাল হয়ে যায় সেই শুনে। মনীষা হেসে ফেলে দেবায়নের কথা শুনে।
শান্তনু ওদের এই আলোচনা থামিয়ে বলে, “সব থেকে আগে আমাদের শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করতে হবে। খাটলিং গ্লেসিয়ার ট্রেকিং বেশ কষ্টকর ট্রেকিং, দিন দশেকের মতন তাঁবুতে থাকা আর হাঁটা। কখন উঁচু চড়াই কখন উতরাই। সেই মতন প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য প্রত্যেককে আমি মর্নিং ওয়াক করতে উপদেশ দেব।”
মনীষা ওকে আলতো ঠ্যালা মেরে বলে, “বাপরে, চোরের মায়ের বড় গলা, রোজদিন ঠিক সাড়ে আটটায় ঘুম থেকে উঠবে আর তড়িঘড়ি করে অফিসে আসবে। তোমার জন্য প্রায় দিন আমার লেট হয়ে যায়।”
শান্তনু কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে বলে, “যার বউ অফিসের এইচ.আর. সেই অফিসে লেট আসাতে ক্ষতি কি।”
ওই শুনে সবাই হেসে ফেলে।
জারিনা জানায়, বাবার কাছ থেকে সব ওষুধপত্র যোগাড় করে একটা বড় ফার্স্ট এইডবক্স আর বেশ কিছু ঠাণ্ডার জন্য ইনজেকশান নিয়ে যাবে। সেদিনের মতন সভা শেষ হলে সবাই কেনা কাটা করতে ব্যাস্ত হয়ে পরে। রূপক আর শান্তনুর ওপরে সব ভার, দলের নেতা শান্তনু আর রূপক ডান হাত, অনুপমা আর দেবায়ন ওদের পকেট। সবার একটা করে রাকস্যাক আর একটা ছোট ব্যাগ কেনা হয়। অনুপমার কাছে প্রচুর ভারী জ্যাকেট ছিল তাই শ্রেয়া আর পায়েলকে কোন জ্যাকেট কিনতে হয় না, তবে বাকিদের জন্য জ্যাকেট দস্তানা ইত্যাদি কেনা হয়। তাঁবুর সরঞ্জাম ঘনসিয়ালি থেকে নিয়ে নেওয়া হবে, গাইড আর মালবাহক লোকের ব্যাবস্থা ঘুট্টু নামক গ্রামে হয়ে যাবে বলে শান্তনু জানায়। এডমিনে থাকার ফলে এইসবের খবর আর ব্যাবস্থা করার কৌশল ওর বেশ ভালো করেই জানা।
ঠিক হয় একদশীর দিন বিকেলে প্লেনে চেপে সোজা দিল্লী। ধীরে ধীরে ঘুরতে যাওয়ার দিন কাছে চলে আসে। পুজো এক রকম হইহুল্লোড়ে কাটিয়ে একাদশীর দিন বিকেলে সবাই নিজেদের জিনিস পত্র নিয়ে কোলকাতা এয়ারপোর্টে উপস্থিত। ওদের ছাড়তে বাড়ির অনেকে এসেছে, বিশেষ করে জারিনার বাবা মা। প্রথম বার মেয়েকে এইভাবে একা বাইরে ছাড়ছে বলে একটু উদ্বেগ প্রকাশ করে। এয়ারপোর্টে পারমিতা এসেছিল, সেই জারিনার বাবাকে অভয় দিয়ে বলে এতগুলো ছেলে মেয়ে একসাথে যাচ্ছে কোন অসুবিধে হবে না। বিশেষ করে শান্তনু ওদের দলের মধ্যে সব থেকে বড়, বাকিদের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ।
প্লেন কোলকাতার মাটি ছাড়তেই সবাই নেচে ওঠে, মুক্তির স্বাদ, সুউচ্চ হিমালয়ের হাতছানি, হিমশীতল গ্লেসিয়াররে ডাক, পনেরো দিন শুধু মাত্র প্রকৃতির কোলে কাটাবে। এই কয়দিনে অনুপমা আর পায়েল ছাড়া কেউই মর্নিং অয়াক করেনি সেই নিয়ে একটু হাসা হাসি হয় প্লেনে। প্লেনের বাকি যাত্রীরা চোদ্দ জনের একটা ট্রেকিং টিম দেখে ভির্মি খেয়ে যায়। সাধারনত যে ভারতীয়রা ট্রেকিংয়ে যায় তারা অধিকাংশ ট্রেনে যাতায়াত করে, তাই অনুপমাদের দেখে করে প্লেনের বাকিরা একটু তাকিয়ে থাকে। ওরা কি আর চুপ করে থাকার মানুষ?
রূপক প্লেনে উঠেই পেছনে বসা পরাশরকে চেঁচিয়ে বলে, “এই শালা কেউ একটু জানালা খুলে দে বড্ড গরম লাগছে। এইখানে মনে হয় এসি নেই।”
সেই শুনে সবার হাসাহাসি শুরু হয়ে যায়। শ্রেয়া একজন বিমান সেবিকাকে ডেকে ইয়ার্কি মেরে বলে, “আচ্ছা, ওই টয়লেটে কেউ পটি করলে কি নীচে পড়ে যাবে?”
এয়ার হোস্টেস হাসবে না কাঁদবে কিছু ভেবে পায় না। ভাবে এইগুলো একদম গেঁয়ো নাকি? ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে বলে, “না না, তোর পটি এই শুন্যে উড়তে উড়তে পাখীদের খাদ্য হয়ে যাবে।”
শ্রেয়া হঠাৎ শান্তনুকে বলে, “টিম লিডার আমাদের খিদে পেয়েছে। ডিনারের কি ব্যাবস্থা।”
শান্তনু পেছন থেকে চেঁচিয়ে বলে, “সুন্দরীরা একটু চুপচাপ বসে থাকো, একটু পরেই খাবার সার্ভ করা হবে।”
মনীষা আর ঋতুপর্ণা চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ আমাদের নিরামিষ।”
এক কোনা থেকে পরাশর চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি কিন্তু মাছের ঝোল আর ভাত।”
দেবায়ন চেঁচিয়ে ওঠে, “টিম লিডার আমার হুইস্কি কোথায়?”
সেই সাথে তাল মেলায় রূপক আর ধীমান, “স্কচ অন রক্স বেবি।”
ওদের চেঁচামেচিতে প্লেনের বাকি যাত্রীরা রিতিমতন ভিরমি খেয়ে যায়।
প্লেনে ওঠার পর থেকে প্রবাল মুখে কুলুপ এঁটে চুপ। হাওয়ার চাপ কমে যাওয়ার ফলে ওর কান ভোভো করছে। সঙ্গীতার হাত খানি মুঠি করে ধরে চুপচাপ সিটে বসে। সেটা ধীমান দেখতে পেয়ে মজা করে বলে, “ওরে বাল, তোর বউ নিয়ে কেউ পালিয়ে যাবে না। প্লেনের মধ্যে কেউ নিয়ে আর পালাবে কোথায়। এইবারে একটু ছেড়ে দে।”
সঙ্গীতা উল্টে ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে বলে, “চুপ কর, প্লেনে চাপলে ওর মাথা ঘোরে।”
দেবায়ন সিট থেকে উঠে ওর মাথায় চাঁটি মেরে ইয়ার্কি মেরে বলে, “তোর জিন্স নয়, শাড়ি পরে আসা উচিত ছিল। ওকে আঁচলের তলায় লুকিয়ে রাখতিস তাহলে ভালো হত।”
অনুপমা ওদের বলে, “আরে আরে আঁচলের তলায় অনেক কিছু লুকানো আছে রে প্রবাল, লাগা একটু মুখ লাগা।”
এই ভাবে মজা করতে করতে ওরা রাতের বেলা দিল্লী পৌঁছায়। শান্তনু জানায়, ভোর বেলা একটা চোদ্দ সিটের বাস ওদের জন্য ঠিক করা হয়েছে। দিল্লী থেকে এই বাসে চেপেই ওরা হৃষীকেশ হয়ে ঘুট্টু যাবে। ঘুট্টু থেকে ওদের ট্রেকিংয়ের শুরু।
দিল্লীতে রাত কাটিয়ে তারপরের দিন সকাল বেলায় একটা ছোট বাসে চেপে সবাই হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দিল্লী ছাড়ার আগে, দেবায়ন রূপক আর ধীমান বেশ কয়েক বোতল হুইস্কি, রাম ইত্যাদি মদ কিনে নিয়েছিল। সারাটা রাস্তা হাসি মজা করতে করতে কেটে যায়। হৃষীকেশ পৌঁছাতে ওদের বিকেল হয়ে যায়। দেবায়ন, অঙ্কন আর অনুপমা ছাড়া বাকিদের হৃষীকেশ আগে থেকে ঘোরা ছিল। তাও সন্ধ্যের পরে সবাই হৃষীকেশ ঘুরে বেড়িয়ে দেখে। পুজোর পরে একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব এসে গেছে পাহাড়ের পাদদেশে। হৃষীকেশ থেকে পাহাড় শুরু, ওদের হোটেলের পেছনে পাহাড়, গঙ্গার জল এইখানে খুব ঠাণ্ডা। এর ওপরে গেলে জলের তাপমাত্রা কত কম্বে সেই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু হয়। হৃষীকেশে ওরা দশ দিনের খাবার দাবার কেনাকাটা করে নেয়। ম্যাগি, চাল ডাল, আলু ইত্যাদি। শান্তনু জানিয়েছে, রাতে যদি নিজেরা রান্না না করতে পারে তাহলে একটা রান্নার লোক সাথে নিয়ে যাবে। জারিনা আর ঋতুপর্ণা জানিয়ে দেয় ওরা রান্না করতে রাজি। পরাশর হেসে বলে, পাহাড়ি পথে হাটার পরে দেহে আর শক্তি থাকবে না যে রান্না করতে বসবে।
মেয়েদের মধ্যে বিশেষ করে শ্রেয়া, ঋতুপর্ণা আর অনুপমার খুব চিন্তা স্নান করবে কি করে। দেবায়ন মজা করে বলে, “ভিলাঙ্গনা নদীর ঠাণ্ডা জলে তোরা স্নান করে আমাদের কোলে চেপে যাস আমরা তোদের ঠিক গরম করে দেব।”
ধীমান একটু নেচে নেয় সেই শুনে, “এইবারে কে কার কোলে চাপবে সেটা কিন্তু আমি ঠিক করে দেব।”
রূপক হেসে শান্তনুর কাঁধ চাপড়ে বলে, “কি বস, আমরা সবাই কিন্তু ঠোঁট কাটা, মুখে কোন ট্যাক্স নেই।”
মনীষার দিকে চোখ টিপে উত্তর দেয় শান্তনু হেসে বলে, “তাতে অসুবিধে নেই শুধু আমার বউটা যেন বেঁচে ফিরে আসে।”
সেই শুনে লজ্জায় মনীষার কান গাল লাল হয়ে যায়। এমন একটা দলের সাথে আগে কোনোদিন কোথাও যায়নি। ওরা যে এতটা ঠোঁট কাটা আর এই সব বিষয়ে কথাবার্তা বলবে সেটা ভাবেনি।
দেবায়ন চোখ টিপে শান্তনুকে জিজ্ঞেস করে, “বস, আজ রাতে কি কান খুচাবে না অন্য কিছু?”
শান্তনু মুখ গোমড়া করে বলে, “না রে ভাই, কান খুচাবো….. কি করি বলো পাউরুটিতে জ্যাম লেগে আছে। আশা করি কাল শেষ হয়ে যাবে।”
মনীষা সেই শুনে ওকে মারতে শুরু করে দেয় আর বাকিরা সবাই হেসে ফেলে।
হৃষীকেশ থেকে কাক ভোরে ওরা সবাই বাসে চেপে বেড়িয়ে পড়ে ঘুট্টুর উদ্দেশ্যে। একশো সত্তর কিলোমিটার পথ, এরপরে যেতে হবে তেহেরি, ঘনসিয়ালি হয়ে ওদের যেতে হবে ঘুট্টু। তেহেরি শহর আর নেই, বাঁধের ফলে গঙ্গার স্তর বেড়ে গেছে যার ফলে শহর উঠে গেছে। হৃষীকেশ ছাড়াতেই ওদের বাস ধীরে ধীরে সরু আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে ধরে চড়াই উঠতে শুরু করে দেয়। সরু পথ, দুই ধারে উঁচু সবুজ পাহাড়। বাস একবার ডানদিকে মোড় নেয় কিছুপরেই আবার বাম দিকে মোড় নেয়। বারকোট পার হতেই পায়েল বমি করতে শুরু করে দেয়, সেই দেখাদেখি সঙ্গীতা আর শ্রেয়ার বমি পেয়ে যায়। বারকোটের পরে একটা ছোট বসতি জায়গায় থেমে জল খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু। প্রবাল, পরাশরের শরীর একটু খারাপ হয়ে যায় পাহাড়ের আঁকা বাঁকা পথে। শান্তনু দেবায়ন বেশ চিন্তায় পড়ে যায়। জারিনা সঙ্গে ওষুধ এনেছিল সেই গুলো খেয়ে মোটামুটি সবাই সুস্থ হয়ে যায়। তেহেরি ড্যাম ছাড়িয়ে, গঙ্গা পার হয়ে আরো দুর ওদের যেতে হবে। তেহেরি পৌঁছাতেই দুপুর, ঘনসিয়ালি পৌঁছাতে আরো বেশ কয়েক ঘণ্টা লেগে যাবে। ড্যামের জন্য বড় ভারী গাড়ি চলার ফলে তেহেরির পর থেকেই রাস্তার অবস্থা খুব খারাপ। ঘনসিয়ালির পরে বলতে গেলে রাস্তা আর নেই। কালী বাগি থেকে ছোট ব্রিজ পার করে ভিলাঙ্গনা নদীর ওপাড়ে যায় ওদের বাস। দুর উত্তরে সুউচ্চ তুষারে ঢাকা হিমালয় পর্বত মালা দেখে সবার দেহ মন ভালো হয়ে ওঠে। ওই দুরের তুষারে ঢাকা কোন এক শৃঙ্গের নীচে ওদের গন্তব্য স্থল। খাটলিং গ্লেসিয়ার গলে তৈরি হয়েছে ভিলাঙ্গনা নদী।
ঘুট্টুতে একটা রেস্ট হাউসে ওদের থাকার ব্যাবস্থা করা হয়েছিল। মেয়েদের সেই রেস্ট হাউস বিশেষ পছন্দের নয়, বিশেষ করে পায়েল আর অনুপমার। সেটা হওয়ার কথা, বড় লোকের মেয়ে সর্বদা ফাইভ স্টার হোটেলে থেকে এসেছে, ছোট রেস্ট হাউসে কি করে কাটাবে।
এই নিয়ে অনুপমার সাথে শান্তনুর একটু বচসা হয়ে যায়, “এই খানে রাত কাটানো যায় নাকি? সবাই এত ক্লান্ত হয়ে এসেছে আর এই জায়গায় কিছুই পাওয়া যায় না।”
শেষ মেশ দেবায়ন ওদের বুঝিয়ে বলে, “পুচ্চি আমরা এইখানে ফাইভ স্টার রিসোর্টে কাটাতে আসিনি। এটাই শেষ রেস্ট হাউস, এরপরে টেন্টে থাকতে হবে।”
অনুপমা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “বেশ তো, টেন্টে থাকব সেটাই ভালো।”
দেবায়ন শান্তনুকে অন্যদিকে পাঠিয়ে অনুপমাকে শান্ত করে, “আচ্ছা বাবা, এর চেয়ে ভালো কিছু এইখানে পাওয়া সম্ভব নয়। একটা রাতের ব্যাপার, এরপরে যখন ঘুরে আসবি তখন দেখবি এই রেস্ট হাউস তোর কাছে ফাইভ স্টার মনে হবে।”
কথাটা না বুঝতে পেরে অনুপমা পায়েল ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি করে?”
দেবায়ন হেসে বলে, “এরপরে শুধু মাত্র টেন্ট আর আমাদের মুখ দেখতে পাবি। এই ঘুট্টুর পর থেকে আমরা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সরু পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যাবো। দশ দিন পরে যখন ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসব তখন এই বিছানা দেখে মনে হবে, আহহহ….. কি আরাম।”
দুইজনেই সেই শুনে হেসে ফেলে। উত্তরের তুষারে ঢাকা পর্বত মালা থেকে বয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া ওদের কাঁপিয়ে দেয়। ঘুট্টুতে ওদের জন্য গাইড, রঞ্জিত আর জনা দশেক পোর্টার(কুলি) তৈরি ছিল। রঞ্জিতের বাড়ি তেহেরিতে ছিল, কিন্তু সেই শহর উঠে যাওয়ার পরে নিজের গ্রামে ফিরে যায়। এইখানে অথবা উত্তরকাশিতে গিয়ে বিভিন্ন ট্রেকিংয়ের গাইডের কাজ করে। মালবাহী ছেলে গুলো বাড়ি এই ঘুট্টু, গাঙ্গি, রীহ এইসব ছোট ছোট গ্রামে। রেস্ট হাউসের সামনের খোলা জায়গায় রাতের বেলা ক্যাম্প ফায়ার তৈরি করে সবাই গল্পে মেতে ওঠে। রঞ্জিত জানিয়ে দেয়, ঘুট্টু থেকে রীহ দশ কিলোমিটার পথ। রাস্তার প্রথম দিকে একটু চরাই তারপরে বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথে ওদের এগোতে হবে। এতটা পথ বাসে যাত্রা করার পরে কারুর দেহে বেশিক্ষণ রাত জাগার শক্তি ছিল না। কোন রকমে খাওয়া সেরে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে সবাই সেঁধিয়ে যায়।
ভোর পাঁচটায় ওদের গাইড রঞ্জিত এসে ওদের ঘুম থেকে উঠিয়ে দেয়। ঘুম ঘুম চোখে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে অনুপমা কাতর কণ্ঠে বলে, “উঠতে হবে নাকি? কটা বাজে?”
দেবায়ন গভীর নিদ্রায় ছিল তাই ওর কথা শুনতে পায়নি। স্লিপিং ব্যাগে অন্যদিকে ফিরে কাত হয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। অনুপমা ওকে আরো জড়িয়ে ধরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। এই ঠাণ্ডায় ওর গায়ের গরমে সকালের ঘুম আর কিছুতেই ছাড়তে চায় না। এমন সময়ে শ্রেয়া আর ঋতুপর্ণা এসে ওদের ধাক্কা দিয়ে তুলে দেয়। বেশি দেরি করলে রীহ পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। সবার এই প্রথম বার ট্রেকিংয়ে যাওয়া তাই সবাই বেশ উৎসাহী। গরম জলে স্নান সেরে, ব্রেকফাস্ট সেরে সবাই বেরিয়ে পড়ে রীহের উদ্দেশ্যে। খাবারের ব্যাটারি, তাঁবুর সরঞ্জাম, বড় বড় ব্যাগ নিয়ে মালবাহী ছেলেরা অনেক আগেই রীহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে। ওরা আগে থেকেই একটা ভালো জায়গা দেখে তাঁবু খাটিয়ে দুপুরের রান্নার যোগাড় করবে বলে ওদের গাইড রঞ্জিত ওদের জানিয়ে দেয়। ছেলেদের পিঠে নিজেদের একটা ব্যাগ আর মেয়েদের কাছে ছোট ব্যাগে শুধু মাত্র জলের বোতল। ঋতুপর্ণা, অনুপমা আর জারিনা বেশ শক্তপোক্ত, তাই নিজেদের ছোট ব্যাগ নিজেরাই বহন করে। অন্যদিকে শ্রেয়া নিজের ব্যাগ রুপকের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, মনীষা এক প্রকার খালি হাতেই নাচতে নাচতে যাত্রা শুরু করে। অঙ্কন পায়েলের পাশ আর ছাড়ে না, সেই নিয়ে ওদের সবার মধ্যে বেশ হাসাহাসি হয়।