05-10-2020, 07:43 PM
পর্ব ২৭ (#০৪)
অনুপমা খানিকক্ষন চুপ করে থাকার পরে মাইক নিয়ে বলে, “আজকে আমাদের সেন গ্রুপ অফ কোম্পানির প্রথম অ্যানুয়াল মিট।”
সবাই চুপ, সবার কান ওর দিকে। অনুপমা বলে, “আমি জানিনা এনুয়াল মিটে কি বলতে হয়, তাও সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। একটা ছাদ দাঁড় করাতে গেলে অন্তত পক্ষে তিন খানা থামের দরকার পরে। এই গ্রুপ কোম্পানির বিষয়ে জানি না তবে আমার জীবনের তিন খানা থাম, তিন মহিলা…..”
সবাই উৎকণ্ঠায় ওর দিকে তাকিয়ে। অনুপমা প্রথমে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ডেকে বলে, “আমার মা, মিসেস পারমিতা সেন, যার ভালোবাসায় এতদুর এসেছি।” পারমিতার চোখে জল চলে আসে। চোখের কোল মুছতে মুছতে মেয়ের দিকে এগিয়ে যায়। তারপরে অনুপমা, দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে মঞ্চে ডেকে বলে, “আমার মামনি, মিস্টার দেবায়নের মা, যার আশীর্বাদে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।” দেবশ্রী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, কি বলছে মেয়েটা? অনুপমা কাতর চোখে মামনিকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করে। অগত্যা দেবশ্রী ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। তারপরে অনুপমা, নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে কাছে ডেকে বলে, “আমার বান্ধবী, মিস নিবেদিতা চৌধুরী যার অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আজকে আমরা এইখানে একত্রিত হয়েছি।” হতবাক নিবেদিতা দাঁতের মাঝে আঙ্গুল কেটে চোখের জল সংবরণ করে অনুপমার দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা ওকেও হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকে। তারপরে মাইকে বলে, “মহিলারাই এই জগতের জন্মদাত্রী। আজকের রাত তাই মেয়েদের রাত। এই পৃথিবী সব মেয়েদের জন্য” হাত মুঠি করে হাওয়ায় উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে, “লেডিস, ড্যান্স ফ্লোর অনেকক্ষণ থেকেই খালি পরে। আজকে নো ব্যালেন্স সিট, নো বড় এন্ড ছোট, কার কাছে কি আছে, কার কাছে কি নেই। একটা রাত এইসব ভুলে….. লেটস পার্টি হার্ড…..”
মঞ্চে দাঁড়িয়ে চার মহিলাকে দেখে সবাই হাততালি দেয়। গুঞ্জনে ভরে ওঠে রেডিসনের লন, আকাশে মেঘের গুরগুর শুরু হয়ে যায়। সেই উপেক্ষা করে অনুপমা মাইক নিয়ে চেঁচিয়ে, “মেয়েরা দেখিয়ে দাও, ওই আকাশের কালো মেঘের গুরগুর চড়চড় ধ্বনি আমরা ভয় করিনা।”
মঞ্চ থেকে নেমে এসেই দেবায়ন কে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দেয়। ওর মাথা বুকে চেপে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি হল তোর?”
মাথা নাড়ায় অনুপমা, “কিছু না।” ওর গলা ধরে এসেছে এতক্ষণে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, এই বুকের মধ্যে ঢুকে পড়লে ভালো হত।
ওকে ওইভাবে দেবায়নের বুকে মাথা গুঁজে থাকতে দেখে নিবেদিতা ওদের দিকে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। নরম হাতের পরশে অনুপমার সম্বিত ফিরে আসে। নিবেদিতাকে দেখে চোখের কোল মুছে মিষ্টি হাসি দেয়। নিবেদিতা স্মিত হেসে ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ওইখানে উঠে একটু পাগল হয়ে গেছিলে?”
অনুপমা দেবায়নের বাজু দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বলে, “আমাকে পাগল করার লোক আর ঠিক করার লোক আমার পাশেই আছে।”
মিটের সাথে পার্টি কিছুক্ষণের মধ্যে জমে ওঠে। পারমিতা আর নিবেদিতা পরস্পরকে অতি মার্জিতভাবে অতি সুকৌশলে এড়িয়ে চলেছে। পারমিতা, দেবশ্রীকে নিয়ে একপাশে গল্পে মেতে ওঠে। নিবেদিতা আর অনুপমা কথা বলতে বলতে ভিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। কম বয়সী ছেলে মেয়েরা ততক্ষণে নাচের জায়গায় উঠে নাচ করতে শুরু করে দিয়েছে।
ভিড়ের এক কোনায় হটাত করে ওর চোখ ধৃতিমানের দিকে চলে যায়। ধৃতিমানের হাতে একটা মদের গেলাস, ওর ঠাণ্ডা বরফের মতন চোখের সাথে চোখাচুখি হতেই ওর মেরুদন্ড দিয়ে হিমশীতল এক ধারা বয়ে যায়। একপাশে নিবেদিতাকে দেখে, অন্য পাশে দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে মামনিকে দেখে। বাবার কোম্পানিতে চাকরি করছে ধৃতিমান, এই মিটে আসবে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু ওর কথা একদম মাথায় ছিল না অনুপমার। এই সমাগমে কিছু করে বসবে না তো? অতটা সাহস নেই তবে যদি মামনির সামনে পরে যায় তখন কি হবে? সঙ্গে সঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে দেবায়নের কাছে দৌড় লাগায়।
হাঁপাতে হাঁপাতে দেবায়নকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে, “সর্বনাশ হতে একটু বাকি আছে রে।”
দেবায়ন অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে একটু খুলে বল।”
দূরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ধৃতিমানের দিকে দেখিয়ে অনুপমা বলে, “ধৃতিমানের কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। একদিকে মামনি অন্যদিকে নিবেদিতা। ওদের সামনে পরে গেলে কি হবে?”
দেবায়নের সাথে ধৃতিমানের চোখাচুখি হয়, ওর ওই চাহনি দেখে চিন্তায় পড়ে যায়। খানিকক্ষণ পরে কিছু একটা চিন্তা করে ওর কাঁধে চাপ দিয়ে অভয় প্রদান করে বলে, “চিন্তা করিস না, আমি ওকে কিছু করে হোক এখান থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ঠিক সেই সময়ে রূপক ওইখানে চলে আসে। ওকে দেখে দুইজনে চুপ হয়ে যায়। রূপক ওদের ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারন জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন জানায় ওরা এমনি দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্চের বক্তৃতা দেওয়ার পরে অনুপমা একটু ভাবাবেগে গলে গিয়েছিল তাই ওর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ওইখানে ছেড়ে দিয়ে দেবায়ন ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে যায়, ধৃতিমানের দিকে।
রূপক সেটা লক্ষ্য করে অনুপমাকে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ রে ওই লোকটা সেই লোকটা না, যাকে আমরা মিস চৌধুরীর সাথে জলপাইগুড়িতে দেখেছিলাম?”
অনুপমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, ভেবেছিল হয়ত রূপক চিনতে পারবে না কিন্তু। অনুপমা মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে বলে, “কই না তো?”
হাতের গেলাসে চুমুক দিয়ে ধৃতিমানের দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে রূপক ওকে বলে, “আরে কিছু একটা লুকাচ্ছিস তুই। ওই ভদ্রলোক জলপাইগুড়ির সেই ভদ্রলোক, কিন্তু এই মিটে কেন?”
অনুপমা ধরা পড়ে গেছে তাই ওকে সত্যি বলে দেয়, “আসলে ওই ভদ্রলোক বাবার কন্সট্রাকশান কোম্পানিতে চাকরি করে।”
রূপক মাথা দুলিয়ে বলে, “হুম, তাহলে মিস চৌধুরীর সাথে কিছু একটা হবে।”
অনুপমা ম্লান হেসে উত্তর দেয়, “না, নিবেদিতাকে ওর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই দেবায়ন গেছে। এই মিটে কিছু যদি করে বসে সেই ভয়ে।”
রূপক ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “মানে? ওর সাথে মিস চৌধুরীর সম্পর্ক কেটে গেছে?”
অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ।”
রূপক হাতের গেলাস এক চুমুকে শেষ করে বলে, “ওই লোকটাকে কি এইখান থেকে তাড়াতে হবে? বল এখুনি লেগে পড়ছি।”
অনুপমা ওর বাজুতে ছোট চাঁটি মেরে বলে, “তুই আর পুচ্চু, মারামারি কাটাকাটি ছাড়া কিছু জানিস?”
ওর কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে কানেকানে বলে, “আরো একটা জিনিস করতে পারি কিন্তু শালা ছেলে না হলে ঠিক লাগিয়ে দিতাম।” বলেই হেসে ফেলে।
অনুপমা ওকে নিয়ে বন্ধু বান্ধবীরা যেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল সেই দিকে এগিয়ে যায়। শ্রেয়া, পায়েল, ভাই অঙ্কন, সঙ্গীতা প্রবাল, ধীমান ঋতুপর্ণা সবাই একদিকে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। কিছু পরে দেবায়ন ফিরে এসে ওদের সাথে যোগদান করে। অনুপমার সাথে চোখের ইশারায় কথা হয়ে যায় যে ধৃতিমানকে ঠিক করে দিয়েছে। বহু লোকের মাঝে তারপরে আর ধৃতিমানকে দেখা যায় না।
অনুপমা আর দেবায়ন আবার বন্ধুদের ছেড়ে সবার সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়ে পরে। এমন সময়ে ওদের দেখা অনন্যার সাথে হয়। অনন্যাকে দেখে অনুপমা বেশ আশ্চর্য হয়ে যায়, ওর পাশে আবার এক অচেনা আগন্তুক।
অনন্যা ওর হাত ধরে হেসে বলে, “বাপ রে তুই একদম পাক্কা বিজনেস ওম্যান হয়ে গেছিস দেখছি।”
অনুপমা স্মিত হেসে দেবায়নের বাজু আঁকড়ে ধরে বলে, “হ্যাঁ, এই ছেলেটার জন্য হতে হল।”
অনন্যা পাশের আগন্তুকের সাথে দেবায়নের পরিচয় করিয়ে বলে, “সত্যজিত, বলেছিলাম তোকে মনে আছে?”
অনুপমা হাত বাড়িয়ে সত্যজিতের সাথে হাত মিলিয়ে কুশল সম্ভাষণ আদান প্রদান করে।
দেবায়ন অনন্যাকে প্রশ্ন করে, “তোমার মানে…..”
অনন্যা কাতর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “প্লিস আজকে নয়।” তারপরে অনুপমাকে বলে, “হ্যাঁ রে একটু সময় হবে তোর?”
অনুপমা ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করে কি ব্যাপারে কথা বলতে চায়। উত্তরে অনন্যা ওকে বলে, “তোরা দুইজনেই এইখানে আছিস আর সত্যজিত এসেছে। মানে ঐযে মিস্টার বসাক বলেছিল।”
অনুপমা বুঝতে পারে কি বিষয়ে অনন্যা ওর সাথে আলোচনা করতে চায় তাই হেসে ওকে বলে, “সরি অনন্যাদি, আজকে রাতে শুধু পার্টি। তুমি সময় করে একদিন আমার অফিসে এসো না হয় বাড়িতে এসো ওইখানে এইসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
দেবায়ন মিচকি হেসে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কত টাকার ধাক্কা লাগাতে চাও?”
অনন্যা সত্যজিতের দিকে একবার দেখে বলে, “সেই রকম একটা প্লান করে নিয়েছি তবে হাতে টাকা নেই তাই শুরু করতে পারছি না।”
সত্যজিত ওকে উত্তর দেয়, “মানে এই ষাট থেকে আশি লাখ টাকার মতন লাগবে।”
অনুপমা আর দেবায়ন মুখ চাওয়াচায়ি করে। তারপরে দেবায়ন মিচকি হেসে সত্যজিতের সামনেই অনন্যার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “চার পাঁচ লাখ টাকা হলে না হয় এখুনি দিয়ে দিতাম। কিন্তু আশি লাখ টাকা, এটা বিনিয়োগের ব্যাপার। কি রকম রিটার্ন পাবো সেই বিষয়ে কিছু জানা নেই।”
অনুপমা ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন এইখানে বিজনেস নয়।” অনন্যাকে হেসে উত্তর দেয়, “প্লিস ওর কথায় কিছু মনে কর না, তোমাদের লাইন অব বিজনেস, প্রোজেকশান, স্ট্রাটেজি সব নিয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে এসো আলোচনা করা যাবে।”
দেবায়ন মিচকি হেসে অনন্যাকে বলে, “আজকে প্রথম কিস্তির রিটার্ন পেলে বড় ভালো হত।”
অনন্যা ওর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলে, “তুমি না বড্ড শয়তান…..” বলেই ওকে আলতো একটা চাঁটি মারে। ওদের ওইভাবে মিশতে দেখে সত্যজিতের একটু কেমন কেমন মনে হয়।
বহু মানুষের চোখ ওদের দিকে, ছোট পর্দার নায়িকা অনন্যাকে দেখে অনেকেই ওর সই নিতে এগিয়ে আসে। অনুপমা আর দেবায়ন ওদের ছেড়ে আবার অন্যদিকে এগিয়ে যায়। দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, ধৃতিমানকে ও মৃদু শাসিয়ে রায়চক থেকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছে। অনুপমা মাথা দোলায় আলতো করে। রাত যত বেড়ে ওঠে, তত বেড়ে ওঠে আকাশের গুরগুর চড়চড় ধ্বনি আর তত বেড়ে ওঠে নাচের তাল আর সঙ্গীত। নাচের ফ্লোরে অনেকেই উঠে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। অনুপমার নাচের জায়গায়, বেশ কয়েক জন সুন্দরী ছোট চাপা আঁটো পার্টি পোশাক পরিহিত মেয়েদের দেখা পায়। গানের তালে তালে বিদেশী অথবা হোটেলের মালিকদের সাথে বেশ জড়াজড়ি করে নাচছে। ওদের অফিসের লোকজন, ছেলে মেয়েরা উদ্দাম নাচে ব্যাস্ত। সবাইকে দেখে আর দেবায়নের বাজু ধরে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
অনুপমা খানিকক্ষন চুপ করে থাকার পরে মাইক নিয়ে বলে, “আজকে আমাদের সেন গ্রুপ অফ কোম্পানির প্রথম অ্যানুয়াল মিট।”
সবাই চুপ, সবার কান ওর দিকে। অনুপমা বলে, “আমি জানিনা এনুয়াল মিটে কি বলতে হয়, তাও সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই। একটা ছাদ দাঁড় করাতে গেলে অন্তত পক্ষে তিন খানা থামের দরকার পরে। এই গ্রুপ কোম্পানির বিষয়ে জানি না তবে আমার জীবনের তিন খানা থাম, তিন মহিলা…..”
সবাই উৎকণ্ঠায় ওর দিকে তাকিয়ে। অনুপমা প্রথমে ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে ডেকে বলে, “আমার মা, মিসেস পারমিতা সেন, যার ভালোবাসায় এতদুর এসেছি।” পারমিতার চোখে জল চলে আসে। চোখের কোল মুছতে মুছতে মেয়ের দিকে এগিয়ে যায়। তারপরে অনুপমা, দেবশ্রীর দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে মঞ্চে ডেকে বলে, “আমার মামনি, মিস্টার দেবায়নের মা, যার আশীর্বাদে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।” দেবশ্রী অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে, কি বলছে মেয়েটা? অনুপমা কাতর চোখে মামনিকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করে। অগত্যা দেবশ্রী ধীর পায়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। তারপরে অনুপমা, নিবেদিতার দিকে তাকিয়ে কাছে ডেকে বলে, “আমার বান্ধবী, মিস নিবেদিতা চৌধুরী যার অক্লান্ত পরিশ্রমের জন্য আজকে আমরা এইখানে একত্রিত হয়েছি।” হতবাক নিবেদিতা দাঁতের মাঝে আঙ্গুল কেটে চোখের জল সংবরণ করে অনুপমার দিকে নিস্পলক নয়নে তাকিয়ে থাকে। অনুপমা ওকেও হাত নাড়িয়ে কাছে ডাকে। তারপরে মাইকে বলে, “মহিলারাই এই জগতের জন্মদাত্রী। আজকের রাত তাই মেয়েদের রাত। এই পৃথিবী সব মেয়েদের জন্য” হাত মুঠি করে হাওয়ায় উঁচিয়ে চিৎকার করে বলে, “লেডিস, ড্যান্স ফ্লোর অনেকক্ষণ থেকেই খালি পরে। আজকে নো ব্যালেন্স সিট, নো বড় এন্ড ছোট, কার কাছে কি আছে, কার কাছে কি নেই। একটা রাত এইসব ভুলে….. লেটস পার্টি হার্ড…..”
মঞ্চে দাঁড়িয়ে চার মহিলাকে দেখে সবাই হাততালি দেয়। গুঞ্জনে ভরে ওঠে রেডিসনের লন, আকাশে মেঘের গুরগুর শুরু হয়ে যায়। সেই উপেক্ষা করে অনুপমা মাইক নিয়ে চেঁচিয়ে, “মেয়েরা দেখিয়ে দাও, ওই আকাশের কালো মেঘের গুরগুর চড়চড় ধ্বনি আমরা ভয় করিনা।”
মঞ্চ থেকে নেমে এসেই দেবায়ন কে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দেয়। ওর মাথা বুকে চেপে নিচু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “কি হল তোর?”
মাথা নাড়ায় অনুপমা, “কিছু না।” ওর গলা ধরে এসেছে এতক্ষণে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মনে হচ্ছে, এই বুকের মধ্যে ঢুকে পড়লে ভালো হত।
ওকে ওইভাবে দেবায়নের বুকে মাথা গুঁজে থাকতে দেখে নিবেদিতা ওদের দিকে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখে। নরম হাতের পরশে অনুপমার সম্বিত ফিরে আসে। নিবেদিতাকে দেখে চোখের কোল মুছে মিষ্টি হাসি দেয়। নিবেদিতা স্মিত হেসে ওকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ওইখানে উঠে একটু পাগল হয়ে গেছিলে?”
অনুপমা দেবায়নের বাজু দুই হাতে আঁকড়ে ধরে বলে, “আমাকে পাগল করার লোক আর ঠিক করার লোক আমার পাশেই আছে।”
মিটের সাথে পার্টি কিছুক্ষণের মধ্যে জমে ওঠে। পারমিতা আর নিবেদিতা পরস্পরকে অতি মার্জিতভাবে অতি সুকৌশলে এড়িয়ে চলেছে। পারমিতা, দেবশ্রীকে নিয়ে একপাশে গল্পে মেতে ওঠে। নিবেদিতা আর অনুপমা কথা বলতে বলতে ভিড়ের দিকে এগিয়ে যায়। কম বয়সী ছেলে মেয়েরা ততক্ষণে নাচের জায়গায় উঠে নাচ করতে শুরু করে দিয়েছে।
ভিড়ের এক কোনায় হটাত করে ওর চোখ ধৃতিমানের দিকে চলে যায়। ধৃতিমানের হাতে একটা মদের গেলাস, ওর ঠাণ্ডা বরফের মতন চোখের সাথে চোখাচুখি হতেই ওর মেরুদন্ড দিয়ে হিমশীতল এক ধারা বয়ে যায়। একপাশে নিবেদিতাকে দেখে, অন্য পাশে দূরে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে মামনিকে দেখে। বাবার কোম্পানিতে চাকরি করছে ধৃতিমান, এই মিটে আসবে সেটা স্বাভাবিক কিন্তু ওর কথা একদম মাথায় ছিল না অনুপমার। এই সমাগমে কিছু করে বসবে না তো? অতটা সাহস নেই তবে যদি মামনির সামনে পরে যায় তখন কি হবে? সঙ্গে সঙ্গে হন্তদন্ত হয়ে দেবায়নের কাছে দৌড় লাগায়।
হাঁপাতে হাঁপাতে দেবায়নকে একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলে, “সর্বনাশ হতে একটু বাকি আছে রে।”
দেবায়ন অবাক হয়ে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে একটু খুলে বল।”
দূরে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা ধৃতিমানের দিকে দেখিয়ে অনুপমা বলে, “ধৃতিমানের কথা একদম ভুলে গিয়েছিলাম। একদিকে মামনি অন্যদিকে নিবেদিতা। ওদের সামনে পরে গেলে কি হবে?”
দেবায়নের সাথে ধৃতিমানের চোখাচুখি হয়, ওর ওই চাহনি দেখে চিন্তায় পড়ে যায়। খানিকক্ষণ পরে কিছু একটা চিন্তা করে ওর কাঁধে চাপ দিয়ে অভয় প্রদান করে বলে, “চিন্তা করিস না, আমি ওকে কিছু করে হোক এখান থেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
ঠিক সেই সময়ে রূপক ওইখানে চলে আসে। ওকে দেখে দুইজনে চুপ হয়ে যায়। রূপক ওদের ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কারন জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন জানায় ওরা এমনি দাঁড়িয়ে আছে। মঞ্চের বক্তৃতা দেওয়ার পরে অনুপমা একটু ভাবাবেগে গলে গিয়েছিল তাই ওর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের ওইখানে ছেড়ে দিয়ে দেবায়ন ভিড়ের মধ্যে এগিয়ে যায়, ধৃতিমানের দিকে।
রূপক সেটা লক্ষ্য করে অনুপমাকে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ রে ওই লোকটা সেই লোকটা না, যাকে আমরা মিস চৌধুরীর সাথে জলপাইগুড়িতে দেখেছিলাম?”
অনুপমার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়, ভেবেছিল হয়ত রূপক চিনতে পারবে না কিন্তু। অনুপমা মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানিয়ে বলে, “কই না তো?”
হাতের গেলাসে চুমুক দিয়ে ধৃতিমানের দিকে ভালো ভাবে তাকিয়ে রূপক ওকে বলে, “আরে কিছু একটা লুকাচ্ছিস তুই। ওই ভদ্রলোক জলপাইগুড়ির সেই ভদ্রলোক, কিন্তু এই মিটে কেন?”
অনুপমা ধরা পড়ে গেছে তাই ওকে সত্যি বলে দেয়, “আসলে ওই ভদ্রলোক বাবার কন্সট্রাকশান কোম্পানিতে চাকরি করে।”
রূপক মাথা দুলিয়ে বলে, “হুম, তাহলে মিস চৌধুরীর সাথে কিছু একটা হবে।”
অনুপমা ম্লান হেসে উত্তর দেয়, “না, নিবেদিতাকে ওর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যেই দেবায়ন গেছে। এই মিটে কিছু যদি করে বসে সেই ভয়ে।”
রূপক ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “মানে? ওর সাথে মিস চৌধুরীর সম্পর্ক কেটে গেছে?”
অনুপমা মাথা দোলায়, “হ্যাঁ।”
রূপক হাতের গেলাস এক চুমুকে শেষ করে বলে, “ওই লোকটাকে কি এইখান থেকে তাড়াতে হবে? বল এখুনি লেগে পড়ছি।”
অনুপমা ওর বাজুতে ছোট চাঁটি মেরে বলে, “তুই আর পুচ্চু, মারামারি কাটাকাটি ছাড়া কিছু জানিস?”
ওর কাঁধে হাত রেখে কাছে টেনে কানেকানে বলে, “আরো একটা জিনিস করতে পারি কিন্তু শালা ছেলে না হলে ঠিক লাগিয়ে দিতাম।” বলেই হেসে ফেলে।
অনুপমা ওকে নিয়ে বন্ধু বান্ধবীরা যেখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছিল সেই দিকে এগিয়ে যায়। শ্রেয়া, পায়েল, ভাই অঙ্কন, সঙ্গীতা প্রবাল, ধীমান ঋতুপর্ণা সবাই একদিকে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে গল্পে মশগুল। কিছু পরে দেবায়ন ফিরে এসে ওদের সাথে যোগদান করে। অনুপমার সাথে চোখের ইশারায় কথা হয়ে যায় যে ধৃতিমানকে ঠিক করে দিয়েছে। বহু লোকের মাঝে তারপরে আর ধৃতিমানকে দেখা যায় না।
অনুপমা আর দেবায়ন আবার বন্ধুদের ছেড়ে সবার সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়ে পরে। এমন সময়ে ওদের দেখা অনন্যার সাথে হয়। অনন্যাকে দেখে অনুপমা বেশ আশ্চর্য হয়ে যায়, ওর পাশে আবার এক অচেনা আগন্তুক।
অনন্যা ওর হাত ধরে হেসে বলে, “বাপ রে তুই একদম পাক্কা বিজনেস ওম্যান হয়ে গেছিস দেখছি।”
অনুপমা স্মিত হেসে দেবায়নের বাজু আঁকড়ে ধরে বলে, “হ্যাঁ, এই ছেলেটার জন্য হতে হল।”
অনন্যা পাশের আগন্তুকের সাথে দেবায়নের পরিচয় করিয়ে বলে, “সত্যজিত, বলেছিলাম তোকে মনে আছে?”
অনুপমা হাত বাড়িয়ে সত্যজিতের সাথে হাত মিলিয়ে কুশল সম্ভাষণ আদান প্রদান করে।
দেবায়ন অনন্যাকে প্রশ্ন করে, “তোমার মানে…..”
অনন্যা কাতর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “প্লিস আজকে নয়।” তারপরে অনুপমাকে বলে, “হ্যাঁ রে একটু সময় হবে তোর?”
অনুপমা ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করে কি ব্যাপারে কথা বলতে চায়। উত্তরে অনন্যা ওকে বলে, “তোরা দুইজনেই এইখানে আছিস আর সত্যজিত এসেছে। মানে ঐযে মিস্টার বসাক বলেছিল।”
অনুপমা বুঝতে পারে কি বিষয়ে অনন্যা ওর সাথে আলোচনা করতে চায় তাই হেসে ওকে বলে, “সরি অনন্যাদি, আজকে রাতে শুধু পার্টি। তুমি সময় করে একদিন আমার অফিসে এসো না হয় বাড়িতে এসো ওইখানে এইসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে।”
দেবায়ন মিচকি হেসে ওকে জিজ্ঞেস করে, “কত টাকার ধাক্কা লাগাতে চাও?”
অনন্যা সত্যজিতের দিকে একবার দেখে বলে, “সেই রকম একটা প্লান করে নিয়েছি তবে হাতে টাকা নেই তাই শুরু করতে পারছি না।”
সত্যজিত ওকে উত্তর দেয়, “মানে এই ষাট থেকে আশি লাখ টাকার মতন লাগবে।”
অনুপমা আর দেবায়ন মুখ চাওয়াচায়ি করে। তারপরে দেবায়ন মিচকি হেসে সত্যজিতের সামনেই অনন্যার কাঁধে আলতো ধাক্কা মেরে বলে, “চার পাঁচ লাখ টাকা হলে না হয় এখুনি দিয়ে দিতাম। কিন্তু আশি লাখ টাকা, এটা বিনিয়োগের ব্যাপার। কি রকম রিটার্ন পাবো সেই বিষয়ে কিছু জানা নেই।”
অনুপমা ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলে, “প্লিস দেবায়ন এইখানে বিজনেস নয়।” অনন্যাকে হেসে উত্তর দেয়, “প্লিস ওর কথায় কিছু মনে কর না, তোমাদের লাইন অব বিজনেস, প্রোজেকশান, স্ট্রাটেজি সব নিয়ে একদিন আমাদের বাড়িতে এসো আলোচনা করা যাবে।”
দেবায়ন মিচকি হেসে অনন্যাকে বলে, “আজকে প্রথম কিস্তির রিটার্ন পেলে বড় ভালো হত।”
অনন্যা ওর দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে বলে, “তুমি না বড্ড শয়তান…..” বলেই ওকে আলতো একটা চাঁটি মারে। ওদের ওইভাবে মিশতে দেখে সত্যজিতের একটু কেমন কেমন মনে হয়।
বহু মানুষের চোখ ওদের দিকে, ছোট পর্দার নায়িকা অনন্যাকে দেখে অনেকেই ওর সই নিতে এগিয়ে আসে। অনুপমা আর দেবায়ন ওদের ছেড়ে আবার অন্যদিকে এগিয়ে যায়। দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, ধৃতিমানকে ও মৃদু শাসিয়ে রায়চক থেকে কোলকাতা পাঠিয়ে দিয়েছে। অনুপমা মাথা দোলায় আলতো করে। রাত যত বেড়ে ওঠে, তত বেড়ে ওঠে আকাশের গুরগুর চড়চড় ধ্বনি আর তত বেড়ে ওঠে নাচের তাল আর সঙ্গীত। নাচের ফ্লোরে অনেকেই উঠে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। অনুপমার নাচের জায়গায়, বেশ কয়েক জন সুন্দরী ছোট চাপা আঁটো পার্টি পোশাক পরিহিত মেয়েদের দেখা পায়। গানের তালে তালে বিদেশী অথবা হোটেলের মালিকদের সাথে বেশ জড়াজড়ি করে নাচছে। ওদের অফিসের লোকজন, ছেলে মেয়েরা উদ্দাম নাচে ব্যাস্ত। সবাইকে দেখে আর দেবায়নের বাজু ধরে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।