03-10-2020, 07:14 PM
পঞ্চবিংশ পর্ব (#13)
অনুপমা বলে, “চলুন একটু আপনার রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।”
রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই সবাই একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হোটেলের দুই মালিক একসাথে রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। দেবায়ন আর অনুপমা টেবিলের একপাশে বসে আর দিলিপ বাবু ওদের সামনে বসে। দিলিপ বাবু খাবারের কথা জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা জানায় যে ওরা খেতে আসেনি, আসলে দিলিপ বাবুর রুমের সিগারেটের ধোঁয়াতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তাই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। অনুপমার কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে দিলিপ বাবু। হাসতে হাসতে ওর পেট ফেটে যাবার জোগাড়, টেবিল চাপড়ে বলে, এই কথা ওকে কেউ আজ পর্যন্ত বলেনি। সবাই চোখ বুজে নাক বুজে ওর রুমের সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ সহ্য করে নেয়।
দিলিপ বাবু বলে, “সত্যি বলতে বিগত পনেরো বছরে হাসতে ভুলে গেছি আমি।” তারপরে ওদের অবাক করে বলে, “আমি সব জানি মিস্টার বসাক। মিস অনুপমা সেন আপনার বাগদত্তা আমি জানি।”
দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। এমন সময়ে দিলিপ বাবুর ফোনে কারুর ফোন আসে। দিলিপ বাবু ফোন ধরে বলেন, “না জেসমিন আজকে নয়। আজকে রাতে আমি একটু ব্যাস্ত থাকব। আরে না না…… অন্য কেউ নয়…… তোমার সাথে পরে কথা বলব…… আরে না না…… রাজিব কে বলে দেব তোমার টাকা দিয়ে দেবে……”
ওর কথাবার্তা শুনে বুঝে গেল যে রাতে জেসমিন নামে একটা মেয়ের আসার কথা ছিল ওর বাড়িতে। কিন্তু কি কারনে তাকে কাটিয়ে দিল সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ওরা।
দিলিপ বাবু ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ রাতে কি করছ তোমরা?”
দেবায়ন বলে, “কিছুই নয়। অনুপমাকে নিয়ে একটু শহর দেখব তারপরে কালকে বাড়ি ফিরব।”
দিলিপ বাবু দেবায়নের হাত ধরে বলে, “সত্যি বলতে অনেকদিন পরে আজকে একটু মন কেমন লাগছে। প্লিস আজ রাতে আমার বাড়িতে এসো, একসাথে ডিনার করব।”
অনুপমা হেসে বলে, “ঠিক আছে রাতে আপনার বাড়িতে আসবো।”
আরও বেশ কিছুক্ষণ দিলিপ বাবুর সঙ্গে বসে ওরা হোটেলে ফিরে যায়। হোটেলে ফিরে দেবায়ন কিঞ্চিত সংশয় ব্যাক্ত করে অনুপমার কাছে, কিন্তু অনুপমা ওকে আশ্বস্ত করে বলে যে দিলিপ বাবু রাতে তাঁর মনের কথা খুলে বলবে আর সেই সময়ে অনুপমা ওকে মুসৌরি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে। দেখা যাক মুসৌরি বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে দিলিপ বাবু কি উত্তর দেন।
রাতে ওদের নিতে গাড়ি পৌঁছে যায়। গাড়ি করে দিলিপ বাবুর বাড়িতে পৌঁছায়। বেশ বড়সড় একতলা বাড়ি, দুটো সবসময়ের চাকর, ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ থাকে না বাড়িতে। বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দিলিপ বাবু। সকালের সেই লোলুপ চোখের চাহনি আর তাঁর চেহারায় নেই। ওদের দেখে আময়িক হেসে অভ্যর্থনা জানায়। বাড়ির চাকর এসে ওদের সামনে খাদ্য পানীয় রেখে চলে যায়। অনুপমা আর দেবায়ন এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে। বিশাল বড়লোক, তাই অনেক রকমের জিনিস পত্রে শোকেস ঠাসা। বাড়ির পরিচালনা চাকরদের হাতেই বলা চলে।
দেবায়ন দিলিপ বাবুকে প্রশ্ন করে, “আপনি একাই থাকেন এত বড় বাড়িতে?”
দিলিপ বাবু বলেন, “হ্যাঁ, একাই থাকি।”
দেবায়ন বলে, “আপনার বাবা মা ভাই বোন?”
দিলিপ বাবু বলেন, “বাবা মা অনেকদিন আগেই স্বর্গে চলে গেছেন আর ভাই হায়দ্রাবাদে থাকে।”
অনুপমা বলে, “আপনার একা থাকতে ভালো লাগে? মানে মাঝ মাঝে কি মনে হয় না যে সাথে কেউ থাকলে বড় ভালো হত?”
দিলিপ বাবু কাষ্ঠ হেসে বলেন, “হ্যাঁ মন চায় আর সেটা মাঝে মাঝে পুষিয়ে যায়।”
কথাটার তাৎপর্য দুইজনেই বুঝতে পারে।
কিছুপরে দিলিপবাবু ওদের মদের কথা জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন জানায় যে হুইস্কি তে ওর কোন অসুবিধা নেই, অনুপমা মদ খাওয়ার কথা মানা করে দেয়। দিলিপ বাবু চাকরকে ডেকে হুইস্কি আনতে বলে।
অনুপমা একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলেন না।”
দিলিপ বাবু পালটে প্রশ্ন করেন, “কি কথা?”
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “আপনি কেন বিয়ে করেন নি।”
দিলিপ বাবু বললেন, “কি হবে জেনে আমার কথা। এই তোমাদের দেখে বড় ভাল লাগছে এই শান্তি।”
অনুপমা আব্দার করে চেপে ধরে, “বলুন না প্লিস, কেন বিয়ে করলেন না। কেউ কি আপনাকে আঘাত দিয়েছে যে সেই আঘাত থেকে আর উঠতে পারলেন না আর……”
গুমরে ওঠেন দিলিপ বাবু, “না…… কেউ আমাকে আঘাত করেনি। না ও আমাকে আঘাত করতেই পারে না।”
দেবায়ন দিলিপ বাবুর হাতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “নাম কি তাঁর?”
দিলিপ বাবু মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ছলছল চোখে দেবায়ন আর অনুপমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন আমার অতীত জানতে চাইছ তোমরা?”
অনুপমা ওর হাতের উষ্ণ পরশ ছুঁইয়ে বলে, “আপনার ওই চোখের পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। আপনি এত মদ খান কাউকে ভুলে থাকার জন্য। কেন নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছেন? একবার কাউকে মনের কথা খুলে বলুন দেখবেন মন অনেক হাল্কা হয়ে যাবে।”
এক ঢোকে হাতের গ্লাস শেষ করে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে দিলিপ বাবু। হাত কাঁপতে শুরু করে দেয়, চোখের কোল একটু ছলকে ওঠে। দেবায়ন ওর হাতের চাপ বাড়িয়ে দিলিপ বাবুর মনে বল যোগায়।
দিলিপ বাবু বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে পকেট থেকে পার্স বের করে একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি অনুপমার হাতে দেয়। ছবিটা দেখিয়ে বলেন, “কণিকা আমার প্রথম আর অন্তিম ভালোবাসা……”
কিছুক্ষণ চুপ থাকেন, কণ্ঠ স্বর কেঁপে ওঠে, “কণিকার সাথে দেখা হয়েছিল কলেজে পড়ার সময়ে। বড় মিষ্টি মেয়ে, ওর চোখ দুটো আমাকে বড় টানত। কিন্তু ওরা নিচু জাতের ছিল মানে সিডুল কাস্ট আর আমরা ', আর বিশাল বড়োলোক। কণিকার বাবা সামান্য সরকারি কেরানি আর আমার বাবা বিশাল ব্যাবসাদার। এই টাকা পয়সা প্রতিপত্তি আমাদের প্রেমের মাঝে চলে আসে। আমি বাবার সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। আমার বাবা কণিকার বাড়িতে গিয়ে ওর বাবাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে আর তারপরে কনিকারা এই শহর ছেড়ে চলে যায়। তারপরে আমি প্রতিজ্ঞা করি যে আমি কোনদিন বিয়ে করব না। বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি কণিকাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম। খুঁজে খুঁজে হায়দ্রাবাদ পৌঁছে জানতে পারলাম যে কণিকার বিয়ে হয়ে গেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম যে সময় মতন নিজের প্রেমকে বাঁচাতে পারিনি বলে। তাই আর বিয়ে করা হল না, এই বুকে আর কাউকে রাখতে নারাজ, মিস সেন। তাই নিজেকে সবসময়ে মদে ডুবিয়ে রাখি।”
অনুপমা দিলিপ বাবুর হাত ধরে বলে, “আপনি আমাদের সাথে ঘুরতে যাবেন?”
অনুপমার কথা শুনে চমকে ওঠে দিলিপ বাবু, একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে তাকায়, “কি বলছ তুমি? কোথায় বেড়াতে যাবো?”
দেবায়ন বলে, “মুসৌরি বেড়াতে যাবেন আমাদের সাথে?”
দিলিপ বাবু প্রশ্ন করে, “এত জায়গা থাকতে হটাত মুসৌরি কেন?”
দেবায়ন হেসে জবাব দেয়, “খুব সুন্দর পাহাড়ে ঘেরা জায়গা তাই। এই দুই বছর আগে আমরা মুসৌরি বেড়াতে গিয়েছিলাম।”
দিলিপ বাবুর মনে সন্দেহ হয় তাও হেসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা ঠিক কি চাও বলো তো? তোমাদের ঠিক সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। মুসৌরি নিয়ে গিয়ে কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?”
অনুপমা মিষ্টি হেসে জবাব দেয়, “একবার আমাদের বিশ্বাস করে দেখুন।”
দিলিপ বাবু প্রশ্ন করেন, “ঠিক আছে, কবে যেতে হবে মুসৌরি?”
দেবায়ন উত্তরে বলে, “কালকেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি।”
ঠিক হয় যে আগামী কাল দিল্লী হয়ে মুসৌরির পৌঁছাবে। দিলিপ বাবু সঙ্গে সঙ্গে ওদের টুর অপারেটর কে বলে প্লেনের টিকিট, দিল্লী থেকে মুসৌরি যাবার জন্য গাড়ি, হোটেল বুকিং ইত্যাদি সেরে ফেলেন। সবকিছু হয়ে যাবার পরে রাতে হোটেলে ফিরে দেবায়ন সংশয় ব্যাক্ত করে। অনুপমা বলে মুসৌরি গিয়ে যা হবার দেখা যাবে, দেবায়নের সংশয় অবান্তর নয় সেটা ভালো ভাবেই জানে। কস্তূরী ওদের কণিকার কলেজের ফোন নাম্বার বাড়ির ঠিকানা ইতাদ্যি দিয়েছিল।
পরেরদিন ভোরের প্লেন ধরে দিল্লী পৌঁছে যান তিনজনে। দিল্লী থেকে গাড়ি করে মুসউরি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের রাত হয়ে যায়। সারা রাস্তা দিলিপ বাবু বেশ চিন্তিত থাকেন আর বারেবারে দেবায়নকে প্রশ্ন করে হঠাৎ এই ঘুরতে আসার জন্য। দেবায়ন ওকে জানায় যে পরের দিন ওরা মুসৌরি ঘুরে বেড়াবে তারপরের দিন ওরা ধনোল্টি বেড়াতে যাবে। বেড়াবার প্লান শুনেও আশ্বস্ত হতে পারেন না দিলিপ বাবু।
পাহাড় বরাবর অনুপমাকে টেনেছে, দেশে বিদেশের নানা পাহাড়ি জায়গায় বাবা মায়ের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে কিন্তু এই বারের ঘুরতে আসা ঠিক অন্যবারের মতন নয়। এই বারে ওরা এসেছে দুই পুরানো প্রেমিক প্রেমিকাকে মেলানর জন্য যদিও তাঁর পেছনে ওদের অভসন্ধি অন্য কিছু পাওয়ার। দেবায়ন একটু বিরক্ত হয় এতকিছু করার পরেও যদি হোটেলের মালিকানা স্বত্তা হাতে না আসে তাহলে কি হবে, কিন্তু অনুপমার হাসিমুখ দেখে চুপ করে যায়। অনুপমার মাথায় ওই হোটেল, ব্যাবসা টাকা পয়সা নেই, ওর একটাই লক্ষ্য কণিকা আর দিলিপ বাবুর মিলন।
সকালে উঠেই অনুপমা আগে কণিকার কলেজে ফোন করে জেনে নেয় ওদের ছুটি কখন হয়। সেই মতন সারাদিন মুসৌরি ঘুরে বিকেলের দিকে গাড়ি নিয়ে ঠিক কলেজের সামনে পৌঁছে যায়। দিলিপ বাবু অবাক হয়ে ওদের প্রশ্ন করে যে ওরা কেন ওকে কলেজে এনেছে। কলেজের ছুটি হতেই অনুপমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। চোখ বন্ধ করে একবার কণিকার ছবি মনে এঁকে নিতে চেষ্টা করে। দিলিপ বাবুর কাছে দেখা ছবির সাথে কস্তূরী দেওয়া ছবির মুখের আদলে মিল থাকলেও কণিকা অনেক বদলে গেছে। দেবায়ন বারেবারে ঘড়ির দিকে তাকায় আর কলেজের গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুপরে কণিকা কলেজের গেট থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবায়ন দিলিপ বাবুর কাঁধে হাত রেখে কলেজের গেটের দিকে তাকাতে বলে। কলেজের গেটের দিকে তাকাতেই দিলিপ বাবু থমকে যান, কাকে দেখছে, নিজেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। ঋজু কঠিন স্বভাবের মানুষটা শেষ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। অবাক হয়ে দেবায়নের দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে।
ওই দিকে অনুপমা কণিকার দিকে এগিয়ে যায়। অনুপমা কণিকার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি নিশ্চয় মিস কণিকা?”
অনুপমাকে দেখে কণিকা চিনতে পারে না। কণিকা মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অনুপমার দিকে। অনুপমা ওকে আঙুল দিয়ে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা দিলিপ বাবু আর দেবায়নের দিকে দেখায়। পনেরো বছর পরে দিলিপ বাবুকে দেখে কণিকা থমকে যায়। হটাত মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছে, মাথা ধরে টলে পড়ে। কিন্তু তাঁর আগেই দিলিপ বাবু দৌড়ে এসে কনিকাকে ধরে ফেলে। কণিকা জল ভরা চোখ মেলে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে দিলিপ বাবুর মুখের দিকে। সময় যেন ওদের চারপাশে দাঁড়িয়ে যায়। কণিকা নিথর হয়ে দিলিপ বাবুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
অনেকক্ষণ না অল্পক্ষণ, কণিকা ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দিলিপ বাবুকে প্রশ্ন করে, “তুমি আমাকে খুঁজে পেলে কি করে?”
দিলিপ বাবুর কণ্ঠ স্বর জড়িয়ে আসে, “কেমন আছো তুমি, কণিকা?”
নিজের নাম শুনে, কণিকা চোখ বন্ধ করে নেয়। অনুপমার ওর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারে যে এতদিন পরে দিলিপ বাবুর কণ্ঠ স্বর শুনে নিজেকে সামলাতে পারছেন না।
কণিকা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “ভালো আছি।”
এতদিন পরে পুরানো প্রেমিকাকে দেখে দিলিপ বাবু কি বলবেন কিছু ভেবে পান না। কিছু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কণিকা, অনুপমাদের পরিচয় জানতে চায়। দিলিপ বাবু ওদের পরিচয় দেন, কিন্তু কি ভাবে অনুপমা ওদের খুঁজে পেয়েছে সেটা দিলিপ বাবুর জানা নেই। অনুপমা আর দেবায়ন, ওদের অদুরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দিলিপ বাবু আর কণিকা নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলে তারপরে কণিকা ওদের সবাইকে বাড়িতে আসতে নিমন্ত্রন জানায়। কণিকার পুত্র প্রেমজিতের কলেজের ছুটি আগেই হয়ে গেছিল, তাই ওরা পৌঁছানোর আগেই সে বাড়িতে ছিল। বাড়ি পৌঁছে কণিকা, বাকিদের সাথে প্রেমজিতের পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রেমজিত, মুসৌরির এক কলেজে পরে, এখানেই বড় হয়েছে।
কণিকার বাড়ি একটা বাগানে ঘেরা এক তলা বাড়ি, দুটো ঘর একটা বসার ঘর, ছোটো হলেও খুব সুন্দর। সামনে বাগান, পেছনে সবুজে ঢাকা পাহাড় দেখে অনুপমা দেবায়নকে নিজের মনের ইচ্ছে ব্যাক্ত করে জানায় যে ভবিষ্যতে এমন একটা বাড়ি চাই ওর। সেই শুনে দেবায়ন একটু হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে ডালহৌসি অথবা সোলাং উপত্যকায় যেখানে ওদের রিসোরট আছে সেখানে ইচ্ছে হলেই থেকে আসতে পারে।
রাতের খাওয়ার পরে দিলিপ বাবু জানান যে কনিকাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। কণিকা জানিয়ে দেন যে এই বয়সে দ্বিতীয় বার বিয়ে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় আর ছেলেও অনেক বড় হয়ে গেছে। বিগত দিনের কথা জিজ্ঞেস করাতে জানা যায় যে, দিলিপ বাবুর পিতা কণিকার বাবাকে অপমান করে আর তারপরে তারা সবাই ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে অন্য এক শহরে চলে যায়। সেখানে কলেজের পড়াশুনা শেষ করে কণিকা আর তারপরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর স্বামী সেই সময়ে দেরাদুনে ন্যাশানাল ডিফেন্স একাডেমিতে চাকরি করতেন। বিয়ের ছয় বছর পরেই এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। তারপরে কণিকা আর ব্যাঙ্গালোর ফিরে যায় নি, মুসৌরিতে একটা মিশনারি কলেজে চাকরি নিয়ে এখানেই থেকে গেছে।
অনুপমা আর দেবায়ন কনিকাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করে যে এক ধাক্কায় কোনদিন কারুর জীবন শেষ হয়ে যায় না। কণিকা বলেন যে তাঁর ছেলে এখন ক্লাস ফোরে পড়ে, সে যদি প্রশ্ন করে এই নতুন ভদ্রলোক কে, তাহলে কি জবাব দেবে কণিকা? এতদিন পড়ে হঠাৎ করে এসে হাত চাইলেই হয় না। ছেলের ইচ্ছে তাঁর চাহিদা সেটাই বর্তমানে কণিকার কাছে সব থেকে প্রধান তাই কণিকা মুসৌরি ছেড়ে যেতে নারাজ।
অনুপমা আর দেবায়ন, দিলিপ বাবুকে বুঝিয়ে বলে যে তাকে আরও বেশ কিছুদিন কণিকার সাথে মুসোউরিতে থেকে যেতে আর প্রেমজিতের সাথে মেলামেশা করতে। দিলিপ বাবুও কণিকার মনের অবস্থা অনুধাবন করেন। দুই দিনে ছোটো প্রেমজিতের চোখে অনেক প্রশ্ন, কে এই ভদ্রলোক, একে আগে কোনদিন দেখেনি, কেন ওর মায়ের সাথে এত হৃদ্যতা ইত্যাদি। ওর চোখের চাহনি দেখে দিলিপ বাবু থেকে যেতে রাজি হয়ে যান আর সেই সাথে কণিকার মন গলে যায়। কনিকাও চাইছিল যাতে দিলিপ বাবু কয়েক দিন ওদের সাথে থাকুক, প্রেমজিতের সাথে মেলামেশা করলে পরস্পরকে জানতে বুঝতে সুবিধে হবে। সময় মতন কণিকা পুত্রকে বুঝিয়ে উঠতে পারবেন তাঁর মনের ইচ্ছে।
এই দুই দিনে অনুপমা আর দেবায়ন হোটেলেই ছিল কিন্তু দিলিপ বাবু প্রথম দিন হোটেলে থাকার পরে কণিকার বাড়িতে থেকে গিয়েছিল। দেবায়ন যে কাজে এসেছিল সেটা আর তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব হল না, তাই সেই বিষয়ে একটু চিন্তিত কিন্তু অনুপমা একপ্রকার খুশি। পনেরো বছর পড়ে দিলিপ বাবু তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে সেটা দেখেই অনুপমা খুশি।
ফিরে আসার আগের দিন রাতে কণিকার বাড়িতে রাতের খাবার সময়ে সবাই একসাথে বসে।
কণিকা অনুপমাকে প্রশ্ন করে, “তোমরা এত খবর কোথা থেকে পেলে সত্যি বলো তো?”
অনুপমা কথা ঘুরিয়ে, কনিকাকে শেষ অনুরোধ করে, “আপনি দিলিপ বাবুর সাথে ফিরে চলুন ব্যাঙ্গালোর।”
কণিকা একবার একটু দুরে বসা প্রেমজিতের দিকে দেখে আর একবার দিলিপ বাবুর মুখের দিকে তাকায়। শেষ পর্যন্ত হেসে বলেন, “দিলিপ যখন এত কষ্ট করে আমাকে খুঁজে বের করেছে তাহলে না ফিরে আর স্বস্তি নেই। তবে আমার কিছু সময়ের দরকার, মানে প্রেমজিতকে বুঝিয়ে রাজি করান। বর্তমানে ওকে বড় করা ওকে মানুষ করা আমার প্রধান উদ্দেশ্য।”
দিলিপ বাবু কণিকার হাতের ওপরে হাত রেখে আশ্বস্ত করার কণ্ঠে বলেন, “এবারে আর কোন উদ্দেশ্য তোমার একার হতে পারে না কণিকা। একবার যখন রাজি হয়েছ, তাহলে আমরা দুইজনে মিলে মিশে প্রেমজিতকে বড় করব। আমি জানি আমাদের দুইজনের পক্ষেই একটু বেশি কষ্টকর, তাই আমি কিছুদিনের জন্য এখানে থেকে যাবো তোমাদের সাথে। প্রেমজিতের সাথে মেলামেশা না করলে ও আমাকে কি ভাবে আপন করে নেবে?”
স্বস্তির শ্বাস নেয় অনুপমা। খাওয়া শেষে দিলিপ বাবু দেবায়নের হাত চেপে ধরে বলেন, “তোমাদের এই উপকার কি ভাবে পূরণ করব আমি ভেবে পাচ্ছি না।”
অনুপমা চোখ টিপে ইশারা করে দেবায়নকে। অনুপমার সেই চোরা ইশারা দিলিপ বাবু দেখে ফেলে হেসে দেন। দিলিপ বাবু বলেন, “তোমরা সত্যি অনেক দুষ্টু, অনেক শয়তান। প্রথম যেদিন এসেছিলে সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম যে তোমরা এমনি এমনি আসোনি। কিন্তু তারপরে এই কয়দিনে যা ঘটিয়ে দিলে আমার জীবনে, আমার সব অঙ্ক ভুল হয়ে গেল। আমি জানি তোমরা কি চাও। চিন্তা নেই মিস্টার বসাক, তুমি আমাকে যা দিয়েছ তার বদলে আমার সব কিছু তোমার পায়ে লুটিয়ে দিলেও এই ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। আমি ব্যাঙ্গালোর ফিরি, তারপরে তোমাদের একদিন ডাকবো।”
অনুপমার মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি তুমি দীর্ঘজীবী হও, মানুষের মন জয় করো। টাকা পয়সা রোজগারের শত কোটি পন্থা আছে, কিন্তু মানুষের মন জয় করার একটাই পন্থা, সেটা ভালোবাসা। কোনদিন কোন রকমের কোন সমস্যায় পড়লে আমাকে একবার খবর দিও। আমি তোমাদের পাশে এসে দাঁড়াবো, আমার এই প্রান তোমাদের কাছে ঋণী।”
এরপরে অনুপমা আর দেবায়ন কোলকাতা ফিরে আসে পালা, তিলোত্তমা কোলকাতার বুকে।
অনুপমা বলে, “চলুন একটু আপনার রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসি।”
রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই সবাই একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হোটেলের দুই মালিক একসাথে রেস্টুরেন্টে ঢুকেছে। দেবায়ন আর অনুপমা টেবিলের একপাশে বসে আর দিলিপ বাবু ওদের সামনে বসে। দিলিপ বাবু খাবারের কথা জিজ্ঞেস করাতে অনুপমা জানায় যে ওরা খেতে আসেনি, আসলে দিলিপ বাবুর রুমের সিগারেটের ধোঁয়াতে ওর খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তাই রেস্টুরেন্টে নিয়ে এসেছে। অনুপমার কথা শুনে হাসিতে ফেটে পড়ে দিলিপ বাবু। হাসতে হাসতে ওর পেট ফেটে যাবার জোগাড়, টেবিল চাপড়ে বলে, এই কথা ওকে কেউ আজ পর্যন্ত বলেনি। সবাই চোখ বুজে নাক বুজে ওর রুমের সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ সহ্য করে নেয়।
দিলিপ বাবু বলে, “সত্যি বলতে বিগত পনেরো বছরে হাসতে ভুলে গেছি আমি।” তারপরে ওদের অবাক করে বলে, “আমি সব জানি মিস্টার বসাক। মিস অনুপমা সেন আপনার বাগদত্তা আমি জানি।”
দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। এমন সময়ে দিলিপ বাবুর ফোনে কারুর ফোন আসে। দিলিপ বাবু ফোন ধরে বলেন, “না জেসমিন আজকে নয়। আজকে রাতে আমি একটু ব্যাস্ত থাকব। আরে না না…… অন্য কেউ নয়…… তোমার সাথে পরে কথা বলব…… আরে না না…… রাজিব কে বলে দেব তোমার টাকা দিয়ে দেবে……”
ওর কথাবার্তা শুনে বুঝে গেল যে রাতে জেসমিন নামে একটা মেয়ের আসার কথা ছিল ওর বাড়িতে। কিন্তু কি কারনে তাকে কাটিয়ে দিল সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না ওরা।
দিলিপ বাবু ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ রাতে কি করছ তোমরা?”
দেবায়ন বলে, “কিছুই নয়। অনুপমাকে নিয়ে একটু শহর দেখব তারপরে কালকে বাড়ি ফিরব।”
দিলিপ বাবু দেবায়নের হাত ধরে বলে, “সত্যি বলতে অনেকদিন পরে আজকে একটু মন কেমন লাগছে। প্লিস আজ রাতে আমার বাড়িতে এসো, একসাথে ডিনার করব।”
অনুপমা হেসে বলে, “ঠিক আছে রাতে আপনার বাড়িতে আসবো।”
আরও বেশ কিছুক্ষণ দিলিপ বাবুর সঙ্গে বসে ওরা হোটেলে ফিরে যায়। হোটেলে ফিরে দেবায়ন কিঞ্চিত সংশয় ব্যাক্ত করে অনুপমার কাছে, কিন্তু অনুপমা ওকে আশ্বস্ত করে বলে যে দিলিপ বাবু রাতে তাঁর মনের কথা খুলে বলবে আর সেই সময়ে অনুপমা ওকে মুসৌরি ঘুরতে যাওয়ার কথা বলবে। দেখা যাক মুসৌরি বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনে দিলিপ বাবু কি উত্তর দেন।
রাতে ওদের নিতে গাড়ি পৌঁছে যায়। গাড়ি করে দিলিপ বাবুর বাড়িতে পৌঁছায়। বেশ বড়সড় একতলা বাড়ি, দুটো সবসময়ের চাকর, ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ থাকে না বাড়িতে। বসার ঘরে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দিলিপ বাবু। সকালের সেই লোলুপ চোখের চাহনি আর তাঁর চেহারায় নেই। ওদের দেখে আময়িক হেসে অভ্যর্থনা জানায়। বাড়ির চাকর এসে ওদের সামনে খাদ্য পানীয় রেখে চলে যায়। অনুপমা আর দেবায়ন এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে। বিশাল বড়লোক, তাই অনেক রকমের জিনিস পত্রে শোকেস ঠাসা। বাড়ির পরিচালনা চাকরদের হাতেই বলা চলে।
দেবায়ন দিলিপ বাবুকে প্রশ্ন করে, “আপনি একাই থাকেন এত বড় বাড়িতে?”
দিলিপ বাবু বলেন, “হ্যাঁ, একাই থাকি।”
দেবায়ন বলে, “আপনার বাবা মা ভাই বোন?”
দিলিপ বাবু বলেন, “বাবা মা অনেকদিন আগেই স্বর্গে চলে গেছেন আর ভাই হায়দ্রাবাদে থাকে।”
অনুপমা বলে, “আপনার একা থাকতে ভালো লাগে? মানে মাঝ মাঝে কি মনে হয় না যে সাথে কেউ থাকলে বড় ভালো হত?”
দিলিপ বাবু কাষ্ঠ হেসে বলেন, “হ্যাঁ মন চায় আর সেটা মাঝে মাঝে পুষিয়ে যায়।”
কথাটার তাৎপর্য দুইজনেই বুঝতে পারে।
কিছুপরে দিলিপবাবু ওদের মদের কথা জিজ্ঞেস করাতে দেবায়ন জানায় যে হুইস্কি তে ওর কোন অসুবিধা নেই, অনুপমা মদ খাওয়ার কথা মানা করে দেয়। দিলিপ বাবু চাকরকে ডেকে হুইস্কি আনতে বলে।
অনুপমা একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কিন্তু আমার কথার উত্তর দিলেন না।”
দিলিপ বাবু পালটে প্রশ্ন করেন, “কি কথা?”
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “আপনি কেন বিয়ে করেন নি।”
দিলিপ বাবু বললেন, “কি হবে জেনে আমার কথা। এই তোমাদের দেখে বড় ভাল লাগছে এই শান্তি।”
অনুপমা আব্দার করে চেপে ধরে, “বলুন না প্লিস, কেন বিয়ে করলেন না। কেউ কি আপনাকে আঘাত দিয়েছে যে সেই আঘাত থেকে আর উঠতে পারলেন না আর……”
গুমরে ওঠেন দিলিপ বাবু, “না…… কেউ আমাকে আঘাত করেনি। না ও আমাকে আঘাত করতেই পারে না।”
দেবায়ন দিলিপ বাবুর হাতে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “নাম কি তাঁর?”
দিলিপ বাবু মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে ছলছল চোখে দেবায়ন আর অনুপমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন আমার অতীত জানতে চাইছ তোমরা?”
অনুপমা ওর হাতের উষ্ণ পরশ ছুঁইয়ে বলে, “আপনার ওই চোখের পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে আছে। আপনি এত মদ খান কাউকে ভুলে থাকার জন্য। কেন নিজেকে এত কষ্ট দিচ্ছেন? একবার কাউকে মনের কথা খুলে বলুন দেখবেন মন অনেক হাল্কা হয়ে যাবে।”
এক ঢোকে হাতের গ্লাস শেষ করে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে দিলিপ বাবু। হাত কাঁপতে শুরু করে দেয়, চোখের কোল একটু ছলকে ওঠে। দেবায়ন ওর হাতের চাপ বাড়িয়ে দিলিপ বাবুর মনে বল যোগায়।
দিলিপ বাবু বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে পকেট থেকে পার্স বের করে একটা সুন্দরী মেয়ের ছবি অনুপমার হাতে দেয়। ছবিটা দেখিয়ে বলেন, “কণিকা আমার প্রথম আর অন্তিম ভালোবাসা……”
কিছুক্ষণ চুপ থাকেন, কণ্ঠ স্বর কেঁপে ওঠে, “কণিকার সাথে দেখা হয়েছিল কলেজে পড়ার সময়ে। বড় মিষ্টি মেয়ে, ওর চোখ দুটো আমাকে বড় টানত। কিন্তু ওরা নিচু জাতের ছিল মানে সিডুল কাস্ট আর আমরা ', আর বিশাল বড়োলোক। কণিকার বাবা সামান্য সরকারি কেরানি আর আমার বাবা বিশাল ব্যাবসাদার। এই টাকা পয়সা প্রতিপত্তি আমাদের প্রেমের মাঝে চলে আসে। আমি বাবার সামনে দাঁড়াতে পারলাম না। আমার বাবা কণিকার বাড়িতে গিয়ে ওর বাবাকে যাচ্ছেতাই বলে অপমান করে আর তারপরে কনিকারা এই শহর ছেড়ে চলে যায়। তারপরে আমি প্রতিজ্ঞা করি যে আমি কোনদিন বিয়ে করব না। বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি কণিকাকে খুঁজতে বের হয়েছিলাম। খুঁজে খুঁজে হায়দ্রাবাদ পৌঁছে জানতে পারলাম যে কণিকার বিয়ে হয়ে গেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম যে সময় মতন নিজের প্রেমকে বাঁচাতে পারিনি বলে। তাই আর বিয়ে করা হল না, এই বুকে আর কাউকে রাখতে নারাজ, মিস সেন। তাই নিজেকে সবসময়ে মদে ডুবিয়ে রাখি।”
অনুপমা দিলিপ বাবুর হাত ধরে বলে, “আপনি আমাদের সাথে ঘুরতে যাবেন?”
অনুপমার কথা শুনে চমকে ওঠে দিলিপ বাবু, একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে তাকায়, “কি বলছ তুমি? কোথায় বেড়াতে যাবো?”
দেবায়ন বলে, “মুসৌরি বেড়াতে যাবেন আমাদের সাথে?”
দিলিপ বাবু প্রশ্ন করে, “এত জায়গা থাকতে হটাত মুসৌরি কেন?”
দেবায়ন হেসে জবাব দেয়, “খুব সুন্দর পাহাড়ে ঘেরা জায়গা তাই। এই দুই বছর আগে আমরা মুসৌরি বেড়াতে গিয়েছিলাম।”
দিলিপ বাবুর মনে সন্দেহ হয় তাও হেসে জিজ্ঞেস করেন, “তোমরা ঠিক কি চাও বলো তো? তোমাদের ঠিক সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না। মুসৌরি নিয়ে গিয়ে কি আমাকে মেরে ফেলতে চাও?”
অনুপমা মিষ্টি হেসে জবাব দেয়, “একবার আমাদের বিশ্বাস করে দেখুন।”
দিলিপ বাবু প্রশ্ন করেন, “ঠিক আছে, কবে যেতে হবে মুসৌরি?”
দেবায়ন উত্তরে বলে, “কালকেই আমরা বেড়িয়ে পড়ি।”
ঠিক হয় যে আগামী কাল দিল্লী হয়ে মুসৌরির পৌঁছাবে। দিলিপ বাবু সঙ্গে সঙ্গে ওদের টুর অপারেটর কে বলে প্লেনের টিকিট, দিল্লী থেকে মুসৌরি যাবার জন্য গাড়ি, হোটেল বুকিং ইত্যাদি সেরে ফেলেন। সবকিছু হয়ে যাবার পরে রাতে হোটেলে ফিরে দেবায়ন সংশয় ব্যাক্ত করে। অনুপমা বলে মুসৌরি গিয়ে যা হবার দেখা যাবে, দেবায়নের সংশয় অবান্তর নয় সেটা ভালো ভাবেই জানে। কস্তূরী ওদের কণিকার কলেজের ফোন নাম্বার বাড়ির ঠিকানা ইতাদ্যি দিয়েছিল।
পরেরদিন ভোরের প্লেন ধরে দিল্লী পৌঁছে যান তিনজনে। দিল্লী থেকে গাড়ি করে মুসউরি পৌঁছাতে পৌঁছাতে ওদের রাত হয়ে যায়। সারা রাস্তা দিলিপ বাবু বেশ চিন্তিত থাকেন আর বারেবারে দেবায়নকে প্রশ্ন করে হঠাৎ এই ঘুরতে আসার জন্য। দেবায়ন ওকে জানায় যে পরের দিন ওরা মুসৌরি ঘুরে বেড়াবে তারপরের দিন ওরা ধনোল্টি বেড়াতে যাবে। বেড়াবার প্লান শুনেও আশ্বস্ত হতে পারেন না দিলিপ বাবু।
পাহাড় বরাবর অনুপমাকে টেনেছে, দেশে বিদেশের নানা পাহাড়ি জায়গায় বাবা মায়ের সাথে ঘুরে বেড়িয়েছে কিন্তু এই বারের ঘুরতে আসা ঠিক অন্যবারের মতন নয়। এই বারে ওরা এসেছে দুই পুরানো প্রেমিক প্রেমিকাকে মেলানর জন্য যদিও তাঁর পেছনে ওদের অভসন্ধি অন্য কিছু পাওয়ার। দেবায়ন একটু বিরক্ত হয় এতকিছু করার পরেও যদি হোটেলের মালিকানা স্বত্তা হাতে না আসে তাহলে কি হবে, কিন্তু অনুপমার হাসিমুখ দেখে চুপ করে যায়। অনুপমার মাথায় ওই হোটেল, ব্যাবসা টাকা পয়সা নেই, ওর একটাই লক্ষ্য কণিকা আর দিলিপ বাবুর মিলন।
সকালে উঠেই অনুপমা আগে কণিকার কলেজে ফোন করে জেনে নেয় ওদের ছুটি কখন হয়। সেই মতন সারাদিন মুসৌরি ঘুরে বিকেলের দিকে গাড়ি নিয়ে ঠিক কলেজের সামনে পৌঁছে যায়। দিলিপ বাবু অবাক হয়ে ওদের প্রশ্ন করে যে ওরা কেন ওকে কলেজে এনেছে। কলেজের ছুটি হতেই অনুপমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। চোখ বন্ধ করে একবার কণিকার ছবি মনে এঁকে নিতে চেষ্টা করে। দিলিপ বাবুর কাছে দেখা ছবির সাথে কস্তূরী দেওয়া ছবির মুখের আদলে মিল থাকলেও কণিকা অনেক বদলে গেছে। দেবায়ন বারেবারে ঘড়ির দিকে তাকায় আর কলেজের গেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কিছুপরে কণিকা কলেজের গেট থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবায়ন দিলিপ বাবুর কাঁধে হাত রেখে কলেজের গেটের দিকে তাকাতে বলে। কলেজের গেটের দিকে তাকাতেই দিলিপ বাবু থমকে যান, কাকে দেখছে, নিজেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। ঋজু কঠিন স্বভাবের মানুষটা শেষ পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। অবাক হয়ে দেবায়নের দিকে নিস্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে।
ওই দিকে অনুপমা কণিকার দিকে এগিয়ে যায়। অনুপমা কণিকার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আপনি নিশ্চয় মিস কণিকা?”
অনুপমাকে দেখে কণিকা চিনতে পারে না। কণিকা মাথা নাড়িয়ে “হ্যাঁ” বলে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে অনুপমার দিকে। অনুপমা ওকে আঙুল দিয়ে দুরে দাঁড়িয়ে থাকা দিলিপ বাবু আর দেবায়নের দিকে দেখায়। পনেরো বছর পরে দিলিপ বাবুকে দেখে কণিকা থমকে যায়। হটাত মনে হয় যেন স্বপ্ন দেখছে, মাথা ধরে টলে পড়ে। কিন্তু তাঁর আগেই দিলিপ বাবু দৌড়ে এসে কনিকাকে ধরে ফেলে। কণিকা জল ভরা চোখ মেলে নিস্পলক তাকিয়ে থাকে দিলিপ বাবুর মুখের দিকে। সময় যেন ওদের চারপাশে দাঁড়িয়ে যায়। কণিকা নিথর হয়ে দিলিপ বাবুর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
অনেকক্ষণ না অল্পক্ষণ, কণিকা ধীরে ধীরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দিলিপ বাবুকে প্রশ্ন করে, “তুমি আমাকে খুঁজে পেলে কি করে?”
দিলিপ বাবুর কণ্ঠ স্বর জড়িয়ে আসে, “কেমন আছো তুমি, কণিকা?”
নিজের নাম শুনে, কণিকা চোখ বন্ধ করে নেয়। অনুপমার ওর মুখের দিকে চেয়ে বুঝতে পারে যে এতদিন পরে দিলিপ বাবুর কণ্ঠ স্বর শুনে নিজেকে সামলাতে পারছেন না।
কণিকা ধরা গলায় উত্তর দেয়, “ভালো আছি।”
এতদিন পরে পুরানো প্রেমিকাকে দেখে দিলিপ বাবু কি বলবেন কিছু ভেবে পান না। কিছু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে কণিকা, অনুপমাদের পরিচয় জানতে চায়। দিলিপ বাবু ওদের পরিচয় দেন, কিন্তু কি ভাবে অনুপমা ওদের খুঁজে পেয়েছে সেটা দিলিপ বাবুর জানা নেই। অনুপমা আর দেবায়ন, ওদের অদুরে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছুক্ষণ দিলিপ বাবু আর কণিকা নিজেদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা বলে তারপরে কণিকা ওদের সবাইকে বাড়িতে আসতে নিমন্ত্রন জানায়। কণিকার পুত্র প্রেমজিতের কলেজের ছুটি আগেই হয়ে গেছিল, তাই ওরা পৌঁছানোর আগেই সে বাড়িতে ছিল। বাড়ি পৌঁছে কণিকা, বাকিদের সাথে প্রেমজিতের পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রেমজিত, মুসৌরির এক কলেজে পরে, এখানেই বড় হয়েছে।
কণিকার বাড়ি একটা বাগানে ঘেরা এক তলা বাড়ি, দুটো ঘর একটা বসার ঘর, ছোটো হলেও খুব সুন্দর। সামনে বাগান, পেছনে সবুজে ঢাকা পাহাড় দেখে অনুপমা দেবায়নকে নিজের মনের ইচ্ছে ব্যাক্ত করে জানায় যে ভবিষ্যতে এমন একটা বাড়ি চাই ওর। সেই শুনে দেবায়ন একটু হেসে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় যে ডালহৌসি অথবা সোলাং উপত্যকায় যেখানে ওদের রিসোরট আছে সেখানে ইচ্ছে হলেই থেকে আসতে পারে।
রাতের খাওয়ার পরে দিলিপ বাবু জানান যে কনিকাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে। কণিকা জানিয়ে দেন যে এই বয়সে দ্বিতীয় বার বিয়ে করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় আর ছেলেও অনেক বড় হয়ে গেছে। বিগত দিনের কথা জিজ্ঞেস করাতে জানা যায় যে, দিলিপ বাবুর পিতা কণিকার বাবাকে অপমান করে আর তারপরে তারা সবাই ব্যাঙ্গালোর ছেড়ে অন্য এক শহরে চলে যায়। সেখানে কলেজের পড়াশুনা শেষ করে কণিকা আর তারপরেই তার বিয়ে হয়ে যায়। তাঁর স্বামী সেই সময়ে দেরাদুনে ন্যাশানাল ডিফেন্স একাডেমিতে চাকরি করতেন। বিয়ের ছয় বছর পরেই এক গাড়ি দুর্ঘটনায় তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয়। তারপরে কণিকা আর ব্যাঙ্গালোর ফিরে যায় নি, মুসৌরিতে একটা মিশনারি কলেজে চাকরি নিয়ে এখানেই থেকে গেছে।
অনুপমা আর দেবায়ন কনিকাকে অনেক বুঝাতে চেষ্টা করে যে এক ধাক্কায় কোনদিন কারুর জীবন শেষ হয়ে যায় না। কণিকা বলেন যে তাঁর ছেলে এখন ক্লাস ফোরে পড়ে, সে যদি প্রশ্ন করে এই নতুন ভদ্রলোক কে, তাহলে কি জবাব দেবে কণিকা? এতদিন পড়ে হঠাৎ করে এসে হাত চাইলেই হয় না। ছেলের ইচ্ছে তাঁর চাহিদা সেটাই বর্তমানে কণিকার কাছে সব থেকে প্রধান তাই কণিকা মুসৌরি ছেড়ে যেতে নারাজ।
অনুপমা আর দেবায়ন, দিলিপ বাবুকে বুঝিয়ে বলে যে তাকে আরও বেশ কিছুদিন কণিকার সাথে মুসোউরিতে থেকে যেতে আর প্রেমজিতের সাথে মেলামেশা করতে। দিলিপ বাবুও কণিকার মনের অবস্থা অনুধাবন করেন। দুই দিনে ছোটো প্রেমজিতের চোখে অনেক প্রশ্ন, কে এই ভদ্রলোক, একে আগে কোনদিন দেখেনি, কেন ওর মায়ের সাথে এত হৃদ্যতা ইত্যাদি। ওর চোখের চাহনি দেখে দিলিপ বাবু থেকে যেতে রাজি হয়ে যান আর সেই সাথে কণিকার মন গলে যায়। কনিকাও চাইছিল যাতে দিলিপ বাবু কয়েক দিন ওদের সাথে থাকুক, প্রেমজিতের সাথে মেলামেশা করলে পরস্পরকে জানতে বুঝতে সুবিধে হবে। সময় মতন কণিকা পুত্রকে বুঝিয়ে উঠতে পারবেন তাঁর মনের ইচ্ছে।
এই দুই দিনে অনুপমা আর দেবায়ন হোটেলেই ছিল কিন্তু দিলিপ বাবু প্রথম দিন হোটেলে থাকার পরে কণিকার বাড়িতে থেকে গিয়েছিল। দেবায়ন যে কাজে এসেছিল সেটা আর তাঁর পক্ষে বলা সম্ভব হল না, তাই সেই বিষয়ে একটু চিন্তিত কিন্তু অনুপমা একপ্রকার খুশি। পনেরো বছর পড়ে দিলিপ বাবু তাঁর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছে সেটা দেখেই অনুপমা খুশি।
ফিরে আসার আগের দিন রাতে কণিকার বাড়িতে রাতের খাবার সময়ে সবাই একসাথে বসে।
কণিকা অনুপমাকে প্রশ্ন করে, “তোমরা এত খবর কোথা থেকে পেলে সত্যি বলো তো?”
অনুপমা কথা ঘুরিয়ে, কনিকাকে শেষ অনুরোধ করে, “আপনি দিলিপ বাবুর সাথে ফিরে চলুন ব্যাঙ্গালোর।”
কণিকা একবার একটু দুরে বসা প্রেমজিতের দিকে দেখে আর একবার দিলিপ বাবুর মুখের দিকে তাকায়। শেষ পর্যন্ত হেসে বলেন, “দিলিপ যখন এত কষ্ট করে আমাকে খুঁজে বের করেছে তাহলে না ফিরে আর স্বস্তি নেই। তবে আমার কিছু সময়ের দরকার, মানে প্রেমজিতকে বুঝিয়ে রাজি করান। বর্তমানে ওকে বড় করা ওকে মানুষ করা আমার প্রধান উদ্দেশ্য।”
দিলিপ বাবু কণিকার হাতের ওপরে হাত রেখে আশ্বস্ত করার কণ্ঠে বলেন, “এবারে আর কোন উদ্দেশ্য তোমার একার হতে পারে না কণিকা। একবার যখন রাজি হয়েছ, তাহলে আমরা দুইজনে মিলে মিশে প্রেমজিতকে বড় করব। আমি জানি আমাদের দুইজনের পক্ষেই একটু বেশি কষ্টকর, তাই আমি কিছুদিনের জন্য এখানে থেকে যাবো তোমাদের সাথে। প্রেমজিতের সাথে মেলামেশা না করলে ও আমাকে কি ভাবে আপন করে নেবে?”
স্বস্তির শ্বাস নেয় অনুপমা। খাওয়া শেষে দিলিপ বাবু দেবায়নের হাত চেপে ধরে বলেন, “তোমাদের এই উপকার কি ভাবে পূরণ করব আমি ভেবে পাচ্ছি না।”
অনুপমা চোখ টিপে ইশারা করে দেবায়নকে। অনুপমার সেই চোরা ইশারা দিলিপ বাবু দেখে ফেলে হেসে দেন। দিলিপ বাবু বলেন, “তোমরা সত্যি অনেক দুষ্টু, অনেক শয়তান। প্রথম যেদিন এসেছিলে সেদিন বুঝে গিয়েছিলাম যে তোমরা এমনি এমনি আসোনি। কিন্তু তারপরে এই কয়দিনে যা ঘটিয়ে দিলে আমার জীবনে, আমার সব অঙ্ক ভুল হয়ে গেল। আমি জানি তোমরা কি চাও। চিন্তা নেই মিস্টার বসাক, তুমি আমাকে যা দিয়েছ তার বদলে আমার সব কিছু তোমার পায়ে লুটিয়ে দিলেও এই ঋণ আমি শোধ করতে পারবো না। আমি ব্যাঙ্গালোর ফিরি, তারপরে তোমাদের একদিন ডাকবো।”
অনুপমার মাথায় হাত রেখে বলে, “আমি তোমাকে আশীর্বাদ করি তুমি দীর্ঘজীবী হও, মানুষের মন জয় করো। টাকা পয়সা রোজগারের শত কোটি পন্থা আছে, কিন্তু মানুষের মন জয় করার একটাই পন্থা, সেটা ভালোবাসা। কোনদিন কোন রকমের কোন সমস্যায় পড়লে আমাকে একবার খবর দিও। আমি তোমাদের পাশে এসে দাঁড়াবো, আমার এই প্রান তোমাদের কাছে ঋণী।”
এরপরে অনুপমা আর দেবায়ন কোলকাতা ফিরে আসে পালা, তিলোত্তমা কোলকাতার বুকে।