03-10-2020, 07:12 PM
পঞ্চবিংশ পর্ব (#12)
রাতে উটি পৌঁছে মিস্টার সেনকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে পুনের হোটেল এক প্রকার সম্পূর্ণ ওদের হাতে চলে এসেছে। মিস্টার সেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন কি ভাবে দেবায়ন এই দুঃসাধ্য কাজ সম্ভব করতে পেরেছে। অনুপমা ওর কাছ থেকে ফোন নিয়ে ওর বাবাকে জানায় যে কোলকাতা ফিরে সবিস্তারে সব কিছু জানিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে দু’বার মিস্টার পারিজাতের ফোন চলে আসে ওদের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। পারিজাত ব্যাবসাদার মানুষ হলেও মনের দিক থেকে দিলিপ বাবু আর মিস্টার রজতের মতন অতটা কুটিল মস্তিষ্কের ব্যাক্তি নয়।
পরের দিন দুপুরের পরেই দেবায়ন আর অনুপমা, পারিজাত বাবুর হোটেলে পৌঁছে যায়। মিস্টার সেন এই হোটেলের পঁচিশ শতাংশের মালিক তাই মাঝে মাঝে মিস্টার সেন এসে ঘুরে যান, তদারকি করে যান। এর আগেও মিস্টার সেনের সাথে একবার এখানে এসেছিল দেবায়ন, তবে অনুপমার জন্য উটি ভ্রমন প্রথম বার।
মিস্টার পারিজাত, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মাথায় কাঁচা পাকা চুল, চোখে চশমা, চেহারায় এক আময়িক হাসি হাসি ভাব। পারিজাত বাবু অনুপমাকে দেখে বেশ খুশি হন। পারিজাত বাবু অনুপমার সাথে বাড়ির গল্পে মেতে ওঠে, ছেলে মেয়ের গল্পে মেতে ওঠে। পারিজাত বাবুর হাসি হাসি চেহারা দেখে অনুপমা একটু গলে যায়। দেবায়নকে একপাশে টেনে বলে যে এর সাথে চটুল পদ্ধতি না করে সোজা কোন উপায়ে হোটেলের কথা বলতে।
দেবায়ন হেসে বলে, “দ্যাখ পুচ্চি, পুনেতে রজতের সাথে যেটা আমরা করেছি সেটা তুই কুটিল চাল বলতে পারিস। কিন্তু এখানে আমি যা করছি সেটা ব্যাবসার মারপ্যাঁচ। দয়া করে এখানে মাথা ঘামাস না, প্লিস সোনা এই ডিল আমাকে করতে দে।”
ড্রিঙ্কসের গ্লাস হাতে তুলে পারিজাত বাবু দেবায়নকে প্রশ্ন করে, “এইতো কিছু দিন আগেই মিস্টার সেন এলেন। এর মধ্যেই আবার তুমি ঘুরতে এলে?”
দেবায়ন হেসে পারিজাতকে বলে, “এই এমনি এলাম। গত কোয়ার্টারে বেশ ভালো আয় হয়েছে আর এখন গরমের ছুটির মরশুম। তাই বর্তমান কোয়ার্টারে আয় কেমন হচ্ছে সেটা একবার দেখতে এলাম।”
পারিজাত বাবু মৃদু হেসে কথা ঘুরিয়ে বলে, “হ্যাঁ উটি ভালো জায়গা। মিস সেনের মনে হয় এই প্রথম উটি আসা।”
অনুপমা মাথা নাড়িয়ে বলে “হ্যাঁ।”
পারিজাত বাবু ওকে বলে, “তাহলে ভালো কথা। আজ রাতের ডিনার আমার বাড়িতে, তারপরে কাল উটি ঘুরে বেড়াও দুইজনে।”
দেবায়ন অত সহজে ভোলার মানুষ নয় তাই পাল্টা হেসে বলে, “আমন্ত্রন নিশ্চয় রক্ষা করব মিস্টার পারিজাত। কিন্তু একবার এই কোয়াটারের ব্যালেন্স সিটটা আর মান্থলি রিপোর্টটা দেখতে পেলে বড় ভালো হয়।”
পারিজাত বাবু একটু ফাঁপড়ে পরে যায় তাও পাক্কা ব্যাবসাদারের মতন উত্তর দেয়, “মিস্টার বসাক, যেমন মানুষের আসা যাওয়া লেগেই থাকে সেই মতন টাকার আসা যাওয়া লেগে থাকে। এখনো তো কোয়ার্টার শেষ হয়নি, শেষ হলেই আমি মিস্টার সেনকে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব।”
দেবায়ন পারিজাত বাবুর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, “তাহলে এবারে আসল কথায় আসি মিস্টার পারিজাত।”
দেবায়নের গম্ভির কণ্ঠস্বর শুনে পারিজাত বাবু একটু নড়েচড়ে বসে। দেবায়ন ওকে বলে, “দেখুন মিস্টার পারিজাত। সেন আঙ্কেল কেন এসেছিলেন সেটা আমাদের অজানা নয়। আমি আজকে সেই কথা নিয়েই এসেছি।”
দেবায়নের মুখে হোটেলের কথা শুনে পারিজাত বাবুর মুখের আদল বদলে যায়। আময়িক চেহারা একটু ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। চশমা নামিয়ে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে দেবায়নকে বলে, “মিস সেন আছেন তাই তোমাকে অনুরোধ করছি যে এই সব ব্যাবসার কথা আমরা পরে আলোচনা করবো। এখন উটি ঘুরে দেখো।”
অনুপমা একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার পারিজাত বাবুর দিকে তাকায়। পারিজাত বাবু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “আরে মিস সেন, তুমি দেখি এখনো এই কাবাব টা খেলেই না। খেয়ে দেখো, খাশ লাখনউয়ের গেলাটি কাবাব।”
অনুপমা পারিজাত বাবুর কথায় একটু হেসে একটা কাবাব তুলে নেয়।
দেবায়নের মৃদু হেসে পারিজাত বাবুকে বলে, “মিস্টার পারিজাত, মিস সেন শুধু মাত্র সেন কাকুর মেয়ে নয়। ও আমার হবু সহধর্মিণী, সুতরাং ওর সামনে এই বিষয়ে আলোচনা করলে কিছু হবে না।”
পারিজাত বাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “তাহলে কি চাও মিস্টার বসাক? আমি আমার কথা আগেই মিস্টার সেনকে জানিয়ে দিয়েছি। এখন আমি হোটেল বিক্রি করতে রাজি নই।”
দেবায়ন জবাব দেয়, “মিস্টার পারিজাত, গত কোয়ার্টারে নেট প্রফিট হয়েছে পাঁচ কোটি আর এই কোয়ার্টারে এখন পর্যন্ত আয় হয়েছে এক কোটি। ঠিক কি না?”
পারিজাত বাবু ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে, “তুমি এত খবর জানলে কি করে?”
দেবায়ন জবাব দেয়, “পঁচিশ শতাংশের মালিকানা আমাদের কাছে। একাউন্টস যখন তখন চাইলেই আশা করি দেখতে পারি সেই অধিকার আমাদের আছে।”
পারিজাত বাবু চুপ করে থাকেন। দেবায়ন বলে চলে, “এই এক কোটি থেকে মাইনে দিয়ে, খাবারের বিল, ইলেকট্রিক বিল, ট্যাক্স ইত্যাদি মিটিয়ে এবারে কত হাতে থাকবে? দশ লাখের মতন হয়তো হাতে থাকবে আর নব্বুই লাখ বেড়িয়ে যাবে। তাহলে এই কোয়ার্টারে আমি পাচ্ছি মাত্র আড়াই লাখ টাকা। এত কমে কেন সন্তুষ্ট হবো একবার বলেন?”
এই কথা শুনে পারিজাত বাবুর চাহনি কঠিন হয়ে যায়, “ব্যাবসায় ওঠা নামা হতেই পারে মিস্টার বসাক।”
দেবায়ন দমবার পাত্র নয়, “হ্যাঁ ব্যাবসা মানেই ওঠা নামা। আজকে আমি রাজা কালকে আমি ফকির। কিন্তু ঢোকার সময়ে দেখলাম যে এই ছুটির মরশুমে হোটেল অনেক খালি। কি কারন জানতে পারি কি?”
পারিজাত বাবু বড় এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, “কি চাও খুলে বল।”
দেবায়ন বলে, “শুধু মাত্র আপনার ত্রিশ শতাংশ কিনতে চাই। আমাদের অফার ত্রিশ কোটি টাকা।”
পারিজাত বাবু, “মিস্টার সেন কে আমি আগেই বলেছি যে এই হোটেল আমি এখন বিক্রি করব না।”
দেবায়ন তির্যক হেসে বলে, “বেশ ভালো কথা মিস্টার পারিজাত। আজ আমি চলে যাচ্ছি। এই কোয়ার্টারের মিটিঙে সেন কাকুকে পাঠিয়ে দেব কিন্তু তার পরের মিটিংয়ে আমি নিজে আসব। আর তখন সবার সামনে আপনার হোটেলের ভ্যালু আর হোটেলের আয় ব্যায় নিয়ে আলোচনা করব। সেই মিটিঙে আপনার ফাইন্যান্স ম্যানেজার, এইচ আর ম্যানেজার, রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সবাই থাকবে। ভেবে দেখুন ওদের সামনে যখন আমি এই নিয়ে কথা বলব তখন আপনি কি বলবেন। ওরা সবাই চুপ থাকবে, কারন ওরা মাইনে পায় মিস্টার পারিজাত। ওদের মাইনে প্রতি বছর বাড়ে কিন্তু আমাদের টাকা কোন বছর বারে কোন বছরে কমে আসে। কিন্তু তাই বলে এক কোটি থেকে এক ধাক্কায় আড়াই লাখ? ধাক্কাটা খুব বেশি হয়ে গেল না মিস্টার পারিজাত? একবার ওদের একটু কম মাইনে দিয়ে দেখুন, দেখবেন ওরা কেমন আপনার দিকে তেড়ে আসে।”
অপমান আর বদনামের ভয়ে পারিজাত বাবু গুমরে ওঠেন, “সবার সামনে অপমান? ঠিক সহ্য করতে পারছি না মিস্টার বসাক। মিস্টার সেনের সাথে এতদিনের পরিচয়, আর তুমি তাঁর মান এইরকম ভাবে রাখলে?”
দেবায়ন বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বলে, “মিস্টার পারিজাত, আপনি আমার থেকে অনেক বড়, আমি আপনাকে অপমান করতে চাই না। তাই শুধু অনুরোধ করছি যে হোটেলের মালিকানা বিক্রি করে দিন। আমি রীতিমত টাকা দিয়ে কিনতে চাই, দাম কম দিচ্ছি না। ভালোই টাকা দিচ্ছি।”
পারিজাত বাবু বলে, “ত্রিশ কোটি টাকা? জানো এই হোটেলের বর্তমান দর কত?”
দেবায়ন বলে, “হ্যাঁ জানি। এই হোটেলের বর্তমান ভ্যালু দেড়শো কোটি টাকা, কিন্তু যে হোটেল চলে না তার দাম কত হতে পারে মিস্টার পারিজাত? এই কোয়ার্টারে এই অবস্থা, এর পরে বর্ষা কাল, কোন টুরিস্ট এখানে আসবে না, তখন দাম আরও পড়ে যাবে।”
পারিজাত বাবু কোণঠাসা হয়ে যায়, “মিস্টার বসাক, পঞ্চাশ কোটির নিচে কি করে ডিল করি?”
দেবায়ন বলে, “ত্রিশ কোটি ঠিক দাম দিচ্ছি মিস্টার পারিজাত।”
দেবায়নের কথাবার্তা শুনে পারিজাত বাবু ভাবনায় পড়ে যায়। বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলেন, “তোমাকে ত্রিশ শতাংশ দিয়ে দিলে আমার কাছে কি থাকবে? শুধু মাত্র পনেরো শতাংশ? জানোই তো যে বাকি কুড়ি শতাংশ আমার শালীর নামে লেখা।”
দেবায়ন হেসে ফেলে, “ওকে বুঝিয়ে ওঠার দায়িত্ব আপনার।”
পারিজাত বাবু বলে, “আচ্ছা একটা কথা বল। মানছি যে আমার হোটেলের আয় হঠাৎ কমে গেছে, কিন্তু তোমার হাতে পড়লে তুমি কি ভাবে হোটেলের আয় বাড়িয়ে দেবে?”
দেবায়ন হেসে জবাব দেয়, “মিস্টার পারিজাত, এই গতকাল আমি পুনেতে একটা ফোর স্টার প্রপার্টি কিনেছি, দেড়শো কোটি টাকার ডিল করে এসেছি। সেন কাকুর মুখে নিশ্চয় শুনেছেন যে আমাদের আরও তিনটে হোটেল আছে। সব মিলিয়ে একটা চেইন হোটেল দাঁড় করাতে চাই। নিজেদের কন্সট্রাকশান কোম্পানি আছে, কোন হোটেলের কন্সট্রাকশান করতে হলে নিজেদের কোম্পানি দিয়েই করাব।”
অনুপমার দিকে দেখিয়ে বলে, “আমার মিসেস নতুন একটা সফটওয়্যার কোম্পানি খুলেছে। এই হোটেল চেইনগুলো আমরা এক সাথে বেঁধে দিতে চাই। তাতে লাভ আছে, কোন হোটেল বেশি আয় করল, কোনটা কম। টাকা ঘুরাতে পারবো এই খান থেকে ওইখানে।”
নিরুপায় পারিজাত বাবু শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলেন, “মিস্টার বসাক তুমি একদম তৈরি হয়েই এসেছ দেখছি।”
দেবায়ন হাত বাড়িয়ে দেয় পারিজাত বাবুর দিকে, “হ্যাঁ এক প্রকার। তাহলে কি রাতের ডিনার আপনার বাড়িতে না কোন রেস্টুরেন্টে করতে হবে?”
পারিজাত বাবু অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “না না মিস সেন প্রথম বার এসেছে, ডিনার আমার বাড়িতেই হবে। কি খেতে চাও বলো।”
অনুপমা হেসে বলে, “আপনি যা খাওয়াতে চাইবেন। আমরা অতিথি।”
পারিজাত বাবু বলে, “বেশ ঠিক আছে। একদম খাস দক্ষিণ ভারতের রাজার খাবার খাওয়াব।”
তারপরে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা একটা কথা বল। নিজের এত বড় হোটেল থাকতে বাইরের হোটেলে কেন থাকতে গেলে? এটা কি ঠিক করলে?”
দেবায়ন হেসে ফেলে, “তখন জানতাম না যে ডিনার আপনার বাড়িতে হবে তাই……” বলেই পারিজাত বাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
পারিজাত বাবু দেবায়ন সাথে হাত মেলায়। দেবায়ন ওর হাতে হোটেলের ফাইল তুলে দেয়। পারিজাত বাবু ফাইল খুলে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে যায়, “এখানে তো লেখা পঁয়ত্রিশ কোটি, তাহলে তুমি ত্রিশ কেন বলছিলে?”
দেবায়ন হেসে ফেলে, “ব্যাবসাদারের মন, দরদাম না করলে কি আর মন ভরে মিস্টার পারিজাত। আপনাকে ঠকিয়ে কি লাভ আছে আমার বলুন। রিতিমত বাজার দর দিয়েই হোটেল কিনব।”
পারিজাত বাবু, অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমার মিস্টার ভবিষ্যতে অনেক ওপরে উঠবে। তার কারন একটাই, ও হৃদয় দিয়ে ব্যাবসা করে, বাকি আমরা মাথা দিয়ে ব্যাবসা করি তাই সামনের লোককে ঠকাতে চেষ্টা করি।”
দেবায়ন বলে, “কেন মিছে লজ্জা দিচ্ছেন মিস্টার পারিজাত। আপনার কাছ থেকে আর সেন কাকুর কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে।”
পারিজাত বাবু হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “হ্যাঁ সেটা বুঝতেই পারছি আর তাই এবারে মিস্টার সেন নিজে না এসে তোমাকে পাঠিয়েছে। যাই হোক, ওই হোটেল থেকে চেক আউট করে নাও এখুনি। সোজা আমার বাড়িতে চল। আমি কিন্তু কোন কথা শুনতে চাই না মিস্টার বসাক।”
অনুপমা আব্দারের সুরে দেবায়নকে বাংলায় বলে, “হ্যাঁরে এত করে বলছে চল।”
দেবায়ন প্রতি উত্তরে বলে, “হ্যাঁ চল। ডিল ঠিকঠাক হয়ে গেছে এবারে কোন চিন্তা নেই।”
পারিজাত বাবুর সাথে ওরা দুইজনে হোটেল থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবায়ন অনুপমাকে নিয়ে হোটেল ঘুরিয়ে দেখায়। উটির নামকরা হোটেলের মধ্যে এটা অন্যতম। দুটো রেস্টুরেন্ট, দুটো ব্যাঙ্কুয়েট, পাঁচ তলা উঁচু বিশাল হোটেল। হোটেলের মালিকানা পেয়ে দুইজনেই বেশ উৎসাহিত। হোটেলের ম্যানেজার, রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার আরও অন্য ম্যানেজারদের সাথে কথা বলে দেবায়ন। মিস্টার পারিজাত জানায় যে আগামী কোয়ার্টার শেষে, বোর্ড মিটিংয়ে হোটেলের হাত বদলের কথা সবাইকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দেবেন, আর সেই সাথে ওদের সবাইকে আমন্ত্রন জানান। অনুপমা হাসি মুখে আমন্ত্রন স্বীকার করে।
অন্য হোটেল থেকে চেক আউট করে ওরা পারিজাত বাবুর বাড়ি পৌঁছায়। পারিজাত বাবুর বাড়ি উটি থেকে একটু দুরে একটা ছোটো পাহাড়ের ওপরে, চা বাগানের পাশে। সামনে বিশাল লন, পেছনে ছোটো ছোটো সবুজ পাহাড়। এই মনোরম দৃশ্য কোলকাতায় দুর্লভ। পারিজাত বাবুর স্ত্রী, সুনন্দা ওদের বেশ আদর আপ্যায়ন করেন। ধনী হলেও তাঁর স্ত্রীর আচরন খুব আময়িক। রাতের বেলা ভুরি ভোজ সম্পন্ন করে পারিজাত বাবুর বাড়িতেই রাত কাটায়। রাতেই মিস্টার পারিজাত হোটেলের কাগজে স্বাক্ষর করে দেন আর বলেন যে তার শালীর সাথে নিজেই বোঝাপড়া করে নেবেন। দেবায়ন কথা দেয় যে তাঁর মুন্নারের হোটেলের ব্যাপারে দেবায়ন সাহায্য করবে।
পরদিন সকালে পারিজাত বাবুর গাড়ি ওদের কে কোয়েম্বাটুর পৌঁছে দেয়। এর পরে যাত্রা ব্যাঙ্গালোর। মিস্টার দিলিপ কঠিন লোক, কিন্তু এইখানে ওদের কে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। ফ্লাইটে ওঠার আগে, কার্তিকেয়নকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে, এক মাস পর থেকে আবার লোক নিযুক্ত শুরু করতে।
ব্যাঙ্গালোর নেমেই দেবায়ন, দিলিপ বাবুকে ফোন করে জানায় ওদের আসার কথা। ওদের পৌঁছানোর কথা শুনেই বিরক্ত হয়ে যান দিলিপ বাবু। ফোনেই দেবায়নকে কড়া কথা শুনিয়ে জানিয়ে দেয় যে গত বার মিস্টার সেনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে হোটেলের শেয়ার তিনি বিক্রি করতে নারাজ। মিস্টার সেন অনেকদিনের চেনা তাই ভালো ভাবেই গত বার তাকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু বারেবারে ওনাকে এই ভাবে বিরক্ত করলে তিনি মিস্টার সেনের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নেবেন।
অনুপমার অনুরোধে দেবায়ন চুপ করে দিলিপ বাবুর কড়া কণ্ঠের জবাব শুনে যায়। গলার স্বর জড়ানো, তাই থেকে বুঝে যায় যে দিলিপ বাবু বর্তমানে নেশায় চুড়। দেবায়ন জানায় তার সাথে আগামী কাল একবার দেখা করতে চায়। দিলিপ বাবু জানিয়ে দেয় যে সকালে হোটেলে এসে দেখা করতে।
দেবায়ন চিন্তায় পড়ে যায়, কি ভাবে এই হোটেলের ডিল করা যায়। বেশ বড় থ্রি স্টার হোটেল, শহরের একদম মাঝখানে। এটা ছাড়াও দিলিপ বাবুর আরো একটা হোটেলে আছে ব্যাঙ্গালোরে আর সেটাও থ্রি স্টার। ব্যাঙ্গালোর বর্তমানে ভারতের অন্যতম ব্যাস্ত শহর, তথ্য প্রযুক্তির শহর আর প্রচুর লোকের আনাগোনা। এইখানে মাঝামাঝি হোটেল গুলো বেশি চলে আর তাই দিলিপ বাবু হোটেল হাত ছাড়া করতে চায় না।
পরের দিন সকালে দেবায়ন আর অনুপমা, হোটেলে পৌঁছে যায়। অনুপমা দেবায়নকে অনুরোধ করে মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য আর যা কিছু কথা সব অনুপমা বলবে। পশ্চিমী আধুনিক পোশাক ছেড়ে অনুপমা একটা সুন্দর তুঁতে রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। ওর অনুরোধে দেবায়ন সুট ছেড়ে সাধারন জিন্সের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে। হাতে কোন রকমের কাগজ ফাইল নেয় না, খালি হাতেই হোটেলে ঢোকে। এর আগেও একবার মিস্টার সেনের সাথে হোটেল দেখতে এসছিল দেবায়ন। দেবায়নকে ঢুকতে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসে। ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা নমস্কার জানায়। অনুপমা ওকে বলে যে মিস্টার দিলিপের সাথে দেখা করতে এসেছে। রিসেপ্সানিস্ট ওদেরকে কিছুক্ষণ বসতে বলে। দেবায়ন এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে, লোকজনের আনাগোনা দেখেই বোঝা যায় হোটেল একদম ঠাসা। অনুপমা ওর হাত চেপে ধরে শান্ত হতে অনুরোধ করে। অনুপমার হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় বুকের অস্থিরতা কিছুটা লাঘব হয়।
কিছুক্ষণ পরে রিসেপ্সানিস্ট ওদের কে দিলিপ বাবুর কেবিনে নিয়ে যায়। অনুপমা দিলিপ বাবুকে দেখে হাত জোর করে নমস্কার জানায়। দিলিপ বাবুর বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মাঝামাঝি, দেখেই বোঝা যায় যে এক কালে বেশ সুপুরুষ এবং ফর্সা ছিলেন। বর্তমানে গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে। মদ খেয়ে মোটা হয়ে গেছেন, গলার নিচে, চোখের কোলে এবং পেটে চর্বি জমে গেছে। শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন নেন না, ঘন ঘন সিগারেট টানেন। ওনার কেবিন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায় আর নাকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে। অনুপমার দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় তাও নিজেকে সামলে নেয়। দিলিপ বাবু লোলুপ দৃষ্টিতে অনুপমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্ষুধার্ত চাহনি ভরে জরিপ করে। অনুপমার মনে হয় যেন ওকে নগ্ন করে সারা অঙ্গে হাত বুলিয়ে মেপে নিচ্ছে। দিলিপ বাবুর লোলুপ দৃষ্টি দেখে দেবায়নের শরীরের রক্ত ক্রোধে টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। তাও অনুপমা ঠোঁটে হাসি নিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে অনুরোধ জানায়।
দিলিপ বাবু পানপরাগ খাওয়া দেঁতো হাসি দিয়ে দেবায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায়, “কেমন আছো মিস্টার বসাক?”
দেবায়ন হাত মিলিয়ে অনুপমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “মিস অনুপমা সেন, মিস্টার সেনের একমাত্র কন্যে।”
নিজের সাথে অনুপমার সম্পর্ক গোপন করে যায় অনুপমার অনুরোধেই।
দিলিপ বাবু ওদের বসতে বলে সোজাসুজি হোটেলের কথায় চলে আসে, “মিস্টার সেন কে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি যে হোটেল আমি এখন বিক্রি করব না। মিস্টার সেন আমার অনেকদিনের বন্ধু, সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে আমি চিড় ধরাতে চাই না।”
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “না না, মিস্টার দিলিপ, আসলে কি জানেন, ভাবলাম বাবার প্রপার্টি গুলো একবার ঘুরে দেখে আসি।”
অনুপমার গলা শুনে দিলিপ বাবু দেঁতো হেসে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়। এই হোটেল তোমার বাবার বটে, কেন দেখতে আসবে না, নিশ্চয় আসবে।”
অনুপমা এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে একটু হোটেলটা ঘুরে দেখি।”
দিলিপ বাবু ফোন তুলে কাউকে ডাকতে যায় কিন্তু অনুপমা বাধা দিয়ে বলে, “আপনি যদি সাথে আসেন তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে?”
দিলিপ বাবু যেন হাতে মোয়া পেয়ে গেছে এমন একটা হাসি দিয়ে গলে পড়ে বলে, “না না মিস সেন একদম না। তোমার মতন সুন্দরীকে আমি হোটেল ঘুরিয়ে দেখাব, এটা আমার ভাগ্য।”
অনুপমা আর দিলিপ বাবু উঠে দাঁড়ায়, একটু পেছনে দেবায়ন। রুম থেকে বের হতেই হোটেলের সব স্টাফ ওদের দিকে তাকায়। দেবায়ন ওদের কিছুটা পেছন থেকে অনুসরণ করে। দিলিপ বাবু ওদের কে রেস্টুরেন্ট দেখায়, বার দেখায়, বিভিন্ন ধরনের রুমের ব্যাপারে জানায়।
অনুপমা দিলিপ বাবুকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার মিসেস কি করে মিস্টার দিলিপ?”
দিলিপ বাবু তির্যক হেসে বলে, “দুধ খেতে হলে কি আর গাই কিনতে হয় মিস সেন? আমি বিয়ে করিনি মিস সেন।”
অনুপমা প্রশ্ন করে, “কেন করেন নি? আপনি একজন ধনী সুপুরুষ ব্যাক্তি।”
দিলিপ বাবুর কোন পুরাতন জায়গায় খোঁচা লাগে আর সেই জায়গা অনুপমা আর দেবায়নের অজানা নয়। তাও দিলিপ বাবু দেঁতো হাসি হেসে বলে, “আরে তুমি দেখি আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছো। ছাড়ো না ওই সব কথা। হোটেল দেখো, বার দেখো।”
অনুপমা দিলিপ বাবুর হাত ধরে অনুনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করে, “বলুন না দিলিপ বাবু, আপনি কেন বিয়ে করেন নি?”
অনুপমার উষ্ণ নরম হাতের ছোঁয়ায় হটাত করে যেন দিলিপ বাবুর মন উদাস হয়ে যায়। একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “জীবনে টাকা কামাতে কামাতে ঠিক জীবন সাথী পেলাম না তাই আর বিয়ে করা হল না।”
অনুপমা হেসে ওর হাত ধরে বলে, “আপনার কত বয়স হয়েছে যে আপনি এখন আর বিয়ে করতে পারবেন না? আপনি চাইলেই আপনার বাড়ির সামনে লম্বা লাইন লেগে যাবে।”
ব্যাথা ভরা হাসি দিয়ে দিলিপ বাবু উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মিস সেন, জানি। সত্যি কথা বলতে কি জানো বাড়ির সামনে…… ছাড়ো অইসব কথা……”
কথাটা বলতে বাধা পায় দিলিপ বাবু আর তাঁর কারন অনুপমা দেবায়নের অজানা নয় যে কাদের লাইন লাগে রোজ রাতে।
রাতে উটি পৌঁছে মিস্টার সেনকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে পুনের হোটেল এক প্রকার সম্পূর্ণ ওদের হাতে চলে এসেছে। মিস্টার সেন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন কি ভাবে দেবায়ন এই দুঃসাধ্য কাজ সম্ভব করতে পেরেছে। অনুপমা ওর কাছ থেকে ফোন নিয়ে ওর বাবাকে জানায় যে কোলকাতা ফিরে সবিস্তারে সব কিছু জানিয়ে দেবে। ইতিমধ্যে দু’বার মিস্টার পারিজাতের ফোন চলে আসে ওদের খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য। পারিজাত ব্যাবসাদার মানুষ হলেও মনের দিক থেকে দিলিপ বাবু আর মিস্টার রজতের মতন অতটা কুটিল মস্তিষ্কের ব্যাক্তি নয়।
পরের দিন দুপুরের পরেই দেবায়ন আর অনুপমা, পারিজাত বাবুর হোটেলে পৌঁছে যায়। মিস্টার সেন এই হোটেলের পঁচিশ শতাংশের মালিক তাই মাঝে মাঝে মিস্টার সেন এসে ঘুরে যান, তদারকি করে যান। এর আগেও মিস্টার সেনের সাথে একবার এখানে এসেছিল দেবায়ন, তবে অনুপমার জন্য উটি ভ্রমন প্রথম বার।
মিস্টার পারিজাত, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, মাথায় কাঁচা পাকা চুল, চোখে চশমা, চেহারায় এক আময়িক হাসি হাসি ভাব। পারিজাত বাবু অনুপমাকে দেখে বেশ খুশি হন। পারিজাত বাবু অনুপমার সাথে বাড়ির গল্পে মেতে ওঠে, ছেলে মেয়ের গল্পে মেতে ওঠে। পারিজাত বাবুর হাসি হাসি চেহারা দেখে অনুপমা একটু গলে যায়। দেবায়নকে একপাশে টেনে বলে যে এর সাথে চটুল পদ্ধতি না করে সোজা কোন উপায়ে হোটেলের কথা বলতে।
দেবায়ন হেসে বলে, “দ্যাখ পুচ্চি, পুনেতে রজতের সাথে যেটা আমরা করেছি সেটা তুই কুটিল চাল বলতে পারিস। কিন্তু এখানে আমি যা করছি সেটা ব্যাবসার মারপ্যাঁচ। দয়া করে এখানে মাথা ঘামাস না, প্লিস সোনা এই ডিল আমাকে করতে দে।”
ড্রিঙ্কসের গ্লাস হাতে তুলে পারিজাত বাবু দেবায়নকে প্রশ্ন করে, “এইতো কিছু দিন আগেই মিস্টার সেন এলেন। এর মধ্যেই আবার তুমি ঘুরতে এলে?”
দেবায়ন হেসে পারিজাতকে বলে, “এই এমনি এলাম। গত কোয়ার্টারে বেশ ভালো আয় হয়েছে আর এখন গরমের ছুটির মরশুম। তাই বর্তমান কোয়ার্টারে আয় কেমন হচ্ছে সেটা একবার দেখতে এলাম।”
পারিজাত বাবু মৃদু হেসে কথা ঘুরিয়ে বলে, “হ্যাঁ উটি ভালো জায়গা। মিস সেনের মনে হয় এই প্রথম উটি আসা।”
অনুপমা মাথা নাড়িয়ে বলে “হ্যাঁ।”
পারিজাত বাবু ওকে বলে, “তাহলে ভালো কথা। আজ রাতের ডিনার আমার বাড়িতে, তারপরে কাল উটি ঘুরে বেড়াও দুইজনে।”
দেবায়ন অত সহজে ভোলার মানুষ নয় তাই পাল্টা হেসে বলে, “আমন্ত্রন নিশ্চয় রক্ষা করব মিস্টার পারিজাত। কিন্তু একবার এই কোয়াটারের ব্যালেন্স সিটটা আর মান্থলি রিপোর্টটা দেখতে পেলে বড় ভালো হয়।”
পারিজাত বাবু একটু ফাঁপড়ে পরে যায় তাও পাক্কা ব্যাবসাদারের মতন উত্তর দেয়, “মিস্টার বসাক, যেমন মানুষের আসা যাওয়া লেগেই থাকে সেই মতন টাকার আসা যাওয়া লেগে থাকে। এখনো তো কোয়ার্টার শেষ হয়নি, শেষ হলেই আমি মিস্টার সেনকে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব।”
দেবায়ন পারিজাত বাবুর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে, “তাহলে এবারে আসল কথায় আসি মিস্টার পারিজাত।”
দেবায়নের গম্ভির কণ্ঠস্বর শুনে পারিজাত বাবু একটু নড়েচড়ে বসে। দেবায়ন ওকে বলে, “দেখুন মিস্টার পারিজাত। সেন আঙ্কেল কেন এসেছিলেন সেটা আমাদের অজানা নয়। আমি আজকে সেই কথা নিয়েই এসেছি।”
দেবায়নের মুখে হোটেলের কথা শুনে পারিজাত বাবুর মুখের আদল বদলে যায়। আময়িক চেহারা একটু ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। চশমা নামিয়ে টেবিলের ওপরে ঝুঁকে দেবায়নকে বলে, “মিস সেন আছেন তাই তোমাকে অনুরোধ করছি যে এই সব ব্যাবসার কথা আমরা পরে আলোচনা করবো। এখন উটি ঘুরে দেখো।”
অনুপমা একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার পারিজাত বাবুর দিকে তাকায়। পারিজাত বাবু ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “আরে মিস সেন, তুমি দেখি এখনো এই কাবাব টা খেলেই না। খেয়ে দেখো, খাশ লাখনউয়ের গেলাটি কাবাব।”
অনুপমা পারিজাত বাবুর কথায় একটু হেসে একটা কাবাব তুলে নেয়।
দেবায়নের মৃদু হেসে পারিজাত বাবুকে বলে, “মিস্টার পারিজাত, মিস সেন শুধু মাত্র সেন কাকুর মেয়ে নয়। ও আমার হবু সহধর্মিণী, সুতরাং ওর সামনে এই বিষয়ে আলোচনা করলে কিছু হবে না।”
পারিজাত বাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে মুখের কাছে দুই হাত জড়ো করে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, “তাহলে কি চাও মিস্টার বসাক? আমি আমার কথা আগেই মিস্টার সেনকে জানিয়ে দিয়েছি। এখন আমি হোটেল বিক্রি করতে রাজি নই।”
দেবায়ন জবাব দেয়, “মিস্টার পারিজাত, গত কোয়ার্টারে নেট প্রফিট হয়েছে পাঁচ কোটি আর এই কোয়ার্টারে এখন পর্যন্ত আয় হয়েছে এক কোটি। ঠিক কি না?”
পারিজাত বাবু ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করে, “তুমি এত খবর জানলে কি করে?”
দেবায়ন জবাব দেয়, “পঁচিশ শতাংশের মালিকানা আমাদের কাছে। একাউন্টস যখন তখন চাইলেই আশা করি দেখতে পারি সেই অধিকার আমাদের আছে।”
পারিজাত বাবু চুপ করে থাকেন। দেবায়ন বলে চলে, “এই এক কোটি থেকে মাইনে দিয়ে, খাবারের বিল, ইলেকট্রিক বিল, ট্যাক্স ইত্যাদি মিটিয়ে এবারে কত হাতে থাকবে? দশ লাখের মতন হয়তো হাতে থাকবে আর নব্বুই লাখ বেড়িয়ে যাবে। তাহলে এই কোয়ার্টারে আমি পাচ্ছি মাত্র আড়াই লাখ টাকা। এত কমে কেন সন্তুষ্ট হবো একবার বলেন?”
এই কথা শুনে পারিজাত বাবুর চাহনি কঠিন হয়ে যায়, “ব্যাবসায় ওঠা নামা হতেই পারে মিস্টার বসাক।”
দেবায়ন দমবার পাত্র নয়, “হ্যাঁ ব্যাবসা মানেই ওঠা নামা। আজকে আমি রাজা কালকে আমি ফকির। কিন্তু ঢোকার সময়ে দেখলাম যে এই ছুটির মরশুমে হোটেল অনেক খালি। কি কারন জানতে পারি কি?”
পারিজাত বাবু বড় এক নিঃশ্বাস নিয়ে বলেন, “কি চাও খুলে বল।”
দেবায়ন বলে, “শুধু মাত্র আপনার ত্রিশ শতাংশ কিনতে চাই। আমাদের অফার ত্রিশ কোটি টাকা।”
পারিজাত বাবু, “মিস্টার সেন কে আমি আগেই বলেছি যে এই হোটেল আমি এখন বিক্রি করব না।”
দেবায়ন তির্যক হেসে বলে, “বেশ ভালো কথা মিস্টার পারিজাত। আজ আমি চলে যাচ্ছি। এই কোয়ার্টারের মিটিঙে সেন কাকুকে পাঠিয়ে দেব কিন্তু তার পরের মিটিংয়ে আমি নিজে আসব। আর তখন সবার সামনে আপনার হোটেলের ভ্যালু আর হোটেলের আয় ব্যায় নিয়ে আলোচনা করব। সেই মিটিঙে আপনার ফাইন্যান্স ম্যানেজার, এইচ আর ম্যানেজার, রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার সবাই থাকবে। ভেবে দেখুন ওদের সামনে যখন আমি এই নিয়ে কথা বলব তখন আপনি কি বলবেন। ওরা সবাই চুপ থাকবে, কারন ওরা মাইনে পায় মিস্টার পারিজাত। ওদের মাইনে প্রতি বছর বাড়ে কিন্তু আমাদের টাকা কোন বছর বারে কোন বছরে কমে আসে। কিন্তু তাই বলে এক কোটি থেকে এক ধাক্কায় আড়াই লাখ? ধাক্কাটা খুব বেশি হয়ে গেল না মিস্টার পারিজাত? একবার ওদের একটু কম মাইনে দিয়ে দেখুন, দেখবেন ওরা কেমন আপনার দিকে তেড়ে আসে।”
অপমান আর বদনামের ভয়ে পারিজাত বাবু গুমরে ওঠেন, “সবার সামনে অপমান? ঠিক সহ্য করতে পারছি না মিস্টার বসাক। মিস্টার সেনের সাথে এতদিনের পরিচয়, আর তুমি তাঁর মান এইরকম ভাবে রাখলে?”
দেবায়ন বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বলে, “মিস্টার পারিজাত, আপনি আমার থেকে অনেক বড়, আমি আপনাকে অপমান করতে চাই না। তাই শুধু অনুরোধ করছি যে হোটেলের মালিকানা বিক্রি করে দিন। আমি রীতিমত টাকা দিয়ে কিনতে চাই, দাম কম দিচ্ছি না। ভালোই টাকা দিচ্ছি।”
পারিজাত বাবু বলে, “ত্রিশ কোটি টাকা? জানো এই হোটেলের বর্তমান দর কত?”
দেবায়ন বলে, “হ্যাঁ জানি। এই হোটেলের বর্তমান ভ্যালু দেড়শো কোটি টাকা, কিন্তু যে হোটেল চলে না তার দাম কত হতে পারে মিস্টার পারিজাত? এই কোয়ার্টারে এই অবস্থা, এর পরে বর্ষা কাল, কোন টুরিস্ট এখানে আসবে না, তখন দাম আরও পড়ে যাবে।”
পারিজাত বাবু কোণঠাসা হয়ে যায়, “মিস্টার বসাক, পঞ্চাশ কোটির নিচে কি করে ডিল করি?”
দেবায়ন বলে, “ত্রিশ কোটি ঠিক দাম দিচ্ছি মিস্টার পারিজাত।”
দেবায়নের কথাবার্তা শুনে পারিজাত বাবু ভাবনায় পড়ে যায়। বেশ খানিকক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে বলেন, “তোমাকে ত্রিশ শতাংশ দিয়ে দিলে আমার কাছে কি থাকবে? শুধু মাত্র পনেরো শতাংশ? জানোই তো যে বাকি কুড়ি শতাংশ আমার শালীর নামে লেখা।”
দেবায়ন হেসে ফেলে, “ওকে বুঝিয়ে ওঠার দায়িত্ব আপনার।”
পারিজাত বাবু বলে, “আচ্ছা একটা কথা বল। মানছি যে আমার হোটেলের আয় হঠাৎ কমে গেছে, কিন্তু তোমার হাতে পড়লে তুমি কি ভাবে হোটেলের আয় বাড়িয়ে দেবে?”
দেবায়ন হেসে জবাব দেয়, “মিস্টার পারিজাত, এই গতকাল আমি পুনেতে একটা ফোর স্টার প্রপার্টি কিনেছি, দেড়শো কোটি টাকার ডিল করে এসেছি। সেন কাকুর মুখে নিশ্চয় শুনেছেন যে আমাদের আরও তিনটে হোটেল আছে। সব মিলিয়ে একটা চেইন হোটেল দাঁড় করাতে চাই। নিজেদের কন্সট্রাকশান কোম্পানি আছে, কোন হোটেলের কন্সট্রাকশান করতে হলে নিজেদের কোম্পানি দিয়েই করাব।”
অনুপমার দিকে দেখিয়ে বলে, “আমার মিসেস নতুন একটা সফটওয়্যার কোম্পানি খুলেছে। এই হোটেল চেইনগুলো আমরা এক সাথে বেঁধে দিতে চাই। তাতে লাভ আছে, কোন হোটেল বেশি আয় করল, কোনটা কম। টাকা ঘুরাতে পারবো এই খান থেকে ওইখানে।”
নিরুপায় পারিজাত বাবু শেষ পর্যন্ত হেসে ফেলেন, “মিস্টার বসাক তুমি একদম তৈরি হয়েই এসেছ দেখছি।”
দেবায়ন হাত বাড়িয়ে দেয় পারিজাত বাবুর দিকে, “হ্যাঁ এক প্রকার। তাহলে কি রাতের ডিনার আপনার বাড়িতে না কোন রেস্টুরেন্টে করতে হবে?”
পারিজাত বাবু অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “না না মিস সেন প্রথম বার এসেছে, ডিনার আমার বাড়িতেই হবে। কি খেতে চাও বলো।”
অনুপমা হেসে বলে, “আপনি যা খাওয়াতে চাইবেন। আমরা অতিথি।”
পারিজাত বাবু বলে, “বেশ ঠিক আছে। একদম খাস দক্ষিণ ভারতের রাজার খাবার খাওয়াব।”
তারপরে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা একটা কথা বল। নিজের এত বড় হোটেল থাকতে বাইরের হোটেলে কেন থাকতে গেলে? এটা কি ঠিক করলে?”
দেবায়ন হেসে ফেলে, “তখন জানতাম না যে ডিনার আপনার বাড়িতে হবে তাই……” বলেই পারিজাত বাবুর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
পারিজাত বাবু দেবায়ন সাথে হাত মেলায়। দেবায়ন ওর হাতে হোটেলের ফাইল তুলে দেয়। পারিজাত বাবু ফাইল খুলে চোখ বুলিয়ে অবাক হয়ে যায়, “এখানে তো লেখা পঁয়ত্রিশ কোটি, তাহলে তুমি ত্রিশ কেন বলছিলে?”
দেবায়ন হেসে ফেলে, “ব্যাবসাদারের মন, দরদাম না করলে কি আর মন ভরে মিস্টার পারিজাত। আপনাকে ঠকিয়ে কি লাভ আছে আমার বলুন। রিতিমত বাজার দর দিয়েই হোটেল কিনব।”
পারিজাত বাবু, অনুপমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “তোমার মিস্টার ভবিষ্যতে অনেক ওপরে উঠবে। তার কারন একটাই, ও হৃদয় দিয়ে ব্যাবসা করে, বাকি আমরা মাথা দিয়ে ব্যাবসা করি তাই সামনের লোককে ঠকাতে চেষ্টা করি।”
দেবায়ন বলে, “কেন মিছে লজ্জা দিচ্ছেন মিস্টার পারিজাত। আপনার কাছ থেকে আর সেন কাকুর কাছ থেকে আমার অনেক কিছু শেখার আছে।”
পারিজাত বাবু হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “হ্যাঁ সেটা বুঝতেই পারছি আর তাই এবারে মিস্টার সেন নিজে না এসে তোমাকে পাঠিয়েছে। যাই হোক, ওই হোটেল থেকে চেক আউট করে নাও এখুনি। সোজা আমার বাড়িতে চল। আমি কিন্তু কোন কথা শুনতে চাই না মিস্টার বসাক।”
অনুপমা আব্দারের সুরে দেবায়নকে বাংলায় বলে, “হ্যাঁরে এত করে বলছে চল।”
দেবায়ন প্রতি উত্তরে বলে, “হ্যাঁ চল। ডিল ঠিকঠাক হয়ে গেছে এবারে কোন চিন্তা নেই।”
পারিজাত বাবুর সাথে ওরা দুইজনে হোটেল থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবায়ন অনুপমাকে নিয়ে হোটেল ঘুরিয়ে দেখায়। উটির নামকরা হোটেলের মধ্যে এটা অন্যতম। দুটো রেস্টুরেন্ট, দুটো ব্যাঙ্কুয়েট, পাঁচ তলা উঁচু বিশাল হোটেল। হোটেলের মালিকানা পেয়ে দুইজনেই বেশ উৎসাহিত। হোটেলের ম্যানেজার, রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার আরও অন্য ম্যানেজারদের সাথে কথা বলে দেবায়ন। মিস্টার পারিজাত জানায় যে আগামী কোয়ার্টার শেষে, বোর্ড মিটিংয়ে হোটেলের হাত বদলের কথা সবাইকে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়ে দেবেন, আর সেই সাথে ওদের সবাইকে আমন্ত্রন জানান। অনুপমা হাসি মুখে আমন্ত্রন স্বীকার করে।
অন্য হোটেল থেকে চেক আউট করে ওরা পারিজাত বাবুর বাড়ি পৌঁছায়। পারিজাত বাবুর বাড়ি উটি থেকে একটু দুরে একটা ছোটো পাহাড়ের ওপরে, চা বাগানের পাশে। সামনে বিশাল লন, পেছনে ছোটো ছোটো সবুজ পাহাড়। এই মনোরম দৃশ্য কোলকাতায় দুর্লভ। পারিজাত বাবুর স্ত্রী, সুনন্দা ওদের বেশ আদর আপ্যায়ন করেন। ধনী হলেও তাঁর স্ত্রীর আচরন খুব আময়িক। রাতের বেলা ভুরি ভোজ সম্পন্ন করে পারিজাত বাবুর বাড়িতেই রাত কাটায়। রাতেই মিস্টার পারিজাত হোটেলের কাগজে স্বাক্ষর করে দেন আর বলেন যে তার শালীর সাথে নিজেই বোঝাপড়া করে নেবেন। দেবায়ন কথা দেয় যে তাঁর মুন্নারের হোটেলের ব্যাপারে দেবায়ন সাহায্য করবে।
পরদিন সকালে পারিজাত বাবুর গাড়ি ওদের কে কোয়েম্বাটুর পৌঁছে দেয়। এর পরে যাত্রা ব্যাঙ্গালোর। মিস্টার দিলিপ কঠিন লোক, কিন্তু এইখানে ওদের কে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। ফ্লাইটে ওঠার আগে, কার্তিকেয়নকে ফোনে জানিয়ে দেয় যে, এক মাস পর থেকে আবার লোক নিযুক্ত শুরু করতে।
ব্যাঙ্গালোর নেমেই দেবায়ন, দিলিপ বাবুকে ফোন করে জানায় ওদের আসার কথা। ওদের পৌঁছানোর কথা শুনেই বিরক্ত হয়ে যান দিলিপ বাবু। ফোনেই দেবায়নকে কড়া কথা শুনিয়ে জানিয়ে দেয় যে গত বার মিস্টার সেনকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে হোটেলের শেয়ার তিনি বিক্রি করতে নারাজ। মিস্টার সেন অনেকদিনের চেনা তাই ভালো ভাবেই গত বার তাকে পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু বারেবারে ওনাকে এই ভাবে বিরক্ত করলে তিনি মিস্টার সেনের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নেবেন।
অনুপমার অনুরোধে দেবায়ন চুপ করে দিলিপ বাবুর কড়া কণ্ঠের জবাব শুনে যায়। গলার স্বর জড়ানো, তাই থেকে বুঝে যায় যে দিলিপ বাবু বর্তমানে নেশায় চুড়। দেবায়ন জানায় তার সাথে আগামী কাল একবার দেখা করতে চায়। দিলিপ বাবু জানিয়ে দেয় যে সকালে হোটেলে এসে দেখা করতে।
দেবায়ন চিন্তায় পড়ে যায়, কি ভাবে এই হোটেলের ডিল করা যায়। বেশ বড় থ্রি স্টার হোটেল, শহরের একদম মাঝখানে। এটা ছাড়াও দিলিপ বাবুর আরো একটা হোটেলে আছে ব্যাঙ্গালোরে আর সেটাও থ্রি স্টার। ব্যাঙ্গালোর বর্তমানে ভারতের অন্যতম ব্যাস্ত শহর, তথ্য প্রযুক্তির শহর আর প্রচুর লোকের আনাগোনা। এইখানে মাঝামাঝি হোটেল গুলো বেশি চলে আর তাই দিলিপ বাবু হোটেল হাত ছাড়া করতে চায় না।
পরের দিন সকালে দেবায়ন আর অনুপমা, হোটেলে পৌঁছে যায়। অনুপমা দেবায়নকে অনুরোধ করে মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য আর যা কিছু কথা সব অনুপমা বলবে। পশ্চিমী আধুনিক পোশাক ছেড়ে অনুপমা একটা সুন্দর তুঁতে রঙের সালোয়ার কামিজ পরে। ওর অনুরোধে দেবায়ন সুট ছেড়ে সাধারন জিন্সের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে। হাতে কোন রকমের কাগজ ফাইল নেয় না, খালি হাতেই হোটেলে ঢোকে। এর আগেও একবার মিস্টার সেনের সাথে হোটেল দেখতে এসছিল দেবায়ন। দেবায়নকে ঢুকতে দেখে সবাই নড়েচড়ে বসে। ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়েটা নমস্কার জানায়। অনুপমা ওকে বলে যে মিস্টার দিলিপের সাথে দেখা করতে এসেছে। রিসেপ্সানিস্ট ওদেরকে কিছুক্ষণ বসতে বলে। দেবায়ন এদিক ওদিকে তাকিয়ে দেখে, লোকজনের আনাগোনা দেখেই বোঝা যায় হোটেল একদম ঠাসা। অনুপমা ওর হাত চেপে ধরে শান্ত হতে অনুরোধ করে। অনুপমার হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায় বুকের অস্থিরতা কিছুটা লাঘব হয়।
কিছুক্ষণ পরে রিসেপ্সানিস্ট ওদের কে দিলিপ বাবুর কেবিনে নিয়ে যায়। অনুপমা দিলিপ বাবুকে দেখে হাত জোর করে নমস্কার জানায়। দিলিপ বাবুর বয়স চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশের মাঝামাঝি, দেখেই বোঝা যায় যে এক কালে বেশ সুপুরুষ এবং ফর্সা ছিলেন। বর্তমানে গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে। মদ খেয়ে মোটা হয়ে গেছেন, গলার নিচে, চোখের কোলে এবং পেটে চর্বি জমে গেছে। শরীরের প্রতি বিশেষ যত্ন নেন না, ঘন ঘন সিগারেট টানেন। ওনার কেবিন ধোঁয়াটে হয়ে গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায় আর নাকে পোড়া গন্ধ ভেসে আসে। অনুপমার দম বন্ধ হয়ে যাবার জোগাড় তাও নিজেকে সামলে নেয়। দিলিপ বাবু লোলুপ দৃষ্টিতে অনুপমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত ক্ষুধার্ত চাহনি ভরে জরিপ করে। অনুপমার মনে হয় যেন ওকে নগ্ন করে সারা অঙ্গে হাত বুলিয়ে মেপে নিচ্ছে। দিলিপ বাবুর লোলুপ দৃষ্টি দেখে দেবায়নের শরীরের রক্ত ক্রোধে টগবগ করে ফুটতে শুরু করে। তাও অনুপমা ঠোঁটে হাসি নিয়ে দেবায়নের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে অনুরোধ জানায়।
দিলিপ বাবু পানপরাগ খাওয়া দেঁতো হাসি দিয়ে দেবায়নের দিকে হাত বাড়িয়ে হাত মেলায়, “কেমন আছো মিস্টার বসাক?”
দেবায়ন হাত মিলিয়ে অনুপমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, “মিস অনুপমা সেন, মিস্টার সেনের একমাত্র কন্যে।”
নিজের সাথে অনুপমার সম্পর্ক গোপন করে যায় অনুপমার অনুরোধেই।
দিলিপ বাবু ওদের বসতে বলে সোজাসুজি হোটেলের কথায় চলে আসে, “মিস্টার সেন কে আমি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি যে হোটেল আমি এখন বিক্রি করব না। মিস্টার সেন আমার অনেকদিনের বন্ধু, সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে আমি চিড় ধরাতে চাই না।”
অনুপমা মিষ্টি হেসে বলে, “না না, মিস্টার দিলিপ, আসলে কি জানেন, ভাবলাম বাবার প্রপার্টি গুলো একবার ঘুরে দেখে আসি।”
অনুপমার গলা শুনে দিলিপ বাবু দেঁতো হেসে বলে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয় নিশ্চয়। এই হোটেল তোমার বাবার বটে, কেন দেখতে আসবে না, নিশ্চয় আসবে।”
অনুপমা এদিক ওদিকে তাকিয়ে বলে, “তাহলে একটু হোটেলটা ঘুরে দেখি।”
দিলিপ বাবু ফোন তুলে কাউকে ডাকতে যায় কিন্তু অনুপমা বাধা দিয়ে বলে, “আপনি যদি সাথে আসেন তাহলে কি খুব ক্ষতি হবে?”
দিলিপ বাবু যেন হাতে মোয়া পেয়ে গেছে এমন একটা হাসি দিয়ে গলে পড়ে বলে, “না না মিস সেন একদম না। তোমার মতন সুন্দরীকে আমি হোটেল ঘুরিয়ে দেখাব, এটা আমার ভাগ্য।”
অনুপমা আর দিলিপ বাবু উঠে দাঁড়ায়, একটু পেছনে দেবায়ন। রুম থেকে বের হতেই হোটেলের সব স্টাফ ওদের দিকে তাকায়। দেবায়ন ওদের কিছুটা পেছন থেকে অনুসরণ করে। দিলিপ বাবু ওদের কে রেস্টুরেন্ট দেখায়, বার দেখায়, বিভিন্ন ধরনের রুমের ব্যাপারে জানায়।
অনুপমা দিলিপ বাবুকে জিজ্ঞেস করে, “আপনার মিসেস কি করে মিস্টার দিলিপ?”
দিলিপ বাবু তির্যক হেসে বলে, “দুধ খেতে হলে কি আর গাই কিনতে হয় মিস সেন? আমি বিয়ে করিনি মিস সেন।”
অনুপমা প্রশ্ন করে, “কেন করেন নি? আপনি একজন ধনী সুপুরুষ ব্যাক্তি।”
দিলিপ বাবুর কোন পুরাতন জায়গায় খোঁচা লাগে আর সেই জায়গা অনুপমা আর দেবায়নের অজানা নয়। তাও দিলিপ বাবু দেঁতো হাসি হেসে বলে, “আরে তুমি দেখি আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছো। ছাড়ো না ওই সব কথা। হোটেল দেখো, বার দেখো।”
অনুপমা দিলিপ বাবুর হাত ধরে অনুনয়ের সুরে জিজ্ঞেস করে, “বলুন না দিলিপ বাবু, আপনি কেন বিয়ে করেন নি?”
অনুপমার উষ্ণ নরম হাতের ছোঁয়ায় হটাত করে যেন দিলিপ বাবুর মন উদাস হয়ে যায়। একবার দেবায়নের দিকে তাকায় একবার অনুপমার দিকে। নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “জীবনে টাকা কামাতে কামাতে ঠিক জীবন সাথী পেলাম না তাই আর বিয়ে করা হল না।”
অনুপমা হেসে ওর হাত ধরে বলে, “আপনার কত বয়স হয়েছে যে আপনি এখন আর বিয়ে করতে পারবেন না? আপনি চাইলেই আপনার বাড়ির সামনে লম্বা লাইন লেগে যাবে।”
ব্যাথা ভরা হাসি দিয়ে দিলিপ বাবু উত্তর দেয়, “হ্যাঁ মিস সেন, জানি। সত্যি কথা বলতে কি জানো বাড়ির সামনে…… ছাড়ো অইসব কথা……”
কথাটা বলতে বাধা পায় দিলিপ বাবু আর তাঁর কারন অনুপমা দেবায়নের অজানা নয় যে কাদের লাইন লাগে রোজ রাতে।