05-10-2020, 07:45 PM
পর্ব ২৭ (#০৫)
দেবায়ন এখন অফিসে আসেনি। বাবা এইবারে গোয়া গেছে একটা নতুন রিসোর্টের ব্যাপারে। দেবায়নকে সাথে নিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু অনুপমার অনুরোধে এইবারে আর দেবায়ন যায়নি। সকাল থেকে ঝিরঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই বৃষ্টিতে মামনির কাছে থাকলে, সোনামুগ ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা খাওয়া যেত। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছেলেটা কোথায় যে বের হল? সকালে ফোন করে বলেছিল যে অফিসে আসতে একটু দেরি হবে কিন্তু কত দেরি? লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে প্রায়। কোলকাতায় থাকলে এমন দেরি করে না, যদি কেনাকাটা কিছু করার থাকে তাহলে ওকে সাথেই নিয়েই বের হয়। কাজ থাকলে ওকে বলে যেত কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু না, কি বলল, “এই একটু দোকানে যাবো।” কেন যাবি কোন দোকানে যাবি কিছুই বলল না। বৃষ্টির ভিজে হাওয়ায় হৃদয় বড় উদাস হয়ে যায় অনুপমার। পাগল বাউলের মতন খালি নেচে বেড়ায় এদিক ওদিক।
বেচারি অনুপমার খুব বড় অভিযোগ, সব প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের নানান ধরনের উপহার দেয়, কিন্তু দেবায়ন ওকে আজ পর্যন্ত কিছুই দেয়নি। অবশ্য তাতে ওর ভুল ছিল না যে তা নয়, কলেজে পড়ার সময় থেকেই দেবায়নকে টাকা খরচ করতে দিত না, কিন্তু তাই বলে চাকরি পাওয়ার পরে ওকে একটা উপহার দেবে না? না না, এতটা ওর ওপরে অভিযোগ করা ঠিক নয়। গতবার যখন বিন্সার, ডালহৌসি কাজে গেছিল তখন ডালহৌসি থেকে ওর জন্য একটা সুন্দর ফারের জ্যাকেট কিনে এনেছিল। যদিও ওর কাছে প্রচুর জ্যাকেট, তাও ওর দেওয়া জ্যাকেট খানা ওর বেশ পছন্দ হয়েছিল।
এইসব ভাবছিল অনুপমা নিজের হাত দেখে, আঙ্গুল গুলো বড্ড খালি শুধু একটা সোনার আংটি ছাড়া কিছুই নেই। ঠিক তখন দেবায়ন কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ওকে দেখে হাসে। কি ব্যাপার, চোখে যেন এক শয়তানি হাসি, আবার কোথায় কি করে এসেছে দেবায়ন? আর পারা গেল না এই ছেলেটাকে নিয়ে, নিশ্চয় কোথাও কোন মেয়ে দেখেছে আর সেই গল্প জুড়ে বসবে, না হয় কোন ডিল ফাইনাল হবে সেই নিয়ে আলোচনা। কিন্তু এই চেহারা আর এই মিচকি হাসি কেমন যেন ঠেকায়। কোনোদিন এমন ভাবে মাথা চুলকে হাসতে দেখেনি ওকে। না না, একবার ওর সামনে এসেছিল এই ভাবে মিচকি হাসতে হাসতে, সে বহুদিন আগের কথা।
ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে প্রশ্ন করে দেবায়ন, “কি রে কি করছিস?”
অনুপমা উঠে দাঁড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে নাকে নাক ঘষে মিষ্টি করে বলে, “তোর কথা ভাবছিলাম।” তারপরে কিঞ্চিত অভিমানী কণ্ঠে ওকে বলে, “সবার বয়ফ্রেন্ডরা কত কিছু দেয়…..”
ডান হাতে বাম হাত নিয়ে আলতো চেপে চোখ চোখ রেখে বলে দেবায়ন, “আমি সত্যি তোকে কিছু দেইনি কোনোদিন?”
ওই প্রগাঢ় ভালোবাসার চাহনির সামনে লজ্জায় পরে যায় অনুপমা, মাথা নিচু করে আলতো ঝাঁকিয়ে বলে, “না মানে…..”
ওর বাম হাত ঠোঁটের কাছে এনে হাতের তালুতে ছোট চুমু খায় দেবায়ন। তপ্ত ভিজে ঠোঁটের পরশে অনুপমার শরীর শিহরিত হয়ে যায়। আপনা হতেই দেবায়নের কলারে হাত উঠে যায়। দেবায়ন ওর দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে, দুই চোখে প্রেমের ধিকিধিকি আগুন, ওকে ঝলসে দেওয়ার আগের মুহূর্তে নিয়ে যায়। নিজেকে ওর প্রশস্ত বুকের ওপরে আছাড় মারতে উদ্যত হয় অনুপমা। দেবায়ন ঝুঁকে ওর বাম হাতের আঙ্গুল একটা একটা করে মুখের মধ্যে নিয়ে গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত চুষে দেয়। কেঁপে ওঠে অনুপমা, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কি করছে ছেলেটা, এটা যে অফিস। এইভাবে কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে, নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারবে? ওর দেহের প্রত্যেক স্নায়ু উন্মুখ হয়ে ওঠে দেবায়নের দেহের সাথে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য। অনুপমার অনামিকা মুখের মধ্যে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুষে দেয় তারপরে অনামিকা বের করে আনে মুখের মধ্যে থেকে।
তিরতির করে ভীষণ প্রেমের জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে দেবায়নকে গভীর আবেগজনিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি করছিস তুই?”
দেবায়ন ওর অনামিকা চেপে ধরে, আঙ্গুলে শক্ত ধাতুর গোলাকার কিছু একটা ঠেকে। দেবায়ন ওর চোখে চোখ রেখে খুব নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “বুড়ি হয়ে আমার মাথার পাকা চুল তুলে দিতে দিতে আমার সাথে ঝগড়া করবি?”
দেবায়ন ওর অনামিকায় কিছু একটা ঠেলে দেয়। হাতের চাপের মধ্যে বুঝতে পারে ওর আঙ্গুলে একটা আংটি। চোখ জোড়া ভরে আসে অনুপমার। চোখের পাতার সাথে সাথে ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে অনুপমার। আলতো মাথা নাড়িয়ে প্রগাঢ় আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে, “করব রে, খুব ঝগড়া করব। তুই তোর দাঁতের পাটি ভুলে যাবি আর আমি খুঁজে দেব।”
দেবায়ন আবেগজড়ানো কণ্ঠে বলে, “সত্যি তুই খুঁজে দিবি? আর তোর চোখের চশমাটার কি হবে?”
দেবায়নের নাকের ওপরে নাক ঘষে বলে, “তুই আমাকে দেখিয়ে দিবি আর কি। আমি ওষুধ খেতে ভুলে গেলে কি হবে?”
উত্তর দেয় দেবায়ন, “ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখব, মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখব।”
অনুপমা ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করে, “কবে থেকে শুরু করব এই খোঁজাখুঁজি?”
দেবায়ন ওর মুখ আঁজলা করে ধরে বলে, “এই ডিসেম্বর থেকে শুরু করলে কেমন হয়?”
মাথা উঁচু করে ওর চোখের দিকে তাকায় অনুপমা। আলতো ঠোঁট মেলে এগিয়ে দেয় দেবায়নের দিকে। ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে ওই কথা শুনে। দেবায়নের ঠোঁট নেমে আসে ওর লাল নরম ঠোঁটের ওপরে। মিশে যায় দুই জোড়া কপোত কপোতীর ঠোঁট। অনুপমার আঙ্গুলে একটা বড় সলিটায়ার হীরের আংটি।
চুম্বন শেষে, ওর বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে চুপচাপ পরে থাকে অনেকক্ষণ। দেবায়ন ওকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে দেয়। এইবারে ওর রাত আর বড় হবে না, এই বারে ওর আর ঠাণ্ডা লাগবে না। ওর বুক আর খালি থাকবে না। আয়নার সাথে আর কথা বলতে হবে না। রোজ সকালে ওকে ফোন করে উঠাতে হবে না। রাতে “গুড নাইট” কিস হাওয়ায় দিতে হবে না। ওর জামা চুরি করে পড়তে হবে না। অনেক কিছু “হবে না” তালিকা শেষ হয়ে যাবে ওর জীবনে।
আঙ্গুলের আংটিটা দেখে, সোনার আংটির ওপরে একটা বড় হীরে। এই কিছুক্ষণ আগেই কত অভিযোগ নিয়ে নিজের সাথে কথা বলছিল আর ঠিক তখনি….. পুচ্চু কি ওর মনের কথা শুনতে পারে নাকি? ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কাঁপা আবেগভরা কণ্ঠে বলে, “তুই কি আমার মনের কথা শুনতে পেরেছিলি?”
দেবায়ন আলতো মাথা দোলায়, “হঠাৎ করে আজ সকালে বৃষ্টি দেখে বুকটা বড় ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল তুই কাছে থাকলে দুইজনে বাইকে করে এই বৃষ্টিতে ভিজতে বের হয়ে যেতাম।”
অনুপমা ওর বুকের ওপরে একটা কিল বসিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলে, “বললি না কেন?”
ওর গালে আলতো চুমু খেয়ে দেবায়ন উত্তর দেয়, “তাহলে এই সারপ্রাইস হত কি করে?”
আবার দেবায়নকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, “খুব সুন্দর হয়েছে রে আংটিটা। মামনিকে বলেছিস?”
দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “না মানে এখন মা’কে বলিনি ভাবছি তুই আমার সাথে বাড়ি চল, দুইজনে একসাথে মা’কে বলব।”
একটু লাজুক হেসে বলে, “আর বাকিদের?”
দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “এখন নয়, বাকিদের না হয় ওই ট্রিপে গিয়ে বলব যে ডিসেম্বরে আমরা বিয়ে করছি।” ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বলে, “চল কোথাও বেড়িয়ে পরি এই বৃষ্টিতে।”
সেই শুনে নেচে ওঠে অনুপমা, চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে ওর, “কোথায় যাবো?”
দেবায়ন মিচকি হেসে বলে, “কোলকাতায় রাস্তার অভাব আছে নাকি? পারলে না হয় দুরগাপুর হাইওয়ে ধরা যাবে। যতদূর যাওয়া যায় যাবো তারপরে আবার বাইক ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরব।”
“নক নক….. কৌন হ্যায়? নক নক….. কৌন হ্যায়?” অনুপমার ফোন বেজে ওঠে, এটা মায়ের রিং টোন। এই এমন সময়ে মা ফোন করল হঠাৎ করে, কি ব্যাপার? হৃদয়ে প্রবল উচ্ছাস, ঠিক পেছনে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে দেবায়ন ওর ঘাড়ের ওপরে নাক ঘষে উত্যক্ত করে তোলে ওকে। আঙ্গুলের আংটি দেখে মাকে বলার জন্য অধীর হয়ে ওঠে।
ফোন তুলেই মাকে বলে, “জানো মা আজকে কি হয়েছে।”
পারমিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
লাজুক হেসে প্রবল উচ্ছাসে দেবায়নের হাত খানি বুকের কাছে টেনে বলে, “পুচ্চু আমাকে একটা সলিটেয়ার দিয়েছে।”
পারমিতা অন্যপাশ থেকে খুশি হয়ে বলে, “এতদিনে তাহলে তোরা বিয়েটা সারছিস।”
মাথা দোলায় অনুপমা, “হ্যাঁ…..”
পারমিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যান্ডসাম কি কাছে আছে নাকি?”
দেবায়ন মিচকি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মিমি, তোমার মেয়েকে এইবারে তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে আমার কাছে রাখব ভাবছি।”
পারমিতা কিঞ্চিত ধরা গলায় বলে, “বারন কে করেছে, সে তো অনেকদিন আগেই নিয়ে গেছ।”
দেবায়ন উত্তর দেয়, “এইবারে একদম পাকাপাকি ভাবে নিয়ে যাবো।”
পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি জানে?”
অনুপমা উত্তর দেয়, “না এখন মামনিকে জানানো হয়নি। আজ রাতে জানাবো।”
দেবায়ন বলে, “তুমি আর মা একটা ভালো দিনক্ষণ ঠিক কর, আর তর সইছে না।”
পারমিতা অন্যদিক থেকে হেসে বলে, “ইসসস আর তর সইছে না, সব হয়ে গেল আর কি বাকি আছে?”
অনুপমা হেসে বলে, “অনেক কিছু বাকি, ওর মাথার পাকা চুল তুলে দেওয়া বাকি, আমার চশমা হারিয়ে যাওয়া আর ওর দ্বারা খুঁজে পাওয়া বাকি…..”
পারমিতা হেসে বলে, “আচ্ছা হয়েছে, বুঝতে পারছি তোর মনে বিয়ের ফুল ফুটছে। যার জন্য ফোন করেছিলাম। তোরা দুইজনে একসাথে আছিস যখন ভালোই হল। অনন্যা আর সত্যজিত এসেছে, তোদের সাথে ওর পত্রিকার সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে চায়।”
অনুপমা কপালে করাঘাত করে, দুই দিন আগে অনন্যা ওকে ফোন করে বলেছিল যে পত্রিকার সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য ওর বাড়িতে আসতে চায়। অনুপমা একদম ভুলে গেছে, এমন কি দেবায়নকে বলতেও ভুলে গেছে। আসলে এনুয়াল মিটের পর থেকেই এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট নিয়ে শ্রেয়ার সাথে এত ব্যাস্ত ছিল যে অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাবার সময় ছিল না ওর কাছে।
মা’কে উত্তরে বলে, “উফফফ একদম ভুলে গেছি….. আচ্ছা এক কাজ কর ওদের কিছুক্ষণ বসতে বল আমরা এই এক ঘন্টার মধ্যে আসছি।”
ফোন ছেড়ে দেবায়ন কে সবিস্তারে অনন্যার বিষয়ে জানায়। ফোনে ওর সাথে অনন্যার শুধু মাত্র একটু কথাবার্তা হয়েছিল। প্রোজেকশান, লাইন অফ বিজনেস, স্ট্রাটেজি এইসব ওর মাথায় ঢোকে না তাই এই বিষয়ে বাবার সাথে আর দেবায়নের সাথে আলোচনা করার কথা বলেছিল। দেবায়ন সব শুনে একটু মন মরা হয়ে যায়, অনুপমাও একটু মন মরা হয়ে যায়। এই ভিজে আবহাওয়ায় ঘুরতে যেতে বেশি ভালো লাগে এর মধ্যে আবার ব্যাবসা সংক্রান্ত আলোচনা করতে বসতে হবে ভেবেই মন কিঞ্চিত ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু কি করা যাবে, অনন্যা একদম বাড়ি পৌঁছে গেছে, আবার মায়ের সাথে অনন্যার বেশ ভালো সম্পর্ক। দেবায়ন আর অনুপমা কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথে যেতে যেতে অনুপমা জানায় ওদের আশি থেকে নব্বুই লাখ টাকার দরকার।
বাড়িতে পা রাখতেই ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে, “বাপ রে শেষ পর্যন্ত আমার মেয়ে বড় হয়ে গেল।” আবেগ জড়িত, মাতৃস্নেহে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, “মেয়েটাকে একটু দেখো।”
অনুপমা মা’কেজড়িয়ে ধরে বলে, “প্লিস মা, এখুনি শুরু করোনা তো।”
হাতের বড় হীরের আংটি দেখে পারমিতা ওকে বলে, “তোর ভাগ্য সত্যি ভালো।”
দেবায়ন মিচকি হেসে বলে, “ভাগ্য আমার ভালো। যাই হোক এইবারে আগে কাজ সারি তারপরে বাড়ি ফিরতে হবে। মাকে এখন জানানো হয়নি। আজ রাতে অনু কিন্তু আমাদের বাড়িতে থাকবে।”
পারমিতা দেবায়নের গালে আলতো টোকা মেরে হেসে বলে, “আমার বাড়ির মেয়ে অনেকদিন আগেই শ্বশুর বাড়িতে পা রেখে দিয়েছে, আর কি কিছু বলতে পারি?”
অনন্যা আর সত্যজিত বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের সামনে এই বিষয়ে কিছু আর আলোচনা করা হল না। সামান্য কুশল সম্ভাষণের পরেই সোজা প্রত্রিকা সম্বন্ধে আলোচনায় বসে গেল। সত্যজিত ফাইল এনেছিল, ল্যাপটপে বেশ কয়েকটা প্রেসেন্টেসান বানিয়ে এনেছিল, সেই গুলো দেখাল। ইতিমধ্যে ওদের পাব্লিকেশানের একটা নাম ঠিক করা হয়েছে, পত্রিকার একটা নাম ঠিক করে নিয়েছে “ফুলের ঝুড়ি”। সত্যজিত নিজে ফটোগ্রাফার, এই পাবলিকেশান লাইনে বেশ চেনাজানাও আছে, বেশ কয়েকজন সম্পাদক সম্পাদিকার সাথে ইতিমধ্যে কথাবার্তা আলোচনা সেরে নিয়েছে। আগামী বড়দিনে পত্রিকার শুরু করতে চায়।
সব শুনে দেবায়ন স্মিত হেসে জানায়, “দেখো মিস্টার সত্যজিত, এমনিতে এই পাবলিকেশান লাইনে বিনিয়োগ করা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ, মানুষে বই খুব কম পড়ে। মাসে কয়টা কপি বিক্রি করতে পারবে? তুমি যে প্রোজেকশান দেখিয়েছ সেটা পাঁচ বছরে এচিভ করতে পারবে বলে আমার সন্দেহ আছে।”
সত্যজিত একটু দমে যায় ওর কথা শুনে। অনেক আশা ভরসা নিয়ে অনন্যার কাছে শুনেই এদের কাছে এসেছিল। দেবায়ন তাও ওকে বলে, “আশি লাখ টাকা বিনিয়োগ করা খুব বড় ঝুঁকি। এত টাকা বিনিয়োগের আগে আমাকে একবার সেন কাকুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে।”
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে ওকে বলে, “বাঙালী মেয়েরা এখন বাড়িতে বসে বই পড়ে। আর শুধু যে পত্রিকা বেচে আমাদের টাকা আসবে সেটা নয়। বিজ্ঞাপনেও টাকা আসবে সেই নিয়ে তোমার চিন্তা নেই, শুধু প্রাথমিক ইন্ধন আমাদের নেই।”
পারমিতা দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন, আমি সোমেশকে বুঝিয়ে বলে দেব, শুধু তুমি না কর না। অনন্যা অনেক করেছে, ওর জন্য এইটুকু করতেই হবে।”
পারমিতা আর অনন্যা কি ভাবে ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানিতে কাজ এনেছে সেই বিষয়ে দেবায়ন ভালো ভাবেই জানে।
অনুপমা এর মধ্যে নেই তাই স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, “আমি এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না, অনন্যাদি। ও আর বাবা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই চূড়ান্ত।”
দেবায়ন খানিক ভেবে স্মিত হেসে বলে, “কাকিমা যখন বলছে তখন দিতে পারি। তবে আমার কয়েকটা শর্ত আছে।”
সত্যজিত জিজ্ঞেস করে, “কি শর্ত?”
দেবায়ন উত্তরে বলে, “ব্রেক ইভেনে না পৌঁছানো পর্যন্ত কাকিমা তোমাদের এই পাবলিকেশানের এম ডি হয়ে থাকবে, তারপরে দেখা যাবে। আর বোর্ড অফ ডাইরেক্টরের মধ্যে পায়েল কে নিতে হবে। অনুপমার অত সময় নেই, কিন্তু পায়েল মাঝে মাঝে তোমাদের অফিসে যেতে পারে।”
সত্যজিত আর অনন্যা মুখ চাওয়াচায়ি কর নিচু কণ্ঠে নিজেদের অধ্যে আলোচনা করে ওদের জানায়, এই শর্ত ওরা মানতে রাজি। দেবায়ন জানিয়ে দেয়, কিছুদিনের মধ্যেই মিস্টার সেনের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে ওদের এই পত্রিকার টাকা দিয়ে দেবে।
সেই সাথে দেবায়ন অনন্যাকে মিচকি হেসে বলে, “সেই দিন রাতে তুমি বলছিলে ষাট লাখ টাকা আর এই কয়দিনে একেবারে নব্বুই লাখ টাকা হয়ে গেল?”
সত্যজিত হেসে বলে, “না না সেটা একটা ইনিসিয়াল এস্টিমেট মাত্র ছিল, আসলে আমরা সব অঙ্ক কষে নিয়ে তারপরে এসেছি। আর হাতে একটু বেশি থাকলে একটু ভালো হয়।”
দেবায়ন অনন্যাকে হেসে বলে, “বেশ তো, ভালো কথা, কিন্তু…..” চোখ টিপে হেসে বলে, “এত বড় অঙ্কের টাকার বিনিয়োগের পরিবর্তে আমার কিছু চাই।”
পারমিতা ওর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে চোখ পাকিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন…..”
অনন্যা পারমিতাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে দেবায়নকে বলে, “না না, কি চাও বলো? কোথাও যেতে হবে কি?”
দেবায়ন উত্তরে জানায়, “তুমি একবার মিস চৌধুরীর সাথে কথা বলে নিও।”
অনুপমা লক্ষ্য করে অনন্যা বেশ গলে পড়ে আদুরে কণ্ঠে দেবায়নের সাথে কথাবার্তা বলছিল। আলোচনা শেষে খাওয়া দাওয়া শেষে, সত্যজিত স্মিত হেসে দেবায়নের সাথে হাত মিলিয়ে বলে, “একদিন বাড়িতে ডিনারে এসো।”
অনুপমাকে চোখ টিপে হেসে বলে অনন্যা, “ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন রইল কিন্তু, ভুলে যাস না…..”
অনুপমা ওর গালে গাল ঠেকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, “সত্যজিত থাকলে হবে না কিন্তু…..”
উত্তরে অনন্যা নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, “না না, ডিনারের পরে সত্যজিত থাকে, না বাড়ি চলে যায়। চিন্তা নেই ব্রেকফাস্ট আমরা একসাথেই করব।”
দেবায়ন হেসে সত্যজিতের সাথে হাত মিলিয়ে জানায়, “ঠিক আছে একদিন ডিনারে অনন্যার বাড়িতে দেখা হবে।”
দেবায়ন এখন অফিসে আসেনি। বাবা এইবারে গোয়া গেছে একটা নতুন রিসোর্টের ব্যাপারে। দেবায়নকে সাথে নিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু অনুপমার অনুরোধে এইবারে আর দেবায়ন যায়নি। সকাল থেকে ঝিরঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। এই বৃষ্টিতে মামনির কাছে থাকলে, সোনামুগ ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ ভাজা খাওয়া যেত। এই বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছেলেটা কোথায় যে বের হল? সকালে ফোন করে বলেছিল যে অফিসে আসতে একটু দেরি হবে কিন্তু কত দেরি? লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে প্রায়। কোলকাতায় থাকলে এমন দেরি করে না, যদি কেনাকাটা কিছু করার থাকে তাহলে ওকে সাথেই নিয়েই বের হয়। কাজ থাকলে ওকে বলে যেত কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু না, কি বলল, “এই একটু দোকানে যাবো।” কেন যাবি কোন দোকানে যাবি কিছুই বলল না। বৃষ্টির ভিজে হাওয়ায় হৃদয় বড় উদাস হয়ে যায় অনুপমার। পাগল বাউলের মতন খালি নেচে বেড়ায় এদিক ওদিক।
বেচারি অনুপমার খুব বড় অভিযোগ, সব প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের নানান ধরনের উপহার দেয়, কিন্তু দেবায়ন ওকে আজ পর্যন্ত কিছুই দেয়নি। অবশ্য তাতে ওর ভুল ছিল না যে তা নয়, কলেজে পড়ার সময় থেকেই দেবায়নকে টাকা খরচ করতে দিত না, কিন্তু তাই বলে চাকরি পাওয়ার পরে ওকে একটা উপহার দেবে না? না না, এতটা ওর ওপরে অভিযোগ করা ঠিক নয়। গতবার যখন বিন্সার, ডালহৌসি কাজে গেছিল তখন ডালহৌসি থেকে ওর জন্য একটা সুন্দর ফারের জ্যাকেট কিনে এনেছিল। যদিও ওর কাছে প্রচুর জ্যাকেট, তাও ওর দেওয়া জ্যাকেট খানা ওর বেশ পছন্দ হয়েছিল।
এইসব ভাবছিল অনুপমা নিজের হাত দেখে, আঙ্গুল গুলো বড্ড খালি শুধু একটা সোনার আংটি ছাড়া কিছুই নেই। ঠিক তখন দেবায়ন কাঁচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ওকে দেখে হাসে। কি ব্যাপার, চোখে যেন এক শয়তানি হাসি, আবার কোথায় কি করে এসেছে দেবায়ন? আর পারা গেল না এই ছেলেটাকে নিয়ে, নিশ্চয় কোথাও কোন মেয়ে দেখেছে আর সেই গল্প জুড়ে বসবে, না হয় কোন ডিল ফাইনাল হবে সেই নিয়ে আলোচনা। কিন্তু এই চেহারা আর এই মিচকি হাসি কেমন যেন ঠেকায়। কোনোদিন এমন ভাবে মাথা চুলকে হাসতে দেখেনি ওকে। না না, একবার ওর সামনে এসেছিল এই ভাবে মিচকি হাসতে হাসতে, সে বহুদিন আগের কথা।
ওর সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে প্রশ্ন করে দেবায়ন, “কি রে কি করছিস?”
অনুপমা উঠে দাঁড়িয়ে ওর গলা জড়িয়ে নাকে নাক ঘষে মিষ্টি করে বলে, “তোর কথা ভাবছিলাম।” তারপরে কিঞ্চিত অভিমানী কণ্ঠে ওকে বলে, “সবার বয়ফ্রেন্ডরা কত কিছু দেয়…..”
ডান হাতে বাম হাত নিয়ে আলতো চেপে চোখ চোখ রেখে বলে দেবায়ন, “আমি সত্যি তোকে কিছু দেইনি কোনোদিন?”
ওই প্রগাঢ় ভালোবাসার চাহনির সামনে লজ্জায় পরে যায় অনুপমা, মাথা নিচু করে আলতো ঝাঁকিয়ে বলে, “না মানে…..”
ওর বাম হাত ঠোঁটের কাছে এনে হাতের তালুতে ছোট চুমু খায় দেবায়ন। তপ্ত ভিজে ঠোঁটের পরশে অনুপমার শরীর শিহরিত হয়ে যায়। আপনা হতেই দেবায়নের কলারে হাত উঠে যায়। দেবায়ন ওর দিকে একভাবে চেয়ে রয়েছে, দুই চোখে প্রেমের ধিকিধিকি আগুন, ওকে ঝলসে দেওয়ার আগের মুহূর্তে নিয়ে যায়। নিজেকে ওর প্রশস্ত বুকের ওপরে আছাড় মারতে উদ্যত হয় অনুপমা। দেবায়ন ঝুঁকে ওর বাম হাতের আঙ্গুল একটা একটা করে মুখের মধ্যে নিয়ে গোড়া থেকে ডগা পর্যন্ত চুষে দেয়। কেঁপে ওঠে অনুপমা, চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। কি করছে ছেলেটা, এটা যে অফিস। এইভাবে কতক্ষণ দাঁড়াতে পারবে, নিজেকে সংবরণ করে রাখতে পারবে? ওর দেহের প্রত্যেক স্নায়ু উন্মুখ হয়ে ওঠে দেবায়নের দেহের সাথে মিলিয়ে যাওয়ার জন্য। অনুপমার অনামিকা মুখের মধ্যে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চুষে দেয় তারপরে অনামিকা বের করে আনে মুখের মধ্যে থেকে।
তিরতির করে ভীষণ প্রেমের জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে দেবায়নকে গভীর আবেগজনিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি করছিস তুই?”
দেবায়ন ওর অনামিকা চেপে ধরে, আঙ্গুলে শক্ত ধাতুর গোলাকার কিছু একটা ঠেকে। দেবায়ন ওর চোখে চোখ রেখে খুব নিচু কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “বুড়ি হয়ে আমার মাথার পাকা চুল তুলে দিতে দিতে আমার সাথে ঝগড়া করবি?”
দেবায়ন ওর অনামিকায় কিছু একটা ঠেলে দেয়। হাতের চাপের মধ্যে বুঝতে পারে ওর আঙ্গুলে একটা আংটি। চোখ জোড়া ভরে আসে অনুপমার। চোখের পাতার সাথে সাথে ঠোঁট জোড়া কেঁপে ওঠে অনুপমার। আলতো মাথা নাড়িয়ে প্রগাঢ় আবেগজড়িত কণ্ঠে বলে, “করব রে, খুব ঝগড়া করব। তুই তোর দাঁতের পাটি ভুলে যাবি আর আমি খুঁজে দেব।”
দেবায়ন আবেগজড়ানো কণ্ঠে বলে, “সত্যি তুই খুঁজে দিবি? আর তোর চোখের চশমাটার কি হবে?”
দেবায়নের নাকের ওপরে নাক ঘষে বলে, “তুই আমাকে দেখিয়ে দিবি আর কি। আমি ওষুধ খেতে ভুলে গেলে কি হবে?”
উত্তর দেয় দেবায়ন, “ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রাখব, মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়ে রাখব।”
অনুপমা ওর বুকের ওপরে মাথা রেখে জিজ্ঞেস করে, “কবে থেকে শুরু করব এই খোঁজাখুঁজি?”
দেবায়ন ওর মুখ আঁজলা করে ধরে বলে, “এই ডিসেম্বর থেকে শুরু করলে কেমন হয়?”
মাথা উঁচু করে ওর চোখের দিকে তাকায় অনুপমা। আলতো ঠোঁট মেলে এগিয়ে দেয় দেবায়নের দিকে। ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে ওই কথা শুনে। দেবায়নের ঠোঁট নেমে আসে ওর লাল নরম ঠোঁটের ওপরে। মিশে যায় দুই জোড়া কপোত কপোতীর ঠোঁট। অনুপমার আঙ্গুলে একটা বড় সলিটায়ার হীরের আংটি।
চুম্বন শেষে, ওর বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে চুপচাপ পরে থাকে অনেকক্ষণ। দেবায়ন ওকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে দেয়। এইবারে ওর রাত আর বড় হবে না, এই বারে ওর আর ঠাণ্ডা লাগবে না। ওর বুক আর খালি থাকবে না। আয়নার সাথে আর কথা বলতে হবে না। রোজ সকালে ওকে ফোন করে উঠাতে হবে না। রাতে “গুড নাইট” কিস হাওয়ায় দিতে হবে না। ওর জামা চুরি করে পড়তে হবে না। অনেক কিছু “হবে না” তালিকা শেষ হয়ে যাবে ওর জীবনে।
আঙ্গুলের আংটিটা দেখে, সোনার আংটির ওপরে একটা বড় হীরে। এই কিছুক্ষণ আগেই কত অভিযোগ নিয়ে নিজের সাথে কথা বলছিল আর ঠিক তখনি….. পুচ্চু কি ওর মনের কথা শুনতে পারে নাকি? ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে কাঁপা আবেগভরা কণ্ঠে বলে, “তুই কি আমার মনের কথা শুনতে পেরেছিলি?”
দেবায়ন আলতো মাথা দোলায়, “হঠাৎ করে আজ সকালে বৃষ্টি দেখে বুকটা বড় ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল তুই কাছে থাকলে দুইজনে বাইকে করে এই বৃষ্টিতে ভিজতে বের হয়ে যেতাম।”
অনুপমা ওর বুকের ওপরে একটা কিল বসিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলে, “বললি না কেন?”
ওর গালে আলতো চুমু খেয়ে দেবায়ন উত্তর দেয়, “তাহলে এই সারপ্রাইস হত কি করে?”
আবার দেবায়নকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, “খুব সুন্দর হয়েছে রে আংটিটা। মামনিকে বলেছিস?”
দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “না মানে এখন মা’কে বলিনি ভাবছি তুই আমার সাথে বাড়ি চল, দুইজনে একসাথে মা’কে বলব।”
একটু লাজুক হেসে বলে, “আর বাকিদের?”
দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “এখন নয়, বাকিদের না হয় ওই ট্রিপে গিয়ে বলব যে ডিসেম্বরে আমরা বিয়ে করছি।” ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বলে, “চল কোথাও বেড়িয়ে পরি এই বৃষ্টিতে।”
সেই শুনে নেচে ওঠে অনুপমা, চোখ জোড়া চকচক করে ওঠে ওর, “কোথায় যাবো?”
দেবায়ন মিচকি হেসে বলে, “কোলকাতায় রাস্তার অভাব আছে নাকি? পারলে না হয় দুরগাপুর হাইওয়ে ধরা যাবে। যতদূর যাওয়া যায় যাবো তারপরে আবার বাইক ঘুরিয়ে বাড়ির পথ ধরব।”
“নক নক….. কৌন হ্যায়? নক নক….. কৌন হ্যায়?” অনুপমার ফোন বেজে ওঠে, এটা মায়ের রিং টোন। এই এমন সময়ে মা ফোন করল হঠাৎ করে, কি ব্যাপার? হৃদয়ে প্রবল উচ্ছাস, ঠিক পেছনে থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে দেবায়ন ওর ঘাড়ের ওপরে নাক ঘষে উত্যক্ত করে তোলে ওকে। আঙ্গুলের আংটি দেখে মাকে বলার জন্য অধীর হয়ে ওঠে।
ফোন তুলেই মাকে বলে, “জানো মা আজকে কি হয়েছে।”
পারমিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”
লাজুক হেসে প্রবল উচ্ছাসে দেবায়নের হাত খানি বুকের কাছে টেনে বলে, “পুচ্চু আমাকে একটা সলিটেয়ার দিয়েছে।”
পারমিতা অন্যপাশ থেকে খুশি হয়ে বলে, “এতদিনে তাহলে তোরা বিয়েটা সারছিস।”
মাথা দোলায় অনুপমা, “হ্যাঁ…..”
পারমিতা ওকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যান্ডসাম কি কাছে আছে নাকি?”
দেবায়ন মিচকি হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মিমি, তোমার মেয়েকে এইবারে তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে আমার কাছে রাখব ভাবছি।”
পারমিতা কিঞ্চিত ধরা গলায় বলে, “বারন কে করেছে, সে তো অনেকদিন আগেই নিয়ে গেছ।”
দেবায়ন উত্তর দেয়, “এইবারে একদম পাকাপাকি ভাবে নিয়ে যাবো।”
পারমিতা জিজ্ঞেস করে, “দেবশ্রীদি জানে?”
অনুপমা উত্তর দেয়, “না এখন মামনিকে জানানো হয়নি। আজ রাতে জানাবো।”
দেবায়ন বলে, “তুমি আর মা একটা ভালো দিনক্ষণ ঠিক কর, আর তর সইছে না।”
পারমিতা অন্যদিক থেকে হেসে বলে, “ইসসস আর তর সইছে না, সব হয়ে গেল আর কি বাকি আছে?”
অনুপমা হেসে বলে, “অনেক কিছু বাকি, ওর মাথার পাকা চুল তুলে দেওয়া বাকি, আমার চশমা হারিয়ে যাওয়া আর ওর দ্বারা খুঁজে পাওয়া বাকি…..”
পারমিতা হেসে বলে, “আচ্ছা হয়েছে, বুঝতে পারছি তোর মনে বিয়ের ফুল ফুটছে। যার জন্য ফোন করেছিলাম। তোরা দুইজনে একসাথে আছিস যখন ভালোই হল। অনন্যা আর সত্যজিত এসেছে, তোদের সাথে ওর পত্রিকার সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করতে চায়।”
অনুপমা কপালে করাঘাত করে, দুই দিন আগে অনন্যা ওকে ফোন করে বলেছিল যে পত্রিকার সম্বন্ধে আলোচনা করার জন্য ওর বাড়িতে আসতে চায়। অনুপমা একদম ভুলে গেছে, এমন কি দেবায়নকে বলতেও ভুলে গেছে। আসলে এনুয়াল মিটের পর থেকেই এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট নিয়ে শ্রেয়ার সাথে এত ব্যাস্ত ছিল যে অন্য কোন বিষয় নিয়ে ভাবার সময় ছিল না ওর কাছে।
মা’কে উত্তরে বলে, “উফফফ একদম ভুলে গেছি….. আচ্ছা এক কাজ কর ওদের কিছুক্ষণ বসতে বল আমরা এই এক ঘন্টার মধ্যে আসছি।”
ফোন ছেড়ে দেবায়ন কে সবিস্তারে অনন্যার বিষয়ে জানায়। ফোনে ওর সাথে অনন্যার শুধু মাত্র একটু কথাবার্তা হয়েছিল। প্রোজেকশান, লাইন অফ বিজনেস, স্ট্রাটেজি এইসব ওর মাথায় ঢোকে না তাই এই বিষয়ে বাবার সাথে আর দেবায়নের সাথে আলোচনা করার কথা বলেছিল। দেবায়ন সব শুনে একটু মন মরা হয়ে যায়, অনুপমাও একটু মন মরা হয়ে যায়। এই ভিজে আবহাওয়ায় ঘুরতে যেতে বেশি ভালো লাগে এর মধ্যে আবার ব্যাবসা সংক্রান্ত আলোচনা করতে বসতে হবে ভেবেই মন কিঞ্চিত ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। কিন্তু কি করা যাবে, অনন্যা একদম বাড়ি পৌঁছে গেছে, আবার মায়ের সাথে অনন্যার বেশ ভালো সম্পর্ক। দেবায়ন আর অনুপমা কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। পথে যেতে যেতে অনুপমা জানায় ওদের আশি থেকে নব্বুই লাখ টাকার দরকার।
বাড়িতে পা রাখতেই ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে, “বাপ রে শেষ পর্যন্ত আমার মেয়ে বড় হয়ে গেল।” আবেগ জড়িত, মাতৃস্নেহে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, “মেয়েটাকে একটু দেখো।”
অনুপমা মা’কেজড়িয়ে ধরে বলে, “প্লিস মা, এখুনি শুরু করোনা তো।”
হাতের বড় হীরের আংটি দেখে পারমিতা ওকে বলে, “তোর ভাগ্য সত্যি ভালো।”
দেবায়ন মিচকি হেসে বলে, “ভাগ্য আমার ভালো। যাই হোক এইবারে আগে কাজ সারি তারপরে বাড়ি ফিরতে হবে। মাকে এখন জানানো হয়নি। আজ রাতে অনু কিন্তু আমাদের বাড়িতে থাকবে।”
পারমিতা দেবায়নের গালে আলতো টোকা মেরে হেসে বলে, “আমার বাড়ির মেয়ে অনেকদিন আগেই শ্বশুর বাড়িতে পা রেখে দিয়েছে, আর কি কিছু বলতে পারি?”
অনন্যা আর সত্যজিত বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। ওদের সামনে এই বিষয়ে কিছু আর আলোচনা করা হল না। সামান্য কুশল সম্ভাষণের পরেই সোজা প্রত্রিকা সম্বন্ধে আলোচনায় বসে গেল। সত্যজিত ফাইল এনেছিল, ল্যাপটপে বেশ কয়েকটা প্রেসেন্টেসান বানিয়ে এনেছিল, সেই গুলো দেখাল। ইতিমধ্যে ওদের পাব্লিকেশানের একটা নাম ঠিক করা হয়েছে, পত্রিকার একটা নাম ঠিক করে নিয়েছে “ফুলের ঝুড়ি”। সত্যজিত নিজে ফটোগ্রাফার, এই পাবলিকেশান লাইনে বেশ চেনাজানাও আছে, বেশ কয়েকজন সম্পাদক সম্পাদিকার সাথে ইতিমধ্যে কথাবার্তা আলোচনা সেরে নিয়েছে। আগামী বড়দিনে পত্রিকার শুরু করতে চায়।
সব শুনে দেবায়ন স্মিত হেসে জানায়, “দেখো মিস্টার সত্যজিত, এমনিতে এই পাবলিকেশান লাইনে বিনিয়োগ করা বেশ ঝুঁকির ব্যাপার। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ, মানুষে বই খুব কম পড়ে। মাসে কয়টা কপি বিক্রি করতে পারবে? তুমি যে প্রোজেকশান দেখিয়েছ সেটা পাঁচ বছরে এচিভ করতে পারবে বলে আমার সন্দেহ আছে।”
সত্যজিত একটু দমে যায় ওর কথা শুনে। অনেক আশা ভরসা নিয়ে অনন্যার কাছে শুনেই এদের কাছে এসেছিল। দেবায়ন তাও ওকে বলে, “আশি লাখ টাকা বিনিয়োগ করা খুব বড় ঝুঁকি। এত টাকা বিনিয়োগের আগে আমাকে একবার সেন কাকুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা করতে হবে।”
অনন্যা মাথা নাড়িয়ে ওকে বলে, “বাঙালী মেয়েরা এখন বাড়িতে বসে বই পড়ে। আর শুধু যে পত্রিকা বেচে আমাদের টাকা আসবে সেটা নয়। বিজ্ঞাপনেও টাকা আসবে সেই নিয়ে তোমার চিন্তা নেই, শুধু প্রাথমিক ইন্ধন আমাদের নেই।”
পারমিতা দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন, আমি সোমেশকে বুঝিয়ে বলে দেব, শুধু তুমি না কর না। অনন্যা অনেক করেছে, ওর জন্য এইটুকু করতেই হবে।”
পারমিতা আর অনন্যা কি ভাবে ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানিতে কাজ এনেছে সেই বিষয়ে দেবায়ন ভালো ভাবেই জানে।
অনুপমা এর মধ্যে নেই তাই স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, “আমি এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না, অনন্যাদি। ও আর বাবা যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই চূড়ান্ত।”
দেবায়ন খানিক ভেবে স্মিত হেসে বলে, “কাকিমা যখন বলছে তখন দিতে পারি। তবে আমার কয়েকটা শর্ত আছে।”
সত্যজিত জিজ্ঞেস করে, “কি শর্ত?”
দেবায়ন উত্তরে বলে, “ব্রেক ইভেনে না পৌঁছানো পর্যন্ত কাকিমা তোমাদের এই পাবলিকেশানের এম ডি হয়ে থাকবে, তারপরে দেখা যাবে। আর বোর্ড অফ ডাইরেক্টরের মধ্যে পায়েল কে নিতে হবে। অনুপমার অত সময় নেই, কিন্তু পায়েল মাঝে মাঝে তোমাদের অফিসে যেতে পারে।”
সত্যজিত আর অনন্যা মুখ চাওয়াচায়ি কর নিচু কণ্ঠে নিজেদের অধ্যে আলোচনা করে ওদের জানায়, এই শর্ত ওরা মানতে রাজি। দেবায়ন জানিয়ে দেয়, কিছুদিনের মধ্যেই মিস্টার সেনের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করে ওদের এই পত্রিকার টাকা দিয়ে দেবে।
সেই সাথে দেবায়ন অনন্যাকে মিচকি হেসে বলে, “সেই দিন রাতে তুমি বলছিলে ষাট লাখ টাকা আর এই কয়দিনে একেবারে নব্বুই লাখ টাকা হয়ে গেল?”
সত্যজিত হেসে বলে, “না না সেটা একটা ইনিসিয়াল এস্টিমেট মাত্র ছিল, আসলে আমরা সব অঙ্ক কষে নিয়ে তারপরে এসেছি। আর হাতে একটু বেশি থাকলে একটু ভালো হয়।”
দেবায়ন অনন্যাকে হেসে বলে, “বেশ তো, ভালো কথা, কিন্তু…..” চোখ টিপে হেসে বলে, “এত বড় অঙ্কের টাকার বিনিয়োগের পরিবর্তে আমার কিছু চাই।”
পারমিতা ওর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝে চোখ পাকিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন…..”
অনন্যা পারমিতাকে থামিয়ে দিয়ে হেসে দেবায়নকে বলে, “না না, কি চাও বলো? কোথাও যেতে হবে কি?”
দেবায়ন উত্তরে জানায়, “তুমি একবার মিস চৌধুরীর সাথে কথা বলে নিও।”
অনুপমা লক্ষ্য করে অনন্যা বেশ গলে পড়ে আদুরে কণ্ঠে দেবায়নের সাথে কথাবার্তা বলছিল। আলোচনা শেষে খাওয়া দাওয়া শেষে, সত্যজিত স্মিত হেসে দেবায়নের সাথে হাত মিলিয়ে বলে, “একদিন বাড়িতে ডিনারে এসো।”
অনুপমাকে চোখ টিপে হেসে বলে অনন্যা, “ব্রেকফাস্টের নেমন্তন্ন রইল কিন্তু, ভুলে যাস না…..”
অনুপমা ওর গালে গাল ঠেকিয়ে নিচু কণ্ঠে বলে, “সত্যজিত থাকলে হবে না কিন্তু…..”
উত্তরে অনন্যা নিচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, “না না, ডিনারের পরে সত্যজিত থাকে, না বাড়ি চলে যায়। চিন্তা নেই ব্রেকফাস্ট আমরা একসাথেই করব।”
দেবায়ন হেসে সত্যজিতের সাথে হাত মিলিয়ে জানায়, “ঠিক আছে একদিন ডিনারে অনন্যার বাড়িতে দেখা হবে।”