29-09-2020, 12:29 AM
বিংশ পর্ব (#07)
দেবায়নের ঘুম কেটে গিয়ে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “কি হয়েছে পায়েলের?”
অনুপমা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “পায়েলের খবর পাওয়া গেছে, তুমি এখুনি আমার বাড়িতে এসো।”
দেবায়ন মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী ওর জন্য জামা প্যান্ট নিয়ে তৈরি। দেবশ্রী, দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “মেয়েটাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আয় আর যারা এর পেছনে আছে তাদের ছাড়িস না।”
দেবায়ন, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি যখন একবার বলে দিয়েছ, তাহলে আর সেই শয়তানদের রক্ষে নেই।”
রাত তখন বারোটা বাজে। বাইক নিয়ে অনুপমার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে দেবায়ন। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই রূপক আর ধিমানকে ফোনে করে অনুপমার বাড়িতে যেতে বলে, জানিয়ে দেয় যে পায়েলের খবর পাওয়া গেছে। রূপক জানায় যে শ্রেয়া ওকে জানিয়েছে, সেই মতন ও শ্রেয়াকে নিয়ে অনুপমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ধিমান জানিয়ে দেয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ও অনুপমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে।
বাইকের শব্দ শুনে অনুপমা দৌড়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বসার ঘরে ঢুকে দেখে যে শ্রেয়া, রূপক, ধিমান, সঙ্গীতা সবাই পৌঁছে গেছে। পারমিতা অঙ্কনকে জড়িয়ে ধরে একধারে বসে। মিস্টার সেন, চুপ করে সোফার উপরে বসে আছেন। অঙ্কন চুপ করে গুম মেরে সবার দিকে তাকিয়ে। দেবায়ন জিজ্ঞেস করে অনুপমাকে, কি খবর।
অঙ্কন বলে, “এই কিছু আগে, মানে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমার কাছে একটা ফোন আসে। কার ফোন জানি না। সেই লোকটা আমাকে ফোনে বলল যে একটা মেয়ে ওকে আমার নাম্বার দিয়ে সাহায্য চেয়েছে। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে ওই মেয়েটা মিষ্টি ছাড়া আর কেউ নয়। আমি এখুনি যাবো সেই লোকটার সাথে দেখা করতে আর মিষ্টি কে বাঁচাতে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “তুই কোথায় যাবি? লোকটা কে, কোথা থেকে ফোন করেছে কিছু জানিস? এত রাতে হয়ত কোন শত্রুর চাল হতে পারে। কি করে বিশ্বাস করা যায় যে লোক’টা সত্যি কথা বলছে?”
অঙ্কন রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে ওঠে, “দিদির কিছু হলে তুমি কি করতে? এই রকম ভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে?” পারমিতা ছেলেকে শান্ত হতে বলে। অঙ্কন বলে, “আমার মন বলছে যে লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না। লোকটা নৈহাটির কাছাকাছি, মালঞ্চ নামে একটা গ্রাম থেকে ফোন করেছে। আমি যেতে চাই দেবায়নদা, মিষ্টি আমাকে ডাকছে। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে এর পেছনে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর হাত আছে। লোকটা যেই হোক আমি মিষ্টিকে বাঁচাতে যাচ্ছি। আমি ওকে বলেছি যে আমি আসছি। লোকটা আমাকে বলেছে যে কল্যাণী হাইওয়ের মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।”
দেবায়ন বলে, “ঠিক আছে। লোকটার ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
অঙ্কন দেবায়নকে সেই আগন্তুকের ফোন নাম্বার দেয়। রূপক ধিমানকে বলে যে এক বার ঋতুপর্ণাকে খবর দিতে, কারন লোকটা জানিয়েছে যে পায়েলের শরীর খুব খারাপ, কথা বলার মতন শক্তি নেই, ঋতুপর্ণার দরকার লাগতে পারে। ধিমান ঋতুপর্ণাকে মেস থেকে নিয়ে আসতে বেড়িয়ে পরে।
দেবায়ন আগন্তুককে ফোন করে, “আপনি কে? আপনি এত রাতে পায়েলের খবর কি করে জানলেন?”
ওপর পাশে সম্পূর্ণ গ্রাম্য কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে, “বাবু, আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন, নাইলে মেয়েডা মারা যাবে। আপনারা আসুন তারপরে আমি সব জানাবো। বাবু আমি চোর কিন্তু কোন মেয়ের ইজ্জত চুরি করিনা। বাবু আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।”
লোকটার কণ্ঠ স্বর শুনে দেবায়ন বুঝতে পারে যে হয়ত লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না।
রূপক জিজ্ঞেস করে লোকটা কি বলল, দেবায়ন সবাইকে বলে যে ওদের বের হতে হবে নৈহাটির উদ্দেশ্যে। দেবায়ন অনুপমাকে বলে যে একবার পরাশরকে ফোনে জানিয়ে দিতে যাতে ও জারিনার বাবাকে বলে রাখে। পায়েলকে কি রকম অবস্থায় পাবে জানে না, ডাক্তারের দরকার পড়তে পারে। অনুপমা সোজা জারিনাকে ফোন করে। জারিনা জানিয়ে দেয় যে ওর আব্বুকে সব জানিয়ে দেবে। জারিনা পরাশরকে ফোনে সব ঘটনা জানায়। পরাশর দেবায়নকে ফোনে জিজ্ঞেস করে যে দরকার পড়লে কাকাকে নিয়ে চলে আসবে। দেবায়ন বলে যে এখুনি কোন দরকার নেই পুলিশের, আগে পায়েলকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসুক তারপরে পুলিশে দেবে না নিজেরা বিচার করবে সেটা পরের ব্যাপার।
অনুপমার বাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে রণক্ষেত্রের পরিচালনা গৃহ হয়ে ওঠে। সঙ্গীতা ওর মামাতো দাদা, রুদ্রকে ফোনে সব জানিয়ে দেয়। রুদ্র জানিয়ে দেয় ওর বন্ধু বান্ধব নিয়ে কল্যাণী হাইওয়ের মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। ধিমান কিছুক্ষণের মধ্যে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে উপস্থিত। ঋতুপর্ণা বেশ কয়েকটা স্যালাইন আর কিছু ইঞ্জেকশান, একটা আইস বক্সে নিয়ে এসেছে। দেবায়ন, অনুপমা আর শ্রেয়াকে বাড়িতে থাকতে বলে। দেবায়ন জানায় যে ওইখানে মারামারির মধ্যে মেয়েদের গিয়ে প্রয়োজন নেই। অনুপমা নাছোরবান্দা, পায়েলের সাথে যারা এই সব করেছে তাদের নিজে হাতে খুন করবে। পারমিতা আর শ্রেয়া কিছুতেই অনুপমাকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত দেবায়ন ধমক দেয় অনুপমাকে। ধমক খেয়ে থমথমে মুখে চুপচাপ বসে পরে অনুপমা। অঙ্কন যাবেই, ওকে বারন করা ঠিক হবে না বলে দেবায়ন ওকে আর বারন করে না। অনুপমাদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, তাই ধিমান একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করেছে। রূপক বলে যে শুধু সঙ্গীতার ফোন ছাড়া বাকি সবার ফোন অনুপমার বাড়িতে রেখে যেতে।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটার মধ্যে সবাই বেড়িয়ে পরে নৈহাটির উদ্দেশ্যে।
অনুপমা দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, “তুমি পায়েলকে বাঁচিয়ে নিয়ে এস। ও হয়ত জানে না যে ওর মা মারা গেছে। আমি ওকে আমার সব দিয়ে দেব, শুধু আমার বান্ধবীকে ফিরিয়ে নিয়ে এস।” চোখ মুছে বলে, “শয়তান গুলোকে ছেরো না একদম।”
দেবায়ন পারমিতাকে বলে, “মা এক কথা বলেছে, চিন্তা করো না। পায়েলকে নিয়ে আসব আর সেই সাথে বাকিদের ওইখানে কবর দিয়ে আসব।”
একটা সুমোর মধ্যে, দেবায়ন, রুপক, ঋতুপর্ণা, সঙ্গীতা আর অঙ্কন। ধিমানের হাতে স্টিয়ারিং, ছয়জনে বেড়িয়ে পরে নৈহাটির উদ্দেশ্যে। জানে না কি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকার কেটে, গাড়ি দ্রুত গতিতে নৈহাটির দিকে ধেয়ে চলে। সময়ের সাথে ওদের লড়াই, দেরি হলে যদি পায়েলকে বাঁচান না যায় সেই চিন্তায় দেবায়ন ঘেমে যায়, ধিমান পাগলের মতন গাড়ি চালায়। চারপাশে ঘন কালো আঁধার, রাস্তায় শুধু ট্রাক ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যারাকপুর ছাড়িয়ে যায়। ব্যারাকপুর পার হতেই সঙ্গীতার কাছে ওর দাদার ফোন আসে। সঙ্গীতা জানায় ওর দাদা, রুদ্রর সাথে সেই লোকটার দেখা হয়েছে। লোকটা সত্যি কথাই বলছে, না হলে এত রাতে কল্যাণী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত না। ওদের জন্য সবাই ওখানে অপেক্ষায় আছে। তীব্র গতিতে গাড়ি চালায় ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা নৈহাটির কল্যাণী রোডের মোড়ে পৌঁছে যায়।
রুদ্র, ওদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছিল। সাথে প্রায় আরও দশ বারোটা ছেলে, সবার হাতে কিছু না কিছু, কারুর হাতে লাঠি, কারুর হাতে বড় ছুরি, কারুর হাতে দা। সবাই তৈরি এক রক্তাক্ত যুদ্ধের জন্য। রুদ্রকে দেখে সঙ্গীতা দৌড়ে যায়। গাড়ি থেকে দুটি মেয়েকে নামতে দেখে রুদ্র একটু ঘাবড়ে যায় বিশেষ করে ওর বোনকে দেখে। রুদ্র সঙ্গীতাকে আসার কারন জিজ্ঞেস করে। সঙ্গীতা জানায় যে পায়ল কে বাঁচাতে এসেছে। রুদ্র সেই আগন্তুককে ধরে এনে দেবায়নের সামনে এনে দাঁড় করায়। দেবায়ন তাকে সব ঘটনা জিজ্ঞেস করে।
অগন্তুক বলে, “বাবু আমি ছিঁচকে এক চোর, নাম জেনে আর কি হবে তাও বলি, আমার নাম শ্যাম। পুজোর মরশুম গ্রামের মানুষের কাছে পয়সা আসে এই সময়ে। গ্রামের দিকের সবার বাড়ি ঘরদোর আমার চেনা। ওই মালঞ্চের দিকে থাকি আমি। ওইখানে সমীর বাবুর অনেক জমিজমা, আম বাগান আর ফলের বাগান আছে। বেশ বড় লোক চাষা। বাগানের মাঝে ওদের একটা বেড়ার বাড়ি আছে যেখানে গরম কালে ওদের লোকেরা বাগান পাহারা দেবার জন্য থাকে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “এই সমীর বাবু কে?”
রুদ্র উত্তর দেয়, “অগ্নিহোত্রীর বাবার নাম সমীর। অনেক জমিজমা আছে আবার কাপড়ের ব্যাবসা আছে, বেশ বড়োলোক। পাড়ায় বেশ নাম ডাক, সেই সাথে খুব কুটিল প্রকৃতির লোক। তাবে চিন্তা করিস না তোরা, অগ্নিকে পেলে কুপিয়ে মারব। আমার বোনের বান্ধবী মানে আমার বোন।”
রুদ্র দুটো ছেলেকে বলল যে সঙ্গীতাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে, ওদের সাথে সঙ্গীতাকে গিয়ে কাজ নেই। সঙ্গীতা অনিচ্ছা সত্বেও ওর মামাবাড়ি চলে যায়। রুদ্র তারপরে বলে, “ঋতুপর্ণার দরকার আছে। এক কাজ করা যাক, আমরা হাঁটতে থাকি ততক্ষণে ওর মুখে সব কথা শোনা যাক।”
গাড়ি বড় রাস্তায় দাড়ি করিয়ে সবাই দল বেঁধে মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। চারপাশে খালি মাঠ, মাঝ খান দিয়ে ভুতের মতন এগিয়ে চলে একদল ছেলে। শ্বাসের আওয়াজ আর পায়ের আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, কোথাও দুরে ঝিঁঝিঁ পোকা একটানে সুর করে গান গেয়ে চলেছে।
শ্যাম তার কথা বলতে শুরু করে, “দুই তিন দিন ধরে দেখি সেই কুঁড়ে বাড়িটায় দুটো ছেলের আনাগোনা। তারমধ্যে একজন সমীর বাবুর ছেলে। গরম কালে ওইখানে মানুষ জন থাকে, কিন্তু এইসময়ে ওইখানে ছেলেদের দেখে আমার সন্দেহ হল। আমি তক্কে তক্কে থাকলাম, কি হচ্ছে জানার জন্য। আমি ওদের বাড়ির উপরে নজর রাখলাম, নিশ্চয় কিছু লুকিয়েছে, হয়ত চুরি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আজ সন্ধ্যের পরে দেখলাম যে ছেলেগুলো বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে, কিন্তু ভেতরে হ্যারিকেন জ্বালান। আমি চালের টালি সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যা দেখি, তাতে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একটা ঘরে যেখানে খড় বিচুলি, লাঙ্গল ইত্যাদি থাকে সেই ঘরে একটা মেয়ে বাঁধা। মেয়েটার গায়ে কাপড় নেই বললেই চলে, শুধু মাত্র একটা ছেঁড়া নোংরা কামিজ। আমি মেয়েটার মুখের উপরে ঝুঁকে নাকের কাছে হাত নিয়ে দিয়ে দেখলাম যে শ্বাস চলছে, কিন্তু খুব ধিরে। আমি কি করব কিছু ভেবে পেলাম না। এসেছিলাম চুরি করতে কিন্তু মেয়েটাকে দেখে বড় কষ্ট হল। মেয়েটা কোন রকমে চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখের করুন ভাষা দেখে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কে ওকে বেঁধে রেখেছে, ওর বাড়ি কোথায়? মেয়েটার কথা বলার মতন শক্তি ছিল না। আমি আমার জামা দিয়ে মেয়েটাকে ঢেকে দিলাম। আমি চোর হতে পারি বাবু, কিন্তু কোন মেয়ের গায়ে আজ পর্যন্ত হাত তুলিনি। মেয়েটা আমাকে কোনমতে ইশারায় ফোনের কথা জিজ্ঞেস করে। আমি আমার ফোন বের করে দিলাম। সেই ফোন হাতে ধরার মতন শক্তি ছিল না মেয়েটার হাতে। আমি এক একটা করে বোতামে আঙুল দিয়ে দেখালাম, আর সেই মতন আমাকে ইশারায় আপনার নম্বর জানাল। আমি যেরকম ভাবে ঢুকেছিলাম তেমনি বেড়িয়ে এলাম। আমি বের হবার কিছু পরে দেখলাম যে ওই দুজন ছেলে বাড়িতে আবার ঢুকেছে, ওদের হাতে খবরের কাগজে মোড়া মদের বতল। আমি বুঝতে পারলাম যে মদ খেয়ে এই মেয়েটার সর্বনাশ করবে ওরা। আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করলাম।”
দেবায়ন অঙ্কনের দিকে তাকায়। অঙ্কনের দুই চোখে আগুন ঝরছে, দাঁতে দাঁত পিষে চিবিয়ে বলে, “আমি তোমাকে বলেছিলাম বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ধরতে। যদি মিষ্টির কিছু হয় তাহলে আমি তোমাকে, মাকে আর বাবাকে কোনদিন ক্ষমা করব না।”
রূপক অঙ্কনকে বুঝিয়ে বলে, “দ্যাখ ভাই, আমাদের হাতে কিছু ছিল না। আমরা জানতাম না যে পায়েল কোথায়। প্রমান ছাড়া ওদের গায়ে হাত দিলে পুলিস কেস হয়ে যেত।”
অঙ্কন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “দিদির কিছু হলে দেবায়নদা চুপ করে থাকত? তখন প্রমানের অপেক্ষা করত না নিশ্চয়।”
অঙ্কনের কথা শুনে দেবায়ন মাথা নিচু করে নেয়।
ঋতুপর্ণা অঙ্কনকে আসস্থ করে বলে, “ভাইটি, চুপ কর এখন। পায়েলের কিছু হবে না।”
সবাই আবার চুপচাপ হাঁটতে শুরু করে। বেশ কিছুদুর যাবার পরে, দুরে একটা বাগানের দিকে দেখিয়ে দেয় শ্যাম। বলে ওর মাঝে একটা বেড়ার ঘর আছে তার মধ্যে পায়েলকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পা টিপে টিপে সবাই এগোতে শুরু করে দেয় বাড়ি টার দিকে। সব থেকে আগে দেবায়ন আর রুদ্র, দুইজনের হাতে বাঁশের লাঠি। ঠিক পেছনে ধিমান আর রূপক। রুদ্র একটা বড় ছুরি রূপকের হাতে ধরিয়ে দেয়। বাকি ছেলেরা পেছনে। রুদ্র ইশারায় ওর সাথে আসা ছেলেগুলোকে বলে বাড়ি ঘরে ফেলতে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরের হ্যারিকেনের আলো দেখা যায়। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু চাপা শ্বাসের আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না।
শ্যাম গলা নিচু করে দেবায়নকে বলে, “বাবু, দরমার বেড়া, এক লাথিতে ভেঙ্গে যাবে দরজা।”
রুদ্র আর দেবায়ন দরজায় এক সজোরে লাথি মারতেই দরজা খুলে যায়। বিনয় আর অগ্নিহোত্রী, বেশ আরাম করে একটা তক্তায় বসে মদ গিলছিল আর গল্প করছিল, কি ভাবে পায়েলকে ভোগ করা যায়। দরজা ভাঙ্গার শব্দে চমকে ওঠে দুইজনে। ওদের হাতের কাছে একটা লাঠি ছিল, সেই টা তুলে নিল বিনয়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেবায়ন, রুদ্র আর রূপক ঝাঁপিয়ে পরে দুটি ছেলের উপরে। এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুসি মারতে শুরু করে দেয় দুইজনকে। ততক্ষণে রুদ্রের বাকি বন্ধুরা দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে বেঁধে ফেলে। শ্যাম চোর বলে যে দিদিমনি পাশের ঘরে। ধিমান পাশের ঘরের দরজা লাথি মেরে ভেঙ্গে দেয়। ভেতরের দৃশ্য দেখে ধিমান আর ঋতুপর্ণা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর, একপাশে খড় বিচুলির গাদা। ঘরের এক কোনায় এক তাল ঘুঁটে, এক পাশে বস্তায় সার, খৈল রাখা। একটা বড় মাটির জালায় খৈল ভেজান, তার দুর্গন্ধে ঘরে টেকা দায়। কোন পশুকে হয়ত এত নোংরা অবস্থায় রাখা হয় না। দেবায়ন ঘরে ঢুকে পায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখে। ওর অবস্থা দেখে চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। ফর্সা রঙ আর ফর্সা নেই, কালী হয়ে গেছে। সুন্দরী পায়েলের সেই মূর্তি কালী মাখা, দেখলে মনে হয় যেন একটা শুকনো কঙ্কালের উপরে চামড়া জড়ানো। গায়ে একটা ছেঁড়া কামিজ ছাড়া নিচে কিছুই পরে নেই।
অঙ্কন দৌড়ে গিয়ে পায়লেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁপা গলায় পায়েলকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “মিষ্টি আমি এসে গেছি।” চোখ ভিজে আসে অঙ্কনের। পায়েল কোনোরকমে চোখ খুলে একবার অঙ্কনের মুখের দিকে তাকায়, ঠোঁট জোড়া নড়ে ওঠে কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বের হয় না। পায়েল, অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে অজ্ঞান হয়ে যায়। অঙ্কন চিৎকার করে ওঠে, “মিষ্টি প্লিস সোনা, চোখ খোলো। প্লিস সোনা আমাকে ছেড়ে যেও না।”
শ্যাম অন্য ঘর থেকে একটা বোতলে জল নিয়ে ঋতুপর্ণার হাতে দেয়। ঋতুপর্ণা পায়েলের মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। পায়েলের শরীরে এতটুকু শক্তি ছিল না যে চোখ খুলে একবার সবাইকে দেখে। কোনোরকমে শেষ সম্বলের মতন অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে নিস্বার হয়ে পরে থাকে। অঙ্কন প্রাণপণে পায়েলকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ দিয়ে ভরিয়ে দেয়। ধিমান আর ঋতুপর্ণা ওর পাশে এসে বসে পড়ে।
দেবায়নের ঘুম কেটে গিয়ে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “কি হয়েছে পায়েলের?”
অনুপমা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “পায়েলের খবর পাওয়া গেছে, তুমি এখুনি আমার বাড়িতে এসো।”
দেবায়ন মায়ের দিকে তাকায়। দেবশ্রী ওর জন্য জামা প্যান্ট নিয়ে তৈরি। দেবশ্রী, দেবায়নের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “মেয়েটাকে বাঁচিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আয় আর যারা এর পেছনে আছে তাদের ছাড়িস না।”
দেবায়ন, মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি যখন একবার বলে দিয়েছ, তাহলে আর সেই শয়তানদের রক্ষে নেই।”
রাত তখন বারোটা বাজে। বাইক নিয়ে অনুপমার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে দেবায়ন। বাড়ি থেকে বেড়িয়েই রূপক আর ধিমানকে ফোনে করে অনুপমার বাড়িতে যেতে বলে, জানিয়ে দেয় যে পায়েলের খবর পাওয়া গেছে। রূপক জানায় যে শ্রেয়া ওকে জানিয়েছে, সেই মতন ও শ্রেয়াকে নিয়ে অনুপমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ধিমান জানিয়ে দেয় কিছুক্ষণের মধ্যেই ও অনুপমার বাড়িতে পৌঁছে যাবে।
বাইকের শব্দ শুনে অনুপমা দৌড়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এসে দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে। বসার ঘরে ঢুকে দেখে যে শ্রেয়া, রূপক, ধিমান, সঙ্গীতা সবাই পৌঁছে গেছে। পারমিতা অঙ্কনকে জড়িয়ে ধরে একধারে বসে। মিস্টার সেন, চুপ করে সোফার উপরে বসে আছেন। অঙ্কন চুপ করে গুম মেরে সবার দিকে তাকিয়ে। দেবায়ন জিজ্ঞেস করে অনুপমাকে, কি খবর।
অঙ্কন বলে, “এই কিছু আগে, মানে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ আমার কাছে একটা ফোন আসে। কার ফোন জানি না। সেই লোকটা আমাকে ফোনে বলল যে একটা মেয়ে ওকে আমার নাম্বার দিয়ে সাহায্য চেয়েছে। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে ওই মেয়েটা মিষ্টি ছাড়া আর কেউ নয়। আমি এখুনি যাবো সেই লোকটার সাথে দেখা করতে আর মিষ্টি কে বাঁচাতে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “তুই কোথায় যাবি? লোকটা কে, কোথা থেকে ফোন করেছে কিছু জানিস? এত রাতে হয়ত কোন শত্রুর চাল হতে পারে। কি করে বিশ্বাস করা যায় যে লোক’টা সত্যি কথা বলছে?”
অঙ্কন রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে ওঠে, “দিদির কিছু হলে তুমি কি করতে? এই রকম ভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকতে?” পারমিতা ছেলেকে শান্ত হতে বলে। অঙ্কন বলে, “আমার মন বলছে যে লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না। লোকটা নৈহাটির কাছাকাছি, মালঞ্চ নামে একটা গ্রাম থেকে ফোন করেছে। আমি যেতে চাই দেবায়নদা, মিষ্টি আমাকে ডাকছে। আমি বুকে হাত রেখে বলতে পারি যে এর পেছনে বিনয় আর অগ্নিহোত্রীর হাত আছে। লোকটা যেই হোক আমি মিষ্টিকে বাঁচাতে যাচ্ছি। আমি ওকে বলেছি যে আমি আসছি। লোকটা আমাকে বলেছে যে কল্যাণী হাইওয়ের মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করবে।”
দেবায়ন বলে, “ঠিক আছে। লোকটার ফোন নাম্বার আছে তোর কাছে?”
অঙ্কন দেবায়নকে সেই আগন্তুকের ফোন নাম্বার দেয়। রূপক ধিমানকে বলে যে এক বার ঋতুপর্ণাকে খবর দিতে, কারন লোকটা জানিয়েছে যে পায়েলের শরীর খুব খারাপ, কথা বলার মতন শক্তি নেই, ঋতুপর্ণার দরকার লাগতে পারে। ধিমান ঋতুপর্ণাকে মেস থেকে নিয়ে আসতে বেড়িয়ে পরে।
দেবায়ন আগন্তুককে ফোন করে, “আপনি কে? আপনি এত রাতে পায়েলের খবর কি করে জানলেন?”
ওপর পাশে সম্পূর্ণ গ্রাম্য কণ্ঠ স্বর ভেসে আসে, “বাবু, আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন, নাইলে মেয়েডা মারা যাবে। আপনারা আসুন তারপরে আমি সব জানাবো। বাবু আমি চোর কিন্তু কোন মেয়ের ইজ্জত চুরি করিনা। বাবু আপনারা তাড়াতাড়ি আসুন।”
লোকটার কণ্ঠ স্বর শুনে দেবায়ন বুঝতে পারে যে হয়ত লোকটা মিথ্যে কথা বলছে না।
রূপক জিজ্ঞেস করে লোকটা কি বলল, দেবায়ন সবাইকে বলে যে ওদের বের হতে হবে নৈহাটির উদ্দেশ্যে। দেবায়ন অনুপমাকে বলে যে একবার পরাশরকে ফোনে জানিয়ে দিতে যাতে ও জারিনার বাবাকে বলে রাখে। পায়েলকে কি রকম অবস্থায় পাবে জানে না, ডাক্তারের দরকার পড়তে পারে। অনুপমা সোজা জারিনাকে ফোন করে। জারিনা জানিয়ে দেয় যে ওর আব্বুকে সব জানিয়ে দেবে। জারিনা পরাশরকে ফোনে সব ঘটনা জানায়। পরাশর দেবায়নকে ফোনে জিজ্ঞেস করে যে দরকার পড়লে কাকাকে নিয়ে চলে আসবে। দেবায়ন বলে যে এখুনি কোন দরকার নেই পুলিশের, আগে পায়েলকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসুক তারপরে পুলিশে দেবে না নিজেরা বিচার করবে সেটা পরের ব্যাপার।
অনুপমার বাড়ি কিছুক্ষণের মধ্যে রণক্ষেত্রের পরিচালনা গৃহ হয়ে ওঠে। সঙ্গীতা ওর মামাতো দাদা, রুদ্রকে ফোনে সব জানিয়ে দেয়। রুদ্র জানিয়ে দেয় ওর বন্ধু বান্ধব নিয়ে কল্যাণী হাইওয়ের মোড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। ধিমান কিছুক্ষণের মধ্যে ঋতুপর্ণাকে নিয়ে উপস্থিত। ঋতুপর্ণা বেশ কয়েকটা স্যালাইন আর কিছু ইঞ্জেকশান, একটা আইস বক্সে নিয়ে এসেছে। দেবায়ন, অনুপমা আর শ্রেয়াকে বাড়িতে থাকতে বলে। দেবায়ন জানায় যে ওইখানে মারামারির মধ্যে মেয়েদের গিয়ে প্রয়োজন নেই। অনুপমা নাছোরবান্দা, পায়েলের সাথে যারা এই সব করেছে তাদের নিজে হাতে খুন করবে। পারমিতা আর শ্রেয়া কিছুতেই অনুপমাকে বুঝিয়ে উঠতে পারে না। শেষ পর্যন্ত দেবায়ন ধমক দেয় অনুপমাকে। ধমক খেয়ে থমথমে মুখে চুপচাপ বসে পরে অনুপমা। অঙ্কন যাবেই, ওকে বারন করা ঠিক হবে না বলে দেবায়ন ওকে আর বারন করে না। অনুপমাদের গাড়ি নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না, তাই ধিমান একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করেছে। রূপক বলে যে শুধু সঙ্গীতার ফোন ছাড়া বাকি সবার ফোন অনুপমার বাড়িতে রেখে যেতে।
রাত প্রায় সাড়ে বারোটার মধ্যে সবাই বেড়িয়ে পরে নৈহাটির উদ্দেশ্যে।
অনুপমা দেবায়নকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে, “তুমি পায়েলকে বাঁচিয়ে নিয়ে এস। ও হয়ত জানে না যে ওর মা মারা গেছে। আমি ওকে আমার সব দিয়ে দেব, শুধু আমার বান্ধবীকে ফিরিয়ে নিয়ে এস।” চোখ মুছে বলে, “শয়তান গুলোকে ছেরো না একদম।”
দেবায়ন পারমিতাকে বলে, “মা এক কথা বলেছে, চিন্তা করো না। পায়েলকে নিয়ে আসব আর সেই সাথে বাকিদের ওইখানে কবর দিয়ে আসব।”
একটা সুমোর মধ্যে, দেবায়ন, রুপক, ঋতুপর্ণা, সঙ্গীতা আর অঙ্কন। ধিমানের হাতে স্টিয়ারিং, ছয়জনে বেড়িয়ে পরে নৈহাটির উদ্দেশ্যে। জানে না কি ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকার কেটে, গাড়ি দ্রুত গতিতে নৈহাটির দিকে ধেয়ে চলে। সময়ের সাথে ওদের লড়াই, দেরি হলে যদি পায়েলকে বাঁচান না যায় সেই চিন্তায় দেবায়ন ঘেমে যায়, ধিমান পাগলের মতন গাড়ি চালায়। চারপাশে ঘন কালো আঁধার, রাস্তায় শুধু ট্রাক ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যারাকপুর ছাড়িয়ে যায়। ব্যারাকপুর পার হতেই সঙ্গীতার কাছে ওর দাদার ফোন আসে। সঙ্গীতা জানায় ওর দাদা, রুদ্রর সাথে সেই লোকটার দেখা হয়েছে। লোকটা সত্যি কথাই বলছে, না হলে এত রাতে কল্যাণী মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকত না। ওদের জন্য সবাই ওখানে অপেক্ষায় আছে। তীব্র গতিতে গাড়ি চালায় ওরা। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা নৈহাটির কল্যাণী রোডের মোড়ে পৌঁছে যায়।
রুদ্র, ওদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়েছিল। সাথে প্রায় আরও দশ বারোটা ছেলে, সবার হাতে কিছু না কিছু, কারুর হাতে লাঠি, কারুর হাতে বড় ছুরি, কারুর হাতে দা। সবাই তৈরি এক রক্তাক্ত যুদ্ধের জন্য। রুদ্রকে দেখে সঙ্গীতা দৌড়ে যায়। গাড়ি থেকে দুটি মেয়েকে নামতে দেখে রুদ্র একটু ঘাবড়ে যায় বিশেষ করে ওর বোনকে দেখে। রুদ্র সঙ্গীতাকে আসার কারন জিজ্ঞেস করে। সঙ্গীতা জানায় যে পায়ল কে বাঁচাতে এসেছে। রুদ্র সেই আগন্তুককে ধরে এনে দেবায়নের সামনে এনে দাঁড় করায়। দেবায়ন তাকে সব ঘটনা জিজ্ঞেস করে।
অগন্তুক বলে, “বাবু আমি ছিঁচকে এক চোর, নাম জেনে আর কি হবে তাও বলি, আমার নাম শ্যাম। পুজোর মরশুম গ্রামের মানুষের কাছে পয়সা আসে এই সময়ে। গ্রামের দিকের সবার বাড়ি ঘরদোর আমার চেনা। ওই মালঞ্চের দিকে থাকি আমি। ওইখানে সমীর বাবুর অনেক জমিজমা, আম বাগান আর ফলের বাগান আছে। বেশ বড় লোক চাষা। বাগানের মাঝে ওদের একটা বেড়ার বাড়ি আছে যেখানে গরম কালে ওদের লোকেরা বাগান পাহারা দেবার জন্য থাকে।”
দেবায়ন জিজ্ঞেস করে, “এই সমীর বাবু কে?”
রুদ্র উত্তর দেয়, “অগ্নিহোত্রীর বাবার নাম সমীর। অনেক জমিজমা আছে আবার কাপড়ের ব্যাবসা আছে, বেশ বড়োলোক। পাড়ায় বেশ নাম ডাক, সেই সাথে খুব কুটিল প্রকৃতির লোক। তাবে চিন্তা করিস না তোরা, অগ্নিকে পেলে কুপিয়ে মারব। আমার বোনের বান্ধবী মানে আমার বোন।”
রুদ্র দুটো ছেলেকে বলল যে সঙ্গীতাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে, ওদের সাথে সঙ্গীতাকে গিয়ে কাজ নেই। সঙ্গীতা অনিচ্ছা সত্বেও ওর মামাবাড়ি চলে যায়। রুদ্র তারপরে বলে, “ঋতুপর্ণার দরকার আছে। এক কাজ করা যাক, আমরা হাঁটতে থাকি ততক্ষণে ওর মুখে সব কথা শোনা যাক।”
গাড়ি বড় রাস্তায় দাড়ি করিয়ে সবাই দল বেঁধে মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। চারপাশে খালি মাঠ, মাঝ খান দিয়ে ভুতের মতন এগিয়ে চলে একদল ছেলে। শ্বাসের আওয়াজ আর পায়ের আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না। মাঝে মাঝে দূর থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যায়, কোথাও দুরে ঝিঁঝিঁ পোকা একটানে সুর করে গান গেয়ে চলেছে।
শ্যাম তার কথা বলতে শুরু করে, “দুই তিন দিন ধরে দেখি সেই কুঁড়ে বাড়িটায় দুটো ছেলের আনাগোনা। তারমধ্যে একজন সমীর বাবুর ছেলে। গরম কালে ওইখানে মানুষ জন থাকে, কিন্তু এইসময়ে ওইখানে ছেলেদের দেখে আমার সন্দেহ হল। আমি তক্কে তক্কে থাকলাম, কি হচ্ছে জানার জন্য। আমি ওদের বাড়ির উপরে নজর রাখলাম, নিশ্চয় কিছু লুকিয়েছে, হয়ত চুরি করলে অনেক টাকা পাওয়া যাবে। আজ সন্ধ্যের পরে দেখলাম যে ছেলেগুলো বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে, কিন্তু ভেতরে হ্যারিকেন জ্বালান। আমি চালের টালি সরিয়ে ভেতরে ঢুকে যা দেখি, তাতে আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। একটা ঘরে যেখানে খড় বিচুলি, লাঙ্গল ইত্যাদি থাকে সেই ঘরে একটা মেয়ে বাঁধা। মেয়েটার গায়ে কাপড় নেই বললেই চলে, শুধু মাত্র একটা ছেঁড়া নোংরা কামিজ। আমি মেয়েটার মুখের উপরে ঝুঁকে নাকের কাছে হাত নিয়ে দিয়ে দেখলাম যে শ্বাস চলছে, কিন্তু খুব ধিরে। আমি কি করব কিছু ভেবে পেলাম না। এসেছিলাম চুরি করতে কিন্তু মেয়েটাকে দেখে বড় কষ্ট হল। মেয়েটা কোন রকমে চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখের করুন ভাষা দেখে আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম কে ওকে বেঁধে রেখেছে, ওর বাড়ি কোথায়? মেয়েটার কথা বলার মতন শক্তি ছিল না। আমি আমার জামা দিয়ে মেয়েটাকে ঢেকে দিলাম। আমি চোর হতে পারি বাবু, কিন্তু কোন মেয়ের গায়ে আজ পর্যন্ত হাত তুলিনি। মেয়েটা আমাকে কোনমতে ইশারায় ফোনের কথা জিজ্ঞেস করে। আমি আমার ফোন বের করে দিলাম। সেই ফোন হাতে ধরার মতন শক্তি ছিল না মেয়েটার হাতে। আমি এক একটা করে বোতামে আঙুল দিয়ে দেখালাম, আর সেই মতন আমাকে ইশারায় আপনার নম্বর জানাল। আমি যেরকম ভাবে ঢুকেছিলাম তেমনি বেড়িয়ে এলাম। আমি বের হবার কিছু পরে দেখলাম যে ওই দুজন ছেলে বাড়িতে আবার ঢুকেছে, ওদের হাতে খবরের কাগজে মোড়া মদের বতল। আমি বুঝতে পারলাম যে মদ খেয়ে এই মেয়েটার সর্বনাশ করবে ওরা। আমি সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করলাম।”
দেবায়ন অঙ্কনের দিকে তাকায়। অঙ্কনের দুই চোখে আগুন ঝরছে, দাঁতে দাঁত পিষে চিবিয়ে বলে, “আমি তোমাকে বলেছিলাম বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে ধরতে। যদি মিষ্টির কিছু হয় তাহলে আমি তোমাকে, মাকে আর বাবাকে কোনদিন ক্ষমা করব না।”
রূপক অঙ্কনকে বুঝিয়ে বলে, “দ্যাখ ভাই, আমাদের হাতে কিছু ছিল না। আমরা জানতাম না যে পায়েল কোথায়। প্রমান ছাড়া ওদের গায়ে হাত দিলে পুলিস কেস হয়ে যেত।”
অঙ্কন চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, “দিদির কিছু হলে দেবায়নদা চুপ করে থাকত? তখন প্রমানের অপেক্ষা করত না নিশ্চয়।”
অঙ্কনের কথা শুনে দেবায়ন মাথা নিচু করে নেয়।
ঋতুপর্ণা অঙ্কনকে আসস্থ করে বলে, “ভাইটি, চুপ কর এখন। পায়েলের কিছু হবে না।”
সবাই আবার চুপচাপ হাঁটতে শুরু করে। বেশ কিছুদুর যাবার পরে, দুরে একটা বাগানের দিকে দেখিয়ে দেয় শ্যাম। বলে ওর মাঝে একটা বেড়ার ঘর আছে তার মধ্যে পায়েলকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পা টিপে টিপে সবাই এগোতে শুরু করে দেয় বাড়ি টার দিকে। সব থেকে আগে দেবায়ন আর রুদ্র, দুইজনের হাতে বাঁশের লাঠি। ঠিক পেছনে ধিমান আর রূপক। রুদ্র একটা বড় ছুরি রূপকের হাতে ধরিয়ে দেয়। বাকি ছেলেরা পেছনে। রুদ্র ইশারায় ওর সাথে আসা ছেলেগুলোকে বলে বাড়ি ঘরে ফেলতে। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরের হ্যারিকেনের আলো দেখা যায়। চারদিক নিস্তব্ধ, শুধু চাপা শ্বাসের আওয়াজ ছাড়া কিছু শোনা যায় না।
শ্যাম গলা নিচু করে দেবায়নকে বলে, “বাবু, দরমার বেড়া, এক লাথিতে ভেঙ্গে যাবে দরজা।”
রুদ্র আর দেবায়ন দরজায় এক সজোরে লাথি মারতেই দরজা খুলে যায়। বিনয় আর অগ্নিহোত্রী, বেশ আরাম করে একটা তক্তায় বসে মদ গিলছিল আর গল্প করছিল, কি ভাবে পায়েলকে ভোগ করা যায়। দরজা ভাঙ্গার শব্দে চমকে ওঠে দুইজনে। ওদের হাতের কাছে একটা লাঠি ছিল, সেই টা তুলে নিল বিনয়। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেবায়ন, রুদ্র আর রূপক ঝাঁপিয়ে পরে দুটি ছেলের উপরে। এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুসি মারতে শুরু করে দেয় দুইজনকে। ততক্ষণে রুদ্রের বাকি বন্ধুরা দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে অগ্নিহোত্রী আর বিনয়কে বেঁধে ফেলে। শ্যাম চোর বলে যে দিদিমনি পাশের ঘরে। ধিমান পাশের ঘরের দরজা লাথি মেরে ভেঙ্গে দেয়। ভেতরের দৃশ্য দেখে ধিমান আর ঋতুপর্ণা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর, একপাশে খড় বিচুলির গাদা। ঘরের এক কোনায় এক তাল ঘুঁটে, এক পাশে বস্তায় সার, খৈল রাখা। একটা বড় মাটির জালায় খৈল ভেজান, তার দুর্গন্ধে ঘরে টেকা দায়। কোন পশুকে হয়ত এত নোংরা অবস্থায় রাখা হয় না। দেবায়ন ঘরে ঢুকে পায়েলের দিকে তাকিয়ে দেখে। ওর অবস্থা দেখে চোখ ফেটে জল বেড়িয়ে আসে। ফর্সা রঙ আর ফর্সা নেই, কালী হয়ে গেছে। সুন্দরী পায়েলের সেই মূর্তি কালী মাখা, দেখলে মনে হয় যেন একটা শুকনো কঙ্কালের উপরে চামড়া জড়ানো। গায়ে একটা ছেঁড়া কামিজ ছাড়া নিচে কিছুই পরে নেই।
অঙ্কন দৌড়ে গিয়ে পায়লেকে জড়িয়ে ধরে। কাঁপা গলায় পায়েলকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “মিষ্টি আমি এসে গেছি।” চোখ ভিজে আসে অঙ্কনের। পায়েল কোনোরকমে চোখ খুলে একবার অঙ্কনের মুখের দিকে তাকায়, ঠোঁট জোড়া নড়ে ওঠে কিন্তু গলা থেকে আওয়াজ বের হয় না। পায়েল, অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে অজ্ঞান হয়ে যায়। অঙ্কন চিৎকার করে ওঠে, “মিষ্টি প্লিস সোনা, চোখ খোলো। প্লিস সোনা আমাকে ছেড়ে যেও না।”
শ্যাম অন্য ঘর থেকে একটা বোতলে জল নিয়ে ঋতুপর্ণার হাতে দেয়। ঋতুপর্ণা পায়েলের মুখে জল ছিটিয়ে দেয়। পায়েলের শরীরে এতটুকু শক্তি ছিল না যে চোখ খুলে একবার সবাইকে দেখে। কোনোরকমে শেষ সম্বলের মতন অঙ্কনের বুকে মাথা গুঁজে নিস্বার হয়ে পরে থাকে। অঙ্কন প্রাণপণে পায়েলকে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সারা শরীরের উত্তাপ দিয়ে ভরিয়ে দেয়। ধিমান আর ঋতুপর্ণা ওর পাশে এসে বসে পড়ে।