28-09-2020, 10:17 PM
পর্ব আট
সুভাষ বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আদি চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকে। অনেক প্রশ্নের উত্তর ওর আর জানা হল না, কোনোদিন জানতে পারবে কি না সেটা সন্দেহ আছে। যে ওকে আসলে জন্ম দিয়েছিল সে কেন ওকে ছেড়ে চলে গেল? তবে ওকে ছেড়ে চলে যাওয়াতে আদির সুবিধা হয়েছে। ভালোবাসা, মায়া মমতা, ওকে বড় করা কোন কিছুতেই সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কোনদিনের জন্য কার্পণ্য করেনি। ঋতুপর্ণা এখন পর্যন্ত জানে না যে আদি ওর নিজের ছেলে নয় তাই চোখ খুলেই স্নেহারত মায়ের মতন আদিকে খুঁজেছিল কিন্তু ওর মা যে ওকে চিনতে পারছে না। আদির ফাঁকা বুক আবার টনটন করে ওঠে।
দুপুরের পরে ঋতুপর্ণার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরতেই ঋতুপর্ণার সেই এক চাহিদা, নিজের ছেলেকে দেখতে চায়। আদি প্রথমে মায়ের সামনে যেতে সাহস পায়নি। পাছে ওকে দেখে ভুল ভেবে বসে। ওর পাশে কেউ নেই, হটাত করে বড় একা নিঃসঙ্গ বলে মনে হয় নিজেকে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার তৃষা আদিকে বলেন, “তোমার মায়ের পোস্ট ট্রমাটিক রেট্রোগ্রেড এম্নেশিয়া হয়েছে।” আদি হাঁ করে ডক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডক্টর তৃষা বলেন, “তোমার মায়ের মনের মধ্যে, সময় থমকে গেছে দশ বছর আগে। তোমার মা, তোমাকে দশ বছর আগের হিসাবে খুঁজছে। তোমার চেহারা এই দশ বছরে অনেক বদলে গেছে। তুমি এখন ক্লাস সিক্সে পড়া সেই ছোট আদি নেই। তোমার মায়ের মাথায় তোমার যে ছবি আঁকা তার সাথে কিছুতেই বর্তমানের আদিকে মেলাতে পারছে না। এমত মানসিক অবস্থায় তোমার মায়ের সাথে খুব সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে। দশ বছর আগে সঠিক কি হয়েছিল যার জন্য তোমার বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়েছিল, সেটা সম্বন্ধে কি তুমি কিছু জানো?” আদি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় সেই ব্যাপারে কিছুই জানে না। ডক্টর তৃষা জানায়, “সেটা জানলে হয়ত একটু ভালো হত।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাবার সাথে কি একবার কথা বলা যাবে?” আদি, ডক্টরকে সুভাষের ফোন নাম্বার দেয়। তৃষা জানিয়ে দেয়, সুভাষের সাথে কথাবার্তা বলে তারপরে জানাবে।
আদি, তৃষাকে প্রশ্ন করে, “মা যদি আমাকে চিনতে নাই পারল, তাহলে বাড়ি নিয়ে কি করে যাবো?”
তৃষা একটু ভেবে উত্তর দেন, “নিজের বাড়ি তোমার মা চিনতে পারবেন, কিন্তু সেই বাড়িতে তুমি থাকলে তোমার মায়ের মনে সন্দেহ জাগবে। সেটা কি করে কাটানো যায় সেটাই বড় চিন্তার বিষয়।”
আদিও চিন্তায় পরে যায়। এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে মায়ের সাথে অচেনা মানুষের মতন কি করে কাটানো সম্ভব। একটা উপায় বের করতেই হবে, না মা অর সাথে থাকতে চাইবে না। কড় গুনতে গুনতে, এদিক ওদিকে তাকিয়ে সাত পাঁচ চিন্তা ভাবনা করতে করতে আদি, তৃষার চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসে। পায়ে পায়ে, চুপচাপ আই সি ইউর সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁচের দরজার পেছনে, সাদা বিছানায়, সাদা চাদরে ঢাকা নিস্তব্ধ, নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা ঋতুপর্ণার দিকে একভাবে চেয়ে থাকে। কাঁচের দরজায় নিজের প্রতিফলন দেখে ভড়কে যায়। নাওয়া খাওয়া এক প্রকার চুলোয় গেছে, উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতন দেখাচ্ছে আদিকে।
তিস্তার ফোন এলো, “ঋতুপর্ণাদি এখন কেমন আছেন?”
উত্তর দেওয়ার তেমন মানসিকতা ছিলনা তাও ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিতে হয়, “একি রকম।” ভাবে একবার, তিস্তাকে কি সবিস্তারে জানাবে। ওকে জানানো কি ঠিক হবে? হয়ত একটু সাহায্য করতে পারে তিস্তা। প্রেম ভালোবাসা হয়ত ওদের মধ্যে নেই ঠিক, কিন্তু আন্তরিকতা আছে। আদি উত্তর দেয়, “মায়ের রেট্রোগ্রেড এম্নেসিয়া হয়েছে।”
তিস্তা, “মানে?”
আদি, “অর্থাৎ, মা আমাকে চিনতে পারছে না। দশ বছর আগের আমাকে খুঁজছে, আমাকে দেখে মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে আমি বড় হয়ে গেছি।”
তিস্তা সব কিছু শুনে বার কয়েক হুম হ্যাঁ, করার পরে বলে, “ঋতুপর্ণাদি কবে ছুটি পাচ্ছে?”
আদি উত্তর দেয়, “দিন পাঁচ সাত লাগতে পারে।”
তিস্তা খানিক্ষন ভেবে বলে, “আমি তোমার বাড়িতে এসে থাকব, ঋতুপর্ণাদির দেখা শোনা করব চিন্তা কর না।”
এটা কি তিস্তার কোন মতলব আদির কাছাকাছি আসার না এর পেছনে অন্য কোন মতলব আছে? কিন্তু প্রেমিক কৌশিককে ছেড়ে ওর কাছে আসতে কেন যাবে তিস্তা? খানিক ভেবে আদি উত্তর দেয়, “ডোন্ট ওরি, আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। তোমার অত চিন্তা করতে হবে না। আর এই যে তুমি বললে আমাকে হেল্প করবে তার জন্য মেনি মেনি থাঙ্কস।”
তিস্তা মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “অত ফরমাল হতে হবে না আদি। তুমি অনেক মেচিওর আর ম্যানেজ করে নেবে সেটা জানি, তাও বলে রাখলাম। এই সময়ে ঋতুপর্ণাদির পাশে একটা মেয়ে থাকলে, মানে আশা করি তুমি বুঝতে পারছ। অনেক সময়ে হয়ত তোমার সাহায্য নিতে চাইবে না, তখন তুমি কি করবে।”
আদি অনেক কিছুই এখন চিন্তা ভাবনা করে দেখেনি। মাকে নিয়ে কি করে বাড়িতে ফিরবে। মায়ের সামনে নিজের কি পরিচয় দেবে। তবে বাবা যখন অর্থনৈতিক সাহায্যের ভরসা দিয়েছে তখন সর্বদার জন্য একটা নার্স রাখবে। তাই তিস্তার জবাবে বলে, “নার্স রেখে নেব।”
তিনদিন একভাবে কেটে যায়। এর মাঝে অবশ্য সোসাইটি থেকে কমল জেঠু আর জেঠিমা ওর জন্য খাবার দাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল। তিস্তা আর কৌশিক এসেছিল এর মাঝে দেখা করতে। ওর কলেজের বন্ধুরা, মায়ের কলেজের কলিগরা সবাই এক এক করে দেখা করতে এসেছিল। দশ বছর আগে বীথিকা দেবী তখন ইতিহাসের টিচার ছিলেন, তাই ঋতুপর্ণা শুধু মাত্র তাকেই চিনতে পারল।
ঋতুপর্ণাকে আই সি ইউ থেকে রুমে নিয়ে যাওয়া হল। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে বেশ কয়েক জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। আদি পাশে ছিল, চোখের আড়াল হয়নি কিন্তু মায়ের চোখের সামনে যেতে পারেনি, পাছে ওকে দেখে আবার কিছু গোলযোগ বেড়ে যায়। দিন যায় আর ঋতুপর্ণা যত সুস্থ হয়ে ওঠে, আদির বুকের ধুকপুকানি, আশঙ্কা আরো বেশি বেড়ে ওঠে। মাকে নিয়ে কি করে বাড়ি যাবে। এদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে একদিন পরে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে।
মনরোগি বিশেষজ্ঞ ডক্টর তৃষার সাথে শলা পরামর্শ করে আদি, কি ভাবে মাকে বুঝানো যায়। তৃষা ওকে বুঝিয়ে বলে যে আগে ওর মাকে বুঝতে দিতে হবে যে তিনি অনেক কিছু ভুলে গেছেন। আদিকে মায়ের কাছাকাছি থাকতে হবে, বুঝতে দিতে হবে যে আদি ঋতুপর্ণার কাছের মানুষ, ওকে ভালবাসে। কারন স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পরে ওর মায়ের একমাত্র সম্বল ওর ছেলে আদি। আদি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, মায়ের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত।
রাতের বেলা হস্পিটালের ওয়েটিং রুমে একটা চেয়ারে বসে একটু ঝিমুনি ভাব এসে গিয়েছিল আদির। এমন সময়ে নার্স এসে ওকে ডেকে তুলে বলে ওর মা নাকি ওকে ডাকছে। আদি ভালো ভাবে জানে, মা যাকে খুঁজছে সেই মানুষ ও নয়। তাও ধির পায়ে নার্সের পেছন পেছন রুমে এসে ঢোকে আদি। তিন বেডের, সেমি প্রাইভেট রুম, পর্দা দিয়ে ঘেরা।
ওকে কোনরকমে নিস্তেজ চোখ মেলে তাকায় ঋতুপর্ণা। নিস্তেজ হাতে কাছে আসতে ইশারা করে আদিকে। আদির বুকটা হটাত করে ছলাত করে ওঠে। একটা চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসে।
মিনমিন মিহি নিস্তেজ গলায় ঋতুপর্ণা প্রশ্ন করে, “তোমার নাম কি?”
কি উত্তর দেবে আদি, একটু ভেবে মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “আদিত্য, তোমার... মানে আপনার ছেলের নাম।”
নিস্তেজ হাসি ফুটে ওঠে ঋতুপর্ণার ফ্যাকাসে ঠোঁটে, “আচ্ছা। আমি নার্সের কাছে শুনলাম তুমি নাকি সেইদিন থেকে এইখানেই রয়েছ?”
আদি মাথা দুলিয়ে জানায়, হ্যাঁ।
ঋতুপর্ণা সামনে বসা ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। “তুমি আমার ছেলেকে খুঁজে দেবে?”
বুকের পাঁজর ভাঙলেও আদি মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ খুঁজে দেব।”
ঋতুপর্ণা উঠে বসতে চেষ্টা করে। আদি সঙ্গে সঙ্গে ঋতুপর্ণাকে ধরে পিঠের পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে দেয়। মায়ের চেহারা দিকে তাকিয়ে দেখে আদি, এই কয়দিনে শুকিয়ে গেছে, গায়ের রঙ আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আগের সেই রূপের ডালি আর নেই সব কেমন যেন ঝরা পাতা আর শুকনো ফুলের গাদা।
ঋতুপর্ণা কোনরকমে উঠে বসে প্রশ্ন করে, “আমার ফ্যামিলি থেকে কি কেউ এসেছিল?”
আদি দাঁতে দাঁত চেপে কোন রকমে চোখের জল বেঁধে রাখে। মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ মানে মিস্টার সুভাষ এসেছিলেন আপনাকে দেখতে।”
সুভাষের নাম কানে যেতেই মুখ বেদনায় পাংশু হয়ে যায় ঋতুপর্ণার। ভাসা ভাসা চোখে প্রশ্ন করে, “ও ছাড়া?”
মাথা নাড়ায় আদি, “আপনার কলেজের কলিগেরা আর আপনি যেখানে থাকেন সেই সোসাইটির কয়েকজন।”
ঋতুপর্ণার যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না ছেলেটার কথা। এক অজানা অচেনা ছেলে ওর জন্য কেন এতদিন অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কি ওর পরিচয়? ও কি ওর কেউ হয়? আদির দিকে শ্রান্ত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
আদিও বুঝতে পারে ওর মা ওর পরিচয় খুঁজছে। কি পরিচয় দেবে? আদি হাত বাড়াল মায়ের হাত হাতে নেওয়ার জন্য। নিস্তেজ নরম হাতখানি হাতের মধ্যে নিয়ে পাশে বসল। মায়ের মুখের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। বড় ইচ্ছে করে একবার আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে। এতদিন মা ওকে সব কিছু থেকে আগলে রেখেছিল এইবারে ওর পালা।
ঋতুপর্ণা অনেকক্ষন হাঁ করে চেয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে, কোথায় যেন দেখেছে ছেলেটাকে কিন্তু কিছুতেই মনে করে উঠতে পারছে না কোথায় দেখেছে। তবে ছেলেটার ছলছল চাহনির অর্থ ওর বোধগম্য হল না। ঋতুপর্ণা একটু দোনামনা করলেও ছেলেটার হাতের উষ্ণতা ওকে কেমন যেন ভরিয়ে দিল। এই ছোঁয়া যেন ওর অনেকদিনের চেনা, এই আওয়াজ ও কোথাও শুনেছে।
ম্লান হেসে আদি, ঋতুপর্ণার নির্বাক প্রশ্নের উত্তরে বলে, “আমি আপনার খুব কাছের একজন। আপনি ঠিক হয়ে গেলেই সব কিছু বুঝতে পারবেন। আগামি কাল আপনি হসপিটাল থেকে ছুটি পেয়ে যাবেন, তারপরে বাড়ি।” এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলার পরে আদি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
চুপচাপ নির্বাক দুইজনে হাতে হাত রেখে বসে থাকে।
সুভাষ বেড়িয়ে যাওয়ার পরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আদি চুপচাপ চেয়ারে বসে থাকে। অনেক প্রশ্নের উত্তর ওর আর জানা হল না, কোনোদিন জানতে পারবে কি না সেটা সন্দেহ আছে। যে ওকে আসলে জন্ম দিয়েছিল সে কেন ওকে ছেড়ে চলে গেল? তবে ওকে ছেড়ে চলে যাওয়াতে আদির সুবিধা হয়েছে। ভালোবাসা, মায়া মমতা, ওকে বড় করা কোন কিছুতেই সুভাষ আর ঋতুপর্ণা কোনদিনের জন্য কার্পণ্য করেনি। ঋতুপর্ণা এখন পর্যন্ত জানে না যে আদি ওর নিজের ছেলে নয় তাই চোখ খুলেই স্নেহারত মায়ের মতন আদিকে খুঁজেছিল কিন্তু ওর মা যে ওকে চিনতে পারছে না। আদির ফাঁকা বুক আবার টনটন করে ওঠে।
দুপুরের পরে ঋতুপর্ণার জ্ঞান ফেরে। জ্ঞান ফিরতেই ঋতুপর্ণার সেই এক চাহিদা, নিজের ছেলেকে দেখতে চায়। আদি প্রথমে মায়ের সামনে যেতে সাহস পায়নি। পাছে ওকে দেখে ভুল ভেবে বসে। ওর পাশে কেউ নেই, হটাত করে বড় একা নিঃসঙ্গ বলে মনে হয় নিজেকে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, ডাক্তার তৃষা আদিকে বলেন, “তোমার মায়ের পোস্ট ট্রমাটিক রেট্রোগ্রেড এম্নেশিয়া হয়েছে।” আদি হাঁ করে ডক্টরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ডক্টর তৃষা বলেন, “তোমার মায়ের মনের মধ্যে, সময় থমকে গেছে দশ বছর আগে। তোমার মা, তোমাকে দশ বছর আগের হিসাবে খুঁজছে। তোমার চেহারা এই দশ বছরে অনেক বদলে গেছে। তুমি এখন ক্লাস সিক্সে পড়া সেই ছোট আদি নেই। তোমার মায়ের মাথায় তোমার যে ছবি আঁকা তার সাথে কিছুতেই বর্তমানের আদিকে মেলাতে পারছে না। এমত মানসিক অবস্থায় তোমার মায়ের সাথে খুব সাবধানে কথাবার্তা বলতে হবে। দশ বছর আগে সঠিক কি হয়েছিল যার জন্য তোমার বাবা মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়েছিল, সেটা সম্বন্ধে কি তুমি কিছু জানো?” আদি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয় সেই ব্যাপারে কিছুই জানে না। ডক্টর তৃষা জানায়, “সেটা জানলে হয়ত একটু ভালো হত।” কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাবার সাথে কি একবার কথা বলা যাবে?” আদি, ডক্টরকে সুভাষের ফোন নাম্বার দেয়। তৃষা জানিয়ে দেয়, সুভাষের সাথে কথাবার্তা বলে তারপরে জানাবে।
আদি, তৃষাকে প্রশ্ন করে, “মা যদি আমাকে চিনতে নাই পারল, তাহলে বাড়ি নিয়ে কি করে যাবো?”
তৃষা একটু ভেবে উত্তর দেন, “নিজের বাড়ি তোমার মা চিনতে পারবেন, কিন্তু সেই বাড়িতে তুমি থাকলে তোমার মায়ের মনে সন্দেহ জাগবে। সেটা কি করে কাটানো যায় সেটাই বড় চিন্তার বিষয়।”
আদিও চিন্তায় পরে যায়। এক বাড়িতে এক ছাদের নিচে মায়ের সাথে অচেনা মানুষের মতন কি করে কাটানো সম্ভব। একটা উপায় বের করতেই হবে, না মা অর সাথে থাকতে চাইবে না। কড় গুনতে গুনতে, এদিক ওদিকে তাকিয়ে সাত পাঁচ চিন্তা ভাবনা করতে করতে আদি, তৃষার চেম্বার থেকে বেড়িয়ে আসে। পায়ে পায়ে, চুপচাপ আই সি ইউর সামনে এসে দাঁড়ায়। কাঁচের দরজার পেছনে, সাদা বিছানায়, সাদা চাদরে ঢাকা নিস্তব্ধ, নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা ঋতুপর্ণার দিকে একভাবে চেয়ে থাকে। কাঁচের দরজায় নিজের প্রতিফলন দেখে ভড়কে যায়। নাওয়া খাওয়া এক প্রকার চুলোয় গেছে, উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতন দেখাচ্ছে আদিকে।
তিস্তার ফোন এলো, “ঋতুপর্ণাদি এখন কেমন আছেন?”
উত্তর দেওয়ার তেমন মানসিকতা ছিলনা তাও ভদ্রতার খাতিরে উত্তর দিতে হয়, “একি রকম।” ভাবে একবার, তিস্তাকে কি সবিস্তারে জানাবে। ওকে জানানো কি ঠিক হবে? হয়ত একটু সাহায্য করতে পারে তিস্তা। প্রেম ভালোবাসা হয়ত ওদের মধ্যে নেই ঠিক, কিন্তু আন্তরিকতা আছে। আদি উত্তর দেয়, “মায়ের রেট্রোগ্রেড এম্নেসিয়া হয়েছে।”
তিস্তা, “মানে?”
আদি, “অর্থাৎ, মা আমাকে চিনতে পারছে না। দশ বছর আগের আমাকে খুঁজছে, আমাকে দেখে মা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না যে আমি বড় হয়ে গেছি।”
তিস্তা সব কিছু শুনে বার কয়েক হুম হ্যাঁ, করার পরে বলে, “ঋতুপর্ণাদি কবে ছুটি পাচ্ছে?”
আদি উত্তর দেয়, “দিন পাঁচ সাত লাগতে পারে।”
তিস্তা খানিক্ষন ভেবে বলে, “আমি তোমার বাড়িতে এসে থাকব, ঋতুপর্ণাদির দেখা শোনা করব চিন্তা কর না।”
এটা কি তিস্তার কোন মতলব আদির কাছাকাছি আসার না এর পেছনে অন্য কোন মতলব আছে? কিন্তু প্রেমিক কৌশিককে ছেড়ে ওর কাছে আসতে কেন যাবে তিস্তা? খানিক ভেবে আদি উত্তর দেয়, “ডোন্ট ওরি, আমি ম্যানেজ করে নিতে পারবো। তোমার অত চিন্তা করতে হবে না। আর এই যে তুমি বললে আমাকে হেল্প করবে তার জন্য মেনি মেনি থাঙ্কস।”
তিস্তা মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “অত ফরমাল হতে হবে না আদি। তুমি অনেক মেচিওর আর ম্যানেজ করে নেবে সেটা জানি, তাও বলে রাখলাম। এই সময়ে ঋতুপর্ণাদির পাশে একটা মেয়ে থাকলে, মানে আশা করি তুমি বুঝতে পারছ। অনেক সময়ে হয়ত তোমার সাহায্য নিতে চাইবে না, তখন তুমি কি করবে।”
আদি অনেক কিছুই এখন চিন্তা ভাবনা করে দেখেনি। মাকে নিয়ে কি করে বাড়িতে ফিরবে। মায়ের সামনে নিজের কি পরিচয় দেবে। তবে বাবা যখন অর্থনৈতিক সাহায্যের ভরসা দিয়েছে তখন সর্বদার জন্য একটা নার্স রাখবে। তাই তিস্তার জবাবে বলে, “নার্স রেখে নেব।”
তিনদিন একভাবে কেটে যায়। এর মাঝে অবশ্য সোসাইটি থেকে কমল জেঠু আর জেঠিমা ওর জন্য খাবার দাবার পাঠিয়ে দিয়েছিল। তিস্তা আর কৌশিক এসেছিল এর মাঝে দেখা করতে। ওর কলেজের বন্ধুরা, মায়ের কলেজের কলিগরা সবাই এক এক করে দেখা করতে এসেছিল। দশ বছর আগে বীথিকা দেবী তখন ইতিহাসের টিচার ছিলেন, তাই ঋতুপর্ণা শুধু মাত্র তাকেই চিনতে পারল।
ঋতুপর্ণাকে আই সি ইউ থেকে রুমে নিয়ে যাওয়া হল। মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হয়েছে, তবে বেশ কয়েক জায়গায় স্টিকিং প্লাস্টার লাগানো। আদি পাশে ছিল, চোখের আড়াল হয়নি কিন্তু মায়ের চোখের সামনে যেতে পারেনি, পাছে ওকে দেখে আবার কিছু গোলযোগ বেড়ে যায়। দিন যায় আর ঋতুপর্ণা যত সুস্থ হয়ে ওঠে, আদির বুকের ধুকপুকানি, আশঙ্কা আরো বেশি বেড়ে ওঠে। মাকে নিয়ে কি করে বাড়ি যাবে। এদিকে ডাক্তার বলে দিয়েছে একদিন পরে মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে।
মনরোগি বিশেষজ্ঞ ডক্টর তৃষার সাথে শলা পরামর্শ করে আদি, কি ভাবে মাকে বুঝানো যায়। তৃষা ওকে বুঝিয়ে বলে যে আগে ওর মাকে বুঝতে দিতে হবে যে তিনি অনেক কিছু ভুলে গেছেন। আদিকে মায়ের কাছাকাছি থাকতে হবে, বুঝতে দিতে হবে যে আদি ঋতুপর্ণার কাছের মানুষ, ওকে ভালবাসে। কারন স্বামী ছেড়ে যাওয়ার পরে ওর মায়ের একমাত্র সম্বল ওর ছেলে আদি। আদি মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, মায়ের জন্য সব কিছু করতে প্রস্তুত।
রাতের বেলা হস্পিটালের ওয়েটিং রুমে একটা চেয়ারে বসে একটু ঝিমুনি ভাব এসে গিয়েছিল আদির। এমন সময়ে নার্স এসে ওকে ডেকে তুলে বলে ওর মা নাকি ওকে ডাকছে। আদি ভালো ভাবে জানে, মা যাকে খুঁজছে সেই মানুষ ও নয়। তাও ধির পায়ে নার্সের পেছন পেছন রুমে এসে ঢোকে আদি। তিন বেডের, সেমি প্রাইভেট রুম, পর্দা দিয়ে ঘেরা।
ওকে কোনরকমে নিস্তেজ চোখ মেলে তাকায় ঋতুপর্ণা। নিস্তেজ হাতে কাছে আসতে ইশারা করে আদিকে। আদির বুকটা হটাত করে ছলাত করে ওঠে। একটা চেয়ার টেনে বিছানার পাশে বসে।
মিনমিন মিহি নিস্তেজ গলায় ঋতুপর্ণা প্রশ্ন করে, “তোমার নাম কি?”
কি উত্তর দেবে আদি, একটু ভেবে মৃদু হেসে উত্তর দেয়, “আদিত্য, তোমার... মানে আপনার ছেলের নাম।”
নিস্তেজ হাসি ফুটে ওঠে ঋতুপর্ণার ফ্যাকাসে ঠোঁটে, “আচ্ছা। আমি নার্সের কাছে শুনলাম তুমি নাকি সেইদিন থেকে এইখানেই রয়েছ?”
আদি মাথা দুলিয়ে জানায়, হ্যাঁ।
ঋতুপর্ণা সামনে বসা ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করে। “তুমি আমার ছেলেকে খুঁজে দেবে?”
বুকের পাঁজর ভাঙলেও আদি মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ খুঁজে দেব।”
ঋতুপর্ণা উঠে বসতে চেষ্টা করে। আদি সঙ্গে সঙ্গে ঋতুপর্ণাকে ধরে পিঠের পেছনে দুটো বালিশ দিয়ে দেয়। মায়ের চেহারা দিকে তাকিয়ে দেখে আদি, এই কয়দিনে শুকিয়ে গেছে, গায়ের রঙ আরো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আগের সেই রূপের ডালি আর নেই সব কেমন যেন ঝরা পাতা আর শুকনো ফুলের গাদা।
ঋতুপর্ণা কোনরকমে উঠে বসে প্রশ্ন করে, “আমার ফ্যামিলি থেকে কি কেউ এসেছিল?”
আদি দাঁতে দাঁত চেপে কোন রকমে চোখের জল বেঁধে রাখে। মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ মানে মিস্টার সুভাষ এসেছিলেন আপনাকে দেখতে।”
সুভাষের নাম কানে যেতেই মুখ বেদনায় পাংশু হয়ে যায় ঋতুপর্ণার। ভাসা ভাসা চোখে প্রশ্ন করে, “ও ছাড়া?”
মাথা নাড়ায় আদি, “আপনার কলেজের কলিগেরা আর আপনি যেখানে থাকেন সেই সোসাইটির কয়েকজন।”
ঋতুপর্ণার যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না ছেলেটার কথা। এক অজানা অচেনা ছেলে ওর জন্য কেন এতদিন অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকবে। কি ওর পরিচয়? ও কি ওর কেউ হয়? আদির দিকে শ্রান্ত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।
আদিও বুঝতে পারে ওর মা ওর পরিচয় খুঁজছে। কি পরিচয় দেবে? আদি হাত বাড়াল মায়ের হাত হাতে নেওয়ার জন্য। নিস্তেজ নরম হাতখানি হাতের মধ্যে নিয়ে পাশে বসল। মায়ের মুখের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে থাকে। বড় ইচ্ছে করে একবার আস্টেপিস্টে জড়িয়ে ধরে। এতদিন মা ওকে সব কিছু থেকে আগলে রেখেছিল এইবারে ওর পালা।
ঋতুপর্ণা অনেকক্ষন হাঁ করে চেয়ে থাকে ছেলের মুখের দিকে, কোথায় যেন দেখেছে ছেলেটাকে কিন্তু কিছুতেই মনে করে উঠতে পারছে না কোথায় দেখেছে। তবে ছেলেটার ছলছল চাহনির অর্থ ওর বোধগম্য হল না। ঋতুপর্ণা একটু দোনামনা করলেও ছেলেটার হাতের উষ্ণতা ওকে কেমন যেন ভরিয়ে দিল। এই ছোঁয়া যেন ওর অনেকদিনের চেনা, এই আওয়াজ ও কোথাও শুনেছে।
ম্লান হেসে আদি, ঋতুপর্ণার নির্বাক প্রশ্নের উত্তরে বলে, “আমি আপনার খুব কাছের একজন। আপনি ঠিক হয়ে গেলেই সব কিছু বুঝতে পারবেন। আগামি কাল আপনি হসপিটাল থেকে ছুটি পেয়ে যাবেন, তারপরে বাড়ি।” এক নিঃশ্বাসে এত কথা বলার পরে আদি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।
চুপচাপ নির্বাক দুইজনে হাতে হাত রেখে বসে থাকে।