04-10-2020, 10:42 AM
ষষ্টবিংশ পর্ব (#02)
অনুপমা ওর কেবিনে ঢুকে দেখে শ্রেয়া কারুর সাথে ফোনে কথা বলছে। ফোনের আওয়াজ শুনে বুঝে যায় যে শ্রেয়া ইন্দ্রনীলের সাথেই কথা বলছে।
অনুপমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে শ্রেয়া ইন্দ্রনীলকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা এই যে নতুন প্রোজেক্টের কোন কোম্পানি? তুমি কি দীপঙ্কর’দা র সাথে কথা বলেছ?”
ইন্দ্রনীল বলে, “না এখন বলিনি, শুধু তোমাকে বলছি। তুমি না হয় বুঝে শুনে দিপঙ্ককর’দা র সাথে অনুপমার সাথে কথা বল।”
শ্রেয়া বলে, “কিসের প্রোজেক্ট?”
ইন্দ্রনীল, “সুইজারল্যান্ডের একটা ওষুধের কোম্পানির প্রোজেক্ট। এটা পাতি একটা এপ্লিকেশানের কাজ আর তার মেইনটেনান্স করা। প্রোজেক্ট বেশ বড়সড়, আর এককালীন বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে, তারপরে প্রতি মাসে মেইনটেনান্স আছেই।”
শ্রেয়া বলে, “ঠিক আছে তুমি আমাকে সবিস্তারে মেল কর আমি দেখছি কি করা যায়। এই নিয়ে আমি অনুর সাথে আর দেবুর সাথে কথা বলে নেব।”
ইন্দ্রনীল ফোন রেখে দিতেই অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার, কিসের প্রোজেক্ট?”
শ্রেয়া বলে, “একটা ওষুধের কোম্পানির জন্য এপ্লিকেশান ডেভেলপ করতে হবে।”
অনুপমা শ্রেয়ার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে শ্রেয়ার মনের অভিপ্রায়, মেয়েটা আসলে কি করতে চলেছে। অনুপমা কিছুক্ষণ পরে ওকে প্রশ্ন বলে, “তুই যাচ্ছিস জার্মানি। তুই কি এইবারে এই ডিল করে ফিরবি?”
শ্রেয়া হেসে উত্তর দেয়, “তুই যদি বলিস তাহলে করেই ফিরব না হলে আবার যাওয়া সে অনেক খরচ। আমি ভাবছিলাম যে এইবারে যদি এই প্রোজেক্ট করি তাহলে রূপক কে সাথে নিয়ে যাবো। এইটা সফটওয়্যার এপ্লিকেশান, এটা ওর ডিপার্টমেন্ট করবে আশা করি।”
অনুপমা হেসে বলে, “তুই যা ভালো বুঝিস তাই করিস।”
শ্রেয়া কিছুক্ষণ অনুপমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ রে একটা সত্যি কথা আমাকে বলবি?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “কি কথা?”
শ্রেয়া বলে, “তুই কি আমার ওপরে ক্ষেপে আছিস?”
অনুপমা বলে, “কেন?”
শ্রেয়া বলে, “আমি জানি এই কয়দিনে আমি তোদের সাথে ঠিক ভাবে মেলা মেশা করিনি তাই তোরা সবাই আমার ওপরে ক্ষেপে আছিস। আমি সব বুঝতে পারি এই যে মাঝে মাঝে পায়েল এসে আমাকে প্রশ্ন করে, তুই করিস।”
অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নেয়, এই হচ্ছে মোক্ষম সময় ওকে চেপে ধরার তাই ওকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল। এখানে সবাই ব্যাস্ত, সবাই নিজেদের কাজে মেতে আছে, রূপক ব্যাস্ত, দেবু ব্যাস্ত, সুপর্ণা ম্যাডাম ব্যাস্ত কিন্তু তোর রুপ এত ভিন্ন কেন? তুই কেন নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছিলিস?”
শ্রেয়া খিলখিল করে হেসে বলে, “এই দ্যাখ কাজ হলেই তোকে ডাক দিলাম। দুপুরে লাঞ্চ এক সাথেই করি সবাই। তাহলে কই আলাদা করে রেখেছি?”
অনুপমা সোজাসুজি প্রশ্ন করে, “তোর সাথে ইন্দ্রনীলের বেশ হৃদ্যতা বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। এই যে আজকের ব্যাপারটা, ইন্দ্রনীল তোকে ফোন করল কিন্তু আমাকে অথবা দেবায়ন অথবা দীপঙ্করদা কে করল না। তোদের মাথায় ঠিক কি চলছে একটু খুলে বলবি? তোরা নিশ্চয় কিছু উলটোপালটা প্লান করছিস না।”
শ্রেয়া হঠাৎ ভুরু নাচিয়ে চাপা হেসে বলে, “উম্মম্ম, সরি অনু এখন কিছু বলতে পারছি না। সময় হলে সব বুঝিয়ে দেব।”
অনুপমা ভেবে পায় না আগামী দিনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। শ্রেয়া কি ওদের ভালো চায় না খারাপ চায়।
কিছু দিনের মধ্যে রূপকের সাথে শ্রেয়া আর এক দল টেকনিশিয়ান জার্মানি যাত্রা করে। এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট ওদের সারভারে ডিপ্লয় করা হয় আর সেই সাথে ইন্দ্রনীল, শ্রেয়া আর রূপককে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের ওষুধের কোম্পানির প্রোজেক্ট ফাইনাল করে ফেলে।
এইবারে শ্রেয়ার সাথে রূপকের যাওয়াতে অনুপমার মনের দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। জলপাইগুড়িতে রূপক ওকে বলেছিল যে শ্রেয়া আর রূপকের হৃদ্যতা কমে এসেছে, কিন্তু এই বিজনেস ট্রিপে যাওয়ার ফলে অনুপমা বুঝে যায় যে রূপকও হয়তো ওদের সাথে জড়িত। হতে পারে এই বড় বড় প্রোজেক্টের আড়ালে ওরা নিজেদের কোন ছোটো ছোটো কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। একাউন্টস দেখে অথবা কাগজ পত্র দেখে কিছু বুঝে ওঠার উপায় নেই কারন বাইরের কাজ হয়ত বাইরে সেরে নেয় রূপক।
একদিন অনুপমার বাবার সাথে ওরা তিনজনে বসে এই গ্রুপ কোম্পানি নিয়ে আলোচনা করে। পুনের হোটেলের মালিকানা অচিরেই ওদের হাতে চলে আসবে। ইতিমধ্যে মেহেকের সাথে কথা বার্তা হয়ে গেছে আর সেই মতন ট্রান্সফার কাগজ তৈরি হয়ে গেছে। দিলিপ বাবু জানিয়েছেন যে তাঁর দ্বিতীয় হোটেল মিস্টার সেনের নামে করে দেবেন। দুটো কন্সট্রাক্সান কোম্পানি বেশ ভালো আয় করছে আর প্রতিশ্রুতি মাফিক মিস্টার হেরজোগকে তাঁর পাওনা সময় মতন মিটিয়ে দেওয়ায় হচ্ছে। সেই আলোচনায় দেবায়ন জানায় যে পায়েলকে বোর্ড মেম্বার বানানো হোক আর সেই সাথে ওদের মার্কেটিংয়ের প্রধান দীপঙ্কর’দা কেও বোর্ডে নেওয়া হোক। পায়েলের ব্যাপারে অনুপমা একটু দোনামনা করে, পায়েলকে কোন কিছুতে জড়াতে নারাজ। অফিসে গেলেও অনুপমা ওকে খুব আগলে রাখে আর বাড়িতে বাকিরা আগলে রাখে। দেবায়ন অনুপমা আর মিস্টার সেনকে বুঝিয়ে বলে শ্রেয়ার ব্যাবহার দিনে দিনে সন্দেহ উদ্রেক করেছে, ভবিষ্যতে বোর্ডে ওদের হাতে বেশি মেম্বার থাকলে শ্রেয়া যদি কিছু উলটো পাল্টা করার চেষ্টা কিওরে তাহলে ওকে ছাড়িয়ে দিতে অসুবিধে হবে না। অনুপমা বুঝতে পারে যে পায়েলকে শুধু মাত্র দল ভারী করার জন্য বোর্ড মেম্বারে নেওয়া হচ্ছে। আগামী বোর্ড মিটিঙে এই নতুন সদস্যদের নামাঙ্কিত করা হবে আর বাকিদের জানানো হবে।
কিছুদিন পরেই ওদের তৃতীয় বোর্ড মিটিং ডাকা হয়। ততদিনে শ্রেয়া আর রূপক জার্মানি থেকে ফিরে আসে আর সেই ওষুধের কোম্পানির ডিল করে আসে। এইবারে ইন্দ্রনীল জার্মানি থেকে আসে। অনুপমাই দেবায়নের হয়ে কথা বলতে শুরু করে। প্রথমে ওদের আয় ব্যয় নিয়ে আলোচনা চলে। এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট সাথে চুক্তি ছিল প্রফিট শেয়ারিং তাই প্রথম সপ্তাহ থেকেই টাকা আসতে শুরু করে। মাস দুয়েক পরে জারমেনিয়া এয়ারলাইন্সের প্রোজেক্ট ডিপ্লয় করলে একি রকম ভাবে আয় শুরু হয়ে যাবে। প্রথম বছর শেষ হওয়ার আগেই ওদের আয় বেশ কয়েক গুন বেড়ে যাবে তবে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পৌঁছতে অনেক দিন লাগবে। বোর্ড মিটিঙে নতুন দুইজনকে বোর্ডে নেওয়ার কথা বলে অনুপমা, একজন পায়েল আর দ্বিতীয় দীপঙ্কর’দা।
সুপর্ণা ম্যাডাম আর মনীষা আগে থেকেই বোর্ড মেম্বার ছিল এবারে পায়েল আর দীপঙ্কর’দা নিযুক্ত হওয়াতে ইন্দ্রনীল ছাড়া বাকি সবাই খুশি। ইন্দ্রনীলের হাবভাব দেখে মনে হল সে বোর্ড মেম্বার হলে ভালো হত। রূপক জানায় যে সুইজারল্যান্ডের সফটওয়ারের কাজ বেশ এগিয়ে গেছে, সেটাও মাস দুয়েকের মধ্যে ডিপ্লয় করা যেতে পারে। মনীষা জানায় যে গত তিন কোয়ার্টারে অনেক খরচের ফলে আগামী বছরে ওদের মাইনে বাড়ানোর ব্যাপারে একটু চাপ আছে কারন, গত তিন চার মাসে যে হারে লোকবল বেড়েছে সেই হারে আয় বাড়েনি। এখন ওদের আয় সবার মাইনে দিতে পারে না। মনীষার কথা শুনে শ্রেয়া আর রূপক একটু দমে যায়, মুখ শুকনো করে অনুপমার দিকে চেয়ে থাকে। অনুপমা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলে, যেহেতু এই বছরে তিনটে বড় প্রোজেক্ট এসেছে সুতরাং এই বছরে মাইনে ঠিক মতন না বাড়াতে পারলেও পুজোর সময়ে সবাইকে ভালো বোনাস দেওয়ার চেষ্টা করবে। দেবায়ন চুপচাপ সবার কথা শুনে যায়। অনুপমা ওর মতামতের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে পরে জানিয়ে দেবে।
গ্রীষ্মের গরম কাটিয়ে বর্ষা ঋতু নেমে আসে জলের ধারা নিয়ে। সারা গ্রীষ্ম ওদের অফিস কাজেই গরম ছিল। বর্ষা নামতেই তৃষ্ণার্ত গাছ পালার মতন সবাই যেন গরম থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এর মাঝে দেবায়ন আর অনুপমা, পুনের হোটেলের ট্রান্সফার কাগজ তৈরি করে মান্ডি গিয়ে মেহেকের স্বাক্ষর নিয়ে আসে। সেখানে শুভমের সাথে দেখা হয়, আর শুভম ওদের জানায় যে মেহেক কে নিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাবে। অনুপমা ওদের হাতে পাঁচ কোটি টাকার চেক তুলে দেয় আর ওদের শুভেচ্ছা জানায়। মিস্টার সেন আগেই পুনে পৌঁছে যান নতুন হোটেল ম্যানেজার নিযুক্ত করার জন্য। হোটেলের কাগজ পত্র নিয়ে দেবায়ন আর অনুপমা পুনে পৌঁছায়। মিস্টার সেন আলাদা করে একবার রজত বাবুর সাথে দেখা করে, অবশ্য সেই আলোচনায় দেবায়ন অথবা অনুপমা ছিল না তাই ওরা জানে না ওদের মাঝে কি কথা হয়। তবে রজত বাবুর সাথে কথা বলে আসার পরে মিস্টার সেনের চেহারা বদলে যায়, বেশ গম্ভির হয়ে দেবায়ন আর অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ তারপরে একপাশে ডেকে নিয়ে হেসে ফেলেন। তিনি বলেন কিছু কিছু জায়গায় চক্রান্ত করা ভালো কিন্তু একটু ভেবে চিন্তে চক্রান্ত করা উচিত। রজত বাবু পুনের বেশ বড় লোক, কিন্তু মিস্টার সেন কম যায় না। তিনি উলটে রজত বাবুকে শাসিয়ে এসেছেন যে যদি ভবিষ্যতে ওদের দিকে চোখ তুলে তাকায় তাহলে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে না। চার কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে তাকে।
পুনের পরে ওরা সবাই উটি যায়। উটি হোটেলের বোর্ড মিটিংয়ে, মিস্টার পারিজাত হোটেলের নতুন মালিকের নাম ঘোষণা করে আর সেই সাথে মিস্টার সেনকে অভ্যর্থনা জানায়। কারতিকেয়নকে দেবায়ন আলাদা করে অনেক টাকা দেয় আর ভবিষ্যতে তাঁর জন্য জমি কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ব্যাঙ্গালোরে ওদের জন্য বেশ বড় একটা চমক অপেক্ষা করেছিল। দিলিপ বাবু কনিকাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর ফিরে এসেছেন, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে বন্ধিত হবেন। প্রেমজিতের সাথে দিলিপ বাবুর আন্তরিকতা বেশ বেড়ে গেছে, যেখানেই যায় প্রেমজিতকে সাথে নিয়ে যায়। কণিকা, ব্যাঙ্গালোরের একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। দিলিপ বাবু ওদের জানান যে কথা মতন দ্বিতীয় হোটেলের পঁচাত্তর শতাংশের মালিকানা দেবায়ন আর অনুপমার নামে লিখে দিতে চান আর বর্তমান হোটেলের আগে যেমন পঁচিশ শতাংশ মিস্টার সেনের নামে ছিল সেটা তেমনি থাকবে। দেবায়ন আর মিস্টার সেন খুশি, কিন্তু তার চেয়ে বেশি খুশি হয় অনুপমা। দিলিপ বাবু মদ ছেড়ে দিয়েছেন, কণিকার কড়া তত্তাবধনে রোজ সকালে উঠে ব্যায়াম করা, হাঁটতে যাওয়া ইত্যাদি করার ফলে অনেক সুস্থ হয়ে উঠেছেন। দিন তিনেক ব্যাঙ্গালোরে ছিল আর সেই কয়দিনে দিলিপ বাবুর মুখে শুধু মাত্র অনুপমা আর দেবায়নের জয়গান। আসার আগে অনুপমা, দিলিপ বাবু আর কণিকাকে জানিয়ে দেয় যে কি করে ওদের খুঁজে পেয়েছিল। অনুপমার মুখে সব কথা শুনে দিলিপ বাবু অবাক হলেও হেসে ফেলেন। তিনি বলেন অনেক সময়ে কয়লা খুঁড়তে খুঁড়তে হীরের সন্ধান পাওয়া যায়, হয়ত তার জীবনের এই ঘটনা এমন এক উদাহরন।
কোলকাতায় বর্ষা শেষ হতে অনেক বেশি সময় নেয় এমন কি মাঝে মাঝে দুর্গা পুজোর সময়ে বৃষ্টি নেমে আসে। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু বর্ষা যেন আর কোলকাতা ছাড়তে চায় না। বিগত ছয় মাসে দেবায়ন একবারের জন্য বাইরে যায়নি, দুই একদিনের কাজ ছাড়া আর সেই জন্য অনুপমা ভীষণ খুশি। পায়েলের সাথে গাড়িতে করে অফিসে আসত কিন্তু ফেরার সময়ে দেবায়নের বাইকে ফিরত। কোনদিন বৃষ্টিতে কাক ভিজে হয়ে গেলে দেবায়নের বাড়িতেই থেকে যেত অথবা দেবায়ন ওর বাড়িতে থেকে যেত। অফিস ফেরত, কোনদিন ফ্লুরিসে বসে গল্প করত, কোনদিন আহেলিতে গিয়ে বসত, কোনদিন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে এগ রোল খেত। কাজের সাথে ভালোবাসার এক অদ্ভুত মেল বন্ধনে দুইজনেই ভেসে বেড়ায়।
সেদিন সকাল থেকেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারুর কাজে তেমন মন ছিল না। লাঞ্চের পরে অনুপমা ব্যাঙ্কের একাউন্ট ডিটেলস দেখছিল, এক বছর ঘুরে আসার সময় এসে গেছে। ঠিক এক বছর আগে, এমন এক পুজোর আগেই ওদের কোম্পানি শুরু হয়েছিল। আজ এক বছর পরে বিগত এক বছরের আয় আর ব্যায় খুলে বসে। কুড়ি কোটি টাকা দিয়ে শুরু কোম্পানি, শুধু মাত্র পাঁচ কোটি টাকা ওর আর দেবায়নের জয়েন্ট একাউন্টে পরে রয়েছে। বাকি সব আয় কোম্পানি একাউন্টে, এই এক বছরে আয় শুধু মাত্র পাঁচ থেকে ছয় কোটি যার সবটাই মাইনে দিতে, ট্যাক্স দিতে, অফিসের ভাড়া দিতে ইত্যাদি বিল মেটাতে মেটাতে খরচ হয়ে গেছে। এদিকে দুই সপ্তাহ পরেই কোম্পানির বার্ষিক মিটিং। জার্মানি থেকে অনিমেশ আঙ্কেল এসেছেন আর ইন্দ্রনীল এসেছে। ইন্দ্রনীল আসাতে শ্রেয়ার চলন বলন বদলে গেছে। সেটা সবার চোখে না পড়লেও অনুপমা আর দেবায়নের চোখ এড়াতে পারেনি। মাঝে মাঝেই ইন্দ্রনীলকে শ্রেয়ার কেবিনে দেখা যায়, লাঞ্চের সময় টুকু ওদের সাথে লাঞ্চ করে কিন্তু বাকি সময়ে শ্রেয়া বেশ ছাড়া ছাড়া থাকে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওর চোখ পড়ে নিবেদিতার দেওয়া দুই কোটি টাকার ওপরে, হ্যাঁ এক সময়ে নিবেদিতা ওর একাউন্টে দুই কোটি টাকা দিয়েছিল। সেই সাথে মনে পরে যায় ছয় মাস আগে জলপাইগুড়িতে নিবেদিতার সাথে আচমকা দেখা হয়ে যাওয়া। দেবায়নকে সেই ঘটনা জানিয়েছিল কিন্তু তারপরে কাজের চাপে সেই কথা মাথা থেকে উবে গেছে। দেবায়ন কি নিবেদিতা আর ধৃতিমানের ব্যাপারে কিছু খোঁজ খবর নিয়েছে? একবার জিজ্ঞেস করলে হয় কি হল। এমন সময়ে দেবায়ন ওর কেবিনের দরজা খুলে ঢোকে।
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “তুই না একশো বছর বাঁচবি। আমি তোর কথা মনে করছিলাম এখুনি।”
দেবায়ন ওর কাছে এসে গাল টিপে আদর করে বলে, “তুই আমার সাথে থাকবি তো?”
অনুপমা চেয়ারে বসে ছিল তাই ওর কোমর জড়িয়ে পেটের ওপরে মুখ ঘষে বলে, “তুই থাকলে আমিও থাকব। এবারে বল কেন এসেছিলি?”
দেবায়ন মাথা চুলকে বলে, “যদি কিছু মনে না করিস তাহলে আমার সাথে একটু বের হবি।”
অনুপমা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে দেবায়নের ঠোঁটে মিচকি হাসি। কি চলছে আবার এই ছেলেটার মাথায়? দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “বৃষ্টি যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে। কোথায় যেতে হবে?”
দেবায়ন ওর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলে, “আমার ওপরে বিশ্বাস আছে তো? তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
অনুপমা ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, “বিষ দিলেও অমৃত ভেবে গিলে নেব। চল কোথায় নিয়ে যেতে চাস।”
এইরকম জল ভেজা আবহাওয়ায় গাড়িতে চড়তে ইচ্ছে করে না তাই ব্যাগ গুছিয়ে দেবায়নের বাইকে চেপে বেড়িয়ে গেল। যাবার আগে পায়েলকে বলে গেল যেন অফিস ছুটি হলেই বাড়ি ফেরে। আকাশে কালো মেঘের খেলা, দুপুরের পরে বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে তাই বাতাস বেশ ঠাণ্ডা আর ভিজে। রাস্তায় এদিকে ওদিকে জল জমে, দুইপাশের গাছ গুলো যেন এই স্নান সেরে উঠেছে। সূর্যের দেখা নেই, বিকেলের দিকে আবার বৃষ্টি নামতে পারে। পেছনে বসে দুই হাতে আস্টেপিস্টে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীর মিশিয়ে দেয় ওর পিঠের ওপরে। নরম শরীর দেবায়নের উত্তাপ শুষে নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। নরম বুকে পিঠের পেশির ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে অনুপমা, এই বৃষ্টির দিনে বড় দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু লোক মাঝে নিজেকে সামলে নেয়।
রাস্তায় যেতে যেতে অনুপমা দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তোকে ধৃতিমানের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিতে বলেছিলাম সেটা কি নিয়েছিস?”
দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ নিয়েছি। ব্যাটা অনেক ঘাঘু মাল। নিবেদিতা ম্যাডামের কোম্পানিতে মার্কেটিং হেড হিসাবে জয়েন করেছিল এই জানুয়ারিতে। নিবেদিতা ম্যাডামকে একা পেয়ে হাত মারতে চেষ্টা করেছিল, এক লেঙ্গি মেরে শালাকে চুপ করিয়ে দিয়েছি।”
অনুপমা ওর মামনির সাথে ধৃতিমানের হৃদ্যতা অনেক আগেই আঁচ করেছিল কিন্তু কোনদিন সেটা দেবায়নকে খুলে বলেনি কারন দেবশ্রীর বারন ছিল। এবারে আবার নিবেদিতার পেছনে পড়েছে? লোকটা তাঁর মানে বিশেষ সুবিধের নয়।
অনুপমা প্রশ্ন করে, “মানে?”
দেবায়ন, “যেদিন তুই আমাকে নিবেদিতা আর ধৃতিমানের ব্যাপারে জানালি সেইদিন থেকেই ধৃতিমানের ব্যাপারে আমি একটু খোঁজ খবর লাগিয়েছিলাম। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধৃতিমান নিবেদিতা ম্যাডামকে গল্প বলেছিল যে তাঁর স্ত্রী, রেনুকা এক গাড়ি দুর্ঘটনায় অনেক বছর আগে গত হয়েছেন, আর সেই গাড়ি দুর্ঘটনার আসল কারন তাঁর পুরনো প্রেমিকা, কল্পনার স্বপ্ন। এই গল্প শুনে আমার মন বলল এর পেছনের আসল ঘটনা অন্য কিছু। খোঁজ নেওয়ার জন্য এখানে ধৃতিমানের বাড়িতে গেলাম, পরিচয় দিলাম ওর কোম্পানির কর্তা হিসাবে। ধৃতিমানের মেয়ে, মল্লিকার সাথে দেখা হল। মল্লিকা বেশ বড় হয়েছে ক্লাস ইলেভেন পড়ে এখন, আমাকে দেখেই চিনতে পারল আর তোর কথা জিজ্ঞেস করল। আমি ওর সাথে কথা বললাম বেশ কিছুক্ষণ তারপরে ধৃতিমানের শ্বশুর শাশুরির সাথে কথা বললাম। ওদের সাথে কথা বলে একটা বিষয়ে একটু সন্দেহ জাগল মনের মধ্যে। ধৃতিমানের শ্বশুর মশায় আমাকে বললেন যে তাঁর কন্যের সাথে তাঁর জামাইয়ের সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। ধৃতিমান আগে একজনকে ভালবাসত, সেটা ফলপ্রসু না হওয়ার পরে রেনুকার সাথে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরে কয়েক মাস পর থেকে নাকি ওই কল্পনার সাথে আবার প্রেম ভালোবাসা শুরু হয়। তারপরে ধৃতিমানের মুম্বাইয়ের ঠিকানা চাইলাম ওদের কাছে, সেটা পেতে কোন অসুবিধে হল না। তোর মনে আছে গত মাসে দিন দুয়েকের জন্য মুম্বাই গেছিলাম আমি?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ মনে আছে। তুই বলেছিলিস নিজের কোন কাজে যাচ্ছিস। তুই এই কাজে গেছিলিসি আমাকে বলিসনি কেন?”
দেবায়ন হেসে বলে, “মেয়েদের পেটে কি আর কথা থাকে, তাই আর তোকে বলিনি। তুই জানলে যদি মা কে বলে দিতিস তাই।”
অনুপমা ওর মাথায় চাটি মেরে বলে, “কুত্তা, বাকি পাঁচ জনের মতন আমি নই যে পেটের কথা রাষ্ট্র করে বেড়াব। জলপাইগুড়ির কথা মামনির কাছে বেমালুম চেপে গেছি আমি। মামনি কিছুই জানে এই সব বিষয়ে, উলটে আমার ভয় ছিল তোকে বললে তুই কি করে বসিস। তা মুম্বাই গিয়ে কি খবর নিয়ে এলি?”
দেবায়ন বলে, “মুম্বাই গিয়ে ধৃতিমানের মায়ের সাথে কথা বলে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। তবে এইটুকু বললেন যে রেনুকা আর ধৃতিমানের সম্পর্ক বিশেষ ভালো ছিল না। তখন আমার মনের মধ্যে সন্দেহ জাগল, এই দুর্ঘটনা হয়ত ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে।”
অনুপমা আঁতকে ওঠে, “মানে?”
দেবায়ন বলে, “মানে ধৃতিমানের শ্বশুরের কথা আর ধৃতিমানের মায়ের কাছে সব কিছু শোনার পরে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। কোলকাতা ফিরে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লাম। একদিন ধৃতিমানকে ডাকলাম আমাদের কন্সট্রাকশান অফিসে। আমাকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে উঠল। আমি ওকে চেপে ধরলাম সেই সাথে বললাম যে আমি বেহালা গিয়েছিলাম, মুম্বাই গিয়েছিলাম ইত্যাদি। আমি চেপে ধরে বললাম যে ওই কল্পনাকে খুঁজে পেতেও আমার কোন অসুবিধে হবে না। সুতরাং আসল কথা বলে ফেলা ভালো। ধৃতিমানের গলা শুকিয়ে কাঠ, আমি ওকে বললাম সত্যি কথা না বললে, আমি ওর মেয়েকে এখানে ডাকব আর তাঁর স্ত্রীর সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল সেটা খুলে জানিয়ে দেব। ধৃতিমান অবশেষে ভেঙ্গে পড়ল, জানালো যে গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছিল সেটা সত্যি কিন্তু তিনি ড্রাইভার সিটে বসে ছিল যতক্ষণ না রেনুকার রক্তাক্ত দেহ প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে প্রানহীন না হয়ে গেল। ঠিক সময়ে লোকজন ডাকলে রেনুকা বেঁচে যেত কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবেই ধৃতিমান রেনুকাকে ওই খানে মড়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল।”
সব শুনে অনুপমার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দেয়, চাপা হুঙ্কারে দেবায়নের কানের কাছে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
দেবায়ন বলে, “চিন্তা নেই, ওই সাপের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছি। নিবেদিতার সাথে কিছু করবে না।”
অনুপমা বলে, “কোথায় আছে? নিবেদিতার কোম্পানিতেই আছে নাকি এখন?”
দেবায়ন বলে, “নিবেদিতা ম্যাডামের কাছে আমি সবকিছু খুলে বলেছিলাম, নিবেদিতা ম্যাডাম একটু খানি ভেঙ্গে পড়েছিল কিন্তু সামলে নিয়েছে। কাজ ভালো করে লোকটা, এই কয় মাসে প্রচুর দুই নম্বরি করে টাকা কামিয়ে দিয়েছে আমাদের দুই কোম্পানিকে। তাই ওকে নিবেদিতা ম্যাডামের কোম্পানিতে থেকে ছাড়িয়ে সোজা আমাদের কোম্পানিতে নিযুক্ত করেছি। কাকুর সামনে আওয়াজ উঠানোর শক্তি আর সাহস নেই। আর আমার হাতে মোক্ষম অস্ত্র রয়েছে বেশি বেগড়বাঁই করলে সবার সামনে উলঙ্গ করে পেটাবো।”
অনুপমা ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই না একটা সত্যি……”
দেবায়ন বলে, “আমি কি?”
অনুপমা ঠোঁট কুঁচকে ওর ঘাড়ের কাছে আলতো চুমু খেয়ে বলে, “একটা দুষ্টু মিষ্টি পুচ্চু সোনা।”
কিছুক্ষণ পরে দেবায়ন একটা বাজারে বাইক থামিয়ে অনুপমাকে একটা বড় ফুলের তোড়া আর বেশ কিছু চকোলেট কিনতে বলে। অনুপমা প্রশ্ন করলে শুধু মাত্র হেসে জানায় যেখানে যাচ্ছে সেখানে এই উপহার গুলো লাগবে। অনুপমা চিন্তায় পরে যায়, কার বাড়িতে কার সাথে দেখা করার জন্য ওকে নিয়ে যাচ্ছে। বারেবারে প্রশ্ন করেও সঠিক উত্তর না পেয়ে কিঞ্চিত অভিমান করে বসে থাকে।
অনুপমা ওর কেবিনে ঢুকে দেখে শ্রেয়া কারুর সাথে ফোনে কথা বলছে। ফোনের আওয়াজ শুনে বুঝে যায় যে শ্রেয়া ইন্দ্রনীলের সাথেই কথা বলছে।
অনুপমাকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে শ্রেয়া ইন্দ্রনীলকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা এই যে নতুন প্রোজেক্টের কোন কোম্পানি? তুমি কি দীপঙ্কর’দা র সাথে কথা বলেছ?”
ইন্দ্রনীল বলে, “না এখন বলিনি, শুধু তোমাকে বলছি। তুমি না হয় বুঝে শুনে দিপঙ্ককর’দা র সাথে অনুপমার সাথে কথা বল।”
শ্রেয়া বলে, “কিসের প্রোজেক্ট?”
ইন্দ্রনীল, “সুইজারল্যান্ডের একটা ওষুধের কোম্পানির প্রোজেক্ট। এটা পাতি একটা এপ্লিকেশানের কাজ আর তার মেইনটেনান্স করা। প্রোজেক্ট বেশ বড়সড়, আর এককালীন বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাওয়া যাবে, তারপরে প্রতি মাসে মেইনটেনান্স আছেই।”
শ্রেয়া বলে, “ঠিক আছে তুমি আমাকে সবিস্তারে মেল কর আমি দেখছি কি করা যায়। এই নিয়ে আমি অনুর সাথে আর দেবুর সাথে কথা বলে নেব।”
ইন্দ্রনীল ফোন রেখে দিতেই অনুপমা ওকে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার, কিসের প্রোজেক্ট?”
শ্রেয়া বলে, “একটা ওষুধের কোম্পানির জন্য এপ্লিকেশান ডেভেলপ করতে হবে।”
অনুপমা শ্রেয়ার চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে শ্রেয়ার মনের অভিপ্রায়, মেয়েটা আসলে কি করতে চলেছে। অনুপমা কিছুক্ষণ পরে ওকে প্রশ্ন বলে, “তুই যাচ্ছিস জার্মানি। তুই কি এইবারে এই ডিল করে ফিরবি?”
শ্রেয়া হেসে উত্তর দেয়, “তুই যদি বলিস তাহলে করেই ফিরব না হলে আবার যাওয়া সে অনেক খরচ। আমি ভাবছিলাম যে এইবারে যদি এই প্রোজেক্ট করি তাহলে রূপক কে সাথে নিয়ে যাবো। এইটা সফটওয়্যার এপ্লিকেশান, এটা ওর ডিপার্টমেন্ট করবে আশা করি।”
অনুপমা হেসে বলে, “তুই যা ভালো বুঝিস তাই করিস।”
শ্রেয়া কিছুক্ষণ অনুপমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “হ্যাঁ রে একটা সত্যি কথা আমাকে বলবি?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “কি কথা?”
শ্রেয়া বলে, “তুই কি আমার ওপরে ক্ষেপে আছিস?”
অনুপমা বলে, “কেন?”
শ্রেয়া বলে, “আমি জানি এই কয়দিনে আমি তোদের সাথে ঠিক ভাবে মেলা মেশা করিনি তাই তোরা সবাই আমার ওপরে ক্ষেপে আছিস। আমি সব বুঝতে পারি এই যে মাঝে মাঝে পায়েল এসে আমাকে প্রশ্ন করে, তুই করিস।”
অনুপমা বুক ভরে শ্বাস নেয়, এই হচ্ছে মোক্ষম সময় ওকে চেপে ধরার তাই ওকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা তুই আমাকে একটা সত্যি কথা বল। এখানে সবাই ব্যাস্ত, সবাই নিজেদের কাজে মেতে আছে, রূপক ব্যাস্ত, দেবু ব্যাস্ত, সুপর্ণা ম্যাডাম ব্যাস্ত কিন্তু তোর রুপ এত ভিন্ন কেন? তুই কেন নিজেকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছিলিস?”
শ্রেয়া খিলখিল করে হেসে বলে, “এই দ্যাখ কাজ হলেই তোকে ডাক দিলাম। দুপুরে লাঞ্চ এক সাথেই করি সবাই। তাহলে কই আলাদা করে রেখেছি?”
অনুপমা সোজাসুজি প্রশ্ন করে, “তোর সাথে ইন্দ্রনীলের বেশ হৃদ্যতা বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। এই যে আজকের ব্যাপারটা, ইন্দ্রনীল তোকে ফোন করল কিন্তু আমাকে অথবা দেবায়ন অথবা দীপঙ্করদা কে করল না। তোদের মাথায় ঠিক কি চলছে একটু খুলে বলবি? তোরা নিশ্চয় কিছু উলটোপালটা প্লান করছিস না।”
শ্রেয়া হঠাৎ ভুরু নাচিয়ে চাপা হেসে বলে, “উম্মম্ম, সরি অনু এখন কিছু বলতে পারছি না। সময় হলে সব বুঝিয়ে দেব।”
অনুপমা ভেবে পায় না আগামী দিনে ওর জন্য কি অপেক্ষা করছে। শ্রেয়া কি ওদের ভালো চায় না খারাপ চায়।
কিছু দিনের মধ্যে রূপকের সাথে শ্রেয়া আর এক দল টেকনিশিয়ান জার্মানি যাত্রা করে। এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট ওদের সারভারে ডিপ্লয় করা হয় আর সেই সাথে ইন্দ্রনীল, শ্রেয়া আর রূপককে নিয়ে সুইজারল্যান্ডের ওষুধের কোম্পানির প্রোজেক্ট ফাইনাল করে ফেলে।
এইবারে শ্রেয়ার সাথে রূপকের যাওয়াতে অনুপমার মনের দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। জলপাইগুড়িতে রূপক ওকে বলেছিল যে শ্রেয়া আর রূপকের হৃদ্যতা কমে এসেছে, কিন্তু এই বিজনেস ট্রিপে যাওয়ার ফলে অনুপমা বুঝে যায় যে রূপকও হয়তো ওদের সাথে জড়িত। হতে পারে এই বড় বড় প্রোজেক্টের আড়ালে ওরা নিজেদের কোন ছোটো ছোটো কাজ হাতিয়ে নিচ্ছে। একাউন্টস দেখে অথবা কাগজ পত্র দেখে কিছু বুঝে ওঠার উপায় নেই কারন বাইরের কাজ হয়ত বাইরে সেরে নেয় রূপক।
একদিন অনুপমার বাবার সাথে ওরা তিনজনে বসে এই গ্রুপ কোম্পানি নিয়ে আলোচনা করে। পুনের হোটেলের মালিকানা অচিরেই ওদের হাতে চলে আসবে। ইতিমধ্যে মেহেকের সাথে কথা বার্তা হয়ে গেছে আর সেই মতন ট্রান্সফার কাগজ তৈরি হয়ে গেছে। দিলিপ বাবু জানিয়েছেন যে তাঁর দ্বিতীয় হোটেল মিস্টার সেনের নামে করে দেবেন। দুটো কন্সট্রাক্সান কোম্পানি বেশ ভালো আয় করছে আর প্রতিশ্রুতি মাফিক মিস্টার হেরজোগকে তাঁর পাওনা সময় মতন মিটিয়ে দেওয়ায় হচ্ছে। সেই আলোচনায় দেবায়ন জানায় যে পায়েলকে বোর্ড মেম্বার বানানো হোক আর সেই সাথে ওদের মার্কেটিংয়ের প্রধান দীপঙ্কর’দা কেও বোর্ডে নেওয়া হোক। পায়েলের ব্যাপারে অনুপমা একটু দোনামনা করে, পায়েলকে কোন কিছুতে জড়াতে নারাজ। অফিসে গেলেও অনুপমা ওকে খুব আগলে রাখে আর বাড়িতে বাকিরা আগলে রাখে। দেবায়ন অনুপমা আর মিস্টার সেনকে বুঝিয়ে বলে শ্রেয়ার ব্যাবহার দিনে দিনে সন্দেহ উদ্রেক করেছে, ভবিষ্যতে বোর্ডে ওদের হাতে বেশি মেম্বার থাকলে শ্রেয়া যদি কিছু উলটো পাল্টা করার চেষ্টা কিওরে তাহলে ওকে ছাড়িয়ে দিতে অসুবিধে হবে না। অনুপমা বুঝতে পারে যে পায়েলকে শুধু মাত্র দল ভারী করার জন্য বোর্ড মেম্বারে নেওয়া হচ্ছে। আগামী বোর্ড মিটিঙে এই নতুন সদস্যদের নামাঙ্কিত করা হবে আর বাকিদের জানানো হবে।
কিছুদিন পরেই ওদের তৃতীয় বোর্ড মিটিং ডাকা হয়। ততদিনে শ্রেয়া আর রূপক জার্মানি থেকে ফিরে আসে আর সেই ওষুধের কোম্পানির ডিল করে আসে। এইবারে ইন্দ্রনীল জার্মানি থেকে আসে। অনুপমাই দেবায়নের হয়ে কথা বলতে শুরু করে। প্রথমে ওদের আয় ব্যয় নিয়ে আলোচনা চলে। এয়ার বার্লিনের প্রোজেক্ট সাথে চুক্তি ছিল প্রফিট শেয়ারিং তাই প্রথম সপ্তাহ থেকেই টাকা আসতে শুরু করে। মাস দুয়েক পরে জারমেনিয়া এয়ারলাইন্সের প্রোজেক্ট ডিপ্লয় করলে একি রকম ভাবে আয় শুরু হয়ে যাবে। প্রথম বছর শেষ হওয়ার আগেই ওদের আয় বেশ কয়েক গুন বেড়ে যাবে তবে ব্রেক ইভেন পয়েন্টে পৌঁছতে অনেক দিন লাগবে। বোর্ড মিটিঙে নতুন দুইজনকে বোর্ডে নেওয়ার কথা বলে অনুপমা, একজন পায়েল আর দ্বিতীয় দীপঙ্কর’দা।
সুপর্ণা ম্যাডাম আর মনীষা আগে থেকেই বোর্ড মেম্বার ছিল এবারে পায়েল আর দীপঙ্কর’দা নিযুক্ত হওয়াতে ইন্দ্রনীল ছাড়া বাকি সবাই খুশি। ইন্দ্রনীলের হাবভাব দেখে মনে হল সে বোর্ড মেম্বার হলে ভালো হত। রূপক জানায় যে সুইজারল্যান্ডের সফটওয়ারের কাজ বেশ এগিয়ে গেছে, সেটাও মাস দুয়েকের মধ্যে ডিপ্লয় করা যেতে পারে। মনীষা জানায় যে গত তিন কোয়ার্টারে অনেক খরচের ফলে আগামী বছরে ওদের মাইনে বাড়ানোর ব্যাপারে একটু চাপ আছে কারন, গত তিন চার মাসে যে হারে লোকবল বেড়েছে সেই হারে আয় বাড়েনি। এখন ওদের আয় সবার মাইনে দিতে পারে না। মনীষার কথা শুনে শ্রেয়া আর রূপক একটু দমে যায়, মুখ শুকনো করে অনুপমার দিকে চেয়ে থাকে। অনুপমা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলে, যেহেতু এই বছরে তিনটে বড় প্রোজেক্ট এসেছে সুতরাং এই বছরে মাইনে ঠিক মতন না বাড়াতে পারলেও পুজোর সময়ে সবাইকে ভালো বোনাস দেওয়ার চেষ্টা করবে। দেবায়ন চুপচাপ সবার কথা শুনে যায়। অনুপমা ওর মতামতের কথা জিজ্ঞেস করলে বলে পরে জানিয়ে দেবে।
গ্রীষ্মের গরম কাটিয়ে বর্ষা ঋতু নেমে আসে জলের ধারা নিয়ে। সারা গ্রীষ্ম ওদের অফিস কাজেই গরম ছিল। বর্ষা নামতেই তৃষ্ণার্ত গাছ পালার মতন সবাই যেন গরম থেকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। এর মাঝে দেবায়ন আর অনুপমা, পুনের হোটেলের ট্রান্সফার কাগজ তৈরি করে মান্ডি গিয়ে মেহেকের স্বাক্ষর নিয়ে আসে। সেখানে শুভমের সাথে দেখা হয়, আর শুভম ওদের জানায় যে মেহেক কে নিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই ক্যালিফোর্নিয়া চলে যাবে। অনুপমা ওদের হাতে পাঁচ কোটি টাকার চেক তুলে দেয় আর ওদের শুভেচ্ছা জানায়। মিস্টার সেন আগেই পুনে পৌঁছে যান নতুন হোটেল ম্যানেজার নিযুক্ত করার জন্য। হোটেলের কাগজ পত্র নিয়ে দেবায়ন আর অনুপমা পুনে পৌঁছায়। মিস্টার সেন আলাদা করে একবার রজত বাবুর সাথে দেখা করে, অবশ্য সেই আলোচনায় দেবায়ন অথবা অনুপমা ছিল না তাই ওরা জানে না ওদের মাঝে কি কথা হয়। তবে রজত বাবুর সাথে কথা বলে আসার পরে মিস্টার সেনের চেহারা বদলে যায়, বেশ গম্ভির হয়ে দেবায়ন আর অনুপমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ তারপরে একপাশে ডেকে নিয়ে হেসে ফেলেন। তিনি বলেন কিছু কিছু জায়গায় চক্রান্ত করা ভালো কিন্তু একটু ভেবে চিন্তে চক্রান্ত করা উচিত। রজত বাবু পুনের বেশ বড় লোক, কিন্তু মিস্টার সেন কম যায় না। তিনি উলটে রজত বাবুকে শাসিয়ে এসেছেন যে যদি ভবিষ্যতে ওদের দিকে চোখ তুলে তাকায় তাহলে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে না। চার কাঁধে তুলে নিয়ে যেতে তাকে।
পুনের পরে ওরা সবাই উটি যায়। উটি হোটেলের বোর্ড মিটিংয়ে, মিস্টার পারিজাত হোটেলের নতুন মালিকের নাম ঘোষণা করে আর সেই সাথে মিস্টার সেনকে অভ্যর্থনা জানায়। কারতিকেয়নকে দেবায়ন আলাদা করে অনেক টাকা দেয় আর ভবিষ্যতে তাঁর জন্য জমি কিনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ব্যাঙ্গালোরে ওদের জন্য বেশ বড় একটা চমক অপেক্ষা করেছিল। দিলিপ বাবু কনিকাকে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর ফিরে এসেছেন, কিছুদিনের মধ্যেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে বন্ধিত হবেন। প্রেমজিতের সাথে দিলিপ বাবুর আন্তরিকতা বেশ বেড়ে গেছে, যেখানেই যায় প্রেমজিতকে সাথে নিয়ে যায়। কণিকা, ব্যাঙ্গালোরের একটা কলেজে চাকরি পেয়ে গেছে। দিলিপ বাবু ওদের জানান যে কথা মতন দ্বিতীয় হোটেলের পঁচাত্তর শতাংশের মালিকানা দেবায়ন আর অনুপমার নামে লিখে দিতে চান আর বর্তমান হোটেলের আগে যেমন পঁচিশ শতাংশ মিস্টার সেনের নামে ছিল সেটা তেমনি থাকবে। দেবায়ন আর মিস্টার সেন খুশি, কিন্তু তার চেয়ে বেশি খুশি হয় অনুপমা। দিলিপ বাবু মদ ছেড়ে দিয়েছেন, কণিকার কড়া তত্তাবধনে রোজ সকালে উঠে ব্যায়াম করা, হাঁটতে যাওয়া ইত্যাদি করার ফলে অনেক সুস্থ হয়ে উঠেছেন। দিন তিনেক ব্যাঙ্গালোরে ছিল আর সেই কয়দিনে দিলিপ বাবুর মুখে শুধু মাত্র অনুপমা আর দেবায়নের জয়গান। আসার আগে অনুপমা, দিলিপ বাবু আর কণিকাকে জানিয়ে দেয় যে কি করে ওদের খুঁজে পেয়েছিল। অনুপমার মুখে সব কথা শুনে দিলিপ বাবু অবাক হলেও হেসে ফেলেন। তিনি বলেন অনেক সময়ে কয়লা খুঁড়তে খুঁড়তে হীরের সন্ধান পাওয়া যায়, হয়ত তার জীবনের এই ঘটনা এমন এক উদাহরন।
কোলকাতায় বর্ষা শেষ হতে অনেক বেশি সময় নেয় এমন কি মাঝে মাঝে দুর্গা পুজোর সময়ে বৃষ্টি নেমে আসে। ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বর্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু বর্ষা যেন আর কোলকাতা ছাড়তে চায় না। বিগত ছয় মাসে দেবায়ন একবারের জন্য বাইরে যায়নি, দুই একদিনের কাজ ছাড়া আর সেই জন্য অনুপমা ভীষণ খুশি। পায়েলের সাথে গাড়িতে করে অফিসে আসত কিন্তু ফেরার সময়ে দেবায়নের বাইকে ফিরত। কোনদিন বৃষ্টিতে কাক ভিজে হয়ে গেলে দেবায়নের বাড়িতেই থেকে যেত অথবা দেবায়ন ওর বাড়িতে থেকে যেত। অফিস ফেরত, কোনদিন ফ্লুরিসে বসে গল্প করত, কোনদিন আহেলিতে গিয়ে বসত, কোনদিন পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে এগ রোল খেত। কাজের সাথে ভালোবাসার এক অদ্ভুত মেল বন্ধনে দুইজনেই ভেসে বেড়ায়।
সেদিন সকাল থেকেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছিল। কারুর কাজে তেমন মন ছিল না। লাঞ্চের পরে অনুপমা ব্যাঙ্কের একাউন্ট ডিটেলস দেখছিল, এক বছর ঘুরে আসার সময় এসে গেছে। ঠিক এক বছর আগে, এমন এক পুজোর আগেই ওদের কোম্পানি শুরু হয়েছিল। আজ এক বছর পরে বিগত এক বছরের আয় আর ব্যায় খুলে বসে। কুড়ি কোটি টাকা দিয়ে শুরু কোম্পানি, শুধু মাত্র পাঁচ কোটি টাকা ওর আর দেবায়নের জয়েন্ট একাউন্টে পরে রয়েছে। বাকি সব আয় কোম্পানি একাউন্টে, এই এক বছরে আয় শুধু মাত্র পাঁচ থেকে ছয় কোটি যার সবটাই মাইনে দিতে, ট্যাক্স দিতে, অফিসের ভাড়া দিতে ইত্যাদি বিল মেটাতে মেটাতে খরচ হয়ে গেছে। এদিকে দুই সপ্তাহ পরেই কোম্পানির বার্ষিক মিটিং। জার্মানি থেকে অনিমেশ আঙ্কেল এসেছেন আর ইন্দ্রনীল এসেছে। ইন্দ্রনীল আসাতে শ্রেয়ার চলন বলন বদলে গেছে। সেটা সবার চোখে না পড়লেও অনুপমা আর দেবায়নের চোখ এড়াতে পারেনি। মাঝে মাঝেই ইন্দ্রনীলকে শ্রেয়ার কেবিনে দেখা যায়, লাঞ্চের সময় টুকু ওদের সাথে লাঞ্চ করে কিন্তু বাকি সময়ে শ্রেয়া বেশ ছাড়া ছাড়া থাকে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওর চোখ পড়ে নিবেদিতার দেওয়া দুই কোটি টাকার ওপরে, হ্যাঁ এক সময়ে নিবেদিতা ওর একাউন্টে দুই কোটি টাকা দিয়েছিল। সেই সাথে মনে পরে যায় ছয় মাস আগে জলপাইগুড়িতে নিবেদিতার সাথে আচমকা দেখা হয়ে যাওয়া। দেবায়নকে সেই ঘটনা জানিয়েছিল কিন্তু তারপরে কাজের চাপে সেই কথা মাথা থেকে উবে গেছে। দেবায়ন কি নিবেদিতা আর ধৃতিমানের ব্যাপারে কিছু খোঁজ খবর নিয়েছে? একবার জিজ্ঞেস করলে হয় কি হল। এমন সময়ে দেবায়ন ওর কেবিনের দরজা খুলে ঢোকে।
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “তুই না একশো বছর বাঁচবি। আমি তোর কথা মনে করছিলাম এখুনি।”
দেবায়ন ওর কাছে এসে গাল টিপে আদর করে বলে, “তুই আমার সাথে থাকবি তো?”
অনুপমা চেয়ারে বসে ছিল তাই ওর কোমর জড়িয়ে পেটের ওপরে মুখ ঘষে বলে, “তুই থাকলে আমিও থাকব। এবারে বল কেন এসেছিলি?”
দেবায়ন মাথা চুলকে বলে, “যদি কিছু মনে না করিস তাহলে আমার সাথে একটু বের হবি।”
অনুপমা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে যে দেবায়নের ঠোঁটে মিচকি হাসি। কি চলছে আবার এই ছেলেটার মাথায়? দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “বৃষ্টি যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে। কোথায় যেতে হবে?”
দেবায়ন ওর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে বলে, “আমার ওপরে বিশ্বাস আছে তো? তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?”
অনুপমা ওর গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে, “বিষ দিলেও অমৃত ভেবে গিলে নেব। চল কোথায় নিয়ে যেতে চাস।”
এইরকম জল ভেজা আবহাওয়ায় গাড়িতে চড়তে ইচ্ছে করে না তাই ব্যাগ গুছিয়ে দেবায়নের বাইকে চেপে বেড়িয়ে গেল। যাবার আগে পায়েলকে বলে গেল যেন অফিস ছুটি হলেই বাড়ি ফেরে। আকাশে কালো মেঘের খেলা, দুপুরের পরে বৃষ্টি একটু ধরে এসেছে তাই বাতাস বেশ ঠাণ্ডা আর ভিজে। রাস্তায় এদিকে ওদিকে জল জমে, দুইপাশের গাছ গুলো যেন এই স্নান সেরে উঠেছে। সূর্যের দেখা নেই, বিকেলের দিকে আবার বৃষ্টি নামতে পারে। পেছনে বসে দুই হাতে আস্টেপিস্টে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীর মিশিয়ে দেয় ওর পিঠের ওপরে। নরম শরীর দেবায়নের উত্তাপ শুষে নিতে তৎপর হয়ে ওঠে। নরম বুকে পিঠের পেশির ছোঁয়ায় কেঁপে ওঠে অনুপমা, এই বৃষ্টির দিনে বড় দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু লোক মাঝে নিজেকে সামলে নেয়।
রাস্তায় যেতে যেতে অনুপমা দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, তোকে ধৃতিমানের ব্যাপারে একটু খোঁজ খবর নিতে বলেছিলাম সেটা কি নিয়েছিস?”
দেবায়ন মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ নিয়েছি। ব্যাটা অনেক ঘাঘু মাল। নিবেদিতা ম্যাডামের কোম্পানিতে মার্কেটিং হেড হিসাবে জয়েন করেছিল এই জানুয়ারিতে। নিবেদিতা ম্যাডামকে একা পেয়ে হাত মারতে চেষ্টা করেছিল, এক লেঙ্গি মেরে শালাকে চুপ করিয়ে দিয়েছি।”
অনুপমা ওর মামনির সাথে ধৃতিমানের হৃদ্যতা অনেক আগেই আঁচ করেছিল কিন্তু কোনদিন সেটা দেবায়নকে খুলে বলেনি কারন দেবশ্রীর বারন ছিল। এবারে আবার নিবেদিতার পেছনে পড়েছে? লোকটা তাঁর মানে বিশেষ সুবিধের নয়।
অনুপমা প্রশ্ন করে, “মানে?”
দেবায়ন, “যেদিন তুই আমাকে নিবেদিতা আর ধৃতিমানের ব্যাপারে জানালি সেইদিন থেকেই ধৃতিমানের ব্যাপারে আমি একটু খোঁজ খবর লাগিয়েছিলাম। ওর ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ধৃতিমান নিবেদিতা ম্যাডামকে গল্প বলেছিল যে তাঁর স্ত্রী, রেনুকা এক গাড়ি দুর্ঘটনায় অনেক বছর আগে গত হয়েছেন, আর সেই গাড়ি দুর্ঘটনার আসল কারন তাঁর পুরনো প্রেমিকা, কল্পনার স্বপ্ন। এই গল্প শুনে আমার মন বলল এর পেছনের আসল ঘটনা অন্য কিছু। খোঁজ নেওয়ার জন্য এখানে ধৃতিমানের বাড়িতে গেলাম, পরিচয় দিলাম ওর কোম্পানির কর্তা হিসাবে। ধৃতিমানের মেয়ে, মল্লিকার সাথে দেখা হল। মল্লিকা বেশ বড় হয়েছে ক্লাস ইলেভেন পড়ে এখন, আমাকে দেখেই চিনতে পারল আর তোর কথা জিজ্ঞেস করল। আমি ওর সাথে কথা বললাম বেশ কিছুক্ষণ তারপরে ধৃতিমানের শ্বশুর শাশুরির সাথে কথা বললাম। ওদের সাথে কথা বলে একটা বিষয়ে একটু সন্দেহ জাগল মনের মধ্যে। ধৃতিমানের শ্বশুর মশায় আমাকে বললেন যে তাঁর কন্যের সাথে তাঁর জামাইয়ের সুহৃদ সম্পর্ক ছিল না। ধৃতিমান আগে একজনকে ভালবাসত, সেটা ফলপ্রসু না হওয়ার পরে রেনুকার সাথে বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের পরে কয়েক মাস পর থেকে নাকি ওই কল্পনার সাথে আবার প্রেম ভালোবাসা শুরু হয়। তারপরে ধৃতিমানের মুম্বাইয়ের ঠিকানা চাইলাম ওদের কাছে, সেটা পেতে কোন অসুবিধে হল না। তোর মনে আছে গত মাসে দিন দুয়েকের জন্য মুম্বাই গেছিলাম আমি?”
অনুপমা মাথা নাড়ায়, “হ্যাঁ মনে আছে। তুই বলেছিলিস নিজের কোন কাজে যাচ্ছিস। তুই এই কাজে গেছিলিসি আমাকে বলিসনি কেন?”
দেবায়ন হেসে বলে, “মেয়েদের পেটে কি আর কথা থাকে, তাই আর তোকে বলিনি। তুই জানলে যদি মা কে বলে দিতিস তাই।”
অনুপমা ওর মাথায় চাটি মেরে বলে, “কুত্তা, বাকি পাঁচ জনের মতন আমি নই যে পেটের কথা রাষ্ট্র করে বেড়াব। জলপাইগুড়ির কথা মামনির কাছে বেমালুম চেপে গেছি আমি। মামনি কিছুই জানে এই সব বিষয়ে, উলটে আমার ভয় ছিল তোকে বললে তুই কি করে বসিস। তা মুম্বাই গিয়ে কি খবর নিয়ে এলি?”
দেবায়ন বলে, “মুম্বাই গিয়ে ধৃতিমানের মায়ের সাথে কথা বলে বিশেষ কিছু জানতে পারলাম না। তবে এইটুকু বললেন যে রেনুকা আর ধৃতিমানের সম্পর্ক বিশেষ ভালো ছিল না। তখন আমার মনের মধ্যে সন্দেহ জাগল, এই দুর্ঘটনা হয়ত ইচ্ছাকৃত ভাবে করা হয়েছে।”
অনুপমা আঁতকে ওঠে, “মানে?”
দেবায়ন বলে, “মানে ধৃতিমানের শ্বশুরের কথা আর ধৃতিমানের মায়ের কাছে সব কিছু শোনার পরে আমার কেমন যেন সন্দেহ হল। কোলকাতা ফিরে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়লাম। একদিন ধৃতিমানকে ডাকলাম আমাদের কন্সট্রাকশান অফিসে। আমাকে দেখে ভুত দেখার মতন চমকে উঠল। আমি ওকে চেপে ধরলাম সেই সাথে বললাম যে আমি বেহালা গিয়েছিলাম, মুম্বাই গিয়েছিলাম ইত্যাদি। আমি চেপে ধরে বললাম যে ওই কল্পনাকে খুঁজে পেতেও আমার কোন অসুবিধে হবে না। সুতরাং আসল কথা বলে ফেলা ভালো। ধৃতিমানের গলা শুকিয়ে কাঠ, আমি ওকে বললাম সত্যি কথা না বললে, আমি ওর মেয়েকে এখানে ডাকব আর তাঁর স্ত্রীর সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল সেটা খুলে জানিয়ে দেব। ধৃতিমান অবশেষে ভেঙ্গে পড়ল, জানালো যে গাড়ি দুর্ঘটনা হয়েছিল সেটা সত্যি কিন্তু তিনি ড্রাইভার সিটে বসে ছিল যতক্ষণ না রেনুকার রক্তাক্ত দেহ প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে প্রানহীন না হয়ে গেল। ঠিক সময়ে লোকজন ডাকলে রেনুকা বেঁচে যেত কিন্তু ইচ্ছাকৃত ভাবেই ধৃতিমান রেনুকাকে ওই খানে মড়ার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল।”
সব শুনে অনুপমার শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটতে শুরু করে দেয়, চাপা হুঙ্কারে দেবায়নের কানের কাছে বলে, “শুয়োরের বাচ্চাটা কোথায়?”
দেবায়ন বলে, “চিন্তা নেই, ওই সাপের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছি। নিবেদিতার সাথে কিছু করবে না।”
অনুপমা বলে, “কোথায় আছে? নিবেদিতার কোম্পানিতেই আছে নাকি এখন?”
দেবায়ন বলে, “নিবেদিতা ম্যাডামের কাছে আমি সবকিছু খুলে বলেছিলাম, নিবেদিতা ম্যাডাম একটু খানি ভেঙ্গে পড়েছিল কিন্তু সামলে নিয়েছে। কাজ ভালো করে লোকটা, এই কয় মাসে প্রচুর দুই নম্বরি করে টাকা কামিয়ে দিয়েছে আমাদের দুই কোম্পানিকে। তাই ওকে নিবেদিতা ম্যাডামের কোম্পানিতে থেকে ছাড়িয়ে সোজা আমাদের কোম্পানিতে নিযুক্ত করেছি। কাকুর সামনে আওয়াজ উঠানোর শক্তি আর সাহস নেই। আর আমার হাতে মোক্ষম অস্ত্র রয়েছে বেশি বেগড়বাঁই করলে সবার সামনে উলঙ্গ করে পেটাবো।”
অনুপমা ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুই না একটা সত্যি……”
দেবায়ন বলে, “আমি কি?”
অনুপমা ঠোঁট কুঁচকে ওর ঘাড়ের কাছে আলতো চুমু খেয়ে বলে, “একটা দুষ্টু মিষ্টি পুচ্চু সোনা।”
কিছুক্ষণ পরে দেবায়ন একটা বাজারে বাইক থামিয়ে অনুপমাকে একটা বড় ফুলের তোড়া আর বেশ কিছু চকোলেট কিনতে বলে। অনুপমা প্রশ্ন করলে শুধু মাত্র হেসে জানায় যেখানে যাচ্ছে সেখানে এই উপহার গুলো লাগবে। অনুপমা চিন্তায় পরে যায়, কার বাড়িতে কার সাথে দেখা করার জন্য ওকে নিয়ে যাচ্ছে। বারেবারে প্রশ্ন করেও সঠিক উত্তর না পেয়ে কিঞ্চিত অভিমান করে বসে থাকে।