28-09-2020, 10:19 PM
নার্স পরেদিন সকালেই এসেছিল। সেদিন বিকেল থেকেই মায়ের চরিত্রের পরিবর্তন দেখতে পায় আদি। সব কিছুতেই কেমন যেন হাল্কা একটা ভাব। আদি বুঝতে পারে যে মা নিজেকে খুঁজতে চেষ্টা করছে। ধিরে ধিরে মা প্রচন্ড চুপচাপ হয়ে যায়। কয়েকদিন পরেই নার্স কে ছাড়িয়ে দেয়, বলে যে নার্সের দরকার নেই। ধিরে ধিরে ঋতুপর্ণা নিজেকে নিজের ঘরের মধ্যে বন্দি করে নেয়। সারাদিন নিজের ঘরের মধ্যেই কাটিয়ে দেয়। কোন কোনোদিন বিকেলে কমল জেঠু জেঠিমা এলে বাইরে বের হয় না হলে নিজের ঘর ছেড়ে একদম বাইরে বের হয় না।
আদি বড় ভাবনায় পরে যায়, সারাদিন একা একা থেকে ওর মা যদি হটাত কিছু করে বসে তাহলে। যদিও মাঝে মাঝে আদি কমল জেঠিমাকে ফোন করে মায়ের খোঁজ খবর নেয় তবুও ওর মা নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য বেড়জাল বুনে ফেলে। কিছুতেই সেই দুর্ভেদ্য বেড়জাল ছিঁড়ে মাকে বের করা যাচ্ছে না। এর মাঝে আদি কয়েকবার ডক্টর তৃষাকে ফোন করে মায়ের অবস্থার কথা জানায়। তৃষা জানায় আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে, পারলে মায়ের ঘরে যেন ওদের পুরানো ফটো অথবা আদির কোন স্মৃতি চিহ্ন রেখে দেয়। যদি সেই দেখে ঋতুপর্ণার কিছু মনে পরে।
এইভাবে দিন দশেক কাটার পরে একদিন বিকেলে আদি বাড়ি ফিরে দেখে দরজায় তালা মারা। আদির মাথায় বাজ ভেঙ্গে পরে। এইটাই আদি সন্দেহ করেছিল, ওর মা হয়ত কিছু একটা করে বসবে। সঙ্গে সঙ্গে আদি কমল জেঠুকে ফোন করে। কমল জেঠু জেঠিমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে, সেই সাথে সোসাইটির অনেক লোকজন ছুটে আসে। ঋতুপর্ণার এক্সিডেন্টের কথা কারুর অজানা নয়, অনেকেই এই রূপসীর আকস্মাত মানসিক আর চরিত্রের পরিবরতনে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এর মাঝে এই ঘটনা।
আদি ওদের সোসাইটির দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করে যে সে কিছু জানে কি না। দারোয়ান জানায়, আদি কলেজে বেড়িয়ে যাওয়ার কিছু পরেই ঋতুপর্ণা ম্যাডামকে বাইরে যেতে দেখেছে। কথাবার্তা বলে তেমন কিছু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি, সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হয়েছিল। আদি আর জানতে পারে যে মায়ের হাতে একটা ব্যাগ ছিল আর কিছু না। আদি মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে, ওর মা কোথায় যেতে পারে? মুম্বাই ওর বাবা সুভাষের কাছে নিশ্চয় যাবে না, কারন সেই ঠিকানা মায়ের কাছে নেই। বাকিরা ততক্ষণে গার্ড টাকে বকাবকি শুরু করে দিয়েছে। আদির পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে, মাথা ঘুরছে, গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কি করবে, কোথায় যাবে কোথায় খুঁজবে। একবার একা ছেড়ে গিয়েছিল তাতেই এই এক্সিডেন্ট আবার এক্সিডেন্ট হলে এইবারে বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। অনেকেই পুলিসে এফ আই আর লেখানর কথা বলছে।
ঠিক সেই সময়ে আদির কাছে ফোন আসে। নাম্বারটা অজানা। আদি ফোন তুলে হ্যালো বলতেই গলাটা চেনা চেনা মনে হল। দার্জিলিঙে যে হোস্টেলে আদি পড়াশুনা করত সেই কলেজের হেডমাস্টার ফোন করেছে।
ফাদার স্যামুয়েল বললেন, “হ্যালো আদিত্য কেমন আছো?”
এত দিন পরে ফাদার স্যামুয়েলের গলার আওয়াজ শুনে আদির খুশি হওয়ার কথা কিন্তু মা নিখোঁজ হয়ে যাওয়াতে মনমরা হয়ে উত্তর দিল, “এই চলে যাচ্ছে ফাদার। আপনি কেমন আছেন?”
ফাদার স্যামুয়েল জিজ্ঞেস করেন, “তোমার মায়ের কি হয়েছে?”
আদি চমকে ওঠে, “কেন ফাদার, কি হয়েছে?”
ফাদার স্যামুয়েলের গলার স্বর বড় গম্ভির শোনায়, “তোমার মা এই কিছু আগে, কলেজে এসে তোমার খবর জানতে চাইছিল। তোমার মায়ের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম কিছু একটা বড় ঘটে গেছে।”
মায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে জেনে আদি স্বস্তির শ্বাস নেয়। আদি বুঝতে পেরেছিল বেশি দিন নিজের পরিচয় আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হবে না। যে ভাবে নিজের ছেলেকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই ঘটনা একদিন না একদিন ঘটতই। আদি ধরা গলায় ফাদারকে বলে, “ফাদার, মায়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাতে মা সব কিছু ভুলে গেছে।” তারপরে আদি, মায়ের মানসিক অসুস্থতার সম্বন্ধে সব কিছু বিষদে জানায়। তার সাথে এও জানায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্ধ্যের ফ্লাইট ধরে আদি বাগডোগরা পৌঁছে যাবে। ফাদার জানিয়ে দেয়, ওর মাকে কলেজের গেস্ট হাউসে রাখা হয়েছে। আদিকে আনার জন্য এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। আদি কোন রকমে একটা ব্যাগে অল্প কিছু জিনিস পত্র নিয়ে দৌড় লাগাল এয়ারপোরটের দিকে। ভাগ্য ক্রমে সন্ধ্যের ফ্লাইটে একটা টিকিট ও পেয়ে গেল। ফ্লাইটে ওঠার আগে একবার ফাদারকে ফোন করে জেনে নিল মায়ের খবর। ফাদার জানিয়ে দেয় যে যত রাত হোক, গাড়ি ওর জন্য তৈরি থাকবে, আর ওর মাকে খুব সাবধানে ওদের গেস্ট হাউসে এক প্রকার নজর বন্দি করে রাখা হয়েছে। আদি এই ব্যাপারে ওর বাবাকে কিছুই জানাল না।
সারাখন শুধু মায়ের চিন্তায় কেটে গেল। বাগডোগরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তা ধরে এঁকে বেঁকে গাড়ি দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল কলেজের দিকে। ফাদার মনে হয় ড্রাইভারকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল আদির সম্বন্ধে, সেই জন্য ড্রাইভার বিশেষ কোন প্রশ্ন করেনি। আদির বুকের ধুকপুকানি কিছুতেই আর কমতে চায় না। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে গাড়ি কলেজের গেস্ট হাউসে পৌঁছে যায়। ফাদার স্যামুয়েল আদির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। আদি পৌঁছাতেই ফাদার ওকে ডেকে আগে নিজের অফিসে নিয়ে যান।
ফাদার জানতে চান আদির মায়ের আসলে কি হয়েছে। আদি সংক্ষেপে ঘটনার বিবরন দিয়ে বলে ওর মা সব কিছুই ভুলে গেছে। মায়ের মনের মধ্যে আদি এখন কলেজে পড়া ছোট ছেলে আর সেই জন্যেই ছেলের খোঁজে ওর মা এই কলেজে এসে হাজির হয়েছে। আদির কথা শুনে ফাদার একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন, যদিও ওর মাকে বিষদে কিছুই জানানো হয়নি তাও ওর মাকে নিরস্ত করতে সবাই হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল। ওর মা প্রথমে মানতেই চায়নি যে ছেলে আর এইখানে পড়েনা। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে শুঝিয়ে ঋতুপর্ণাকে বলা হয়েছে যে তিনি যেন গেস্ট হাউসে চলে যান, সময় মতন ছেলেকে নিয়ে আসা যাবে। ওর তাও কিছুতেই নড়তে নারাজ। তারপরে ফাদার জানিয়ে দেয় যে আদি এক কলেজের কাজে একটু বাইরে গেছে, রাতের মধ্যে ফিরে এলেই মায়ের সামনে প্রস্তুত করা হবে। এই শুনে ঋতুপর্ণা নিরস্ত হন আর শেষ পর্যন্ত গেস্ট হাউসে যান।
রাত অনেক হয়ে গেছে। পুজো এসে গেলেও আকাশে বৃষ্টির আনাগোনা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। ফ্লাইট থেকে নেমেই বুঝতে পেরেছিল যে ঝড় উঠবে। বাইরে যেমন ঝড় ঠিক তেমনি আদির বুকের ভেতরেও ঝড় চলছিল। এক দৌড়ে গেস্ট হাউসে পৌঁছে যায়। দারোয়ান রুম দেখিয়ে দিতেই দৌড়ে গিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। আকাশ ততক্ষণে ডাক ছাড়তে শুরু করে দিয়েছে। দরজায় মৃদু টোকা মেরে অস্থির ভাবে দাঁড়িয়ে দরজা খলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক মিনিট যেন এক ঘন্টার মতন মনে হয়। এতখন কেন লাগছে দরজা খুলতে? ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পরে আদি। মাকে কাছে না পেলে এক প্রকার মরেই যাবে। আবার টোকা মারে আদি। দ্বিতীয় বার দরজায় ধাক্কা মারার পরে দরজা খুলে যায়।
দরজায় পা রেখে আদি থমকে যায়। মাথার চুল এলোমেলো, চোখ জোড়া জবা ফুলের মতন লাল, মনে হয় কেঁদে কেঁদে একসা হয়ে গেছে। আঁচলটা কোন রকমে কাঁধের একপাশে ঝুলে রয়েছে। মায়ের এই ভগ্ন অবস্থা দেখে আদির কাঁদতে ইচ্ছে করে। যদি সামনে দাঁড়ান মহিলা ওর মা না হয়ে ওর প্রেমিকা অথবা বান্ধবী হত তাহলে আদি এতখনে ওর গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিত।
ধরা গলায়, দাঁতে দাঁত পিষে মায়ের জল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ব্যাথায় চাপা গর্জন করে ওঠে, “এই ভাবে কাউকে কিছু না বলে পাগলের মতন কেউ বেড়িয়ে যায় নাকি? তুমি কি সত্যি কিছু বোঝ না না বুঝতে চাও না।“ রাগের মাথায় কথা গুলো বলে ফেলার পরে আদির মনে পরে ওর মায়ের যে স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। মা কি করেই বা জানবে যে যার খোঁজে এতদুর একা একা পাগলিনীর মতন ধেয়ে এসেছে সেই মানুষ এতদিন ওর কাছেই ছিল।
আদির এই হটাত চাপা গর্জন শুনে ঋতুপর্ণা ক্ষণিকের জন্য দমে যায়। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আদির দিকে একটু রাগ আর অভিমান ভরা চাহনি নিয়ে তাকায় ঋতুপর্ণা। ঋতুপর্ণা কিছুক্ষণ আদির দিকে একভাবে চেয়ে থাকার পরে প্রশ্ন করে, “আমি ত আমার ছেলের খোঁজে এসেছি। তুমি কেন এসেছ এইখানে?”
আদি মায়ের এই কথা শুনে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর সামলাতে পারে না। প্রায় কাঁদো কাঁদ হয়ে মাকে বলে, “এই ভাবে কাউকে না জানিয়ে একা আসতে আছে নাকি? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করতাম বলত? তোমার ছেলে ভালো আছে, ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এইভাবে তুমি আমাকে না জানিয়ে বেড়িয়ে আসবে...”
আর থাকতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ঋতুপর্ণা, “আমি কি করব। কিছুতেই যে আমার আদিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে।” বলেই আদির জামার কলার ধরে বুকের কাছে চলে আসে, “বল আমার ছেলে কোথায়। তুমি জানো আর তাই তুমি দৌড়ে এইখানে এসেছ। বল না আমার ছেলে কোথায়?...”
আদি, মাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। দুই বলিষ্ঠ বাহু ঋতুপর্ণার কোমল দেহ আবদ্ধ করতেই ঋতুপর্ণা অবশ হয়ে যায়। আদির বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে। মায়ের পিঠের ওপরে হাত রেখে মাকে নিজের সাথে মিশিয়ে দেয় আদি। কালো ঘন চুলের মধ্যে মাথা গুঁজে মায়ের সব দুঃখ কষ্ট লাঘব করতে প্রানপন চেষ্টা করে। মাকে জড়িয়ে আদি ভাবতে শুরু করে কোথা থেকে কথা শুরু করবে, কি ভাবে জানাবে যার বুকে মাথা রেখে মা দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটাই মায়ের আদি। ফুঁপিয়ে কাঁদার ফলে মায়ের পিঠ ওঠা নামা করে সেই সাথে মায়ের নরম সুগোল স্তন জোড়া আদির বুকের সাথে লেপটে যায়। বুকের থেকে আঁচল সরে যায়, খালি পিঠের ওপরে আদির হাত বিচরন করে। আদির বাম হাত নেমে যায় মায়ের পিঠের নিচে অন্য হাতে মায়ের ঘাড়ের কাছে ধরে মাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুইজনের মাঝে।
বেশ কিছু পরে আদি, মায়ের মুখ আঁজলা করে ধরে নিজের দিকে তুলে ধরে। দুই কাজল কালো চোখ থেকে বন্যার জলের মতন অশ্রু এক নাগারে বয়ে চলেছে ঋতুপর্ণার। কিছুতেই সেই কান্নায় বাঁধ লাগাতে পারছে না। আদি মায়ের মুখের দিকে ঝুঁকে পরে। পান পাতার আকারের চেহারা, বড় বড় ছলছল কালো চোখ জোড়া। আদির চোখের সামনে শুধু মায়ের চোখ, মায়ের গোলাপি নরম ঠোঁট জোড়া, মৃদু গরম শ্বাস বইছে সেই অল্প খোলা ঠোঁটের ভেতর থেকে।
ছেলের বিরহে এক প্রকার পাগলিনী হয়ে গেছে কিন্তু তাও এই ছেলেটার আলিঙ্গন যেন শান্তির এক পরত ছড়িয়ে দেয় ওর ফাঁকা বুকের মধ্যে। মুখের ওপরে এই ছেলেটার তপ্ত শ্বাসের বন্যা, গালে তপ্ত হাতের পরশ, শরীর জুরিয়ে যাওয়া উষ্ণতা ঋতুপর্ণাকে শান্ত করে দেয়। ফুলে ওঠা নরম স্তন জোড়া ততক্ষণে আদির বুকের সাথে মিশে গেছে। আদির জামা উপচে ওর গায়ের উষ্ণতা মায়ের ব্লাউজ ভেদ করে নরম স্তন জোড়া ভাসিয়ে তুলেছে। বুকের থেকে আঁচল খসে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু সেইদিকে কারুর খেয়াল নেই।
বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মায়ের গালের জলের রেখা মুছাতে মুছাতে আদি বলে, “প্লিস সোনা, শান্ত হও আমি তোমাকে সব বলব।”
অচেনা অথচ বড্ড কাছের এই ছেলেটার মুখ থেকে “সোনা” শুনে অবাক হয়ে যায় ঋতুপর্ণা। হটাত করে মাকে “সোনা” বলে ফেলে আদিও বড় বিবৃত বোধ করে। ঋতুপর্ণার কান গাল হটাত করে লাল হয়ে যায় লজ্জায়, একি, এই ছেলেটার বুকের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছে। আদিও মাকে শরীর থেকে হাত সরিয়ে কাঁধে হাত রাখে। ঋতুপর্ণার কেমন কেমন মনে হলেও শরীর যেন এই পরশে অবশ হয়ে আসে।
আদি বড় ভাবনায় পরে যায়, সারাদিন একা একা থেকে ওর মা যদি হটাত কিছু করে বসে তাহলে। যদিও মাঝে মাঝে আদি কমল জেঠিমাকে ফোন করে মায়ের খোঁজ খবর নেয় তবুও ওর মা নিজের চারপাশে এক অদৃশ্য বেড়জাল বুনে ফেলে। কিছুতেই সেই দুর্ভেদ্য বেড়জাল ছিঁড়ে মাকে বের করা যাচ্ছে না। এর মাঝে আদি কয়েকবার ডক্টর তৃষাকে ফোন করে মায়ের অবস্থার কথা জানায়। তৃষা জানায় আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে, পারলে মায়ের ঘরে যেন ওদের পুরানো ফটো অথবা আদির কোন স্মৃতি চিহ্ন রেখে দেয়। যদি সেই দেখে ঋতুপর্ণার কিছু মনে পরে।
এইভাবে দিন দশেক কাটার পরে একদিন বিকেলে আদি বাড়ি ফিরে দেখে দরজায় তালা মারা। আদির মাথায় বাজ ভেঙ্গে পরে। এইটাই আদি সন্দেহ করেছিল, ওর মা হয়ত কিছু একটা করে বসবে। সঙ্গে সঙ্গে আদি কমল জেঠুকে ফোন করে। কমল জেঠু জেঠিমা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে, সেই সাথে সোসাইটির অনেক লোকজন ছুটে আসে। ঋতুপর্ণার এক্সিডেন্টের কথা কারুর অজানা নয়, অনেকেই এই রূপসীর আকস্মাত মানসিক আর চরিত্রের পরিবরতনে চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এর মাঝে এই ঘটনা।
আদি ওদের সোসাইটির দারোয়ান কে জিজ্ঞেস করে যে সে কিছু জানে কি না। দারোয়ান জানায়, আদি কলেজে বেড়িয়ে যাওয়ার কিছু পরেই ঋতুপর্ণা ম্যাডামকে বাইরে যেতে দেখেছে। কথাবার্তা বলে তেমন কিছু অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি, সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হয়েছিল। আদি আর জানতে পারে যে মায়ের হাতে একটা ব্যাগ ছিল আর কিছু না। আদি মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে, ওর মা কোথায় যেতে পারে? মুম্বাই ওর বাবা সুভাষের কাছে নিশ্চয় যাবে না, কারন সেই ঠিকানা মায়ের কাছে নেই। বাকিরা ততক্ষণে গার্ড টাকে বকাবকি শুরু করে দিয়েছে। আদির পায়ের তলায় মাটি সরে গেছে, মাথা ঘুরছে, গা হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কি করবে, কোথায় যাবে কোথায় খুঁজবে। একবার একা ছেড়ে গিয়েছিল তাতেই এই এক্সিডেন্ট আবার এক্সিডেন্ট হলে এইবারে বেঁচে থেকে আর লাভ নেই। অনেকেই পুলিসে এফ আই আর লেখানর কথা বলছে।
ঠিক সেই সময়ে আদির কাছে ফোন আসে। নাম্বারটা অজানা। আদি ফোন তুলে হ্যালো বলতেই গলাটা চেনা চেনা মনে হল। দার্জিলিঙে যে হোস্টেলে আদি পড়াশুনা করত সেই কলেজের হেডমাস্টার ফোন করেছে।
ফাদার স্যামুয়েল বললেন, “হ্যালো আদিত্য কেমন আছো?”
এত দিন পরে ফাদার স্যামুয়েলের গলার আওয়াজ শুনে আদির খুশি হওয়ার কথা কিন্তু মা নিখোঁজ হয়ে যাওয়াতে মনমরা হয়ে উত্তর দিল, “এই চলে যাচ্ছে ফাদার। আপনি কেমন আছেন?”
ফাদার স্যামুয়েল জিজ্ঞেস করেন, “তোমার মায়ের কি হয়েছে?”
আদি চমকে ওঠে, “কেন ফাদার, কি হয়েছে?”
ফাদার স্যামুয়েলের গলার স্বর বড় গম্ভির শোনায়, “তোমার মা এই কিছু আগে, কলেজে এসে তোমার খবর জানতে চাইছিল। তোমার মায়ের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারলাম কিছু একটা বড় ঘটে গেছে।”
মায়ের খোঁজ পাওয়া গেছে জেনে আদি স্বস্তির শ্বাস নেয়। আদি বুঝতে পেরেছিল বেশি দিন নিজের পরিচয় আত্মগোপন করে থাকা সম্ভব হবে না। যে ভাবে নিজের ছেলেকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল এই ঘটনা একদিন না একদিন ঘটতই। আদি ধরা গলায় ফাদারকে বলে, “ফাদার, মায়ের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল তাতে মা সব কিছু ভুলে গেছে।” তারপরে আদি, মায়ের মানসিক অসুস্থতার সম্বন্ধে সব কিছু বিষদে জানায়। তার সাথে এও জানায় যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সন্ধ্যের ফ্লাইট ধরে আদি বাগডোগরা পৌঁছে যাবে। ফাদার জানিয়ে দেয়, ওর মাকে কলেজের গেস্ট হাউসে রাখা হয়েছে। আদিকে আনার জন্য এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। আদি কোন রকমে একটা ব্যাগে অল্প কিছু জিনিস পত্র নিয়ে দৌড় লাগাল এয়ারপোরটের দিকে। ভাগ্য ক্রমে সন্ধ্যের ফ্লাইটে একটা টিকিট ও পেয়ে গেল। ফ্লাইটে ওঠার আগে একবার ফাদারকে ফোন করে জেনে নিল মায়ের খবর। ফাদার জানিয়ে দেয় যে যত রাত হোক, গাড়ি ওর জন্য তৈরি থাকবে, আর ওর মাকে খুব সাবধানে ওদের গেস্ট হাউসে এক প্রকার নজর বন্দি করে রাখা হয়েছে। আদি এই ব্যাপারে ওর বাবাকে কিছুই জানাল না।
সারাখন শুধু মায়ের চিন্তায় কেটে গেল। বাগডোগরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত হয়ে গেল। রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তা ধরে এঁকে বেঁকে গাড়ি দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল কলেজের দিকে। ফাদার মনে হয় ড্রাইভারকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিল আদির সম্বন্ধে, সেই জন্য ড্রাইভার বিশেষ কোন প্রশ্ন করেনি। আদির বুকের ধুকপুকানি কিছুতেই আর কমতে চায় না। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে গাড়ি কলেজের গেস্ট হাউসে পৌঁছে যায়। ফাদার স্যামুয়েল আদির জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। আদি পৌঁছাতেই ফাদার ওকে ডেকে আগে নিজের অফিসে নিয়ে যান।
ফাদার জানতে চান আদির মায়ের আসলে কি হয়েছে। আদি সংক্ষেপে ঘটনার বিবরন দিয়ে বলে ওর মা সব কিছুই ভুলে গেছে। মায়ের মনের মধ্যে আদি এখন কলেজে পড়া ছোট ছেলে আর সেই জন্যেই ছেলের খোঁজে ওর মা এই কলেজে এসে হাজির হয়েছে। আদির কথা শুনে ফাদার একটু চিন্তিত হয়ে পড়েন, যদিও ওর মাকে বিষদে কিছুই জানানো হয়নি তাও ওর মাকে নিরস্ত করতে সবাই হিমশিম খেয়ে গিয়েছিল। ওর মা প্রথমে মানতেই চায়নি যে ছেলে আর এইখানে পড়েনা। শেষ পর্যন্ত অনেক বুঝিয়ে শুঝিয়ে ঋতুপর্ণাকে বলা হয়েছে যে তিনি যেন গেস্ট হাউসে চলে যান, সময় মতন ছেলেকে নিয়ে আসা যাবে। ওর তাও কিছুতেই নড়তে নারাজ। তারপরে ফাদার জানিয়ে দেয় যে আদি এক কলেজের কাজে একটু বাইরে গেছে, রাতের মধ্যে ফিরে এলেই মায়ের সামনে প্রস্তুত করা হবে। এই শুনে ঋতুপর্ণা নিরস্ত হন আর শেষ পর্যন্ত গেস্ট হাউসে যান।
রাত অনেক হয়ে গেছে। পুজো এসে গেলেও আকাশে বৃষ্টির আনাগোনা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান। ফ্লাইট থেকে নেমেই বুঝতে পেরেছিল যে ঝড় উঠবে। বাইরে যেমন ঝড় ঠিক তেমনি আদির বুকের ভেতরেও ঝড় চলছিল। এক দৌড়ে গেস্ট হাউসে পৌঁছে যায়। দারোয়ান রুম দেখিয়ে দিতেই দৌড়ে গিয়ে রুমের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। আকাশ ততক্ষণে ডাক ছাড়তে শুরু করে দিয়েছে। দরজায় মৃদু টোকা মেরে অস্থির ভাবে দাঁড়িয়ে দরজা খলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক মিনিট যেন এক ঘন্টার মতন মনে হয়। এতখন কেন লাগছে দরজা খুলতে? ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পরে আদি। মাকে কাছে না পেলে এক প্রকার মরেই যাবে। আবার টোকা মারে আদি। দ্বিতীয় বার দরজায় ধাক্কা মারার পরে দরজা খুলে যায়।
দরজায় পা রেখে আদি থমকে যায়। মাথার চুল এলোমেলো, চোখ জোড়া জবা ফুলের মতন লাল, মনে হয় কেঁদে কেঁদে একসা হয়ে গেছে। আঁচলটা কোন রকমে কাঁধের একপাশে ঝুলে রয়েছে। মায়ের এই ভগ্ন অবস্থা দেখে আদির কাঁদতে ইচ্ছে করে। যদি সামনে দাঁড়ান মহিলা ওর মা না হয়ে ওর প্রেমিকা অথবা বান্ধবী হত তাহলে আদি এতখনে ওর গালে সপাটে একটা চড় কষিয়ে দিত।
ধরা গলায়, দাঁতে দাঁত পিষে মায়ের জল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ব্যাথায় চাপা গর্জন করে ওঠে, “এই ভাবে কাউকে কিছু না বলে পাগলের মতন কেউ বেড়িয়ে যায় নাকি? তুমি কি সত্যি কিছু বোঝ না না বুঝতে চাও না।“ রাগের মাথায় কথা গুলো বলে ফেলার পরে আদির মনে পরে ওর মায়ের যে স্মৃতি শক্তি লোপ পেয়ে গেছে। মা কি করেই বা জানবে যে যার খোঁজে এতদুর একা একা পাগলিনীর মতন ধেয়ে এসেছে সেই মানুষ এতদিন ওর কাছেই ছিল।
আদির এই হটাত চাপা গর্জন শুনে ঋতুপর্ণা ক্ষণিকের জন্য দমে যায়। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে আদির দিকে একটু রাগ আর অভিমান ভরা চাহনি নিয়ে তাকায় ঋতুপর্ণা। ঋতুপর্ণা কিছুক্ষণ আদির দিকে একভাবে চেয়ে থাকার পরে প্রশ্ন করে, “আমি ত আমার ছেলের খোঁজে এসেছি। তুমি কেন এসেছ এইখানে?”
আদি মায়ের এই কথা শুনে শেষ পর্যন্ত নিজেকে আর সামলাতে পারে না। প্রায় কাঁদো কাঁদ হয়ে মাকে বলে, “এই ভাবে কাউকে না জানিয়ে একা আসতে আছে নাকি? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি করতাম বলত? তোমার ছেলে ভালো আছে, ঠিক আছে, কিন্তু তাই বলে এইভাবে তুমি আমাকে না জানিয়ে বেড়িয়ে আসবে...”
আর থাকতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে ঋতুপর্ণা, “আমি কি করব। কিছুতেই যে আমার আদিকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না যে।” বলেই আদির জামার কলার ধরে বুকের কাছে চলে আসে, “বল আমার ছেলে কোথায়। তুমি জানো আর তাই তুমি দৌড়ে এইখানে এসেছ। বল না আমার ছেলে কোথায়?...”
আদি, মাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে। দুই বলিষ্ঠ বাহু ঋতুপর্ণার কোমল দেহ আবদ্ধ করতেই ঋতুপর্ণা অবশ হয়ে যায়। আদির বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠে। মায়ের পিঠের ওপরে হাত রেখে মাকে নিজের সাথে মিশিয়ে দেয় আদি। কালো ঘন চুলের মধ্যে মাথা গুঁজে মায়ের সব দুঃখ কষ্ট লাঘব করতে প্রানপন চেষ্টা করে। মাকে জড়িয়ে আদি ভাবতে শুরু করে কোথা থেকে কথা শুরু করবে, কি ভাবে জানাবে যার বুকে মাথা রেখে মা দাঁড়িয়ে সেই ছেলেটাই মায়ের আদি। ফুঁপিয়ে কাঁদার ফলে মায়ের পিঠ ওঠা নামা করে সেই সাথে মায়ের নরম সুগোল স্তন জোড়া আদির বুকের সাথে লেপটে যায়। বুকের থেকে আঁচল সরে যায়, খালি পিঠের ওপরে আদির হাত বিচরন করে। আদির বাম হাত নেমে যায় মায়ের পিঠের নিচে অন্য হাতে মায়ের ঘাড়ের কাছে ধরে মাকে আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে পাথরের মতন দাঁড়িয়ে থাকে। সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে পরে দুইজনের মাঝে।
বেশ কিছু পরে আদি, মায়ের মুখ আঁজলা করে ধরে নিজের দিকে তুলে ধরে। দুই কাজল কালো চোখ থেকে বন্যার জলের মতন অশ্রু এক নাগারে বয়ে চলেছে ঋতুপর্ণার। কিছুতেই সেই কান্নায় বাঁধ লাগাতে পারছে না। আদি মায়ের মুখের দিকে ঝুঁকে পরে। পান পাতার আকারের চেহারা, বড় বড় ছলছল কালো চোখ জোড়া। আদির চোখের সামনে শুধু মায়ের চোখ, মায়ের গোলাপি নরম ঠোঁট জোড়া, মৃদু গরম শ্বাস বইছে সেই অল্প খোলা ঠোঁটের ভেতর থেকে।
ছেলের বিরহে এক প্রকার পাগলিনী হয়ে গেছে কিন্তু তাও এই ছেলেটার আলিঙ্গন যেন শান্তির এক পরত ছড়িয়ে দেয় ওর ফাঁকা বুকের মধ্যে। মুখের ওপরে এই ছেলেটার তপ্ত শ্বাসের বন্যা, গালে তপ্ত হাতের পরশ, শরীর জুরিয়ে যাওয়া উষ্ণতা ঋতুপর্ণাকে শান্ত করে দেয়। ফুলে ওঠা নরম স্তন জোড়া ততক্ষণে আদির বুকের সাথে মিশে গেছে। আদির জামা উপচে ওর গায়ের উষ্ণতা মায়ের ব্লাউজ ভেদ করে নরম স্তন জোড়া ভাসিয়ে তুলেছে। বুকের থেকে আঁচল খসে গেছে অনেক আগেই, কিন্তু সেইদিকে কারুর খেয়াল নেই।
বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মায়ের গালের জলের রেখা মুছাতে মুছাতে আদি বলে, “প্লিস সোনা, শান্ত হও আমি তোমাকে সব বলব।”
অচেনা অথচ বড্ড কাছের এই ছেলেটার মুখ থেকে “সোনা” শুনে অবাক হয়ে যায় ঋতুপর্ণা। হটাত করে মাকে “সোনা” বলে ফেলে আদিও বড় বিবৃত বোধ করে। ঋতুপর্ণার কান গাল হটাত করে লাল হয়ে যায় লজ্জায়, একি, এই ছেলেটার বুকের মধ্যে লুকিয়ে পড়েছে। আদিও মাকে শরীর থেকে হাত সরিয়ে কাঁধে হাত রাখে। ঋতুপর্ণার কেমন কেমন মনে হলেও শরীর যেন এই পরশে অবশ হয়ে আসে।