05-10-2020, 03:23 PM
পর্ব ২৭ (#০২)
শেয়ার নিয়ে শ্রেয়া নির্বিকার, টাকার অঙ্ক বাড়ল কি কমল সেটা নিয়ে ওর বিশেষ মাথাব্যাথা নেই। আগের মতন কাজে ডুবে যায় কিন্তু হাতে বেশি টাকা পেয়ে রূপক বেশ খুশি। কে বা কারা ওদের সার্ভার হ্যাক করেছিল সেটা আর ধরা যায় না তবে কাজের বিশেষ ক্ষতি হয়নি, কারন ডেটা আর প্রোগ্রামের ব্যাকআপ ছিল, একদিনের মধ্যে ডেটা রিস্টোর করে কাজ শুরু হয়ে যায়।
কয়েকদিন পরেই ওদের গ্রুপ কোম্পানির অ্যানুয়াল মিটিং, হোটেলের মালিকদের আর ম্যানেজারদের ডাকা হয়েছে, দুটো কন্সট্রাকশান কোম্পানির কর্মচারীদের ডাকা হয়েছে সেই সাথে অনুপমাদের সফটওয়্যার কোম্পানির সবাইকে ডাকা হয়েছে। নিবেদিতা আর অনুপমার ওপরে অ্যানুয়াল মিটের সব ভার তাতেই ওরা দুইজনে খুব ব্যাস্ত। মিস্টার হেরজোগ আর মিস্টার মেরকেল, জারমেনিয়া এয়ারলাইন্স আর এয়ার বার্লিনের আই টি ডিপার্টমেন্টের কর্তারা আসবে বলে জানিয়েছে।
দেবায়ন, মিটের জায়গা ঠিক করার জন্য বাবার সাথে হোটেল র্যাডিসন গেছে। ওই হোটেলে বেশ বড় লন আছে, সেই সাথে গঙ্গার ধারে তে বেশ ভালো হবে। অনুপমা চুপচাপ নিজের কেবিনে বসে অ্যানুয়াল মিটের কথা চিন্তা করছিল। কি মেনু হবে, কারা কারা আসছে তাদের ফাইনাল লিস্ট, বাইরে থেকে যারা আসবে তাদের কারুর কারুর জন্য র্যাডিসনে রুম বুক করা হয়েছে, কারুর জন্য পার্কে অথবা * স্তান ইন্টারন্যাশনালে। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে সেটা খেয়াল নেই ওর। এমন সময়ে শ্রেয়া আর পায়েল দড়াম করে ওর দরজা খুলে কেবিনে ঢুকে পরে। ওদের ওই ভাবে ঢুকতে দেখ একটু আশ্চর্য হয়ে যায় অনুপমা।
শ্রেয়া সামনের চেয়ার টেনে বলে, “এই তুই কি রে, লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে আর এত কি নিয়ে পড়ে আছিস তুই?” পায়েল চুপচাপ শ্রেয়ার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে সামনে বসে পড়ে।
অনুপমা হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি এনেছিস আজকে?”
শ্রেয়া ওর ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে, “দেবু নেই বলে কি খাওয়া দাওয়া ভুলে গেছিস?”
অনুপমা হেসে উত্তর দেয়, “না না সেরকম কিছু নয়। এই অ্যানুয়াল মিটের ব্যাবস্থা করছিলাম। নিবেদিতা ম্যাডামের সাথে এর পরে দেখা করতে যাবো।”
শ্রেয়া ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “ওই সব জানিনা, সামনে পুজো, পুজোর বাজারের কি হবে?” পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিরে, আমি কি সব বলব আর তুই বেশ আম খাবি তাই না?”
পায়েল স্মিত হেসে ওকে বলে, “তুই যে ভাবে আক্রমন করেছিস তাতে আমি আর কি বলব।” তারপরে অনুপমাকে বলে, “রূপক এইবারে ধরেছে ট্রেকিংয়ে যেতে। কি করব?”
উফ, এই রূপক, কয়েকদিন থেকে নেচে বেড়াচ্ছে ট্রেকিংয়ে যাবে। কে কে যাবে এখন সেটাই ঠিক করা হল না, কে না কে ওকে ইমেল করেছে আর সেই নিয়ে খাটলিং গ্লেসিয়ার যাবে তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিয়েছে।
শ্রেয়া ওর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলে, “আজকে আর কোন কাজ নয়, চল পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে পড়ি।”
অনুপমা পায়েলের দিকে তাকায়, পায়েল স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় যে পুজোর বাজার করতে যেতে রাজি। অনুপমা জানায় ওকে একবার নিবেদিতার কাছে যেতে হবে কিছু বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। পায়েল, শ্রেয়া কেউ নিবেদিতাকে চেনে না তাই ওকে প্রশ্ন করে নিবেদিতার পরিচয়। অনুপমা একটু ভেবে নিবেদিতার পরিচয় দেয়, ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানির কর্ণধার হিসাবে।
তিনজনে রাসেল স্ট্রিটের অফিস থেকে বেড়িয়ে সোজা মিন্টো পার্কে, নিবেদিতার অফিসে চলে যায়। ওদের দেখে নিবেদিতা একটু অবাক হয়ে যায়। কোনোদিন অনুপমা ওদের অফিসে আসেনি আর যখন এসেছে একেবারে সাথে দুই বান্ধবী নিয়ে এসেছে।
নিবেদিতা একটু ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরে অনুপমাকে দেখে। অনুপমা ওকে ক্ষান্ত করে বলে, “আরে এত হুড়োহুড়ি কেন লাগিয়েছ? সবাই বান্ধবী।” পায়েল আর শ্রেয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
নিবেদিতা হেসে পায়েলকে বলে, “কেমন আছো?”
পায়েল অবাক হয়ে যায়, অনুপমা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় জানায় নিবেদিতা ওর সম্পর্কে সব কিছু জানে। তারপরে অনুপমা ওকে জানায় যে ওরা সবাই পুজোর বাজার করতে বের হবে, যদি নিবেদিতা সঙ্গে যায় তাহলে খুব ভালো হয়। সেই শুনে নিবেদিতাও বেশ খুশি হয়ে যায়। অনুপমার মাথায় শুধু মাত্র একটা চিন্তা ঘোরাফেরা করে, সত্যি কি বিন্সারে নিবেদিতা আর দেবায়ন একটা রুমে ছিল?
অদম্য কৌতূহল শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখতে না পেরে অনুপমা নিবেদিতাকে এক সময়ে কানেকানে প্রশ্ন করে, “বিন্সারে কি হয়েছিল?”
হঠাৎ ওই প্রশ্ন শুনে নিবেদিতা ঘাবড়ে যায়, উত্তর দেয়, “কি হয়েছিল?”
অনুপমা ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারে দেবায়ন ওকে ইয়ার্কি মেরে বলেছে, তাও প্রশ্ন করে, “রিসোর্ট কেমন ছিল?”
নিবেদিতা স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ ঠিকঠাক, তবে অনেক কাজ বাকি। একটা সুইমং পুল, একটা বাচ্চাদের পার্ক, বেশ কিছু এক্সপান্সানের কাজ করতে হবে এই যা। কেন দেবায়ন তোমাকে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না গো, এই সবে আমার কি কাজ। আজকাল কোথায় কি কি করে আসে আমাকে সব বলে নাকি?”
নিবেদিতা হেসে বলে, “এই রকম বল না, সারাটা সপ্তাহ শুধু তোমার গুণগান করে বেড়িয়েছে।” ওর গাল টিপে বলে, “এক সময়ে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল পুচ্চির কথা শুনে।”
“পুচ্চি” এই ডাক শুধু মাত্র দেবায়ন আর ওর মধ্যে সীমিত। সেই নাম নিবেদিতার ঠোঁটে শুনে বুঝতে পারে, না সারাটা সময় শুধু মাত্র ওর কথাই হয়েছে এদের মাঝে।
মিন্টো পার্কের নিবেদিতার অফিস থেকে চারজনে বেড়িয়ে, গাড়ি নিয়ে সোজা, এস্প্লানেড। আকাশে কালো মেঘ তাও বাঙ্গালীরা পুজোর বাজার করতে বেড়িয়েছে, পুজো বলে কথা, সামান্য কালো মেঘ কি আর তাতে বাধ সাধতে পারে। রাস্তায় তিল ঠাইয়ের জায়গা নেই, চারদিকে লোকে লোকারণ্য। কোন ছেলে সঙ্গে নেই, ভিড় ঠেলে এগুতে একটু অসুবিধে হয়, এত ভিড়ে কেনাকাটা করতে অনুপমা অভ্যস্ত নয়। এতদিন দেবায়ন অথবা মায়ের সাথে বেড়িয়েছে, ওকে আগলে রাখার জন্য পাশে দেবায়ন থাকত এইবারে নেই। ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে এমন সময়ে ওর মামনি, দেবশ্রীর ফোন আসে।
দেবশ্রী ফোন করে বলে, “হ্যাঁ রে তুই কোথায়?”
অনুপমা উত্তর দেয়, “এই শ্রেয়া আর পায়েলকে নিয়ে একটু শপিং করতে বেড়িয়েছি। কি হয়েছে বল না?”
দেবশ্রী একটু থেমে ওকে প্রশ্ন করে, “দেবু কখন বাড়ি ফিরবে কিছু বলে গেছে কি?”
অনুপমা জানে দেবায়নের ফিরতে রাত হবে, রেডিসন থেকে সোজা আবার ব্যান্ডেল যাবে বাবার সাথে তারপরে ফিরবে। তাই দেবশ্রীকে উত্তর দেয়, “ওর ফিরতে রাত হবে কেন কিছু কাজ আছে নাকি?”
দেবশ্রীর একটু চিন্তিত কণ্ঠে ওকে বলে, “এখুনি একটু বাড়িতে আসতে পারবি? একটু কথা ছিল।”
বন্ধুদের নিয়ে শপিং করতে বেড়িয়েছে এরমাঝে মামনির ফোন। মামনির গলা শুনে মনে হল একটু চিন্তিত তাই পাল্টা প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে তোমার?”
দেবশ্রী উত্তর দেয়, “তেমন কিছু না। মণির ছেলে হয়েছে…..”
সেই খবর শুনে অনুপমা আনন্দিত হয়ে বলে, “এত ভালো খবর কিন্তু তোমাকে কে খবর দিল?”
দেবশ্রী একটু থেমে ওকে বলে, “না রে ওরা এখানে মানে….. তুই একটু বাড়িতে আসতে পারবি, জরুরি দরকার আছে।”
সূর্য মনিদিপা কোলকাতায় শুনে অনুপমা আশ্চর্য হয়ে যায়। ওদের জলপাইগুড়ি থাকার কথা, সেই মতন দেবায়নকে রাজি করিয়ে ওদের ছয় লাখ টাকা দিয়ে এসেছিল দোকান করার জন্য। মনিদিপা ছেলে হয়েছে সেটা সুখবর বটে কিন্তু ওদের বারবার করে বলে এসেছিল যাতে ওরা কোনোদিন মামনির সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা না করে তা স্বত্তেও ওরা ফোন করেছে? ভাবতেই রাগে অনুপমার গা জ্বলে ওঠে।
অনুপমা মামনিকে প্রশ্ন করে, “কোথায় আছে ওরা, কি কথা হয়েছে ওদের সাথে?”
দেবশ্রী ওর কণ্ঠস্বর শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “তুই প্লিস দেবুকে কিছু বলিস না পারলে একটু তাড়াতাড়ি মানে দেবু বাড়ি ফিরে আসার আগে আমার এখানে আয়।”
তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না যে মনিদিপা আর সূর্য সোজা মামনির বাড়িতে এসেছে। শ্রেয়া আর পায়েলকে বলে অফিসে চলে যেতে আর নিবেদিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। বলে একটা জরুরি কাজে ওকে এখুনি বের হতে হবে। শ্রেয়া বারেবারে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। নিবেদিতা বাকিদের নিয়ে বেড়িয়ে পরে অফিসে দিকে আর অনুপমা একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা লেক টাউনে দেবায়নের বাড়ি পৌঁছে যায়।
দেবশ্রী ওর জন্য বসার ঘরে অপেক্ষা করছিল। বাড়িতে ঢুকেই মনিদিপা আর সূর্যকে দেখে আশ্চর্যের সাথে সাথে রেগে ওঠে। দেবশ্রী অনুপমার চেহারা দেখে বুঝতে পারে যে অনুপমা রেগে গেছে ওদের দেখে, কিন্তু নিরুপায়।
অনুপমা কঠিন কণ্ঠে সূর্য আর মনিদিপাকে প্রশ্ন করে, “কি মনে করে একেবারে এই বাড়িতে আসা হয়েছে?”
সূর্য এক কোনায় দাঁড়িয়ে, মনিদিপা ছোট ছেলে কোলে ওকে বলে, “প্লিস খুব বিপদে পরে বৌদির স্মরনে এসেছি। আমি জানতাম তুমি রেগে যাবে কিন্তু আমরা বড় নিরুপায়।”
অনুপমা হিমশীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কেন নিরুপায়? তোমাকে ছয় লাখ টাকা দিয়ে এসেছিলাম দোকান দিতে। চুপচাপ ওইখানে ব্যাবসা করতে পারতে। আবার আমাদের জীবনে কোন ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছ? আর এসেছ যখন তখন এই বাড়িতে কেন?” সূর্যের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, “তোমার মনে নেই কি বলেছিলাম?”
ওর কঠিন কণ্ঠস্বর শুনে দেবশ্রী ওকে শান্ত করে বলে, “যা হবার হয়ে গেছে, এইবেলা ওদের ক্ষমা করে দে, মা।”
অনুপমা অবাক হয়ে মামনিকে বলে, “তুমি কি মানুষ মামনি? যা হবার হয়ে গেছে আর আমরা ভুলে যাবো?”
দেবশ্রী মাথা নিচু করে বসে থাকে সেই সাথে সূর্য আর মনিদিপার মাথা নিচু হয়ে যায়। অনুপমা ওদের কোলকাতা আসার কারন জিজ্ঞেস করে।
উত্তরে সূর্যের বদলে মনিদিপা বলে, “কিছুটা আমাদের ভুল আর আমাদের কপাল। তুমি যে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলে তার মধ্যে তিন লাখ দিয়ে একটা ছোট দোকান খুলেছিল সূর্য আর বাকি তিন লাখ একটা চিটফান্ডে দিয়েছিল। সেই চিট ফান্ড টাকা খেয়ে পালিয়ে গেছে। দোকানের অনেক কিছু বাকি পড়ে যায়, দোকান কয়েক মাস পরে উঠে যায়। আবার আমরা সেই পথে বসে যাই।”
অনুপমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, কঠিন কণ্ঠে মনিদিপাকে বলে, “সেটা তোমাদের আগে ভাবা উচিত ছিল মনিদিপা। বারেবারে তোমাদের টাকা আমি দিতে পারব না। সেবারে অনেক কষ্টে দেবায়নকে রাজি করিয়ে টাকা দিয়েছিলাম কিন্তু আর নয়।” কিছুক্ষণ থেমে বলে, “এখন কোথায় উঠেছ?”
মনিদিপা মাথা নাড়িয়ে বলে, “সোজা জলপাইগুড়ি থেকে এইখানে এসেছি আর কোথায় যাবো বল?”
অনুপমা আহত সাপের মতন ফোঁস করে ওঠে, “কেন, তোমাদের অসুবিধে আমাকে ফোন করতে পারোনি?”
আহত সূর্য মিনমিন করে বলে, “না মানে, ভাবলাম তুমি সেই বারে টাকা দিয়েছ এইবারে যদি বৌদি…..”
মামনি সামনে বসে আছে সেটা অনুপমা ভুলে যায়, প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে বলে, “মামনি কি করবে? দেবায়ন আসার আগে তোমাদের এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে।”
সূর্য কাতর কণ্ঠে বলে, “কোথায় যাবো? এইখানে আর কে আছে আমাদের?”
অনুপমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “এতদিন এই কোলকাতায় ছিলে কোন চেনাজানা কারুর বাড়িতে থাকো কিন্তু আর এক পয়সা তোমরা পাবে না।”
অগ্নিশর্মা অনুপমাকে শান্ত করে দেবশ্রী বলে, “তুই একটু শান্ত হয়ে দেখ কি করা যেতে পারে। এই ছোট বাচ্চা নিয়ে ওরা কোথায় যাবে?”
তখনি কোলের ছোট বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে, সেই কান্না শুনে অনুপমার মন কিছুটা গলে যায়। মনিদিপা আর সূর্যকে বলে, “তোমাদের মাথা গোঁজার জায়গা আছে কি?”
সূর্য মাথা দুলিয়ে জানায় আছে।
অনুপমা ওদের বলে, “আচ্ছা তাহলে সেইখানে থাকো। কয়েকদিনের মধ্যে আমি দেখি কি করতে পারি।”
অনুপমা মনিদিপার কোল থেকে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে দেখে, বেশ টাবুটুবু গোলগাল মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটা। ছোট্ট নরম হাত বাড়িয়ে অনুপমার গাল ছুঁয়ে দেয়। অনুপমা শেষ পর্যন্ত রাগ ভুলে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে হেসে ফেলে। আলতো মাথা নাড়িয়ে স্মিত হেসে বলে, “এই তোর জন্য বুঝলি রে শয়তান ছেলে…..”
বিনামেঘে বজ্রাপাতের মতন বাড়ির সামনে অনুপমার বাবার গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ওই গাড়ি থেকে দেবায়ন কে নামতে দেখে বাড়ির মধ্যে সবার গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। অনুপমা আর দেবশ্রী মুখ চাওয়াচায়ি করে, কিছু করে হোক দেবায়নকে সরাতে হবে। যদি দেবায়ন ওদের বাড়িতে সূর্য আর মনিদিপাকে দেখে ফেলে তাহলে মাথায় রক্ত চড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে অনুপমার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, নিজের ব্যাগ উঠিয়ে মামনির গালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বেড়িয়ে যায়।
দেবায়ন বাড়িতে ঢোকার আগেই সামনের দরজা খুলে এক গাল হেসে ওকে বলে, “তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি? র্যাডিসন ফোরটে কি হল?”
ওদের বাড়িতে এই বিকেলে অনুপমাকে দেখে দেবায়ন আশ্চর্য হয় না, কেননা ওর জন্য এই বাড়ির দরজা সবসময়ে খোলা। তাও স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, “মা কখন বাড়িতে ফিরেছে?”
অনুপমা ওকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখে বলে, “আরে না আমার একটু কাজ ছিল তাই এসেছিলাম।” ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “তুই প্লিস আমার সাথে একটু পুজোর শপিং করতে যাবি?”
দেবায়ন অবাক হয়ে ওকে বলে, “সেই রায়চক থেকে এসেছি একটু বাড়িতে বসতে দে তারপরে না হয় যাবো।”
অনুপমা কাতর কণ্ঠে আবদার করে, “প্লিস প্লিস, ওই দেখ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছ চল না একটু।”
সুন্দরী প্রেয়সীর কাতর কণ্ঠের ডাক উপেক্ষা করার যো ওর নেই তাই অগত্যা আবার গাড়িতে উঠে অনুপমার সাথে শপিং করতে বের হতে হয় ওকে। গাড়িতে উঠেই দেবায়নের চোখ বাঁচিয়ে দেবশ্রীকে একটা এস এম এস করে জানিয়ে দেয় সূর্য আর মনিদিপাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে আর রাতে ফোন করে এই বিষয়ে কথাবার্তা বলবে। ঘুণাক্ষরে যদি দেবায়ন এই বিষয়ে টের পায় তাহলে আর রক্ষে নেই।
সেদিনের মতন সূর্য আর মনিদিপাকে দেবায়নের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয় অনুপমা। সেদিন শপিং করতে বিশেষ মন ছিল না ওর, মাথায় শুধু ঘুরছিল সূর্য আর মনিদিপাকে কি করে ওর চোখ বাঁচিয়ে সাহায্য করা যায়। ব্যাঙ্কে ওদের জয়েন্ট একাউন্ট, এতগুলো টাকা তুললে অতি সহজে দেবায়নের কাছে ধরা পড়ে যাবে, যদিও দেবায়ন কোনোদিন প্রশ্ন করে না ব্যাঙ্কের খাতা কোনোদিন নিজে খুলে দেখেও না। টাকার দরকার পড়লে ওর পার্স হাতড়ায় না হলে ওর কাছেই হাত পাতে। কিন্তু তাই বলে এত গুলো টাকা দেবায়নকে না বলে দেবে, সেটা মন মেনে নিতে পারে না। সূর্য আর মনিদিপা যখন আবার কোলকাতা ফিরে সোজা দেবায়নের বাড়িতে এসছে, নিশ্চয় কিছু কুমতলবে এসেছে। যদি সত্যি ওদের টাকার প্রয়োজন হত অথবা বিপদে পড়ত তাহলে হয়ত একবারের জন্য ওকে ফোন করত কিন্তু সেটা করেনি। কত টাকা চায় ওরা, কত টাকা দিলে সূর্য আর মনিদিপা চুপ থাকবে? একবার মনিদিপার শারীরিক অবস্থা দেখে বিগলিত হয়ে টাকা দিয়েছিল, এইবারে আবার কোলে ছোট ছেলে নিয়ে এসেছে। ফেলে দিতে চাইলেও ফেলে দেওয়া যায় না কিছুতেই। অন্তত ওর হৃদয় অতটা পাথর হয়ে যায়নি এখন। শত ভাবনা মাথায় ভর করে। দেবশ্রীও এই বিষয়ে দেবায়নকে কিছু জানায় না।
কয়েকদিন পরে সূর্যের দেওয়া ঠিকানায় অনুপমা একা গিয়ে ওদের সাথে দেখা করে।
শেয়ার নিয়ে শ্রেয়া নির্বিকার, টাকার অঙ্ক বাড়ল কি কমল সেটা নিয়ে ওর বিশেষ মাথাব্যাথা নেই। আগের মতন কাজে ডুবে যায় কিন্তু হাতে বেশি টাকা পেয়ে রূপক বেশ খুশি। কে বা কারা ওদের সার্ভার হ্যাক করেছিল সেটা আর ধরা যায় না তবে কাজের বিশেষ ক্ষতি হয়নি, কারন ডেটা আর প্রোগ্রামের ব্যাকআপ ছিল, একদিনের মধ্যে ডেটা রিস্টোর করে কাজ শুরু হয়ে যায়।
কয়েকদিন পরেই ওদের গ্রুপ কোম্পানির অ্যানুয়াল মিটিং, হোটেলের মালিকদের আর ম্যানেজারদের ডাকা হয়েছে, দুটো কন্সট্রাকশান কোম্পানির কর্মচারীদের ডাকা হয়েছে সেই সাথে অনুপমাদের সফটওয়্যার কোম্পানির সবাইকে ডাকা হয়েছে। নিবেদিতা আর অনুপমার ওপরে অ্যানুয়াল মিটের সব ভার তাতেই ওরা দুইজনে খুব ব্যাস্ত। মিস্টার হেরজোগ আর মিস্টার মেরকেল, জারমেনিয়া এয়ারলাইন্স আর এয়ার বার্লিনের আই টি ডিপার্টমেন্টের কর্তারা আসবে বলে জানিয়েছে।
দেবায়ন, মিটের জায়গা ঠিক করার জন্য বাবার সাথে হোটেল র্যাডিসন গেছে। ওই হোটেলে বেশ বড় লন আছে, সেই সাথে গঙ্গার ধারে তে বেশ ভালো হবে। অনুপমা চুপচাপ নিজের কেবিনে বসে অ্যানুয়াল মিটের কথা চিন্তা করছিল। কি মেনু হবে, কারা কারা আসছে তাদের ফাইনাল লিস্ট, বাইরে থেকে যারা আসবে তাদের কারুর কারুর জন্য র্যাডিসনে রুম বুক করা হয়েছে, কারুর জন্য পার্কে অথবা * স্তান ইন্টারন্যাশনালে। লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে সেটা খেয়াল নেই ওর। এমন সময়ে শ্রেয়া আর পায়েল দড়াম করে ওর দরজা খুলে কেবিনে ঢুকে পরে। ওদের ওই ভাবে ঢুকতে দেখ একটু আশ্চর্য হয়ে যায় অনুপমা।
শ্রেয়া সামনের চেয়ার টেনে বলে, “এই তুই কি রে, লাঞ্চের সময় হয়ে গেছে আর এত কি নিয়ে পড়ে আছিস তুই?” পায়েল চুপচাপ শ্রেয়ার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে সামনে বসে পড়ে।
অনুপমা হেসে জিজ্ঞেস করে, “কি এনেছিস আজকে?”
শ্রেয়া ওর ল্যাপটপ বন্ধ করে বলে, “দেবু নেই বলে কি খাওয়া দাওয়া ভুলে গেছিস?”
অনুপমা হেসে উত্তর দেয়, “না না সেরকম কিছু নয়। এই অ্যানুয়াল মিটের ব্যাবস্থা করছিলাম। নিবেদিতা ম্যাডামের সাথে এর পরে দেখা করতে যাবো।”
শ্রেয়া ঝাঁঝিয়ে ওঠে, “ওই সব জানিনা, সামনে পুজো, পুজোর বাজারের কি হবে?” পায়েলের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিরে, আমি কি সব বলব আর তুই বেশ আম খাবি তাই না?”
পায়েল স্মিত হেসে ওকে বলে, “তুই যে ভাবে আক্রমন করেছিস তাতে আমি আর কি বলব।” তারপরে অনুপমাকে বলে, “রূপক এইবারে ধরেছে ট্রেকিংয়ে যেতে। কি করব?”
উফ, এই রূপক, কয়েকদিন থেকে নেচে বেড়াচ্ছে ট্রেকিংয়ে যাবে। কে কে যাবে এখন সেটাই ঠিক করা হল না, কে না কে ওকে ইমেল করেছে আর সেই নিয়ে খাটলিং গ্লেসিয়ার যাবে তাই নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করে দিয়েছে।
শ্রেয়া ওর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলে, “আজকে আর কোন কাজ নয়, চল পুজোর বাজার করতে বেরিয়ে পড়ি।”
অনুপমা পায়েলের দিকে তাকায়, পায়েল স্মিত হেসে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয় যে পুজোর বাজার করতে যেতে রাজি। অনুপমা জানায় ওকে একবার নিবেদিতার কাছে যেতে হবে কিছু বিষয়ে আলোচনা করার জন্য। পায়েল, শ্রেয়া কেউ নিবেদিতাকে চেনে না তাই ওকে প্রশ্ন করে নিবেদিতার পরিচয়। অনুপমা একটু ভেবে নিবেদিতার পরিচয় দেয়, ওদের কন্সট্রাকশান কোম্পানির কর্ণধার হিসাবে।
তিনজনে রাসেল স্ট্রিটের অফিস থেকে বেড়িয়ে সোজা মিন্টো পার্কে, নিবেদিতার অফিসে চলে যায়। ওদের দেখে নিবেদিতা একটু অবাক হয়ে যায়। কোনোদিন অনুপমা ওদের অফিসে আসেনি আর যখন এসেছে একেবারে সাথে দুই বান্ধবী নিয়ে এসেছে।
নিবেদিতা একটু ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরে অনুপমাকে দেখে। অনুপমা ওকে ক্ষান্ত করে বলে, “আরে এত হুড়োহুড়ি কেন লাগিয়েছ? সবাই বান্ধবী।” পায়েল আর শ্রেয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।
নিবেদিতা হেসে পায়েলকে বলে, “কেমন আছো?”
পায়েল অবাক হয়ে যায়, অনুপমা আলতো মাথা দুলিয়ে ইশারায় জানায় নিবেদিতা ওর সম্পর্কে সব কিছু জানে। তারপরে অনুপমা ওকে জানায় যে ওরা সবাই পুজোর বাজার করতে বের হবে, যদি নিবেদিতা সঙ্গে যায় তাহলে খুব ভালো হয়। সেই শুনে নিবেদিতাও বেশ খুশি হয়ে যায়। অনুপমার মাথায় শুধু মাত্র একটা চিন্তা ঘোরাফেরা করে, সত্যি কি বিন্সারে নিবেদিতা আর দেবায়ন একটা রুমে ছিল?
অদম্য কৌতূহল শেষ পর্যন্ত দমিয়ে রাখতে না পেরে অনুপমা নিবেদিতাকে এক সময়ে কানেকানে প্রশ্ন করে, “বিন্সারে কি হয়েছিল?”
হঠাৎ ওই প্রশ্ন শুনে নিবেদিতা ঘাবড়ে যায়, উত্তর দেয়, “কি হয়েছিল?”
অনুপমা ওর চেহারা দেখে বুঝতে পারে দেবায়ন ওকে ইয়ার্কি মেরে বলেছে, তাও প্রশ্ন করে, “রিসোর্ট কেমন ছিল?”
নিবেদিতা স্মিত হেসে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ ঠিকঠাক, তবে অনেক কাজ বাকি। একটা সুইমং পুল, একটা বাচ্চাদের পার্ক, বেশ কিছু এক্সপান্সানের কাজ করতে হবে এই যা। কেন দেবায়ন তোমাকে কিছু বলেনি এই ব্যাপারে?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “না গো, এই সবে আমার কি কাজ। আজকাল কোথায় কি কি করে আসে আমাকে সব বলে নাকি?”
নিবেদিতা হেসে বলে, “এই রকম বল না, সারাটা সপ্তাহ শুধু তোমার গুণগান করে বেড়িয়েছে।” ওর গাল টিপে বলে, “এক সময়ে আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল পুচ্চির কথা শুনে।”
“পুচ্চি” এই ডাক শুধু মাত্র দেবায়ন আর ওর মধ্যে সীমিত। সেই নাম নিবেদিতার ঠোঁটে শুনে বুঝতে পারে, না সারাটা সময় শুধু মাত্র ওর কথাই হয়েছে এদের মাঝে।
মিন্টো পার্কের নিবেদিতার অফিস থেকে চারজনে বেড়িয়ে, গাড়ি নিয়ে সোজা, এস্প্লানেড। আকাশে কালো মেঘ তাও বাঙ্গালীরা পুজোর বাজার করতে বেড়িয়েছে, পুজো বলে কথা, সামান্য কালো মেঘ কি আর তাতে বাধ সাধতে পারে। রাস্তায় তিল ঠাইয়ের জায়গা নেই, চারদিকে লোকে লোকারণ্য। কোন ছেলে সঙ্গে নেই, ভিড় ঠেলে এগুতে একটু অসুবিধে হয়, এত ভিড়ে কেনাকাটা করতে অনুপমা অভ্যস্ত নয়। এতদিন দেবায়ন অথবা মায়ের সাথে বেড়িয়েছে, ওকে আগলে রাখার জন্য পাশে দেবায়ন থাকত এইবারে নেই। ভিড় ঠেলে এগোতে এগোতে এমন সময়ে ওর মামনি, দেবশ্রীর ফোন আসে।
দেবশ্রী ফোন করে বলে, “হ্যাঁ রে তুই কোথায়?”
অনুপমা উত্তর দেয়, “এই শ্রেয়া আর পায়েলকে নিয়ে একটু শপিং করতে বেড়িয়েছি। কি হয়েছে বল না?”
দেবশ্রী একটু থেমে ওকে প্রশ্ন করে, “দেবু কখন বাড়ি ফিরবে কিছু বলে গেছে কি?”
অনুপমা জানে দেবায়নের ফিরতে রাত হবে, রেডিসন থেকে সোজা আবার ব্যান্ডেল যাবে বাবার সাথে তারপরে ফিরবে। তাই দেবশ্রীকে উত্তর দেয়, “ওর ফিরতে রাত হবে কেন কিছু কাজ আছে নাকি?”
দেবশ্রীর একটু চিন্তিত কণ্ঠে ওকে বলে, “এখুনি একটু বাড়িতে আসতে পারবি? একটু কথা ছিল।”
বন্ধুদের নিয়ে শপিং করতে বেড়িয়েছে এরমাঝে মামনির ফোন। মামনির গলা শুনে মনে হল একটু চিন্তিত তাই পাল্টা প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে তোমার?”
দেবশ্রী উত্তর দেয়, “তেমন কিছু না। মণির ছেলে হয়েছে…..”
সেই খবর শুনে অনুপমা আনন্দিত হয়ে বলে, “এত ভালো খবর কিন্তু তোমাকে কে খবর দিল?”
দেবশ্রী একটু থেমে ওকে বলে, “না রে ওরা এখানে মানে….. তুই একটু বাড়িতে আসতে পারবি, জরুরি দরকার আছে।”
সূর্য মনিদিপা কোলকাতায় শুনে অনুপমা আশ্চর্য হয়ে যায়। ওদের জলপাইগুড়ি থাকার কথা, সেই মতন দেবায়নকে রাজি করিয়ে ওদের ছয় লাখ টাকা দিয়ে এসেছিল দোকান করার জন্য। মনিদিপা ছেলে হয়েছে সেটা সুখবর বটে কিন্তু ওদের বারবার করে বলে এসেছিল যাতে ওরা কোনোদিন মামনির সাথে সম্পর্ক করার চেষ্টা না করে তা স্বত্তেও ওরা ফোন করেছে? ভাবতেই রাগে অনুপমার গা জ্বলে ওঠে।
অনুপমা মামনিকে প্রশ্ন করে, “কোথায় আছে ওরা, কি কথা হয়েছে ওদের সাথে?”
দেবশ্রী ওর কণ্ঠস্বর শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলে, “তুই প্লিস দেবুকে কিছু বলিস না পারলে একটু তাড়াতাড়ি মানে দেবু বাড়ি ফিরে আসার আগে আমার এখানে আয়।”
তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমতী অনুপমার বুঝতে দেরি হয় না যে মনিদিপা আর সূর্য সোজা মামনির বাড়িতে এসেছে। শ্রেয়া আর পায়েলকে বলে অফিসে চলে যেতে আর নিবেদিতার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। বলে একটা জরুরি কাজে ওকে এখুনি বের হতে হবে। শ্রেয়া বারেবারে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয় না। নিবেদিতা বাকিদের নিয়ে বেড়িয়ে পরে অফিসে দিকে আর অনুপমা একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা লেক টাউনে দেবায়নের বাড়ি পৌঁছে যায়।
দেবশ্রী ওর জন্য বসার ঘরে অপেক্ষা করছিল। বাড়িতে ঢুকেই মনিদিপা আর সূর্যকে দেখে আশ্চর্যের সাথে সাথে রেগে ওঠে। দেবশ্রী অনুপমার চেহারা দেখে বুঝতে পারে যে অনুপমা রেগে গেছে ওদের দেখে, কিন্তু নিরুপায়।
অনুপমা কঠিন কণ্ঠে সূর্য আর মনিদিপাকে প্রশ্ন করে, “কি মনে করে একেবারে এই বাড়িতে আসা হয়েছে?”
সূর্য এক কোনায় দাঁড়িয়ে, মনিদিপা ছোট ছেলে কোলে ওকে বলে, “প্লিস খুব বিপদে পরে বৌদির স্মরনে এসেছি। আমি জানতাম তুমি রেগে যাবে কিন্তু আমরা বড় নিরুপায়।”
অনুপমা হিমশীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “কেন নিরুপায়? তোমাকে ছয় লাখ টাকা দিয়ে এসেছিলাম দোকান দিতে। চুপচাপ ওইখানে ব্যাবসা করতে পারতে। আবার আমাদের জীবনে কোন ব্যাঘাত ঘটাতে এসেছ? আর এসেছ যখন তখন এই বাড়িতে কেন?” সূর্যের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, “তোমার মনে নেই কি বলেছিলাম?”
ওর কঠিন কণ্ঠস্বর শুনে দেবশ্রী ওকে শান্ত করে বলে, “যা হবার হয়ে গেছে, এইবেলা ওদের ক্ষমা করে দে, মা।”
অনুপমা অবাক হয়ে মামনিকে বলে, “তুমি কি মানুষ মামনি? যা হবার হয়ে গেছে আর আমরা ভুলে যাবো?”
দেবশ্রী মাথা নিচু করে বসে থাকে সেই সাথে সূর্য আর মনিদিপার মাথা নিচু হয়ে যায়। অনুপমা ওদের কোলকাতা আসার কারন জিজ্ঞেস করে।
উত্তরে সূর্যের বদলে মনিদিপা বলে, “কিছুটা আমাদের ভুল আর আমাদের কপাল। তুমি যে ছয় লাখ টাকা দিয়েছিলে তার মধ্যে তিন লাখ দিয়ে একটা ছোট দোকান খুলেছিল সূর্য আর বাকি তিন লাখ একটা চিটফান্ডে দিয়েছিল। সেই চিট ফান্ড টাকা খেয়ে পালিয়ে গেছে। দোকানের অনেক কিছু বাকি পড়ে যায়, দোকান কয়েক মাস পরে উঠে যায়। আবার আমরা সেই পথে বসে যাই।”
অনুপমার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়, কঠিন কণ্ঠে মনিদিপাকে বলে, “সেটা তোমাদের আগে ভাবা উচিত ছিল মনিদিপা। বারেবারে তোমাদের টাকা আমি দিতে পারব না। সেবারে অনেক কষ্টে দেবায়নকে রাজি করিয়ে টাকা দিয়েছিলাম কিন্তু আর নয়।” কিছুক্ষণ থেমে বলে, “এখন কোথায় উঠেছ?”
মনিদিপা মাথা নাড়িয়ে বলে, “সোজা জলপাইগুড়ি থেকে এইখানে এসেছি আর কোথায় যাবো বল?”
অনুপমা আহত সাপের মতন ফোঁস করে ওঠে, “কেন, তোমাদের অসুবিধে আমাকে ফোন করতে পারোনি?”
আহত সূর্য মিনমিন করে বলে, “না মানে, ভাবলাম তুমি সেই বারে টাকা দিয়েছ এইবারে যদি বৌদি…..”
মামনি সামনে বসে আছে সেটা অনুপমা ভুলে যায়, প্রচন্ড রাগে চেঁচিয়ে বলে, “মামনি কি করবে? দেবায়ন আসার আগে তোমাদের এই বাড়ি থেকে চলে যেতে হবে।”
সূর্য কাতর কণ্ঠে বলে, “কোথায় যাবো? এইখানে আর কে আছে আমাদের?”
অনুপমা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “এতদিন এই কোলকাতায় ছিলে কোন চেনাজানা কারুর বাড়িতে থাকো কিন্তু আর এক পয়সা তোমরা পাবে না।”
অগ্নিশর্মা অনুপমাকে শান্ত করে দেবশ্রী বলে, “তুই একটু শান্ত হয়ে দেখ কি করা যেতে পারে। এই ছোট বাচ্চা নিয়ে ওরা কোথায় যাবে?”
তখনি কোলের ছোট বাচ্চাটা কেঁদে ওঠে, সেই কান্না শুনে অনুপমার মন কিছুটা গলে যায়। মনিদিপা আর সূর্যকে বলে, “তোমাদের মাথা গোঁজার জায়গা আছে কি?”
সূর্য মাথা দুলিয়ে জানায় আছে।
অনুপমা ওদের বলে, “আচ্ছা তাহলে সেইখানে থাকো। কয়েকদিনের মধ্যে আমি দেখি কি করতে পারি।”
অনুপমা মনিদিপার কোল থেকে ছোট ছেলেটাকে কোলে নিয়ে দেখে, বেশ টাবুটুবু গোলগাল মিষ্টি দেখতে বাচ্চাটা। ছোট্ট নরম হাত বাড়িয়ে অনুপমার গাল ছুঁয়ে দেয়। অনুপমা শেষ পর্যন্ত রাগ ভুলে ছেলেটাকে কোলে নিয়ে হেসে ফেলে। আলতো মাথা নাড়িয়ে স্মিত হেসে বলে, “এই তোর জন্য বুঝলি রে শয়তান ছেলে…..”
বিনামেঘে বজ্রাপাতের মতন বাড়ির সামনে অনুপমার বাবার গাড়ি এসে দাঁড়ায়। ওই গাড়ি থেকে দেবায়ন কে নামতে দেখে বাড়ির মধ্যে সবার গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। অনুপমা আর দেবশ্রী মুখ চাওয়াচায়ি করে, কিছু করে হোক দেবায়নকে সরাতে হবে। যদি দেবায়ন ওদের বাড়িতে সূর্য আর মনিদিপাকে দেখে ফেলে তাহলে মাথায় রক্ত চড়ে যাবে। সঙ্গে সঙ্গে অনুপমার মাথায় বুদ্ধি খেলে যায়, নিজের ব্যাগ উঠিয়ে মামনির গালে ছোট্ট চুমু খেয়ে বেড়িয়ে যায়।
দেবায়ন বাড়িতে ঢোকার আগেই সামনের দরজা খুলে এক গাল হেসে ওকে বলে, “তুই এত তাড়াতাড়ি ফিরে এলি? র্যাডিসন ফোরটে কি হল?”
ওদের বাড়িতে এই বিকেলে অনুপমাকে দেখে দেবায়ন আশ্চর্য হয় না, কেননা ওর জন্য এই বাড়ির দরজা সবসময়ে খোলা। তাও স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে, “মা কখন বাড়িতে ফিরেছে?”
অনুপমা ওকে বাইরেই দাঁড় করিয়ে রেখে বলে, “আরে না আমার একটু কাজ ছিল তাই এসেছিলাম।” ওর হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে, “তুই প্লিস আমার সাথে একটু পুজোর শপিং করতে যাবি?”
দেবায়ন অবাক হয়ে ওকে বলে, “সেই রায়চক থেকে এসেছি একটু বাড়িতে বসতে দে তারপরে না হয় যাবো।”
অনুপমা কাতর কণ্ঠে আবদার করে, “প্লিস প্লিস, ওই দেখ গাড়ি দাঁড়িয়ে আছ চল না একটু।”
সুন্দরী প্রেয়সীর কাতর কণ্ঠের ডাক উপেক্ষা করার যো ওর নেই তাই অগত্যা আবার গাড়িতে উঠে অনুপমার সাথে শপিং করতে বের হতে হয় ওকে। গাড়িতে উঠেই দেবায়নের চোখ বাঁচিয়ে দেবশ্রীকে একটা এস এম এস করে জানিয়ে দেয় সূর্য আর মনিদিপাকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে আর রাতে ফোন করে এই বিষয়ে কথাবার্তা বলবে। ঘুণাক্ষরে যদি দেবায়ন এই বিষয়ে টের পায় তাহলে আর রক্ষে নেই।
সেদিনের মতন সূর্য আর মনিদিপাকে দেবায়নের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয় অনুপমা। সেদিন শপিং করতে বিশেষ মন ছিল না ওর, মাথায় শুধু ঘুরছিল সূর্য আর মনিদিপাকে কি করে ওর চোখ বাঁচিয়ে সাহায্য করা যায়। ব্যাঙ্কে ওদের জয়েন্ট একাউন্ট, এতগুলো টাকা তুললে অতি সহজে দেবায়নের কাছে ধরা পড়ে যাবে, যদিও দেবায়ন কোনোদিন প্রশ্ন করে না ব্যাঙ্কের খাতা কোনোদিন নিজে খুলে দেখেও না। টাকার দরকার পড়লে ওর পার্স হাতড়ায় না হলে ওর কাছেই হাত পাতে। কিন্তু তাই বলে এত গুলো টাকা দেবায়নকে না বলে দেবে, সেটা মন মেনে নিতে পারে না। সূর্য আর মনিদিপা যখন আবার কোলকাতা ফিরে সোজা দেবায়নের বাড়িতে এসছে, নিশ্চয় কিছু কুমতলবে এসেছে। যদি সত্যি ওদের টাকার প্রয়োজন হত অথবা বিপদে পড়ত তাহলে হয়ত একবারের জন্য ওকে ফোন করত কিন্তু সেটা করেনি। কত টাকা চায় ওরা, কত টাকা দিলে সূর্য আর মনিদিপা চুপ থাকবে? একবার মনিদিপার শারীরিক অবস্থা দেখে বিগলিত হয়ে টাকা দিয়েছিল, এইবারে আবার কোলে ছোট ছেলে নিয়ে এসেছে। ফেলে দিতে চাইলেও ফেলে দেওয়া যায় না কিছুতেই। অন্তত ওর হৃদয় অতটা পাথর হয়ে যায়নি এখন। শত ভাবনা মাথায় ভর করে। দেবশ্রীও এই বিষয়ে দেবায়নকে কিছু জানায় না।
কয়েকদিন পরে সূর্যের দেওয়া ঠিকানায় অনুপমা একা গিয়ে ওদের সাথে দেখা করে।