01-10-2020, 12:33 PM
ত্রয়োবিংশ পর্ব (#02)
মায়ের সম্মতি পেয়ে দেবায়ন খুব খুশি। দেবশ্রী ছেলেকে শুধু একটা কথা বলে, এই টাকা পয়সা, নাম যশে যেন নিজের মান সন্মান বজায় রেখে চলে। মাকে জড়িয়ে ধরে দেবায়ন আসস্থ করে। দেবশ্রী জানায় ওদের দিল্লী অফিসে একটা ছেলে এডমিনে ছিল, নাম শান্তনু দুবে। ছেলেটা বিহারী কিন্তু আসানসোলে বাড়ি। দেবশ্রীর আগের অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়েছে এবং দিল্লীতেই চাকরি করছে কিন্তু কোলকাতা ফিরতে চায়, বাড়ির কাছে কোথাও চাকরি করতে চায়। দেবায়নের সফটওয়্যার ফার্ম হলে ওকে যেন একটা কাজ দেয়। সেই সাথে শান্তনুর স্ত্রী, মনীষা জিন্টা সে আগে দেবশ্রীর নিচে কাজ করত। এইচ.আর হিসাবে সে ভালোই কাজ করবে। দেবায়ন জানিয়ে দেয়, ওদের ফার্মে লোকজনের দরকার পড়বে, চেনাজানা হলে ভালো হয়।
মিস্টার সেন নিজের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যাবসা দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। পুরানো গাড়ি বিক্রি করে দুটো গাড়ি কেনা হয়। একটা অনুপমার বাড়ির জন্য টয়োটা ক্যামরি আর মিস্টার সেন নিজের জন্য কেনেন, অডি এ-সিক্স। দেবায়ন বলে, নিজের জন্য পরে গাড়ি কিনবে। এখন ওর বুলেটে ঘোরার শখ কমেনি। গাড়ি থাকলেও অনুপমা ওর সাথেই বাইকে চেপে সব জায়গায় যায়। অনুপমার গাড়ি বেশির ভাগ দিন বাড়িতেই থাকে।
এক বছর বাদ গেছে পায়েলের। তবে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে আশেপাশের আবহাওয়ার সাথে। অনুপমা ওকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে তারপরে দেবায়নের সাথে কাজে বের হয়। বিকেলে গাড়ি ওকে কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে আসে। পায়েলের দৌড় এই বাড়ি থেকে কলেজ আর কলেজ থেকে বাড়ি। এছাড়া কোথাও বের হতে চায় না।
এক বিকেলে মিস্টার সেন দেবায়নের সাথে এই সফটওয়্যার ফার্মের ব্যাপারে আলোচনা করে বুঝিয়ে দেয় কার সাথে কি ভাবে কথা বলে বশ করবে। মিস্টার সেন বলেন যে, ফার্ম প্রাইভেট লিমিটেড করতে হলে কমপক্ষে তিন জন ডাইরেক্টর চাই। অনুপমাকে ডাইরেক্টর করে দিলে ভালো। কারন ডাইরেক্টর লাভের অংশ পাবে এবং সাথে সাথে মাইনে। কিন্তু শুরুতে যতদিন না কোম্পানি ব্রেক ইভেনে পৌছাবে ততদিন বাকিদের খাতিরে অনুপমা কোন মাইনে নেবে না। দেবায়ন যদি মাইনে নিয়ে চাকরি করে তাহলে বিয়ের পরে টাকার সমস্যা থাকবে না। দেবায়ন বুঝতে পারল এই কোম্পানির প্যাঁচ। মিস্টার সেন আরো জানালেন যে, শ্রেয়ার সাথে ঠিক যেন সেই রকম করে। শ্রেয়াকে যেন বেশি শেয়ার না দেয়, কারন টাকা লাগাবে মিস্টার সেন, বুদ্ধি আর মাথা লাগাবে দেবায়ন। শ্রেয়ার নামে দশ থেকে বারো শতাংশ দিলেই হবে। যদি রূপক অন্য কোথাও চাকরি করতে চায় তাহলে অন্য কিছু ভাববে এই সফটওয়্যার ফার্মের ব্যাপারে। সবকিছু বুঝে শুনে যেন কথাবার্তা বলে দেবায়ন আর অনুপমা। ব্যাবসা এক জিনিস আর বন্ধুত্ত অন্য। ব্যাবসার মধ্যে বন্ধুত্ত আনা ভালো কিন্তু একটা সীমা পর্যন্ত। তৃতীয় ডাইরেক্টর হিসাবে মিস্টার সেন থাকবেন।
মিস্টার সেন আরো জানান, যে প্রথমে একটা অফিসের জন্য জায়গা যোগাড় করতে হবে। কোম্পানির নাম রেজিসস্টার করাতে হবে, সব ডাইড়েক্টর দের নাম ধাম দিতে হবে। তারপরের বিজনেশ আর জনবল যোগাড় করা। মিস্টার সেন বললেন, শুরু দিকে ওদের আগের কোম্পানির যে ছেলেটা একাউন্টস দেখত তাকে দিয়ে কাজ করাবেন। দেবায়ন বলে, মা একজন এইচ.আর এর কথা বলেছে। বিজনেসের জন্য মিস্টার সেন খুঁজবেন, কারন সফটওয়্যার মারকেটিং আর অন্য মারকেটিঙ্গের মধ্যে অনেক তফাত। সময়ের আগেই সব যোগাড় করে নেবেন। মিস্টার সেন বললেন দেবায়ন বড় হয়ে গেছে, এবারে যেন নিজের ভালো মন্দ বুঝে শুনে সবার সাথে এই ব্যাবসা আর বাকি কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলে।
দেবায়ন মিস্টার সেনকে জিজ্ঞেস করে নিবেদিতার কোম্পানির ব্যাপারে। মিস্টার সেন বলেন যে ওদের কন্সট্রাক্সান কোম্পানির জন্য মিস্টার সেন ডাইরকেটর যোগাড় করেছেন। যাদের সাথে এতদিন কাজ করে এসেছিলেন তাদের মধ্যে দুই জনকে নিয়েছেন। তাদের নামে শেয়ার নেই, তারা নামেই ডাইরেক্টর। আর নিবেদিতার কোম্পানির জন্য মিস্টার সেন চল্লিশ কোটি টাকা দিয়েছে। নিবেদিতা মিন্টো পার্কের কাছে অফিস নিয়েছে। মিস্টার সেন বলেন, ওদের এই গ্রুপ কোম্পানির জন্য রাসেল স্ট্রিটের পুরনো অফিসের নিচের তলায় অফিস খুলতে। মিস্টার সেন বলেন শ্রেয়া আর রূপকের সাথে কথাবার্তা বলার পরে ওরা নিজেরাই এইসব দেখতে যেতে পারে। ওদের সাথে নিয়ে গেলে ওদের ভালো লাগবে, ওরা বুঝবে যে ওদের কথার দাম দেওয়া হয়েছে। এই ভাবে মানুষকে বশে করা যায়। দেবায়ন হেসে ফেলে মিস্টার সেনের কথা শুনে।
একদিন বিকেলে শ্রেয়া আর রূপকের সাথে আলোচনায় বসে দেবায়ন আর অনুপমা।
দেবায়ন প্রথম কথা শুরু করে, “আমি আর অনুপমা ঠিক করেছি একটা সফটওয়্যার ফার্ম খুলব।”
রূপক, “হ্যাঁ, শ্রেয়া আমাকে জানিয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু আমি মুম্বাইয়ে একটা বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি।”
দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। রূপক বলে, “আগে তোদের পুরো পরিকল্পনা শুনি তারপরে সিদ্ধান্ত নেব কোথায় জয়েন করব। তোদের কাছে কি কোন প্রোজেক্ট প্লান আছে এই কোম্পানির ব্যাপারে? মানে কি নিয়ে কোম্পানি বিজনেস করবে, কি কি প্রোডাক্ট হবে এই সব আর কি?”
অনুপমা আর দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “না ওই সব ব্যাপারে কিছু জানি না বলেই তোকে ডাকা।”
রূপক হেসে দেয়, “তার মানে আমার সাহায্য চাই। কিন্তু এতে আমাদের লাভ?”
অনুপমা বলে, “লাভ মানে, তুমি আমাদের সাথে থাকবে। এই কোম্পানির এক অংশীদার হবে।”
রূপক শ্রেয়ার দিকে তাকায়। শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “টাকা কে দেবে?”
অনুপমা, “টাকার কথা চিন্তা করিস না। টাকা আমি আর দেবায়ন যোগাড় করে নেব। তোরা শুধু এই টুকু জানা যে তোরা কি আমাদের সাথে থাকবি?”
রূপক একভার শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি মুম্বাইয়ে যে কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি সেই কোম্পানি দুশো কোটি টাকার কোম্পানি। আমার জয়েনিং স্যালারি পঁচিশ হাজার এবং সাথে আরও অনেক সুযোগ সুবিধে আছে।”
দেবায়ন হেসে বলে, “দ্যাখ ভাই, আমি এখুনি বলছি না যে আমরা তোকে ওই মাইনে দিতে পারব। তবে তোর ওপরে নির্ভর করবে ভবিষ্যতে এই কম্পানিকে তুই কোথায় নিয়ে যেতে চাস। তার ওপরে নির্ভর করবে তোর মাইনে আর বাকি সুযোগ সুবিধে।”
রূপক, “তাহলে একটু খুলেই বল। কত টাকা দিয়ে শুরু করবি। আমি সেই মতন প্রোজেক্ট প্লেন মন দেব।”
অনুপমা একবার দেবায়নের দিকে তাকায়। দেবায়ন বলে, “আমাদের ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট হবে কুড়ি থেকে ত্রিশ কোটি টাকা।”
টাকার অঙ্ক শুনে শ্রেয়া আর রূপক অবাক হয়ে যায়। শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “এত টাকা আসবে কোথা থেকে?”
অনুপমা হেসে বলে, “তুই শুধু এবারে বল যে আমাদের সাথে কি তোরা যোগ দিবি?”
শ্রেয়া একটু ভেবে রূপককে বলে, “তুমি কি ভাবছ?”
রূপক, “আমি ভাবছি পরের কথা। ওরা যে অঙ্ক নিয়ে কোম্পানি শুরু করার কথা ভাবছে। এই কোলকাতা শহরে এই অঙ্কে বেশ বড় কোম্পানি খোলা যাবে।”
দেবায়ন রূপকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “তাহলে কি ভেবে নেব যে তুই আমাদের সাথে আছিস?”
রূপক, “একদম গুরু। আমি যেখানে জয়েন করতাম সেই কোম্পানি ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট করে, ছোটো খাটো সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করে। আমরা সেই পন্থা অবলম্বন করতে পারি। ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট দিয়ে শুরু করতে পারি, সেই সাথে ওয়েবএপ্লিকেশান আছে, বিভিন্ন ছোটো ছোটো কোম্পানির জন্য সফটওয়্যারের কাজ আছে। তুই কিছু জানিস আমি কিছু জানি, বাকি করতে করতে হয়ে যাবে। তবে আমি কয়েক জন সিনিয়ারের সাথে কথা বলে একটা প্রোজেক্ট প্লান করে নেব।”
দেবায়ন, “হ্যাঁ তাহলে তুই একটা প্রোজেক্ট প্লান করে ফেল। ইতিমধ্যে দেখি কাউকে বলে কয়ে যদি বিজনেসের ব্যাপারে কিছু হয়। কোন সফটওয়্যার ডিল যদি করা যায় তাহলে বেশ ভালো হবে।”
শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “আমি কি করব এখানে?”
অনুপমা হেসে ফেলে, “তুমি কি করতে চাও সোনা মণি? তুই মাঝে মাঝে অফিসে এসে রূপককে একটু দেখা দিয়ে যাস তাহলেই হবে।”
শ্রেয়া রূপকের বাজু জড়িয়ে বলে, “কি গো, তোমার সামনে ঘোরাফেরা করলে তুমি কাজ করবে তো?”
চারজনে হেসে ফেলে শ্রেয়ার কথা শুনে। দেবায়ন বলে, “এবারে একটা সিরিয়াস কথা। দ্যাখ তুই আমার কোম্পানিতে চাকরি করবি, সেটা হয় না। চাকরির চেয়ে বড় তুই আমার বন্ধু। আমি ভেবে রেখেছি তুই একজন ডাইরেক্টর হবি এই কোম্পানিতে।”
রূপক অবাক হয়ে যায় দেবায়নের প্রস্তাবে, “তুই সত্যি বলছিস?”
দেবায়ন, “হ্যাঁ। এই কোম্পানির শেয়ার দেব তোকে। আমি তোকে শুধু মাত্র মাইনে দিয়ে রাখব সেটা ভালো নয়। প্রধানত যেখানে তুই আমার জন্য এত করবি।”
রূপক বার কয়েক চোখের পাতা নাড়ায়। শ্রেয়া দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “কত পারসেন্ট শেয়ার পাবে রূপক?”
দেবায়ন বলে, “না আমার পরিকল্পনা একটু ভিন্ন। শ্রেয়া হবে ডাইরেক্টর আর রূপক চাকরি করবে।”
রূপক বুঝতে পারে না। দেবায়ন মিস্টার সেনের সাথে থেকে থেকে ব্যাবসার প্যাঁচ বেশ শিখে গেছে, তবে বন্ধুদের ভালো করতে চায় তাই বলে, “দ্যাখ ভাই। আমি যদি রূপকের নামে শেয়ার দেই তাহলে যতদিন না কোম্পানি লাভের অংশ দেখছে ততদিন শুধু আঙুল চুষে একটা সামান্য মাইনে নিতে হবে। আমি চাইছিলাম যে শেয়ার হবে শ্রেয়ার নামে, তাতে যখন লাভ হবে তখন তোরা মোটা টাকা লাভের অংশ থেকে পাবি। কিন্তু এই কয় বছর চলার জন্য টাকা চাই, তাই রূপককে মাইনে দেওয়া হবে।”
শ্রেয়া জড়িয়ে ধরে দেবায়নকে, “তুই মাল এত বুদ্ধি কোথায় রেখেছিলি রে।”
রূপক মিচকি হেস শ্রেয়াকে বলে, “নৈহাটির রাতে তুমি তো ছিলে না তাই জানো না। ওর মাথায় যে কখন কি আসে সেটা ওই জানে।”
দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “যাই হোক ভাই, সেসব নিয়ে আমার চিন্তা নেই তুই যা ভালো বুঝিস সেটা করিস।”
শ্রেয়া দেবায়নের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, আমি ডাইরেক্টর হব আমাকে একটা কেবিন দিবি?”
অনুপমা হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “কেন মাল কেবিনে বসে কি করবি? রূপকের কোলে বসে থাকবি নাকি?”
শ্রেয়া, “কেন রূপক কেন? কোম্পানির ডাইরেক্টর যখন দেবায়ন, তখন ওর কোলে বসব।”
অনুপমা হেসে বলে, “হে হে সোনা মণি। কোম্পানির ডাইরেক্টর আমি, পুচ্চু নয়। তুই আর আমি ডাইরেক্টর হব আর আমাদের বর গুলো গাধার মতন খাটবে।”
দেবায়ন, “শ্রেয়ার নামে বারো পারসেন্ট শেয়ার থাকবে।”
শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “এত কম, বারো পারসেন্ট কেন?”
অনুপমা, “সবে শুরু। এখন তুই কিছুই পাবি না। রূপকের মাইনে দিতে, বাকিদের মাইনে দিতে হিমশিম খেয়ে যাবো।”
শ্রেয়া রূপককে বলে, “কি গো কিছু বলবে? বন্ধুত্ত এক জায়গায় আর বিজনেস এক জায়গায়। কিন্তু তাই বলে বারো পারসেন্ট?”
দেবায়ন শ্রেয়াকে বুঝিয়ে বলে, “শোন। একবার ব্রেক ইভেনে পৌঁছে গেলে বারো পারসেন্ট অনেক টাকা। আর রূপক প্রতি মাসে ভালো মাইনে পাবে।”
শ্রেয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “না না, বারো পারসেন্ট অনেক কম। আমি গরু নাকি? রূপক প্রোজেক্ট প্লান করবে, রূপক কাজ করবে আর শেয়ারের বেলায় শুধু মাত্র বারো পারসেন্ট। কুড়ি থেকে পঁচিশ না হলে রূপক কাজ করবে না।”
শ্রেয়া মনক্ষুণ্ণ হয়ে যায়।
শ্রেয়ার বেগতিক দেখে দেবায়নের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। টেবিলের তলা দিয়ে অনুপমা ওর হাত চেপে শান্ত করে শ্রেয়াকে বলে, “দ্যাখ ভাই, একা রূপকের মাথায় কাজ হচ্ছে না। আমার পুচ্চুর আর রূপকের মাথা মিলে এই কোম্পানির টেকনিকাল তৈরি হবে। আমি সেই সাথে একটু এডমিনিস্ট্রেসান দেখব, একাউন্টসের জন্য, এইচ.আরের জন্য লোক জন থাকবে। আমাকে পুরোটা খরচ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোম্পানি বড় হলে তখন দেখা যাবে।”
রূপক শ্রেয়াকে বুঝিয়ে বলে, “তোমার একি হল? রাম না হতে রামায়ন কেন গাইছ তুমি? আমি একা ত করছি না। দেবায়নের মাথা লাগছে, অনুপমার টাকা লাগছে। সত্যি কথা বলতে আমাদের গ্যাঁটের থেকে কিছু যাচ্ছেনা একবার ভেবে দেখো। ওরা যে আমাদের একটা এত বড় অফার দিয়েছে সেটাই বড় কথা।”
শ্রেয়া চাপা গলায় বলে, “আমাদের দরকার তাই এসেছে আমাদের কাছে। কিন্তু পনেরো হতেই পারে।”
শ্রেয়ার কথা শুনে দেবায়ন বলতে যাচ্ছিল যে তুই না হলে আমি অন্য কাউকে দেখে নেব। অনুপমা দেবায়নের হাতে চিমটি কেটে চুপ করে যেতে বলে। সূর্য মনিদিপার সময়ে, পায়েলের সময়ে শ্রেয়া ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল। একটা ভালো বান্ধবীকে হারাতে চায় না অনুপমা। অনুপমা তাই কথা না বাড়িয়ে বলে, “ওকে বাবা, পনেরো দেব। এবারে শান্তি? কিন্তু এখুনি পনেরো দিতে পারছি না। দুই বছর যাক তারপরে পারসেন্টেজ বাড়িয়ে দেব।”
রূপক শ্রেয়াকে শান্ত করে বলে, “তুমি না একদম যাতা। আগে কোম্পানি শুরু হোক, টাকা আসুক তারপরে।”
দেবায়নকে বলে, “ভাই তুই যা ভালো বুঝিস সেটা করিস। ওর কথায় বেশি কান দিস না।”
রূপকের কথায় শ্রেয়া একটু আহত হয়। ভেবেছিল রূপক ওর হয়ে কথা বলবে। শ্রেয়ার চেহারায় কালো মেঘের ছায়া দেখে অনুপমা বড় ব্যাথা পায়। বান্ধবী ভেবে ওর সাথে কাজের কথা ভেবেছিল, ভাবেনি যে এর মধ্যেই বিজনেসের প্যাঁচ চলে আসবে। রূপক অনুপমার চোখের ভাষা পড়ে কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করে।
এরপরে একদিন রূপকের সাথে দেবায়ন আর অনুপমা রাসেল স্ট্রিটের অফিস দেখতে যায়। চার হাজার স্কোয়ার ফিটের বেশ বড় অফিস। একি বিল্ডিংয়ে মিস্টার সেনের কন্সট্রাক্সান কোম্পানি। জায়গা দেখার পরে মিস্টার সেনের সাথে কথা বলে ভাড়া এবং বাকি কাজ সেরে ফেলে। এবারে কথা ওঠে লোকজন যোগাড়ের। দেবশ্রী বলেছিল শান্তনু আর মনীষার কথা। দেবশ্রী ওদের দিল্লী থেকে ডেকে পাঠায়। শান্তনু আর মনীষার সাথে দেখা করে সবাই। দেবশ্রী ওদের দেখে ভারী খুশি হয়। মনীষা এইচ.আরের ভার গ্রহন করে আর শান্তনু এডমিন দেখে। শান্তনুর ঘাড়ে অফিস সাজানোর দায়িত্ত পরে। ইলেক্ট্রিকের কাজ, কেবিন, ফারনিচার ইতাদ্যির কাজ শুরু হয়। পাঁচখানা কেবিন, একটা বড় কনফারেন্স হল আর একশ জনের মতন বসার জায়গা করা ঠিক করা হয়। ইতিমধ্যে অনুপমা আর দেবায়নের যৌথ একাউন্টে মিস্টার সেন কুড়ি কোটি টাকা দিয়ে বলেন, ওদের ভবিষ্যৎ এবারে ওদের হাতে, এই টাকা যেন বিচার বিবেচনা মতন খরচ করা হয়। একটা বড় ব্যাঙ্কে কোম্পানি একাউন্ট খোলা হয়। মিস্টার সেন তাঁর অফিসের একাউন্টসের সুজিতকে নিযুক্ত করে অনুপমার কোম্পানির একাউন্টস দেখার জন্য। মারকেটিঙ্গের জন্য দেবশ্রী পুরান অফিসের দীপঙ্কর সরকারকে অফার দেয় দেবায়নের কোম্পানিতে জয়েন করতে।
ইতিমধ্যে রূপক ওর কলেজের সিনিয়ারদের সাথে আলাপ আলোচনা করে একটা প্রোজেক্ট প্লান তৈরি করে কোম্পানির জন্য। কি ভাবে অয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টের কাজ হবে, কি কি সফটওয়্যার লাগবে, ইত্যাদি। রূপক আর দেবায়ন সেই প্রোজেক্ট প্লান মাকে দেখায়। দেবশ্রী ছেলে মেয়েদের উৎসাহ উদ্দিপনা দেখে খুশি হয়ে বলেন যে তাঁর আশীর্বাদ সবসময়ে ওদের সাথে আছে। কোম্পানির একটা নাম ঠিক করা হয় আর কাজের জন্য লোক নিযুক্ত করা শুরু হয়। ওরা চারজনে ঠিক করে যে পুজোর আগেই কোম্পানির কাজ শুরু করে দেবে। সেই মতন বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার সাথে কাজ শুরু হয়। অফিস সাজানো, ফারনিচার, ইত্যাদিতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। ছোটো অফিস, পুজোর আগেই ভরে ওঠে লোকে। রূপকের তত্তাবধনে থাকে টেকনিকাল, শ্রেয়া নামেই ডাইরেক্টর। অনুপমা আর দেবায়নের ঘাড়ে সব কিছু দেখার ভার এসে পরে। দেবায়ন বুঝতে পারে যে ভবিষ্যতে শ্রেয়াকে নিয়ে কোম্পানির মধ্যে একটা গণ্ডগোল পাকাতে পারে। ওদের কম্পিউটার শিক্ষিকা মিস সুপর্ণা চ্যাটারজির কথা মাথায় আসে। অনুপমা আর দেবায়ন, সুপর্ণাকে অনুরোধ করে ওদের কোম্পানিতে জয়েন করার জন্য। দেবায়নের কথা শুনে সুপর্ণা যেন আকাশ থেকে পরে। অনুপমা সুপর্ণাকে রাজি করায়, ম্যাডাম অনেকদিন থেকে কম্পিউটার ফিল্ডে আছে, তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায়। সুপর্ণা ওদের কোম্পানিতে সি.টি.ও হিসাবে জয়েন করে।
পুজোর আগেই ওদের ছোটো কোম্পানিতে কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিনে, সব বন্ধুদের ডাকে। দেবায়ন আর অনুপমার সাথে সাথে রূপক আর শ্রেয়ার পরিবারের সকলে উপস্থিত। দেবশ্রী আর পারমিতা বেশ খুশি, ছেলে মেয়ে নিজের চেষ্টায় একটা বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে।
মায়ের সম্মতি পেয়ে দেবায়ন খুব খুশি। দেবশ্রী ছেলেকে শুধু একটা কথা বলে, এই টাকা পয়সা, নাম যশে যেন নিজের মান সন্মান বজায় রেখে চলে। মাকে জড়িয়ে ধরে দেবায়ন আসস্থ করে। দেবশ্রী জানায় ওদের দিল্লী অফিসে একটা ছেলে এডমিনে ছিল, নাম শান্তনু দুবে। ছেলেটা বিহারী কিন্তু আসানসোলে বাড়ি। দেবশ্রীর আগের অফিসের কাজ ছেড়ে দিয়েছে এবং দিল্লীতেই চাকরি করছে কিন্তু কোলকাতা ফিরতে চায়, বাড়ির কাছে কোথাও চাকরি করতে চায়। দেবায়নের সফটওয়্যার ফার্ম হলে ওকে যেন একটা কাজ দেয়। সেই সাথে শান্তনুর স্ত্রী, মনীষা জিন্টা সে আগে দেবশ্রীর নিচে কাজ করত। এইচ.আর হিসাবে সে ভালোই কাজ করবে। দেবায়ন জানিয়ে দেয়, ওদের ফার্মে লোকজনের দরকার পড়বে, চেনাজানা হলে ভালো হয়।
মিস্টার সেন নিজের চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি ব্যাবসা দেখতে শুরু করে দিয়েছেন। পুরানো গাড়ি বিক্রি করে দুটো গাড়ি কেনা হয়। একটা অনুপমার বাড়ির জন্য টয়োটা ক্যামরি আর মিস্টার সেন নিজের জন্য কেনেন, অডি এ-সিক্স। দেবায়ন বলে, নিজের জন্য পরে গাড়ি কিনবে। এখন ওর বুলেটে ঘোরার শখ কমেনি। গাড়ি থাকলেও অনুপমা ওর সাথেই বাইকে চেপে সব জায়গায় যায়। অনুপমার গাড়ি বেশির ভাগ দিন বাড়িতেই থাকে।
এক বছর বাদ গেছে পায়েলের। তবে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে আশেপাশের আবহাওয়ার সাথে। অনুপমা ওকে কলেজে পৌঁছে দিয়ে তারপরে দেবায়নের সাথে কাজে বের হয়। বিকেলে গাড়ি ওকে কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে আসে। পায়েলের দৌড় এই বাড়ি থেকে কলেজ আর কলেজ থেকে বাড়ি। এছাড়া কোথাও বের হতে চায় না।
এক বিকেলে মিস্টার সেন দেবায়নের সাথে এই সফটওয়্যার ফার্মের ব্যাপারে আলোচনা করে বুঝিয়ে দেয় কার সাথে কি ভাবে কথা বলে বশ করবে। মিস্টার সেন বলেন যে, ফার্ম প্রাইভেট লিমিটেড করতে হলে কমপক্ষে তিন জন ডাইরেক্টর চাই। অনুপমাকে ডাইরেক্টর করে দিলে ভালো। কারন ডাইরেক্টর লাভের অংশ পাবে এবং সাথে সাথে মাইনে। কিন্তু শুরুতে যতদিন না কোম্পানি ব্রেক ইভেনে পৌছাবে ততদিন বাকিদের খাতিরে অনুপমা কোন মাইনে নেবে না। দেবায়ন যদি মাইনে নিয়ে চাকরি করে তাহলে বিয়ের পরে টাকার সমস্যা থাকবে না। দেবায়ন বুঝতে পারল এই কোম্পানির প্যাঁচ। মিস্টার সেন আরো জানালেন যে, শ্রেয়ার সাথে ঠিক যেন সেই রকম করে। শ্রেয়াকে যেন বেশি শেয়ার না দেয়, কারন টাকা লাগাবে মিস্টার সেন, বুদ্ধি আর মাথা লাগাবে দেবায়ন। শ্রেয়ার নামে দশ থেকে বারো শতাংশ দিলেই হবে। যদি রূপক অন্য কোথাও চাকরি করতে চায় তাহলে অন্য কিছু ভাববে এই সফটওয়্যার ফার্মের ব্যাপারে। সবকিছু বুঝে শুনে যেন কথাবার্তা বলে দেবায়ন আর অনুপমা। ব্যাবসা এক জিনিস আর বন্ধুত্ত অন্য। ব্যাবসার মধ্যে বন্ধুত্ত আনা ভালো কিন্তু একটা সীমা পর্যন্ত। তৃতীয় ডাইরেক্টর হিসাবে মিস্টার সেন থাকবেন।
মিস্টার সেন আরো জানান, যে প্রথমে একটা অফিসের জন্য জায়গা যোগাড় করতে হবে। কোম্পানির নাম রেজিসস্টার করাতে হবে, সব ডাইড়েক্টর দের নাম ধাম দিতে হবে। তারপরের বিজনেশ আর জনবল যোগাড় করা। মিস্টার সেন বললেন, শুরু দিকে ওদের আগের কোম্পানির যে ছেলেটা একাউন্টস দেখত তাকে দিয়ে কাজ করাবেন। দেবায়ন বলে, মা একজন এইচ.আর এর কথা বলেছে। বিজনেসের জন্য মিস্টার সেন খুঁজবেন, কারন সফটওয়্যার মারকেটিং আর অন্য মারকেটিঙ্গের মধ্যে অনেক তফাত। সময়ের আগেই সব যোগাড় করে নেবেন। মিস্টার সেন বললেন দেবায়ন বড় হয়ে গেছে, এবারে যেন নিজের ভালো মন্দ বুঝে শুনে সবার সাথে এই ব্যাবসা আর বাকি কাজ নিয়ে কথাবার্তা বলে।
দেবায়ন মিস্টার সেনকে জিজ্ঞেস করে নিবেদিতার কোম্পানির ব্যাপারে। মিস্টার সেন বলেন যে ওদের কন্সট্রাক্সান কোম্পানির জন্য মিস্টার সেন ডাইরকেটর যোগাড় করেছেন। যাদের সাথে এতদিন কাজ করে এসেছিলেন তাদের মধ্যে দুই জনকে নিয়েছেন। তাদের নামে শেয়ার নেই, তারা নামেই ডাইরেক্টর। আর নিবেদিতার কোম্পানির জন্য মিস্টার সেন চল্লিশ কোটি টাকা দিয়েছে। নিবেদিতা মিন্টো পার্কের কাছে অফিস নিয়েছে। মিস্টার সেন বলেন, ওদের এই গ্রুপ কোম্পানির জন্য রাসেল স্ট্রিটের পুরনো অফিসের নিচের তলায় অফিস খুলতে। মিস্টার সেন বলেন শ্রেয়া আর রূপকের সাথে কথাবার্তা বলার পরে ওরা নিজেরাই এইসব দেখতে যেতে পারে। ওদের সাথে নিয়ে গেলে ওদের ভালো লাগবে, ওরা বুঝবে যে ওদের কথার দাম দেওয়া হয়েছে। এই ভাবে মানুষকে বশে করা যায়। দেবায়ন হেসে ফেলে মিস্টার সেনের কথা শুনে।
একদিন বিকেলে শ্রেয়া আর রূপকের সাথে আলোচনায় বসে দেবায়ন আর অনুপমা।
দেবায়ন প্রথম কথা শুরু করে, “আমি আর অনুপমা ঠিক করেছি একটা সফটওয়্যার ফার্ম খুলব।”
রূপক, “হ্যাঁ, শ্রেয়া আমাকে জানিয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু আমি মুম্বাইয়ে একটা বড় সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি।”
দেবায়ন আর অনুপমা পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করে। রূপক বলে, “আগে তোদের পুরো পরিকল্পনা শুনি তারপরে সিদ্ধান্ত নেব কোথায় জয়েন করব। তোদের কাছে কি কোন প্রোজেক্ট প্লান আছে এই কোম্পানির ব্যাপারে? মানে কি নিয়ে কোম্পানি বিজনেস করবে, কি কি প্রোডাক্ট হবে এই সব আর কি?”
অনুপমা আর দেবায়ন মাথা নাড়ায়, “না ওই সব ব্যাপারে কিছু জানি না বলেই তোকে ডাকা।”
রূপক হেসে দেয়, “তার মানে আমার সাহায্য চাই। কিন্তু এতে আমাদের লাভ?”
অনুপমা বলে, “লাভ মানে, তুমি আমাদের সাথে থাকবে। এই কোম্পানির এক অংশীদার হবে।”
রূপক শ্রেয়ার দিকে তাকায়। শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “টাকা কে দেবে?”
অনুপমা, “টাকার কথা চিন্তা করিস না। টাকা আমি আর দেবায়ন যোগাড় করে নেব। তোরা শুধু এই টুকু জানা যে তোরা কি আমাদের সাথে থাকবি?”
রূপক একভার শ্রেয়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আমি মুম্বাইয়ে যে কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছি সেই কোম্পানি দুশো কোটি টাকার কোম্পানি। আমার জয়েনিং স্যালারি পঁচিশ হাজার এবং সাথে আরও অনেক সুযোগ সুবিধে আছে।”
দেবায়ন হেসে বলে, “দ্যাখ ভাই, আমি এখুনি বলছি না যে আমরা তোকে ওই মাইনে দিতে পারব। তবে তোর ওপরে নির্ভর করবে ভবিষ্যতে এই কম্পানিকে তুই কোথায় নিয়ে যেতে চাস। তার ওপরে নির্ভর করবে তোর মাইনে আর বাকি সুযোগ সুবিধে।”
রূপক, “তাহলে একটু খুলেই বল। কত টাকা দিয়ে শুরু করবি। আমি সেই মতন প্রোজেক্ট প্লেন মন দেব।”
অনুপমা একবার দেবায়নের দিকে তাকায়। দেবায়ন বলে, “আমাদের ইনিশিয়াল ইনভেস্টমেন্ট হবে কুড়ি থেকে ত্রিশ কোটি টাকা।”
টাকার অঙ্ক শুনে শ্রেয়া আর রূপক অবাক হয়ে যায়। শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “এত টাকা আসবে কোথা থেকে?”
অনুপমা হেসে বলে, “তুই শুধু এবারে বল যে আমাদের সাথে কি তোরা যোগ দিবি?”
শ্রেয়া একটু ভেবে রূপককে বলে, “তুমি কি ভাবছ?”
রূপক, “আমি ভাবছি পরের কথা। ওরা যে অঙ্ক নিয়ে কোম্পানি শুরু করার কথা ভাবছে। এই কোলকাতা শহরে এই অঙ্কে বেশ বড় কোম্পানি খোলা যাবে।”
দেবায়ন রূপকের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে, “তাহলে কি ভেবে নেব যে তুই আমাদের সাথে আছিস?”
রূপক, “একদম গুরু। আমি যেখানে জয়েন করতাম সেই কোম্পানি ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট করে, ছোটো খাটো সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট করে। আমরা সেই পন্থা অবলম্বন করতে পারি। ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট দিয়ে শুরু করতে পারি, সেই সাথে ওয়েবএপ্লিকেশান আছে, বিভিন্ন ছোটো ছোটো কোম্পানির জন্য সফটওয়্যারের কাজ আছে। তুই কিছু জানিস আমি কিছু জানি, বাকি করতে করতে হয়ে যাবে। তবে আমি কয়েক জন সিনিয়ারের সাথে কথা বলে একটা প্রোজেক্ট প্লান করে নেব।”
দেবায়ন, “হ্যাঁ তাহলে তুই একটা প্রোজেক্ট প্লান করে ফেল। ইতিমধ্যে দেখি কাউকে বলে কয়ে যদি বিজনেসের ব্যাপারে কিছু হয়। কোন সফটওয়্যার ডিল যদি করা যায় তাহলে বেশ ভালো হবে।”
শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “আমি কি করব এখানে?”
অনুপমা হেসে ফেলে, “তুমি কি করতে চাও সোনা মণি? তুই মাঝে মাঝে অফিসে এসে রূপককে একটু দেখা দিয়ে যাস তাহলেই হবে।”
শ্রেয়া রূপকের বাজু জড়িয়ে বলে, “কি গো, তোমার সামনে ঘোরাফেরা করলে তুমি কাজ করবে তো?”
চারজনে হেসে ফেলে শ্রেয়ার কথা শুনে। দেবায়ন বলে, “এবারে একটা সিরিয়াস কথা। দ্যাখ তুই আমার কোম্পানিতে চাকরি করবি, সেটা হয় না। চাকরির চেয়ে বড় তুই আমার বন্ধু। আমি ভেবে রেখেছি তুই একজন ডাইরেক্টর হবি এই কোম্পানিতে।”
রূপক অবাক হয়ে যায় দেবায়নের প্রস্তাবে, “তুই সত্যি বলছিস?”
দেবায়ন, “হ্যাঁ। এই কোম্পানির শেয়ার দেব তোকে। আমি তোকে শুধু মাত্র মাইনে দিয়ে রাখব সেটা ভালো নয়। প্রধানত যেখানে তুই আমার জন্য এত করবি।”
রূপক বার কয়েক চোখের পাতা নাড়ায়। শ্রেয়া দেবায়নকে জিজ্ঞেস করে, “কত পারসেন্ট শেয়ার পাবে রূপক?”
দেবায়ন বলে, “না আমার পরিকল্পনা একটু ভিন্ন। শ্রেয়া হবে ডাইরেক্টর আর রূপক চাকরি করবে।”
রূপক বুঝতে পারে না। দেবায়ন মিস্টার সেনের সাথে থেকে থেকে ব্যাবসার প্যাঁচ বেশ শিখে গেছে, তবে বন্ধুদের ভালো করতে চায় তাই বলে, “দ্যাখ ভাই। আমি যদি রূপকের নামে শেয়ার দেই তাহলে যতদিন না কোম্পানি লাভের অংশ দেখছে ততদিন শুধু আঙুল চুষে একটা সামান্য মাইনে নিতে হবে। আমি চাইছিলাম যে শেয়ার হবে শ্রেয়ার নামে, তাতে যখন লাভ হবে তখন তোরা মোটা টাকা লাভের অংশ থেকে পাবি। কিন্তু এই কয় বছর চলার জন্য টাকা চাই, তাই রূপককে মাইনে দেওয়া হবে।”
শ্রেয়া জড়িয়ে ধরে দেবায়নকে, “তুই মাল এত বুদ্ধি কোথায় রেখেছিলি রে।”
রূপক মিচকি হেস শ্রেয়াকে বলে, “নৈহাটির রাতে তুমি তো ছিলে না তাই জানো না। ওর মাথায় যে কখন কি আসে সেটা ওই জানে।”
দেবায়নের দিকে তাকিয়ে বলে, “যাই হোক ভাই, সেসব নিয়ে আমার চিন্তা নেই তুই যা ভালো বুঝিস সেটা করিস।”
শ্রেয়া দেবায়নের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁ রে, আমি ডাইরেক্টর হব আমাকে একটা কেবিন দিবি?”
অনুপমা হেসে ফেলে ওর কথা শুনে, “কেন মাল কেবিনে বসে কি করবি? রূপকের কোলে বসে থাকবি নাকি?”
শ্রেয়া, “কেন রূপক কেন? কোম্পানির ডাইরেক্টর যখন দেবায়ন, তখন ওর কোলে বসব।”
অনুপমা হেসে বলে, “হে হে সোনা মণি। কোম্পানির ডাইরেক্টর আমি, পুচ্চু নয়। তুই আর আমি ডাইরেক্টর হব আর আমাদের বর গুলো গাধার মতন খাটবে।”
দেবায়ন, “শ্রেয়ার নামে বারো পারসেন্ট শেয়ার থাকবে।”
শ্রেয়া জিজ্ঞেস করে, “এত কম, বারো পারসেন্ট কেন?”
অনুপমা, “সবে শুরু। এখন তুই কিছুই পাবি না। রূপকের মাইনে দিতে, বাকিদের মাইনে দিতে হিমশিম খেয়ে যাবো।”
শ্রেয়া রূপককে বলে, “কি গো কিছু বলবে? বন্ধুত্ত এক জায়গায় আর বিজনেস এক জায়গায়। কিন্তু তাই বলে বারো পারসেন্ট?”
দেবায়ন শ্রেয়াকে বুঝিয়ে বলে, “শোন। একবার ব্রেক ইভেনে পৌঁছে গেলে বারো পারসেন্ট অনেক টাকা। আর রূপক প্রতি মাসে ভালো মাইনে পাবে।”
শ্রেয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “না না, বারো পারসেন্ট অনেক কম। আমি গরু নাকি? রূপক প্রোজেক্ট প্লান করবে, রূপক কাজ করবে আর শেয়ারের বেলায় শুধু মাত্র বারো পারসেন্ট। কুড়ি থেকে পঁচিশ না হলে রূপক কাজ করবে না।”
শ্রেয়া মনক্ষুণ্ণ হয়ে যায়।
শ্রেয়ার বেগতিক দেখে দেবায়নের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। টেবিলের তলা দিয়ে অনুপমা ওর হাত চেপে শান্ত করে শ্রেয়াকে বলে, “দ্যাখ ভাই, একা রূপকের মাথায় কাজ হচ্ছে না। আমার পুচ্চুর আর রূপকের মাথা মিলে এই কোম্পানির টেকনিকাল তৈরি হবে। আমি সেই সাথে একটু এডমিনিস্ট্রেসান দেখব, একাউন্টসের জন্য, এইচ.আরের জন্য লোক জন থাকবে। আমাকে পুরোটা খরচ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোম্পানি বড় হলে তখন দেখা যাবে।”
রূপক শ্রেয়াকে বুঝিয়ে বলে, “তোমার একি হল? রাম না হতে রামায়ন কেন গাইছ তুমি? আমি একা ত করছি না। দেবায়নের মাথা লাগছে, অনুপমার টাকা লাগছে। সত্যি কথা বলতে আমাদের গ্যাঁটের থেকে কিছু যাচ্ছেনা একবার ভেবে দেখো। ওরা যে আমাদের একটা এত বড় অফার দিয়েছে সেটাই বড় কথা।”
শ্রেয়া চাপা গলায় বলে, “আমাদের দরকার তাই এসেছে আমাদের কাছে। কিন্তু পনেরো হতেই পারে।”
শ্রেয়ার কথা শুনে দেবায়ন বলতে যাচ্ছিল যে তুই না হলে আমি অন্য কাউকে দেখে নেব। অনুপমা দেবায়নের হাতে চিমটি কেটে চুপ করে যেতে বলে। সূর্য মনিদিপার সময়ে, পায়েলের সময়ে শ্রেয়া ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল। একটা ভালো বান্ধবীকে হারাতে চায় না অনুপমা। অনুপমা তাই কথা না বাড়িয়ে বলে, “ওকে বাবা, পনেরো দেব। এবারে শান্তি? কিন্তু এখুনি পনেরো দিতে পারছি না। দুই বছর যাক তারপরে পারসেন্টেজ বাড়িয়ে দেব।”
রূপক শ্রেয়াকে শান্ত করে বলে, “তুমি না একদম যাতা। আগে কোম্পানি শুরু হোক, টাকা আসুক তারপরে।”
দেবায়নকে বলে, “ভাই তুই যা ভালো বুঝিস সেটা করিস। ওর কথায় বেশি কান দিস না।”
রূপকের কথায় শ্রেয়া একটু আহত হয়। ভেবেছিল রূপক ওর হয়ে কথা বলবে। শ্রেয়ার চেহারায় কালো মেঘের ছায়া দেখে অনুপমা বড় ব্যাথা পায়। বান্ধবী ভেবে ওর সাথে কাজের কথা ভেবেছিল, ভাবেনি যে এর মধ্যেই বিজনেসের প্যাঁচ চলে আসবে। রূপক অনুপমার চোখের ভাষা পড়ে কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা বলতে শুরু করে।
এরপরে একদিন রূপকের সাথে দেবায়ন আর অনুপমা রাসেল স্ট্রিটের অফিস দেখতে যায়। চার হাজার স্কোয়ার ফিটের বেশ বড় অফিস। একি বিল্ডিংয়ে মিস্টার সেনের কন্সট্রাক্সান কোম্পানি। জায়গা দেখার পরে মিস্টার সেনের সাথে কথা বলে ভাড়া এবং বাকি কাজ সেরে ফেলে। এবারে কথা ওঠে লোকজন যোগাড়ের। দেবশ্রী বলেছিল শান্তনু আর মনীষার কথা। দেবশ্রী ওদের দিল্লী থেকে ডেকে পাঠায়। শান্তনু আর মনীষার সাথে দেখা করে সবাই। দেবশ্রী ওদের দেখে ভারী খুশি হয়। মনীষা এইচ.আরের ভার গ্রহন করে আর শান্তনু এডমিন দেখে। শান্তনুর ঘাড়ে অফিস সাজানোর দায়িত্ত পরে। ইলেক্ট্রিকের কাজ, কেবিন, ফারনিচার ইতাদ্যির কাজ শুরু হয়। পাঁচখানা কেবিন, একটা বড় কনফারেন্স হল আর একশ জনের মতন বসার জায়গা করা ঠিক করা হয়। ইতিমধ্যে অনুপমা আর দেবায়নের যৌথ একাউন্টে মিস্টার সেন কুড়ি কোটি টাকা দিয়ে বলেন, ওদের ভবিষ্যৎ এবারে ওদের হাতে, এই টাকা যেন বিচার বিবেচনা মতন খরচ করা হয়। একটা বড় ব্যাঙ্কে কোম্পানি একাউন্ট খোলা হয়। মিস্টার সেন তাঁর অফিসের একাউন্টসের সুজিতকে নিযুক্ত করে অনুপমার কোম্পানির একাউন্টস দেখার জন্য। মারকেটিঙ্গের জন্য দেবশ্রী পুরান অফিসের দীপঙ্কর সরকারকে অফার দেয় দেবায়নের কোম্পানিতে জয়েন করতে।
ইতিমধ্যে রূপক ওর কলেজের সিনিয়ারদের সাথে আলাপ আলোচনা করে একটা প্রোজেক্ট প্লান তৈরি করে কোম্পানির জন্য। কি ভাবে অয়েবসাইট ডেভেলপমেন্টের কাজ হবে, কি কি সফটওয়্যার লাগবে, ইত্যাদি। রূপক আর দেবায়ন সেই প্রোজেক্ট প্লান মাকে দেখায়। দেবশ্রী ছেলে মেয়েদের উৎসাহ উদ্দিপনা দেখে খুশি হয়ে বলেন যে তাঁর আশীর্বাদ সবসময়ে ওদের সাথে আছে। কোম্পানির একটা নাম ঠিক করা হয় আর কাজের জন্য লোক নিযুক্ত করা শুরু হয়। ওরা চারজনে ঠিক করে যে পুজোর আগেই কোম্পানির কাজ শুরু করে দেবে। সেই মতন বিপুল উৎসাহ উদ্দিপনার সাথে কাজ শুরু হয়। অফিস সাজানো, ফারনিচার, ইত্যাদিতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। ছোটো অফিস, পুজোর আগেই ভরে ওঠে লোকে। রূপকের তত্তাবধনে থাকে টেকনিকাল, শ্রেয়া নামেই ডাইরেক্টর। অনুপমা আর দেবায়নের ঘাড়ে সব কিছু দেখার ভার এসে পরে। দেবায়ন বুঝতে পারে যে ভবিষ্যতে শ্রেয়াকে নিয়ে কোম্পানির মধ্যে একটা গণ্ডগোল পাকাতে পারে। ওদের কম্পিউটার শিক্ষিকা মিস সুপর্ণা চ্যাটারজির কথা মাথায় আসে। অনুপমা আর দেবায়ন, সুপর্ণাকে অনুরোধ করে ওদের কোম্পানিতে জয়েন করার জন্য। দেবায়নের কথা শুনে সুপর্ণা যেন আকাশ থেকে পরে। অনুপমা সুপর্ণাকে রাজি করায়, ম্যাডাম অনেকদিন থেকে কম্পিউটার ফিল্ডে আছে, তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চায়। সুপর্ণা ওদের কোম্পানিতে সি.টি.ও হিসাবে জয়েন করে।
পুজোর আগেই ওদের ছোটো কোম্পানিতে কাজ শুরু হয়ে যায়। প্রথম দিনে, সব বন্ধুদের ডাকে। দেবায়ন আর অনুপমার সাথে সাথে রূপক আর শ্রেয়ার পরিবারের সকলে উপস্থিত। দেবশ্রী আর পারমিতা বেশ খুশি, ছেলে মেয়ে নিজের চেষ্টায় একটা বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই দাঁড় করাতে চেষ্টা করছে।