28-09-2020, 07:44 PM
বিংশ পর্ব (#06)
সারা রাত ঘুমাতে পারেনি অনুপমা, সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়ে দেয় অথবা নিজের ঘরে পায়চারি করে। কাকভোরে দেবায়নকে ফোন করে অনুপমা জিজ্ঞেস করে ওর ভাইয়ের কথা। দেবায়ন বলে যে অঙ্কনের মুখে সব শুনেছে, দেখা হলে সব কথা জানাবে। অনুপমা বলে যে গত রাতে অনেকবার পায়েলের ফোনে ফোন করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। বেশ কয়েক বার ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছে কিন্তু প্রতিবার ওর বাবা তুলেছিল ফোন তাই কোন কথা না বলে ফোন কেটে দিয়েছে। দেবায়ন জানায় যে পায়েলের অবস্থা বড় খারাপ, এমত অবস্থায় কি করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। অনুপমা অঙ্কনের সাথে কথা বলে শান্ত হতে বলে। দিদির আস্বাস বানী শুনে অঙ্কনের ধড়ে প্রান ফিরে আসে। মিস্টার সেন আর পারমিতাকে সামলে নেবে অনুপমা। দেবায়নকে বলে যে অঙ্কনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতে। অনুপমা বলে যে, অঙ্কন যেন ভুলেও এখন পায়েলের নাম বাড়িতে না নেয়। ওর বাবা মা দুইজনে খুব রেগে আছে অঙ্কনের উপরে।
সকাল বেলা মা জিজ্ঞেস করলে, দেবায়ন জানায় যে পরে বিস্তারিত ভাবে সব ঘটনা জানাবে। দেবশ্রী মাথা চাপড়ে জিজ্ঞেস করে যে দেবায়ন কি সারা পৃথিবীর সমস্যার সমাধান করতে বেড়িয়েছে? মায়ের কথা শুনে হেসে বলে যে, অন্তত যাদের ভালোবাসে তাদের সমস্যার সমাধান করতেই পারে। দেবশ্রী আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, যেন সাবধানে থাকে।
ঢাকের বাদ্যি বাজতে শুরু করেছে। ঘন নীল আকাশে পোজা তুলোর মতন মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়, আকাশে বাতাসে আগমনীর সুরের দোলা লাগে। অঙ্কনের মনের বাতি দিন দিন নিভতে শুরু করে দেয়। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুপমা চিন্তিত হয়ে পরে। ষষ্ঠীর পুজো কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে। পারমিতা অনুপমাকে নিয়ে পুজোর মন্ডপে এসেছে। অনুপমার চোখ বারেবারে সুজাতা কাকিমাকে খোঁজে। প্রতিবছর সুজাতা কাকিমা ওদের সাথেই ষষ্ঠীর পুজো দেয়। এই কয়দিনে অনুপমা ওদের বাড়ি যেতে সাহস করেনি। সুজাতা কাকিমার দেখা না পেয়ে অনুপমা খুব চিন্তিত হয়ে পরে। দেবায়ন আর অনুপমার কথা মতন অঙ্কন নিজেকে শান্ত করে নেয়, বাড়িতে পায়েলের কথা আর ওঠায় নি সেদিনের পরে। কিন্তু রোজরাতে বাবা মা ঘুমিয়ে পড়ার পরে দিদির কাছে এসে মনের সংশয় ব্যাক্ত করত। নিরুপায় অনুপমার কাছে ভাইকে প্রবোধ দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
সব বন্ধু বান্ধবী পুজোর আনন্দে মত্ত, শুধু মাত্র অনুপমা আর দেবায়ন চিন্তায় ঘুমাতে পারে না। অঙ্কনের মুখে পায়েলের বাড়ির ব্যাপারে যা শুনেছে তাতে এই টুকু বুঝতে পেরেছে যে পায়েল আর ওর মায়ের ওপরে ওর বাবা খুব অত্যাচার শুরু করবে। পুলিসের কাছে গিয়ে কাজ দেবে না। ওর বন্ধু বান্ধবীরা কেউ এই বিষয়ে কিছুই জানে না। সপ্তমির দিনে সব বন্ধু বান্ধবীদের ঘুরতে বেড়ানোর কথা ছিল, কিন্তু অনুপমা ওদের মানা করে দেয়। শ্রেয়ার খুব সন্দেহ হয় সেই ব্যাপারে কেননা বেড়ান, পার্টি, মজা করা ইত্যাদিতে সব থেকে আগে অনুপমা আর দেবায়ন এগিয়ে আসে। ওদের হাত ধরেই বাকিরা আনন্দের শরিক হয়। শ্রেয়া চেপে ধরে অনুপমাকে। শেষ পর্যন্ত অনুপমা থাকতে না পেরে শ্রেয়াকে সব কথা খুলে বলে। সপ্তমির দিনে আর ওদের ঠাকুর দেখতে যাওয়া হল না। অনুপমার বাড়িতে গেলে ওর মা বকাবকি করতে পারে সেই কারনে সব বন্ধু বান্ধবীরা একত্রিত হয় শ্রেয়ার বাড়িতে। জারিনা চিন্তিত আর সব থেকে ছোটো আর অনুপমার একটু আদুরের, তাই অনুপমার হাত ধরে সোফার উপরে চুপচাপ বসে।
অনুপমা, “একটা খবর আমার কাছে, যেটা একটু ভয়ের। ওদের বাড়ির যে কাজের লোক, তার সাথে আমাদের বাড়ির কাজের লোকের জানাশুনা আছে। তাকে দিয়ে খবর বের করেছি আমি।”
সবাই ত্রস্ত চোখে অনুপমার দিকে তাকিয়ে। অনুপমা দেবায়নকে সেই কথা বলতে বলে।
দেবায়ন, “অনুপমা বেশ কয়েক বার গেছিল পায়েলের বাড়িতে, কিন্তু ঢুকতে পারেনি। ব্যাপারটা হচ্ছে যে, সুজাতা কাকিমার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে সেই দিনের পর থেকে। বলতে পারা যায় যে কাকিমা শয্যা শায়ি হয়ে গেছেন। এক নতুন কাজের লোক রাখা হয়েছে। সে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। পুরানো কাজের লোকের কাছ থেকে পাওয়া খবর যে পায়েল বাড়িতে নেই, পায়েলের দেখা পাওয়া যায়নি ওই দিনের পর থেকে। এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে পায়েলকে ওর পিসির বাড়ি নৈহাটি পাঠিয়ে দিয়েছে না বাড়িতে কোথাও আটক করে রেখেছে। কেননা ওই কাজের লোককে সেইদিনের পরে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।”
রূপক দাঁত কিড়মিড় করে দেবায়নকে বলে, “শালা, ওই ডাক্তারকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিলে কেমন হয়। দুই ঘা মারলে শালা সব বলে দেবে।”
পরাশর বলে, “ভুলেও কিছু করতে যাস না। পায়েলের বাবা তিনি, আইন সম্মত মেয়ের ওপরে তার অধিকার বেশি। পুলিসে এফ.আই.আর করে দিলে আমার কাকাও বাঁচাতে পারবে না। আমি কাকাকে বলে দেখি। কিছু একটা পথ বলতে পারবে নিশ্চয়।”
অনুপমা, “কিছু করে কি ওর বাড়িতে ঢোকা যাবে না? মুশকিল হচ্ছে আমাদের সব বান্ধবীদের ওর বাবা চেনে। হয়ত ওই চাকরকে বলাই আছে যে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে না দিতে।”
ঋতুপর্ণা বলে, “একটা উপায় আছে। আমাকে ওর বাবা দেখেনি কোনদিন, জানে না আমি ওর বান্ধবী। আমি কিছু একটা করে ওর বাড়িতে ঢুকতে পারি।”
ধিমান জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ভাবে যাবে? যেই তুমি বলবে যে তুমি ওর বান্ধবী অথবা তুমি সুজাতা কাকিমার সাথে দেখা করতে চাও, তখনি ওদের সন্দেহ হবে আর তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। অপমান করে বার করে দেবে।”
সঙ্গীতা, “এক কাজ করা যায়। আমি কালকে নৈহাটি চলে যাবো আর আমার মামাতো দাদাকে সব কথা খুলে বলব। বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে চেপে ধরলে কিছু একটা কথা বের হতে পারে।”
পরাশর বলে, “ধর যদি ওই খানে না থাকে আর তোর দাদা ওদের মারধোর করে তাহলে কিন্তু আবার হিতে বিপরিত হতে পারে।”
অনুপমার গলা ধরে আসে, বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে, “আমরা কি হাতে হাত দিয়ে বসে থাকব আর ওই মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে আমরা থাকতে?”
দেবায়ন, “কি করতে চাও তুমি শুনি?”
পরাশর, “কাকাকে একবার বলে দেখি, কি উপায় করা যায়। আমার যতদূর মনে হয় আমরা এফ.আই.আর পর্যন্ত করতে পারবো না। কেননা ওর বাবা মা জীবিত আর ওর বাবা মা এখন পর্যন্ত মেয়ের ব্যাপারে পুলিসের কাছে কিছু বলেনি।”
জারিনা শেষ পর্যন্ত মুখ খোলে, “আমি একটা কথা বলব?”
পরাশর হেসে ফেলে, “তুমি চুপ করে থাক, ছোটো আছো এখন। হাতি ঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল।”
সবাই পরাশরের কথা শুনে হেসে ফেলে একমাত্র অনুপমা ছাড়া। অনুপমা সবাইকে চুপ করিয়ে জারিনার কথা শুনতে বলে।
জারিনা বলে, “আমার আব্বু ডাক্তার আর পায়েলদির বাবাও ডাক্তার। আব্বাজানকে বলে ওর বাবার খবর বের করতে পারি। হয়ত আব্বুর চেনা জানা কেউ হতে পারে যে পায়েলদির বাবাকে চেনে।”
পরাশর, “তাতে লাভ? ওর বাবার কথা জেনে আমাদের কি হবে? আমরা কি পায়েলের খবর জানতে পারবো? বাইরের কেউ যদি ওর মেয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তৎক্ষণাৎ ওর বাবা সতর্ক হয়ে যাবে আর কিছুই বলবে না।”
অনুপমা, “আমার ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। একে ত বাবা মায়ের ভয়ে বাড়িতে কিছু বলতে পারছে না। আর ওইদিকে পায়েলের জন্য বেচারার রাতে ঘুম হচ্ছে না।”
শ্রেয়া হেসে বলে, “তোর ভাই প্রেম করার আর মেয়ে পেল না, শেষ পর্যন্ত কি না পায়েল? তুই ওকে আগে বলিস নি, যে পায়েলের বাড়ির কি অবস্থা।”
জারিনা শ্রেয়াকে হেসে বলে, “শ্রেয়াদি, প্রেম কি আর দিনক্ষণ, ধর্ম গোত্র নামধাম বয়স দেখে হয়? সেই যদি হত, তাহলে আমাকে আর পরাশরকে ডুবে মরে যাওয়া উচিত। সেটাই করতাম যদি না শেষ পর্যন্ত দেবশ্রী কাকিমা আমাদের দুই পরিবারের মাঝে সুরাহা করিয়ে না দিত।”
পরাশর দেবায়নকে বলে, “শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে কাকিমার শরনাপন্ন হতে হবে আমাদের। দেবী দুর্গতিনাশিনী কি উপায় করেন একবার দেখা যাক।”
অনুপমা মুখ ভার করে বলে, “মামনি সব জানে, মামনি খুব চিন্তায় আছে। এর বেশি মামনি আর কি করতে পারে? পায়েলের বাবা যেই রকমের মানুষ সেখানে মামনিকে নিয়ে যেতে বড় ভয় করে।”
রূপক সবাইকে থামিয়ে বলে, “ভাই, শেষ কথা হচ্ছে যে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”
পুজোর আনন্দ মাতামাতি কিছুই হল না শেষ পর্যন্ত। সবার কপালে চিন্তার রেখা। শ্রেয়ার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অনুপমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয় দেবায়ন। বাড়ির যাবার রাস্তায় অনুপমা বলে যে ওর মাকে একটু বুঝানোর চেষ্টা করেছে, মা একটু নরম হয়েছে। মাও খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে পায়েলের ব্যাপারে। অনেকদিন ধরে আসে ওদের বাড়িতে তাই ওর বান্ধবী হিসাবে মায়ের খুব ভালো লেগেছিল। মা ক্ষণিকের জন্য রেগে গিয়েছিল, যখন জানতে পারে যে অঙ্কন পায়েলের প্রেমে পড়েছে। দেবায়ন হেসে বলে যে ওর মিমি ভালো, বুঝালে অনেক কিছু বোঝে। অনুপমা আলতো করে চাঁটি মেরে বলে দশমীতে ওর বাড়িতে সপরিবারে নিমন্ত্রন। দেবায়ন বলে যে সেটা ওকে না জানিয়ে ওর মাকে জানালে ভালো হয়। অনুপমা বলে ওর মা মামনির সাথে কথা বলে নেবে।
দুর্গা পুজো শেষ, কালী পুজোর আরও কয়েকদিন দেরি। রাতের অন্ধকার আকাশে মাঝে মাঝে কেউ বাজি ফুটিয়ে আকাশ আলোকিত করে দেয়। অনুপমার মনে শান্তি নেই, একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মন পরে থাকে ওর প্রিয় বান্ধবীর কাছে। কোথায় আছে, কেমন আছে, কোন খবর পায়নি বিগত কুড়ি দিনে। পুজোর ছুটি শেষ, কলেজ আর দুইদিনের মধ্যে খুলে যাবে। সেই সাথে পরাশুনার চাপ বেড়ে যাবে। দশমীর পর থেকেই ওদের কম্পিউটার ক্লাস পুরদমে শুরু হয়ে যায়। প্রায় প্রতিদিন দেবায়নের সাথে দেখা হয়
প্রায় রোজ দিন একবার করে সন্ধ্যে বেলায় অনুপমা না হলে দেবায়ন একবার পায়েলের বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে যায়, এই আশায় যদি কোন খবর পায় পায়েলের। অঙ্কন রোজ সামনের মাঠে গিয়ে চেয়ে থাকে পায়েলের অন্ধকার বাড়ির দিকে, যদি কারুর দেখা পাওয়া যায় সেই আশায়। লক্ষ্মী পুজোর পরেরদিন থেকেই পায়েলদের বাড়ির দরজায় তালা। কাউকে আসতে যেতেও দেখে না। আশে পাশের বাড়ির লোক কেউ জানে না ডক্টর কমলেশ পরিবার নিয়ে কোথায় গেছে। অন্ধকার বাড়ি দেখে অনুপমা আরো চিন্তায় পরে যায়। ওইদিকে অঙ্কনের অবস্থা শোচনীয়, ওর বন্ধুরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটু ধাতস্ত করেছে। দুর্গা পুজোর সময়ে একটা দিনের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়নি অঙ্কন। শুধু নিজের রুম আর খাবার সময়ে নিচে আসা ছাড়া কিছু করেনি, কারুর সাথে কথা পর্যন্ত বলে নি। পারমিতা ছেলের মতিগতি দেখে খুব চিন্তায় পরে যায়। মিস্টার সেন আর পারমিতা, ছেলের মনের অবস্থা বুঝে ওদের সম্পর্কের কথা মেনে নেয়। কিন্তু সব থেকে বড় চিন্তা, পায়েল কোথায়?
সঙ্গীতা, পুজোর পরেই ওর মামা বাড়িতে গিয়ে ওর মামাতো দাদা, রুদ্রকে সব কিছু জানিয়েছিল। সঙ্গীতার কাছে পায়েলের ছবি ছিল কিন্তু ওর বাবা মায়ের কোন ছবি ছিল না। রুদ্র সব কিছু শুনে বলেছিল যে ও আর তার বন্ধুরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের বাড়ির উপরে কড়া নজর রাখবে। সঙ্গীতা রোজদিন ওর দাদাকে ফোনে জিজ্ঞেস করে পায়েলের খবর, কিন্তু সেখানেও পায়েলের কোন খবর পাওয়া যায়না। লক্ষ্মী পুজোর দুইদিন পরে একদিন খবর আসে যে বিনয়ের বাড়িতে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। রুদ্র খবর নিয়ে জানতে পারে যে বিনয়ের এক মামিমা মারা গেছেন। সেই শুনে সঙ্গীতা সঙ্গে সঙ্গে দেবায়ন আর অনুপমাকে ফোন করে। অনুপমা বুঝতে পারে যে পায়েলের মায়ের মৃত্যু হয়েছে, কারন পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসি দুই ভাই বোন। সেই খবর শুনে অনুপমা খুব ভেঙ্গে পরে। সঙ্গীতা খবর নিয়ে জানতে পারে যে এক রাতে, বিনয়ের মামিমা হার্ট এটাকে মারা যান।
কিছুদিন আগে সব বন্ধুরা আবার শ্রেয়ার বাড়িতে আলোচনা সভা বসায়। সঙ্গীতা সব কিছু জানায়। সেই খানে পরাশর বলে যে ওর সাথে ওর কাকার কথা হয়েছে। কাকা বলেছেন যে যতক্ষণ না ওদের বাড়ির লোক কিছু নালিশ জানায় ততক্ষণ পুলিসের হাত পা বাঁধা। আইন মত বন্ধু বান্ধবীরা কিছু করতে পারে না যতক্ষণ পায়েলের বাবা জীবিত। অনুপমা খুব ভেঙ্গে পড়েছিল পায়েলের মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে, অঙ্কনকে সেই সব খবর জানানো হয় নি। অনুপমার ভয় এবারে হয়ত কোনদিন পায়ালের মৃত্যু সংবাদ কোন খবরের কাগজে পড়বে অথবা হয়ত জানতেও পারবে না যে পায়েলের মৃত্যু হয়েছে।
অনুপমার সম্বিৎ ফিরে আসে ওর মায়ের হাতের আলতো ছোঁয়ায়, “কি রে এত রাতে কি করছিস ছাদে?”
মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে অনুপমা। পারমিতা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলে, “কি করা যেতে পারে বল? সেদিন তোর বাবার আর আমার খুব রাগ হয়েছিল অঙ্কনের ওপরে। আমি পায়েলকে অনেকদিন ধরেই চিনি, তাই ঠিক মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আজ মনে হচ্ছে, সেদিন যদি জোর করে পায়েলকে বাড়িতে নিয়ে আসতাম তাহলে হয়ত মা মেয়ে দুই জনেই বেঁচে থাকতো।”
অনুপমা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “না মা, পায়েলের কিছু হতে পারে না।”
পারমিতা বলে, “জানি না, তবে খুব ভয় হচ্ছে এখন। পায়েলের মা মারা যাবার পরে আরো ভয় করছে ওই মেয়েটার জন্য। পরাশরের কাকু কিছু করতে পারছে না?”
অনুপমা, “না মা, আমাদের হাত পা একদম বাঁধা। মা, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় মাঝে মাঝে, মনে হয় যেন পায়েল আমার বুকের উপরে চেপে বসে কেঁদে কেঁদে বলছে আমাকে বাচা অনু।”
অনুপমার করুন আর্তনাদে পারমিতা কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না, “হ্যান্ডসাম কি করছে। ওর মাথায় কিছুই কি আসছে না? এত বুদ্ধি রাখে আর পায়েলকে বাঁচানোর সময়ে ওর বুদ্ধি খালি হয়ে গেছে?”
অনুপমা, “মুশকিল ওখানেই মা। ওইদিকে পায়েলের পিসির বাড়ির উপরে সঙ্গীতার দাদা নজর রেখেছে, কিন্তু কথা হচ্ছে যে পায়েলের দেখা পায়নি। একবার পায়েলের দেখা পেলে না হয় কিছু করা যায়। পরাশরের কাকু বলেছে কোন প্রমান ছাড়া বিনয় অথবা অগ্নিহোত্রীকে পুলিসে আটক করতে পারবে না। যারাই পায়েলকে ধরে রেখেছে অথবা কিছু করেছে, তারা খুব সতর্ক ভাবে কার্যসিদ্ধি করেছে। এদিকে পায়েলদের বাড়ি বিগত দশ দিন থেকে বন্ধ, কেউ নেই বাড়িতে। পায়েলের বাবা নৈহাটি, পায়েল ওইখানে নেই, বাড়িতে নেই। সমস্যা ওইখানে যে কি হচ্ছে কিছুই ঠিক ভাবে জানা যাচ্ছে না।”
পারমিতা বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেয়েকে নিচে নিয়ে আসে। অঙ্কন নিজের ঘরে জেগে বসে, সামনে বই খোলা কিন্তু পড়তে আর ভালো লাগে না ওর। মা আর দিদিকে নিচে নামতে দেখে একবার দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে। অঙ্কন বেড়িয়ে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে, কোন খবর পাওয়া গেল পায়েলের? অনুপমা মাথা নাড়ায়, না কোন খবর পাওয়া যায়নি। শুকনো মুখে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় অঙ্কন। পারমিতার মাঝে মাঝে ভয় হয় যে অঙ্কন রাগে দুঃখে কিছু করে না বসে।
রাতের খাওয়ার পরে দেবায়ন চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি দেখে। ওর মা একবার জিজ্ঞেস করে পায়েলের কথা। দেবায়ন শুকনো মুখে জানিয়ে দেয় যে পায়েলের কোন খবর পাওয়া যায়নি। দেবশ্রী রাতের কাজ সেরে ঘুমাতে চলে যায়। টিভি দেখতে দেখতে দেবায়ন সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পরে।
কত রাত ঠিক খেয়াল নেই, মায়ের ধক্কায় ধরমর করে উঠে বসে দেবায়ন।
দেবায়ন মাকে জিজ্ঞেস করে, “কি হল?”
দেবশ্রী ওর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলে, “অনুর ফোন এই নে কথা বল।”
ওই পাশে অনুপমার কাঁপা গলা শোনা যায়, “পায়েল পায়েল…”
দেবায়নের ঘুম কেটে গিয়ে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “কি হয়েছে পায়েলের?”
অনুপমা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “পায়েলের খবর পাওয়া গেছে, তুমি এখুনি আমার বাড়িতে এসো।”
সারা রাত ঘুমাতে পারেনি অনুপমা, সারা রাত বিছানায় জেগে কাটিয়ে দেয় অথবা নিজের ঘরে পায়চারি করে। কাকভোরে দেবায়নকে ফোন করে অনুপমা জিজ্ঞেস করে ওর ভাইয়ের কথা। দেবায়ন বলে যে অঙ্কনের মুখে সব শুনেছে, দেখা হলে সব কথা জানাবে। অনুপমা বলে যে গত রাতে অনেকবার পায়েলের ফোনে ফোন করতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ওর ফোন বন্ধ। বেশ কয়েক বার ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছে কিন্তু প্রতিবার ওর বাবা তুলেছিল ফোন তাই কোন কথা না বলে ফোন কেটে দিয়েছে। দেবায়ন জানায় যে পায়েলের অবস্থা বড় খারাপ, এমত অবস্থায় কি করবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। অনুপমা অঙ্কনের সাথে কথা বলে শান্ত হতে বলে। দিদির আস্বাস বানী শুনে অঙ্কনের ধড়ে প্রান ফিরে আসে। মিস্টার সেন আর পারমিতাকে সামলে নেবে অনুপমা। দেবায়নকে বলে যে অঙ্কনকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যেতে। অনুপমা বলে যে, অঙ্কন যেন ভুলেও এখন পায়েলের নাম বাড়িতে না নেয়। ওর বাবা মা দুইজনে খুব রেগে আছে অঙ্কনের উপরে।
সকাল বেলা মা জিজ্ঞেস করলে, দেবায়ন জানায় যে পরে বিস্তারিত ভাবে সব ঘটনা জানাবে। দেবশ্রী মাথা চাপড়ে জিজ্ঞেস করে যে দেবায়ন কি সারা পৃথিবীর সমস্যার সমাধান করতে বেড়িয়েছে? মায়ের কথা শুনে হেসে বলে যে, অন্তত যাদের ভালোবাসে তাদের সমস্যার সমাধান করতেই পারে। দেবশ্রী আলতো হেসে মাথা নাড়িয়ে বলে, যেন সাবধানে থাকে।
ঢাকের বাদ্যি বাজতে শুরু করেছে। ঘন নীল আকাশে পোজা তুলোর মতন মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়, আকাশে বাতাসে আগমনীর সুরের দোলা লাগে। অঙ্কনের মনের বাতি দিন দিন নিভতে শুরু করে দেয়। ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অনুপমা চিন্তিত হয়ে পরে। ষষ্ঠীর পুজো কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে। পারমিতা অনুপমাকে নিয়ে পুজোর মন্ডপে এসেছে। অনুপমার চোখ বারেবারে সুজাতা কাকিমাকে খোঁজে। প্রতিবছর সুজাতা কাকিমা ওদের সাথেই ষষ্ঠীর পুজো দেয়। এই কয়দিনে অনুপমা ওদের বাড়ি যেতে সাহস করেনি। সুজাতা কাকিমার দেখা না পেয়ে অনুপমা খুব চিন্তিত হয়ে পরে। দেবায়ন আর অনুপমার কথা মতন অঙ্কন নিজেকে শান্ত করে নেয়, বাড়িতে পায়েলের কথা আর ওঠায় নি সেদিনের পরে। কিন্তু রোজরাতে বাবা মা ঘুমিয়ে পড়ার পরে দিদির কাছে এসে মনের সংশয় ব্যাক্ত করত। নিরুপায় অনুপমার কাছে ভাইকে প্রবোধ দেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।
সব বন্ধু বান্ধবী পুজোর আনন্দে মত্ত, শুধু মাত্র অনুপমা আর দেবায়ন চিন্তায় ঘুমাতে পারে না। অঙ্কনের মুখে পায়েলের বাড়ির ব্যাপারে যা শুনেছে তাতে এই টুকু বুঝতে পেরেছে যে পায়েল আর ওর মায়ের ওপরে ওর বাবা খুব অত্যাচার শুরু করবে। পুলিসের কাছে গিয়ে কাজ দেবে না। ওর বন্ধু বান্ধবীরা কেউ এই বিষয়ে কিছুই জানে না। সপ্তমির দিনে সব বন্ধু বান্ধবীদের ঘুরতে বেড়ানোর কথা ছিল, কিন্তু অনুপমা ওদের মানা করে দেয়। শ্রেয়ার খুব সন্দেহ হয় সেই ব্যাপারে কেননা বেড়ান, পার্টি, মজা করা ইত্যাদিতে সব থেকে আগে অনুপমা আর দেবায়ন এগিয়ে আসে। ওদের হাত ধরেই বাকিরা আনন্দের শরিক হয়। শ্রেয়া চেপে ধরে অনুপমাকে। শেষ পর্যন্ত অনুপমা থাকতে না পেরে শ্রেয়াকে সব কথা খুলে বলে। সপ্তমির দিনে আর ওদের ঠাকুর দেখতে যাওয়া হল না। অনুপমার বাড়িতে গেলে ওর মা বকাবকি করতে পারে সেই কারনে সব বন্ধু বান্ধবীরা একত্রিত হয় শ্রেয়ার বাড়িতে। জারিনা চিন্তিত আর সব থেকে ছোটো আর অনুপমার একটু আদুরের, তাই অনুপমার হাত ধরে সোফার উপরে চুপচাপ বসে।
অনুপমা, “একটা খবর আমার কাছে, যেটা একটু ভয়ের। ওদের বাড়ির যে কাজের লোক, তার সাথে আমাদের বাড়ির কাজের লোকের জানাশুনা আছে। তাকে দিয়ে খবর বের করেছি আমি।”
সবাই ত্রস্ত চোখে অনুপমার দিকে তাকিয়ে। অনুপমা দেবায়নকে সেই কথা বলতে বলে।
দেবায়ন, “অনুপমা বেশ কয়েক বার গেছিল পায়েলের বাড়িতে, কিন্তু ঢুকতে পারেনি। ব্যাপারটা হচ্ছে যে, সুজাতা কাকিমার শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়েছে সেই দিনের পর থেকে। বলতে পারা যায় যে কাকিমা শয্যা শায়ি হয়ে গেছেন। এক নতুন কাজের লোক রাখা হয়েছে। সে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেয় না। পুরানো কাজের লোকের কাছ থেকে পাওয়া খবর যে পায়েল বাড়িতে নেই, পায়েলের দেখা পাওয়া যায়নি ওই দিনের পর থেকে। এখন ঠিক বোঝা যাচ্ছে না যে পায়েলকে ওর পিসির বাড়ি নৈহাটি পাঠিয়ে দিয়েছে না বাড়িতে কোথাও আটক করে রেখেছে। কেননা ওই কাজের লোককে সেইদিনের পরে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়।”
রূপক দাঁত কিড়মিড় করে দেবায়নকে বলে, “শালা, ওই ডাক্তারকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিলে কেমন হয়। দুই ঘা মারলে শালা সব বলে দেবে।”
পরাশর বলে, “ভুলেও কিছু করতে যাস না। পায়েলের বাবা তিনি, আইন সম্মত মেয়ের ওপরে তার অধিকার বেশি। পুলিসে এফ.আই.আর করে দিলে আমার কাকাও বাঁচাতে পারবে না। আমি কাকাকে বলে দেখি। কিছু একটা পথ বলতে পারবে নিশ্চয়।”
অনুপমা, “কিছু করে কি ওর বাড়িতে ঢোকা যাবে না? মুশকিল হচ্ছে আমাদের সব বান্ধবীদের ওর বাবা চেনে। হয়ত ওই চাকরকে বলাই আছে যে কাউকে বাড়িতে ঢুকতে না দিতে।”
ঋতুপর্ণা বলে, “একটা উপায় আছে। আমাকে ওর বাবা দেখেনি কোনদিন, জানে না আমি ওর বান্ধবী। আমি কিছু একটা করে ওর বাড়িতে ঢুকতে পারি।”
ধিমান জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ভাবে যাবে? যেই তুমি বলবে যে তুমি ওর বান্ধবী অথবা তুমি সুজাতা কাকিমার সাথে দেখা করতে চাও, তখনি ওদের সন্দেহ হবে আর তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে না। অপমান করে বার করে দেবে।”
সঙ্গীতা, “এক কাজ করা যায়। আমি কালকে নৈহাটি চলে যাবো আর আমার মামাতো দাদাকে সব কথা খুলে বলব। বিনয় আর অগ্নিহোত্রীকে চেপে ধরলে কিছু একটা কথা বের হতে পারে।”
পরাশর বলে, “ধর যদি ওই খানে না থাকে আর তোর দাদা ওদের মারধোর করে তাহলে কিন্তু আবার হিতে বিপরিত হতে পারে।”
অনুপমার গলা ধরে আসে, বুক কেঁপে ওঠে ভয়ে, “আমরা কি হাতে হাত দিয়ে বসে থাকব আর ওই মেয়েটার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে আমরা থাকতে?”
দেবায়ন, “কি করতে চাও তুমি শুনি?”
পরাশর, “কাকাকে একবার বলে দেখি, কি উপায় করা যায়। আমার যতদূর মনে হয় আমরা এফ.আই.আর পর্যন্ত করতে পারবো না। কেননা ওর বাবা মা জীবিত আর ওর বাবা মা এখন পর্যন্ত মেয়ের ব্যাপারে পুলিসের কাছে কিছু বলেনি।”
জারিনা শেষ পর্যন্ত মুখ খোলে, “আমি একটা কথা বলব?”
পরাশর হেসে ফেলে, “তুমি চুপ করে থাক, ছোটো আছো এখন। হাতি ঘোড়া গেল তল মশা বলে কত জল।”
সবাই পরাশরের কথা শুনে হেসে ফেলে একমাত্র অনুপমা ছাড়া। অনুপমা সবাইকে চুপ করিয়ে জারিনার কথা শুনতে বলে।
জারিনা বলে, “আমার আব্বু ডাক্তার আর পায়েলদির বাবাও ডাক্তার। আব্বাজানকে বলে ওর বাবার খবর বের করতে পারি। হয়ত আব্বুর চেনা জানা কেউ হতে পারে যে পায়েলদির বাবাকে চেনে।”
পরাশর, “তাতে লাভ? ওর বাবার কথা জেনে আমাদের কি হবে? আমরা কি পায়েলের খবর জানতে পারবো? বাইরের কেউ যদি ওর মেয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে তৎক্ষণাৎ ওর বাবা সতর্ক হয়ে যাবে আর কিছুই বলবে না।”
অনুপমা, “আমার ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। একে ত বাবা মায়ের ভয়ে বাড়িতে কিছু বলতে পারছে না। আর ওইদিকে পায়েলের জন্য বেচারার রাতে ঘুম হচ্ছে না।”
শ্রেয়া হেসে বলে, “তোর ভাই প্রেম করার আর মেয়ে পেল না, শেষ পর্যন্ত কি না পায়েল? তুই ওকে আগে বলিস নি, যে পায়েলের বাড়ির কি অবস্থা।”
জারিনা শ্রেয়াকে হেসে বলে, “শ্রেয়াদি, প্রেম কি আর দিনক্ষণ, ধর্ম গোত্র নামধাম বয়স দেখে হয়? সেই যদি হত, তাহলে আমাকে আর পরাশরকে ডুবে মরে যাওয়া উচিত। সেটাই করতাম যদি না শেষ পর্যন্ত দেবশ্রী কাকিমা আমাদের দুই পরিবারের মাঝে সুরাহা করিয়ে না দিত।”
পরাশর দেবায়নকে বলে, “শেষ পর্যন্ত মনে হচ্ছে কাকিমার শরনাপন্ন হতে হবে আমাদের। দেবী দুর্গতিনাশিনী কি উপায় করেন একবার দেখা যাক।”
অনুপমা মুখ ভার করে বলে, “মামনি সব জানে, মামনি খুব চিন্তায় আছে। এর বেশি মামনি আর কি করতে পারে? পায়েলের বাবা যেই রকমের মানুষ সেখানে মামনিকে নিয়ে যেতে বড় ভয় করে।”
রূপক সবাইকে থামিয়ে বলে, “ভাই, শেষ কথা হচ্ছে যে আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।”
পুজোর আনন্দ মাতামাতি কিছুই হল না শেষ পর্যন্ত। সবার কপালে চিন্তার রেখা। শ্রেয়ার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অনুপমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয় দেবায়ন। বাড়ির যাবার রাস্তায় অনুপমা বলে যে ওর মাকে একটু বুঝানোর চেষ্টা করেছে, মা একটু নরম হয়েছে। মাও খুব চিন্তিত হয়ে পড়েছে পায়েলের ব্যাপারে। অনেকদিন ধরে আসে ওদের বাড়িতে তাই ওর বান্ধবী হিসাবে মায়ের খুব ভালো লেগেছিল। মা ক্ষণিকের জন্য রেগে গিয়েছিল, যখন জানতে পারে যে অঙ্কন পায়েলের প্রেমে পড়েছে। দেবায়ন হেসে বলে যে ওর মিমি ভালো, বুঝালে অনেক কিছু বোঝে। অনুপমা আলতো করে চাঁটি মেরে বলে দশমীতে ওর বাড়িতে সপরিবারে নিমন্ত্রন। দেবায়ন বলে যে সেটা ওকে না জানিয়ে ওর মাকে জানালে ভালো হয়। অনুপমা বলে ওর মা মামনির সাথে কথা বলে নেবে।
দুর্গা পুজো শেষ, কালী পুজোর আরও কয়েকদিন দেরি। রাতের অন্ধকার আকাশে মাঝে মাঝে কেউ বাজি ফুটিয়ে আকাশ আলোকিত করে দেয়। অনুপমার মনে শান্তি নেই, একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে কালো আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। মন পরে থাকে ওর প্রিয় বান্ধবীর কাছে। কোথায় আছে, কেমন আছে, কোন খবর পায়নি বিগত কুড়ি দিনে। পুজোর ছুটি শেষ, কলেজ আর দুইদিনের মধ্যে খুলে যাবে। সেই সাথে পরাশুনার চাপ বেড়ে যাবে। দশমীর পর থেকেই ওদের কম্পিউটার ক্লাস পুরদমে শুরু হয়ে যায়। প্রায় প্রতিদিন দেবায়নের সাথে দেখা হয়
প্রায় রোজ দিন একবার করে সন্ধ্যে বেলায় অনুপমা না হলে দেবায়ন একবার পায়েলের বাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে যায়, এই আশায় যদি কোন খবর পায় পায়েলের। অঙ্কন রোজ সামনের মাঠে গিয়ে চেয়ে থাকে পায়েলের অন্ধকার বাড়ির দিকে, যদি কারুর দেখা পাওয়া যায় সেই আশায়। লক্ষ্মী পুজোর পরেরদিন থেকেই পায়েলদের বাড়ির দরজায় তালা। কাউকে আসতে যেতেও দেখে না। আশে পাশের বাড়ির লোক কেউ জানে না ডক্টর কমলেশ পরিবার নিয়ে কোথায় গেছে। অন্ধকার বাড়ি দেখে অনুপমা আরো চিন্তায় পরে যায়। ওইদিকে অঙ্কনের অবস্থা শোচনীয়, ওর বন্ধুরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে একটু ধাতস্ত করেছে। দুর্গা পুজোর সময়ে একটা দিনের জন্য বাড়ি থেকে বের হয়নি অঙ্কন। শুধু নিজের রুম আর খাবার সময়ে নিচে আসা ছাড়া কিছু করেনি, কারুর সাথে কথা পর্যন্ত বলে নি। পারমিতা ছেলের মতিগতি দেখে খুব চিন্তায় পরে যায়। মিস্টার সেন আর পারমিতা, ছেলের মনের অবস্থা বুঝে ওদের সম্পর্কের কথা মেনে নেয়। কিন্তু সব থেকে বড় চিন্তা, পায়েল কোথায়?
সঙ্গীতা, পুজোর পরেই ওর মামা বাড়িতে গিয়ে ওর মামাতো দাদা, রুদ্রকে সব কিছু জানিয়েছিল। সঙ্গীতার কাছে পায়েলের ছবি ছিল কিন্তু ওর বাবা মায়ের কোন ছবি ছিল না। রুদ্র সব কিছু শুনে বলেছিল যে ও আর তার বন্ধুরা অগ্নিহোত্রী আর বিনয়ের বাড়ির উপরে কড়া নজর রাখবে। সঙ্গীতা রোজদিন ওর দাদাকে ফোনে জিজ্ঞেস করে পায়েলের খবর, কিন্তু সেখানেও পায়েলের কোন খবর পাওয়া যায়না। লক্ষ্মী পুজোর দুইদিন পরে একদিন খবর আসে যে বিনয়ের বাড়িতে এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে। রুদ্র খবর নিয়ে জানতে পারে যে বিনয়ের এক মামিমা মারা গেছেন। সেই শুনে সঙ্গীতা সঙ্গে সঙ্গে দেবায়ন আর অনুপমাকে ফোন করে। অনুপমা বুঝতে পারে যে পায়েলের মায়ের মৃত্যু হয়েছে, কারন পায়েলের বাবা আর পায়েলের পিসি দুই ভাই বোন। সেই খবর শুনে অনুপমা খুব ভেঙ্গে পরে। সঙ্গীতা খবর নিয়ে জানতে পারে যে এক রাতে, বিনয়ের মামিমা হার্ট এটাকে মারা যান।
কিছুদিন আগে সব বন্ধুরা আবার শ্রেয়ার বাড়িতে আলোচনা সভা বসায়। সঙ্গীতা সব কিছু জানায়। সেই খানে পরাশর বলে যে ওর সাথে ওর কাকার কথা হয়েছে। কাকা বলেছেন যে যতক্ষণ না ওদের বাড়ির লোক কিছু নালিশ জানায় ততক্ষণ পুলিসের হাত পা বাঁধা। আইন মত বন্ধু বান্ধবীরা কিছু করতে পারে না যতক্ষণ পায়েলের বাবা জীবিত। অনুপমা খুব ভেঙ্গে পড়েছিল পায়েলের মায়ের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে, অঙ্কনকে সেই সব খবর জানানো হয় নি। অনুপমার ভয় এবারে হয়ত কোনদিন পায়ালের মৃত্যু সংবাদ কোন খবরের কাগজে পড়বে অথবা হয়ত জানতেও পারবে না যে পায়েলের মৃত্যু হয়েছে।
অনুপমার সম্বিৎ ফিরে আসে ওর মায়ের হাতের আলতো ছোঁয়ায়, “কি রে এত রাতে কি করছিস ছাদে?”
মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে অনুপমা। পারমিতা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করে বলে, “কি করা যেতে পারে বল? সেদিন তোর বাবার আর আমার খুব রাগ হয়েছিল অঙ্কনের ওপরে। আমি পায়েলকে অনেকদিন ধরেই চিনি, তাই ঠিক মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আজ মনে হচ্ছে, সেদিন যদি জোর করে পায়েলকে বাড়িতে নিয়ে আসতাম তাহলে হয়ত মা মেয়ে দুই জনেই বেঁচে থাকতো।”
অনুপমা কাঁদতে কাঁদতে বলে, “না মা, পায়েলের কিছু হতে পারে না।”
পারমিতা বলে, “জানি না, তবে খুব ভয় হচ্ছে এখন। পায়েলের মা মারা যাবার পরে আরো ভয় করছে ওই মেয়েটার জন্য। পরাশরের কাকু কিছু করতে পারছে না?”
অনুপমা, “না মা, আমাদের হাত পা একদম বাঁধা। মা, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় মাঝে মাঝে, মনে হয় যেন পায়েল আমার বুকের উপরে চেপে বসে কেঁদে কেঁদে বলছে আমাকে বাচা অনু।”
অনুপমার করুন আর্তনাদে পারমিতা কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারে না, “হ্যান্ডসাম কি করছে। ওর মাথায় কিছুই কি আসছে না? এত বুদ্ধি রাখে আর পায়েলকে বাঁচানোর সময়ে ওর বুদ্ধি খালি হয়ে গেছে?”
অনুপমা, “মুশকিল ওখানেই মা। ওইদিকে পায়েলের পিসির বাড়ির উপরে সঙ্গীতার দাদা নজর রেখেছে, কিন্তু কথা হচ্ছে যে পায়েলের দেখা পায়নি। একবার পায়েলের দেখা পেলে না হয় কিছু করা যায়। পরাশরের কাকু বলেছে কোন প্রমান ছাড়া বিনয় অথবা অগ্নিহোত্রীকে পুলিসে আটক করতে পারবে না। যারাই পায়েলকে ধরে রেখেছে অথবা কিছু করেছে, তারা খুব সতর্ক ভাবে কার্যসিদ্ধি করেছে। এদিকে পায়েলদের বাড়ি বিগত দশ দিন থেকে বন্ধ, কেউ নেই বাড়িতে। পায়েলের বাবা নৈহাটি, পায়েল ওইখানে নেই, বাড়িতে নেই। সমস্যা ওইখানে যে কি হচ্ছে কিছুই ঠিক ভাবে জানা যাচ্ছে না।”
পারমিতা বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেয়েকে নিচে নিয়ে আসে। অঙ্কন নিজের ঘরে জেগে বসে, সামনে বই খোলা কিন্তু পড়তে আর ভালো লাগে না ওর। মা আর দিদিকে নিচে নামতে দেখে একবার দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখে। অঙ্কন বেড়িয়ে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে, কোন খবর পাওয়া গেল পায়েলের? অনুপমা মাথা নাড়ায়, না কোন খবর পাওয়া যায়নি। শুকনো মুখে নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় অঙ্কন। পারমিতার মাঝে মাঝে ভয় হয় যে অঙ্কন রাগে দুঃখে কিছু করে না বসে।
রাতের খাওয়ার পরে দেবায়ন চুপচাপ বসার ঘরে বসে টিভি দেখে। ওর মা একবার জিজ্ঞেস করে পায়েলের কথা। দেবায়ন শুকনো মুখে জানিয়ে দেয় যে পায়েলের কোন খবর পাওয়া যায়নি। দেবশ্রী রাতের কাজ সেরে ঘুমাতে চলে যায়। টিভি দেখতে দেখতে দেবায়ন সোফার উপরেই ঘুমিয়ে পরে।
কত রাত ঠিক খেয়াল নেই, মায়ের ধক্কায় ধরমর করে উঠে বসে দেবায়ন।
দেবায়ন মাকে জিজ্ঞেস করে, “কি হল?”
দেবশ্রী ওর হাতে ফোন ধরিয়ে দিয়ে বলে, “অনুর ফোন এই নে কথা বল।”
ওই পাশে অনুপমার কাঁপা গলা শোনা যায়, “পায়েল পায়েল…”
দেবায়নের ঘুম কেটে গিয়ে চাপা চেঁচিয়ে ওঠে, “কি হয়েছে পায়েলের?”
অনুপমা কাঁপতে কাঁপতে বলে, “পায়েলের খবর পাওয়া গেছে, তুমি এখুনি আমার বাড়িতে এসো।”